২৪. ঋগ্বেদ : লোকায়ত না ধর্মসাহিত্য?

ঋগ্বেদ : লোকায়ত না ধর্মসাহিত্য?

ঋগ্বেদের চরিত্র সম্পর্কে দীর্ঘদিন ধরে বাদানুনাদ চলে আসছে,–উৎপত্তি ও অন্তর্বস্তুর বিচারে তা ধর্মসাহিত্য না লোকায়াত গ্ৰন্থ? কোনো কোনো কবি তাদের রচিত সূক্তে যজ্ঞের উল্লেখ করেছেন, কিন্তু প্রায়ই সংহিতা-পাঠের সঙ্গে যজ্ঞীয় বিনিয়োগের সঙ্গতি রক্ষিত হয় নি। স্পষ্টতই এই সব সুক্তের যজ্ঞীয় বিনিযোগ পরবর্তীকালে যান্ত্রিকভাবে পর্যালোচনাপ্রসূত পুনর্ভাবনার ফলে ঘটেছিল। লুই হ্রনু তার একটি গ্রন্থে মন্তব্য করেছেন, “প্রায়ই বলা হয়ে থাকে যে বেদে লোকায়ত কাব্য রয়েছে। যথার্থ বিচারে অবশ্য এরকম নিদর্শন পাওয়া যায় না ; শুধু কিছু কিছু লোকায়ত বিষয়বস্তু, গান, ধ্রুবপদ ও কীেতুককর আখ্যানকে ধর্মীয় উদ্দেশ্যে বিশেষ ধরণে প্রয়োগ করা হয়েছে। প্রকৃতপক্ষে বেদের সমস্ত কিছুই ধর্মীয় বিধিরই অধীন ; এর লক্ষ্য দ্বিবিধ-একদিকে পর্যাপ্ত অলীকৃত ভাষায় দেবতার স্তুতি এবং অন্যদিকে পুরোহিতের ক্রিয়াকলাপের পার্থিব দাবিসমূহ পরিপূর্ণ করা।” অর্থাৎ বিভিন্ন সুক্তে মাঝে মাঝে লোকায়ত বিষয় প্রবর্তিত হলেও ঋগ্বেদ মূলত ধর্মীয় সাহিত্য। বস্তুত পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্ত থেকে প্রাচীন সাহিত্যরূপে আমাদের কাছে যা কিছু এসে পৌঁছেছে তার অধিকাংশই নিছক শিল্পবোধপ্রণোদিত সৃষ্টি নয়, বরং সঙ্ঘবদ্ধ সামাজিক জীবনের আয়তনের মধ্যে এদের একটা সুস্পষ্ট উদ্দেশ্যমূলক প্রয়োগিক দিক ছিল। যথোপযুক্ত সাংস্কৃতিক পরিপ্রেক্ষিতেই তাদের সর্বপ্রথম স্থাপিত করে, শুধু সাহিত্যরীতি হিসাবে বিচার না করে, বিশেষ অভিব্যক্তি রূপেই গ্ৰহণ করতে হবে। প্রচলিত সংহিতার যে যজ্ঞীয় বিনিয়োগ পাওয়া যায় তা সায়ণ কর্তৃক ঐতরেয় ব্রাহ্মাণ ও আশ্বলায়ন শ্ৰীেতসূত্র থেকে সঙ্কলিত হয়েছিল। কারো মতে ঋগ্বেদের সূক্তগুলি প্রথম যজ্ঞানুষ্ঠান থেকে এবং ভারতীয় আৰ্যদের নিরাপত্তা ও বিজয় বিধানের জন্য দেবতাদের প্রতি কৃতজ্ঞতা-জ্ঞাপক সূক্তগুলি থেকে স্বতন্ত্র ও স্বাধীনভাবে রচিত হয়েছিল ; পরবতীকালে সূক্তগুলির উপযোগিতা ব্যাপকতর করার জন্য যজ্ঞানুষ্ঠানগুলি আবিষ্কৃত হয়েছিল। ঋগ্বেদের বহু মন্ত্রই কেবলমাত্র সংহিতায় পাওয়া যায় ; এতে প্রমাণিত হয় যে যজ্ঞে এদের প্রয়োগ ছিল না। এই বাদানুবাদকে আমরা তিনটি সম্ভাব্য দৃষ্টিভঙ্গি থেকে বিশ্লেষণ করতে পারি ; যেমন ঋগ্বেদে (১) প্রাথমিক ভাবেই যজ্ঞীয় আচার-বিধিমূলক, (২) এটি ধর্মসাহিত্য অর্থাৎ দেবকল্পনার বিবরণ, (৩) এটি লোকায়ত বিশ্বাস ও অনুষ্ঠানের সাহিত্য।

