০২. পাঠভেদ (ব্রাহ্মণ)

পাঠভেদ (ব্রাহ্মণ)

প্ৰত্যেক সংহিতার সঙ্গে এক বা একাধিক ‘ব্রাহ্মণ’ সংশ্লিষ্ট রয়েছে; এটা থেকে অনুমান করা যায় যে, আবৃত্তি বা গীতির উপাদানকে ভিন্ন ভিন্ন ধর্মীয় অনুষ্ঠানমূলক

ব্যাখ্যামূলক উপাদান যুক্ত হচ্ছিল। সূত্রসাহিত্য অন্তত তেইশটি ব্রাহ্মণ থেকে উদ্ধৃতি দিয়েছে, যদিও এদের মধ্যে সবগুলি আমাদের কাছে পৌঁছায়নি। এগুলির মধ্যে নিম্নোক্ত গ্রন্থগুলি প্ৰধান :–অহুরক, কঙ্কত, কালবিবি, চরকছাগলেয়, জাবালি, পৈঙ্গায়নি ভাল্লবি, মাসসরাবি, মৈত্রায়ণীয়, রৌরুকি, শায্যায়ন, শৈশালি, স্বেতাশ্বতর ও হরিদ্রাবিক। এই ব্রাহ্মণগুলির লুপ্ত হয়ে যাওয়ার কারণ : পূর্ববতী রচনাগুলির সারাংশ পরবর্তী রচনাগুলির মধ্যেই অনুপ্রবিষ্ট হয়ে যাওয়া; পুনরাবৃত্তির ফলে কিছু কিছু রচনার প্রয়োজন ফুরিয়ে যাওয়া এবং সাধারণভাবে যজ্ঞানুষ্ঠানের ব্যাপারটিরই প্রভাব ক্ষুন্ন হওয়া। কিছু কিছু পুরোহিত পরিবার তাদের নিজস্ব ব্রাহ্মণ’ গ্ৰন্থসহ অধিক ক্ষমতাবান ও জনপ্রিয় প্রতিদ্বন্দ্বীদের দ্বারা সম্ভবত সম্পূর্ণত আচ্ছন্ন হয়ে গিয়েছিলেন, কালক্রমে তাদের পারিবারিক দুর্বলতর ব্রাহ্মণ রচনাগুলি ক্ৰমে অপ্রচলিত হয়ে গিয়েছিল।

ঋগ্বেদের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট ব্ৰাহ্মণ দুটি হ’ল ঐতরেয় ও কৌষীতকি (দ্বিতীয়টি শাখায়ন নামেও পরিচিত)। ঐতরেয় ব্ৰাহ্মণ মোট চল্লিশটি অধ্যায়ে বিন্যস্ত; প্রত্যেকটি অধ্যায় আটটি পঞ্চকে (বা পঞ্চিকায়) বিভক্ত। প্রাচীন ঐতিহ্য অনুযায়ী এ গ্রন্থের রচয়িতা মহীদাস ঐতরেয়। সম্ভবত, এই ব্রাহ্মণটি পূর্বপ্রচলিত কিছু রচনার সংকলন। এর প্রধান বিষয়বস্তু হ’ল সোমযাগ, এবং অগ্নিহোত্ৰ (অগ্নিদেবের প্রতি প্রাত্যহিক দুগ্ধ-হব্যদান)। রাজসূয়-যজ্ঞও এতে বর্ণিত হয়েছে। কীথের অভিমত এই যে, ঐতরেয় ব্ৰাহ্মণ প্রকৃতপক্ষে জৈমিনীয় ও শতপথ ব্ৰাহ্মণ অপেক্ষা প্রাচীনতর–এমনকি, তৈক্তিরীয় সংহিতার ব্রাহ্মণ গোত্রের অংশগুলি অপেক্ষাও ঐতরেয়কে প্রাচীনতর বলা চলে। ঐতরেয় ব্রাহ্মণের রচনাশৈলী সাধারণভাবে বর্ণনাত্মক ও মাঝে মাঝেই প্রসঙ্গবিচুত। ব্যাকরণ ও নিরুক্তের সম্বন্ধে এতে যে স্পষ্ট দৃষ্টিভঙ্গি পরিস্ফুট হয়েছে, তা বহুলাংশে যাস্কের কথাই স্মরণ করিয়ে দেয়; সম্ভবত এই দুটি গ্রন্থ রচনাকালের দিক দিয়ে পরম্পরের নিকটবর্তী ।

যদিও বিষয়বস্তুর ক্ষেত্রে সাধারণত ঐতরেয় ও কৌষীতকি ব্ৰাহ্মণ পরম্পর সংলগ্ন, তবু কিছু কিছু অংশে আবার দুটি গ্রন্থ সম্পূৰ্ণভাবেই পরস্পরবিরোধী মত ব্যক্ত করেছে। সম্ভবত, এটা প্ৰাচীনতম ব্ৰাহ্মণ প্রন্থের দ্বিধা বিভাগের ইঙ্গিত বহন করেছে; যাজ্ঞিক পণ্ডিতদের মধ্যে আনুষ্ঠানিক অনুপুঙ্খ সম্পর্কে মতভেদ হওয়ার ফলেই সম্ভবত তাঁরা অভিন্ন মূল গ্ৰন্থকে বিভাগ করার সিদ্ধান্ত গ্ৰহণ করেছিলেন। ঐতরেয় ব্রাহ্মণের শেষ দশটি অধ্যায় কৌষীতকিতে পাওয়া যায় না। সম্ভবত, এই অংশে ঐতরেয়তে পরবর্তী কালে সংযোজিত হয়েছিল। কৌষীতকির প্রথম ছাটি অধ্যায়ের বিষয়বস্তু হ’ল : অগ্ন্যাধান, দর্শপূর্ণমাস ও চতুর্মাস্য। পরবর্তী বাইশটি অধ্যায়ে শুধুমাত্র সোমযাগই আলোচিত হয়েছে; এই অংশ অন্যটির তুলনায় অর্বাচীনতর; যেহেতু শৈলীগত বিচারে এটি অধিক সামঞ্চস্যপূর্ণ ও সম্পাদনার দিক দিয়ে আরো সুবিন্যস্ত। কিন্তু অন্যদিকে ঐতরেয় ব্রাহ্মণকে বহু ব্যক্তির প্রয়াস সৃষ্ট অসংলগ্ন ‘ব্রাহ্মণ’ জাতীয় রচনার একটি বিশৃঙ্খল সংকলন বলেই মনে হয়।

প্রাচীনতর অভিন্ন ব্ৰাহ্মণের সম্ভাব্য বিভাজনের আরো একটি কারণ হ’ল ঐতরেয় ব্রাহ্মণের ভৌগোলিক পটভূমিকায়, যেখানে কুরুপাঞ্চাল ও বশউশীনর অঞ্চল, কৌষীতকিতে সেখানে নৈমিষারণ্য। এই তথ্যটি ঐতিহাসিক কালক্রমের দ্বারা নির্দিষ্ট আঞ্চলিক ভিন্নতার প্রতি আমাদের দৃষ্টি আকর্ষণ করে : আৰ্যরা যখন দক্ষিণপূর্বদিকে আরো কিছুদূর অগ্রসর হয়েছিলেন, সে সময় রচিত অর্বাচীনতর ব্রাহ্মণ গ্ৰন্থসমূহের অন্যতম হ’ল কৌষীতকি । এটি যজুর্বেদের (সংহিতা ও ব্রাহ্মণ) শেষাংশের ব্ৰাহ্মণ গোত্রের অংশগুলি রচনার সমকালীন; সম্ভবত, অথর্ববেদও তখনই সংকলিত হচ্ছিল। বৈদিক দেবসঙ্ঘে বিলম্বে আগত ঈশান মহাদেবের উল্লেখ এখানে পাই। অর্বাচীনতা সম্পর্কে ভাষাতাত্ত্বিক সাক্ষ্য ছাড়াও অধিক পরিশীলিত ভাষা প্রয়োগের কেন্দ্ৰ উত্তর ভারতে শিক্ষার্থীরা যে শিক্ষাগ্ৰহণের জন্যে আসত তার উল্লেখও কামরা লক্ষ্য করি। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে যজ্ঞানুষ্ঠান বিষয়ে বিশেষজ্ঞদের সংখ্যা বহুগুণ বধিত হ’ল। তাই কৌষীতকির পরবর্তীর অংশে প্রায়ই বিশেষরূপে পিঙ্গ ও কৌষীতক-এর নাম উল্লিখিত হয়েছে–বিশেষত যজ্ঞবিষয়ে কৌষীতককে অপ্ৰতিদ্বন্দ্বী রূপে গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে; অথচ এই নামগুলি ঐতরোয়ে মাত্র একবার পাওয়া যায়।

ব্ৰাহ্মণ সাহিত্যে সামবেদ সমৃদ্ধতম। সামবেদীয় ব্রাহ্মণগুলির মধ্যে সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ হ’ল তাণ্ড্য মহাব্ৰাহ্মণ বা পৌঢ় বা পঞ্চবিংশ ব্রাহ্মণ। শেষোক্ত নাম থেকে সহজেই বোঝা যায় যে, এতে পাঁচশটি অধ্যায় রয়েছে। হিন্টার নিৎসের মতে এটি প্রাচীনতর ব্রাহ্মণগুলির অন্যতম এবং কিছু কিছু লক্ষণীয় বৈশিষ্ট্য একে অনন্য করে তুলেছে। এ ব্ৰাহ্মণটি পড়ে যে নীরস ও শুষ্ক ব’লে মনে হয়, সম্ভবত তার কারণ এই যে, এর অতীন্দ্ৰিয় প্রবণতার আতিশয়্য। পরবর্তী প্রজন্মের নিকট সম্পূর্ণ তাৎপৰ্যহীন বলে প্রতিভাত হয়েছিল। তবে, এই গ্রন্থের প্রকৃত গুরুত্ব এই যে, এতে বহু দেবকাহিনী ও লোকশ্রুতি সংকলিত হয়েছে। সামবেদের ব্ৰাহ্মণরূপে এর মুখ্য আলোচ্য বিষয় হ’ল সামমন্ত্র, সামগানের পদ্ধতি ও উপলক্ষ্য; সংশ্লিষ্ট অতিপ্ৰাকৃত কাহিনী ও তৎপ্রসূত সুফল। অগ্নিক্টোম থেকে শুরু করে বিশ্বসৃজাময়ন (কিংবদন্তী অনুযায়ী একসহস্র বর্ষব্যাপী একটি যজ্ঞ) পর্যন্ত মোট সাতাশি ধরনের যজ্ঞানুষ্ঠান এই গ্রন্থে বিবৃত হয়েছে। কাত্যায়ন ও আপস্তম্ব শ্রৌতসূত্রে নির্দেশিত ক্রম অনুযায়ী যজ্ঞগুলি এখানে বিন্যস্ত।

