প্রথম খণ্ড
দ্বিতীয় খণ্ড
তৃতীয় খণ্ড

১৪. “নিঃঋতি হইতে আমাদের দূরে রাখ”

নিঃঋতি হইতে আমাদের দূরে রাখ

a fall from the simple moral grandeur of the ancient gentile society(৮৫) : Engles

ঐতরেয় ব্রাহ্মণের উপাখ্যান অনুসারে, যুপকাষ্ঠে বদ্ধ হয়ে শুনঃশেপ বরুণের—অতীতের সেই বরুণের—স্মৃতি উদ্বুদ্ধ করতে চেয়েছিলেন, কামনা জানিয়েছিলেন—

বাধস্য দূরে নির্‌ঋতিং পরাচৈঃ
কৃতং চিদেনঃ প্র মুমুগ্ধ্যস্মৎ।।
অর্থাৎ,—নিঃঋতি হইতে আমাদিগকে দূরে রাখ, কৃত পাপের মোহ হইতে আমাদিগকে মুক্ত করে।। ঋগ্বেদ : ১.২৪.৯ ৷৷

ঋতের যা বিপরীত তারই নাম নিঃঋতি। ঋতহীনত্ব। পিতা যখন অর্থের প্রলোভনে মেধ্য পশুর মতো পুত্রকে বধ করতে অগ্রসর হয় তখন স্বভাবতই ঋতহীনতার আশঙ্কা জাগে। আর তখন অতীতের সেই প্রিয় ও নিত্যবন্ধুর কথাও মনে পড়ে। কেননা, অতীতে এই বরুণই ছিলেন ঋতের পালক, ঋতের রক্ষক।

আ রাজানা মহ ঋতস্ত গোপা
সিন্ধুপতী ক্ষত্রিয়া যাতমৰ্বাক্।
ইলাং নো মিত্রা বরুণোত বৃষ্টিমব দিব ইন্বতং জীরদানূ।৷
অর্থাৎ, হে রাজন, হে মহান ঋতের পালকদ্বয়, হে নদীগুলির পতি, হে ক্ষত্রিয়দ্বয়, তোমরা দুই জন আমাদের অভিমুখে আগমন কর; হে মিত্রাবরুণ, হে শীঘ্রদানকারী, তোমরা আমাদিগকে অন্ন ও বৃষ্টি অন্তরীক্ষ হইতে প্রেরণ কর।। ঋগ্বেদ : ৭.৬৪.২।।

ঋতেন যাবৃতাবৃধাৰ্বতস্য জ্যোতিষস্পতী।
তা মিত্রাবরুণা হুবে।।
অর্থাত,–যাঁহারা ঋত দ্বারা ঋতকে বর্ধিত করেন, যাহার ঋতের প্রকাশকর্তা, সেই মিত্রাবরুনকে আহ্বান করি। ঋগ্বেদ : ১.২৩.৫ ৷৷

ঋতেন মিত্রাবরুণাবৃতাবৃধাবৃতস্পৃশা।
ক্রতুং বৃহন্তমাশাখে।।
অর্থাৎ, —হে মিত্রাবত্রুণ, তোমরা ঋতের দ্বারা ঋতকে বর্ধিত কর ও ঋতকে স্পর্শ কর, যজ্ঞকে বর্ধিত করিবার জন্য পরিব্যাপ্ত হও।। ঋগ্বেদ : ১.২.৮।।

ঋতেন ঋতমপিহিতং ধ্রুবং বাং সূর্যস্য যত্র বিমূচন্ত্যশ্বাণ্‌।
দশ শতা সহ তন্থূস্তদেকং
দেবানাং শ্রেষ্ঠং বপু্ষামপশ্যম্।।
অর্থাৎ,—যে স্থানে সূর্যের অশ্বগুলি মোচন করা হয়, সেই ঋত ঋতের দ্বারা আবৃত; সেই স্থানে দশশতের সহিত অবস্থানকারী সেই এক (মিত্রাবরুণ)-কে, দেবতাশরীরের মধ্যে শ্রেষ্ঠকে, দেখিয়াছিলাম।। ঋগ্বেদ : ৫.৬২.১ ৷।

ঋত মানে কী? আমাদের পক্ষে এ-প্রশ্নের সহজ উত্তর দেওয়া কঠিন। কেননা ঋগ্বেদের কবিদের কাছে এই ঋতই ছিলো সেই প্রাচীন অবিভক্ত সমাজের আদিম নীতিবোধ। নীতিবোধের চেতনার দিক থেকে প্রাচীন সমাজের সঙ্গে আধুনিক সমাজের অনেক পরিবর্তন হয়ে গিয়েছে। আমাদের আধুনিক চেতনায় প্রাকৃতিক নিয়ম, জীবন সংগ্রাম, কর্তব্য, দায়িত্ব প্রভৃতির ধারণা পরস্পর থেকে বিচ্ছিন্ন ও স্বতন্ত্র হয়ে দাঁড়িয়েছে; আদিম সমাজে তা ছিলো না। নৈতিক জীবনের নিয়মও প্রাকৃতিক নিয়মের মতোই স্বাভাবিক, প্রাকৃতিক নিয়মের মতোই অমোঘ। এঙ্গেলস্(৮৬) যেমন বললেন,

there was as yet no distinction between rights and duties; the question of whether participation in public affairs, blood-revenge or atonement of injuries was a right or a duty never confronted the (Iroquois) Indian; it would have appeared as absurd as the question of whether eating, sleeping or hunting was a right or a duty.

