১২. মৃগার ও কুন্তাপসূক্ত

মৃগার ও কুন্তাপসূক্ত

অথর্ববেদের নিজস্ব বৈশিষ্ট্যযুক্ত দুই শ্রেণীর সূক্ত ‘মৃগার’ ও ‘কুন্তাপ’ সূক্ত ব’লে পরিচিত। চতুর্থ অধ্যায়ে সাতটি ‘মৃগার’ সূক্ত একাদিক্ৰমে বিন্যস্ত; রচয়িতা মৃগার ঋষির নাম অনুযায়ী সূক্তগুলির সাধারণ নামকরণ করা হয়েছে। সূক্তগুলিতে আহুত দেবতারা যথাক্রমে প্ৰচেতা অগ্নি, ইন্দ্ৰ, সবিতা ও বায়ু, দ্যাবাপৃথিবী, মরুদগণ, ভব ও শর্ব বা রুদ্র এবং মিত্ৰাবরুণ। এইসব সূক্তের সমস্ত শ্লোকেই একটি সাধারণ ধ্রুবপদ রয়েছে : ‘তিনি আমাদের পাপ থেকে মুক্ত করুন।’ এই মন্ত্রগুলি ‘বৃহচ্ছান্তি’ বা ‘অংহােলিঙ্গ’ শ্রেণীর মন্ত্রসমূহের অন্তর্গত; আবার একইসঙ্গে এরা বৃহত্তর পৌষ্টিক শ্রেণীভুক্ত মন্ত্রের অন্যতম উপবিভাগ। আরোগ্যমূলক ঐন্দ্ৰজালিক অনুষ্ঠানের অঙ্গরূপে এইগুলি ব্যবহৃত হত বলে বোঝা যায় যে, পাপই ব্যাধির কারণ রূপে নির্দেশিত। চব্বিশতম সূক্ত ছাড়া অন্যত্র দুই বা ততোধিক দেবতা মন্ত্রে উদ্দিষ্ট হয়েছেন। সমস্ত সুক্তেই ভাববস্তু নৈতিক পাপ-স্বীকারোক্তি, শাস্তি-বাচক, প্ৰায়শ্চিত্তমূলক এবং ফলের দিক দিয়ে মুক্তিপ্ৰদ। অপরাধ-সচেতনতা এবং ক্ষমা, শান্তি ও সমৃদ্ধির আকাঙক্ষামিশ্ৰিত ভয় এইসব সূক্তে মুখ্য আবেগরাপে পরিস্ফুট হয়েছে। নৈতিক সূক্ত যেহেতু সংহিতা-সাহিত্যে সাধারণভাবে বিরল, মৃগার সূক্তের বিশেষ গুরুত্ব তাই অনস্বীকার্য।

কুন্তাপ সুক্তের সংখ্যা মোট তেরটি, সাধারণত অথর্ববেদ সংহিতার উপসংহারে এদের স্থান নির্দিষ্ট। এই সূক্তগুলিতে কোনো দেবতা, রচয়িতা, ছন্দ বা সম্পূর্ণ বিনিয়োগ উল্লিখিত হয় নি, এমনকি, কোনো পদপাঠও নেই। মন্ত্রগুলি ঋগ্বেদ থেকে সম্পূর্ণত উৎকলিত হয়েছে; বৈতান-সূত্র অনুযায়ী এরা শািন্ত্র ও স্তোত্ররূপে সোমযাগে প্ৰযুক্ত হয়ে থাকে। এদের কিছু কিছু সাধারণ বৈশিষ্ট্য রয়েছে; যেমন এরা পুনরাবৃত্তিময়, সাংকেতিক, গূঢ় রহস্যপূর্ণ, কখনো কখনো আপাতদৃষ্টিতে আদিরসের আভাসযুক্ত ;– সম্ভবত, রহস্যময় ঐন্দ্ৰজালিক উর্বরতা বৃদ্ধির অনুষ্ঠানে এগুলি প্ৰযুক্ত হত। সূক্তগুলির ভাষা সাধারণভাবে প্রাচীন এবং এগুলি জনপ্রিয় ছিল বলে অনুমান করা যায়।