তাণ্ড্য মহাব্ৰাহ্মণ প্রকৃতপক্ষে সামবেদ সংহিতার সম্পূরক একটি রচনা। এই ব্ৰাহ্মণের প্রথম অধ্যায়ে প্রচুর যজুর্মন্ত্র থাকায় স্পষ্টই প্রমাণিত হচ্ছে যে, সাহিত্যমাধ্যমরূপে ব্ৰাহ্মণটি যজুর্বেদীয় আনুষ্ঠানিক রচনারই যুক্তিযুক্ত ধারাবাহিক অভিব্যক্তি। রচনাকাল নিৰ্ণয় করতে গিয়ে আমরা বিষয়বস্তুর একটি বিশেষ দিক অর্থাৎ ব্রাত্যস্তোমের প্রতি মনোনিবেশ করতে বাধ্য হই। কুরু ও পাঞ্চাল অঞ্চল এই গ্রন্থের ভৌগোলিক পটভূমিকা নয়; সরস্বতী ও দৃষদ্বতী নদীর মধ্যবতী পাঞ্জাবের অববাহিকা অঞ্চল এর পৃষ্ঠভূমি।

ষড়্‌ বিংশ ব্রাহ্মণ স্পষ্টতই পঞ্চবিংশের ধারাবাহিক সম্প্রসারণ। এই গ্ৰন্থ ছাটি প্ৰপাঠক ও সাতচল্লিশটি খণ্ডে বিভক্ত। একাহ অনুষ্ঠানের জন্যে প্রযোজ্য রহস্যগূঢ় সুব্রহ্মণ্য সূত্র এর প্রধান বিষয়বস্তু। এর মধ্যে কিছু কিছু অথর্ববেদীয় বৈশিষ্ট্যও চোখে পড়ে যা মূলত শত্রুর ক্ষতি করার উদ্দেশ্যে প্ৰযুক্ত এবং ঐ জাতীয় ক্ষেত্রে বর্ণনার মধ্যে যা সবিশেষ পরিস্ফুট হয়েছে। আষেয় কল্পের মত পরবর্তী রচনায় এই গ্রন্থের অস্তিত্ব স্বীকৃত বলে আলোচ্য ব্ৰাহ্মণটি অন্তত এইসব রচনার তুলনায় প্রাচীনতর। এর মধ্যে প্রধানত–প্ৰায়শ্চিত্ত ও অভিসম্পাতের সূত্রগুলি রয়েছে। সামবেদীয় ব্ৰাহ্মণগুলির মতোই এই গ্রন্থের প্রাথমিক লক্ষ্য হ’ল সাম্যমন্ত্র ও সেগুলির অতীন্দ্ৰিয় অনুষঙ্গ। তেমনি সাধারণ ব্ৰাহ্মণ-সাহিত্যের মতোই এই গ্রন্থে আছে বিভিন্ন প্রত্নকথা, নিরুক্তি; বিশেষত কারুবিদ্যা সম্পর্কে প্ৰযুক্ত শব্দগুলির ব্যুৎপত্তিগত ও আধ্যাত্মিক বিষয়ে বিতর্ক রয়েছে। দেবতা ও দানবদের যুদ্ধসম্পর্কিত কাহিনীগুলি নতুন অনুষ্ঠান প্রবর্তনের প্রস্তাবনারূপে ব্যবহৃত হয়েছে। পরবর্তী সমস্ত সামবেদীয় ব্ৰাহ্মণের মতো এই গ্রন্থেও সূত্র ও ছন্দগুলির ব্যাখ্যা অতিপ্ৰাকৃতস্তরে। বিভিন্ন সূক্তের আনুষ্ঠানিক বিনিয়োগও এতে বৰ্ণিত হয়েছে। ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র দেবকাহিনী এবং যজ্ঞভূমির নিকটে বিচরণশীল দানব ও রাক্ষসদের বিনাশসাধনের জন্যে উদ্বেগ ও ধবংসপ্ৰচেষ্টা এই ব্ৰাহ্মণের সর্বত্র ইতস্তত বিক্ষিপ্ত। কিছু কিছু প্ৰত্নকথা সৃষ্টিতত্ত্বমূলক ও হেতুসন্ধানের বৈশিষ্ট্যযুক্ত, আবার কিছু কিছু উপনিষদের ভাবনায় নিজ্ঞাত। প্রধান ব্রাহ্মণগুলির মতো এই গ্রন্থেও সামবেদ এবং তৎসংশ্লিষ্ট পুরোহিত ও অনুষ্ঠানের সঙ্গে সম্পর্কিত কারুবিদ্যামূলক শব্দের ছদ্ম ব্যুৎপত্তি দেওয়ার চেষ্টা রয়েছে। প্ৰায়শ্চিত্ত, বিনাশাত্মক ইন্দ্ৰজাল, যুপকাষ্ঠ, অগ্নিহোত্র, ‘স্বাহা’ শব্দের উচ্চারণ। (‘স্বাহা’ এখানে দেবীরূপে গণ্য) ইত্যাদি সমস্ত কিছুরই অতীন্দ্ৰিয় অনুষঙ্গ ব্যাঘাত হয়েছে। ‘পলাশ’ (আক্ষরিক অর্থে ‘মাংসাশী’ অর্থাৎ রাক্ষস) শব্দের মধ্যে সংখ্যাবিষয়ক অতীন্দ্ৰিয় প্রবণতা ও শুভকর ইন্দ্ৰজালি লক্ষণীয়। দৈবত ব্ৰাহ্মণ দুটি ভাগে বিভক্ত ও একান্নটি সংক্ষিপ্ত সূত্রের সংকলন। ‘অদ্ভূত’ ব্ৰাহ্মণ এরই পরিশিষ্ট, প্রকৃতপক্ষে বড়বিংশের শেষতম অধ্যায়ের সঙ্গে সংযোজিত অংশ। কিছু কিছু সামবেদীয় সূত্রের সঙ্গে এর সাদৃশ্য রয়েছে; যেহেতু এই গ্রন্থের প্রধান আলোচ্যবিষয় অপ্রত্যাশিত ঘটনা, ভাবী অমঙ্গলের পূর্বসূচনা ও তা’ নিবারণের উদ্দেশ্যে অনুষ্ঠান এবং শস্যহানি, বজ্ৰপাত ও ভূমিকম্পজাতীয় প্রাকৃতিক দুৰ্যোগ নিবারণের উপযুক্ত ক্রিয়াকল্প। ‘প্রতিমা’র উল্লেখ থাকায় এই গ্রন্থের রচনাকাল বহু পরবর্তী যুগের বলে নির্দেশ করা সম্ভব।

‘শার্ট্যায়ন’ ব্ৰাহ্মণ থেকে গৃহীত বহু উদ্ধৃতি প্রকৃতপক্ষে জৈমিনীয় ব্রাহ্মণে খুঁজে পাওয়া যায়। যেহেতু ‘শাট্যায়ন ব্ৰাহ্মণ’ নামে কোনো গ্ৰন্থ আমাদের কাছে এসে পৌঁছায়নি, তাই খুব সম্ভব এই গ্রন্থের অধিকাংশ উপাদানই জৈমিনীয় ব্রাহ্মণ আত্মসাৎ করে নিয়েছিল। জৈমিনীয় ব্ৰাহ্মণ ও পঞ্চবিংশ ব্রাহ্মণের বিষয়বস্তুর মধ্যে যথেষ্ট সাদৃশ্য রয়েছে। উভয় গ্রন্থেই সামমন্ত্র, গায়কদের কর্তব্য ও তৎসংশ্লিষ্ট অনুষ্ঠানবিশেষত সোমযোগের বিভিন্ন রূপান্তর বিবৃত হয়েছে। তবে পঞ্চবিংশ ব্রাহ্মণ যেখানে অনুষ্ঠান সম্পর্কিত বিষয় সম্বন্ধে অধিক মনোযোগী, সেখানে অপেক্ষাকৃত দীর্ঘ জৈমিনীয় ব্রাহ্মণটিতে কিছু কিছু প্ৰত্নকথা ও কিংবদন্তীও বিবৃত।

ভাষাতাত্তিক বিচারে পঞ্চবিংশ ব্রাহ্মণ জৈমিনীয় ব্রাহ্মণ অপেক্ষা প্ৰাচীনতর। জৈমিনীয়তে এমন কিছু অনুষ্ঠান ব্যাখ্যাত হয়েছে (যেমন মহাব্রত ও গোসাব) যেগুলি পঞ্চবিংশে পাওয়া যায় না; সম্ভবত, এই দুই গ্ৰছেবি মধ্যবতী পার্থক দুটি যজ্ঞানুষ্ঠানগত ঐতিহ্যের ভিন্নতার ফলেই সৃষ্টি হয়েছিল—একটি গ্রন্থে আপাও দৃষ্টিতে বর্বর জনগোষ্ঠীর অনুষ্ঠান ও স্থান পেয়েছিল অনাগ্রন্থে তা” দেখা যায় না। এই দৃষ্টিভঙ্গি অনুযায়ী জৈমিনীয় ব্রাহ্মণে প্রচুর প্রত্নকথা ও লোকশ্রুতি অন্তর্ভুক্ত হওয়ার ফলেই তা’ অপেক্ষাকৃত পরবর্তী, অধিক বিস্তৃত ও ব্যাপকতর রচনারূপে প্রতিভাত হয়।

