১৩. নতুন উপাসনা পদ্ধতি : প্রশ্ন ও সংশয়

নতুন উপাসনা পদ্ধতি : প্রশ্ন ও সংশয়

প্ৰাজ্ঞ চিন্তাবিদরা যখন বিশ্বজগৎ ও ব্যক্তির স্বভাববৈশিষ্ট্য ও সারবস্তুর সন্ধান করছিলেন, সম্প্রসারণশীল জনগোষ্ঠীর ধর্মীয় আচার ব্যবহার তখন আর কেবল যজ্ঞানুষ্ঠানের মধ্যেই সীমাবদ্ধ ছিল না। বহু লোকপ্রিয় অবৈদিক ও প্ৰাগাৰ্য উপাসনা পদ্ধতি ও পরমাত্মা সম্পর্কে ধারণা প্রচলিত আচার ব্যবহারের মধ্যে অনুপ্রবিষ্ট হচ্ছিল। এগুলির মধ্যে সর্বপ্রধান ভাবাদর্শ হ’ল তপঃ-বহু উপনিষদের মধ্যে এর প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ উল্লেখ ছড়িয়ে রয়েছে। সংহিতা ধর্মযজ্ঞবিষয়ক সামূহিক অনুষ্ঠান পরিচালনার বিদ্যা সম্পর্কে অবহিত ছিল, কিন্তু এই পর্যায়ে তপঃ আত্মোপলব্ধির বহুজন-গ্ৰাহ্য পদ্ধতিতে পরিণত হয়েছে। তাই, মুণ্ডক উপনিষদ বলেছে যে, তপস্ক্রিয়ার দ্বারা ব্ৰহ্মাকে লাভ করা যায় (১ : ১ : ৮)। যখন কীেম সমাজ এবং ঐন্দ্ৰজালিক ও অনুষ্ঠানকেন্দ্ৰিক বিশ্ববীক্ষা বিলীন হওয়ার ফলে নিরাপত্তার অভাববোধ সর্বত্র পরিব্য, গু হয়ে পড়ছিল, সম্ভবত সেই পরিবেশেই নতুন উপাসনা পদ্ধতি অর্থাৎ যোগসাধনচর্যার উদ্ভব ঘটেছিল। হয়ত বা এই ভাবাদর্শ প্ৰাগাৰ্য প্রভাবের ফল।

আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ ধর্মীয় মূল্যবোধ যোগচৰ্যার মধ্যে অভিব্যক্ত হয়েছিল; সম্ভবত সিন্ধু উপত্যকার সভ্যতার প্রাপ্ত প্রত্ন-পশুপতি মূর্তির মধ্যে তার প্রথম প্রমাণ পাওয়া গিয়েছিল। সংহিতায় এই ভাবনার সঙ্গে তুলনীয় কিছু নেই, যদিও যতিদের সঙ্গে ইন্দ্রের শক্ৰতাবিষয়ক উপাখ্যানে একটি ভিন্ন ধরনের ধর্মচৰ্যার নিদর্শন পাওয়া যায়। কিংবা ‘মুনি’ বলে পরিচিত ভিক্ষাজীবী ও মৌন ব্ৰতধারী সন্ন্যাসী সম্প্রদায়ের মধ্যে আদিম মানুষের বিচিত্র ধর্মচৰ্যার ইঙ্গিত রয়েছে। ছান্দোগ্য ঐ পনিষদে যোগসাধনার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট কঠোর বিধিসমূহের উল্লেখ রয়েছে, যেখানে ব্ৰহ্মচর্যাকে উপবাস পালনের সঙ্গে একীভূত করে দেখানো হয়েছে। সম্ভবত, এতে অবৈদিক ভাবাদর্শ দ্বারা বৈদিক ধর্মচিন্তা প্রভাবিত হওয়ার নিদর্শন পাওয়া যাচ্ছে। এছাড়া, মুণ্ডক ও শ্বেতাশ্বেতর উপনিষদে যোগসাধনার নানাবিধ অনুপুঙ্খ উল্লিখিত হয়েছে।

যোগ ছাড়াও ভক্তির প্রাথমিক পর্যায়ের নিদর্শন আমরা শ্বেতাশ্বেতর উপনিষদে লক্ষ্য করি, যেখানে মহেশ্বরের প্রশস্তির মধ্যে পরবর্তী পৌরাণিক যুগের সম্প্রদায়কেন্দ্রিক দৃষ্টিভঙ্গির পূর্বাভাস পাওয়া যায়; মুণ্ডক উপনিষদে গুরুবাদ, কর্মবাদ ও যজ্ঞধর্মের তাৎপৰ্যহীনতা আভাসিত হয়েছে। অর্বাচীনতর শ্বেতাশ্বেতর উপনিষদে এই ধারণাগুলি যেমন আরও বিস্তার লাভ করেছে, তেমনি ব্ৰহ্মজ্ঞান-লাভ মানবজীবনের পরম লক্ষ্যরূপে সেখানে ঘোষিত হয়েছে!

