১. মৌলবাদ-একটি ‘আধুনিক’ পরিভাষা

মৌলবাদের উৎস সন্ধানে – ভবানীপ্রসাদ সাহু

মৌলবাদ-একটি ‘আধুনিক’ পরিভাষা

বাংলা ভাষায় ‘মৌলবাদ’ কথাটি খুব বেশি দিন চালু হয় নি। সত্যি কথা বলতে কি চলন্তিকা, এ. টি. দেব, সাহিত্য সংসদের বাংলা-বাংলা বা বাংলা-ইংরেজি অভিধান, কিংবা কাজী আবদুল ওদুদ-আনিলচন্দ্র ঘোষ সম্পাদিত ‘ব্যবহারিক শব্দ কোষ’–এ ধরনের বিভিন্ন অভিধানে ‘মৌলবাদ’ কথাটিই অনুপস্থিত। এসব অভিধানে ‘অধ্যাত্মবাদ’, ‘মতবাদ’ থেকে ‘সাম্যবাদ’, ‘পুঁজিবাদ’—নানা শব্দই রয়েছে, কিন্তু ‘মৌলবাদ’ শব্দটি একেবারেই বাদ। তবে IPP-এর ‘আধুনিক বাংলা অভিধান’- এ ‘মৌলবাদ’ শব্দটি রয়েছে এবং এর অর্থ বলা হয়েছে ‘ধর্মীয় গোঁড়ামির ফলে জাত সংকীর্ণ মতবাদ’। অন্যদিকে সাহিত্য সংসদের ইংরেজি-বাংলা অভিধানে ‘fundamentalism’ কথাটির অর্থ বাংলায় বলতে গিয়েও ‘মৌলবাদ’ উল্লেখ করা হয় নি, বলা হয়েছে। ‘বাইবেল বা অন্য ধর্মশাস্ত্রের বিজ্ঞানবিরুদ্ধ উক্তিতেও অন্ধবিশ্বাস।’ কিন্তু যথাসম্ভব এই fundamentalism কথাটিরই বাংলা অনুবাদ করে ‘মৌলবাদ’ কথাটি চালু করা হয়েছে। তবে তা যে বেশি দিনের ব্যাপার নয়, তা স্পষ্ট। হলে সব বাংলা অভিধানে অন্তত তার উল্লেখ থাকতো। বর্তমানে কথাটি যেভাবে চালু হয়েছে এবং সংবাদপত্র, প্রবন্ধ, রাজনৈতিক শ্লোগান, বিভিন্ন সংগঠনের প্রচারপত্র ইত্যাদিতে যেভাবে ব্যবহৃত হচ্ছে, তাতে আশা করা যায়, আর কয়েক বছর পরোকার সংস্করণে ঐ সব অভিধানেও কথাটি অন্তর্ভুক্ত হবে।

মূল + ষ্ণ = মৌল ; এই সম্পর্কিত যে মানসিকতা বা মতবাদ আক্ষরিকভাবে তাই-ই মৌলবাদ। মৌল কথাটির অর্থ অনেকভাবেই দেওয়া হয়েছে অভিধানে। তার কয়েকটি হল মূল হইতে আগত, আদিম, প্রাচীন (মৌল আচার) ইত্যাদি। বিমলকৃষ্ণ মতিলাল তার ‘মৌলবাদ—কি ও কেন?’ প্রবন্ধে বলেছেন, ‘ফাণ্ডামেন্টালিজম’ এর বাংলা প্রতিশব্দ তৈরী করা হয়েছে–মৌলবাদ–একেবারে সংস্কৃত ঘেঁষা প্রতিশব্দ– ‘মূল’ থেকে ‘মৌল’। বন্ধু গায়ত্রী চক্রবতী-স্পিভাক বলেন ‘ভৈত্তিকতা’–’ফাণ্ডামেন্টালিজম’-এর প্রতিশব্দ হওয়া উচিত। ‘ভিত্তি’ অথবা ‘ফাউণ্ডেশান’ থেকে। আমি ‘মৌলবাদ’কে গ্ৰহণ করলাম।

‘ভিত্তি’-কে আঁকড়ে রাখার যে প্রবণতা তাকে ‘ভৈত্তিকতা’ বলা যায়; এই ভিত্তি কোন বিশেষ চিন্তাপদ্ধতি, মতাদর্শ, ধর্মমত ইত্যাদির ভিত্তি হিসেবে যে কথাবার্তা বলা হয়েছিল তাকেই বোঝায়। কিন্তু এই অর্থে, মৌলবাদের বিকল্প কথা হিসেবে ‘ভৈত্তিকতা’ শব্দটি আর কেউ ব্যবহার করেছেন বা তার প্রস্তাব দিয়েছেন। কিনা জানা নেই।

