০৬. আঙ্গিক ও ভাষা

০৬. আঙ্গিক ও ভাষা

তৈত্তিরীয় সংহিতায় বিভিন্ন অনুষ্ঠানের বিবৃতি ও ব্যাখ্যার ধরন ভিন্ন ভিন্ন। কখনও কখনও একাদিক্ৰমে অনুষ্ঠানগুলি বিবৃত হয়েছে, কখনও বা একই অনুষ্ঠান পৰ্যায়ক্রমে ব্যাখ্যাত হয়েছে। প্রচলিত ভাষার বিশেষ ধরনের প্রয়োগে দৈনন্দিন ভাষার যুক্তি-পরম্পর্য পরিবর্তিত হয়ে আকৃতি ও তাৎপর্যের মধ্যে গূঢ়াৰ্থবহ প্রতীকী ব্যঞ্জনা দেখা দিয়েছে। অনুষ্ঠানের ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র অনুপুত্বেও প্ৰতীকধর্মিতা যুক্ত হওয়ার ফলে যজ্ঞধর্ম ক্রমশ দৈনন্দিন জীবনবৃত্ত থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে বিশেষ ধরনের গূঢ় এক বিদ্যায় পরিণত হয়েছে। অধ্যাত্ম ব্যাজনার সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ বিচিত্র সব প্রত্নকথাও ধীরে ধীরে আবিষ্কৃত ও ব্যাখ্যাত হওয়ায় ভাষা অনিবাৰ্যভাবেই বিমূর্তয়িত হয়ে পড়েছে। এই ভাষা প্রকৃতপক্ষে সংহিতা ও ব্রাহ্মণ রচনার মধ্যবর্তী যুগসন্ধিক্ষণের ভাষা। প্রসঙ্গত বলা যায় যে, ঋগ্বেদের তুলনায় যজুর্বেদের শব্দভাণ্ডার সমৃদ্ধতির ও উন্নততর ; আৰ্য উৎস ছাড়াও অনাৰ্য উৎস থেকেও সম্ভবত বিচিত্ৰতর প্রতিশব্দ গৃহীত হয়েছিল। ঋগ্বেদের ক্রিয়া-বৈচিত্ৰ্য কিছুটা হ্রাস পেলেও যজুর্বেদের পর্যায়ে ক্রিয়াপদের সমৃদ্ধি প্রায় সমতুল্যই রয়ে গেছে। অবশ্য কিছু কিছু নূতন ক্রিয়াপদের সন্ধানও এই যুগেই প্রথম পাওয়া যাচ্ছে। তার কিছু বা আহত হয়েছে প্ৰাগাৰ্য অস্ট্রিক ও দ্রাবিড় প্রতিবেশীদের শব্দভাণ্ডার থেকে। অন্তর্বিবাহ, বাণিজ্য ও দৈনন্দিন নানা সম্পর্কের মধ্যে প্রতিবেশীদের শব্দভাণ্ডার থেকে ইন্দো-আর্য ভাষা শব্দ সংগ্ৰহ করতে শুরু করেছে। এই উত্তর বৈদিক পৰ্যায়ে বিশেষভাবে। ভাষার দিক থেকেও অনার্য জাতি গোষ্ঠীর কাছে আৰ্য বৈদিক ভাষার ঋণ নূতন নূতন বৃক্ষ, লতা কিংবা পরাজিত শত্রুর ও যজ্ঞীয় পশুর শারীরিক বর্ণনায় এবং সমাজসংস্থার জ্ঞাপক নানা শব্দে সুস্পষ্ট। মন্ত্রের যে অংশগুলি নিশ্চিতভাবে যজুর্বেদের নিজস্ব, সে সবই সংক্ষিপ্ত ও সূত্রবদ্ধ উচ্চারণখুব কম ক্ষেত্রেই সম্পূর্ণ শ্লোক আমরা পাই। অনুষ্ঠান সম্পর্কিত গদ্যে-বচিত নির্দেশাবলীতেই প্রকৃত পুরোহিত-তন্ত্রের রচনার পরিচয় পাই, যা ঋগ্বেদে