০৫. বৈদিক ঐতিহ্যে অথৰ্ববেদের অস্বীকৃতি

বৈদিক ঐতিহ্যে অথৰ্ববেদের অস্বীকৃতি

বৈদিক যুগে দীর্ঘকাল পর্যন্ত অথর্ববেদকে সংহিতাসাহিত্যের অন্তর্ভুক্ত করা হয় নি। আমরা ‘ত্ৰয়ী’ ত্ৰিবেদ ইত্যাদি যে সমস্ত শব্দের উল্লেখ পাই তাতে সংহিতাররূপে ঋক, যজু ও সাম মন্ত্রের সংগ্রহের কথাই বলা হয়। শতপথ ব্ৰাহ্মণ সাধারণত পৃথকভাবে অন্য তিনটি বেদ কিংবা সামগ্রিকভাবে ত্রয়ীর উল্লেখ করলেও অন্তত একটি ক্ষেত্রে ঋক, যজু, সাম এবং অথর্বাঙ্গিরসের উল্লেখ করেছে। এই গ্রন্থে ঋগ্বেদ, যজুর্বেদ, সামবেদ, বাকোবাক্য বা তৰ্কশাস্ত্ৰ, ইতিহাস এবং পুরাণের উল্লেখ আছে। কিন্তু অসংখ্য প্রচলিত ধর্মগ্রন্থে ঋগ্বেদ, যজুর্বেদ, অথর্ববেদ এবং অঙ্গিরস বেদের সঙ্গে সঙ্গে সাপবিষয়ক লোকগাথা, দেবজন উপাখ্যান, ইন্দ্ৰজাল, ইতিহাস ও লোকশ্রুতি উল্লিখিত হয়েছে। স্বাভাবিকভাবেই অথর্ববেদের উপনিষদগুলি ত্রয়ীর সঙ্গে অথর্ববেদের উল্লেখ করেছে; অবশ্য গোভিল, খাদির, আপস্তম্ব ও হিরণ্যকেশী ধর্মসূত্র অথর্ববেদের উল্লেখও করে নি। অনুরূপভাবে যজুর্বোেদর বাজসনেয়ী ও মৈত্রায়ণী সংহিতা, ঋগ্বেদের ঐতরেয় ও কৌষীতকি ব্ৰাহ্মণ বা সামবেদের লাট্যায়ন স্রোতসূত্র অথর্ববেদের উল্লেখ করে নি। তবে ঋগ্বেদের দশম মণ্ডলের প্রথম সূক্তে ‘অথৰ্বাঙ্গিরস’ কথাটি আছে এবং এককভাবে ‘অঙ্গিরস’ শব্দটি আছে তৈত্তিরীয় সংহিতায়। বিপুল বৈদিক সাহিত্যে অথর্ববেদ সম্পর্কে অপযশ প্রচলিত ছিল, যদিও পরবর্তী সাহিত্যে চতুর্বেদের অন্যতম যথার্থ সংহিতাররূপে তাকে স্বীকৃতি দেওয়া হয়েছে।

অথর্ববেদের বিরুদ্ধে এইরূপ প্রতিরোধ গড়ে তোলার কারণ কি? অথর্ববেদের বিষয়বস্তু পরীক্ষা করার পূর্বে আমাদের স্মরণ রাখতে হবে যে, অন্য তিনটি বেদের মধ্যে অনুষ্ঠানগতভাবে পরিচ্ছন্ন একটি পরিকল্প বিদ্যমান ছিল,–হােতা আবৃত্তি করতেন, উদগাতা গান গাইতেন এবং অধিবৰ্ষ অনুষ্ঠানটি হাতেকলমে নিম্পাদন করতেন। সাহিত্যগত শ্রেণীবিচারের দিক দিয়ে বৈদিক সাহিত্য সামগ্রিকভাবে সম্পূর্ণ ছিল ঋগ্বেদ আবৃত্তির উপযোগী কাব্য, সামবেদ সংগীতের জন্য স্তোত্র এবং যজুর্বেদ অনুষ্ঠান পরিচালনার জন্য ধর্মানুষ্ঠানকেন্দ্ৰিক গদ্য নির্দেশাবলী সরবরাহ করত। কোনো কোনো ভারতীয় পণ্ডিত এই চিরাগত ধারণা পোষণ করেন যে, প্রাগুক্ত ত্ৰিবিধ রচনাই ত্রয়ী শব্দের তাৎপর্য এবং অথর্ববেদ যেহেতু গদ্যপদ্যময় সংহিতা, সেটিও ত্রয়ীর বহির্ভূত নয়। অথর্ববেদের বিষয়বস্তুকে অন্তরঙ্গভাবে বিশ্লেষণ করলে আমরা দেখি যে, এই সংহিতাব অধিকাংশ সূক্তই নুতন বিষয়ভিত্তিক, যা ঋগ্বেদের ভাববৃত্তের তুলনায় সম্পূর্ণ অভিনব। এটা সত্য যে, ঋগ্বেদের শেষ মণ্ডলে এই ধরনের কিছু কিছু বিষয়বস্তু সন্নিবেশিত হয়েছে, কিন্তু এগুলির সংখ্যা খুবই কম এবং তাও আবার সেই সংহিতার অস্তিম পর্যায়েই খুঁজে পাওয়া যায়। নূতন বিষয়বস্তুকে আমরা নিম্নোক্তভাবে বর্গীকরণ করতে পারি : (ক) গাৰ্হস্থ্য ও নারীবিষয়ক (খ) সামাজিক ও পারিবারিক (গ) পিতৃপুরুষ বিষয়ক (ঘ) রাজকীয় ও সৈন্যবাহিনী সংক্রান্ত অর্থাৎ ক্ষত্ৰিয়শ্রেণী সংক্রান্ত এবং (ঙ) রহস্যময় ও ঐন্দ্ৰজালিক বিষয় সম্পর্কিত। অন্যভাবে বলা যায় যে, গৃহ, নারী, রাজা ও সৈন্য এখন মনোযোগের কেন্দ্ৰ-বিন্দুতে, এবং দৃষ্টিভঙ্গি মূলত ইন্দ্ৰজালের উপযোগী।