অন্যদিকে ‘মৌলবাদ’ শব্দটির ব্যবহার বিগত শতাব্দীতে এমন কি এই বিংশ  শতাব্দীর প্রথমার্ধেও আদৌ হয়েছিল বলে মনে হয় না। রামমোহন, বিদ্যাসাগর, বঙ্কিমচন্দ্ৰ বা রবীন্দ্রনাথ–বাংলা ভাষা ও সাহিত্য যাদের হাতে শৈশব পেরিয়ে যৌবনে পদার্পণ করেছিল, তাঁরা ধর্ম, ধর্মীয় গোড়ামি, ধর্মীয় কুসংস্কার, ধর্ম সম্প্রদায় ও সাম্প্রদায়িকতা ইত্যাদি প্রসঙ্গে বহু আলোচনা করলেও তাদের লেখায় কোথাও মৌলবাদ শব্দটি সাধারণভাবে চােখে পড়ে না। এটি অবশ্যই ঠিক যে, তাদের প্রতিটি লেখা খুঁটিয়ে পড়ে তারপর এমন মন্তব্য করা হচ্ছে তা নয়। উপযুক্ত গবেষক ও মনোযোগী পাঠক এ ব্যাপারে আলোকপাত করতে পারবেন। তবে এতে অন্তত কোন সন্দেহ নেই যে, বিংশ শতাব্দীর শেষ দুই দশকে (বিশেষত আশির দশকের শেষার্ধ থেকে, রাম জন্মভূমি-বাবরি মসজিদ বিতর্কের প্রসঙ্গে) বাংলা ভাষায় এই শব্দটি পূর্বেকার কয়েক শত বছরের তুলনায় এত বেশি ব্যবহৃত হচ্ছে যে, শব্দটির উদ্ভবই এই সময়ে ঘটেছে বলে বলা যায়।

এই শব্দটির এমন সৃষ্টি ও বহুল ব্যবহারের জন্য ‘ধন্যবাদ’ প্রাপ্য এখনকার হিন্দুত্ববাদী ও ইসলামী জঙ্গী গোষ্ঠীগুলির। এই অর্থে হিন্দু, খৃস্ট বা ইসলামের ইতিহাস ধর্মান্ধ ও গোড়া হিসেবে তার অনুসরণকারী ব্যক্তিদের একটি অংশকে প্রতিষ্ঠা করলেও এবং একটি বিশেষ গোষ্ঠী হিসেবে পাশ্চাত্যে ‘Fundamentalist’— দের ভিত্তি প্রতিষ্ঠা শতাধিক বৎসর পূর্বে ঘটলেও বাংলা ভাষায় ‘মৌলবাদ’ ‘মৌলবাদী’ কথা দুটি বিশেষ মানসিকতাকে ও ঐ মানসিকতার ব্যক্তি বা গোষ্ঠীকে বােঝাতে এত সুনির্দিষ্টভাবে আশির দশকের আগে ব্যবহৃত হয়নি। এর একটি বড় কারণ আধুনিক ইসলামী মৌলবাদের আবির্ভাব ঘটেছে। ৭০-এর দশকের শেষের দিকে, ইরান ও আফগানিস্থানে। আর শিবসেনা, রাষ্ট্রীয় স্বয়ং সেবক সংঘ, বিশ্ব হিন্দু পরিষদ, ভারতীয় জনতা পার্টি ও তার অন্যান্য সহযোগী সংগঠনগুলি এই আধুনিক বিশ্বে, ধর্মনিরপেক্ষ হিসেবে ঘোষিত ভারতের বুকে বসে ধর্মীয় সংকীর্ণতা, সাম্প্রদায়িকতা ও অসহিষ্ণুতার যে চরম বহিঃপ্রকাশ ঘটিয়েছে ও ঘটাচ্ছে এবং ধর্মান্ধ গোষ্ঠীগুলিও যে একই অ-সভ্য আচরণ করেছে, এসবের প্রভাবে কোন এক সময় কোন লেখক বা সাংবাদিক এমন একটি গ্রহণযোগ্য শব্দ ব্যবহার করে বসেছেন। তাঁর মাথায় যথাসম্ভব ঐ Fundamentalism বা Fundamentalist-দের উদাহরণ ছিল অর্থাৎ একেবারে স্বাধীনভাবে এই শব্দটি যে সৃষ্টি হয়েছে তা নয়। শ্ৰদ্ধেয় পণ্ডিত শ্ৰী বিমলকৃষ্ণ মতিলালও এই অনুমানই করেছেন। অর্থাৎ ঐ সময় এখানে গুণগতভাবে Fundamentalism-এর সঙ্গে তার সাদৃশ্যও খুঁজে পাওয়া গেছিল।

রামমোহন রায় তাঁর ‘সহমরণ বিষয় প্ৰবৰ্ত্তক ও নিবৰ্ত্তকের সম্বাদ’ (১৮১৮-১৯) লেখায় বলেছিলেন, “যে সকল মূঢ়েরা বেদের ফলশ্রবণবাক্যে রত হইয়া আপাত প্রিয়কারী যে ওই ফলশ্রুতি তাহাকেই পরমার্থসাধক করিয়া কহে আর কহে যে ইহার পর অন্য ঈশ্বরতত্ত্ব নাই” ইত্যাদি। এখন এই মানসিকতার কথা বলতে গিয়ে মৌলবাদ বা মৌলবাদী কথাগুলি যুৎসইভাবে কোথাও হয়তো বসিয়ে দেওয়া যেত।