বর্তমানে ‘ছান্দোগ্য’ ব্রাহ্মণ নামে পরিচিত গ্রন্থটি প্রকৃতপক্ষে ছান্দোগ্য উপনিষদ। একটি নির্দিষ্ট শাখার অন্তর্গত সমস্ত সমাবেদীয় পাঠের শ্রেণীগত নামরূপে ছান্দোগ্যকে যেহেতু গ্ৰহণ করা হয়, তাই এমনও হতে পারে যে, মূলত পঞ্চবিংশ ব্রাহ্মণ, ষড়বিংশ ব্ৰাহ্মণ ও অদ্ভুত ব্ৰাহ্মণ একত্রে ছান্দোগ্য ব্ৰাহ্মণকে গঠন করেছিল। প্রচলিত পাঠে প্ৰথম দুটি অধ্যায় পাওয়া যায় না, আবার এর শেষ আটটি অধ্যায় নিয়ে ছান্দোগ্য উপনিষদ গড়ে উঠেছে।

সামবেদের গৌণ ব্ৰাহ্মণগুলির মধ্যে ‘দেবতাধ্যায়’ নামের ছোট উপব্রাহ্মণটি তিনটি অধ্যায়ে বিন্যস্ত ক্ষুদ্র সারগ্রন্থ এবং নামকরণের মধ্যেই ইঙ্গিত রয়েছে যে, এতে সেইসব দেবতাদের নামের তালিকা রয়েছে যাদের উদ্দেশে সাম্যমন্ত্রগুলি রচিত হয়েছিল।

পাঁচটি অধ্যায়ে বিভক্ত তথাকথিত ‘সংহিতোপণিষদ’ ব্ৰাহ্মণ স্পষ্টতই পরবর্তীকালের রচনা; এখানে শিক্ষকদের প্রতি প্ৰদত্ত দক্ষিণই বিশেষ গুরুত্ব পেয়েছে। এই গ্রন্থে প্রধানত সামমন্ত্র গানের সুফল এবং সুরনিবন্ধ শব্দের গায়ন পদ্ধতি বৰ্ণিত হয়েছে।

তিনটি অধ্যায়ে বিন্যস্ত বংশ’ ব্ৰাহ্মণের নামের মধ্যেই এই ইঙ্গিত স্পষ্ট যে, এই প্রন্থে শুধুমাত্র সামবেদের অধ্যাপকদের বংশতালিকা রয়েছে।

বহু পরবর্তীকালের রচনা ‘সামবিধান ব্রাহ্মণ’কে ব্রাহ্মণ সাহিত্যের অন্তর্ভুক্ত করা কঠিন, কেননা এর বিষয়বস্তু সূত্ৰ সাহিত্যেরই কাছাকাছি। জীবনের মূলাধার রূপে সুর ও তালকে মহিমান্বিত করা ছাড়াও এই গ্ৰন্থ অমঙ্গল, দানবশক্তি ও বিবিধ প্রকারের বিপদ নিবারণের উপায় এবং বাস্তব জীবনের সমৃদ্ধি নিশ্চিত করার পদ্ধতি বিবৃত করেছে। ধ্বংসাত্মক নেতিবাচক ইন্দ্ৰজালের ভূমিকা, বিশেষত দাম্পত্য সম্পর্কের ক্ষেত্রে, এতে বেশ প্রাধান্য পেয়েছে। এই গ্রন্থে পুনর্জন্ম থেকে মুক্তির অঙ্গীকার উচ্চারিত হয়েছে; তবে সবচেয়ে কৌতুহলপ্ৰদ তথ্য এই যে, গ্রন্থের শেষে ভারতমাতার একটি ভাবমূর্তি; কল্পিত মাতৃভূমির উত্তরসীমায় হিমালয় ও দক্ষিণে কন্যাকুমারী; এই দেবীর উপাসনাই মোক্ষের ধ্রুব উপায়। আয়ুৰ্বেদ ও চিকিৎসা বিদ্যালয়ের প্রতিষ্ঠার উল্লেখও এতে রয়েছে এবং এসব তথ্য থেকে প্রমাণিত হচ্ছে যে এই গ্ৰন্থকে বৈদিক যুগের চেয়ে স্মৃতির অর্থাৎ পৌরাণিক যুগের রচনা বলেই নির্দেশিত করা উচিত।

কৃষ্ণ যজুর্বেদের একটিমাত্র ব্রাহ্মণ আমাদের হাতে পৌঁছেছে, তৈত্তিরীয়। তৃতীয় ও শেষ অধ্যায় ছাড়া এ গ্রন্থটির অন্যান্য অংশকে তৈত্তিরীয় সংহিতার অবিচ্ছিন্ন সংযোজন রূপেই গণ্য করা চলে-সমগ্ৰ ব্ৰাহ্মণটি বারোটি প্ৰপাঠকে বিন্যস্ত। সামগ্রিকভাবে আপাস্তম্বকেই তৈত্তিরীয় ব্রাহ্মণে রচয়িতা বলে উল্লেখ করা হয়, কিন্তু শেষ তিনটি প্ৰপাঠকে লেখক রূপে কঠ উল্লিখিত হয়েছে, গ্রন্থের উপসংহারেও রয়েছে কঠোপনিষৎ ।

ব্ৰাহ্মণ সাহিত্যের মধ্যে দীর্ঘতম ও সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ রচনা শতপথ ব্ৰাহ্মণ, এটি শুক্ল যজুর্বেদের অন্তর্গত। যজুর্বেদ সংহিতার মতো এই ব্ৰাহ্মণটিও দুটি শাখায় বিভক্ত,-কাশ্ব ও মাধ্যন্দিন-রূপে আমাদের কাছে পৌঁছেছে। কথা শাখায় সতেরোটি কাণ্ড, সেগুলিও আবার প্রপাঠকে বিভক্ত। মাধ্যন্দিন শাখা থেকেই এই ব্ৰাহ্মণের নামকরণে ‘শতপথ’ শব্দটি ব্যবহাত হয়েছে; কেননা মাধ্যন্দিন শাখায় চৌদ্দটি কাণ্ড একশটি অধ্যায় বা আটষট্টিটি প্ৰপাঠকে উপবিভক্ত–এ ছাড়াও ক্ষুদ্রতর বিভাগ এই গ্রন্থে চারশ আটত্রিশটি ব্রাহ্মণে ও সাতহাজার ছশ চবিবশটি কণ্ডিকা রয়েছে। শতপথ ব্ৰাহ্মণের কাণ্ব ও মাধ্যন্দিন শাখার প্রধান পার্থক্য এই যে, প্রথমোক্ত শাখায় উদ্ধারী, রাজপেয় ও রাজসূয় যজ্ঞ সম্পর্কে তিনটি অতিরিক্ত অংশ রয়েছে। বিষয়-বিন্যাসের ক্ষেত্রে দুটি শাখার মধ্যে পার্থক্য লক্ষ্য করা যায়।

শতপথ ব্ৰাহ্মণের সংকলন কতকটা পরবর্তীকালে হলেও এর বিষয়বস্তুর মধ্যে প্রচুর প্রাচীনতর উপাদান রয়েছে। এই গ্রন্থে রুদ্রকে পরবর্তীকালের মহাদেব” নামে অভিহিত করা হয়েছে; আমরা আরও একজন পরবর্তী দেবতা, “পুরুষ নারায়ণের প্ৰথম উল্লেখ এখানে লক্ষ করি; পরবর্তী অৰ্ধদেবতা কুবের বৈশ্রবর্ণেরও প্রথম উল্লেখ এখানেই পাওয়া যায় ।

শতপথ ব্ৰাহ্মণে উল্লিখিত দুজন রচয়িতার মধ্যে শাণ্ডিল্যের নাম ষষ্ঠ থেকে নবম অধ্যায়ে প্রায়ই চোখে পড়ে; এই অংশে যাজ্ঞবল্ক্যের নাম পাওয়াই যায় না। তাই মনে হয়, শাণ্ডিল্যই সম্ভবত ঐ চারটি অধ্যায়ের রচয়িতা ছিলেন। অন্যদিকে যাজ্ঞবল্ক্য বাকি অংশের প্রণেতা। শাণ্ডিল্য রচিত অংশে উত্তর-পশ্চিম অঞ্চলে ভৌগোলিক পটভূমিকা স্পষ্ট, কিন্তু যজ্ঞবল্ক্য রচিত অংশে বিদেহের মতো দক্ষিণপূর্ব অঞ্চলের উল্লেখ লক্ষণীয়। সুতরাং শেষোক্ত অংশ সম্ভবত পরবর্তী কালে রচিত হয়েছিল। তখন লৌহনির্মিত সামগ্ৰী ও লাঙলের সাহায্যে কৃষিভূমি খনন করে এবং অরণ্যভূমি নির্মূল করে কিছু ব্যাপকভাবে কৃষিকাৰ্য সম্ভব করা হয়েছিল। সেই যুগে আর্যরা ক্রমশ দক্ষিণ-পূর্ব অঞ্চলে অগ্রসর হচ্ছিলেন, অতএব শাণ্ডিল্য রচিত অধ্যায়গুলিই গ্রন্থের প্রাচীনতর অংশ। অন্যদিকে দশম থেকে চতুর্দশ অধ্যায় পরবর্তীকালে বৈদিক যুগের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিত্ব যাজ্ঞবল্ক্য কর্তৃক রচিত ও পরে সংযোজিত হয়েছিল। বিষয়বস্তুর অভ্যন্তরীণ সাক্ষ্যপ্রমাণ থেকেও শেষোক্ত অংশকে পরবর্তীকালে রচিত বলে গ্রহণ করা যায়। তখন প্রশাসকররূপে রাজার ভূমিকা সমাজে দৃঢ়ভাবে প্রতিষ্ঠিত, সামাজিক ও রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠাগুলির উন্নততর পর্যায় যেমন চোখে পড়ে, তেমনি বৈশ্রাবর্ণের মতো উপদেবতা ও পিশাচ যোনির উল্লেখ থেকেও ঐ অংশের বিলম্বিত আবির্ভাব সম্পর্কে সিন্ধান্ত নেওয়া যায়।

