প্রথম খণ্ড
দ্বিতীয় খণ্ড
তৃতীয় খণ্ড

১৩. বরুণের ইতিবৃত্ত : দেবতার রূপান্তর

বরুণের ইতিবৃত্ত : দেবতার রূপান্তর

প্রাক্-বিভক্ত সমাজের ধ্বংসস্তুপের উপর শ্রেণীসমাজের আবির্ভাব-প্রসঙ্গে এঙ্গেলস্‌(৭২) বলছেন, the greed for wealth divided the members of the gentes…

লোভ। বৈদিক সাহিত্যে দেখতে পাই সমাজে এই লোভ যতোই সর্বশক্তি হয়ে উঠছে ততোই পরিবর্তন ঘটছে বৈদিক দেবতার চরিত্রেও। ওই লোভই হয়ে দাঁড়াচ্ছে দেবচরিত্রের একটি প্রধানতম বৈশিষ্ট্য। ঐতরেয় ব্রাহ্মণে বরুণের কী রকম পরিণতি ও রূপান্তর ঘটেছে শুনঃশেপের কাহিনী অবলম্বন করেই তা দেখা যাক।

হরিশ্চন্দ্র বরুণ রাজাকে প্রার্থনা করিলেন, আমার পুত্র হউক, তারা তোমার যাগ করিব। (বরুণ বলিলেন) তাহাই হউক। তখন উহার রোহিত নামের পুত্র জন্মিল। তখন বরুণ হরিশ্চন্দ্রকে বলিলেন, তোমার পুত্র জন্মিয়াছে, তারা : আমার যাগ কর। তিনি তখন বলিলেন, (জন্মের পর অশৌচকালে) দশ দিন গত না হইলে পণ্ড মেধ্য (যাগযোগ্য) হয় না; ইহার দশদিন উত্তীর্ণ হোক, তখন তোমার যাগ করিব। বরুণ বলিলেন, তাহাই হউক।
পরে দশদিন উত্তীর্ণ হইলে বরুণ বলিলেন, দশ দিন উত্তীর্ণ হইয়াছে। এখন এতদ্বারা আমার যাগ কর। তিনি বলিলেন, যখন পণ্ডর দাঁত ওঠে, তখন সে মেধ্য হয়; ইহার দাঁত বাহির হউক, তখন তোমার যাগ করিব। বরুণ বলিলেন, তাহাই হউক।
পরে তাহার দাঁত উঠিলে বরুণ বলিলেন, ইহার দাঁত উঠিয়াছে, এখন এতদ্বারা আমার যাগ কর। তিনি বলিলেন, পশুর দাঁত যখন পড়িয়া যায় তখন সে মেধ্য হয়; ইহার দাঁত পড়ুক, তখন তোমার যাগ করিব। বরুণ বলিলেন, তাহাই হউক।
পরে তাহার দাঁত পড়িলে বরুণ বলিলেন, ইহার দাঁত পড়িয়াছে, এখন এতদ্বারা যাগ কর। তিনি বলিলেন, পশুর দাঁত যখন আবার জন্মে, তখন সে মেধ্য হয়; ইহার দাঁত আবার উঠুক, তখন তোমার যাগ করিব। বরুণ বলিলেন, তাহাই হউক।
পরে তাহার দাঁত আবার উঠিলে বরুণ বলিলেন, ইহার দাঁত আবার উঠিয়াছে, এখন এতদ্বারা আমার যাগ কর। তিনি বলিলেন, ক্ষত্রিয় যখন সন্নাহ (ধনুর্বাণ কবচাদি) ধারণে সমর্থ হয়, তখন সে মেধ্য হয়। এ সন্নাহ প্রাপ্ত হইলে তোমার যাগ করিব। বরুণ বলিলেন, তাহাই হউক।
পরে সেই (বালক) সন্নাহ প্রাপ্ত হইলে বরুণ বলিলেন, এ সন্নাহ প্রাপ্ত হইয়াছে, এখন এতদ্বারা আমার যাগ কর। তাহাই হউক বলিয়া হরিশ্চন্দ্র পুত্রকে ডাকিয়া বলিলেন; হায়, তোমাদ্বারা আমাকে ইহার যাগ করিতে হইবে। তাহা হইবে না, এই বলিয়া সেই রোহিত ধনু গ্রহণ করিয়া অরণ্যে প্রস্থান করিলেন ও সংবৎসর ধরিয়া অরণ্যে বিচরণ করিলেন।
তখন বরুণ ইক্ষ্বাকুবংশধরকে চাপিয়া ধরিলেন, তাঁহার উদরী রোগ উৎপন্ন হইল……(৭৩)

