১৬. সর্বেশ্বেরবাদ

সর্বেশ্বেরবাদ

সামগ্রিক বিচারে ঋগ্বেদ নিশ্চিতভাবেই সৰ্বেশ্বরবাদী। তবু, অন্তিম পর্যায়ের রচনায় পুরোনো বিশ্বাসের প্রতি ক্লিষ্ট সংশয়ের কিছু কিছু চিহ্ন এমন কি একেশ্বরবাদের প্রতি সুস্পষ্ট বেঁকেও কোথাও কোথাও লক্ষ্য করা যায়। দেবতাদের মধ্যে ইন্দ্রের এতদিনকার তর্কাতীত প্ৰাধান্য এখন আর বিনা বাক্যে গ্ৰহণীয় নয়। পারিবারিক মণ্ডলগুলির একটি সূক্তে (২ : ১২) যুদ্ধবিজয়ী ও অলৌকিক খ্যাতিসম্পন্ন শ্রেষ্ঠ দেবতারূপে ইন্দ্ৰ যদিও অত্যন্ত স্পষ্টভাবে বন্দিত হয়েছেন, তবু তার মধ্যেও কয়েকটি মন্ত্রে যেন সংশয়ের কালো ছায়াও ফুটে উঠেছে। এই সূক্তটি ‘সজানীয়’ ব’লেও পরিচিত কেননা এর প্রতি মন্ত্রে একই ধ্রুবপদ : ‘স জনাস ইন্দ্ৰ ৷ পরবর্তী একটি সূক্তে (৮ : ১০০) সংশয়ের ছায়া আরো স্পষ্ট ও ঘনীভূত। অবশ্য সংশয়ের এই তীক্ষ্ণ সুরকে বেশি দূর পর্যন্ত অগ্রসর হতে দেওয়া হয়নি ; দেবতা এখানে যেন স্বয়ং যজমানকে নিজ গৌরবের কথা জানিয়ে আশ্বস্ত করেছেন, অবিশ্বাসীর সন্দেহ দূর করে তার প্রতি আস্থাকে পুনঃপ্রতিষ্ঠিত করেছেন।

ইন্দ্ৰ বা অন্যান্য দেবতার অস্তিত্ব বা পরিচয় সম্পর্কে সরাসরি অবিশ্বাস প্ৰকাশ না করেও হয়তো বা এই সব মন্ত্র যথার্থই গভীরতর সংশয় ব্যক্ত করেছিল। লক্ষণীয় সে ঋগ্বেদের আদিপর্বেই মানুষ প্রশ্ন করছে ‘কে জানে, কে দেখেছে’,–অর্থাৎ সংশয় ও প্রত্যয় একই যুগে দেখা দিয়েছে। বহু সংখ্যক দেব? তা সম্ভবত সাধারণ মানুষের পক্ষে বিভ্ৰান্তিজনক বলে প্ৰতিভাত হয়েছিল এবং যারা চিন্তা বা বিশ্বাসের মধ্যে শৃঙ্খলা আনতে চেয়েছিলেন, তাদের মনেও এই বিশাল দেব-সঙ্ঘের অস্তিত্ব সম্পর্কেই সাহসী ও স্পষ্ট সংশয় দেখা দিয়েছিল। বৈদিক ধর্মীয় ভাবনার ইতিহাসের কোন এক অজ্ঞাত সন্ধিক্ষণে সৰ্বেশ্বরবাদ সম্পর্কিত সংশয় একেশ্বরবাদী প্রবণতা সৃষ্টির প্রক্রিয়াকে ধীর কিন্তু নিশ্চিতভাবে সহায়তা করেছিল ; এই প্রক্রিয়ায় অস্পষ্টতা ও প্রচুর অন্তনিহিত দ্বন্দ্ব ছিল— প্ৰাথমিকভাবে যে বিশুদ্ধ প্রত্নপৌরাণিক একেশ্বরবাদের জন্ম হয়েছিল তাতে দেবতাদের প্রকৃত ব্যক্তিত্ব অন্তরালে রয়ে গিয়েছিল। একটি দেশজ অনার্য প্রভাব কিংবা আর্য ধমীয় চিন্তার দ্বন্দ্ব নিরসনের মধ্য দিয়ে অথবা, সমালোচক পেত্তাজোনির মত অনুযায়ী, কোন আকস্মিক সামাজিক বিপ্লবের ফলে এই ব্যাপারটা ঘটেছিল। আবার এও হতে পারে যে, পূর্বোক্ত উপাদানগুলি একসঙ্গে এমন এক নব্য প্রবণতায় শক্তি জুগিয়েছিল যা শেষ পর্যন্ত একেশ্বরবাদে পরিণত হয়। উৎস যাই হােক না কেন, সংহিতা-রচনার শেষ পর্বে আমরা একেশ্বরবাদের স্পষ্ট লক্ষণ যথার্থই দেখতে পাই।