০৪. সমাজচিত্র (আরণ্যক)

সমাজচিত্র (আরণ্যক)

আনুষ্ঠানিক বা আধ্যাত্মিক আলোচনা উত্থাপন করার জন্য ব্যবহৃত বিভিন্ন উপাখ্যান ও লোকশ্রুতি একত্র করে আমরা আরণ্যকের সামাজিক ও ঐতিহাসিক পরিপ্রেক্ষিত সম্পর্ক সিদ্ধান্ত গ্ৰহণ করতে পারি। ঐতরেয় আরণ্যকে বলা হয়েছে যে, ইন্দ্র যখন উপদেশের জন্য বিশ্বামিত্রের নিকট গমন করেছিলেন, তখন ঋষি বলেছিলেন যে, অন্নই হ’ল শ্রেষ্ঠ। তত্ত্ব [ ২ : ২ : ৪ ] শাখায়নেও এই ধারণার পিনরাবৃত্তি লক্ষ্য করা যায় [ ৮ : ২ : ১, ৯ : ৭ : ১, ৯ : ৯ : ১ ]।

অনুরূপভাবে তৈত্তিরীয় আরণ্যকে বলা হয়েছে যে, ভৃণ্ড যখন তাঁর পিতা বরুণের নিকট উপদেশ চেয়েছিলেন, বরুণ তখন তাঁকে অন্ন সম্পর্কে গুরুত্বপূর্ণ বেশকিছু তত্ত্ব শিক্ষা দিয়েছিলেন (৯ : ১১)। এভাবে বিভিন্ন আরণ্যকের বিচ্ছিন্ন কিছু উপাখ্যান থেকে আমরা বিভিন্ন বিষয় সম্পর্কে তৎকালীন সমাজের দৃষ্টিভঙ্গির পরিচয় পাই।

ইতোমধ্যে সন্ন্যাস যে মহান ও গৌরবজনক একটি আধ্যাত্মিক চর্চার উপায় ও ধর্মম্পদরূপে স্বীকৃত, আরণ্যকে তার বহু প্ৰমাণ পাওয়া যায়। ঐতরেয়তে ভরদ্বাজকে সর্বাধিক বিদ্বান, সর্বাপেক্ষা দীর্ঘজীবী এবং ঋষিদের মধ্যে সর্বশ্রেষ্ঠ সন্ন্যাসীরূপে বর্ণনা করা হয়েছে (১ : ২ : ২ : ৪)। আরণ্যকে জাতিভেদ প্ৰথা সামাজিক বাস্তবরোপে প্রতিষ্ঠিত; বহুস্থানে আমরা বিভিন্ন বর্ণের আর্থিক অবস্থা সম্পর্কে তির্যক কিছু উল্লেখ দেখতে পাই। পারস্পরিক অভিবাদনের রীতি সম্পর্কে যে সমস্ত তথ্য পাওয়া যায়, পরবর্তী ধর্মসূত্রের সঙ্গে তাদের বিশেষ সাদৃশ্য রয়েছে। আর্থিক অবস্থা অনুযায়ী ব্ৰাহ্মণদের মধ্যেও যে শ্রেণীভেদ ছিল, তার সুস্পষ্ট ইঙ্গিত চোখে পড়ে। অরণ্য-মধ্যবতী আশ্রম নিবাসী শিক্ষকদের সঙ্গে রাজ-পুরোহিতদের যে বৈষম্য প্রকট হয়ে উঠেছিল তাও এতে বেশ স্পষ্ট। বিদ্যাদাতা ব্ৰাহ্মণরা অরণ্যবাসী হওয়ার ফলে সাধারণভাবে ঐশ্বৰ্য থেকে বঞ্চিত ছিলেন, কিন্তু অন্য একটি কারণে তারা ছিলেন অধিকতর সম্মানিত; কারণ ব্ৰহ্মজ্ঞান সম্বন্ধে তারা পুত্র বা শিষ্য ব্যতীত অন্য কাউকে শিক্ষা দিতেন না, বিশেষত অন্যজমান ব্যক্তিকে কখনোই ব্ৰহ্মবিদ্যা দান করা যেত না। অতএব, গুরুপরম্পরা বা প্ৰজন্মক্রমে এইসব গূঢ়তত্বের আচাৰ্যরা সমাজমানসে সম্মানের আসনে অধিষ্ঠিত ছিলেন।

