০৪. আঙ্গিক ও ভাষা (উপনিষদ)

আঙ্গিক ও ভাষা (উপনিষদ)

প্রাচীনতম গদ্য উপনিষদগুলিতে ব্ৰাহ্মণ সাহিত্যের অনুরূপ গদ্য যেমন প্রধান আঙ্গিক, তেমনি পদ্যে রচিত উপনিষদগুলির রচনাশৈলীতে আখ্যানকাব্য ও মহাকাব্যসমূহের পূর্বাভাস সূচিত হয়েছে। এদের মধ্যে মৌখিক সাহিত্যের বহু বৈশিষ্ট্য বর্তমান, যদিও অর্বাচীনতম উপনিষদগুলি রচিত হবার পূর্বেই সম্ভবত লেখন-পদ্ধতি আবিষ্কৃত হয়েছিল, অনুমান করা যেতে পারে। ধর্মীয় সাহিত্য ও শাস্ত্রের ক্ষেত্রে সম্ভবত লেখা তখনো প্ৰযুক্ত হয় নি, যেহেতু ঐ সব রচনা শ্রুতিকাব্যরূপে প্রণীত ও মৌখিকভাবে এক প্ৰজন্ম থেকে অন্য প্রজন্মে সঞ্চারিত হচ্ছিল। তাই, গদ্য ও পদ্য উভয়ের মৌল চরিত্রলক্ষণ ছিল সংক্ষিপ্ততা ও ঋজুতা; এমন কি সংলাপাত্মক, বর্ণনাত্মক অংশেও নির্দিষ্ট প্ৰণালীবদ্ধ রচনাগঠনের উপস্থিতি লক্ষ্য করা যায়।

ধ্রুবপদ এবং বাক্যাংশ ও বিশিষ্টার্থক পদ, এমন কি সম্পূর্ণ বাক্য প্রয়োগে যে ধরনের পুনরাবৃত্তি মৌখিক সাহিত্যে স্মৃতিসহায়করূপে গণ্য হয়,–সেসব উপনিষদে প্রচুর পরিমাণে পাওয়া যায়। কোনো বাক্যাংশে শুভসূচক বা সুখপ্রদ বলে পরিগণিত হলে বহুবার তা পুনরাবৃত্ত হয়ে থাকে। স্মৃতিতে ধারণ করার জন্য যেহেতু সর্বাধিক সংক্ষিপ্ততা আবশ্যিক, বর্ণনাংশেও তেমনি চূড়ান্ত বাচনিক সংযম দেখা যায়। কিছু কিছু বাক্য অত্যন্ত দুর্বোধ্য, তবে সাধারণভাবে রচনাশৈলী ব্রাহ্মণানুগ এবং একই ধরনের বাচনিক সংযম এখানে রয়েছে। কখনো কখনো এই চুড়ান্ত সংক্ষিপ্ততার ফলে অভিপ্ৰেত অৰ্থ সম্পর্কে সংশয় দেখা দেয়, কারণ সংযোগকারী শব্দ বা বাক্য প্রায়ই পাওয়া যায় না। তবে কখনো কখনো নিগূঢ় রহস্যবাদী প্রবণতার ফলে ‘তজ্জলান্‌’- এর মতো বাক্যাংশে তির্যক তাৎপর্য যুক্ত হয়; অতীন্দ্ৰিয়বাদী উপাদান সংরক্ষিত করার জন্য নির্দিষ্ট ক্ষুদ্র সংকেতসূত্র জাতীয় অভিব্যক্তি [ যেমন তত্তমসি, সোহহম্‌, অতোহনাদার্তম্‌ ] তাদের সুপরিমিত আঙ্গিক ও প্রসঙ্গের গভীরতার মধ্য দিয়ে হীবক সমুজ্জ্বল হয়ে উঠেছিল।