আমরা আমাদের জীবনে একধরনের মানুষকে পাওনা-আদায়ের জন্যে এইভাবেই হানা দিতে দেখেছি; চলতি কথায় তাদের বলি কাবুলিওয়ালা। ইংরেজী সাহিত্যে আমরা এই রকমেরই একটি চরিত্রের পরিচয় পেয়েছি; তার নাম সাইলক। আর, আমরা বরুণকে দেখেছি ঋগ্বেদে—সে-বরুণ কিন্তু এ-বরুণ নয়। সে-বরুণ মানুষকে শুধু দিচ্ছেন, মানুষের কাছ থেকে পাওনা-আদায়ের জন্যে তাঁকে হানা দিতে দেখা যায়নি।

ঋগ্বেদের প্রাচীন অংশে প্রতিবিম্বিত সামাজিক পরিস্থিতির সঙ্গে ঐতরেয়-ব্রাহ্মণে প্রতিবিম্বিত সমাজের যে কতোখানি পার্থক্য, তা বরুণের রূপান্তর থেকেই অনুমান করা অসম্ভব নয়। ঐতরেয়-ব্রাহ্মণের বরুণের ওই কাবুলিওয়ালা-রূপটিকে আমরা দেখলাম; এবার ঋগ্বেদের বরুণকে দেখা যাক।

মিত্র ও বরুণ সুমধুর বারি বর্ষণ করেন (৫.৬৩.১), বৃষ্টিরূপ ধন ও অমরত্ব দান করেন (৫.৬৩.২), মেঘ ও বৃষ্টি দ্বারা অন্তরীক্ষে সূর্যের রক্ষা বিধান করেন (৫.৬৩, ৪), মেঘকে অন্নসাধক প্রভাব্যঞ্জক বিচিত্র গর্জনধ্বনিতে মুখর করে তোলেন (৫.৬৩.৬), উপকারক-দ্বারা যজ্ঞ রক্ষা করেন এবং পূজনীয় রথের ন্যায় সূর্যকে অন্তরীক্ষে ধারণ করেন (৫.৬৩.৭)। মিত্র ও বরুণের বাঞ্ছিত প্রদত্ত সুখ সকল স্থানেই ব্যাপ্ত আছে (৫.৬৪.২); তাঁহারা অন্ন, ধন ও কল্যাণবিষয়ে যজমানদের প্রতি বিশেষরূপে বদান্য হন (৫.৬৪, ৬)– ইত্যাদি, ইত্যাদি।

ইরাবতীর্বরুণ ধেনবো বাং মধুমদ্বাং সিদ্ধবো মিত্র দুহে।
ত্রয়স্তস্থর্বৃষভাসস্থিস ণাং ধিষণানাং রেতোধা বি দ্যুমস্তঃ।।
অর্থাৎ, —হে বরুণ, হে মিত্র, তোমাদের দ্বারা ধেনুগুলি দুগ্ধবতী, নদীগুলি মধুক্ষরা; (তোমাদের আজ্ঞায়) রেতযুক্ত তিনটি কামবর্ষী স্থান বিশেষরূপে দীপ্তিযুক্ত হইয়াছে।। ঋগ্বেদ : ৫.৬৯.২ ॥

বৃষ্টিদ্যাবা রীত্যাপেষস্পতী দানুমত্যাঃ।
বৃহস্তং গর্তমাশাতে।।
অর্থাৎ, —বৃষ্টিকারী যে গতিযুক্ত দ্যুলোক, হে অন্নের পতি, তোমাদের (মিত্র ও বরুণ) দানশীলতার জন্যই তাহা শ্রেষ্ঠ; তোমরা মহৎ গর্তকে আশ্রয় কর।। ঋগ্বেদ : ৫.৬৮.৫ ॥