তার কারণ,

the tribe, the gens and their institutions were sacred and inviolable, a superior power, instituted by nature, to which the individual remained absolutely subject in feeling, thought and deed.(৮৭)

প্রাচীন সমাজের এই আদিম অখণ্ড নৈতিক চেতনার দিক থেকেই আমরা ঋগ্বেদের ঋতকে বোঝবার চেষ্টা করবো। ঋত মানে সত্য, ঋত মানে যজ্ঞ, ঋত মানে প্রকৃতির অমোঘ নিয়ম, ঋত মানে অমোঘ নৈতিক নিয়ম—আরো অনেক কিছু। ঋতের বর্ণনায় অধ্যাপক কীথ্(৮৮) বলছেন,

(ঋগ্বেদে) বারবার প্রকৃতির অমোঘ নিয়মের উল্লেখ পাওয়া যায়। তার নাম ঋত।…বৈদিক ভারতে শব্দটি ত্রি-অর্থবাচক : বিশ্বের নিয়মানুবর্তিতা, যজ্ঞের বিধি, পৃথিবীতে নৈতিক জীবনের নিয়মানুবর্তিতা।…ঋত অনুসারেই প্রভাতে ঊষাদের আবির্ভাব হয় : ঋত অনুসারেই পিতৃগণ আকাশে সূর্যকে স্থাপন করছেন, সূর্য ওই ঋতের উজ্জ্বল মুখ এবং গ্রহণের অন্ধকার সেই ঋতেরই বিপরীত। সংবৎসর হলো দ্বাদশ অর-বিশিষ্ট ঋতের রথচক্র। নব-গাভীর ধারোষ্ণ দুগ্ধ হলো ঋতের দ্বারা বর্ধিত গাভীর ঋত। জল ও ওষধির মধ্যে লুকোনো আগুন (অগ্নি) অরণি কাঠের ঘর্ষণে ঋতজাত ও ঋতের অঙ্কুর। ঋতের আদেশ অনুসারেই নদীগুলি প্রবাহিত হচ্ছে। প্রাকৃতিক স্তর থেকে সহজেই ঋতের ধারণা নৈতিক ও যজ্ঞ-সম্পৰ্কীয় ধারণায় পর্যবসিত হয়।

এমনকি, স্বয়ং দেবতারাও ঋত হইতে জাত ও ঋতস্বরূপ।

পবমানঃ ঋতঃ কবিঃ সোমঃ।
অর্থাৎ, রক্ষাকারী সোম, যিনি ঋত ও কবি।। ঋগ্বেদ : ৯.৬২.৩০ ॥

ঋতেন য ঋতজাতো বিবাবৃধে রাজা দেব ঋতং বৃহৎ ॥
অর্থাৎ, —যিনি (সোম) রাজা ও দেবতা, ঋত হইতে জাত, (তিনি) ঋতের দ্বারা ঋতকে বৃহৎরূপে বৰ্ধিত করেন।। ঋগ্বেদ : ৯.১.০৮.৮ ৷।

দীদেথ কণ্ব ঋতজাত উক্ষিতো যং নমস্যন্তি কৃষ্টয়ঃ।।
অর্থাৎ, —তুমি হবিদ্বারা স্নাত হইয়া হে ঋতজাত অগ্নি, কণ্বকে দীপ্যমান করিয়াছিলে এবং তোমাকে মনুষ্যগণ নমস্কার করে।। ঋগ্বেদ : ১.৩৬.১৯ ৷।

অশ্বিদ্বয়কে উদ্দেশ্য করে বলা হয়েছে—

রথো হ বাম্‌ ঋতজাঃ
অর্থাৎ, —(হে অশ্বিদ্বয়), তোমরা ঋত হইতে জাত, তোমাদের রথ…।। ঋগ্বেদ : ৩.৫৮.৮।।

অগ্নিও ঋতজাত, ঋতের জ্ঞাতা এবং সত্যস্বরূপ—

ঋতজাত পূর্বীঃ
অর্থাৎ, —(হে অগ্নি) তুমি পূর্বকালে ঋত হইতে জাত হইয়াছিলে।। ঋগ্বেদ : ২.২০.২।।

