১৫. সোমমণ্ডল

সোমমণ্ডল

ঋগ্বেদের সমগ্ৰ নবম মণ্ডলই সোমদেবতার প্রতি নিবেদিত। এর বিষয়বস্তু থেকে স্পষ্টই বোঝা যায় যে সম্পাদনার প্রক্রিয়া অনেক বিলম্বে ঘটেছিল পূর্ববতী মণ্ডলগুলি থেকে একজন নির্দিষ্ট দেবতা অর্থাৎ সোমের প্রতি নিবেদিত সূক্তসমূহ একটি পৃথক মণ্ডলে সন্নিবিষ্ট করার মধ্যেই এ-প্রক্রিয়া সীমাবদ্ধ ছিল। এই সম্পাদনা কর্মের পশ্চাৎপটে সক্রিয় অনুপ্রেরণার সন্ধান করতে গিয়ে আমরা এই বিশেষ তথ্যের সম্মুখীন হই যে, বৈদিক ধর্মের কেন্দ্রীয় ও সর্বাত্মক গুরুত্বপূর্ণ অবস্থানে সোমযাগ ক্রমশ প্রতিষ্ঠিত হচ্ছিল। সোমদেবের মধ্যে রাজধর্ম প্ৰতীকায়িত হয়ে উঠেছিল ; এই রাজধর্মের মধ্য দিয়েই একজন ক্ষত্রিয় সোমদেবের সঙ্গে একাত্ম হয়ে উঠতেন। রাজপদে সোমের উন্নয়ন সোমচৰ্যার গৌরব বৃদ্ধির সঙ্গে একই সূত্রে গ্রথিত। অভিষেকের সময় সোমদেবকেই ব্ৰাহ্মণদের রাজারাপে বর্ণনা করা হয় ; এতেও তাঁর আধিপত্য ও আনুষঙ্গিক জাদুশক্তি প্রমাণিত।

সন্দেহ নেই যে, সোমরসের মধ্যে যে মাদকতা যে, উল্লাসজনক ও ভ্ৰম উৎপাদক বৈশিষ্ট্য ছিল, তারই ফলে যজ্ঞানুষ্ঠানে এর গুরুত্ব ক্রমশ বধিত হয়। দীর্ঘায়ু লাভের জন্যও এই পানীয় ব্যবহার করা হত। ঋগ্বেদের সোমের মতই অবেস্তায় ‘হওম’ স্বৰ্গ থেকে উচ্চ পর্বতে একটি বিপুলকায় পক্ষী দ্বারা আনীত হয়েছিল। ব্যাবিলনীয় প্রত্নকথাতেও রয়েছে, সূর্যদেব শামসের নিকট পবিত্ররূপে গৃহীত ও দীর্ঘায়ুপ্ৰদ একটি জাদুকরী লতা পর্বতে পাওয়া যায়। ঋগ্বেদের সূক্তগুলি সাধাবণভাবে পবিমান সোম অর্থাৎ পশমের চালুনির মধ্যে দিয়ে ছেঁকে-নেওয়া সোমরসের প্রতি নিবেদিত। শ্বেতবর্ণ, উজ্জ্বল ও আকর্ষণীয় রস “দ্রোণ’ কলসে রক্ষিত হওয়ার সময়ে যে মধুর ধ্বনি নিৰ্গত হ’ত পানকারীদের কানে তা অতি মধুর ঠেকত। ঋগ্বেদীয় প্রত্নকথা অনুযায়ী সোম মূলত দৈব সম্পদ ; পক্ষী দ্বারা পৃথিবীতে আনীত হয়ে তা পার্বত্য অঞ্চলে বৃদ্ধিপ্রাপ্ত হয়। বহুবিধ বাস্তব, আনুষ্ঠানিক ও প্রতীকী বিঘ্ন অতিক্রম করে সেই সোম সংগ্ৰহ করতে হত। সোমলতা থেকে নিষ্কাশিত রসের সঙ্গে নানারকম দুগ্ধজাত দ্রব্য, মধু ও ভূষ্ট যবচুর্ণ মিশ্রিত করে তার মাদকতা শক্তি বর্ধিত করা হত। আনুষ্ঠানিকভাবে সোমরস প্রস্তুতির সমগ্র প্রক্রিয়াটি বিভিন্ন সূক্তে এবং বারেবারে বিবৃত হয়েছে। এমনকি প্রাসঙ্গিক বিভিন্ন পাত্র, দ্রোণকলস, হাতা, পেষণ-প্ৰস্তুর (শিলনোড়া), ছাঁকনি প্রভৃতিও উল্লিখিত ও প্রশংসিত হয়েছে।