গদ্যস্তবকগুলি নির্দিষ্ট দৈর্ঘ্যে বিভক্ত হওয়ায় সহজে স্মৃতিতে ধারণের উপযুক্ত ছিল। গদ্যের ব্যাকরণ ও শৈলী পতঞ্জলির সমীপাবতী—যিনি খ্রিস্টপূর্ব দ্বিতীয় শতাব্দীতে জন্মগ্রহণ করেছিলেন। এতে প্রমাণিত হয় যে, খ্রিস্টপূর্ব প্রথম সহস্রাব্দের শেষ শতাব্দীগুলিতে সংক্ষিপ্ত ও সাব্যগর্ভ গদ্যশৈলী সুপ্রতিষ্ঠিত ছিল এবং পরবর্তী কয়েকটি শতাব্দীতে কোনো প্ৰধান পরিবর্তন ছাডই তা নিরবচ্ছিন্নভাবে বর্তমান ছিল। যতিসমূহ ব্যাকরণগত বা প্ৰবন্ধগঠনগতভাবে নির্ধারিত নয়; নিতান্তই শ্বাসাঘাতজনিত যতি, যা মৌখিক সাহিত্যের একটি আবশ্যিক লক্ষণ। মৌখিক সাহিত্যের অন্য লক্ষণ দেখা যায় বিষয়বস্তুর আকস্মিক পরিবর্তনে, আমরা যদি মনে রাখি যে, রচনার অন্তবর্তী ফাঁকগুলি মৌখিকভাবে উপযুক্ত ইঙ্গিতপূর্ণ ভঙ্গি ও শব্দদ্বারা আচার্য র্তাব শিক্ষাদানের সময় পূরণ করে নিতেন, তাহলে এই পরিবর্তনের তাৎপর্য স্পষ্ট হয়ে ওঠে। শুধুমাত্র রচনার স্মরণীয় অংশটুকুই সংরক্ষিত হত। একইভাবে ভৃগু ও বরুণের সংলাপে প্ৰশ্নকর্তাকে পূর্বনির্ধারিত সংকেতসূত্র দ্বারা চিহ্নিত করা হয়েছে, যেখানে জ্ঞানের জন্য পুত্রের সাগ্ৰহ আকাঙ্ক্ষা অভিব্যক্ত হয়েছে—এতেও মৌখিক সাহিত্যের বৈশিষ্ট্যই স্পষ্ট। সাধারণভাবে উপনিষদগুলি স্বরযুক্ত নয়।

বহু উপনিষদে সংলাপ-আঙ্গিকে রচিত দীর্ঘ অংশ রয়েছে। উপনিষদের মধ্যে এগুলিকে চমৎকার ‘জীবন্ত’ আঙ্গিকরূপে গ্ৰহণ করা যায়, কারণ এগুলি প্লেটোর বিখ্যাত সংলাপশৈলীর ধরনে জিজ্ঞাসু ও প্রবক্তাদের মধ্যে সংঘটিত প্ৰকৃত সংলাপগুলিকে রক্ষা করেছে। এই আচার্যরা ছিলেন তাদের সময়ের অগ্রগামী চিন্তাবিদ। বিভিন্ন প্রশ্ন উত্থাপিত হত এবং প্ৰবীণ আচার্য বা ঋষি সেসবের উত্তর দিতেন। এধরনের প্রশ্নোত্তরমূলক দ্বান্দ্বিক রচনাশৈলীর সর্বশ্রেষ্ঠ নিদর্শন পাওয়া যায় প্রশ্নোপনিষদে; খ্রিস্টপূর্ব অষ্টম থেকে পঞ্চম বা চতুর্থ শতাব্দীর মধ্যে প্রচলিত দ্বন্দ্বমূলক আধ্যাত্মিক ভাবনার দিকপরিবর্তন এতে সূচিত হয়েছে। অদ্বন্দ্বমূলক কথকতাধর্মী আলোচনায় সংক্ষিপ্ত ও সারগর্ভ রচনাশৈলী অনুসৃত হত, সাধারণত সমাজে ভাসমান জ্ঞানগর্ভ শ্লোকভাণ্ডারের উত্তরাধিকার থেকে লব্ধ নীতিমূলক রচনা কখনো কখনো প্ৰাগুক্ত শৈলীতে ব্যবহৃত হত। মাঝে মাঝে এদের মধ্যে অধ্যাত্মবিদ্যা সম্পর্কে আশ্চর্য সজীব অস্তদৃষ্টির পরিচয় পাওয়া যায়। জিজ্ঞাসু বিদ্যার্থী প্রায়ই যেভাবে গুরুর কাছে অন্তর্দৃষ্টি উদ্ভাসনের আবেদন জানিয়েছে, আচার্যের উত্তরে সংকেতসূত্রের রূপে নিবদ্ধ তত্ত্বগুলি তৎকালীন জ্ঞানতৃষ্ণার ঐকাস্তিকতা প্রমাণ করেছে। বৃহদারণ্যক উপনিষদ নিগূঢ় রহস্যপূর্ণ শ্লোকসমষ্টি উপস্থাপনার পূর্বে গুরুত্ব আরোপের প্রয়োজনে সংক্ষিপ্ত ভূমিকারূপে কিছু গদ্য স্তবকের পুনরাবৃত্তি করেছে। কোনো কোনো ক্ষেত্রে (যেমন : ২ : ৫ ১৬-১৯) সংহিতার শব্দভাণ্ডার এ ব্যাকরণরীতি যখন অনুসৃত হয়েছে, তাকে প্রাচীনতর রচনারূপে গ্ৰহণ করা যায়; আবার, কোথাও সমসাময়িক অর্থাৎ উপনিষদযুগের ভাষা প্রয়োগের লক্ষণ স্পষ্ট। পরবর্তী পর্যায়ে ভারতীয় অধ্যাত্মবিদ্যার বহু পারিভাষিক শব্দ অর্বাচীনতর উপনিষদগুলিতেই প্রথম প্রবর্তিত হয়েছিল।