এই সমস্ত বিষয়ের অধিকাংশ নিশ্চিতভাবে সূচনা থেকেই ছিল। ধর্মীয় ইতিহাসের আধুনিক গবেষকগণ ইন্দ্ৰজালকে ধর্মের তুলনায় প্রাচীনতর বা পরবর্তী ব’লে ভাবেন না, তাদের মতে এই দুটি সমকালীন। পুরোহিত ও ঐন্দ্ৰজালিকের নিকট একই সমস্যা ছিল অর্থাৎ প্রাকৃতিক শক্তির সামনে অসহায়তার বোধ; এই দুজনেরই লক্ষ্য একই—প্ৰাকৃতিক শক্তিকে নিয়ন্ত্রণ করা, যাতে প্ৰকৃতির বৈরী শক্তির মধ্যেও অস্তিত্ব রক্ষা করার উপায় তারা আবিষ্কার করতে পারে। এই সমস্যার সম্মুখীন হয়ে পুরোহিতের কার্যকলাপে যে ধর্মীয় দৃষ্টিভঙ্গি প্রতিফলিত হয়, তাতে দেখা যায় তিনি নির্দিষ্ট কোনো অনুষ্ঠান করছেন, বিভিন্ন প্রার্থনা ও মন্ত্র আবৃত্তি এবং অথবা এমন গান করছেন যাতে প্রার্থীর পক্ষ থেকে প্রকৃতিকে নিয়ন্ত্রণ করার জন্য দেবতার প্ৰসন্নত কামনা করা হয়। অন্যদিকে জাদুকর বা শামানেরা যে ঐন্দ্ৰজালিক দৃষ্টিভঙ্গির প্রতিনিধিত্ব করতেন, তাতে জাদুশক্তির সাহায্যে প্রত্যক্ষভাবে প্রকৃতিকে নিয়ন্ত্রণ করার জন্য কোনো গূঢ় মন্ত্র জপ করা হ’ত।

ধর্ম ও ইন্দ্ৰজালের মধ্যে চারটি বৈশিষ্ট্য সাধারণভাবে উপস্থিত :

(ক) ধ্বংসের আশঙ্কা এবং জীবন ও সম্পত্তি রক্ষার আকাঙক্ষা। এই প্রসঙ্গে প্রখ্যাত গবেষক পোল রদ্যাঁর বক্তব্য স্মরণ করা যেতে পারে; ঐন্দ্ৰজালিক প্রক্রিয়ার প্রধান লক্ষ্যরূপে তিনি খাদ্য সরবরাহ, ব্যাধি ও মৃত্যু নিবারণ, নারীদের অসুস্থতা এবং মৃত্যুভীতির কথা উল্লেখ করেছেন। তার সিদ্ধান্ত এই যে, ধর্ম ও ইন্দ্ৰজাল সমব্যাপী ও সমকালীন; ইন্দ্ৰজাল থেকে ধর্মের উৎপত্তি হয় নি।

(খ) অন্য একটি ব্যক্তি অর্থাৎ পুরোহিত বা জাদুকরের মধ্যস্থতা।

(গ) কোনো মন্ত্র বা গুঢ় শক্তিসম্পন্ন জাদু শব্দের আবৃত্তি।

(ঘ) নির্দিষ্ট কিছু অনুষ্ঠানের ব্যবস্থাপনা। একমাত্র পদ্ধতির ক্ষেত্রেই পারস্পরিক পার্থক্য বিদ্যমান অর্থাৎ কোথাও নির্দিষ্ট কোনো দেবতার সুবিন্যস্ত ভূমিকা এবং অন্যত্র তার অনুপস্থিতি।

অন্য তিনটি সংহিতা অর্থাৎ ঋগ্বেদ, সামবেদ ও যজুর্বেদ একটি সুসামঞ্জস সামগ্রিক সাহিত্যরূপে গড়ে উঠেছে, কেননা ঋগ্বেদে রয়েছে আবৃত্তিযোগ্য সূক্ত, সামবেদে সংগীতোপযোগী মন্ত্র এবং যজুর্বোেদ জপনীয় পাঠ ও প্রধান শ্রৌতি-যাগসমূহ অনুষ্ঠানের জন্যে নির্দেশাবলী। খুব স্বাভাবিকভাবেই। অথর্ববেদ এই সাহিত্যাবৃত্তের অন্তর্ভুক্ত নয় : এর সূক্তগুলি প্ৰধানত গাৰ্হস্থ্য অনুষ্ঠান, নারী, রাজা, সৈন্য, রুগ্‌ণ ব্যক্তি, কৃষিজীবী এবং গৃহস্বামীর প্রয়োজনের সঙ্গে সম্পূক্ত। তাছাড়া, খাঁটি অথর্ববেদীয় মন্ত্রগুলির জন্য দেবতারা কোনো প্রয়োজন নেই, যদিও পরবর্তীকালে তাদের সঙ্গে বহু দেবতার নাম সংযোজিত হয়েছিল, সুতরাং লক্ষ্য ও বিষয়বস্তুর দিক থেকে অথর্ববেদ অন্য তিনটি বেদের তুলনায় স্বরূপত ভিন্ন। অথর্ববেদের প্রধান বিষয়বস্তুগুলি সাধারণত ঋগ্বেদের মন্ত্রকারদের দৃষ্টি আকর্ষণ করে নি।