যথাৰ্থ বৈদিকযুগ সমাপ্ত হওয়ার বহুদিন পরে যখন বৌদ্ধধর্মের উন্মেষ ও বিলয় হয়ে গেছে, সম্ভবত ব্ৰাহ্মণ্যধর্মের পুনরুত্থানের যুগে আমরা সামবিধান ও ঋগবিধান ব্ৰাহ্মণের মতো ‘বিধান’ ব্ৰাহ্মণ জাতীয় জাদু-অনুষ্ঠানকেন্দ্ৰিক নানা বিশ্লেষণপূর্ণ বিশেষ এক ধরনের রচনার সন্ধান পাই। এই শ্রেণীর গ্রন্থে অনুষ্ঠানগুলি যেমন বিশ্লেষিত হয়েছে, তেমনি সামগীতি ও মন্ত্র আবৃত্তি এখানে জাদুক্ৰিয়া রূপে বৰ্ণিত। বস্তুত, যথাৰ্থ বৈদিক অনুষ্ঠানকে ব্যাখ্যা করার চেয়ে এ ধরনের গ্রহে বিপদ নিবারণের আশু উপায়, প্রকৃতি ও সমাজের অভিসম্পাত, ভাবী অকল্যাণসূচক চিহ্ন, (নিমিত্ত ও ‘শকুন’ নামে যা পরবর্তীকালে চিহ্নিত) অশুভপ্রদ ও ক্ষতিকারক জাদু, ইত্যাদিই অধিকমাত্রায় বিবৃত হয়েছে। সামগ্রিকভাবে ব্ৰাহ্মণ সাহিত্যের সঙ্গে এদের সম্পর্ক নিতান্ত ক্ষীণ ও বাহ্য; এরা যে ‘ব্রাহ্মন’ অভিধা আত্মসাৎ করেছে, তার কারণ আপাতদৃষ্টিতে যজ্ঞানুষ্ঠান সম্পর্কেই এদের মনোযোগ পরিস্ফুট হয়েছে। কিন্তু তা শুধু আপাতদৃষ্টিতেই।

‘আৰ্যোয়’ ব্ৰাহ্মণ গ্রন্থটি সূত্ৰ-ঐতিহ্যের অন্তর্গত আরও একটি বিলম্বিত রচনা; কৌথুম শাখার অন্তবর্তী সামবেদের অর্বাচীনতর রচনাগুলির সঙ্গে সূত্ৰ-সাহিত্যের সাযুজ্য একটি লক্ষণীয় বৈশিষ্ট্য। আর্যেয় নামের মধ্যে যদিও ঋষিদের সঙ্গে সম্পর্কের ইঙ্গিত রয়েছে, প্রকৃতপক্ষে এটি ‘গণ’গুলির বিবিধ নামের তালিকা। মাঝে মাঝে কোনো ঋষিকে তঁর রচনা অনুযায়ী উল্লেখ করা হয়েছে, প্রায়ই ঋষির নিজস্ব নামের চেয়ে বিশেষণটি অধিক জনপ্রিয় বলে মনে হয়। এই ব্ৰাহ্মণে উল্লিখিত গানগুলি পূর্বাচিক ও মহানাম্ন্যার্চিকের অন্তর্গত গ্রামগেয় ও অরণ্যগেয় গীতিসংগ্রহ থেকে উৎকলিত হয়েছে; উত্তরার্চিকের ঊহ ও উহ্যগান। এখানে উদ্ধৃত হয় নি। কীথ অবশ্য ‘মন্ত্র’ ও আর্যেয় ব্রাহ্মণকে একই গ্রন্থের দুটি অধ্যায় বলে মনে করেন। রচনাশৈলীতে অর্বাচীনতার পরিচয় স্পষ্ট; কালগত অসঙ্গতির অভিব্যক্তির মাধ্যমে প্ৰাচীনতার ভাণ করে কৃত্রিমভাবে রচনাকালকে পিছিয়ে দেবার কোনো প্ৰয়াস এখানে দেখা যায় না।

আর্যরা যে আর্যাবর্তে তাদের আদি বাসভূমি থেকে সরে এসেছিল, তার ভৌগোলিক প্রমাণ স্পষ্ট। উত্তর-পশ্চিম সীমান্ত অঞ্চল ও পাঞ্জাব থেকে তারা পূর্বদক্ষিণ অঞ্চলের অন্যত্র এসেছেন বলেই সম্ভবত ঐ উত্তর-পূর্ব অঞ্চলের প্রতি যেন কতকটা তাচ্ছিল্য প্ৰকাশিত হয়েছে। স্পষ্টতই এই ব্ৰাহ্মণ মগধের নিকটবর্তী পূর্বাঞ্চলের দূরতম কোনো প্ৰান্তে রচিত হয়েছিল। এই অঞ্চল সম্পর্কে নিষেধাজ্ঞা তখনো পর্যন্ত বলবৎ থাকলেও পূর্বাঞ্চলের জনসাধারণের সঙ্গে আর্যদের পারস্পরিক সংমিশ্রণের কিছু কিছু প্রমাণও পাওয়া যায়, বস্তুত এই স্থানীয় অধিবাসীদের বসতির সীমানা এখন আর্যাবর্তের পূর্ব সীমান্তে। আর্যরা যেহেতু উত্তর-পশ্চিম দিক থেকে দক্ষিণ-পূর্বাঞ্চলের দিকে ক্রমশ অগ্রসর হচ্ছিলেন, পূর্বদিকে ক্রমাগত অনুপ্রবেশও ঐ অঞ্চলের জনসাধারণের সঙ্গে ক্রমবর্ধমান সম্পর্ক এই ব্ৰাহ্মণের অর্বাচীনতার প্রমাণই বহন করছে।

বৈদিক সাহিত্যে অথৰ্ববেদ অনেক বিলম্বে গৃহীত হয়েছিল, তাই তার একটিমাত্র ব্ৰাহ্মণেই রয়েছে : গোপথ ব্রাহ্মণ। এর বিষয়বস্তু সূত্র সাহিত্যের অধিকতর নিকটবর্তী; কোনো কোনো পণ্ডিতের মতে এই গ্ৰন্থ অথর্ববেদের বৈতান-সূত্র অপেক্ষাও পরবর্তী। এটি যে দুটি অধ্যায়ে বিন্যস্ত, তাদের মধ্যে পূর্ব ব্রাহ্মণ নামে প্ৰথম অধ্যায়ের পাঁচটি প্ৰপাঠক ও উত্তর ব্রাহ্মণ নামে দ্বিতীয় অধ্যায়ের ছাটি প্ৰপাঠক। পূর্ব ব্রাহ্মণের বিষয়বস্তু হ’ল সৃষ্টিতত্ত্ব, প্ৰণব ও গায়ত্রীর অতীন্দ্ৰিয় তাৎপৰ্য, ব্ৰহ্মচারীর কর্তব্য, অমাবস্যা ও পূর্ণিমার রহস্য, সূত্রের নিগূঢ় রহস্যময় তাৎপর্য এবং পুরোহিতদের আনুষ্ঠানিক ভোজন। এ ছাড়াও এতে ছন্দশাস্ত্ৰ সম্পর্কেও একটি অংশ রয়েছে। উত্তরব্ৰাহ্মণে কিছু কিছু প্ৰধান যজ্ঞ বিবৃত হয়েছে; তবে অথর্ববেদের ব্ৰহ্মা শ্রেণীর পুরোহিতের কর্তব্য ও অধিকার এবং যজ্ঞানুষ্ঠানে তার অবস্থানই দ্বিতীয় অধ্যায়ের মূল বর্ণনীয় বস্তু। সমগ্র গ্রন্থের গঠন শিথিল এবং সম্পাদনায় যত্নের অভাব স্পষ্ট।

ঐতরেয় ব্ৰাহ্মণ প্ৰাচীনতর গ্রন্থগুলির অন্যতম; এই গ্ৰন্থ বিশ্লেষণ করে আমরা ব্ৰাহ্মণগুলি রচনার কারণ সম্পর্কে স্পষ্ট ধারণা করতে পারি, কেননা এই গ্রন্থের অন্যতম প্রধান বর্ণনীয় বিষয় হ’ল যজ্ঞানুষ্ঠানের উদ্দেশ্য। এখানে বিভিন্ন দেবকাহিনীর মাধ্যমে যজ্ঞাপ্লির প্রয়োজনীয়তার উপর গুরুত্ব আরোপ করা হয়েছে। তবে সমস্ত অনুষ্ঠানের চুড়াও লক্ষ্য রূপে খাদ্য উৎপাদনের উপর বিশেষ শুরুত্ব আরোপ এই গ্রন্থের একটি লক্ষণীয় বৈশিষ্ট্য। সৃষ্টি, গোসম্পদলাভ ও সন্তানলাভকেও যজ্ঞের অন্যতম প্ৰধান উদ্দেশ্যরূপে উপস্থাপিত করা হয়েছে। এই প্ৰাচীনতর ব্রাহ্মণেও আমরা পুরোহিতদের বিভিন্ন কার্যকলাপ এবং দক্ষিণা গুরুত্ব সহকারে বিবৃত হতে দেখি। যজ্ঞের ক্রমবর্ধমান জটিলতা ও তৎসংশ্লিষ্ট তাৎপর্য কিছু কিছু নির্দেশ থেকে স্পষ্ট হয়ে ওঠে। ঐতরেয় ব্রাহ্মণে প্ৰায় অন্তহীনভাবে পুনরাবৃত্ত দীর্ঘ গদ্য সূত্র এবং প্রত্যেকটি আনুষ্ঠানিক অনুপুঙ্খের প্রয়োগকে যুক্তিগ্রাহারূপে প্রতিষ্ঠিত করার জন্যে বহু দেরকাহিনী উদ্ভাবিত হয়েছে। এমনকি এই প্ৰাচীনতম ব্ৰাহ্মণ গ্রন্থেও সেইসব বৈশিষ্ট্য উপস্থিত যেগুলির প্রভাবে ব্ৰাহ্ম, গ্রন্থগুলি সাহিত্য হিসাবে সাধারণভাবে অনাকর্ষণীয় হয়ে উঠেছিল। সমগ্ৰ ব্ৰাহ্মণ সাহিত্যে পরিব্যাপ্ত বৈশিষ্ট্য হ’ল সংহিতা-বহির্ভুত তাবৎ যজ্ঞসম্পর্কিত—এমনকি যজ্ঞ-বহির্ভূত-ধর্মীয় ও তৎকালীন লোকসমাজ থেকে এই প্ৰাচীনতম সংকলিত বস্তু এই ব্ৰাহ্মণ গ্ৰন্থটিতেও আমরা লক্ষ্য করি।