প্রাপ্ত কাব্যশৈলী থেকে স্বরূপত ভিন্ন। তাই, ইচ্ছাকৃতভাবে নিগূঢ় রহস্য-বিদ্যা নির্মাণের প্ৰয়াস স্পষ্টতই পরিস্ফুট হয়েছে তির্যক অর্থ সম্পন্ন বাক্যাংশে, উদ্ভট সমীকরণে ও আপাত অৰ্থহীন শব্দ দিয়ে রচিত সূত্রগুলিতে। অবশ্য কিছু কিছু ক্ষেত্রে সরলতর প্রার্থনাও প্রথিত হয়েছে। সংখ্যা ও ছন্দের পুনরাবৃত্তির মধ্যে একটি রহস্যের বাতাবরণ নির্মাণের প্রচেষ্টা পরিস্ফুট।

ঋগ্বেদের বহু পরিচিত বাক্যাংশে ও মন্ত্রবিন্যাস ইতোমধ্যে স্তোত্র ও প্রার্থনাগুলির জাদুকরী প্রভাব অর্জন করে নিয়েছে। যজুর্বেদ সংহিতায় এই নতুন মন্ত্রবিন্যাসকে অনুসরণ করা হয়েছে। মৌখিকভাবে রচিত সাহিত্যে এই ধরনের পুনরাবৃত্তি মন্ত্রের আঙ্গিক ও বিষয়গত তাৎপর্য বৃদ্ধির ক্ষেত্রে যে বিশেষ একটি ভূমিকা অর্জন করেছে তাতে কোনো সন্দেহ নেই। এই নির্দিষ্ট বিন্যাস বার বার অনুসৃত ও সচেতনভাবে পুনরাবৃত্ত হওয়ার ফলে পুরোহিতদের অনেক শ্রম লাঘব হ’ত ; মূলত বিশুদ্ধ আনুষ্ঠানিক কাৰ্যপদ্ধতি ও মন্ত্র উচ্চারণের প্রয়োজনে শ্রোতাদের মনোযোগ যাতে বিক্ষিপ্ত না হয়, বহু পরিচিত মন্ত্রাংশের পুনরাবৃত্তি সেক্ষেত্রে একটি বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করত। এই যুগে ইন্দ্রের প্রাধান্য ধীরে ধীরে খর্ব হতে থাকে এবং আনুপাতিকভাবে প্রজাপতির মর্যাদা ক্রমাগত বৃদ্ধি পায়। সমাজে নূতন চেতনার উন্মেষের ফলে পুরাতন যজ্ঞে নুতন অনুপুঙ্খ যুক্ত হয় কিংবা সম্পূর্ণ নুতন যজ্ঞ এবং তৎসম্পর্কিত প্ৰত্নকথা উদ্ভাবিত হতে থাকে। লোক ধর্মের অনেক উপাদান বিভিন্ন অনুপুত্বে আবিষ্কার করা যায়। বহুক্ষেত্রে আদিম ঐন্দ্ৰজালিক বিশ্বাসের অবশেষও খুঁজে পাওয়া সম্ভব। তৎকালীন ভাষায় আধ্যাত্মিক প্ৰতীকধর্মিতা ও রূপকধৰ্মী প্রয়োগ বিশেষ লক্ষণীয়। গভীর দ্যোতনা-যুক্ত বিশিষ্ট বাক্যাংশ আনুষ্ঠানিক পবিত্রতায় মণ্ডিত হয়ে সমগ্ৰ সমাজের নিকট ধর্ম সাহিত্য-রূপে সম্মানিত হত। পুরোহিত রচয়িতাদের প্ৰজন্ম-পরম্পরা যজ্ঞধর্মে কার্যকরী ও স্মৃতিতে ধারণ করার যোগ্য যে নির্দিষ্ট সূত্রবদ্ধ ও সংক্ষিপ্ত ভাবরীতির বিকাশ ঘটিয়েছিলেন, তা সমগ্ৰ জনগোষ্ঠীর নিকট আদরণীয় হয়ে উঠেছিল। মৌখিক সাহিত্যের বিশিষ্ট চরিত্র-লক্ষণ বাচনিক কাঠােমাতো পরিস্ফুট হয়ে উঠেছে। পুনরাবৃত্তি ‘যেমন স্মৃতিসহায়ক ও ঐন্দ্ৰজালিক প্রভাবযুক্ত বাকরীতি রূপে বিবেচিত হয়েছে, তেমনি তাদের মধ্যে স্থাপত্যসুলভ অন্তর্লীন গঠনগত ঐক্যের বোধও অভিব্যক্তি। একই ধর্মবিশ্বাসগত উত্তরাধিকারের প্রতি সমাজের আনুগত্য যেমন স্তোত্রের পুনরাবৃত্ত অংশগুলির মধ্যে আভাসিত হ’ত।

