০৫. স্তোত্রগীতি সম্বন্ধে ঋষিকবিদের দৃষ্টিভঙ্গি

স্তোত্রগীতি সম্বন্ধে ঋষিকবিদের দৃষ্টিভঙ্গি

সম্ভবত ঋগ্বেদের কবিদের রচনায় কিছু কিছু আদিম বিশ্বাস কাব্য-রূপ পরিগ্ৰহ করেছে; বিশেষত ঐন্দ্রজালিক সম্মোহনের সম্বন্ধে আদিম জাদুকর বৈদ্যের মনোভাব এতে প্ৰতিফলিত হয়েছে। তারা বিশ্বাস করতেন যে দেবতাদের ক্ষমতা ও মহাজাগতিক ক্রিয়াকলাপকে পরিপুষ্ট করেই সূক্তগুলি ঐন্দ্ৰজালিক আবেশ তৈরি করতে সমর্থ। স্তুতি দেবতাদের প্রীতি উৎপাদন করে ঠিক যেভাবে আহুতিরূপে অপিত খাদ্য তাদের পরিপুষ্ট করে ; তাই সূত্রগুলি তাদের বৃদ্ধি পেতে সাহায্য করে। স্তুতি রণক্ষেত্র ইন্দ্রের যোদ্ধা চরিত্রের উৎকর্ষ ত্বরান্বিত করে, এটা অতি প্ৰচলিত ধারণা ; কেননা ইন্দ্ৰ প্রবল পরাক্রমে যুদ্ধ করে আর্যদের জয়, সমৃদ্ধি, শান্তি, স্বাস্থ্য ও সম্পদবৃদ্ধিকে নিশ্চিত করে তোলেন। যজ্ঞের সবচেয়ে প্রীতিকর উপকরণই হচ্ছে মন্ত্র ; একটি শক্তিশালী মন্ত্র যজ্ঞের মান বাড়িয়ে দিতে পারে। মন্ত্রগুলির মধ্যে শব্দের ইন্দ্ৰজাল নিহিত থাকে এবং যথার্থ স্বরন্যাস, উচ্চারণ, সুর ও অনুষ্ঠানসহ যজ্ঞে প্ৰযুক্ত হলে সেইসব শব্দ রহস্যময় অলৌকিক ক্ষমতা উৎপন্ন করে (মীমাংসা দর্শনের ‘অপূর্ব সম্বন্ধে ধারণা স্মরণীয়)। মন্ত্রগুলি ঋষিকবিকে অনন্যসাধারণ অন্তদৃষ্টিতে ভূষিত করেছিল ; এমন কি সূৰ্যও নিজেকে মন্ত্রদ্রষ্টা ঋষির কাছে প্ৰকাশ করেছিলেন। এসব কথা শুনি সূক্তে।

এটা অনুধাবন করার জন্য উচ্চারিত শব্দের প্রতি আৰ্যদের অদ্ভুত শ্রদ্ধাবোধের তাৎপর্য প্রয়োজন, তাদের কাছে বাক (গ্ৰীক ‘লোগস’) হল সেই বিশিষ্ট চরিত্রলক্ষণ যা মানুষকে প্রাণিজগতের বহু উদ্ধের্ব উন্নীত করে ; এমন একটা স্তরের কাছাকাছি নিয়ে আসে যেখানে তার সঙ্গে দেবতাদের অবারিত সম্পর্ক গড়ে ওঠে। সুপ্রযুক্ত স্তোত্ৰ শতবর্ষব্যাপী পরমায়ুর আশ্বাস দেয়; যে ব্যক্তি দেবতাদের স্তুতিগান করে না, জীবনে তার কোনো উন্নতি হয় না। প্রশস্তি তো শুধু দেবতাদের ওজস্বিত্যাবর্ধক অন্নই নয়, তা তাদের সৌন্দর্যে অলংকৃত করে। মন্ত্রের সাহায্যে ঋষিকবি পাপ ও দুর্ভাগ্য অতিক্রম করে নিরাপত্তার বেলাভূমিতে উপনীত হওয়ার প্রত্যাশা করেন ; এই রকম মন্ত্রই মানুষের সকল বন্ধন-শৃঙ্খল শিথিল করে দেয়।

অতিলৌকিক অর্থেও স্তোত্ৰগীতি সৃজনধর্মী হতে পারে। অঙ্গিরা বংশের ঋষিরা ছিলেন দেবতাদের প্রতিবেশী ও প্রাচীন ঐতিহ্যের প্রকৃত কবি ; সেই পূর্বসূরিগণ গোপন নিগুঢ় জ্যোতি জয় করেছিলেন ; নিজেদের স্তোত্রের সাহায্যে তঁরা উষাকে অর্জন করেছিলেন। এই বক্তব্যের মূলগত তাৎপর্য এই যে, দেবতাদের প্রতিবেশী সত্যভাষী অঙ্গিরা ঋষিরা। যদি যথার্থ প্রশস্তি না গাইতেন, তাহলে সম্পূর্ণ সৃষ্টিই প্ৰগাঢ় অন্ধকারে আচ্ছন্ন রয়ে যেত। অতএব মন্ত্রের অতিজাগতিক ভূমিকা স্পষ্ট ; তাদের মাধ্যমেই মানুষ ঐহিক সীমিত স্তর থেকে উৎক্রমণ করে বিশ্বস্রষ্টার স্তরে উন্নীত হয়।

