০৫. শিক্ষাব্যবস্থা (উপনিষদ)

০৫. শিক্ষাব্যবস্থা (উপনিষদ)

বৈদিকযুগের সৃষ্টিশীল রচনাপর্যায়ের পরিসমাপ্তি সূচনা করে যে উপনিষদ সাহিত্য, তাতে বৈদিক মানুষের শিক্ষাব্যবস্থা সম্পর্কে তথ্য পাওয়া যায়। ইতোমধ্যে গবেষক ও আচাৰ্যদের কয়েক শতাব্দী ব্যাপী দীর্ঘ পরম্পরার ঐতিহ্য সুপ্রতিষ্ঠিত হয়ে গেছে। বহু উপনিষদে প্রাচীন বিশেষজ্ঞ, ঋষি ও আচাৰ্যরা উদ্ধৃত হয়েছেন এবং দ্বিবিধ বিদ্যা অর্থাৎ পরা ও অপরা বিদ্যার প্রবক্তা আচার্য ও চিন্তাবিদদের দীর্ঘ তালিকা প্ৰস্তুত করা হয়েছে। চতুৰ্বেদ অপরা বিদ্যার অন্তর্ভুক্ত; লক্ষণীয় যে, অথর্ববেদ ইতোমধ্যে শাস্ত্ররূপে স্বীকৃত হয়ে গেছে। অপরা বিদ্যার মধ্যে রয়েছে শিক্ষা, কল্প, ব্যাকরণ, নিরুক্ত, ছন্দ ও জ্যোতিষী (মণ্ডুক ১ : ১ : ৫, বৃহদারণ্যক ২ : 8 : ১০); এছাড়া, ইতিহাস, পুরাণ, উপনিষদ, শ্লোক, ভাষ্য-সাহিত্য ও ভেষজবিদ্যা। এসব জনসাধারণের সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যরূপে আরও পূর্ব থেকে বর্তমান ছিল।

প্ৰথম দিকে বেদাধ্যয়ন তিনটি আর্যবর্ণের পক্ষে অবশ্যপালনীয় কর্তব্য ছিল। অবশ্য শাস্ত্রগুলির দ্রুত বিস্তারের পরে সমগ্ৰ বেদের জ্ঞান অর্জনের থেকে ক্ষত্ৰিয় ও বৈশ্যদের অব্যাহতি দেওয়া হল; যে কোনো বেদের কিয়দংশ অধ্যয়ন করা তাদের

অধ্যয়ন করতে হত। কালক্রমে প্রয়োজনের পরিধি সঙ্কুচিত হয়ে এল, হয়তো বা ক্রমবর্ধমান বৈদিক সাহিত্যও পরিমাণে এত বিপুল কলেবর হ’ল যে, একজনের পক্ষে আয়ত্ত করা দুঃসাধ্য এবং শেষ পর্যন্ত তা গায়ত্রী শ্লোকের তিনটি ক্ষুদ্র চরণ জানার মতো অবিশ্বাস্য ন্যূনতম প্রয়োজনে পর্যবসিত হ’ল। এমন কি, উপনিষদের যুগেও কোনো কোনো ব্ৰাহ্মণ পরিবারে যে বেদাধ্যয়নের প্রতি অবহেলা দেখানো হত, তা ছান্দোগ্য উপনিষদের একটি অংশে (৬ : ১ : ১) স্পষ্ট। সেখানে শ্বেতকেতুকে তাঁর পিতা বেদাধ্যয়নের উপদেশ দিয়ে বলেছেন, তাদের পরিবারে বেদজ্ঞানবিবর্জিত ‘ব্রহ্মবন্ধু’র কোনো অস্তিত্ব নেই। বিখ্যাত বিদ্বান ব্রাহ্মণরা বাস্তবজীবনেও সুপ্রতিষ্ঠিত ছিলেন; তাই, একটি সাধারণ শব্দবদ্ধ পাওয়া যায়, ‘মহাকাল মহাশ্রোত্ৰিয়’। প্ৰচলিত সামাজিক রীতি অনুযায়ী উপনয়নের পরে কিশোর বিদ্যার্থী কয়েক বছরের জন্য গুরুর আশ্রমে যেত; গৃহে প্ৰত্যাবর্তনের পরে সে বিবাহ করে গাৰ্হস্থ্য জীবনে প্রবেশ করত। বলা, বাহুল্য, কয়েক শতাব্দী ধরে সঞ্চিত বিদ্যাকে, সেই অক্ষরজ্ঞান আবিষ্কৃত হবার পূর্ববর্তী দিনগুলিতে, সংরক্ষিত করার একমাত্র উপায়ই ছিল সমগ্র রচনা কণ্ঠস্থ করে। পরবর্তী প্রজন্মের কাছে পৌঁছে দেওয়া। এই বিদ্যার উৎস সম্ভবত ইন্দোইয়োরোপীয়দের মূল বাসভূমি থেকে বিভিন্ন দিকে ছড়িয়ে পড়ার পূর্বে বিদ্যমান ছিল। কালক্রমে লেখন-পদ্ধতি যখন আবিষ্কৃত হ’ল, তখন সংরক্ষণের অন্য উপায় দেখা গেল। ভিন্ন ভিন্ন পরিবার ভিন্ন ভিন্ন বেদ–এমন কি তাদের পৃথক পৃথক শাখাগুলিও সংরক্ষণ করত; ফলে, কোনো একটি ব্যক্তির স্মরণশক্তির উপর চাপ কমে গিয়েছিল। তবে, সমস্ত যুগেই এমন কিছু পরিবার ছিল, যারা চতুৰ্বেদ আয়ত্ত করত। শাস্ত্ৰসমূহে সম্পূৰ্ণ জনগোষ্ঠীর বিশ্বাস, ক্রিয়াকলাপ, মূল্যবোধ-সামগ্রিক জীবনযাপন প্ৰণালী সংরক্ষিত হয়েছিল। জনসাধারণের স্মৃতিতে নিবদ্ধ হওয়া ছাড়াও এসব শাস্ত্ৰ সমগ্ৰ জনগোষ্ঠীর পক্ষে সমন্বয় বিধানের একটি উপাদান হয়ে উঠেছিল; ততদিনে অসংখ্য বৈচিত্রসহ জীবনের অন্যান্য ক্ষেত্রে প্রাসঙ্গিক রচনারীপে এগুলি বিপুল অঞ্চলে ব্যাপ্ত হয়ে পড়েছিল।

অঙ্গীকারবদ্ধ যজ্ঞগুলিতে বৈদিক সাহিত্য আবৃত্তির প্রচলিত ঐতিহ্য থেকেই সম্ভবত এই ধরনের ধারণার উৎপত্তি। তাই, বৃহদারণ্যকে উপনিষদের অন্তিম অধ্যায়ের পূর্ববর্তী অংশে বিভিন্ন রূপ ও গুণ সমন্বিত সন্তান লাভের জন্য অন্যান্য আনুষ্ঠানিক ক্রিয়ার সঙ্গে বিভিন্ন বেদের সম্পূর্ণ বা আংশিক আবৃত্তির বিধান দেওয়া হয়েছে।