১০. দেবসঙ্ঘ (উপনিষদ)

দেবসঙ্ঘ (উপনিষদ)

ব্ৰাহ্মণসাহিত্যের দেবসঙ্ঘ উপনিষদে প্রকৃতপক্ষে একই থেকে গেছে, যদিও দেবতারা পূর্ব পরিচয়ের সারবস্তুর পরিবর্তে নিতান্ত নামটুকুর মধ্যেই পর্যবসিত। কেনোপণিষদ অগ্নি, বায়ু ও ইন্দ্রের মতো প্ৰধান বৈদিক দেবতাদের উল্লেখ করার সঙ্গে সঙ্গে উমা হৈমবতীর মতো পরবর্তীকালে আবিষ্কৃত দেবীকে আমাদের কাছে উপস্থিত করেছে। তৈত্তিরীয় উপনিষদে (১ : ১ : ১) মিত্র, বরুণ, অৰ্যমা, ইন্দ্ৰ, বৃহস্পতি, বিষ্ণু, ব্ৰহ্মা ও বায়ুর উল্লেখ পাই। ঐতরেয় উপনিষদের একটি সৃষ্টিপ্রক্রিয়া সম্পর্কিত কাহিনীতে (১ : ২ : ১-৫) এই তথ্য বিবৃত হয়েছে যে, মানুষের ক্ষুধাতৃষ্ণা নিবৃত্ত হলে তবে দেবতারাও তাদের প্রাপ্য অংশ লাভ করেন। ঐ উপনিষদের অন্যত্র [ ৩ : ১ : ৩ ] প্ৰজ্ঞানকে ব্ৰহ্মা, ইন্দ্ৰ, প্রজাপতি ও মহাভূতসমূহের সঙ্গে একাত্ম করা হয়েছে। সুতরাং এই যুগের নব্য ভাবাদর্শ-সম্ভূত নুতন মূল্যবোধ অর্থাৎ প্রজ্ঞার গৌরব বধিত করার জন্য দেবতাদের প্রাচীন মহিমা খর্ব করা হয়েছে। শ্বেতাশ্বতর উপনিষদ সংহিতা যুগের প্রাচীন ও প্রভাবের দিক থেকে গৌণ দেবতা রুদ্রকে সর্বোত্তম দেবতারূপে উপস্থাপিত করেছে। রুদ্র এখানে সরদপ ঈশ্বরের নামান্তর, কিন্তু বিশেষ লক্ষণীয়ভাবে তিনি মহর্ষি বলে কথিত, যদিও পূর্বে তিনি পশু ও মানুষের প্রতি তীক্ষ্ণ বাণ নিক্ষেপ করতেন এবং মঙ্গলময় ও অমঙ্গলময়—এই দুই রূপে তার প্রাচীনতর ভাবমূর্তি সংরক্ষিত। আবার পরম বিশ্বাতিগ সত্ত্বারূপে তাঁর সমুন্নত অবস্থান এখানে ব্ৰহ্মার সমতুল্য হয়ে পড়েছে। কিছু কিছু অদ্বৈতবাদী প্রবণতা-সহ একেশ্বরবাদী ভাবনার ক্রমাভিব্যক্তি এই প্রক্রিয়ার মধ্যে স্পষ্ট : তাই এখানে বলা হয়েছে যে শিবসম্পর্কিত জ্ঞান নির্বাণ ও পুনর্জন্ম থেকে মুক্তি দান করে।

দেব-দানব সংঘর্ষের ব্রাহ্মণ্য দেবকাহিনীটি উপনিষদে পুনরাবির্ভূত হলেও এর তাৎপর্য এই পর্যায়ে সম্পূর্ণ ভিন্ন; এই সংগ্রাম এখন বস্তুত আধ্যাত্মিক রূপক হয়ে উঠেছে। (যেমন ছান্দোগ্য ৮ : ৭-১২)। দেবতা ও দানব তাই আত্মজ্ঞান লাভের জন্য পরম্পরের প্রতিস্পধী। এই প্ৰত্নকথার দেবতা ও দানবের মধ্যবতী পার্থক্য প্রকৃতপক্ষে বস্তুবাদ ও ভাববাদেব মধ্যবতী পার্থক্যের সমতুল্য; বস্তুবাদকে এখানে মূল্যহীন, সহজ ও অগভীর রূপে চিত্রিত করা হয়েছে, কারণ সম্ভবত সেই যুগে বস্তুবাদী দর্শন কতকটা জনপ্রিয় হয়ে উঠেছিল বলে তাকে হেয় প্ৰতিপন্ন করা অত্যাবশ্যক বিবেচিত হয়েছিল। দ্বিতীয়ত, যে-ইন্দ্ৰকে পূর্বে কঙ্গনা জ্ঞানপিপাসুরূপে দেখা যায়নি–এখানে তাঁকে পরম জ্ঞানের অধ্যবসায়ী জিজ্ঞাসুরূপে উপস্থাপিত করা হয়েছে, সম্ভবত দেবতাদের মধ্যে প্রধান বলেই তিনি জ্ঞানকাণ্ডেও যোগ্য গ্ৰহীতা বলে বিবেচিত। আবার এই প্ৰত্নকথায় জনক বা প্ৰবহন জৈবলির মতো রাজবংশীয় ক্ষত্ৰিয় ঋষিদের প্রতীকী বিবরণও নিহিত থাকতে পারে, যাঁরা সে-যুগে নিশ্চিতভাবে বর্তমান ছিলেন–দেবতাদের মধ্যে ক্ষত্ৰিয় ব’লে গণ্য ইন্দ্ৰ সম্ভবত তাঁদের দৈব প্রতিরূপ। এদিক দিয়ে, যাজ্ঞবল্ক্য বা গৌতমের মতো ব্ৰাহ্মণ দার্শনিকদের দৈব প্রতিরূপ হলেন প্ৰজাপতি। তৃতীয়ত, একটি বঙ্কিম পথ দিয়ে নিদ্রা, স্বপ্ন ও সুষুপ্তির স্তর-সম্পর্কিত বিভিন্ন দৃষ্টিভঙ্গিকে দেহ ও আত্মার মধ্যবর্তী ব্যবধানের ভিন্ন-ভিন্ন অবস্থান রূপে দেখানো হয়েছে—যা-থেকে ক্রমশ এদের পরমাত্মা সম্পর্কে সচেতনতা জেগে ওঠে। আত্মজ্ঞানলিঙ্গলু ব্যক্তিকে ভাবগত উপলব্ধির স্তরে পৌছানোর পূর্বে যে সমস্ত সোপান অতিক্রম করতে হয়-এই কাহিনীতে জ্ঞানই বিবৃত হয়েছে।