পশুপালক সমাজ সাধারণত অন্যবিধ কায়িক শ্রমের অর্থাৎ কৃষি ও বাণিজ্যের প্রতি তীব্র ঘূণা প্ৰকাশ করে থাকে; তাই প্ৰাথমিকভাবে বাণিজ্য ও কৃষিকর্মে নিযুক্ত বৈশ্যশ্রেণীর প্রতি উপেক্ষই প্ৰদৰ্শিত হয়েছে–কেননা পশুপালক আৰ্যদের নিজস্ব আচরণবিধি অনুযায়ী প্রগুক্ত দুটি বৃত্তিই ছিল মর্যাদাহানিকর। বৈদিক যুগের অন্তিম পর্যায়ে অথর্ববেদ সংকলিত হওয়ার সময়ে আর্যরা কৃষিজীবী জনগোষ্ঠীরূপে সুপ্রতিষ্ঠিত হয়েছিলেন,–পশুপালন তখন তাদের আয়ের গৌণ ও পরিপূরক একটি উৎস, কখনো কখনো ব্যবসা-বাণিজ্যও তার পরিপূরক। উৎপাদন ব্যবস্থার অভ্যন্তর বিধানে কৃষিকার্যের উপর অধিক গুরুত্ব আরোপ করায় পরিবর্তনের ফলে উপরি সংগঠনে মূল্যবোধের ক্ষেত্রে বহুদিন পর্যন্ত অনুরাপ কোনো স্পষ্ট পরিবর্তন দেখা যায় নি। ভূমিকৰ্ষণের প্রতি পশুপালক সমাজের অন্তর্গূঢ় বিতৃষ্ণা আরো দীর্ঘকাল অবধি অব্যাহত ছিল; বৈদিক সাহিত্য সংকলনে অথর্ববেদ যে অন্তর্ভুক্ত হয় নি, তার জন্যেও এই বিতৃষ্ণার মনোভাবও অংশত দায়ী। ভেষজবিদ্যাকেও অগৌরবজনক ভেবে তাচ্ছিল্য করা হত; পরবর্তীকালের রচনাগুলিতে এই প্রাচীন দৃষ্টিভঙ্গির প্রতিফলন রয়েছে। তৈত্তিরীয় সংহিতা (৬ : ৪ : ৯; ৩), মৈত্রায়ণী সংহিতা (৪ : ৬ : ২) এবং শতপথ ব্ৰাহ্মণ (৪ : ১ : ৫ : ১৪) গ্রন্থে এ ধরনের বক্তব্য লক্ষ্য করা যায়। অথর্ববেদে যেহেতু ব্যাধি থেকে আরোগ্য লাভের জন্য বিপুল সংখ্যক মন্ত্র রয়েছে,-সুদূর প্রাচীন কাল থেকে জাদুকর চিকিৎসকরা আরোগ্যের জন্য নানারকম ঐন্দ্ৰজালিক অনুষ্ঠানের সময়ে সম্ভবত এইসব মন্ত্র উচ্চারণ করতেন–এদের প্রতি সংস্কৃতিসচেতন প্রাচীন আৰ্য পুরোহিতরা যে ঘূণার মনোভাব পোষণ করতেন তা সহজেই অনুমেয়। ওষধিযুক্ত রক্ষাকবচ ও বিশেষ-নামযুক্ত প্ৰস্তর উল্লিখিত হয়েছে ব্যাধি, দানব এবং বিবিধ সামাজিক ও পারিবারিক অমল প্রতিরোধ করার উপায় হিসেবে। এমনকি কখনো কখনো সংকটকালে রাজারও অলৌকিক সাহায্যের প্রয়োজন দেখা দিত এবং এইসব জাদুকর চিকিৎসকরা ইন্দ্ৰজালের অনুষ্ঠানের দ্বারা তারা ইষ্টসিদ্ধির ব্যবস্থা করতেন।

চিকিৎসাশাস্ত্ৰ বা আয়ুর্বেদের প্রাথমিক সূত্রপাত হয়েছে ভৈষজ্য’ অংশে যেখানে ব্যাধি ও চিকিৎসা পদ্ধতি বিবৃত। অথর্ববেদের অন্যতম শাখা চরণবৈদ্যকে যে চরকসংহিতার লুপ্ত উৎসরূপে মনে করা হয়ে থাকে তা বিশেষভাবে স্মরণীয়। আনুষ্ঠানিক নির্দেশগুলি বা বিনিয়োগগুলিতে আমরা লক্ষ্য করি যে, ওষধি, ধাতু এবং রাসায়নিক পদার্থ। ঔষধ প্ৰস্তুত করার জন্য ব্যবহৃত হত; শিশু-চিকিৎসা, ধাত্রীবিদ্যা ও শল্যচিকিৎসার উপাদানগুলি খুবই প্ৰাথমিক স্তরে হলেও বিদ্যমান ছিল। পরবর্তীকালে মৈত্রী উপনিষদেও চিকিৎসকদের পক্ষে স্বর্গের দ্বার রুদ্ধ করা হয়েছে। অথর্ববেদের অস্বীকৃতির এটিও একটি কারণ, এতে চিকিৎসা-সংক্রান্ত বহু মন্ত্র রয়ে গেছে।

অথর্ববেদে গৃহ ও নারীর প্রাধান্য সুপ্রতিষ্ঠিত ব’লেই তারই মধ্যে আমরা পরবর্তীকালে গৃহ্যসূত্রগুলির পূর্বাভাস লক্ষ্য করি। এই বিশেষ শ্রেণীর রচনা অন্যান্য সংহিতাগুলির গণ্ডী-বহির্ভুত, যেহেতু সেইসব সংহিতা মুখ্যত প্ৰধান শ্রৌতযাগগুলির বিবরণ দিয়েছে, যে সমস্ত অনুষ্ঠানে নারীর ভূমিকা উপেক্ষিত হলেও রাজার ভূমিকার প্ৰতি যথেষ্ট মনোযোগ দেওয়া হয়েছে। অথর্ববেদেই বিশেষভাবে অভিষেক ও যুদ্ধাভিযান-বিষয়ক অনুষ্ঠানগুলির উপর গুরুত্ব আরোপ করা হয়েছে। রাজা ও সৈন্যবাহিনীর উপর এই গুরুত্ব আরোপ করা হয়েছে। বাজা ও সৈন্যবাহিনীর উপর এই গুরুত্ব আরোপের কারণ সম্ভবত খ্রিস্টপূর্ব দ্বিতীয় সহস্রাব্দের শেষদিকে উত্তর ভারতে ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র রাজ্যের উত্থান এবং কিছু কিছু সঙঘবদ্ধ রাজ্য থেকে ক্রমশ বৃহত্তর রাজ্য ও পরে সাম্রাজ্যের প্রতিষ্ঠা। পরবর্তী বৈদিক যুগের সূচনাপর্বে ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র জনপদের রাজারা ধীরে ধীরে গৌরব ও শক্তি অর্জন করছিলেন। এই পর্যায়ে রচিত অথর্ববেদের মধ্যে রাজার শুরুত্ব শুধু বৃদ্ধিই পায় নি, অভিষেক-সংক্রান্ত রাজসূয় যজ্ঞ এক রহস্যময় ও প্রতীকী তাৎপর্য লাভ করেছিল। পণ্ডিতরা অনুমান করেন যে, রাজসূয় যজ্ঞে কিছু কিছু আদিম অনুষ্ঠানের প্রতীকায়ন ঘটেছিল—সম্ভবত মহাবিশ্বের পুনর্নবীকরণের উদ্দেশ্যে অবিচ্ছিন্নভাবে যে সমস্ত বার্ষিক উৎসব অনুষ্ঠিত হত, তাদের সংক্ষেপিত রূপান্তর রাজসূয় যজ্ঞে অভিব্যক্তি। অভিষেক সূক্তগুলি ভাবাদর্শ ও বিষয়বস্তুর দিক দিয়ে অভিনব নয়; ঋগ্বেদে প্ৰাপ্ত রাজসূয় বা বাজপেয় সম্পর্কিত অন্তর্বস্তুরই ধারারাহিক ও বিশদীকৃত রূপ। কিন্তু সৈন্যদের কল্যাণকামনা, ইন্দ্ৰজাল ইত্যাদি নতুন ভাববস্তু, কেননা এই ইন্দ্ৰজাল প্ৰায় সামগ্রিকভাবেই অথর্ববেদীয়।