১১ই সেপ্টেম্বর, ১৮৯৩ তারিখে স্বামী বিবেকানন্দ শিকাগো ধৰ্মসভার উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে অভ্যর্থনার উত্তরে বলেছিলেন, “সাম্প্রদায়িকতা, সংকীর্ণতা ও এসবের ফলস্বরূপ ধর্মোন্মত্ততা এই সুন্দর পৃথিবীকে বহুকাল ধরে আচ্ছন্ন করে রেখেছে। পৃথিবীতে এরা তাণ্ডব চালিয়েছে, বহুবার পৃথিবীকে নরশোণিতে সিক্ত করেছে, সভ্যতাসংস্কৃতি ধ্বংস করেছে এবং সমগ্র মানবজাতিকে নানা সময়ে বিভ্রান্ত, হতাশায় নিমগ্ন করেছে। এই সব ধর্মোন্মাদ পিশাচ যদি না থাকত, তবে মানবসমাজ আজ যে অবস্থায় উপনীত হয়েছে, তার থেকে কত সুন্দর হয়ে উঠতে পারত; এরা তা করতে দেয়নি!” এই ‘ধর্মোন্মাদ পিশাচরা’ ধর্মীয় মৌলবাদীরাই। কিন্তু তখন অন্তত বিবেকানন্দ ‘Fundamentalism’ বা ‘মৌলবাদী’ তথা ‘মৌলবাদী’ কথাগুলি ব্যবহার করেন নি।

এই মৌলবাদ ও মৌলবাদীদের বােঝাতে রবীন্দ্রনাথ ‘ঈশ্বরদ্রোহী পাশবিকতা’, ‘গোঁড়ামি’, ‘ধর্মের বেশে মোহ’, ‘পৌরোহিত্য শক্তি’, ‘সাম্প্রদায়িক ঈর্ষাদ্বেষ’, ‘ধর্মবিকার’, (ধর্মের নামে) ‘মানুষের উপর প্রভুত্ব’ ইত্যাদি নানা শব্দ ব্যবহার করেছেন।

“… তখন ব্রাহ্মণ তো কেবলমাত্ৰ যজন-যাজন অধ্যয়ন লইয়া ছিল না–মানুষের উপর প্রভুত্ব বিস্তার করিয়াছিল। তাই ক্ষত্ৰিয়-প্ৰভু ও ব্রাহ্মণ-প্ৰভুতে সর্বদাই ঠেলা ঠেলি চলিত; বশিষ্ঠে বিশ্বামিত্রে আপস করিয়া থাকা শক্ত।’ (লড়াইয়ের মূল, কালান্তর; পৌষ ১৩২১)

“… মুষলধারে নামিল বেহার অঞ্চলে মুসলমানের প্রতি হিন্দুদের একটা হাঙ্গামা। অন্য দেশেও সাম্প্রদায়িক ঈর্ষাদ্বেষ লইয়া মাঝে মাঝে তুমুল দ্বন্দ্বের কথা শুনি। আমাদের দেশে যে বিরোধ বাধে সে ধর্ম লইয়া, যদিচ আমরা মুখে সর্বদাই বড়াই করিয়া থাকি যে, ধর্মবিষয়ে হিন্দুর উদারতার তুলনা জগতে কোথাও নাই।” (ছোটো ও বড়, কালান্তর; অগ্রহায়ণ, ১৩২৪)

“এ কি হল ধর্মের চেহারা? এই মোহমুগ্ধ ধর্মবিভীষিকার চেয়ে সোজাসুজি নাস্তিকতা অনেক ভালো। ঈশ্বরদ্রোহী পাশবিকতাকে ধর্মের নামাবলী পরালে যে কী বীভৎস হয়ে ওঠে তা চোখ খুলে একটু দেখলেই বেশ বোঝা যায়।” (৮ বৈশাখ, ১৩৩৩-এ শান্তিনিকেতনে দেওয়া ভাষণ)

‘ধর্মের বেশে মোহ যারে এসে ধরে
অন্ধ সে জন মারে আর শুধু মারে।”

কিংবা

“হে ধর্মরাজ ধর্মবিকার নাশি,
ধৰ্মমূঢ়জনেরে বাঁচাও আসি।” (পরিশেষ, রচনাকাল ১৯২৬)

