০৭. দেবসঙ্ঘ

দেবসঙ্ঘ

ব্ৰাহ্মণ সাহিত্যের দেবসংঘ সংহিতা থেকে ভিন্ন। কয়েকজন প্রাচীনতর দেবতা যেমন উবা, ভগ, অর্যামা, মার্তণ্ড, দক্ষ, দৌঃ, পর্জন্য, বায়ুবাতাঃ এখানে সম্পূর্ণই অদৃশ্য হয়ে গেছেন। দ্বিতীয়ত, ইন্দ্ৰ, মিত্র, ব্ৰহ্মা, মরুতঃ, রুদ্রাসঃ–ইত্যাদির মতো কয়েকজন প্রধান প্রাচীনতর দেবতার মহিমা খর্ব হয়ে গেছে। তৃতীয়ত, রুদ্র, বিষ্ণু, বৃহস্পতি ও ঋভুদের মতো প্রাচীনতর গৌণ দেবতারা ক্রমশ মহিমা ও তাৎপর্যের দিক দিকে উন্নততর অবস্থানে পৌঁছেছেন। চতুর্থত, কয়েকজন নতুন দেবতার আবির্ভাব ঘটেছে যাদের মধ্যে প্রজাপতি প্ৰধান; এছাড়া রয়েছেন ‘মীঢ়ুষী’ ও ‘জয়ন্তে’র মতো অর্বাচীন দেবতা এবং কয়েকজন গৌণ অর্ধদেবতা।

দর্শপুর্ণমাস যজ্ঞের অন্তর্গত মিত্ৰবিন্দেষ্টিতে কয়োজন দেবতার জন্যে কিছু কিছু হব্য নির্দিষ্ট হয়েছে, যেমন–অগ্নিকে অন্ন, সোমকে রাজ্য ও বরুণকে সাম্রাজ্য, মিত্রকে যোদ্ধার বীরত্ব, ইন্দ্রকে ওজস্বিতা, বৃহস্পতিকে ব্ৰাহ্মণ্য গৌরব, সবিতাকে রাষ্ট্র বা প্ৰশাসন, পূষাকে ভাগ্য, সরস্বতীকে পুষ্টি এবং তুষ্টাকে রূপ ও আকৃতি। ব্ৰাহ্মণসাহিত্যের সর্বত্র এসব শব্দই আলোচ্য দেবতাদের নির্দিষ্ট বিশেষণে পরিণত হয়েছে; ব্ৰাহ্মণসাহিত্যের সর্বপ্রথম অভিব্যক্তি লাভ করার পূর্বে এগুলি সম্ভবত সামূহিক অবচেতনে উপস্থিত ছিল। ব্রাহ্মাণ্য প্রত্নপুরাণে অত্যন্ত গুরুত্বপূৰ্ণ বৈশিষ্ট্য এই যে, আদর্শ চরিত্ররূপে দেবতাদের চিত্রিত করার কোনো প্ৰয়াসই এখানে দেখা যায় না। বহু রচনা প্রকৃতপক্ষে ইন্দ্রের পাপের তালিকা প্ৰণয়ন করেছে, যেমন তাণ্ড্য মহা ব্ৰাহ্মণে (১৩ : ৬ : ৯) রয়েছে, ‘দীর্ঘজিহ্বী’ নামে দানবীকে শক্তিদ্বারা পরাভূত করতে অসমর্থ হয়ে ইন্দ্ৰ কুৎস সুমিত্রের সাহায্যে দানবীকে তাঁর প্রতি কামনাসক্ত করে তুললেন; তারপর দু’জনে মিলে কুৎস সুমিত্রকে বধ করলেন। এছাড়া শালবৃকদের কাছে যোগী সম্প্রদায়ভুক্ত ‘যতি’দের সমর্পণ বিষয়ে যে প্রাচীন প্রত্নকথাটি ইন্দ্র সম্পর্কে প্রচলিত ছিল, তা’ আবার এখানে নতুনভাবে বিবৃত হয়েছে। অবশ্য ইন্দ্র এখানে ‘যতি’দের প্রতি বর্বরোচিত নিষ্ঠুরতা প্ৰকাশ করলেন। ‘বৈখানস’ নামে প্ৰাগাৰ্য সম্প্রদায়টি ইন্দ্রের প্রতিভাজন ছিল। সম্ভবত আক্রমণকারী আর্যদের প্রতি ‘যতি’র বিরাপ মনোভাব প্ৰকাশ করতেন, আর বৈখানসদের মনোভাব ছিল তাদের প্রতি অনুকুল; সেইসঙ্গে তাদের জীবনযাত্রা ধরনের মধ্যেও হয়তো বা ভিন্নতা ছিল।

ব্ৰাহ্মণ সাহিত্যে ইন্দ্রের বহু ত্রুটিবিচ্যুতি আছে। এখানে তাঁর সমস্ত ক্ষমতার একমাত্র উৎস প্রজাপতি। তবে পূর্বতন পর্যায়ের বীরত্বজনিত গৌরব যে সম্পূর্ণ বিস্মৃত হয় নি, তারও প্রমাণ পাওয়া যায়। ইন্দ্ৰ তার অপরাধের প্রায়শ্চিত্ত করার জন্যে তপস্যায় নিরত হয়েছেন। ব্ৰাহ্মণে এরূপ প্রচুর উল্লেখ থাকায় অনুমান করা যায় যে, এতে প্রকৃতপক্ষে বিজয়ী আর্যদের অপরাধীসুলভ মানসিকতা প্রতিফলিত হয়েছে, যেহেতু প্ৰাগাৰ্যদের সঙ্গে বহু যুদ্ধে তারা অন্যায় ও প্ৰবঞ্চনার আশ্রয় নিয়েছিল।