সাধারণত ‘অথৰ্বন্‌’ ও ‘অঙ্গিরস্‌’ শব্দ দুটি যদিও অগ্নিদেবের পুরোহিত সম্প্রদায়কেই বোঝায়, প্রকৃতপক্ষে এ দুটি ভিন্ন ধরনের ইন্দ্ৰজাল প্রক্রিয়ার সঙ্গে সম্পর্কিত। অথর্ব চিকিৎসাবিষয়ক এবং কল্যাণপ্ৰসূ বা নির্মল ইন্দ্ৰজাল পরিচালনা করতেন। এর মধ্যে ছিল শারীরিক কুশলের ও স্বাস্থ্যের জন্য ইন্দ্ৰজাল (ভৈষজ্য), চিকিৎসা সম্পর্কিত (পৌষ্টিক), সাধারণ পারিবারিক কল্যাণ ও সৌষম্যের জন্য ইন্দ্ৰজাল (সাংমনস্য) রাজকীয় অনুষ্ঠান (রাজকর্মাণি) এবং সমৃদ্ধির জন্য স্ত্রীআচার (স্ত্রী কর্মাণি)। পরবর্তীকালে রচিত ধর্মসূত্রগুলি এইসব বিষয়কেই যথেষ্ট মর্যাদা দান করেছে; অবশ্য সেই সঙ্গে এইসব গ্ৰন্থ ঐন্দ্ৰজালিক আচার অনুষ্ঠানের প্রতি তাচ্ছিল্যও প্রকাশ করেছে। ঋগ্বেদের সময় থেকে যে জাদুবিদ্যা নিন্দিত, অঙ্গিরার সঙ্গে তাই সম্পূক্ত; একে প্রধানত অভিচার বা কৃত্যা বলে অভিহিত করা হয়–এর বিভিন্ন উপরিভাগগুলির মধ্যে রয়েছে মারণ, উচাটন, সন্মোহন ও বশীকরণ। অভিচার বা কৃত্যা প্রকৃতপক্ষে একটি দ্বিমুখী অনুষ্ঠান, যার মধ্যে রয়েছে কৃত্যাপ্রতিহরণ বা শত্রুর জাদুক্ৰিয়াকে নিস্ক্রিয় করার উপযোগী, ঐন্দ্ৰজালিক ক্রিয়া, যাকে আবার কৃতাদূষণ অধ্যায়ে নিন্দা করা হয়েছে। ঋষি অঙ্গিরার সাধারণ বিশেষণ হ’ল ‘ঘোর’ বা ভয়ংকর। অথর্ববেদের পঞ্চম কল্পকে অঙ্গিরস কল্প (বা যাতু, অভিচার বা বিধানকল্প) বলা হয়েছে, এতে প্রমাণিত হচ্ছে যে “অঙ্গিরস’ শব্দটি কৃষ্ণ বা ভয়ংকর ইন্দ্ৰজালের সঙ্গে সম্পূক্ত। এই অংশে যাতু বা দানবদের নিয়ন্ত্রণ করার শক্তি লাভ করার জন্য মন্ত্র এবং কিছু কিছু স্ত্রী-আচারের মন্ত্রও আছে।