ঋগ্বেদের দ্বিতীয় ব্ৰাহ্মণ অর্থাৎ কৌষীতকি বা শঙ্খায়ন আবার অর্বাচীনতর। ব্ৰাহ্মণগুলিব অন্যতম। এই ব্ৰাহ্মণের রচয়িতা সম্বন্ধে আমরা স্বচ্ছন্দে এই সিদ্ধান্ত উপনীত হতে পারি। যে অসংখ্য ব্যক্তির প্রচেষ্টায় রচিত এই গ্রন্থে যে সমস্ত ঋষির নাম উল্লিখিত হয়েছে, কুষীতক বা কৌষীতকি তাদের অন্যতম। আমরা পূর্বেই উল্লেখ করেছি যে প্ৰাথমিক পর্যায়ে ঋগ্বেদের একটিমাত্ৰ ব্ৰাহ্মণ ছিল; পরবর্তী কালে বিভিন্ন ঋষিপরিবার ও অঞ্চলের মধ্যে ভিন্নমত দেখা দেওয়ায় মূল গ্রন্থটি বিভিন্ন শাখায় বিভক্ত হয়ে পড়ে। উভয় গ্রন্থের অভিন্ন একটি উৎস থাকায় বিষয়বস্তুর ক্ষেত্রে উভয়ের যথেষ্ট সাদৃশ্য রয়েছে : দেবতাদের সহগামী যজ্ঞান্নি সম্পর্কে একই ধরনের উদ্বেগ প্ৰকাশিত হয়েছে—প্ৰাচীন মানুষের প্রত্নস্মৃতিতে অগ্নিপ্রজ্বলন সম্পর্কে যে উদ্বেগ, অগ্নিনির্বাপণের যে আতঙ্ক ও ভীতি, এবং যজ্ঞাগ্নি পুনঃপ্রজ্বলনের দীর্ঘ ক্লান্তিকর প্রক্রিয়া সম্পর্কে যে অনিশ্চয়তার বোধ সমাজমানসে তখন জাগারুক ছিল, তা-ই এখানে প্ৰতিফলিত হয়েছে।

কৌষীতকি ব্ৰাহ্মণে বিবৃত যজ্ঞসমূহ হ’ল অগ্নিহোত্র, দর্শপুর্ণমাস, বহুগৌণ ইষ্টি, চতুর্মাস্য : বৈশ্বদেব, বরুণপ্রবাস, সাকমেধ ও শুণাসীরীয়। পর্যাপ্ত শস্যপ্ৰাপ্তির জন্যে যথাকলে ঋতুগুলির আবর্তন, স্বাস্থ্য, বরুণের পাশ, পাপ ও ব্যাধি থেকে মুক্তি ইত্যাদির কামনায় এই যজ্ঞগুলি পরিকল্পিত হয়েছিল। এছাড়া, নিম্নলিখিত যজ্ঞানুষ্ঠানের সঙ্গেও আমরা পরিচিত হই। :–সোমযাগ, দীক্ষণীয় ইষ্টি, প্ৰায়ণীয় ও উদয়নীয়, আতিথ্য ইষ্টি, অগ্নিপ্রণয়ন, অগ্নিক্টোম, পশুযাগ, প্রাতরমুবাক, আপোনপত্রীয়, ষোড়শী, জ্যোতিক্টোম ও গবা ময়ন। বিংশতি থেকে ত্রিংশত অধ্যায় যজ্ঞের সঙ্গে সম্পর্কিত সাধারণ বিষয়গুলি বৰ্ণনা করেছে এবং স্পষ্টই বোঝা যায় যে, সেগুলি পরবর্তীকালে সংযোজিত ।

ঐতিরেয় ও কৌষীতকি ব্ৰাহ্মণের মধ্যে সাধারণভাবে বর্তমান বিষয়গুলি স্পষ্টতই গ্রন্থের প্রাচীনতম অংশ। তবে ব্ৰাহ্মণ সাহিত্য রচনা যখন শেষ পর্যায়ে, সে সময় কৌষীতকির শেষ অধ্যায়গুলি রচিত হওয়ায় এতে সমস্ত নূতন বিষয় সংকলিত হয়েছিল। বিশেষত, শেষ দশটি অধ্যায় বিশ্লেষণ করে আমরা ব্ৰাহ্মণ সাহিত্যের বিলম্বে আগত বিষয়গুলি সম্পর্কে সুস্পষ্ট ধারণা করে নিতে পারি। সংবৎসর সম্বন্ধে ক্রমবর্ধমান সচেতনতা এখন কালের অতীন্দ্ৰিয় দ্যোতনার সঙ্গে সম্পর্কিত, তেমনি মৃত্যু সম্পর্কিত অতীন্দ্রিয় ভাবনা এবং নিদানবিদ্যা, অধ্যাত্মবিদ্যা ও ব্যুৎপত্তি শান্ত্র সম্পর্কিত আলোচনা, জাতিভেদ প্রথা ও অস্পৃশ্য রূপে শূদ্রদের সমাজিক অবস্থান, কল্যাণপ্ৰসূ জাদু ও খাদ্য-উৎপাদন ও উৎপাদন বৃদ্ধির উপর বিশেষ গুরুত্ব আরোপ, গ্ৰাবষ্টুৎ শ্রেণীর পুরোহিতের কার্যকলাপ সম্পর্কে উদ্ভাবিত দেবকাহিনী, ঐন্দ্রজালিক ও ধর্মীয় অনুষ্ঠানের অতিপ্ৰাকৃত স্তরে ব্যাখ্যার সঙ্গে সম্পর্কিত প্রবলহিকা (ধাঁধা) প্রভৃতি কৌষীতকি ব্ৰাহ্মণে বিবৃত হয়েছে। গবাময়ন যজ্ঞ সম্পর্কে আলোচনায় ‘পুরুষ’কে যজ্ঞের সঙ্গে একাত্ম করে দেখা হয়েছে। প্রসঙ্গত যজ্ঞীয় অনুপুঙ্খ, পুরোহিত ও যজমানকে কেন্দ্র করে যজ্ঞানুষ্ঠানের প্রতীকী অতীন্দ্ৰিয় ব্যাখ্যাকে যেভাবে উপস্থাপিত করা হয়েছে, তাতে পরবর্তী তন্ত্রসাহিত্য ও আরণ্যকের পূর্বাভাস লক্ষ্য করা যায়। তবে সর্বাধিক প্ৰযুক্ত ও প্রাধান্যযুক্ত প্ৰতীকায়ন উৎপাদন প্রক্রিয়াকে কেন্দ্ৰ করে গড়ে উঠেছে, কেননা বাস্তবজীবনের সবচেয়ে জরুরি সমস্যারূপে একমাত্র উৎপাদনব্যবস্থাই ফসল, গোসম্পদ ও সন্তানের অবিচ্ছিন্ন প্রবাহ ও দ্রুতবৃদ্ধির আশ্বাস আনত। এই উৎস থেকেই ক্ৰমে সমস্ত অতীন্দ্ৰিয়বাদী ও অধ্যাত্মবাদী প্ৰবণতার সূত্রপাত হয়েছিল।

সামবেদের আটটি প্ৰধান ব্ৰাহ্মণেব মধ্যে পঞ্চবিংশ বা তাণ্ডামহাব্ৰাহ্মণ দীর্ঘতম ও সর্বাধিক পরিচিত। একাহ যজ্ঞ থেকে স্পষ্টতই প্ৰত্বপৌবাণিক সহস্রবর্ষ ব্যাপী যজ্ঞ পর্যন্ত সোমব্যাগের বিভিন্ন বিচিত্র প্রকাশ এই গ্রন্থের বিষয়বস্তু। অগ্নিক্টোম, গবাময়ন ও মহাব্রিতের মতো প্ৰধান যজ্ঞগুলি আলোচিত হলেও সামমন্ত্রের উৎস ও নিগৃঢ় রহস্য, মন্ত্রগানের যথার্থ পদ্ধতি ও তৎপ্রসূত পুণ্যফলেব উপবই সর্বাধিক গুরুত্ব আরোপিত হয়েছে।