আ নো মিত্রাবরণা ঘৃতৈর্গব্যূতিমূক্ষতম্।
মধ্ব রজাংসি সূক্রতূ।।
অর্থাৎ,—হে মিত্রাবরণ, তোমরা আমাদের গোশালাটিকে ঘৃতসিক্ত কর, আমাদের বাসস্থানগুলিকে মধুসিক্ত কর, হে শোভনকৰ্মদ্বয়।। ঋগ্বেদ : ৩.৬২.১৬।

সং যা দানূনি যেমথুর্দিব্যাঃ পার্থিবরিষঃ।
নভস্বতীরা বাং চরন্তু বৃষ্টয়ঃ।।
অর্থাৎ,—হে মিত্রাবরুণ, তোমরা আমাদিগের দানের উপযোগী ধন এবং পার্থিব অন্ন আমাদিগের মধ্যে দান কর; তোমাদিগের জলযুক্ত বৃষ্টি (আমাদিগের মধ্যে) সঞ্চরণ করুক।। ঋগ্বেদ : ৮.২৫.৬ ৷।

ঋগ্বেদের এই দাতা বরুণটিরই প্রেতের মতো, ঐতরেয় ব্রাহ্মণের উত্তমর্ণ বরুণটি পাওনা-আদায়ের জন্যে বারবার হানা দিচ্ছে। ঋগ্বেদে আর যাই হোক আদায়ের ফিকিরে বরুণ বিভীষিকা সৃষ্টি করছেন—একথা কল্পনা করা যায় না।

শুধু তাই নয়, ঋগ্বেদে দেখি বরুণের সঙ্গে যজমানদের একটা রীতিমতো বন্ধু-সম্পর্ক। অধ্যাপক ম্যাক্‌ডোন্যাল(৭৪) বলছেন,

Varuna is on a footing of friendship with his worshipper who communes with him in his celestial abode and sometimes sees him with the mental eye.

য আপির্নিত্যো বরুণ প্রিয়ঃ সন্ত্বামাগাংসি কৃণবৎসখা তে।
মা ত এনস্বন্তে যক্ষিন্‌ ভূজেম যদ্ধি ষ্মা বিপ্রঃ স্তবতে বরুথম।।
অর্থাৎ, —হে বরুণ, যে তোমার সমীপে পাপ করিয়াছিল, সে এখন তোমার প্রিয় ও নিত্যবন্ধু; তোমার আত্মীয়স্থানীয় আমরা যেন পাপযুক্ত না হই, আমরা যেন ভোগ করিতে পারি, বিপ্ররূপ তুমি স্তুতিকারীকে অনিষ্টনিবারক গৃহ প্রদান কর।। ঋগ্বেদ : ৭.৮৮.৬ ।।

কিন্তু ঋগ্বেদে বরুণের চরিত্রে যেটা সবচেয়ে মহান দিক তা হলো তার নৈতিক গৌরব। অধ্যাপক ম্যাকডোন্যাল বলছেন,

The anthropomorphism of Varuna’s personality is more fully developed on the moral than the physical side. The descriptions of his person and his equipment are scanty, more stress being laid on his personality……
The spies (*) of Varuna are sometimes mentioned. They sit down around him (1.24. 13). They behold the two worlds; acquainted with sacrifice they stimulate prayer (7.87. 3)……
In marked contrast with Indra, Varuna has no myths related of him, while much is said about him (and Mitra) as upholder of physical and moral order……They are the guardians of the whole world (2.27.4)…….The order (*) of Mitra and Varuna is established where the steeds of the sun are loosed (5.62. 1.)……(৭৫)

As a moral governor Varuna stands far above any other deity. His wrath is roused by sin, the infringement of his ordinances, which he severely punishes (7.86. 3-4). The fetters (*ffort:) with which he binds sinners, are often mentioned (1.24, 15, etc.). They are cast sevenfold and threefold, ensnaring the man who tells lies, passing by him who’speaks truth (A. V. 4, 16.6). Mitra and Varuna are barriers, furnished with many fetters, against falsehood (7.65.3)……Together with Mitra, Varuna is said to be a dispeller, hater and punisher of falsehood (1.151. 2, etc)…… On. the other hand, Varuna is gracious to the penitent. He unties like a rope and, removes sin (2.28.5; 5.85, 7-8). He releases not only from the sins which men themselves commit, but from those committed by their fathers (7.86. 5)……(৭৬)

বরুণের এই নৈতিক গৌরব প্রসঙ্গে অধ্যাপক কীথ্(৭৭), বলছেন,

But more important than these physical attributes of the god are his moral qualities, his control of the order of the world in its ethical aspect no less than in its physical, his connexion with the worshipper as the saviour in time of peril and distress, the freer from sin, the merciful god, as well as the punisher of the sinner.