রবীন্দ্রসৃষ্টির বিপুল ব্যাপ্তির মধ্যে মৌলবাদী মানসিকতা ও মৌলবাদী গোষ্ঠীর প্রতি তীব্ৰ কাষাঘাতের চিহ্ন ছড়িয়ে আছে, যদিও তিনি ব্ৰহ্মা বা ঈশ্বর জাতীয় একটি অলীক মায়াময় সত্তায় গভীর বিশ্বাসও পোষণ করতেন। অবশ্যই এ তাঁর নিজস্ব বিশ্বাসের ব্যাপার; কিন্তু শুভবুদ্ধি, মনুষ্যত্ব ও মানবসভ্যতার মঙ্গলকর দিকের প্রতি তাঁর আন্তরিক আস্থা তাঁকে ধর্মের নামে এই ‘মোহমুগ্ধ ধর্মবিভীষিকার’ ও ‘পাশবিকতার’ বিরুদ্ধে সোচ্চার করেছে। তবু তাঁর এই বিশাল সৃষ্টিতে শেষ অদিও ‘মৌলবাদী বা ‘মৌলবাদী’ কথাগুলির আবির্ভাব ঘটে নি।

বিদ্যাসাগর থেকে শরৎচন্দ্র, রাজকৃষ্ণ মুখোপাধ্যায় থেকে রাজশেখর বসু-বহু মনীষীই বাংলাভাষায় উগ্র ধর্মান্ধত তথা মৌলবাদের বিরুদ্ধে, তাদের সংগ্রামের প্রকাশ ঘটিয়েছেন। এদের সাহিত্য ও সৃষ্টির মধ্যে ‘মৌলবাদ’ আসে নি। আর এসব কারণে এই কথাটিকেই এখনকার অনেক প্রবন্ধকার একটি ‘আধুনিক পরিভাষা’ হিসেবে গণ্য করতে শুরু করেছেন। যেমন–

“এই ‘এরা’ কারা? এরাই রবীন্দ্রনাথের ভাষায় ‘পৌরোহিত্য শক্তি’, আধুনিক পরিভাষায় ‘মৌলবাদী শক্তি’।”

কিংবা “রবীন্দ্রনাথ ব্রাহ্মণ্যশক্তি সম্পর্কে আপন মনোভাব একটুও গোপন রাখেননি। যা বলার তা খোলাখুলি বলেছেন। যে ব্রাহ্মণদের কথা তিনি তুলে ধরেছেন, বিবাকেনন্দ, বৈদান্তিক সন্ন্যাসী হয়েও তাদের বললেন ‘কলির রাক্ষস’। বিবেকানন্দের প্রাসঙ্গিক অভিমতটি তুলে ধরি। ১৮৯২-এ বোম্বে থেকে জুনাগড়ের দেওয়ানকে লিখছেন—’দুষ্ট ও চতুর পুরুতরা (আধুনিক পরিভাষায় যারা মৌলবাদী শক্তি) যত সব অর্থহীন আচার ও ভাঁড়ামিগুলিকেই বেদের ও হিন্দুধর্মের সার বলে সাধারণ মানুষদের ঠকায়, শোষণ চালায়। মনে রাখবেন যে, এসব দুষ্টু পুরুতগুলো বা তাদের পিতৃপিতামহগণ গত চারপুরুষ ধরে একখণ্ড বেদও দেখেনি। সাধারণ মানুষরা উপায়ান্তর না দেখে পুরুতদের ধর্মাচরণের নির্দেশকে মেনে নেয়। এর ফলে তারা নিজেদের হীন করে ফেলে। কলির রাক্ষসরূপী ব্ৰাহ্মণদের কাছ থেকে ভগবান তাদের বাঁচান।’ এই মৌলবাদী শক্তিকে সমাজ থেকে বিচ্ছিন্ন করতে বিদেশ থেকে বিবেকানন্দের আহ্বান এসে পৌঁছয় ভারতীয় যুবকদের কাছে–” ইত্যাদি (পশ্চিমবঙ্গ, রবীন্দ্রসংখ্যা, ১৪০২-এ তাপস বসুর প্রবন্ধ; বন্ধনীর মন্তব্য তাঁরই)

‘মৌলবাদ’ যে অধুনা প্রচলিত একটি শব্দ তা অন্যরাও স্বীকার করেন। ডঃ গৌতম নিয়োগী তার ‘ইতিহাস ও সাম্প্রদায়িকতা’ গ্রন্থে (১৯৯১) ‘মৌলবাদী’ ‘পুনরুজীবনবাদ’ ও ‘সাম্প্রদায়িকতা’ এই তিনটিকেই ‘অধুনা প্রচলিত শব্দ’ হিসেবে অভিহিত করেছেন। (পৃঃ ১৫)