অথর্ব পরিবার অপেক্ষা অঙ্গিরা পরিবারের সঙ্গেই ভূগুর সম্পর্ক বেশি। মৈত্রায়ণী সংহিতায় এই তিনটি নাম অর্ধদেবতাররূপে বৰ্ণিত; আবার তৈত্তিরীয় ব্ৰাহ্মাণে অঙ্গিরা এবং ভূণ্ড এবং বাজসনেয়ী সংহিতায় অথর্ব দেবতারূপে গৃহীত হয়েছেন। পরস্পর-সংবদ্ধ এই তিনটি পরিবারভুক্ত ব্যক্তিরাই অথর্ববেদের রচয়িতা। অথর্বা এবং অঙ্গিরা উভয়েই অগ্নিচর্যার পুরোহিত হওয়া সত্ত্বেও তাদের মধ্যে এই যে দ্বৈত বোধ, শুভ ও অশুভ ফলদানের মধ্যে অভিব্যক্ত হয়েছে, তার উৎস প্রাচীন ইন্দোইরাণীয় পর্যায়ে আবিষ্কার করা যায়। বস্তুত, ঋগ্বেদের সময়েই অগ্নির দুটি স্পষ্ট রূপভেদ লক্ষণীয়। একদিকে তিনি শুভপ্ৰদ হিব্যবাহন ও হিব্যাৎ আবার অন্যদিকে অশুভ ক্ৰব্যাৎ-সুতরাং সহজেই অনুমান করা যায় যে, অগ্নি প্ৰাথমিক পর্যায়েই দ্বিবিধ কার্যকলাপ ও অনুষঙ্গ নিয়ে গড়ে উঠেছিলেন। অবেস্তায় অগ্নির বিশেষ গুরুত্বের কথাও আমাদের মনে পড়ে; ঐ গ্রন্থে শবদােহ অনুমোদিত নয়, যেহেতু অশুচি শবদেহের সংস্পর্শে অগ্নির মালিন্য দোষ দেখা দেবে, এই তাদের আশঙ্কা। ভারতীয়দের শবদােহপ্রথায় অগ্নি যেহেতু অশুচি শবের সংস্পর্শে দূষিত হয়—ইরাণীয়রা তাই অঙ্গিরার প্রতি বিদ্রুপ বর্ষণ করেছে এবং নিজেদের অগ্নিবিষয়ক পুরোহিতকে শুভসূচক অথর্ব বলে পৃথকভাবে চিহ্নিত করেছে। ধর্মসূত্রগুলি মাঝে মাঝে অথর্ববেদের প্রতি পরস্পর-বিরোধী দৃষ্টিভঙ্গি প্রদর্শন করেছে, কেননা একদিকে তারা যদিও অথর্ববেদকে কোনো কোনো ক্ষেত্রে অপরিহার্যােরাপে স্বীকার করে নিয়েছে, অন্যদিকে আবার বিষয়বস্তুর বিচারে তাকে অপবিত্র, অপধর্মীয় ও ঐন্দ্ৰজালিক কার্যকলাপ উপস্থাপিত করার অপরাধে সাধারণভাবে অপকৃষ্ট বলে বিবেচনা করেছে। এই সব গ্রন্থে এই অভিমত ব্যক্ত হয়েছে যে, অথর্ববেদের ক্রিয়াকর্ম সাধারণভাবে শাস্তিযোগ্য। ইন্দ্ৰজাল ও পুরোহিততন্ত্র যেহেতু পরস্পর বিচ্ছিন্ন নয়, বরং সমস্ত আদিম এমনকি বহু উন্নত ধর্মেও এদের সহাবস্থান লক্ষণীয়-তাই আমরা এমন একটি সময়পরিধি কল্পনা করতে পারি যখন শামান ও জাদু চিকিৎসক পাশাপাশি নিজ নিজ দায়িত্ব পালন করত। বৃহৎ ঐতিহ্য যজ্ঞীয় ধর্ম ব্যাপকতর হওয়ার পর যখন পবিশীলিত স্তোত্র-সাহিত্য সৃষ্টি হ’ল এবং এমন একটি দেব-সঙ্ঘের বন্দনা করা হ’ল যেখানে দেবতাদের সুনির্দিষ্ট অবয়ব ও কার্যকলাপের সুস্পষ্ট বর্ণনা রয়েছে—তখন লঘু ঐতিহ্যের শামান পুরোহিতদের নিকৃষ্ট অবস্থানে অবনমন ঘটল। স্পষ্টতই অথর্ববেদের প্রাচীনতম সূক্তগুলির সঙ্গে দেবতাদের কোনও সম্পর্ক প্রায় ছিলই না। অন্য সমস্ত প্রকৃত জাদুবিদ্যার মতো তারাও প্রত্নকথা ও যজ্ঞানুষ্ঠানের পরিবর্তে ঐন্দ্ৰজালিক অনুষ্ঠান ও মায়ার সাহায্যে প্রকৃতিকে প্রত্যক্ষভাবে নিয়ন্ত্রণ করতে চেয়েছিল। বহু কাল পরে অথর্ববেদ যখন রক্ষণশীল বৃহৎ ঐতিহ্য দ্বারা স্বীকৃত হল, পুরোহিতরা এবং ঋগ্বেদের সূক্তগুলি সমগ্রত কখনো অপরিবর্তিত এবং কখনো বা বিকৃতভাবে অথর্ববেদের মর্যাদা বৃদ্ধির জন্য গৃহীত হয়েছে; তখনই প্রত্যেক সূক্তের সঙ্গে এক বা একাধিক দেবতার সম্পর্ক স্থাপনের ঐতিহ্যগত পদ্ধতিকে অনুকরণ করা হয়েছিল। বর্তমানে প্রচলিত পাঠে বহু সূক্তের দেবনাম ও সূক্তের মধ্যে সামঞ্চস্যহীনতা থেকে তা প্রমাণিত। বহু ক্ষেত্রে ‘মন্ত্রোক্ত দেবতা” বলে দেবতাদের অনির্দিষ্ট অবস্থায় রাখা হয়েছে। কৃমি বিনাশের জন্য একটি সূক্তে দেবতারূপে ইন্দ্রের উপস্থিতি প্রকৃতপক্ষে বহু উদ্ভট উদাহরণের অন্যতম, যেখানে সংহিতা-বিষয়ক নিয়মের একেবারে যান্ত্রিক প্রয়োগ ঘটেছে। যে কোনও স্বীকৃত সংহিতায় প্রতিটি সূক্তের এক বা একাধিক দেবতা, একজন কবি, একটি নির্দিষ্ট ছন্দ এবং যথার্থ আনুষ্ঠানিক প্রয়োগ বা বিনিয়োগ থাকবে এই হ’ল নিয়ম; এই নিয়মের যান্ত্রিক অনুকরণ সত্ত্বেও অধিকাংশ অথর্ববেদীয় সূক্তেরই নিগুঢ় স্বভাবধর্ম অনুযায়ী এই সব বৈশিষ্ট্য থাকা সম্ভব ছিল না। কিন্তু, এই নিয়মটি গৃহীত হওয়ার পর স্বীকৃতি ও মর্যাদালাভের জন্য যে আকাঙক্ষার সৃষ্টি হ’ল, তারই ফলে প্রতি সুক্তের শীর্ষে নিয়মমাফিক এইগুলি সন্নিবেশিত হ’ল। এইভাবে যা কিছু মূলত জাদু পুরোহিতের উপযোগী জাদুক্ৰিয়া বা প্রেতনিবারক অনুষ্ঠান ছিল, তাই এখন ঋগ্বেদীয় সূক্তের অনুকরণে বৃহৎ ঐতিহ্যের ভূমিকা আত্মসাৎ করে নিল। তবে মনে রাখতে হবে যে, ঋগ্বেদের অন্তিম পর্যায়ের রচনা-প্রথম ও দশম মণ্ডলেই-তা সর্বপ্রথম দেখা গিয়েছিল। সেখানকারী কিছু কিছু ক্ষেত্রে বিষয়বস্তুর বৈশিষ্ট্য অথৰ্ববেদের কথাই মনে করিয়ে দেয়, ঠিক যেভাবে কিছু কিছু অথর্ববেদীয় সূক্ত-ঋগ্বেদ থেকে গৃহীত না হওয়া সত্ত্বেও—স্বভাববৈশিষ্ট্যে ঋগ্বেদতুল্য।