আনুষ্ঠানিক অনুপুঙ্খের সঙ্গে সম্পর্কিত বহু প্ৰাচীনতর শাস্ত্রবিশেষজ্ঞদের বক্তব্য উদ্ধৃত হওয়ায় দীর্ঘ ধর্মতাত্বিক ঐতিহ্যের জটিলতা ও পরিণতিই প্রমাণিত হয়েছে। তৈত্তিরীয় আরণ্যকে [ ১ : ১১ : ৮ ] বলা হয়েছে যে, জ্ঞানই মানবজাতির পক্ষে সর্বাধিক বাঞ্ছনীয় বস্তু; জ্ঞানী ব্যক্তিরাই প্ৰকৃত সজ্জন। নর-নারীর পারস্পরিক সান্নিধ্যের সম্বন্ধে কতকটা উদার মনোভাব প্ৰকাশিত হয়েছে : বিবাহিত ও অবিবাহিত-এই উভয়বিধ নারীর গর্ভস্থ সন্তানকে রক্ষা করার জন্য প্রার্থনা নিবেদিত হয়েছে।

এই পর্যায়ে জাতীয় সম্পদ মূলত কৃষিকাৰ্য থেকে উদ্ভূত হ’ত; ভারবাহী পশু, কৃষক, লাঙল, চাবুক ও চামড়ার পাতলা ফালির স্পষ্ট উল্লেখ ছাড়াও পৃথিবীর উদ্দেশ্য উচ্চারিত একটি দীর্ঘ সূক্তে প্রচুরতর শস্যের আকাঙ্খায় রচিত প্রার্থনার মধ্যে কৃষিকার্যের সীতা শুন্যাসীরের উপর দেবত্ব আরোপিত হয়েছে। লক্ষণীয় যে, পর্যাপ্ত শস্য-উৎপাদক পৃথিবীকে এই পর্যায়ে নিম্নোক্ত বিশেষণসমূহে ভূষিত করা হয়েছে : বসুন্ধরা, ধরণী, লোকধারিণী, গন্ধদ্বারা, দুরাধর্ষা, নিত্যপুষ্টা ও করীষিণী শাঙ্খায়ন আরণ্যক, [ ১০ : ১ ]। এসব বিশেষণ থেকে নিঃসন্দেহে প্রমাণিত হচ্ছে যে, তখনকার জনগোষ্ঠীর জীবন ও জীবিকা প্ৰাথমিকভাবে কৃষিনির্ভর ছিল। তবে খাদ্যের জোগান পর্যাপ্ত বা নিয়মিত ছিল না; দারিদ্র্যের বহু উল্লেখ পাওয়া যায়,–দারিদ্রের গ্রাস থেকে মুক্তি পাওয়ার আশাই বহু প্রার্থনার মর্মবস্তু। ক্ষুধা ও তৃষ্ণা তখনো প্ৰবল শত্রুরূপে গণ্য (অশনায়া ও পিপাসা অর্থাৎ ক্ষুধা ও তৃষ্ণা); প্ৰজাপতি সৃষ্টি করার পরে তারা মানুষের শরীরে প্রবিষ্ট হয়েছিল। সংহিতার মতো আরণ্যকেও হতস্বাস্থ্যের উদ্ধার, কাৰ্যশক্তির বৃদ্ধি, চমৎকারিত্ব এবং উত্তম সন্তান লাভের জন্য প্রার্থনা সাধারণভাবে ব্যক্ত হয়েছে। অত্যন্ত কঠোর রীতিতে বিধিবদ্ধভাবে বিশেষ ধরনের কুবের-পূজার বিধান দেওয়া হয়েছে; দারিদ্র্য থেকে মুক্তি পাওয়ার জন্য সর্বাহারাকে এই পূজা সম্পর্কে জ্ঞান লাভ করে অনুষ্ঠানের আয়োজন করার জন্য প্রেরণাও দেওয়া হয়েছে। পঞ্চমহাযজ্ঞের অন্যতম ‘নৃযজ্ঞ’ ইতোমধ্যে কেবল ব্ৰাহ্মণদের উদ্দেশে অন্নদানের সীমাবদ্ধ হয়ে পড়েছে। বেদাধ্যয়ন অরণ্যে থেকেই অভ্যাস করতে হবে, এমন কথাও পড়ি। দুর্বল ও অশক্ত ব্যক্তিদের জন্য নানাবিধ বিকল্প যজ্ঞানুষ্ঠানের বিধান দেওয়া হয়েছে। এটা এমন একটা সময় যখন প্রাচীন ধর্ম নানা রকম পরিবর্তনের মধ্য দিয়ে নুতন একটি রােপ পরিগ্রহ করেছিল। উপাসনা পদ্ধতিরূপে পূজার প্রবর্তন, গুরুত্বপূর্ণ নূতন দেবতারূপে কুবেরের আবির্ভাব ইত্যাদি ছাড়াও ভাবী অমঙ্গলের লক্ষণ, স্বপ্ন, কবচ ও কবচ নির্মাণ ও পরিধানের ঐন্দ্ৰজালিক আচার সাহিত্যের লক্ষণীয় বৈশিষ্ট্য। এ সময় ভৌগোলিক পরিসর আরও দক্ষিণ-পূর্ব দিকে বিস্তৃত হয়েছে, কারণ গঙ্গা ও যমুনা নদীর মধ্যবতী অঞ্চলে বসবাসকারী জনসাধারণই অপেক্ষাকৃত শ্ৰদ্ধেয়রূপে পরিগণিত। আমরা কুরু পাঞ্চাল, উশীনর, মৎস্য, কাশী ও বিদেহের কথা শুনতে পাই, যে সব অঞ্চল পরবর্তীকালে ‘মধ্যদেশ’ নামে পরিচিত হয়েছিল। সামাজিক জীবন সম্পর্কে সাধারণ চিত্রটি হ’ল তুলনামূলকভাবে শান্তিবৃদ্ধি ও সাংস্কৃতির। তৈত্তিরীয়ে বীণা সম্পর্কিত (দৈব ও মানবিক—এই উভয়বিধ) একটি দীর্ঘ আলোচনা (২ : ৩ : ১) থেকে অনুমান করা যায় যে, সে সময় ললিতকলার, বিশেষত সঙ্গীতের চর্চা প্ৰচলিত ছিল।