সোমযাগ সাধারণত দীর্ঘস্থায়ী ; সমস্ত বৈদিক যজ্ঞের মধ্যে দীর্ঘতম হল ‘সত্ৰ’, এটি একাদিক্ৰমে দ্বাদশ বর্ষ ধ’রে অনুষ্ঠিত হত। কিছুকাল পরে চারজন পুরোহিত সম্বলিত একদিবসীয় যজ্ঞও এত সম্প্রসারিত হল যে যজ্ঞনির্বাহক পুরোহিতদের সংখ্যা এবং আনুষ্ঠানিক অনুপুঙ্খ অনেক বেড়ে গেল ; বস্তুত সোমযাগ যজ্ঞশ্রেষ্ঠ বলে স্বীকৃত না হওয়া পর্যন্ত যজ্ঞের সরল কাঠামোয় সম্ভম-উৎপাদক উপাদান, ইন্দ্ৰজাল ও রহস্য নিরন্তর সংযোজিত হয়ে চলেছিল। পরবর্তী সময়ে সোমযাগের অনুষ্ঠানগত তাৎপর্য বিশেষভাবে বধিত হয়ে যখন তার নিজস্ব অতীন্দ্ৰিয় রূপকর্ম গড়ে উঠল এবং সংহিতার পূর্বতন অংশ থেকে যখন নবম মণ্ডল পৃথক হয়ে গেল-সোমগীতি বহুসংখ্যায় রচিত ও পরিমার্জিত হয়ে প্ৰভুত ধমীয় ও আনুষ্ঠানিক তাৎপর্যাবহ সূক্তসমূহে সন্নিবেশিত হল।

প্ৰাথমিক পর্যায়ে সোম পার্থিব উদ্ভিজ্জ ; কিন্তু পরবর্তী পর্যায়ে দৈব সত্তায় উন্নীত এবং ‘রাজা’, ‘সম্রাট্‌’ ও ব্রাহ্মণদের অধিপতিরূপে অভিহিত। লক্ষণীয় যে, তৎকালীন ভারতবর্ষে রাজকীয় পদবী যখন প্ৰতিষ্ঠানিকভাবে দৃঢ় রূপ পরিগ্রহ করছিল, সে সময়েই রাজার সঙ্গে প্রতীকী ভাবে সোমের সমীকরণ ঘটে এবং তার গুরুত্বও এর দ্বারা বহুগুণ বেড়ে যায় আনুষ্ঠানিক ও ঐন্দ্ৰজালিক তাৎপর্য যেমন কালক্রমে সমন্বিত হয়েছে, তেমনি আনুষ্ঠানিক পানীয় ও দেবতার মধ্যে ব্যবধানও ক্ৰমে লুপ্ত হয়ে গেছে। তাছাড়া, সোমের সঙ্গে ইন্দ্রের সম্পর্ক যেহেতু ঘনিষ্ঠ, নবম মণ্ডলের অনেক মন্ত্র প্রাথমিকভাবে সোমসম্বন্ধীয় হয়েও ইন্দ্রের সঙ্গে সম্পর্কযুক্ত।

নবম মণ্ডলের প্রধান কবিরা কাণ্ব, ভৃগু ও আঙ্গিরা পুরোহিত-পরিবারের সদস্য ; এরা যথাক্রমে আট, বারো ও তেইশটি সূক্ত রচনা করেছিলেন। এঁরা এবং অন্যান্য কবিরা সোমকে লতা, দেবতা ও আকাশবিহারী চন্দ্ররূপে বন্দনা করেছেন। সমস্ত বৈদিক ছন্দই এই মণ্ডলে ব্যবহৃত হয়েছে ; তবে মোট সূক্তের অর্ধেকেরও বেশি রচিত হয়েছে গায়ত্রী ছন্দে। সাহিত্যিক দৃষ্টিকোণ থেকে বিচার করলে অধিকাংশ সোমসূক্ত আমাদের হতাশ করে ; কাব্যগত ভাবে স্পষ্টতই এগুলি নিম্নমানের রচনা। এই মণ্ডলের বেশ কিছু সূক্ত অন্যান্য প্রাচীন কাব্যে প্রচলিত মদ্যপান-গীতির মতো ; পানীয় ও তজজাত মাদকতার অবস্থা এসব রচনায় বর্ণিত হয়েছে। অতিদীর্ঘায়িত ও পুনরাবৃত্তিময় যজ্ঞানুষ্ঠানের সঙ্গে এদের নিবিড় সম্পর্ক স্পষ্ট ; প্রসঙ্গ থেকে শ্লোকগুলিকে বিচ্ছিন্ন করে নিলেও কাব্যিক সৌন্দৰ্ম্ম প্ৰায় কোথাওই খুঁজে পাওয়া যায় না। তবে মণ্ডলের শেষ সূক্তটি একটি চমৎকার ব্যতিক্রম।