সুতরাং যুক্তিসহ অনুমান এই যে, বেশ কিছুকাল, সম্ভবত কয়েক শতাব্দী পর্যন্ত বৃহৎ ও লঘু ঐতিহ্য সহাবস্থান করেছিল। শ্রৌতযাগ বৃহৎ ঐতিহ্যের অন্তর্ভুক্ত, — তার মধ্যে সমুন্নত প্ৰত্নকথাভাণ্ডার, আনুষ্ঠানিক সাহিত্য ও পুরোহিততন্ত্র ছিল; জনসাধারণের সামূহিক জীবনের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট সমস্যা তার বিষয়-পরিধির অন্তর্গত। কোনাে সুনির্দিষ্ট প্রণালীবদ্ধ, ধর্মতত্ত্ব বা প্রত্নপুরাণ অথর্ববেদ না থাকার কারণ মূলত তা সম্পূর্ণভাবে দেবসংস্রবমুক্ত ছিল। মন্ত্রগুলি কখনো কখনো নিগুঢ় রহস্যপূর্ণ এবং অদীক্ষিতের কাছে অর্থহীন বাগাড়ম্বর বলে প্ৰতিভাত।

বৃহৎ ঐতিহ্যের পুরোহিতগণ কিছুকাল পৃষ্ঠপোষকসুলভ মনোভাব নিয়ে লঘু ঐতিহ্যের অন্তৰ্গত ধর্মাচরণকে মেনে নেওয়ার পরে এমন একটা সময় এল, যখন প্রাচীনপহী পুরোহিতরা জাদুকর-চিকিৎসকের প্রতি ঘূণা ও বিদ্রুপ প্রদর্শণের পরিবর্তে ঈৰ্যন্বিত হয়ে উঠলেন। সমাজের উৎপাদন-ব্যবস্থায় যোগদান না করে, পরভোজী শ্রেণীরূপে এরা প্রচুর স্বাচ্ছদ্য ও ঐশ্বৰ্য ভোগ করতেন। ফলে এঁরা সেই জাদুকর-চিকিৎকদের নিজেদের প্রতিদ্বন্দ্বী ভাবছিলেন, যাঁরা প্রচলিত দেবকাহিনী বা যজ্ঞানুষ্ঠান ব্যতিরেকেও যজমানদের সম্পদের উপর নির্ভরশীল হয়ে জীবনযাপন করত।

প্ৰধান সামাজিকে শ্রেণী-বিভাজন অবশ্য ছিল ব্রাহ্মণ পুরোহিত ও শামানের মধ্যে। এটা যথার্থ যে, এই দুই শ্রেণীর পুরোহিতদের কার্যক্ষেত্র ছিল পরস্পর ভিন্ন; তবে, প্রাচীনপহী পুরোহিতদের কাছে এটা স্পষ্ট ছিল যে, যজমানের যজ্ঞীয় দক্ষিণা দেবার ক্ষমতা যেহেতু সীমাবদ্ধ, তাই এই দুই ধরনের ধর্মচর্যা ও পুরোহিতসম্প্রদায়ের পরস্পর-বিচ্ছিন্ন কার্যাবলীর ফলে তাদের উপার্জনযোগ্য ধন অকারণে বিভাজিত হচ্ছে। এরই ফলে অথর্ববেদকে সংহিতা সাহিত্যের অন্তর্ভুক্ত করার তাগিদ বাড়ল; ত্রয়ী হল চতুষ্টয়ী : অথর্ববেদেয় পুরোহিতকে ‘ব্ৰহ্মা’ নামে অভিহিত করে যজ্ঞে বিশেষ স্থান দান করা হ’ল। তবে যজ্ঞানুষ্ঠানে বিভিন্ন দায়িত্ব যেহেতু ইতিমধ্যে হােতা, উদগীতা, অধ্বষু এবং তাদের সহকারীদের মধ্যে বিভক্ত হয়ে গেছে, তাই ব্ৰহ্মাকে দূরে উপবিষ্ট অবস্থায় সমগ্ৰ যজ্ঞটি পর্যবেক্ষণের দায়িত্ব দেওয়া হ’ল,–অনুষ্ঠানের ত্রুটিবিচ্যুতির প্রতি দৃষ্টি আকর্ষণ করে তিনি প্ৰায়শ্চিত্তমূলক অনুষ্ঠানের বিধান দিতেন। এই দায়িত্বভার গ্রহণ করার পূর্বে ব্ৰহ্মাকে প্রচলিত শান্ত্র শিক্ষা করতে হাত; কিন্তু তিনি সেই সঙ্গে অথর্ববেদের নিজস্ব রচনাকে মূল ধারার সঙ্গে সংযোজিত করে দক্ষিণার সিংহভাগ গ্রহণ করতেন,–রাজপুরোহিতরূপে ব্ৰহ্মার শ্রেণীগত অবস্থানের ফলেই তাকে তা থেকে বঞ্চিত করা সম্ভব ছিল না। তবে, ব্ৰহ্মার ভূমিকার গুরুত্ব সমাজে অনেক বিলম্বে উপলব্ধ হয়েছিল।