স্তুতি শুধুমাত্ৰ কাব্যিক আবেগ-উন্মাদনার অভিব্যক্তি নয় ; এর দ্বারাই প্রার্থিত বরলাভের প্রত্যক্ষ উল্লেখ বারবার আমাদের দৃষ্টি আকর্ষণ করে। নূতন মন্ত্ররচনা করে সম্পদ ও বলদায়ী অন্ন দান করার জন্য বিভিন্ন দেবতার কাছে পার্থনা করা হয়, প্রশস্তির বিনিময়ে দৈব অনুগ্রহ ও প্ৰাণ-প্ৰাচুৰ্য কামনা করেন। ঋষি-কবি টিপাসনার সবচেয়ে তাৎপর্যপূর্ণ অঙ্গ হল স্তোত্ৰিপাঠ। সুক্তরচনার আরো একটি কারণ এই যে, দেবতারা তাদের মাধ্যমে নন্দিত হতে ভালবাসেন ; এইজন্য বারবার তাদের উপস্থিত হয়ে মন্ত্রের স্তুতি উপভোগ করার আহ্বান জানানো হয়। বলা হয়েছে যে বিপ্ররা অর্থাৎ ঐশী প্রেরণা-ধন্য কবিরা ঋভুদের জন্য স্তোম রচনা করেছেন।

ঋগ্বেদের প্রধান দুই দেবতার অন্যতম অগ্নিকে দেবতাদের কবি বলে উল্লেখ করা হয়েছে, তার প্রতি নিবেদিত স্তুতি দিয়েই প্ৰাচীনতর মণ্ডলগুলির প্রারম্ভিক সূক্তসমূহ গঠিত হয়েছে, এর অন্যতম কারণ সম্ভবত অগ্নির কবিসংজ্ঞা। কবিদের হৃদয়েই স্তোত্রের জন্ম ; রথনির্মাতা যেভাবে তার শিল্পৰ .াকে ধৈর্য ও শ্রমের সাহায্যে প্ৰকাশ করে তেমনি কবিও শব্দের মাধ্যমে অনুরূপভাবে অনুভূতিকে অভিব্যক্তি করেন। সূক্ষ্ম বস্ত্ৰ বয়নের উপমা দিয়েও এই একই বক্তব্য তুলে ধরা হয়েছে। জনৈক কবি নিজেকে শব্দের কারিগর বলে অভিহিত করছেন, তা থেকে বোঝা যাচ্ছে যে, তিনি সচেতন শিল্পী এবং কাব্যের শিল্পকর্মটিও যত্নসাপেক্ষ যেমন ধীর নিষ্ঠার বািন্ত্রবয়ন সম্পাদিত হয় তেমনই। আরেকজন কবি ঘোষণা করেছেন যে, তাদের নূতন ভাষা দিয়েই দেবতারা কাব্যের প্রধান উপাদান সৃষ্টি করেছিলেন ঃ মনোরমা বাক যদি যথাযথভাবে ব্যবহৃত হয়, তাহলে অন্ন ও ওজস্বিতা উৎপাদন করে ; তাই বাক প্রকৃতপক্ষে কামধেনু। মুদ্রা-ব্যবস্থা প্রচলিত হওয়ার পূর্ববতী বিনিময়ভিত্তিক প্রাচীন ভারতীয় বাণিজ্যে গাভী মুদ্রার মতোই ব্যবহৃত হত, এ-কথা মনে রাখলে কামধেনুর চিত্রকল্পটি বিশেষ তাৎপর্যবহ হয়ে ওঠে। অন্যত্র বলা হয়েছে, প্ৰেমময়ী সুসজ্জিতা নববধূ তার দায়িতের কাছে যেভাবে নিজেকে উন্মোচিত করে, তেমনি কবির কাছে বাকও আপন সৌন্দর্য প্রকাশ করে। প্রেরণা ও ছন্দোযুক্ত হওয়ার পরই সাধারণ বাক নবরূপে অপৌরুষেয় হয়ে ওঠে।

অধিকাংশ কাব্যশিল্পবষয়ক মন্ত্র যে আমরা প্ৰথম (৫১-১৯১ সূক্ত) ও দশম অর্থাৎ কালগতভাবে দুটি নবীনতম মণ্ডলে পাই, তা খুবই কৌতুহলপ্ৰদ।। সৃষ্টিশীল রচনাপ্রবাহে যখন ভাটার টান শুরু হয়েছে, পরবতী প্ৰজন্মগুলি সম্ভবত তখন নিরাসক্ত দূরত্ব থেকে সৃষ্টির রহস্যকে বিশ্লেষণ করে তাত্তিক ব্যাখ্যা দিতে চাইছিল। নবম মণ্ডলে আমরা প্রায়ই ‘প্রত্নমন্ম বা পুরাণীগাথা” অর্থাৎ পুরাতন প্রশস্তি বা পুরাতন গীতির কথা শুনি। বস্তুত, নূতন রচনা কবির গভীর শ্রদ্ধাবোধেরই পরিচায়ক যার প্রভাবে তিনি উদ্দিষ্ট দেবতার জন্য নুতন রচনার অর্ঘ্য নিবেদন করছেন। অন্যান্য মণ্ডলেও পুরাতন ও নূতন গীতিকে একই সঙ্গে এমনভাবে প্রশস্তি করা হয়েছে যাতে মনে হয়, এদের গুণগত মাত্রা প্রতিসূক্তেই ভিন্ন। প্রায় কুড়িটি নূতন বা ‘নব্য’ সূক্তের উল্লেখ থেকে প্রমাণিত হয় যে, বৈদিক কবিরা এই তথ্য সম্পর্কে সচেতন ছিলেন যে তাদের নিজস্ব সময়ের বহুপূর্ব থেকেই ঋগ্বেদের সূক্ত-রচনার সূত্রপাত হয়েছিল।