১৩. ধর্মবিশ্বাস

ধর্মবিশ্বাস

আমরা যখন অথর্ববেদের ধর্মবিশ্বাসের কথা বলি, বৈদিক ও অবৈদিক আৰ্য জনগোষ্ঠী এবং আর্য ও আদিম ধর্মমতগুলির লঘু এবং বৃহৎ ঐতিহ্যের ধারাবাহিকতা ও পারস্পরিক সংমিশ্রণে পরিণতিই আমাদের উদ্দিষ্ট। অথর্ববেদের সূক্তগুলি যজ্ঞানুষ্ঠানের বিভিন্ন আবিচ্ছেদ্য কুশীলব অর্থাৎ পুরোহিত, ব্ৰাহ্মণ ও রাজন্যদের কেন্দ্ৰ করেই রচিত; এছাড়া, ইন্দ্ৰজাল ও জাদু অনুষ্ঠান এবং কল্যাণপ্ৰসু অনুষ্ঠানে এবং অশুভ অভিচার ক্রিয়াও এ সংহিতার অন্তর্ভুক্ত। বৃহৎ ঐতিহ্যে প্রধান দেবতারা মূলত ঋগ্বেদ থেকেই গৃহীত, কখনো কখনো দেবতাসহ কয়েকটি সম্পূৰ্ণ ঋগ্বেদীয় সূক্তই সামগ্রিকভাবে বা অংশত ঋণ হিসাবে গৃহীত হয়েছে; কখনো বা সূক্তকে সম্রাস্ত করে তোলার প্রয়োজনে ঋগ্বেদীয় দেবতাদের বৈশিষ্ট্য ও ক্রিয়াকলাপ অথর্ববেদে বহুলাংশে পবিবর্তিত। দৃষ্টান্ত হিসাবে বলা যায় যে, অগ্নির ভূমিকা এখন বহুধাবধিত। এমনকি, কখনো-বা দেবতাদের ভূমিকা সম্পূর্ণ নতুনভাবে নির্ধারিত হয়েছে–যেমন অগ্নি বৃক্ষের, মিত্রাবারুণ গুপ্তর, মরুদগণ পর্বতের, সূৰ্য চক্ষুর, মরুদগণেব পিতা প্রাণিজগতের এবং মৃত্যু জনগণের অধিষ্ঠাতা দেবতা। বিভিন্ন দেবতার মধ্যেও নূতনভাবে সম্পর্ক নির্ণীত হয়েছে; বরুণানী স্বপ্নের জননী, যম তার পিতা এবং তিনি স্বয়ং অরররু নামে পরিচিত। তবে, অন্যান্য সংহিতার তুলনায় অথর্ববেদে উপদেবতাদের প্রাধান্য বেশি : রোহিত, স্কম্ভ ও বাস্তোম্পতিকে দৃষ্টান্ত রূপে উল্লেখ করা যায়। ব্রাত্যসূক্তের সঙ্গে সম্পর্কিত শিবের বিলম্বে আগত নামগুলি একইভাবে উল্লেখযোগ্য : ভব, শর্ব, ঈশান, নীললোহিত, পশুপতি ও উগ্ৰদেব।

‘ব্রাত্য’ শব্দটিও দেবনাম রূপে ব্যবহৃত এবং কালক্রমে নামটি যে বিশ্বদেবের পর্যায়ে উন্নীত হয়েছিল, তার কারণ আর্যদেবসঙেঘ নবাগত দেবতাকে অন্যান্য ঋগ্বেদীয় দেবতার মতো সর্বব্যাপী এক দেবতার সম্মানে ভূষিত করা হত। স্পষ্টতই ব্রাত্য বৃহৎ ঐতিহ্যে ধর্মের বিকল্প শব্দরূপে ব্যবহৃত হয়েছে। ব্রাত্য সূক্তগুলিতে প্রধান শব্দ হ’ল ‘অনুব্যচলন’ বা অনুসরণ করেছিল। এই ব্রাত্যকে কী অনুসরণ করে? যজ্ঞধর্মের সঙ্গে নিয়ত সংশ্লিষ্ট অনুপুঙ্খাসমূহ, অর্থাৎ অনুষ্ঠান-পরিচালক পরোহিত, উপকরণসমূহ, দেবতারা, ছন্দসমূহ, এমনকি বিভিন্ন দিক। এই সমস্তই ব্রাত্য, আবার সমস্তই তিনি অতিক্রম করে যান। ব্রাত্য সূক্তগুলির অধিকাংশই যে রহস্যপূর্ণ ব’লে মনে হয়, এর কারণ এই যে, এদের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট বিশ্বাস ও আনুষ্ঠানিক প্রয়োগবিধি ইতিমধ্যে চিরকালের মত হারিয়ে গেছে। এই সূক্তগুলিতে যে প্রবণতা স্পষ্ট, তা হ’ল, সর্বজনগ্রাহ্য ও অতীন্দ্ৰিয় আনুষ্ঠানিকতা ও দেবকাহিনী নির্মাণের সুব্যক্ত লক্ষ্য। সাধারণভাবে এই প্রবণতাই পরবর্তী কালের সমগ্ৰ বৈদিক ধর্ম ও সাহিত্যের মৌলিক বৈশিষ্ট্য।