উপনিষদ যুগেব বৈদিক ভাষায় নিজস্ব কোনো ব্যাকরণ যদিও ছিল না, তবুও আমরা প্ৰাচীনতর বৈদিক পর্যায় থেকে মহাকাব্যযুগের দিকে ব্যাকরণগত বিবর্তনের আভাস এখানে লক্ষা করি। শব্দরূপ, উপসৰ্গ, ক্রিয়াপদ, ছন্দ ইত্যাদির প্রয়োগে প্ৰাচীন ও নবীনের সহাবস্থান চোখে পড়ে। উপনিষদ রচনার শেষ পর্বে উদ্ভূত অন্যান্য চরিত্রলক্ষণ হ’ল, গ্ৰন্থশেষে–’মাহাত্ম্য’ অংশগুলি, যাতে আছে–রচনা-পাঠ ও শ্রবণের ফলশ্রুতির বর্ণনা। কঠোপনিষদের প্রথম অধ্যায়ের শেষে ও গ্রন্থের উপসংহারে এবং শ্বেতাশ্বতরে গ্ৰন্থশেষে এধরনের অংশ পাওয়া যায়। বহু উপনিষদের সূচনায় ও সমাপ্তিতে পূর্বনির্ধারিত সংকেতসূত্র জাতীয় প্রসস্তিমূলক অংশগুলিতে কখনো কখনো জিজ্ঞাসুদের প্রার্থনাপূরণের আকাঙ্খা অভিব্যক্ত হয়েছে। এগুলি মাঝে মাঝে সংহিতা বা ব্ৰাহ্মণ থেকে চয়ন করা হয়েছে। এটি যে পরবর্তীকালে উদ্ভূত রীতি, তার প্রমাণ হ’ল, প্রাচীনতম দুটি উপনিষদে এটি অনুপস্থিত। ছান্দোগ্য উপনিষদে একটি গুরু ও শিষ্যের তালিকা এবং বৃহদারণ্যকে একটি বংশতালিকা পাওয়া যায়। প্ৰাথমিকভাবে দার্শনিক রচনা হলেও উপনিষদগুলিতে নিছক মতবাদ ছাড়াও অনেক অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ সারবস্তু নিহিত রয়েছে! ব্রাহ্মণগুলির মতো উপনিষদেও কাল্পনিক ব্যুৎপত্তি, গুরু-শিষ্য, তালিকা, বংশতালিকা, অনুষ্ঠানসমূহের পুনর্বিশ্লেষণ এবং অসংখ্য উপকথা, কাহিনী ও কিংবদন্তী পাওয়া যায়। এসব কাহিনীর মাধ্যমে আমরা তৎকালীন সমাজের সঙ্গে পরিচিত হই। প্রধান বিষয়বস্তুর সঙ্গে প্রাসঙ্গিকতা থাকায়, এদের মধ্যে সমাজ, রীতিনীতি, ব্যবহারবিধি, বিশ্বাস ও মূল্যবোধের নির্ভরযোগ্য একটি চিত্র পরিস্ফুট হয়েছে।