এখন মৌলবাদ বা মৌলবাদী কথাগুলি ক্রমশঃ তার বিরল চরিত্র হারিয়ে ফেলেছে। সংবাদপত্রের প্রাসঙ্গিক প্রতিবেদনে তা একটি সাধারণ শব্দ হয়ে দাঁড়িয়েছে। ভারত তথা বিশ্বের নানা স্থানে হিন্দু মৌলবাদী-মুসলিম মৌলবাদীদের সাম্প্রতিক পরিবর্ধিত দাপট ও আস্ফালনকে কেন্দ্র করে যে শব্দ ব্যবহার শুরু হয়েছিল, তা গ্রামেগঞ্জের এমন মানসিকতার লোকেদের জন্যও ব্যবহার করা হচ্ছে। যেমন মুর্শিদাবাদের বাগড়ি ও নদীয়ার করিমগঞ্জ এলাকায় বাউল ফকির দরবেশদের উপর ধর্মীয় অত্যাচারের কথা বলতে গিয়ে এখন বলা হয় ‘মনের এই ভাবকে সিনায় রেখে যাঁরা বাউল সাধনায় জীবনযাপন করছেন, তাদের উপর নেমে এসেছে মৌলবাদীদের হুঙ্কার’ (আজকাল, ২৩ মে, ১৯৯৫); অমিতাভ সিরাজের প্রতিবেদন— “গান গেয়ে একঘরে, জল বন্ধ, জরিমানা”)।

ব্যাপারটা শুধু ভারত বলে নয়,–এই ধরনের মানসিকতা যাদের বা যে সংগঠনেরই আছে তাদের ক্ষেত্রেই আন্তর্জাতিক পরিপ্রেক্ষিতে শব্দটি এখন ব্যবহৃত হচ্ছে। যেমন, “ইংল্যাণ্ডের অনেক কলেজেই দানা বঁধছে ধর্মীয় উত্তেজনা : …রমজানকে কেন্দ্র করে সংঘর্ষের জেরে নাইজিরিয়ার এক কৃষ্ণাঙ্গ ছাত্র মারা যান।… কলেজের ছাত্রদের সূত্রে জানা গিয়েছে সারা বিশ্বে ইসলামের অনন্ত প্রভুত্ব স্থাপনে বিশ্বাসী মৌলবাদী সংগঠন হিজব-উত-হাহরির-এর সমর্থক একদল পাক ছাত্রের সঙ্গে বাকবিতণ্ডার পরই ছাত্রটি আক্রান্ত হন। … উল্লেখ্য, ইংলণ্ডের অধিকাংশ কলেজেই এই মৌলবাদী সংগঠন নিষিদ্ধ ঘোষিত হয়েছে। …’ (আনন্দবাজার পত্রিকা ; ১৩ই মার্চ, ১৯৯৫)

আমেরিকায় ‘ফাণ্ডামেন্টালিজম’ বিগত শতাব্দীতে উদ্ভূত হলেও এবং বাংলায় মৌলবাদ-মৌলবাদী কথাগুলি সম্প্রতি ব্যবহৃত হলেও, অনেকে এধরনের লক্ষণ দেখে ‘মধ্যযুগীয় মৌলবাদ’ কথাও সাধারণভাবে ব্যবহার করেন। তবে যথাসম্ভব ঐ যুগে এভাবে তাদের চিহ্নিত করা হত না। (“গুজরাট-মহারাষ্ট্র অঞ্চলের জনগণ যে মধ্যযুগীয় মৌলবাদ ও ফ্যাসিবাদের কণ্ঠে জয়মাল্য দিয়েছেন, তা সারা দেশের পক্ষে লজ্জাজনক। এর কুফলও সুদূরপ্রসারী হতে বাধ্য৷”—অনীক, ফেব্রুয়ারী-মার্চ, ১৯৯৫)

কথাগুলি ব্যবহৃত হতে হতে ব্যবহারিক ক্ষেত্রে একটি স্বাভাবিক ভাষাগত চরিত্র পেয়ে গেছে এবং ‘মৌলবাদী সংগঠন’-এর মত ‘মৌলবাদী শক্তি’-র মত কথাবার্তাও স্বাভাবিকভাবে ব্যবহৃত হচ্ছে। অর্থাৎ এটিকে একটি সামাজিক (অপ-) শক্তির মর্যাদাও দেওয়া হয়েছে। যেমন, “দেবতার বাণী শুনে চাকরি গেছে শৈলমন্দিরের পূজারীর’ (১৪/৬) শীর্ষক প্রতিবেদনটি পড়ে অত্যন্ত হতাশ হলাম। মুখে যত মত তত পথের মহান আদর্শের অনুসরণ করলেও আমাদের অধিকাংশই অত্যন্ত সন্তৰ্পণে হৃদয়ের নিভৃততম কুঠুরিতে পুষে রাখি এক আদিমতম শ্বাপদকে-ধার দিই তার দাঁতে, নখে; প্রচ্ছন্ন উস্কানী দিই মৌলবাদী শক্তিগুলিকে। তা যদি নাইই হবে তাহলে এই একবিংশ শতাব্দীর দোরগোড়ায়ও বিশ্বজুড়ে দাপাদাপি করবার মত অফুরান মনস্তাত্বিক রসদ মৌলবাদী শক্তিগুলি পায় কোথা থেকে ?…” (আনন্দবাজার পত্রিকায় অংশুমান কর-এর চিঠি; ৩রা জুলাই, ১৯৯৫। সম্পাদকের পক্ষ থেকে এই বিষয়ের চিঠিগুলির সাধারণ শিরোনাম দেওয়া হয়েছে ‘মৌলবাদের থাবা’। )