ঋগ্বেদে বরুণের যে-পরিচয় তার মধ্যে এই নৈতিক গৌরবের দিকটির কথাই আমাদের পক্ষে বিশেষ করে মনে রাখা প্রয়োজন; কেননা, অধ্যাপক কীথ্‌(৭৮) যেমন বলছেন,

it is essential to note that this side of Varuna’s nature is one which steadily disappears in the later texts…

ঐতরেয়-ব্রাহ্মণের পাওনা-আদায়কারী কাবুলিওয়ালা বরুণটির পরিচয় আমরা ইতিপূর্বেই পেয়েছি; এবং উত্তরযুগের সাহিত্যে বরুণ যে কী বিভীষিকা হয়ে দাঁড়িয়েছিলেন তার পরিচয় অধ্যাপক কীথ্‌কে অনুসরণ করেই আমরা একটু পরে আরো স্পষ্টভাবে দেখতে পাবো। এই চারিত্রিক পরিবর্তন যে কতোখানি মৌলিক তা হৃদয়ঙ্গম করবার জন্যে আমাদের পক্ষে ঋগ্বেদ বর্ণিত বরুণের নৈতিক ঐশ্বর্যের কথা স্পষ্টভাবে মনে রাখা দরকার।

ঋগ্বেদে দেখা যায় নৈতিক নিয়মের চূড়ান্ত দায়িত্ব বরুণেরই উপর।

পরি স্পশো বরুণস্য স্মদিষ্টা উভে পশ্যন্তি রোদসী সুমেকে।
ঋতাবানঃ কবয়ো যজ্ঞধীরাঃ প্রচেতসো য ইষয়ন্ত মন্ম।।
অর্থাৎ, —বরণের সহচরগণ মঙ্গল-উদ্দেশ্যে স্বর্গ ও পৃথিবী পরিদর্শন করে, তাঁহারই ভয়ে ঋতযুক্ত, ক্রান্তদর্শী যজ্ঞধীর বিজ্ঞগণ তাঁহার উদ্দেশ্য স্তুতি প্রেরণ করেন।। ঋগ্বেদ : ৭.৮৭.৩ ।।

ঋগ্বেদে দেখা যায় অমৃত বা মিথ্যার বিরুদ্ধে বরুণের কঠোর বিধান।

যুবং বস্ত্রাণি পীবসা বসাথে যুবোরচ্ছিদ্রা মন্তবো হ সৰ্গাঃ। অবাতিরতমনৃতানি বিশ্ব ঋতেন বিশ্ব ঋতেন মিত্রাবরণ সচেথে।।
অর্থাৎ, —হে মিত্রাবরুণ, তোমরা স্থল বস্ত্রদ্বারা আচ্ছন্ন কর; তোমাদের সৃষ্টি ছিদ্রহীন ও মননযুক্ত; (তোমরা) অনৃতকে ধ্বংস করিয়াছিলে এবং বিশ্বকে ঋতের সহিত যুক্ত করিয়াছিলে।। ঋগ্বেদ : ১.১৫২.১ ।।

ইমে চেতারো অনৃতস্য ভূরের্মিত্রো অর্যমা বরুণো হি সন্তি।
ইম ঋতস্য বাবৃধুর্দুরোণে শগ্মাসঃ পুত্রা অদিতেরদদ্ধাঃ।।
অর্থাৎ,—মিত্র, অর্যমা ও বরুণ—ইহারা প্রভূত অমৃতের হন্তা; অদিতির অহিংসিত সুখকর পুত্ৰগণ গৃহে ঋতকে বর্ধিত করিয়াছিলেন।। ঋগ্বেদ : ৭.৬৪.৫ ।৷