পঞ্চবিংশ ব্রাহ্মণের অনুবৃত্তি রূপে পরিচিত ষঢবিংশ ব্রাহ্মণ অবশ্য প্রধান সোমযাগগুলিকে বিবৃত করেনি, আপাতদৃষ্টিতে তা’-এর সম্পূর্বক ভূমিকাই গ্ৰহণ করেছে। এতে মূলত গৌণ অনুষ্ঠানগুলি আলোচিত হয়েছে। এতে কিছু অংশ আছে, যেগুলির সঙ্গে যজ্ঞের সম্পর্ক নিতান্ত পরোক্ষ। শেষ অধ্যাযে স্বাহা, স্বধা ও বিষট্র উচ্চারণের বিধি প্রভৃতি আলোচিত হযেছে; প্রকৃতপক্ষে এই অংশটি ষড়বিংশ ব্ৰাহ্মণের পরিশিষ্ট এবং অদ্ভুত ব্ৰাহ্মণ নামে পবিচিত। প্রকৃতপক্ষে তা’ ষড়বিংশবই ষষ্ঠ অধ্যায়। মানুষের জীবনে যে সমস্ত প্ৰাকৃতিক ও অলৌকিক দুর্যোগের আশঙ্কা থাকে, এতে তার প্রায় সমস্ত দিকই উপস্থাপিত। এই সঙ্গে অবশ্য প্ৰতিষেধমূলক অনুষ্ঠানগুলিও আলোচিত হয়েছে। স্পষ্টতই এই গ্রন্থটি বহু পরবর্তীকালের রচনা, যখন প্রতিমাপূজা ও দেবমন্দির নির্মাণের রীতি প্রচলিত হয়ে গিয়েছে তখনকার বৈদিক ঐতিহ্যকে কৃত্রিমভাবে বেদোত্তর পৌরাণিক ধর্মভাবনা পর্যন্ত প্রসারিত করবার যে প্ৰচেষ্টা শুরু হয়েছিল, এই গ্রন্থে তারই নিদর্শন পাওয়া যায়।

গুরুত্ব বিচারের দিক দিয়ে এর পরেই আমরা সামবিধান ব্ৰাহ্মণের নাম উল্লেখ করতে পারি, বিষয়বস্তুর প্রকৃতি বিশ্লেষণ করে স্পষ্টই বোঝা যায়যে, তা আরও পরবর্তীকালের রচনা। যজ্ঞানুষ্ঠানের সঙ্গে এর প্রায় কোনো সম্পর্ক নেই বললেই চলে, ব্যতিক্রমী পরিস্থিতির প্রতি গ্রন্থটি অধিক মনোযোগী। যদিও গ্রন্থে সূচনায় রহস্যপূর্ণভাবে বলা হয়েছে যে, সমস্ত প্ৰাণী সামবেদকে আশ্রয় করেই জীবনধারণ করে এবং সাতটি সাঙ্গীতিক সুরপ্রবাহে সমস্ত সৃষ্টি বিধৃত। কিছু পরেই কয়েকটি পার্থিব বিষয় সম্পর্কেই গ্রন্থের সম্পূর্ণ মনোযোগ কেন্দ্রীভূত হয়েছে; যেমন উত্তম পত্নী লাভ, পিশাচ ও রাক্ষসদের উৎপাত শান্ত করা, মৃত্যুর পর স্বৰ্গপ্রাপ্তি, পুনর্জন্মনিবৃত্তি ইত্যাদি। পার্থিব সুখ ও সমৃদ্ধি নিশ্চিত করার প্রয়োজনে এবং নানাবিধ আধিদৈবিক ও আধিভৌতিক বিপদ নিবারণের জন্যে কিংবা ঐতিহ্যগত ধর্মাচরণের অভ্যাসে যে সমস্ত অনুষ্ঠান বিবৃত হয়েছে, সেগুলির মধ্যে ব্ৰাহ্মণ্য বৃত্তবহির্ভূত ও ব্ৰাহ্মণ্যযুগের পরবর্তী উপাদানসমূহের প্রভাব স্পষ্ট।

শাব্দিক ব্যুৎপত্তি ও সামমন্ত্রের উৎস বিষয়ক কিছু কিছু রচনায় সামবেদীয় ব্রাহ্মণের বৈশিষ্ট্য পরিস্ফূট হয়েছে। ‘আর্যেয়’ নামে ক্ষুদ্র গ্রন্থে সামমন্ত্রের ক্রম অনুযায়ী বিন্যস্ত সামবেদীয় ঋষিদের নামের তালিকা পাওয়া যায়। এই তাৎপর্যহীন রচনার প্রতি পাঠকদের দৃষ্টি আকর্ষণ করার জন্য এতে বলা হয়েছে যে, এই ঋষিদের সম্পর্কে উপযুক্ত জ্ঞান না থাকলে সামগান থেকে বিপরীত প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি হতে পারে।

‘দেবতাধ্যায়’ নামক অন্য একটি ক্ষুদ্র গ্রন্থে দেবনাম (অগ্নি, ইন্দ্ৰ, প্ৰজাপতি, সোম, বরুণ, তুষ্টা, পূষণ ও সরস্বতী) এবং সামমন্ত্রের বিভিন্ন বিভাগের পারিভাষিক নাম বিবৃত হয়েছে। আটটি প্রধান ছন্দের প্রতি তদুপযোগী বৰ্ণ যোজনা-প্রসঙ্গে অতীন্দ্ৰিয় বিশ্লেষণ প্রদত্ত হয়েছে। গায়ন্ত্রীই সর্বাধিক তাৎপৰ্যপূর্ণ ছন্দরূপে এখানে প্ৰশংসিত; ছন্দনামের ব্যুৎপত্তি নির্ণয়ে যাস্কের অনুসরণ স্পষ্ট।

‘বংশ’ ব্ৰাহ্মণ নামক অত্যন্ত ক্ষুদ্র গ্রন্থটিতে সামবেদের বিভিন্ন শাখার প্রতিষ্ঠাতাদের যেসব নাম বিবৃত হয়েছে, তাদের সূচনায় ব্ৰহ্মা ও সমাপ্তিতে সর্বদত্ত। এই ব্যাপক তালিকা থেকেই বোঝা যায় যে, এটি বহু পরবর্তী কালে রচিত হয়েছিল।

সামবেদের অন্যতম প্রধান ব্ৰাহ্মণ ছান্দোগ্য দশটি প্ৰপাঠকে বিন্যস্ত। প্ৰথম দুটি অধ্যায়ে গৃহ্য অনুষ্ঠানের মন্ত্রসমূহ আলোচিত হয়েছিল বলে এই অংশকে মন্ত্রব্রাহ্মণ বা মন্ত্রপর্বরূপে অভিহিত করা হয়। আটটি অধ্যায়ে বিভক্ত এই গ্রন্থে শুধু নিম্নোক্ত বিষয়গুলিরই আলোচনা। যথা-বিবাহ অনুষ্ঠান, নবজাতকের জাতকর্ম, সাপের প্রতি অর্ঘ্য, স্নাতক শিক্ষার্থীদের অনুষ্ঠান, পিতৃপুরুষদের প্রতি নিবেদিত অনুষ্ঠান, গৃহপ্রতিষ্ঠা, নবনির্মিত গৃহে আনুষ্ঠানিক গৃহপ্ৰবেশ, কৃমিরোগ নিরাময় ইত্যাদি। গোভিল ও খাদির গৃহ্যসূত্রের সঙ্গে এই ব্ৰাহ্মণের নিবিড় সম্পর্ক রয়েছে, কেননা সম্ভবত এই দুটি গ্রন্থ

এর প্রত্যক্ষ পূর্বসূরী।

ছান্দোগ্য ব্ৰাহ্মণের দশটি প্ৰপাঠকের মধ্যে একমাত্র প্রথম দুটিতেই ব্ৰাহ্মণের উপযুক্ত বিষয়বস্তু পাওয়া যায়। তৃতীয় থেকে অষ্টম অধ্যায়ে যে সব গৌণ বিষয় আলোচিত হয়েছে, তার মধ্যে ব্রাহ্মণ ও উপনিষদ এই উভয়েরই চরিত্রবৈশিষ্ট্য বর্তমান। স্পষ্টতই এই গ্রন্থটি বহু পরবর্তীকালে রচিত হয়েছিল, যখন খুব কম লোকই যজ্ঞানুষ্ঠানের সূত্রগুলির প্রকৃত তাৎপর্য বুঝতে পারত। অনুষ্ঠানের তখন এত বেশি যান্ত্রিকতা সৃষ্টি হয়েছিল যে, ধর্মাচারের প্রধান প্রবণতা তখন আনুষ্ঠানিকতা থেকে দ্রুত অতীন্দ্ৰিয় উপলব্ধিতে রূপান্তরিত হচ্ছিল। গ্রন্থের শেষ তিনটি অধ্যায়ে ছান্দোগ্য উপনিষদের সন্ধান পাই।

সংহিতোপনিষদ্‌ ব্রাহ্মণের নামটি খুবই কৌতূহলজনক, যেহেতু নামকরণের মধ্যে বৈদিক সাহিত্যের তিনটি প্রধান ধারাই–সংহিতা, উপনিষদ ও ব্রাহ্মণ-উল্লিখিত হয়েছে এবং উপনিষদ স্থান পেয়েছে ব্ৰাহ্মণের আগে। প্রকৃতপক্ষে এটি পরবর্তীকালে রচিত; বিষয়বস্তুর বিন্যাসে সর্বাত্মক হওয়ার প্রবণতা এর মধ্যে লক্ষ্য করা যায়। এই গ্রন্থের পাঁচটি অধ্যায়ের মধ্যে প্রথমটিতে সমস্ত সংহিতাকে দেবতা, দানব ও ঋষিদের অনুষঙ্গ অনুযায়ী তিনটি শ্রেণীতে বিভক্ত করা হয়েছে। দ্বিতীয় অধ্যায়টি প্রকৃতপক্ষে সামগানের বিভিন্ন অনুপুঙ্খ সংক্রান্ত। তৃতীয় অধ্যায়ে যজ্ঞানুষ্ঠান ও স্বরন্যাসের ক্ষেত্রে সামগানের প্রযোজ্য পরিবর্তনগুলি ব্যাখ্যাত হয়েছে। শেষ দুটি অধ্যায়ে আচার্যের উদ্দেশে প্রদত্ত গুরুদক্ষিণার আলোচনা আছে।