অথর্ববেদেব পরিপ্রেক্ষিতে যে অলৌকিক ক্ষমতা প্ৰাকৃতিক শক্তিকে নিয়ন্ত্রণ করে বা প্রতিবাদী লোকাতীত শক্তিকে নিরপেক্ষ করে তোলে–ব্ৰহ্মা তারই মানুষী রূপ। অবশ্য বৃহৎ ঐতিহ্যের অন্তর্গত পুরোহিতরাও যজ্ঞানুষ্ঠানের মধ্যে এই শক্তির ক্রিয়া সম্পর্কে অবহিত ছিলেন–পরবর্তীকালে এর যৌক্তিকতা প্রমাণের জন্য যজ্ঞানুষ্ঠানে যজমানের পক্ষ থেকে প্রকৃতিকে নিয়ন্ত্রণ-কামনায় উচ্চারিত মন্ত্রসমষ্টি থেকে উদ্ভূত শক্তিকে তঁরা ‘অপূর্ব’ আখ্যা দিয়েছিলেন। ব্ৰহ্মার সঙ্গে ইন্দ্ৰজালের সম্পর্ক বিষয়ে পরবর্তী ব্ৰাহ্মণ সাহিত্যের বিভিন্ন স্থানে স্পষ্ট ইঙ্গিত রয়েছে। দেবশক্তির মধ্যস্থতা ছাড়াই লোকাতীত শক্তিকে সরাসরি নিয়ন্ত্রণ করার যে খ্যাতি তিনি অর্জন করেছিলেন, তারই ফলে ব্ৰহ্মার উন্নততর মাধ্যাত্মিক অবস্থান এবং যজ্ঞবিদ্যা সম্পর্কে সমৃদ্ধতির জ্ঞান সমাজে স্বীকৃত ছিল বলে যজ্ঞ পর্যবেক্ষক পুরোহিতের ভূমিকা গ্ৰহণ তার পক্ষে স্বাভাবিক হয়ে উঠেছিল। একদিকে হােতা, উদগাতা ও অধ্বষু এবং অন্যদিকে ব্ৰহ্মার ভূমিকার কল্যাণে সামূহিক ও গাৰ্হস্থ্য ক্ষেত্রে যাবতীয় প্রয়োজন সিদ্ধির সম্ভাবনা উজ্জ্বল হয়ে উঠল। বৃহৎ ও লঘু ঐতিহ্যের মধ্যে সমঝোতার মাধ্যমে ‘ব্ৰহ্মা’ পুরোহিতদের সামাজিক প্রতিপত্তি বর্ধিত হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে বিমূর্ত আধ্যাত্মিক ভাবনার প্রতীক ‘ব্রহ্মন’ (ক্লীবলিঙ্গ)-এর গৌরবও বর্ধিত হল। এই ব্ৰহ্মা বৈদিক যুগের চূড়ান্ত পর্বে বহু বিলম্বে দেবসঙ্ঘে প্ৰবিষ্ট হয়েছিলেন; ঋগ্বেদের দশম মণ্ডলে তার সঙ্গে আমাদের প্ৰথম পরিচয় ঘটে,–এই অংশটি বহু বিমূর্ত ভাবকেন্দ্ৰিক অথর্ববেদীয় সূক্ত রচিত হওয়ার পর্যায়ের সমকালীন।

উন্নতিশীল পশুপালক সমাজে একক পরিবারের কর্তা পুরোহিতের ভূমিকা গ্ৰহণ করতেন; অন্যদিকে গোষ্ঠীপতি ছিলেন একান্নাবতী বৃহৎ পরিবারের পুরোহিত। আবার গ্রামীণ জাদুকর-পুরোহিত সমগ্ৰ গোষ্ঠীর পক্ষ থেকে ধমীয় আচরণগুলি পরিচালনা করতেন। কৃষিব্যবস্থার পত্তন হওয়ার পরে উদ্ধৃত্তি সম্পদ যখন আরো বর্ধিত হ’ল,–কায়িক শ্রম থেকে বিচ্ছিন্ন ও অবকাশযুক্ত পুরোহিতশ্রেণীর উত্থান দেখা গেল। বৃহৎ ঐতিহ্যে জাদুকরপুরোহিতকে মূলত এককভাবে, মাঝে মাঝে এক বা দুজন গৌণ সহকারীর সাহায্যে, কাৰ্যভার পরিচালনা করতে হত। যাজকতান্ত্রিক ভারতীয় সমাজের অন্তিম পর্যায়ে অথর্ববেদীয় পুরোহিত যখন মূল যাজকগোষ্ঠীর অন্তর্ভুক্ত হলেন তখন ঐতিহাসিকভাবে পরস্পরভিন্ন পৌরাহিত্য-প্রক্রিয়াগুলির মধ্যে নতুন ধরনের সমন্বয় ও সংমিশ্রণের প্রবণতা দেখা দিল। অবশ্য এই সম্ভাবনা বাস্তবায়িত হওয়ার পূর্বে শামানেরা যজ্ঞীয় সাহিত্য অধিগত করে নিয়েছিলেন; এদের মধ্যে অনেকেই সম্ভবত অনার্য ব্রাত্যদের সংস্পর্শে এসে তাদের রহস্যগুঢ় রচনাসম্ভারের সাহায্যে বিমূর্ত ও আধ্যাত্মিক ধ্যান-ধারণার একটি প্রবণতা গড়ে তুলেছিলেন। সুতরাং যে দীর্ঘ ঐতিহ্যের অন্তভাগে অথর্ববেদের অবস্থান, তার মধ্যে রয়েছে গ্রামীণ জাদুকরপুরোহিতগণ (শামান), যাজক সম্প্রদায় এবং রহস্যময় আধ্যাত্মিক (সন্ন্যাস) চিন্তাধারা।