বরুণ শুধু অনৃত-হন্তা নন, ঋতের পালক, ঋতের বর্ধক। বস্তুত, ঋতের সঙ্গে তাঁর এই সম্পর্কের দিক থেকেই বরুণের নৈতিক গৌরবের সবচেয়ে বড়ো পরিচয়। ঋতের কথা আমরা একটু পরেই তুলবো। তার আগে, এখানে, অধ্যাপক রথ্‌-এর একটি মতবাদ উল্লেখ করা প্রাসঙ্গিক হতে পারে।

অধ্যাপক রথ্‌(৭৯) অনুমান করছেন যে, ঋগ্বেদ রচিত হবার যুগেই বৈদিক কবিদের কল্পনায় ইন্দ্রের গৌরব বরুণের চেয়ে অনেক বড়ো হয়ে উঠেছে। অর্থাৎ আগে বরুণই ছিলেন বৈদিক মানুষদের প্রধানতম দেবতা এবং তাঁরই গৌরব সর্বাধিক। যতোই দিন গিয়েছে ততোই বরুণের গৌরব মান হয়েছে এবং তারই জায়গায় ইন্দ্রের গৌরব চূড়ান্ত হয়ে উঠেছে— এ-পরিবর্তন ঋগ্বেদ রচিত হবার সুদীর্ঘ যুগটির মধ্যেই সাধিত হয়েছে। এই মতের পক্ষে একটি প্রমাণ হিসেবে দেখানো হয়েছে যে, ঋগ্বেদের সবচেয়ে অর্বাচীন অংশে—দশম মণ্ডলে—বরুণের গৌরব-বর্ণনায় একটিও সূক্ত নেই; অপরপক্ষে পয়তাল্লিশটি যুক্ত ইন্দ্রের মহিমায় মুখর। কিন্তু অধ্যাপক ম্যাকডোন্যাল(৮০) বলছেন, সূক্তসংখ্যা-নির্ভর এ-জাতীয় যুক্তির মূল্য খুব বেশি নয়। কেননা সামগ্রিকভাবে ঋগ্বেদে বরুণের তুলনায় ইন্দ্রের উদ্দেশ্যে রচিত সূক্ত অনেক বেশি; তৃতীয় মণ্ডলেও বরুণের উদ্দেশ্যে কোনো সূক্ত নেই, কিন্তু ইন্দ্রের উদ্দেশ্যে বাইশটি সূক্ত আছে; দ্বিতীয় মণ্ডলে ইন্দ্রের উদ্দেশ্যে তেইশটি সূক্ত, তুলনায় বরুণের উদ্দেশ্যে মাত্র একটি।

অধ্যাপক ম্যাকডোন্যাল-এর এ-যুক্তি নিশ্চয়ই স্বীকার্য : সূক্তসংখ্যার দিক থেকে বৈদিক দেবতাদের আপেক্ষিক গুরুত্ব নির্ণয় করবার প্রচেষ্টা নির্ভরযোগ্য নয়। তবুও আমরা বৈদিক সাহিত্যের আভ্যন্তরীণ সাক্ষ্য থেকেই অধ্যাপক রথ্‌-এর এই মতবাদটির পক্ষেই কিছু সমৰ্থন পেতে পারি।

তং ব ইন্দ্ৰং ন সূক্রতুং বরুণমিব মায়িনম্।
অর্থাৎ, —(হে মরুৎগণ), তোমরা ইন্দ্রকে শোভন যজ্ঞ বিশিষ্ট মায়াযুক্ত বরুণের ন্যায় (দেখিবে) ॥ ঋগ্বেদ : ৬.৪৮.১৪ ॥

‘মায়া’র আলোচনায় আমরা পরে প্রত্যাবর্তন করবো। আপাতত প্রশ্ন হলো, উপরের উদ্ধৃতি থেকে কি এই কথাই অনুমান করা যায় না যে, ইতিপূর্বে বরুণকে যে-চোখে দেখা হতো ইন্দ্রকেও সেই চোখে দেখবার নির্দেশ দেওয়া হচ্ছে—অর্থাৎ বরুণের অতীত গৌরবই ইন্দ্রের উপর আরোপ করার আয়োজন হচ্ছে? অন্যত্রও এ-জাতীয় আভাস পাওয়া যায়।