অন্তর্ধৃত অর্থাৎ সংহিতাপাঠের প্রমাণ থেকে সম্ভবত নির্দ্বিধায় বলা যায় যে অধিকাংশ সূক্তই দেবতাদের উদ্দেশে প্রার্থনারূপেই রচিত এবং সমস্ত সংহিতাটি প্ৰাথমিকভাবেই একটি স্তোত্ৰ-সংগ্ৰহ। প্রসঙ্গত বলা যায় যে, প্ৰখ্যাত পণ্ডিতদের বিশ্লেষণ অনুযায়ী ধর্মনিরপেক্ষ বিশুদ্ধ লোকায়ত রচনা প্রাচীন মানুষের পক্ষে অকল্পনীয়, যেহেতু তাদের বিশ্ববীক্ষা মূলত ধর্মকেন্দ্রিক ও অনুষ্ঠাননির্ভর, তাদের জগৎ রহস্য-নিয়ন্ত্রিত। ঋগ্বেদের সূক্ত শুধুমাত্র দেবতার প্রশস্তিবাচক গান নয়, কোন রাজকীয় শাসককে সন্তুষ্ট করার প্রয়োজনে রচিত বিশেষ ধরনের কাব্য, সর্বসাধারণের ব্যবহার উপযোগী ও ঐতিহ্যনিয়ন্ত্রিত বিশেষ শৈলীতে সেই কাব্য রচিত হত। যজ্ঞীয় বিনিয়োগের সঙ্গে সম্পর্কহীন মন্ত্র যেমন রচিত হয়েছিল, তেমনি বিনিয়োগযুক্ত কিছু কিছু মন্ত্র সম্ভবত রচনা-মুহুর্তে কোন যজ্ঞের সঙ্গেই সম্পর্কিত ছিল না। কাব্যসৌন্দর্য বা রচনাশক্তির জন্যই পরবতীকালে এগুলি যজ্ঞের অংশ হয়ে পড়ে। ঋগ্বেদের চূড়ান্ত সম্পাদনা ও সংকলনের সময়ে অর্থাৎ দশম মণ্ডলের উৎপত্তি পর্যন্ত কিছু কিছু ইতস্তত বিক্ষিপ্ত মন্ত্র ভাসমান অবস্থায় বিরাজ করছিল।

নিরুক্তে প্রদত্ত শ্রেণীবিন্যাস অনুযায়ী কিছু কিছু মন্ত্র নিরর্থক অর্থাৎ আনুষ্ঠানিকভাবে তাৎপৰ্যহীন। আরো কিছু মন্ত্রের যজ্ঞীয় উপযোগিতা সম্পর্কে সায়ণ বলেছেন, ‘বিনিয়োগঃ লৈঙ্গিকঃ’ অর্থাৎ অনুষ্ঠানের প্রকৃত প্রয়োজন অনুযায়ী মন্ত্রপ্রয়োগ। এইসব মন্ত্রের বিষয়বস্তু এবং তাদের আনুষ্ঠানিক বিনিয়োগের মধ্যে সম্পর্ক সমস্ত ক্ষেত্রেই অত্যন্ত শিথিল। যজ্ঞ যখনই প্ৰচলিত উপাসনা-পদ্ধতি অর্থাৎ অতিপ্রাকৃতের সঙ্গে যোগাযোগস্থাপনের সর্বজনগ্রাহ্য উপায় হয়ে উঠল—সম্ভবত তখন থেকেই আনুষ্ঠানিক বিনিয়োগের প্রয়োজন বিভিন্ন সুক্তের রচনায় নূতন একটি পর্যায়ের সূচনা হল অর্থাৎ বিশুদ্ধ যজ্ঞেরই উদ্দেশ্যে সূক্ত রচিত হতে শুরু হল। যদিও বিশ্লেষণে দেখা যায়। এ জাতীয় সূক্তের সংখ্যা অপেক্ষাকৃত কম। বিবিধ লক্ষ্যযুক্ত মন্ত্র রচনার বিভিন্ন স্তরগুলি আমরা হয়ত কতকটা নির্ধারণ করতে পারি। সম্ভবত প্ৰাথমিক পর্শনে পর্মনিরপেক্ষ প্রেরণার কিছু কিছু সূক্ত রচিত হয়েছিল, যদিও সাম্প্রতিক অর্থে ধর্মনিরপেক্ষ জীবনবীক্ষা প্ৰাচীন মানুষের ছিল না ; সেগুলি ছিল নিতান্তই অনুষ্ঠান-নিরপেক্ষ, কিংবা বলা যায় তাদের ধমীয় বৈশিষ্ট্যের কোনো প্ৰকাশ্য অভিব্যক্তি ছিল না। পরবর্তীকালে যজ্ঞানুষ্ঠান যখন অধিকতর গুরুত্ব অর্জন করল তখন স্পষ্ট আনুষ্ঠানিক প্রয়োজনে সূক্ত রচনার সূত্রপাত হল ; সেই খ্যাতি, প্রতিপত্তি ও পৃষ্ঠপোষকতা লাভের জন্য কবিদের মধ্যে প্রতিযোগিতা শুরু হল। অনুমান করা যায় যে, রাজকীয় পরিবারগুলির সঙ্গে সংশ্লিষ্ট চারণকবিরা লোভনীয় পুরস্কারের আশায় পরস্পরের সঙ্গে প্ৰতিদ্বন্দ্বিতা করতেন। প্ৰতিযোগিতার আবেগ-মথিত উদ্যমে চারণকবিদের পরিবারে যে মৌলিক কাব্যপ্রক্রিয়ার স্ফূরণ ঘটেছিল তাকে ভের্নন আর্নল্ড ‘চারণকবিদের পর্যায়’ বলে চিহ্নিত করতে চেয়েছেন। কিন্তু এখানে বলা প্রয়োজন সুসমৃদ্ধ রাজন্যবর্গের তুষ্টির জন্য অধিকাংশ সূক্তই পরস্পর প্রতিস্পর্ধী চারণকবিদের দ্বারা রচিত হয়েছিল—এমন সিদ্ধান্ত খুব একটা যুক্তিসংগত নয়। আর্যদের ইতিহাসে আদিম ইয়োরোপীয় প্রথম বাসভূমি থেকে বেরিয়ে মধ্যপ্রাচ্য ইরান হয়ে এদেশে এসে পৌঁছে এখানকার আদিম অধিবাসীদের যুদ্ধে পরাস্ত করে, তাদের বাসভূমি দখল করে বসবাস, প্রাগাৰ্য ঐশ্বৰ্য লুণ্ঠন ও ক্রমে কৃষিনির্ভর জীবনযাত্রার অভ্যাস, রাজ্যবিস্তার ও সমৃদ্ধিলাভ—এই দীর্ঘ জীবন-পরিক্রমার ইতিহাসের বহু স্মরণীয় অধ্যায় নানা বংশের নানা কবির প্রেরণায় সূক্তরূপে ব্যক্ত ও রচিত হয়েছিল। স্থানে কালে তার ব্যাপ্তি যেমন সুদূরপ্রসারিত, তেমনই উদ্দেশ্যে ও সিদ্ধিতে বৈচিত্ৰ্যও বিস্ময়কর। আক্রমণকারী আর্যদের যাযাবর জীবনেই সম্ভবত বহু সূক্ত গ্রথিত হয়েছিল। ভারতভুমিতে আৰ্যবসতি স্থাপিত হওয়ার পরই যদিও অধিকাংশ মন্ত্র রচিত, তবুও তাদের মধ্যে অনিশ্চিত ও অনিকেত বাতাবরণের একটা দ্যোতনা রয়ে গেছে। রাজন্যদের সন্তুষ্টিবিধানের প্রয়াস সম্পর্কে বহু মন্ত্রই প্ৰত্যক্ষ কোনো ইঙ্গিত বহন করে না, যদিও পরবতী সূক্তগুলিতে তেমন অনেক দৃষ্টান্ত আমরা খুঁজে পেয়েছি। সূক্ত রচনার বিভিন্ন পৰ্যায় সম্পর্কিত সম্পূর্ণ ভিন্ন একটি অভিমত অনুযায়ী প্ৰথম পর্যায় ধর্মীয় বৈশিষ্ট্যসম্পন্ন, দ্বিতীয়টি নিশ্চিতভাবে যজ্ঞীয় অনুষ্ঠানমূলক এবং তৃতীয়টি মৌল প্রেরণাগত বিচারে ধর্মনিরপেক্ষ, দৰ্শন-অভিমুখী।