খ্রিস্টপূর্ব পঞ্চম শতাব্দীর কাছাকাছি সময়ে বৌদ্ধধর্মের উত্থান ও বিস্তারের ফলে বৈদিক ধর্ম যখন প্ৰবল প্ৰতিদ্বন্দ্বিতার সম্মুখীন হয়েছিল, খুব সম্ভবত তখনই অথর্ববেদ সংহিতা-সাহিত্যের অন্তর্ভুক্ত হয়। পুরোহিতদের মধ্যে এই উপলব্ধি সঞ্চারিত হয় যে, ঐক্যবদ্ধ না হলে তাদের পতন অনিবাৰ্য। রক্ষণশীল ধর্মের সম্পদশালী পুরোহিতদের পক্ষে এই সিদ্ধান্ত ছিল বৈপ্লবিক ঘটনা এবং নিশ্চিতভাবে এতেই বৈদিক ধর্মের আয়ুষ্কাল বহুগুণ বর্ধিত হয়েছিল। প্রাচীন ধর্মচৰ্যার পরিধি থেকে বিচ্ছিন্ন অবস্থায় থেকেও জনসাধারণের কিছু কিছু অংশের সুখী ও তৃপ্ত জীবন যাপনের আশঙ্কাও সেখানে ছিল। জাদুকর চিকিৎসক যেহেতু তাদের গাৰ্হস্থ্য জীবনের সমস্যা সমাধান করে দিত, বিপুল ও ব্যয়সাধ্য প্রধান যজ্ঞ অনুষ্ঠানের প্রতি কোনও আকর্ষণ তারা বোধ করত না কিংবা তেমন সঙ্গতিও তাদের ছিল না। ব্ৰহ্মাবর্ত অর্থাৎ কুরু-পঞ্চাল অঞ্চলের কেন্দ্ৰভূমি থেকে দূরে যারা বাস করত তাদের মধ্যে বৃহৎ ঐতিহ্যে উল্লিখিত যজ্ঞের প্রভাব হ্রাসের লক্ষণগুলি অধিক প্ৰকট, কেননা রক্ষণশীল অঞ্চলের প্রান্তসীমায় বসবাসকারী জনসাধারণের মধ্যে প্রচলিত ধর্মাচারের প্রতি উপেক্ষা প্রদর্শনের প্রবণতা সর্বদাই অধিক পরিস্ফুট হয়। এটা আকস্মিক কোনো সমাপতন নয় যে, অথর্ববেদের ভৌগোলিক ও সামাজিক পরিপ্রেক্ষিতে স্পষ্টতই পূর্বাঞ্চলে মগধদেশে আর্যদের বসতি বিস্তারের প্রমাণ বহন করে, যেখানে অবৈদিক আদিম ধর্ম প্রচলিত ছিল। সেই সঙ্গে বৌদ্ধধর্মের আবির্ভাবের পূর্ববর্তী, সমকালীন ও পরবর্তী সন্ন্যাসী গোষ্ঠীগুলির উত্থান ও বিকাশের কথাও আমাদের মনে রাখতে হবে। সম্ভবত, সমাজবদ্ধ জনসাধারণের যে বিপুল অংশ তখনও পর্যন্ত এইসব গোষ্ঠীপতিদের মতবাদকে অনুসরণ করত, তারা প্ৰধান শ্রৌতি-যাগগুলি সম্পর্কে মোটামুটিভাবে মোহমুক্ত হয়ে পড়েছিলেন, কিন্তু সেই সময় অবধি গাৰ্হস্থ্য ও সামাজিক সংকট মুহুর্তে সম্ভবত তাঁরা শামানদের প্রয়োজন অনুভব করতেন। সুতরাং তৎকালীন ধর্মীয় পরিপ্রেক্ষিতে শামানদের এবং তদুপযোগী অথর্ববেদের ধর্মচিন্তাকে তখনও পর্যন্ত প্রশ্রয় দিয়েছিল যদিও শ্রৌতপুরোহিতরা ও তাদের যজ্ঞানুষ্ঠান তখন প্রত্যাখ্যাত হওয়ার পথে। ফলে শ্রৌতপুরোহিতদের কাছে এই সত্য স্পষ্ট হয়ে উঠেছিল যে ইন্দ্ৰজালের প্রতি উপেক্ষার মনোভাবকে জয় করতে হবে; অথৰ্ববেদ ও তার পুরোহিতসম্প্রদায়ের প্রতি সামাজিক উপেক্ষার মনোভাবকে দূর করতে হবে এবং পবিত্র সংহিতা-সাহিত্যের পরিধিতে ও আনুষ্ঠানিক আচার অনুশীলনের মধ্যে তার শাস্ত্র ও যাজকতন্ত্রকে স্বীকৃতি দিতে হবে। অস্তিত্বরক্ষার জন্য আপোষ মীমাংসার অনিবাৰ্য কঠোর পদ্ধতিরূপে তা বিশেষ ফলপ্রসূ হয়েছিল।

সংহিতা সাহিত্যে বিলম্বে সন্নিবেশিত অথর্ববেদের মধ্যে আমরা অধিকতর মাত্রায় দক্ষিণ-পূর্বাঞ্চলের ভৌগোলিক ও প্রাকৃতিক বৈশিষ্ট্য এবং সেই সঙ্গে বিহার ও বাংলার বেলাভূমি অঞ্চলের বিবিধ প্রকার ব্যাধি-নামের সঙ্গে পরিচিত হই; ভাষাতাত্তিক নিদর্শন থেকেও বোঝা যায় যে, অথর্ববেদের অধিকাংশই অন্যান্য সংহিতার তুলনায় পরবর্তী কালের রচনা। বিষয়বস্তুর বিশ্লেষণ থেকে এটা স্পষ্ট যে, অথর্ববেদের সূক্তগুলি কেবলমাত্র সেই সমাজেই রচিত হওয়া সম্ভব যা কৃষি ব্যবস্থা, বাণিজ্য, প্রশাসন, স্থাপত্য, জ্যোতির্বিদ্যা ও চিকিৎসা শাস্ত্ৰে প্ৰভূত উন্নতি সাধন করেছে এবং যার মধ্যে জটিল ও সুপ্রতিষ্ঠিত যাজকতন্ত্র বিদ্যমান। দক্ষিণার উপর গুরুত্ব আরোপ এবং ব্ৰহ্মৌদন, ব্ৰক্ষাগবী ও পঞ্চৌদন অজ, বশ্য গবী ইত্যাদিব প্রয়োগ থেকে পুরোহিততন্ত্রের তুলনামূলকভাবে পরবর্তী পর্যােয়ই সুস্পষ্ট হয়ে উঠেছে। রাজা ও সৈন্য সম্পর্কিত সূক্তগুলি প্রতিষ্ঠিত রাজত্ব এবং প্রশাসন ও সুনিয়ন্ত্রিত সৈন্যবাহিনীর দিকে নির্দেশ দেয়।

এটা সত্য যে, অথর্ববেদের বিষয়বস্তু বহু অংশ যদিও প্রথম সংকলিত হয়েছে তবু এইগুলি নিশ্চয়ই আর্য জনগোষ্ঠীর নিকট দীর্ঘকাল ধরে পরিচিত ছিল। সুতরাং উল্লিখিত ব্যাধিসমূহ, অপদেবতায় বিশ্বাস, বৃক্ষনাম, সর্প এবং কীটপতঙ্গের ভয়, সপত্নী সম্পর্কে উদ্বেগ, অনুঢ়া বৃদ্ধর উদ্বেগ ও হতাশা ইত্যাদি সমাজের চিরকালীন বিষয়। কিন্তু এই সংহিতায় তাদের উপস্থিতি থেকে পরবর্তীকালে এগুলির সংযোজনই প্রমাণিত হয়,–বিশেষত যখন শ্রৌত পুরোহিতরা বিরোধিতা ত্যাগ করে এই পাঠ ও বিবিধ সহগামী ধর্মর্ষোকে রক্ষণশীল ধর্মের মধ্যে অন্তর্ভুক্ত করা অনিবাৰ্য বলে বুঝেছিল।