ত্বং নো মিত্রো বরুণো ন মায়ী পিত্বো ন দস্ম দয়সে বিভক্তা।
অর্থাৎ,–মিত্র ও বরুণের ন্যায় মায়াযুক্ত হইয়া, হে দর্শনীয় (ইন্দ্র), তুমি আমাদিগের অন্নের বিভক্তা ও দাতা হও।। ঋগ্বেদ : ১০.১৪৭.৫ ।।

এর থেকে আমরা অনুমান করতে পারি যে, এককালে মিত্র ও বরুণই মায়াযুক্ত হয়ে অন্নের দাতা ও বিভক্তা ছিলেন; এই ঋকটির রচনাকালে ইন্দ্রকেও সেই গৌরবে গৌরবান্বিত করে তোলবার আয়োজন হচ্ছে।

ইন্দ্রের পক্ষে এইভাবে বরুণের গৌরবময় স্থান অধিকার করবার পিছনে একটা ঐতিহাসিক কারণও থাকা স্বাভাবিক বা সম্ভব। কেননা, পশুপালন-নির্ভর ট্রাইবের পক্ষে শ্রেণীবিভক্ত সমাজের দিকে যে-অগ্রগতি, তার একটি প্রধানতম অঙ্গ হলো যুদ্ধের উৎসাহ-বৃদ্ধি। পশুপালন-জীবী ট্রাইবদের পক্ষে শ্রেণীসমাজের দিকে অগ্রসর হওয়া প্রসঙ্গেই এঙ্গেলস্(৮১) বলছেন,

The military commander of the people—rex, basileus, thiudans—became an indispensable and permanent official. The wealth of their neighbours excited the greed of the peoples who began to regard the acquisition of wealth as one of the main purposes in life. They were barbarians: plunder appeared to them easier and even more honourable than productive work War, once waged simply to avenge aggression or as a means of enlarging territory that had become inadequate, was now waged for the sake of plunder alone and became a regular profession.

এঙ্গেলস্ দেখাচ্ছেন, এ-অবস্থায় ধন বলতে প্রধানতই গোসম্পদ। এমনকি, cattle assumed the function of money and served as money already at this stage(৮২)। বৈদিক সমাজে কী ভাবে তা শুরু হয়েছিলো শুনঃশেপের উপাখ্যানেই আমরা তার পরিচয় পেয়েছি : একশত গাভীর বিনিময়ে অজীগর্ত তাঁর পুত্রকে বিক্রয় করলেন। আর এই গাভীর কামনাই যে কীভাবে বৈদিক মানুষদের জীবনে যুদ্ধের উদ্দীপনা যোগাতে শুরু করেছিলো আমরা তারও আভাস পেয়েছি গবিষ্টি বলে শব্দটির মধ্যেই : গবিষ্টি মানে গরু পাবার ইচ্ছা, গবিষ্টি মানেই যুদ্ধ।

আমাদের যুক্তির বর্তমান পর্যায়ে মন্তব্য হলো, বৈদিক মানুষদের জীবনে যতোই লুণ্ঠন ও লোভের প্রভাব বর্ধিত হয়েছে,—যতোই বর্ধিত হয়েছে যুদ্ধের উদ্দীপনা—ততোই তাদের দেবলোকেও ওই যুদ্ধের দেবতা, লুণ্ঠনের দেবতা, বীর ইন্দ্রের গৌরব বেড়ে চলা স্বাভাবিক। এই ইন্দ্রের গৌরবই যদি সামগ্রিকভাবে ঋগ্বেদ-সংহিতার প্রধান বৈশিষ্ট্য হয়ে থাকে তাহলে অনুমান করতে হবে পশুপালনমূলক অর্থনীতির বিকাশের ওই পর্যায়টির বৈশিষ্ট্যই সামগ্রিকভাবে ঋগ্বেদ সংহিতার প্রধানতম বৈশিষ্ট্য হয়ে দাঁড়িয়েছিলো।