দ্বাদশ অধ্যায়ের সূচনায় ‘ভূমিসূক্ত’ নামে বিখ্যাত একটি দীর্ঘ ও চমৎকার সূক্ত রয়েছে, নিজস্ব রচনাগুণে যা অতুলনীয়। বেশ কিছু সূক্তে যদিও দ্যাবাপৃথিবী দেবতাররূপে বন্দিত, মৌলিক ভাবনার দিক দিয়ে এসব ক্ষেত্রে মোটামুটিভাবে ঋগ্বেদের ভাবকল্পনার অনুসরণ অব্যাহত রয়েছে আকাশ-দেবতার সঙ্গিনী হওয়া ছাড়া পৃথিবীর পৃথক বৈশিষ্ট্য সব সূক্তে অনুপস্থিত। কিন্তু ভূমি-সূক্তটি কাব্যগুণেই অনন্য; পৃথিবী এখানে সেই মৃত্যুহীন জননী, যিনি আপনি সন্তানদের অন্নদান করেন; তাদের দৌরাত্ম্য ও চাঞ্চল্য ধৈর্যসহকারে সহ্য করেন, স্বৰ্ণশীর্ষ শস্যক্ষেত্রের মাধুরীতে মণ্ডিতা হয়ে যিনি সুন্দরী, এবং বৃক্ষ লতা ও পুষ্প-সমৃদ্ধিতে যিনি মনোরমা। এ সূক্তটি কাব্যিক প্রেরণামণ্ডিত প্রার্থনা ও প্রশস্তি গীতি; শুধুমাত্র পর্যাপ্ত অন্ন ও জলের জন্যে প্রার্থনাই নয়, গো-সম্পদ বৃদ্ধি এবং বহু অদৃশ্য নৈসৰ্গিক বিপদের আশঙ্কা থেকে নিরাপত্তার জন্যে প্রার্থনা ছাড়াও জননী পৃথিবীর কিছু কিছু স্বভাব-বৈশিষ্ট্য, যেমন ধৈর্য মনোহারিতা, সহিষ্ণুতা, আকর্ষণীয় সুরভি ইত্যাদি উপাসক যেন আপনার মধ্যে সঞ্চারিত করতে পারেন, তার জন্যেও প্রার্থনা জানানো হয়েছে। তরুণী ও স্বাস্থ্যবতী। জননীরূপে পৃথিবীর সৌন্দর্য নানাভাবে বর্ণিত ও প্রশংসিত হয়েছে। পরিণত স্বৰ্ণশ্যাম শস্যের মনোহরণ রূপ, গভীর অরণ্যের রহস্যময় সৌন্দর্য এবং বিভিন্ন ঋতুতে পৃথিবীতে পরিবর্তনশীল রূপ সম্পর্কে মুগ্ধতা এই সূক্তে বিবৃত।

পৃথিবী সম্পর্কে কৃষিজীবী মানুষের নবসঞ্জাত বিস্ময় ও সম্রামের বোধ এই নতুন দৃষ্টিভঙ্গির মৰ্মমূলে বিরাজমান; ঋতুচক্রের আবর্তনের সঙ্গে পৃথিবীর পরিবর্তনশীল সৌন্দর্য এবং সোনালি শস্যের প্রথম উদগমে গভীর পরিতৃপ্তি অনুভব করে মানুষ এই উপলব্ধিতে পৌছল যে, পৃথিবী আশ্রয়, নিরাপত্তা ও নিরন্তর অন্নসংস্থানের একটি নির্ভরযোগ্য ধ্রুব উৎস। নতুন জগতে জনসাধারণের বিপুল অংশের পক্ষে ভূমিই জীবনধারণের প্রধান উৎস, অর্থনীতি এখন মূলত কৃষিনির্ভর; উৎপাদনের অন্যান্য গৌণ উপায় থাকলেও সমাজজীবনে সেগুলির গুরুত্ব খুব বেশি ছিল না। এই ভূমিসূক্ত সে যুগে রচিত হয়েছিল, যখন যাযাবর পশুপালক জনগোষ্ঠী কৃষিব্যবস্থাকে গ্ৰহণ করে নতুন জীবনযাত্রার আনন্দকে কৃতজ্ঞচিত্তে মেনে নিয়েছে, ফলে, এই প্ৰথম পৃথিবী সৌন্দর্য ও প্রাচুর্যপূৰ্ণ মাতৃকা-দেবী রূপে উপলব্ধ হয়েছেন। বস্তুত, একটি বা দু’টি আধ্যাত্মিক সূক্তের কথা বাদ দিলে ভূমিসূক্তই অথর্ববেদের সর্বাধিক কাব্যগুণান্বিত সূক্ত।