বিজ্ঞানসম্মত বস্তুবাদী ইতিহাসচর্চ্চার ‘অন্যতম বলিষ্ঠ প্ৰবক্তা’ ডঃ গৌতম নিয়োগীও তীর ইতিহাস ও সাম্প্রদায়িকতা’ (১৯৯১) গ্রন্থে ১৯৯০-এ লেখা ভূমিকায় লিখেছেন, “এই উপমহাদেশের অন্যান্য দেশেও ভারতের মতোই মৌলবাদী শক্তির যেভাবে উত্থান হচ্ছে, তা সবই ঘটছে ভারত-ইতিহাসকে অনেকাংশে সাম্প্রদায়িক ব্যাখ্যা ও বিকৃত করার ফলে।” তিনি আবার ‘সাম্প্রদায়িক মৌলবাদী’ বলে একটি কথা ব্যবহার করেছেন। (“ভারত-ইতিহাসের যে সাম্প্রদায়িক ভাষ্য হিন্দু ও মুসলমান উভয় সম্প্রদায়ের সাম্প্রদায়িক মৌলবাদীরা করে থাকেন, নির্মোহ ধৰ্মনিরপেক্ষ ও বিজ্ঞানসম্মত ইতিহাস-বিচারে, সত্য ও তথ্যনিষ্ঠার নিরিখে তা ধোপে টেকে না।” ঐ; পূঃ ৮২) এখানে স্পষ্টতঃ ধর্মীয় সম্প্রদায়গত বিভেদকে যারা অনড় অচল একটি ব্যবস্থা বলে অন্ধভাবে মনে করে তাদেরই ‘সাম্প্রদায়িক মৌলবাদী’ আখ্যা দেওয়া হয়েছে, যদিও ‘ধর্মীয় সম্প্রদায়িকতা’ কথাটিও প্রচলিত।

এই একই বইতে মানবতাবাদী বিশিষ্ট বুদ্ধিজীবী শ্ৰদ্ধেয় গৌরকিশোর ঘোষ সাক্ষাৎকার দেওয়ার সময় ‘ধর্মীয় মৌলবাদী’ কথা ব্যবহার করেছেন। (“… যারা ধর্মীয় মৌলবাদী তারা মন্দির মসজিদে ঘা পড়তে না পড়তেই যে কোন অছিলায় দেশের সংহতি, সুস্থিতি নষ্ট করে দিতে চাইবেই, দাঙ্গা-হাঙ্গামা বাধাতে চাইবেই।”—ঐ; পৃঃ ৯৯) মৌলবাদী বলতে প্রচলিত অর্থে ধর্মীয় মৌলবাদীদেরই বােঝায়, যদিও মৌলবাদ বা মৌলবাদী একটি বিশেষ মানসিকতা ও ঐ অনুযায়ী ক্রিয়াকাণ্ডকে আর যারা তা পোষণ করে ও ঐ অনুযায়ী কাজকারবার করে তাদের বোঝাতে ব্যবহার করা হচ্ছে। এখানেও শ্ৰী ঘোষ মৌলবাদের বা মৌলবাদী মানসিকতার সামগ্রিকতার মধ্যে, যারা মানুষের তৈরি করা কৃত্রিম ও প্রতিষ্ঠানিক ধর্মমতগুলিকে কেন্দ্র করে তাদের মৌলবাদী মানসিকতার প্রকাশ ঘটায় তাদের বুঝিয়েছেন।

কিন্তু সাধারণভাবে মৌলবাদ বলতে ধর্মীয় মৌলবাদ-কেই বোঝানো হয় এবং এইভাবেই তার প্রাথমিক প্রচলন। (“এটা বোঝায় সময় এসেছে যে মৌলবাদী অত্যাচারের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করতে গেলে ধর্মীয় বিশ্বাসবোধে আঘাত পড়বেই। ধর্মের বিরুদ্ধেই প্রতিবাদ করতে হবে। মৌলবাদ স্বয়ম্ভু নয়। মৌলবাদের উৎস ধর্ম; ধর্মের রীতিনীতি, অনুশাসন, বাণী, নির্দেশ প্রভৃতি ব্যতীত মৌলবাদের কোনো অস্তিত্ব থাকে না; ধর্মের দ্বারাই মৌলবাদ লালিত ও পালিত।”—-সুজিত কুমার দাশ-এর ‘ধর্মবিশ্বাস, রাষ্ট্র এবং নাগরিক অধিকার’, উৎস মানুষ; সেপ্টেম্বর, ১৯৮৮)