কিন্তু অতীতের স্মৃতি হিসেবেই হোক বা বাস্তবিক পক্ষে প্রাচীন রচনার পরিচায়ক হিসেবেই হোক, ঋগ্বেদ সংহিতাতেই এমন একটি দেবতার অতীত গৌরবের আভাস পাওয়া যাচ্ছে যাঁর মহিমার প্রধান কথা ওই লুণ্ঠন-অপহরণমূলক যুদ্ধ নয়—তার বদলে যিনি ছিলেন অন্নের বিভক্ত, অনৃতের হন্তা, ঋতের পালক। তাঁর নাম বরুণ। এবং কালক্রমে, বৈদিক ঋষিরা যতোই যুদ্ধকে মহত্তম বৃত্তি বলে সন্মান করতে শিখেছিলেন ততোই তাদের সাহিত্যে বরুণের মহিমাকে অবদলিত করে ইন্দ্রের মহিমা প্রধান হয়ে উঠেছে।

এভির্ন ইন্দ্রাহভির্দশস্য দুর্মিত্রাসো হি ক্ষিতয়ঃ পবন্তে।
প্রতি যচ্চষ্টে অনৃতমনেনা অব দ্বিতা বরুণো মায়ী নঃ সাৎ।।
অর্থাৎ,–হে ইন্দ্র, দুষ্ট মিত্ররূপী বাধাদানকারী মানবদল আসিতেছে; তাহাদের নিকট হইতে ধন কাড়িয়া লইয়া আমাদিগকে এই পুণ্য দিনে দান কর। মায়াবী বরুণ আমাদিগের মধ্যে যে অনৃত দেখেন তুমি তাহা দ্বিধাবিভক্ত করিয়া অপনোদন কর।। ঋগ্বেদ : ৭.২৮.৪ ।।

এই লোভ, এই লুণ্ঠন, এই যুদ্ধকে বরুণ তখনো অসত্য বা অনৃত হিসেবেই দেখছেন। অর্থাৎ অমোঘ ন্যায়ের পালক বরুণের স্মৃতির সঙ্গে এই লোভ ও লুণ্ঠনের সামঞ্জস্য থাকছে না। তাই লুণ্ঠনের নেতা ইন্দ্রের কাছে কামনা জানানো হচ্ছে, অতীতকালের অমোঘ ন্যায়ের মানদণ্ডে যা আজ অন্যায়, অমৃত বলে প্রতীয়মান হচ্ছে সেই অমৃতবোধকে দ্বিধাবিভক্ত করো, অপনোদন করো।

বৈদিক মানুষেরা যখন এই কামনা করতে শিখেছেন তখন তারা শ্রেণী সমাজের কতোখানি কাছাকাছি এসে পড়েছেন বেদাবিদেরা তার আলোচনা করবেন। আপাতত আমাদের দ্রষ্টব্য হলো, বৈদিক সমাজের এই পরিবর্তনটির ফলে শুধুই যে অতীত দেবতার স্থানে নতুন দেবতার গৌরব ফুটে উঠছে তাই নয়, অতীতের দেবতার চরিত্রেরও বিপর্যয় ঘটে যাচ্ছে।

কেননা, মানব-ইতিহাসের অমোঘ নিয়মের সামনে এমনকি বৈদিক দেবতারাও অসহায়ের মতো। তাঁদের চরিত্রের প্রধানতম উপকরণ বলতে এই মরলোকের মানুষদেরই ধ্যানধারণা, আশা-আকাঙ্খা—শেষ পর্যন্ত যার উৎস হলো প্রকৃতির সঙ্গে মানুষের সম্পর্ক আর মানুষের সঙ্গে মানুষের সম্পর্ক। অতএব, ঐতিহাসিক বিবর্তনের ফলে মানুষের মৌলিক অভিজ্ঞতায় পরিবর্তন দেখা দিলে, তাদের ধ্যানধারণা ও আশা-আকাঙ্খায় বিপর্যয় ঘটলে, দেবতার চরিত্রেও বিপর্যয় ঘটা অসম্ভব নয়।