প্রকৃতপক্ষে প্রায় সবগুলি উপনিষদ এমন কিছু প্রশ্নের উত্তর দিতে চেয়েছে, যা তৎকালীন জনসাধারণের চিন্তাশীল অংশকে সংশয়-প্ৰস্ত করে তুলেছিল। আমরা সেযুগে অনুষ্ঠিত বহু আধ্যাত্মিক আলোচনা চক্রের ব্রহ্মোদ্যের বিবরণ এবং বহু আরণ্য শিক্ষা নিকেতনের নিদর্শন পাই, যেখানে কিছু কিছু মৌলিক সমস্যা নিয়ে আলোচনায় সমাধানের পথ সন্ধান করা হত। এমনকি, যেখানে কোনও প্রশ্ন উত্থাপিত হয়নি, সেসব রচনাকেও কোনো মৌলিক সমস্যার প্রতি আলোকপাতের প্রয়াসরূপে গণ্য করা হত, সমাধানগুলি বিশ্লেষণ করে আমরা তার অন্তরালে প্রচ্ছন্ন প্রশ্নগুলি সম্পর্কে ধারণা করে নিতে পারি। কঠোপনিষদের বিখ্যাত নচিকেতা-উপাখ্যানে মানুষের মরণোত্তর অবস্থা সম্পর্কে যে সংশয় ব্যক্ত হয়েছে, তাতে খ্রিস্টপূর্ব সপ্তম বা ষষ্ঠ শতাব্দীর ভারতবর্ষে প্রেততত্ত্ব সংশ্লিষ্ট প্রাচীন সংশয়ই অভিব্যক্তি লাভ করেছে। সমগ্ৰ প্রশ্নোউপনিষদ প্রকৃতপক্ষে তৎকালীন জিজ্ঞাসুদের মনে ব্ৰহ্মজ্ঞান বিষয়ক প্রশ্ন ও সমাধানের সমষ্টি। এ সবের মধ্যে অরণ্যের আশ্রমগুলিতে তৎকালীন বিদ্যাচর্চার পরিবেশ প্রতিফলিত হয়েছে। এই উপনিষদ থেকে এই তথ্য স্পষ্ট যে, সেসময় প্রধান তত্ত্ব জিজ্ঞাসা জীবনের উৎস, সারাৎসার, ক্রিয়া, পরিধি ও সমাপ্তি ছাড়াও জীবনের মূলাধার আত্মাকে কেন্দ্র করে গড়ে উঠেছিল। তৈত্তিরীয় উপনিষদেও মরণোত্তর অবস্থা সম্পর্কে বেশ কিছু প্রশ্ন তুলে ধরা হয়েছে। আবার, প্রায় সমগ্ৰ ছান্দোগ্য উপনিষদে দ্বান্দ্বিক আঙ্গিকে অধ্যাত্মবিদ্যা সম্পর্কিত বিশেষ জিজ্ঞাসা ছাড়াও কিছু কিছু ব্যবহারিক ও পার্থিব প্রশ্নও উত্থাপিত হয়েছে। আধ্যাত্মিক সমস্যা সম্পর্কে সর্বাপেক্ষা মৌলিক সমাধান সম্ভবত বৃহদারণ্যক উপনিষদে পাওয়া যায়, যেখানে উপনিষদের আদর্শবাদ তার শীর্ষবিন্দুতে উপনীত হয়েছে। এই উপনিষদে যাজ্ঞবল্ক্য ও মৈত্রেয়ীর বিখ্যাত সংলাপ ছাড়াও অশ্বলের সঙ্গে যাজ্ঞবল্ক্যের কথোপকথন তৎকালনী তত্ত্ব জিজ্ঞাসার স্বরূপ আভাসিত হয়েছে। এই উপনিষদে মৃত্যু, অতিজাগতিক উপাদান ও আত্মার সঙ্গে তাদের সম্পর্ক বিস্তারিতভাবে আলোচিত হয়েছে। উদালক ও যাজ্ঞবল্ক্যের কথোপকথন এবং গাগী ও যাজ্ঞবল্ক্যের বিখ্যাত বিতর্ক তৎকালীন দার্শনিক ও আধ্যাত্মিক ভাবনার অসামান্য পরিচয় বহন করছে। মৃত্যু ও পুনর্জন্ম সম্পর্কিত তত্ত্বসমূহ গৃহীত হওয়ার পূর্বে যে পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে বিশ্লেষিত হয়েছিল তার যথেষ্ট প্রমাণ বৃহদারণ্যক উপনিষদে রয়েছে। প্রেততত্ত্ব বিষয়ক কিছু কিছু সংশয়ের সম্পূর্ণ নিরসন হয়নি। জনক ও যাজ্ঞবল্ক্য এবং প্রবহন ও শ্বেতকেতুর সংলাপে আত্মতত্ত্ববিষয়ক সূক্ষ্ম ও বিশদ চিন্তা প্রতিফলিত হয়েছে। বস্তুত বিভিন্ন উপনিষদে উত্থাপিত প্রশ্নগুলি বিশ্লেষণ করে আমরা সেইযুগের প্রধান বৌদ্ধিক প্রক্রিয়ার বিষয়বস্তু সম্পর্কে অবহিত হই; মৃত্যু, মৃত্যুর পরে মানুষের ভাগ্য, বস্তুগত বিশ্বজগৎ ও মানুষের আপনি আত্মার নিগুঢ় স্বভাব, মৃত্যুর পরে মানুষের কর্মের সঙ্গে তার ভাগ্যের সম্পর্ক এবং পুনর্জন্ম থেকে পরিত্রাণ ও চূড়ান্ত মুক্তিলাভের উপায়।