তবে কেউ কেউ আবার বিশেষ ধর্মের পরিচয়ে বিশেষ মৌলবাদী মানসিকতা ও ক্রিয়াকাণ্ডকে চিহ্নিত করছেন, এমন কি সংখ্যালঘু সংখ্যাগুরুর মৌলবাদ হিসেবেও বিভাজিত করছেন। (“… হিন্দু মৌলবাদের আত্মপ্রকাশ এবং বাবরি মসজিদ ধ্বংসের কার্যকারণ ব্যাখ্যা করতে গিয়ে, দূরদর্শনে রামায়ণ-মহাভারত প্রদর্শনকে কিছু বুদ্ধিজীবী যখন দায়ী করেন, অবাক হতে হয়।” এবং “সংখ্যালঘু মৌলবাদকে হিন্দুয়ানির চাপে সন্ত্রস্ত জনগোষ্ঠীর আত্মরক্ষার মনস্তত্ব হিসেবে ব্যাখ্যা করলে হিন্দু মৌলবাদের প্রসারের সুযোগ করে দেওয়া হবে।”–শৈবাল মিত্রের মনোলগ (?)-সংকলন ‘স্বৰ্গ কি হবে না কেনা,’ ১৯৯৫)

আর মৌলবাদ মৌলবাদী কথাগুলি শুধু ভারতের বাঙালীর মধ্যে বলে নয়, বাংলাভাষাতেই যে স্থান পেয়ে গেছে, তা বোঝা যায় বাংলাদেশের লেখকরাও কথাটির ব্যাপক ব্যবহার করেছেন দেখে, যথাসম্ভব বেশ আগে থেকেই। “সাম্প্রদায়িকতার পরিবর্তে ধর্মীয় রাজনীতির নতুন সংস্করণ মৌলবাদের রাজনৈতিক আক্রমণের লক্ষ্যবস্তু হিন্দু অথবা অন্য কোন সম্প্রদায় নয়। এর লক্ষ্যবস্তু হলো, বিপ্লবের শক্তিসমূহ এবং তাদের তাত্ত্বিক শিক্ষক ও রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দ।” (বদরুদ্দিন উমরের ‘বাংলাদেশে মৌলবাদ ও শ্রেণীসংগ্রামের নতুন পর্যায়’, জুলাই, ১৯৮৭এ প্রথম প্রকাশিত।)

“ধর্মের রাজনৈতিক ব্যবহার আজকের দিনে শ্রমিকশ্রেণীর বিরুদ্ধে দেশব্যাপী পুঁজিবাদ তথা সাম্রাজ্যবাদের সবচেয়ে মোক্ষম অস্ত্র। তাই স্বৈরাচার ও সাম্রাজ্যবাদবিরোধী আন্দোলন কখনও ধর্মের রাজনীতি ও মৌলবাদবিরোধী আন্দোলন থেকে পৃথক হতে পারে না।…” (বাংলাদেশ লেখক শিবির, ঢাকা কর্তৃক জুলাই, ১৯৮৮-এ প্রকাশিত ‘সাংস্কৃতিক আন্দােলন’ পুস্তিকায় মনিরুল ইসলাম-এর ‘রাষ্ট্রীয় ধর্ম ও সাম্প্রদায়িক রাজনীতি’) কিংবা “বাংলাদেশে মৌলবাদীরা ধর্মীয় গোঁড়ামি এবং ধর্ম নিরপেক্ষতার মধ্যকার বিরোধটিকে জিইয়ে রাখতে যে কোনো প্রসঙ্গকে তুলে নিতে আগ্রহী। তসলিমা নাসরিনের ইসলাম বিরোধিতা, হিন্দু প্রীতি ও ‘লজ্জা’র প্রকাশ ইস্যু হিসেবে মৌলবাদীদের কাছে খুব লোভনীয়। সিলেটের একটি ক্ষুদ্র মৌলবাদী দল তসলিমা নাসরিনের ইসুতে সিলেটে ধর্মঘট ও হরতাল ডাকে।…” (ফারুক ফয়সল-এর প্রবন্ধ ‘তর্কবিতর্ক এবং তসলিমা নাসরিন’; গোলাম মোর্তোজা ও কাজী মোস্তাফিজুর রহমান সম্পাদিত ‘প্রসঙ্গ নারীবাদ, সাম্প্রদায়িকতা ও তসলিমা নাসরিন’, ঢাকা, ১৯৯৪)

স্পষ্টতই আগেরটিকে মৌলবাদ বলতে সামগ্রিকভাবে মৌলবাদ ও মৌলবাদী মানসিকতা-ক্রিয়াকাণ্ডকেই বােঝানাে হয়েছে; পরেরটিতে বাংলাদেশের মৌলবাদী বলতে মুসলিম মৌলবাদীদেরই বােঝানো হয়েছে, যদিও ‘মুসলিম’ বিশেষণটি উহ্য রয়েছে।

