১৬. কাব্যগুণ (অথর্ববেদ সংহিতা)

কাব্যগুণ (অথর্ববেদ সংহিতা)

অথর্ববেদ সংহিতা কাব্যরূপে মূলত ঋগ্বেদীয় কাব্যের সমপৰ্যায়ভুক্ত হলেও তার কিছু কিছু নিজস্ব চরিত্রবৈশিষ্ট্যও রয়েছে। বিষয়বস্তুর মৌলিক প্রকৃতির জন্যেই এই সংহিতা আশু ও বাস্তব-প্রয়োগযুক্ত এবং অধিকতর পার্থিব বিষয়বস্তুগত সাধারণ দৈনন্দিন গাৰ্হস্থ্য ভাবনাকে প্রতিফলিত করেছে। অধিকাংশ রচনাই যেহেতু ঐন্দ্ৰজালিক বৈশিষ্ট্যযুক্ত তাই এদের কাব্যগুণ খুব বেশি নেই। তবে যে সমস্ত সূক্তে বিপদের আশঙ্কা বা ব্যাধি থেকে পরিত্রাণের আকাঙক্ষা ব্যক্ত হয়েছে, সে সমস্ত ক্ষেত্রেও এমন চমৎকার স্পষ্টতা লক্ষ্য করা যায় যা ঋগ্বেদের অল্প কিছু সূক্ত বাদে বেশ দুর্লভ। বিদ্বেষ ও ভীতির আবেগ থেকে বহুক্ষেত্রে শক্তিশালী চিত্রকল্পের সৃষ্টি হয়েছে। ওজস্বিতার জন্যে প্রার্থনা কিংবা রণবাদ্যের প্রতিক্রিয়া বা ক্রুদ্ধ নারীকে শাস্ত করার উপায় বা শত্রুর বিনাশ বর্ণনা প্রসঙ্গে যেসব সহজ সরল উপমা প্রয়োগ করা হয়েছে, তাতে আবেগজনিত প্রত্যক্ষতার ফলে চমৎকার কাব্যিক পরিবেশের সৃষ্টি হয়েছে। প্ৰণয়-উদ্বোধিক জাদুক্ৰিয়ার মধ্যেও অনুরূপ উপমা নির্মাণশক্তির প্রমাণ পাওয়া যায়। ভীতি ও বিদ্বেষ ছাড়া অন্যান্য আবেগের অভিব্যক্তি থেকেও শক্তিশালী চিত্রকল্পসমন্বিত চিত্তাকর্ষক কাব্যিক মুহুর্তের সৃষ্টি হয়েছে। তবে, কাব্যের এই স্তরে চিত্ৰকল্পগুলি সাধারণভাবে প্রধান অলঙ্কার অর্থাৎ উপমা, রূপক ও অনুপ্রাস এবং অল্প কয়েকটি ক্ষেত্রে প্রাথমিক পর্যায়ে শ্লেষকে কেন্দ্র করে গড়ে উঠেছে। করুণ রসাশিত আবেদনের জন্যে সপত্নীর প্রতি ঈর্ষার বর্ণনা খুবই মর্মস্পশী হয়ে উঠেছে। কখনো কখনো নিরলঙ্কার সরল প্রার্থনা এবং দরিদ্রের কুটীরের বর্ণনাও হৃদয়গ্ৰাহী ভাষায় ব্যক্ত। ইট-কাঠের সাহায্যে গৃহনির্মাণের কৌশল আৰ্যদের অধিগত হওয়ার পর তাদের মনে নিরাপত্তার অতিরিক্ত উপলব্ধি সৃষ্টি হ’ল এবং নবলব্ধ জ্ঞান ও নিশ্চয়তার ফলরূপে জন্ম নিয়েছে অভিনব। সরল কাব্যিক অনুভূতি” তেমনি নববিবাহিত দম্পতীর প্রগাঢ় আবেগের প্রতিফলনেও কাব্যের সৌন্দর্যময় প্রকাশ ঘটেছে।

অন্ত্যেষ্টিবিষয়ক রচনায় বা গর্ভপাত আশঙ্কা থেকে পরিত্রাণের মন্ত্রগুলিতে সাধারণ মানবিক আবেগ-উদ্বেগ, কল্যাণকামনা ইত্যাদি চমৎকার স্পষ্ট ঋজুতায় অভিব্যক্তি। তেমনি প্রাকৃতিক সৌন্দৰ্য্যের নিবিড় দর্শনজনিত আনন্দও বিভিন্ন চিত্রকল্পের মধ্যে নিটােলভাবে প্রকাশিত হয়েছে–এমন কি ঐন্দ্ৰজালিব বৈশিষ্ট্যযুক্ত সূক্তের মধ্যেও তা মাঝে মাঝে চোখে পড়ে। সরল ও সংক্ষিপ্ত পঙক্তিতে সহজ বর্ণনা ও প্রার্থনার মধ্য দিয়ে প্রাকৃতিক সৌন্দৰ্যসঞ্জাত বিস্ময়ের কাব্যিক অভিব্যক্তি ঘটেছে। আদিম মানুষের জীবনমুখী চিন্তা ও প্রকৃতিদর্শন জনিত বিস্ময়ের শ্রেষ্ঠ নিদর্শন আমরা ভূমিসূক্তের মধ্যে লক্ষ্য করি—কাব্যিক প্রকাশের সাবলীল স্পষ্টতা ও শক্তির বিচারে এই বচনাটি যথার্থই অনবদ্য।

অথর্ববেদ যদিও বহু সূক্ষ্মচিন্তা ও অধ্যাত্ম ভাবনামূলক সূক্ত ঋগ্বেদ থেকে আহরণ করেছে, তবুও অথর্ববেদের নিজস্ব বৈশিষ্ট্য অর্থাৎ ঐন্দ্ৰজালিক অতীন্দ্ৰিয়বাদী ও কাব্যিক দিক দিয়ে হৃদয়গ্রাহী প্রকৃতির শারীরিক ও আধ্যাত্মিক উপাদান এবং উৎস সম্পর্কে চমৎকার সূক্ষ্ম চিন্তা ও উপলব্ধির পরিচয়ও কোনো কোনো রচনায় পাওয়া যায়–ঋজুতা ও প্রত্যক্ষতার গুণে এই সব রচনা কাব্যিক দিক দিয়ে উৎকৃষ্ট। মানুষকে দৈব মহিমায় উন্নীত করার মধ্যে একটি নতুন প্রবণতার প্রমাণ পাওয়া যায়; এমন কি মানবদেহকেও বিশেষ মহিমায় মণ্ডিত করা হয়েছে–তাই মানবদেহ সকল দেবতার অধিষ্ঠানভূমি রূপে বৰ্ণিত। অন্যত্র বলা হয়েছে যে, দেবতা ও মানুষের সুষম সমন্বয়ে এই বিশ্বজগৎ গড়ে উঠেছে-পরস্পর পরস্পরের পরিপূরক এবং জীবনের মৰ্মগত রহস্য উভয়কেই আবৃত্ত করে। কামনা ও কালের ধারণাকে কেন্দ্র করে অতীন্দ্ৰিয়বাদী ভাবনা গড়ে উঠেছে-এই উভয়ই অপেক্ষাকৃত নতুন বিমূর্ত আধ্যাত্মিক ভাবনা এবং উভয়ই সৃষ্টির সঙ্গে সংশ্লিষ্ট। এই পর্যায়েই কামনার সৃজনশীল ভূমিকাকে অতিজাগতিক পর্যায়ে উন্নীত করা এবং শেষপর্যন্ত তা আদিমতম অতৃপ্তিজনিত চাঞ্চল্যে এবং পরমাত্মার সেই মহত্তম একাকিত্বের উপলব্ধিতে পরিণতি লাভ করে— উপনিষদে এই ভাবনাই শেষপর্যন্ত সৃষ্টির মূলাধার স্বরূপ চালিকা শক্তিতে রূপান্তরিত হয়। অথর্ববেদের পর্যায়ে কামনা যেমন সৃজনশীল শক্তির প্রতিকল্প তেমনি শ্বাশ্বতকাল সম্পর্কিত কিছু কিছু বিমূর্ত ভাবনা যখন বিলম্বে আবির্ভূত হ’ল, ততদিনে তা’ সমুন্নত মহিমাযুক্ত ভাবনায় পরিণতি লাভ করেছে। কাল সম্পর্কিত ভাবনা যখন এভাবে জনচিত্ত অধিকার করেছে, ততদিনে কৃষি ব্যবস্থার পরবর্তী পর্যায়ের সূচনা হয়ে গেছে, কেননা ঋতুচক্র ও শস্যসমূহের আবর্তন লক্ষ্য করেই কাল সম্পর্কে বিমূর্ত ভাবনার সৃষ্টি হয়েছিল। পশুচারী সমাজের পক্ষে তা তখনও একটি অস্পষ্ট ধারণা, যেহেতু তাদের পালিত পশুসমূহ সম্পূর্ণ বৎসর জুড়েই বংশবৃদ্ধি করে; ফলত, কাল সম্পর্কিত ভাবগত রূপটি আকস্মিক, অপ্রাসঙ্গিক ও নিস্তপ্রয়োজন। কেবলমাত্র যখন ভরণপোষণের জন্যে সময়মত বার্ষিক বৃষ্টিপাতের উপর নির্ভর করতে হ’ল এবং নির্দিষ্ট সময়ের ব্যবধানে শস্য উৎপন্ন হ’ল তখনই মানুষ ঋতুচক্রের যথার্থ আবর্তন সম্পর্কে নিবিড়ভাবে আগ্রহী হয়ে উদ্বিগ্নভাবে ফসলের প্রতীক্ষা করতে শিখল। সেইসঙ্গে মানুষ কালের সম্পূর্ণ অনিবাৰ্যতা ও অমোঘতা সম্পর্কেও সচেতন হয়ে উঠল। সম্পূর্ণত মানুষের আয়ত্তের বহির্ভূত, অথচ অদৃশ্যভাবে মানবিক নিয়তি নিয়ন্ত্রণকারী বিমূর্ত ধারণারাপে কাল সুপ্রতিষ্ঠিত হয়ে গেল। এই উপলব্ধি দেখা দেওয়ার পরই চরম বিমূর্ত ধারণারাপে বিশ্বজগৎ-স্রষ্টা কালের একটি সমগ্ৰ ভাবায়তন মানুষের কাছে সুস্পষ্ট হয়ে উঠল। সুতরাং অথর্ববেদের কালসূক্ত কাল সম্পর্কে মানুষের অতীন্দ্ৰিয়বাদী দৃষ্টিভঙ্গির সম্পূর্ণ বিকাশই সুচিত করছে।