আরণ্যকে প্রতিফলিত নীতিচিন্তা মুখ্যত সত্য ও অসত্য সম্পর্কে কাব্যিক অভিব্যক্তির মধ্যে আভাসিত হয়েছে। নারী-সমাজের শুচিতার সঙ্গে সতীত্বের ধারণা তখন থেকেই সংশ্লিষ্ট হয়ে পড়েছে। পরিবর্তিত অৰ্থনৈতিক পরিস্থিতির সঙ্গে সঙ্গে পাপ সম্পর্কে নূতন চিন্তার সূত্রপাত লক্ষ্য করা যায়, বিশেষত কুসীদ প্ৰত্যপণে ব্যর্থতার জন্য ক্ষয়-রোগ ও মৃত্যুদণ্ড নিরূপিত হয়েছে। তৈত্তিরীয় আরণ্যকে ঋণপরিশোধ ও শান্তি সম্পর্কে দীর্ঘ আলোচনার মধ্যে ধর্মবোধ ও মুক্তির নতুন চিন্তাও আভাসিত (২ : ৬) তবে, কৃষিজীবী সমাজের কাছে পাপ-পূণ্য যে সব সামাজিক প্রয়োজন অনুযায়ী নিরূপিত হচ্ছে, তার ইঙ্গিত স্পষ্ট। একই কারণে যজ্ঞানুষ্ঠান সম্পর্কে দৃষ্টিভঙ্গিও তাৎপৰ্যপূর্ণভাবে পরিবর্তিত হয়ে যাচ্ছিল। নতুন একটি সাহিত্য শ্রেণীরূপে আরণ্যকের প্রকৃত বৈশিষ্ট্য এই যে, সর্বপ্রথম যজ্ঞানুষ্ঠানগুলি এতে অতিপ্ৰাকৃত ও আধ্যাত্মিক দৃষ্টিভঙ্গি অনুযায়ী নতুনভাবে ব্যাখ্যাত হয়েছে। দেবকাহিনী অনুষ্ঠান ও প্রার্থনা সম্পর্কিত পূর্ববতী চিন্তাভাবনা পরিবর্তিত সামাজিক পরিস্থিতিতে এখন যেন অপর্যাপ্ত বলে বিবেচিত হয়েছে। আরণ্যকে পূৰ্ববতী ধৰ্মচর্চার পুনবিশ্লেষণের পশ্চাতে যে যুক্তিবোধ ক্রিয়াশীল তা মূলত অতীন্দ্ৰিয় রহস্যজাত। ব্ৰাহ্মণ পর্যায়ের যজ্ঞ বিশ্লেষণে এর প্রাথমিক বীজ অঙ্কুরিত হলেও এ ক্ষেত্রে তা নিশ্চিতভাবে ভিন্ন দ্যোতনাযুক্ত।