জৈমিনীয় ব্রাহ্মণের সঙ্গে পঞ্চবিংশ ব্রাহ্মণের যথেষ্ট সাদৃশ্য রয়েছে; এতে মুখ্যত যে বিষয়টি বর্ণিত হয়েছে তা হ’ল যজ্ঞানুষ্ঠানে সামগায়ক ছান্দোগ্য পুরোহিতদের কর্তব্য। প্ৰথম অধ্যায়ে অগ্নিহোত্র ও প্ৰায়শ্চিত্ত সহ অগ্নিষ্টোম এবং দ্বিতীয় অধ্যায়ে গবাময়ন ও সোমযাগের কয়েকটি শাখা বিবৃত হয়েছে।

চারটি অধ্যায়ে বিভক্ত জৈমিনীয় উপনিষদ ব্রাহ্মণ একটি অর্বাচীন রচনা, প্ৰথম অধ্যায়ে বিভিন্ন সামমন্ত্রের নাম, দ্বিতীয় ঋষিদের নাম, তৃতীয়ে বিখ্যাত সাম গায়কদের তালিকা এবং চতুর্থে যক্ষারোগ থেকে আরোগ্যের জন্যে প্রার্থনা, উদগাতা শ্রেণীর পুরোহিতদের কর্তব্য এবং সামবেদীয় আচার্য ও প্রধান গায়কদের তালিকা বিবৃত হয়েছে। এই গ্রন্থের শেষতম অংশই হ’ল কোনোপণিষদ।

কৃষ্ণযজুৰ্বেদীয় ব্রাহ্মণগুলির মধ্যে একমাত্র তৈত্তিরীয় আমাদের কাছে এসে পৌঁছেছে। এই গ্রন্থের তিনটি অষ্টকের উপবিভাগরূপে কয়েকটি প্ৰপাঠক কল্পিত হয়েছে, যজুৰ্বেদীয় ব্রাহ্মণরূপে তা প্ৰাথমিকভাবে আনুষ্ঠানিক প্রক্রিয়া ও প্রসঙ্গত মন্ত্রগুলির আলোচনা করেছে। এই গ্রন্থে সোমাযাগের সমস্ত প্ৰধান রূপই ব্যাখাত হয়েছে : সৌত্ৰিমণী, রাজসূয়, বাজপেয়, চাতুর্মস্য, অগ্নিহোত্র, দর্শপুর্ণমাস, ইষ্টি, পুরুষমেধ, পশুযাগ ও অশ্বমেধ। এই গ্রন্থের মধ্যে যেহেতু বহুপরবর্তী যজ্ঞানুষ্ঠান অন্তর্ভুক্ত হয়েছে এবং জ্যোতির্বিদ্যার প্রতি আগ্রহও ব্যক্ত হয়েছে, তাই আমরা এই সিদ্ধান্ত করতে পারি যে, যজ্ঞানুষ্ঠানকে বিকৃত করার প্রক্রিয়া যখন চূড়ান্ত পর্যায়ে পৌঁছেছিল, তৈত্তিরীয় ব্ৰাহ্মণ সেই যুগেই রচনা। বর্ণনীয় বিষয়ের বৈচিত্র্যের কথা মনে রেখে আমরা অনায়াসে তৈত্তিরীয় ব্রাহ্মণকে এই শ্রেণীর রচনার মধ্যে পরিপূর্ণতম ও ব্যাপকতম বলে গ্রহণ করতে পারি। তবে, বিপুল ও বিচিত্র বিষয়বস্তুর বিন্যাসে যথেষ্ট শিথিলতা ও বিশৃঙ্খলা দৃষ্টিগোচর হয়ে বলে আমাদের অনুমান এই যে, তৈত্তিরীয় ব্রাহ্মণ বিভিন্ন যজুর্বেদীয় পুরোহিত শাখার ভিন্ন ভিন্ন প্রজন্মের দ্বারা অসতর্ক ও শিথিলভাবে রচিত ও সম্পাদিত হয়েছিল। যজ্ঞানুষ্ঠান তখন ক্রমশ জটিলতর হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে নূতন নূতন আনুষ্ঠানিক উপাদান ও দেবকাহিনী উদ্ভাবিত হয়ে পুরোহিতসমাজের দ্বারা যজ্ঞশাস্ত্ৰে সমর্থিত হচ্ছিল এবং বিভিন্ন অনুপুঙ্খের মধ্যে পরস্পর-বিরোধিতা ও পুরোহিতদের ক্রমবর্ধমান শাখাগুলির মধ্যে বিভিন্ন বিষয়ে বিতর্ক তীব্র হয়ে উঠেছিল, বস্তুত, যাবতীয় ঐতিহ্যের সুদীর্ঘ ইতিহাস এই গ্রন্থের প্ৰেক্ষাপট রচনা করেছে।

শুক্ল যজুর্বেদের ব্রাহ্মণগুলির মধ্যে একমাত্ৰ শতপথ ব্ৰাহ্মণই এখনও পাওয়া যায়; এই গ্রন্থটি ব্ৰাহ্মণ সাহিত্যের মধ্যে দীর্ঘতম ও সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ। মাধ্যন্দিন শাখায় ছটি কাণ্ডে বিন্যস্ত একশত অধ্যায়ের জন্যই গ্রন্থের এই নামকরণ। বিভিন্ন কাণ্ডের বিষয়বস্তু হল : দর্শপুর্ণমাস (১ম), অগ্ন্যান্ধান, অগ্নিপুনঃপ্রজ্বলন অগ্নিহোত্র, পিণ্ডপিতৃ যজ্ঞ, আগ্ৰায়ণেষ্টি, দীক্ষায়ণ ও চতুর্মাস্য (২য়); সোমযাগ, দীক্ষা ও অভিষব (৩য়); ত্ৰিষবণ, সোমযাগের বিভিন্নরূপ : দ্বাদশাহ, ত্রিরাত্র ও অহীনের জন্য দক্ষিণা এবং সত্ৰ (৪র্থ), রাজসূয় ও বাজপেয় (৫ম), উখা, বিষ্ণুর ত্রিপাদবিক্রম, বাৎমপ্ৰ ও উপাধান (৬ষ্ঠ)।

তৈত্তিরীয় ব্ৰাহ্মণের মতো শতপথ ব্ৰাহ্মণেও যথার্থ সম্পাদনার অভাব লক্ষণীয়। রচয়িতারূপে যদিও যাজ্ঞবল্ক্যের নাম উল্লিখিত হয়েছে, তবু মনে হয় তে, গ্রন্থের বিপুল অংশ রচনা করে থাকলেও সমগ্ৰ ব্ৰাহ্মণ তিনি প্রণয়ন করেন নি, কেননা গ্রন্থের কোনো কোনো স্থানে (মোট তেইশবার) তাকেই প্রতিষ্ঠিত বিশেষজ্ঞ বা বিতর্কে যোগদানকারী বলে উল্লেখ করা হয়েছে। এই ব্ৰাহ্মণের বহু স্থানে দৃষ্টিভঙ্গির ক্ষেত্রে যে সুস্পষ্ট বিভেদ অভিব্যক্ত হয়েছে, তাতেও একাধিক লেখকের হস্তক্ষেপ স্পষ্ট। যাজ্ঞবল্ক্য ছাড়াও বিশেষজ্ঞ রূপে শাণ্ডিল্য ও তুর কাবসেয় উল্লিখিত হয়েছে। ঐতরেয় ব্ৰাহ্মণের মতে জনমেজয়ের অভিষেক ‘তুর’ প্রধান পুরোহিতের দায়িত্ব পালন করেছিলেন, এই জনমেজয় যদি মহাভারতের চরিত্র হয়ে থাকেন, তাহলে শতপথ ব্ৰাহ্মণের রচনাকাল খ্রিস্টপূর্ব সপ্তম বা ষষ্ঠ শতাব্দী। বিভিন্ন তাত্তিক বিতর্কে আমরা শৌচেয়/প্রাচীনযোগ্য, উদ্দালক, আরুণি, শ্বেতকেতু এবং বিদেহরাজ্যের ক্ষত্রিয় রাজা জনককে অংশগ্রহণ করতে দেখি, এবং লক্ষণীয় প্রায় সমস্ত ক্ষেত্রেই যজ্ঞবিষয়ক বিতর্ক উপসংহারে আধ্যাত্মিক ভাবনার পর্যবসিত হয়েছে।

অর্বাচীনতর ব্রাহ্মণগুলিয় অন্যতম শতপথ বিশেষভাবে মূল্যবান হওয়ার কারণ হল, এই গ্ৰন্থ বহু দেবকাহিনীর সংকলন হওয়া ছাড়াও আমাদের কাছে ইতিহাস ও ভূগোলের উপাদানসম্বলিত সামাজিক সংস্কার ও বিশ্বাসের বিচিত্র ও সমৃদ্ধ এই চিত্র উপস্থাপিত করেছে। শুধু তাই নয়, একে আমরা অধ্যাত্মবাদী সৃষ্টিতত্ত্বমূলক ও দার্শনিক পরিশীলনের আকর-গ্ৰন্থ রূপে গ্ৰহণ করতে পারি।-শেষোক্ত উপাদান অন্তিম অধ্যায়ে অর্থাৎ বৃহদারণ্যক উপনিষদের মধ্যে স্পষ্টভাবে অভিব্যক্ত হয়েছে।