বৃহদারণ্যক উপনিষদে এই দেবকাহিনী সামান্য পরিবর্তিতরূপে উপস্থাপিত হয়েছে। লক্ষণীয় যে এতে আয়স্য অঙ্গিরস অর্থাৎ অথর্ববেদীয় এক পুরোহিত দেবতাদের সর্বোত্তম জ্ঞান শিক্ষা দান করেছেন। এখানে আদিত্যকে সুখ ও বসুকে বায়ুমণ্ডল এবং পৃথিবী, আকাশ, সূৰ্য, স্বৰ্গ, চন্দ্ৰ, নক্ষত্র ও রুদ্রকে দশ ইন্দ্ৰিয়, এবং মন ও ইন্দ্রকে বঞ্জের সঙ্গে একাত্ম করা হয়েছে। যজ্ঞবহির্ভুত নৈসৰ্গিক শক্তি ও উপাদানের সঙ্গে দেবতাদের সম্পর্ক রচনার মধ্যে ব্ৰাহ্মণ্যধর্মের দ্রুত স্বকীয়মাণ পরিমণ্ডলে প্রাচীন বিশ্বাসকে নূতন জীবনদানের প্রাণাস্তিক প্রচেষ্টা প্রতিফলিত হয়েছে।

বহুদেববাদ থেকে একেশ্বরবাদ এবং তৎপরবর্তী স্তরে অদ্বৈতবাদ–এই ছিল তৎকালীন সমাজে ধমীয় চেতনার বিবর্তনের প্রক্রিয়া। এভাবে অসংখ্য ঋগ্বেদীয় দেবতা ক্রমশ বৈদিক যুগের অস্তিম পর্যায়ে উখিত পরমাত্মার ভাবমূর্তি অর্থাৎ প্ৰজাপতি, ব্ৰহ্মণস্পতি, ব্ৰহ্মা বা পুরুষের মধ্যে বিলীন হয়েছিলেন। পারস্পরিক বোঝাপড়ার বাতাবরণেই এটা সম্ভব হয়েছিল, কারণ তখনো তারা অস্পষ্ট নবরূপধারী দেবতা রয়ে গেছেন, আহুতি ও প্রার্থনা তাদের উদ্দেশে তখনো নিবেদিত হচ্ছে। সম্ভবত প্ৰাগাৰ্যদের কাছ থেকে একেশ্বরবাদী ধারণা গৃহীত হয়েছিল; তবে, অন্তত বুদ্ধির স্তরে, তা প্রাচীনতর বহুদেববাদ থেকে স্পষ্টত পৃথক হয়ে পড়েছিল। অনুমান করা যেতে পারে, ক্রমবর্ধমান যজ্ঞানুষ্ঠান ও ব্রাহ্মণ পুরোহিতদের শ্বাসরোধিকারী নিয়ন্ত্রণের বিরুদ্ধে ক্ষত্রিয়দের বিদ্রোহের ফলেই এই পরিবর্তন দেখা দিয়েছিল। অবশ্য কোনো একজন নির্দিষ্ট বিদ্রোহী ধর্মপ্ৰবক্তার উল্লেখ করা কঠিন, কেননা ভারতে নব্য চিন্তার বহু প্ৰবক্তা। এই যুগে অর্থাৎ খ্রিস্টপূর্ব সপ্তম ও ষষ্ঠ শতাব্দীতে নানাবিধ বিদ্রোহী মতবাদ প্রচার করেছিলেন; অন্তত, একটি নেতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গির ক্ষেত্রে তাদের ঐক্য ছিল-যজ্ঞধর্মের প্রবল বিরোধিতা। অন্যান্য সাধারণ বৈশিষ্ট্য হ’ল কল্যাণকর আচরণের নির্দেশে নিহিত আদর্শ, চুড়ান্ত সত্যের জন্য বৌদ্ধিক অন্বেষণ এবং কর্ম ও জন্মান্তরবাদ বিশ্বাস। তবে নিঃসন্দেহে এই নব্য চিন্তাধারার স্বরূপকে বিবর্তনধারার পরিপ্রেক্ষিতে স্থাপিত না-করে বৈপ্লবিক পরিবর্তনের অভিব্যক্তি হিসাবে পর্যালোচনা করতে হবে। প্ৰাচীন দেবতাদের অস্তিত্ব। তখনো রয়েছে কিন্তু ভক্তদের কাছে তাদের উজ্জ্বল উপস্থিতি বহুলাংশে নিম্প্রভ এবং প্রাচীনতর প্রত্নকথাগুলির প্রতি বিশ্বাস দুর্বল হয়ে পড়েছে।