ঋগ্বেদীয়পদ্যের মতোই যজুর্বেদের গদ্যভাষা শ্বাসাঘাতযুক্ত স্বরে গ্রথিত, ফলে তা কানে শুনে স্মৃতিতে ধারণ করার পক্ষে বিশেষ উপযোগী। শুধু শ্বাসাঘাতের জন্যই নয়, গদ্য কাঠামোটি বহু ক্ষেত্রেই পদ্যের আঙ্গিকেরই অনুকরণ। অনুপ্ৰাসযুক্ত শব্দ ও বাক্যাংশ নির্দিষ্ট দূরত্বে সন্নিবেশিত হওয়ার ফলে ছন্দোময়তা সৃষ্টি হয়েছে। বিশেষ ভঙ্গিতে ও সামঞ্জস্যপূর্ণ বাচনিক পুনরাবৃত্তি সুনিয়ন্ত্রিতভাবে প্ৰযুক্ত হওয়ার ফলে অভিনব সূত্রাকৃতি রচনাশৈলীর সৃষ্টি হয়েছে। এতে সর্বপ্রকার বাহুল্য বর্জিত হয়, যাতে কণ্ঠস্থ করা ও স্মরণে রাখা সহজ হয় ; ফলে, যজ্ঞে প্রয়োগও অনায়াসে বা স্বল্পতর আয়াসে সাধিত হয়। এ ধরনের গদ্যভাষার বিষয়বস্তু মোটামুটি দুই ধরনের : (১) ক্রিয়াপদহীন, সংক্ষিপ্ত, প্রায় গূঢ়াৰ্থযুক্ত, ছন্দযুক্তিবদ্ধ সূত্রায়িত মন্ত্রসমূহের আনুষ্ঠানিক উচ্চারণ–আপাতদৃষ্টিতে অর্থহীন বাকবিস্তার বলে মনে হলেও আনুষ্ঠানিক আচার ও ভঙ্গির সঙ্গে সম্পর্কিত হওয়ার ফলে তাতে কিছুটা তাৎপর্য খুঁজে পাওয়া সম্ভবপর। শৈলীগত বিচারে নিরলংকার ও ব্যবহারিক হলেও এর মধ্যেই আমরা সংস্কৃত গদ্যের প্রাথমিক নিদর্শন খুঁজে পাই। (২) প্ৰত্নকথাগুলি যে ধরনের গদ্যরীতি বিবৃত হয়েছে তা কতকটা ভিন্ন। শৈলীগত বিচারে স্বল্প শব্দ প্রয়োগের প্রবণতা এর মধ্যেও লক্ষণীয়, যদিও এতে ক্রিয়াপদ একেবারে অনুপস্থিত নয় এবং বাচনিক কাঠামোও কিছুটা কম গ্ৰন্থিল। ব্যবহারিক জীবনে প্রয়োগ-যোগ্যতা পরীক্ষা করার সুযোগ থাকায় এবং একই সংস্কার ও ধর্মীয় বিশ্বাসের উত্তরাধিকারকে গ্ৰহণ করার ফলে যজুর্বেদের গদ্যভাষার মধ্যে উপলব্ধির প্রত্যক্ষতা স্পষ্টভাবে প্রতিফলিত হয়েছে। বস্তুত, প্রাথমিক গদ্যের মাত্র দুটি উদ্দেশ্যই ছিল : যজ্ঞানুষ্ঠানের নির্দেশাবলী প্ৰণয়ন এবং তৎসম্পর্কিত সংক্ষিপ্ত ভাষ্য রচনা। ভায্যে অন্যান্য বিষয়ও যুক্ত হয়েছে, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক ইতিহাসের পক্ষে যাদের গুরুত্ব