অথর্ববেদের একমাত্র ব্রাহ্মণ গোপথ অর্বাচীনতর রচনাগুলির অন্যতম। বৈদিক সাহিত্যের অংশরূপে অথর্ববেদের স্বীকৃতিলাভের পরেই তার নিজস্ব একটি ব্রাহ্মণ গ্রহের অনিবাৰ্য প্রয়োজন অনুভূত হয়েছিল, ফলে গোপথ ব্ৰাহ্মণ রচিত হল। দুটি ভাবে বিভক্ত এই গ্রন্থের পূর্বভাগে পাঁচটি অধ্যায় ও উত্তরভাগে ছটি অধ্যায়। পূর্বভাগের প্রথম অধ্যায়ে সৃষ্টিতত্ত্ব, প্ৰায়শ্চিত্ত অনুষ্ঠান এবং ‘ওম’ ও অন্যান্য রহস্যগূঢ় শব্দের ব্যুৎপত্তি, মৌদ্গল্য ও গালিবের একটি দীর্ঘ বিতর্কে আলোচিত হয়েছে। দ্বিতীয় অধ্যায়ে ব্ৰহ্মচৰ্য, ব্ৰহ্মচারীর কর্তব্য, পঞ্চবিধ অগ্নি, পুরোহিতদের যোগ্যতা, ব্রাহ্মণদের খাদ্য, আত্ৰেয় ও অশ্বমেধ যজ্ঞ এবং বৈশ্বানর ও সপ্তপন জাতীয় অগ্নির উৎস বিবৃত হয়েছে। তৃতীয় অধ্যায়ে অথর্ববেদীয় ব্ৰহ্মা শ্রেণীর পুরোহিতের কার্যাবলীর উপর গুরুত্ব আরোপ করা ছাড়াও কয়েকটি প্ৰায়শ্চিত্তমূলক অনুষ্ঠান, পুরোহিতদের কর্তব্য ও তার প্ৰাপ্য দক্ষিণা, অগ্নিহোত্র, অগ্নিষ্টোম, ঋত্বিকনিয়োগ অনুষ্ঠান সম্পর্কেও আলোচনা আছে। চতুর্থ অধ্যায়ে ঋত্বিক নিয়োগ অনুষ্ঠানের পরবর্তী অংশ প্রধান পুরোহিত ও তাদের সহকারী, বর্ষের উৎপত্তি এবং দশারাত্র, মহাব্ৰত, জ্যোতিষ্টোম ও অতিরাত্র যজ্ঞ বিবৃত হয়েছে। পঞ্চম অধ্যায়ে রয়েছে নানা বিভিন্ন বিষয়বস্তু।

উত্তরভাগের প্রথম অধ্যায়ে যজ্ঞানুষ্ঠানে বরুণ প্রঘাস এবং পিতৃমেধ যজ্ঞ আলোচিত হয়েছে। দ্বিতীয় অধ্যায়ে মাংস অর্ঘ্য, উপসন্দবিষয়ক দেবকাহিনী, দেবপত্নী, সোমপানের প্রশংসা, প্ৰত্বকথার মাধ্যমে কর্তব্যে শিথিলতার পাপক্ষালন, প্ৰজাপতির স্তোত্র ইত্যাদি বিবৃত হয়েছে। তৃতীয় অধ্যায়ে বিষটি উচ্চারণের বিধি এবং যজ্ঞদক্ষিণার বিভিন্ন উপকরণ ছাড়াও ব্যবটু উচ্চারণকে বীজ ও ষড়ঋতুর সঙ্গে তুলনা করা হয়েছে। চতুর্থ অধ্যায়ে দেবতাদের সঙ্গে বেদের সম্পর্ক, বিভিন্ন অনুষ্ঠানের সঙ্গে প্রযোজ্য মন্ত্র, দক্ষিণা, বেদী, পুরোডাশ, ত্ৰিষবাণ, দেবাসুর যুদ্ধ, পঞ্চপ্ৰাণ, উকথা ও ষোড়শী যাগ বর্ণিত হয়েছে। পঞ্চম অধ্যায়ে শর্বরী শব্দের নির্বচন, রাত্রি সম্পর্কিত আটটি সূক্ত, সোমপান ও তৎসংশ্লিষ্ট সামগান, বাজপেয়, সোমব্যাগের প্রাথমিক ও গৌণ অংশ আলোচিত হয়েছে। ষষ্ঠ অধ্যায়ে প্রগাথ, অহীন, নারাশংস, বালখিল্য, বৃহতী এবং এগুলির উপযোগী দেবকাহিনী প্রভৃতি বিবৃত হয়েছে।

গোপথ ব্রাহ্মণে যজ্ঞের আনুষ্ঠানিক বিচূতি ও সংশোধন সম্পর্কে প্রায়ই যে আলোচনা লক্ষ্য করা যায় তা অথর্ববেদের ব্ৰহ্মা শ্রেণীর পুরোহিতের নির্দিষ্ট কর্তব্যের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ। এছাড়া, এতে যে বিচিত্র বিষয়বস্তু আলোচিত হয়েছে, ব্ৰাহ্মণ সাহিত্য অন্তর্ভুক্ত হওয়ার জন্যে সেসব গোপথ ব্ৰাহ্মণের পক্ষে অনিবাৰ্যই ছিল। অথর্ববেদ সংহিতার মধ্যে যদিও বহু প্ৰাচীন উপাদান রয়েছে, গোপথ ব্ৰাহ্মণ পরিকল্পিতভাবে রচিত হয়েছিল ব’লেই প্ৰচলিত ব্ৰাহ্মণ সাহিত্যের ঐতিহ্যকে তা একনিষ্ঠভাবে অনুসরণ করেছে। এই গ্রন্থে যেহেতু দীক্ষানুষ্ঠানের দেবীরূপে ‘শ্রদ্ধা’কে উপস্থাপিত করা হয়েছে এবং ভাষার মধ্যে উপনিষদের সংলগ্নতা সুস্পষ্ট, তবুও একে ব্ৰাহ্মণ সাহিত্যের অন্তিম পর্যায়ের অন্তর্ভুক্ত বলে সহজেই সিদ্ধান্ত করা যায়। অনুষ্ঠান-সম্পর্কিত পারিভাষিক শব্দ, প্রয়োগ ও ক্রিয়ার মধ্যবতী অসামঞ্জস্যকে যেভাবে রূপক নির্মাণ বা ছন্দ প্ৰতীকায়নের মাধ্যমে ব্যাখ্যা করার চেষ্টা হয়েছে এবং ব্যাকরণকে পৃথক বিষয়বস্তুরূপে উপস্থাপিত করা হয়েছে, তা’ থেকেও রচনাকালের পরবর্তিতার ইঙ্গিত পাওয়া যায়।

তবে ব্ৰাহ্মণ সাহিত্যের সাধারণ ধারার সঙ্গে গোপথের পার্থক্য এখানেই যে যথার্থ যজ্ঞানুষ্ঠানের সঙ্গে তার প্রত্যক্ষ সম্পর্ক খুব কম; সে তুলনায় প্রতিবাদপ্রবণ ও ব্যাখ্যামূলক আলোচনা এবং দেবকাহিনীর সাহায্যে অর্থবাদ অংশের অবতারণাই এখানে বেশি প্রাধান্য পেয়েছে। কখনো কখনো এই গ্রন্থে অথর্ববেদের শ্রেষ্ঠত্বও ঘোষিত হয়েছে; বস্তুত, এতে যেন সমাজের দীর্ঘ অবহেলার বিরুদ্ধে অথর্ববেদের বিলম্বিত ও সচেতন প্ৰতিবাদ ধ্বনিত হয়েছে। এই গ্রন্থের আরও একটি বিশেষত্ত্ব হ’ল গাৰ্হস্থ্য অনুষ্ঠানের আলোচনা। এ বেদটির উৎস যে লঘু ঐতিহ্যের মধ্যে, যার জন্যে বৃহৎ ঐতিহ্যের ‘ত্রয়ী’-এর প্রতি দীর্ঘকাল পরম অবজ্ঞা পোষণ করেছে, তাও এই গাৰ্হস্থ্য অনুষ্ঠানের এবং দৈনন্দিন জীবনের সমস্যার প্রতিবিধানের অনুষ্ঠানগুলির দ্বারা প্রমাণিত।

পারিবারিক ও গোষ্ঠীগত জীবনের সঙ্গে অথর্ববেদের নিবিড় সম্পর্কই এতে প্রমাণিত হচ্ছে। উল্লেখ করা যায় যে, অথর্ববেদ সংহিতার মতো গোপথ ব্ৰাহ্মণও ভৃগু ও অঙ্গিরার সঙ্গে আপনি সম্পর্ক ঘোষণা করেছে।

অথর্বপরিশিষ্ট্রের সাক্ষ্য থেকে মনে হয় যে, প্রচলিত গোপথ ব্ৰাহ্মণটি বিশালতর কোনো একটি রচনার অন্তিম অবশেষ, এই জন্যেই একে ‘অনুব্রাহ্মণ’ বলা হয়ে থাকে। সাধারণত অন্য ব্ৰাহ্মণগুলি যে সমস্ত লোকায়ত ও গাৰ্হস্থ্য বিষয় নিয়ে আলোচনা করেনি, অথর্ববেদের বৈশিষ্ট্যযুক্ত এই ব্ৰাহ্মণে সেইসব বিষয়ও ব্যাখ্যাত হয়েছে; যেমন-সৰ্পবেদ, পিশাচবেদ, অসুরবেদ, ইতিহাসবেদ ও পুরাণ। ‘ব্ৰহ্মা’ শ্রেণীর পুরোহিতের উচ্চ প্ৰশংসা, ব্ৰহ্মচারী ও ব্রাত্যদের বিশিষ্ট উল্লেখ, অথর্ব ও অঙ্গিরার ভূমিকার গৌরবকীর্তন, অবৈদিক প্রাগার্য ও যোগী ঐতিহ্যের উপাদান সম্বলিত দেবকাহিনী ইত্যাদি বিশ্লেষণ করে অথর্ববেদের ব্রাহ্মণরূপে গোপথের মুখ্য প্রবণতা ও তাৎপৰ্য সম্পর্কে আমরা অবহিত হই। লক্ষণীয় যে, এই ব্ৰাহ্মণের বিষয়বস্তুর অনুষ্ঠানগত তাৎপর্যক্রমবিবর্তনের পথে আধ্যাত্মিক ও অতিজাগতিক স্তরে নিবিষ্ট হয়ে, পরবর্তী যুগে রচিত গভীর তাৎপৰ্যপূর্ণ অথর্ববেদীয় উপনিষদগুলির পূর্বাভাস সূচিত করেছে।