ঐন্দ্ৰজালিক কাব্যরূপে এবং জীবন সম্পর্কে মূলত আদিম ও রহস্যবাদী দৃষ্টিভঙ্গির প্রকাশ রূপে অথর্ববেদ বস্তুবিম্ব সম্পর্কে শক্ৰতাপূর্ণ ও জীবন সম্পর্কে সক্রিয়ভাবে বিদ্বেষপ্রবণ যে ভাবনার অভিব্যক্তি আমাদের সামনে তুলে ধরেছে–সেই অথর্ববেদেই আবার পাই সর্বব্যাপী অপ্রাপণীয় অথচ নিত্য কল্যাণের ও সার্বভৌম আকাঙক্ষার মহত্তম উচ্চারণ : ‘ইহলোক যা কিছু অন্ধকারে আচ্ছন্ন অর্থাৎ হিংস্ৰতাপূর্ণ, ইহলোকে যা কিছু নিষ্ঠুর, যা কিছু অশুভ–সে সমস্তই শান্ত হােক, কল্যাণে পরিণত হােক, এই পৃথিবীর সমস্ত কিছুই আমাদের কাছে শান্তিময় হয়ে উঠুক।’ বস্তুত প্রাগবৈজ্ঞানিক যুগে বৈরী প্রকৃতির সম্মুখীন মানুষের অসহায়তার এই হ’ল অন্যতম শ্রেষ্ঠ অভিব্যক্তি–যে মানুষ চতুষ্পার্থের অন্ধকার ও অমঙ্গলপ্রদ শক্তির ক্ৰোধ শান্ত করার জন্যে তীব্র আকাঙ্খা ব্যক্ত করে এবং একই সঙ্গে শাস্তি ও সমৃদ্ধির জন্যে তার শ্বাশ্বত বাসনাকেও প্ৰকাশ করে।