অগ্নিবান ঋতচিদ্ধি সত্যঃ
অর্থাৎ, —অগ্নি বিদ্বান, ঋতর জ্ঞাতা এবং সত্যস্বরূপ।। ঋগ্বেদ : ১.১৪৫.৫ ॥

মরুৎগণ সম্বন্ধেও একই কথা,

কো বেদ নূনমেষাং যত্রা মদন্তি ধূতয়ঃ।
ঋতজাত অরেপসঃ ॥
অর্থাৎ, —ইহাদিগের (মরুৎদিগের) বাসস্থান কেই বা জানে? সেখানে শত্রুদিগের ত্রাসকারীগণ আনন্দে থাকেন, তাঁহারা ঋত হইতে জাত বলিয়াই পাপবিহীন ॥ ঋগ্বেদ : ৫.৬১.১৪।।

দেবতারা শুধুই ঋতজাত নন; তারা খতের আচরণও করে থাকেন।

ঋতং বদন্নৃতদ্যুম্ন সত্যং বদন সত্যকৰ্মন্‌।
শ্রদ্ধাং বদন্‌ সোম রাজন্ধাত্রা সোম পরিষ্কৃত ইন্দ্রায়েন্দো পরি স্রব।।
অর্থাৎ, —(হে সোম), ঋতের দ্বারা দীপ্তিযুক্ত, ঋত বলিতে বলিতে, সত্য বলিতে বলিতে তুমি সত্যকর্মা হইয়াছ; শ্রদ্ধা বলিতে বলিতে, হে সোম, শোভমান হইয়া যজমানের দ্বারা পরিষ্কৃত অবস্থায় তুমি ইন্দ্রের উদ্দেশ্যে, হে সুন্দরকান্তি, পরিস্রুত হও।। ঋগ্বেদ : ৯.১১৩.৪।।

ঋতধীতয় আ গত সত্যধর্মাণো অধ্বরং।
অগ্নেঃ পিবত জিহ্বয়া।।
অর্থাৎ,—হে ঋতকর্মযুক্ত সত্যধর্মা বিশ্বদেবগণ, তোমরা যজ্ঞে আসিয়াছ, অগ্নির জিহ্বাদ্বারা তোমরা পান কর।। ঋগ্বেদ : ৫.৫১.২ ।৷

কিন্তু শুধু দেবতাই নন; গাভীগুলিও ঋত আচরণ করতে করতে ঋতযুক্ত হয়েছিলো এবং পুষ্টিলাভ করেছিলো।

মক্ষু কনায়াঃ সখ্যং নবণ্বা ঋতং বদন্ত ঋতযুক্তিমগ্মন্‌।
দ্বিবর্হসো য উপ গোপমাগুরদক্ষিণাসো অচ্যুতা দুদুক্ষন্‌।
অর্থাৎ, —শীঘ্ৰ কমনীয় (স্থান হইতে প্রেরিত) সখ্যযুক্ত নয় মাসের গাভীগুলি ঋত বলিতে বলিতে ঋতযুক্ত হইয়াছিল; দুই-লোকে যাহারা পুষ্টিপ্রাপ্ত হইয়াছিল তাহাদিগের হইতে দক্ষিণাবিহীন (যজমানগণ) নিশ্চিত ফল দোহন করিয়াছিলেন।। ঋগ্বেদ :  ১০.৬১.১০।।

আরো দ্রষ্টব্য হলো, অতীতে এই ঋতই ছিলো জীবনোপায়—ধনলাভের উপায়, অন্নলাভের উপায়, গাভীলাভের উপায়—কিংবা, অন্তত, সেই উপায়ের প্রধানতম অঙ্গ।

ঋতং যতী সরমা গা অবিন্দৎ
অর্থাৎ, ঋতকে প্রাপ্ত হইয়া সরমা গরুগুলি লাভ করিয়াছিল।। ঋগ্বেদ : ৫.৪৫.৭ ॥

ঋতং বর্ষিষ্ঠমুপ গাব আগুঃ।
অর্থাৎ, —(বিশ্বদেব) ঋতকে বহুল করিয়া গরুগুলি পাইয়াছিল।। ঋগ্বেদ : ৩.৫৬.২ ॥

ঋতং সপন্তো অমৃতমেবৈঃ॥
অর্থাৎ, —ঋতদ্বারা সমবেত হইয়া (অগ্নি) অমৃতত্ত্ব প্রাপ্ত হইল।। ঋগ্বেদ : ১.৬৮.৪।।