অনেক। কখনও কখনও যজ্ঞে ব্যবহৃত বিভিন্ন উপকরণ বা আনুষ্ঠানিক কাৰ্যপদ্ধতিকে আধ্যাত্মিক ব্যঞ্জনায় মণ্ডিত করার সচেতন প্রচেষ্টা হয়েছে। ফলে, অনেক ক্ষেত্রেই রচনাশৈলী। আপাতদৃষ্টিতে অনাবশ্যকভাবে ও অত্যধিক পরিমাণে কর্কশ, উচ্চাবচতাহীন, একঘেয়ে, নিষ্প্রাণ ও অনাকর্ষণীয় হয়ে উঠেছে। আকস্মিকভাবে কখনও কখনও দু একটি শ্লোক সন্নিবেশিত হওয়ার ফলে দীর্ঘস্থায়ী অনুষ্ঠানসর্বস্ব গদ্যের একঘেয়ে গতানুগতিকতায় স্বল্প-পরিমাণ বৈচিত্র্যের সঞ্চার হয়েছে ; কিন্তু এই সব শ্লোকও কাব্যের প্রয়োজনে আসে নি, এসেছে পুরোহিতের আনুষ্ঠানিক প্রয়োজনে। অধিকাংশ শ্লোকই ঋগ্বেদ থেকে সরাসরি ঋণরূপে গৃহীত হয়ে যাজ্য বা অনুবাক্যা বা অন্য কোনও যজ্ঞকর্মের অঙ্গরূপে প্ৰযুক্ত হয়েছে।

রচনাশৈলীর মূলগত কর্কশতা সত্ত্বেও কিছু পদ্যাংশে যৎসামান্য কাব্যিক অভিব্যক্তির নিদর্শন রয়েছে। যদিও অধিকাংশ ক্ষেত্রেই এগুলি অতি সাধারণ আলংকারিক অনুপুঙ্খ, প্রাথমিক স্তরের উপমা ও রূপকের স্তর থেকে উন্নততর কোনো পর্যায়ে উন্নীত হতে পারে নি। ফলে, প্রায় সম্পূর্ণতই প্রকৃত কাব্যিক আবেদন সৃষ্টির ক্ষমতা থেকে বঞ্চিত হয়েছে। অধিকাংশ উপমা ও রূপকের উদ্দেশ্য কোনও একটি আনুষ্ঠানিক অনুপুঙ্খের উপর গুরুত্ব আরোপ করা। তবুও এদের মধ্যেই দৈনন্দিন জীবন থেকে সংকলিত উপমার পরিচ্ছন্নতা ও অন্তর্লীন শক্তি আমাদের মুগ্ধ করে। কিছু কিছু চিত্রকল্পের মধ্য দিয়ে আমরা সহসা তৎকালীন জনসমাজের ব্যবহারিক বাস্তব জীবন সম্পর্কে ধারণা করে নিতে পারি। উপমা, রূপক এবং চিত্রকল্পের প্রয়োগে হয়ত ঋগ্বেদের মন্ত্রের তুলনায় কল্পনাসমৃদ্ধির অভাব আছে ; তবুও, অনুষ্ঠান-নির্ভর সাহিত্যে ব্যবহারিক প্রয়োগের মধ্যে যথেষ্ট কার্যকরী বাককুশলতার পরিচয় পাওয়া যায়। অনুপ্ৰাসযুক্ত মন্ত্রের অধিকাংশ ঋগ্বেদ থেকে সরাসরি উদ্ধৃত হয়েছে, যেহেতু সেগুলি সহজেই কণ্ঠস্থ করা যায়। যে সমস্ত ক্ষেত্রে যজুর্বেদের নিজস্ব অনুপ্রাস নির্মাণের নিদর্শন পাওয়া যায়, সেখানে সে সব শুষ্ক ব্যবহারিক এবং সম্পূর্ণত আনুষ্ঠানিক রচনার তাৎপর্য বৃদ্ধির উদ্দেশ্যেই প্ৰযুক্ত হয়েছে, আলংকারিক ও কাব্যিক মণ্ডনের তাগিদে নয়। বস্তুত, যজুর্বেদ, অথর্ববেদ এবং ব্ৰাহ্মণ-গ্ৰন্থ-সমুহে এ জাতীয় রচনায় অলংকার মূলত স্মৃতির সহায়ক।