বৈদিক সমাজের বাস্তব পরিস্থিতি যখন এই হয়ে দাঁড়িয়েছে যে, ক্ষুধাপীড়িত পিতা শতগাভীর বিনিময়ে পুত্রকে বিক্রয় করতে বাধ্য হচ্ছে,— শুধু তাই নয়, আরো শতগাভীর প্রলোভনে পুত্রকে যুপে বদ্ধ করতে এবং আরো শতগাভীর লোভে শানিত অসি হস্তে তাকে বধ করতে অগ্রসর হচ্ছে—তখন? তখন নিশ্চয়ই অনুমান করতে হবে যে, প্রাচীন কালের জ্ঞাতি-সম্পর্কের গুরুত্বকে ধূলিসাৎ করে মানুষে-মানুষে সম্পর্কের চূড়ান্ত নিয়ন্তা হিসেবে দেখা দিয়েছে একটি নতুন শক্তি, তার নাম লোভ, লিপ্সা, লালসা। অতএব, অতীতের সেই বরুণ—সেই সখা, সেই দাতা, সেই প্রিয় ও নিত্যবন্ধু, সেই ঋতের পালক অনৃতের হন্তা—তাঁর পূর্বপরিচয়ও অস্পষ্ট হয়ে যাচ্ছে। ফলে ঐতরেয় ব্রাহ্মণে আমরা দেখছি, অতীত বরুণেরই প্রেত, পাওনা-আদায়ের লোভে অতি ভয়ঙ্কর হয়ে উঠেছে।

আরো কথা আছে। অতীতের সেই বরুণ, সেই সত্য ও ন্যায়ের রক্ষক বরুণ—তাঁর নিয়ম ছিলো অত্যন্ত কঠোর।

Varuna’s ordinances are constantly said to be fixed the epithet dhrita-vrata (ToS) being preeminently applicable to him…the gods themselves follow Warun$ ordinance. Even the immortal gods cannot obstruct the ordinances of Mitra and Varuna…Mitra and Varuna are lords of order (ঋত) and light, who by means of order are the upholders of order…(৮৩)

ঋগ্বেদে বারবার বরুণের পাশ-এর উল্লেখ দেখা যায়,—এই পাশ দিয়ে তিনি অন্যায় আচরণকারিদের বন্ধন করেন (৬.৭৪.৪; ১০.৮৫.২৪, ইত্যাদি)।

মনে রাখা দরকার, বরুণের এই যে কঠোরতা তা ন্যায়ের খাতিরে, সত্যের খাতিরে, প্রাচীন জ্ঞাতি-ভিত্তিক সমাজের সহজাত নীতিনিষ্ঠার খাতিরে। ফলে, লোভ, লিঙ্গা, লালসার প্রভাবে বরুণের চরিত্র থেকে ওই নীতিনিষ্ঠার প্রেরণাটুকু অস্পষ্ট হয়ে এলে বাকি থাকে শুধু কঠোরতা। দেবতাটি তখন ভয়ঙ্কর, বিভীষিকার উৎসমাত্র। উত্তরকালের সাহিত্যে আমরা বরুণকে সেই ভয়ঙ্কর মূর্তিতেই দেখি—দুঃস্বপ্নের মতো। অধ্যাপক কীথ্(৮৪) বলছেন,

It must be admitted that the figure of Varuna does not increase in moral value in the course of the development of the Vedic religion…Varuna is remembered as the god who has fetters and becomes in the Brahmanas a dreaded god, whose ritual in some measure is assimilated to that of the demons and the dead. After the performance of the bath, which ends the Agnistoma sacrifice, the performer turns away and does not look back to escape from Varuna’s notice”, and in the ceremony of that bath when performed after the horse sacrifice, a man of peculiar appearance is driven into the water and an offering made on his head, as being a representative of Varuna”: this form of the expulsion of evils, which is a common idea throughout the world, shows Varuna reduced to a somewhat humble level, and degraded from his Rigvedic eminence.
১। তৈক্তিরীয় সংহিতা : ৬.৬.৩৫; মৈত্রায়নীয় সংহিতা : ৪.৮.৫.
২। আপস্তম্ব শ্রৌত সূত্র : ১৩.১৯.১ ইত্যাদি।

—————
৭২. F. Engels OFPPS 268.
৭৩. ঐতরেয় ব্রাহ্মণ (ত্রিবেদী) ৪৪১-৪।
৭৪. A. A. Macdonell VM-27.
৭৫. Ibid. 23-4.
৭৬. Ibid 26.
৭৭. A. B. Keith RPVU 1:97.
৭৮. Ibid.
৭৯. A. A. Macdonell op. cit. 65.
৮০. Ibid.
৮১. F. Engels OFPPS 267.
৮২. Ibid. 261.
৮৩. A. A. Macdonell op, cit. 26.
৮৪. A. B. Keith op. cit. 1247-8.