ঋতজ্যেন ক্ষিপ্রেণ ব্রহ্মণস্পতির্যত্র বষ্টি প্র তদশ্নোতি ধন্বনা।
তস্য সাধ্বীরিষবো যাভিরস্যতি নৃচক্ষসে দৃশয়ে কর্ণযোনয়ঃ।।
অর্থাৎ, —ব্রহ্মণস্পতি ক্ষিপ্ৰ ঋতরূপ-জ্যাবিশিষ্ট ধনুদ্বারা যাহাই কামনা (করেন) তাহাই ব্যাপ্ত করেন; সেই মনুষ্যের উপায়জ্ঞ, যাহার দ্বারা হিংসা করেন, সেই অব্যর্থ তীরগুলি তাঁহার কর্ণ হইতে জাত। ঋগ্বেদ : ২.২৪.৮।।

অস্ত মে দ্যাবাপৃথিবী ঋতায়তো ভূতমবিত্ৰী বচসঃ সিযাসতঃ।
যযোরায়ুঃ প্ৰতরং তে ইদং পুর উপস্তুতে বসুযুর্বাং মহো দধে।।
অর্থাৎ, —হে রক্ষাকত্রীত,দ্যাবাপৃথিবী, ঋতের কামনা করিয়া বাক্যের দ্বারা তোমাদিগকে তুষ্ট করিতে ইচ্ছুক হইয়াছিল; তোমরা অন্ন প্রকৃষ্টভাবে উৎপন্ন কর, ধনকামনা করিয়া তোমাদিগের স্তুতি করি।। ঋগ্বেদ : ২. ৩২.১।।

এই ঋতই হলো প্রাচীন প্রাক্-বিভক্ত সমাজের সেই অখণ্ড নীতিবোধ, এঙ্গেলস্‌ যাকে বলেছেন, the simple moral grandeur of the ancient gentile society । আমরা ইতিপূর্বেই দেখেছি (পৃ.২৩৩), মহাবস্তু অবদান প্রভৃতি প্রাচীন গ্রন্থ থেকেও এই নীতিবোধটির স্মৃতি সম্পূর্ণভাবে মুছে যায়নি : “সুখনিবাসে থাকিয়া তাঁহারা প্রীতিভক্ষণ করিয়া জীবনযাত্রা নির্বাহ করেন। তাঁহারা যাহা করেন সকলই ধর্ম।” এ-নীতিবোধ স্বাভাবিক এবং সহজাত, মানবচেতনার অপরিহার্য অঙ্গ—তাই প্রাকৃতিক নিয়মের মতোই অমোঘ, প্রাকৃতিক নিয়মের মতোই স্বাভাবিক। কিংবা, যা একই কথা, প্রকৃতির চেতনা এবং এই নৈতিক নিয়মের চেতনা তখনো এক অখণ্ড সামগ্রিক চেতনারই অঙ্গীভূত।

বৈদিক ঋষিরা তারই নাম দিয়েছিলেন, ঋত।

আর অতীতের সেই বরুণ—সেই প্রিয় ও নিত্যবন্ধু বরুণ—তাঁর নৈতিক ঐশ্বর্য বলতেও এই ঋত, এই আদিম অখণ্ড নীতিবোধ। তিনি ঋতের পালক, ঋতের বর্ধক। তিনি শুধু দেন–মানুষের গোশালাগুলি ঘৃতসিক্ত করেন, বাসস্থানগুলি মধুসিক্ত করেন (৩.৬২.১৬); তাঁর জলযুক্ত বৃষ্টি মানুষদের মধ্যে সঞ্চরণ করে (৮.২৫.৬)।

আর উত্তর সাহিত্যে দেখি, এই বরুণই পরিণত হয়েছেন এক বিকট বিভীষিকায় : পাওনা-আদায়ের জন্যে তাঁর হানা দেওয়ার যেন বিরাম নেই, স্নানের পর মানুষ পিছন ফিরে তাকাতে ভয় পাচ্ছে—বরুণের আতঙ্কে আতঙ্কিত।

বরুণের এই অদ্ভূত রূপান্তর ঘটলো কী করে?

লোভে লালসায় মানবসমাজ তখন বিদীর্ণ হয়ে যাচ্ছে। তখন ক্ষুধাপীড়িত পিতা শত-গাভীর আশায় পুত্রকে বিক্রয় করছে, শত-গাভীর প্রলোভনে পুত্রকে যুপে বদ্ধ করতে অগ্রসর হচ্ছে, শত-গাভীর লালসায় শানিত অসি হস্তে অগ্রসর হচ্ছে এই পুত্রকেই বধ করবার জন্য।

যুপে-বদ্ধ পুত্র ওই অতীত-বরুণের স্মৃতিই উদ্বুদ্ধ করতে চেয়েছিলেন, কামনা জানিয়েছিলেন,

নিঋতি থেকে আমাদের দূরে রাখো
আমাদের কৃতপাপ থেকে আমাদের মুক্ত করো।

———–
৮৫. E. Engels OFPPS 163. ,258 .
৮৬. Ibid 258.
৮৭. Ibid. 163.