আরণ্যকে ঐতিহ্যগত বিষয়বস্তুর প্রতীকী পুনর্বিশ্লেষণের মধ্যে উপনিষদের পূর্বাভাস পাওয়া যায়। স্বাধ্যায়ের উপর আরোপিত বিশেষ শুরুত্ব, তার গৌরবায়ণ, প্রাকৃতিক বিপর্যয়ের সময়ে অন্যধ্যায় সম্পর্কিত নতুন নিয়মাবলী সম্পূর্ণত নতুন দৃষ্টিভঙ্গির-ই পরিচয় বহন করছে। আরণ্যক পর্যায়ে স্বাধ্যায় যেন বিশেষ এক ঐন্দ্রজালিক পবিত্রতা অর্জন করেছে। স্পষ্টত স্বাধ্যায়ের মূল অর্থ ছিল দ্বিজ অর্থাৎ ব্ৰাহ্মণ-ক্ষত্ৰিয়-বৈশ্যদের দ্বারা ঋগ্বেদ সংহিতার আবৃত্তি; পরবর্তী পর্যায়ে এর অর্থ দাঁড়াল ঋগ্বেদের অংশ বিশেষ এবং আরো পরবর্তী কালে শুধু গায়ত্রীমন্ত্র আবৃত্তি করা। কালক্রমে তাই আরণ্যকের নির্দেশক বক্তব্যে পরিণত হ’ল। ঐতরেয় আরণ্যকের একটি প্রাসঙ্গিক বক্তব্যের (৫ : ৩ : ২) তাৎপৰ্য একাধিক স্তরে প্রণিধানযোগ্য। প্রথমত, স্বাধ্যায় একসময় বহু ব্যক্তিদ্বারা অবহেলিত হয়েছিল বলে এখানে তার সামাজিকভাবে পুনর্বাসনের চেষ্টা হয়েছে। দ্বিতীয়ত, স্বাধ্যায়ের অনুশীলন থেকে আত্মজ্ঞান ও সত্যবোধ অর্জিত হয়; এর দ্বারা বুঝি যে জ্ঞান তৎকালীন সমাজে আকাঙিক্ষত আধ্যাত্মিক মূল্য পেয়ে গেছে। তৃতীয়ত, এই বক্তব্য মহাব্ৰত অনুষ্ঠান সম্পর্কিত নির্দেশাবলীর উপসংহারে রয়েছে যে, অনুষ্ঠান নাকি স্বাধ্যায় ব্যতীত অসম্পূর্ণ–আনুষ্ঠানিক প্রসঙ্গে এধরনের বিবৃতি কতকটা অপ্রত্যাশিত।

বর্ষকালব্যাপী গবাময়ন যজ্ঞের অন্তর্গত একদিবসীয় মহাব্ৰত অনুষ্ঠানটি বিশেষভাবে ঋগ্বেদের ঐতরেয় ও শাঙ্খায়ন আরণ্যকে পুনর্বিশ্লেষিত হয়েছে। অন্যভাবে বলা যায়, অর্বাচীন যজ্ঞগুলির অন্যতম গবাময়নকে বৈদিক ধর্মের কৰ্মমূলক ও জ্ঞানমূলক স্তরের মধ্যে সেতুবন্ধন করার জন্য ব্যবহার করা হয়েছে। এই দিক দিয়ে দেখা যায়, জ্ঞানতৃষ্ণা অন্ততপক্ষে ব্ৰাহ্মণ যুগের সমকালীন। তবে, আরণ্যক পর্যায়ে মৌলিক গুরুত্ব অর্জন করবার পূর্বে তা গবাময়নকে, বিশেষত এর অন্তর্গত মহাব্ৰত অনুষ্ঠানকে যজ্ঞানুষ্ঠান ও জ্ঞানচর্চার সেতুরূপে গ্ৰহণ করেছে, এই প্রক্রিয়ার পক্ষে প্ৰয়োজনীয় এবং তৎকালে উদীয়মান আধ্যাত্মিক প্রবণতার উপযোগী একটি বিশেষ ও অপেক্ষাকৃত নুতন অনুষ্ঠানকে অভিনব দৃষ্টিভঙ্গিতে পুনর্বিশ্লেষণ করা হয়েছিল। এ ধরনের পুনর্বিশ্লেষণ যুক্তিনিষ্ঠ না হয়ে অতীন্দ্ৰিয় দ্যোতনাযুক্ত হয়েছে; বিশ্লেষণের এই পদ্ধতি ব্রাহ্মণ ঐতিহ্যেরই প্ৰত্যক্ষ উত্তরসূরী। ঐতরেয় ও তৈত্তিরীয় আরণ্যকের বহুস্থানে এর নিদর্শন রয়েছে। বৈদিক যজ্ঞের প্রতীকায়ণ ও মানস যজ্ঞানুষ্ঠানের বিবৃতিতে কিছু কিছু বেদোত্তর লোকায়ত ধর্মচৰ্চার মৌলিক অভিব্যক্তির চিহ্ন খুজে পাওয়া যায়। প্রত্ন-অধ্যাত্মভাবনার পাশাপাশি আমরা অকৃত্রিম জাদুচর্চার প্রবণতারও আভাস পাই।। জীবনের সম্বন্ধে ঐন্দ্ৰজালিক দৃষ্টিভঙ্গির প্রত্যক্ষ নিরবছিন্ন প্ৰকাশরূপে দেহ, মন ও আত্মার অতীন্দ্ৰিয় বিশ্লেষণ লক্ষ্য করা যায়। এই প্রবণতাই আরো পরবর্তীকালে তন্ত্রসাহিত্যে সম্পূর্ণতা লাভ করেছিল।