(আর ‘মৌলবী’ ও ‘মৌলবাদী’ কথা দুটির মধ্যে বেশ ধ্বনিগত সাদৃশ্য রয়েছে, যদিও তাদের উৎস ও অর্থ আলাদা। ‘মৌলবী’ কথার অর্থ ইসলামী শাস্ত্ৰে পণ্ডিত মুসলিম। কিন্তু তাদের অনেকের আচরণ এমন হয়ে উঠেছে যে, মৌলবী ও মৌলবাদী প্রায় সমার্থক হয়ে যাচ্ছে এবং পাশাপাশি উল্লেখিত হচ্ছে। যেমন, ‘অন্তঃসত্ত্বাকে মাটিতে পুতে পাথর ছুড়ে মারার ফতেয়া’ : জহিরুল হক, ঢাকা, ২৭ জুলাই–মৌলবাদীরা কতটা অমানবিক, নৃশংস হতে পারে তার নতুন নজির ফের মিলল। এক দরিদ্র অন্তঃসত্ত্বা মেয়েকে অর্ধেক মাটিতে পুঁতে পাথর ছুড়ে মেরে ফেলার ফতোয় দিয়েছে বাংলাদেশের গাজিপুরের ইসলামপুর গ্রামের মৌলবীরা।…” ইত্যাদি। আজকাল, ২৮.৭.৯৫)

তসলিমা নাসরিনও ১৯৯১-এ বাংলাদেশে প্রকাশিত তার ‘নির্বাচিত কলাম’- এ (এর লেখাগুলি আরো আগে বাংলা দেশের বিভিন্ন পত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছিল।) অনেকবার কথাটি ব্যবহার করেছেন। –”মৌলবাদীরা বলে নারীর স্থান ঘরে, সে সর্বদা পর্দার ভেতরে থাকবে, তার বাইরে এসে বিজ্ঞাপন করা বারণ। …মৌলবাদীরা নারীকে উপাৰ্জনক্ষম, স্বনির্ভর ও প্রগতিশীল দেখতে চায় না। …তলিয়ে দেখলে পুঁজিবাদী ও মৌলবাদীর অন্তর্নিহিত সাযুজ্য বেশ ধরা পড়ে। পুঁজিবাদীরা নারীকে যে শৃঙ্খল পরায় তা রঙচঙে বাহারি। আর মৌলবাদীদের শৃঙ্খল সুরা কলমা পড়া, ফু দেওয়া, ফ্যাকাসে। …” (এখানে আনন্দ পাবলিশার্স প্রকাশিত ‘নির্বাচিত কলাম’- এর তৃতীয় মুদ্রণ থেকে সংগৃহীত)

অন্যদিকে এই ‘ধর্মীয় মৌলবাদীদেরই বোঝাতে নানা প্ৰবন্ধকার অন্যান্য নানা পরিভাষাও ব্যবহার করেছেন। যেমন হিন্দু ধৰ্মীয় মৌলবাদীদের জন্য ‘হিন্দু জাতীয়তাবাদী’ কথাটি। “হিন্দু জাতীয়তাবাদীদের মনে রাখা উচিত, মহাত্মা গান্ধী অথবা পণ্ডিত নেহরু এমন কোন ‘রথ’ কখনো চালাননি যাতে সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি বিনষ্ট হয়। আদবানির রথ যাত্রা সম্বন্ধে কি এই কথা বলা যায়?”–ডঃ অমলেন্দু দে-র ‘ধর্মান্ধতাকে চালানো হচ্ছে জাতীয়তার নামে’, আনন্দবাজার পত্রিকা, ২.১২.৯০। এই ‘ধর্মান্ধতা’ কথাটিও বহু জন ধর্মীয় মৌলবাদের সমর্থক হিসেবে ব্যবহার করেছেন। (সাম্প্রদায়িকতা ও মৌলবাদের বিরুদ্ধে যে সব দম্পতি লড়াই করে আসছেন, তাঁদের মধ্যে একটি প্রখ্যাত নাম, ঐতিহাসিক ও সুলেখক ডঃ অমলেন্দু দে এবং তাঁর স্ত্রী নাসিমা। ডঃ দে তাঁদের বাংলা লেখায় ১৯৯০-এর অগাষ্ট থেকে ‘মৌলবাদ-মৌলবাদী’ কথাগুলি ব্যবহার করছেন বলে জানিয়েছেন। তার আগে, ১৯৭৩ থেকে লিখতেন ‘ধর্মীয় স্বাতন্ত্র্যবোধ’, ‘সাম্প্রদায়িক স্বাতন্ত্র্যবোধ’ ‘ইসলামিকরণ’ ইত্যাদি কথা। আর বক্তৃতাদিতে ১৯৮০ সাল থেকেই মৌলবাদ-মৌলবাদী ইত্যাদি ব্যবহার করতেন। যাঁরা এ প্রসঙ্গে কাজ করছেন, তাদের অন্যতম একজনের শব্দ ব্যবহারের সংক্ষিপ্ত ইতিবৃত্ত রাখার জন্য এখানে এই ব্যক্তিগত উল্লেখ।)

‘হিন্দুত্ববাদী’ কথাটিও হিন্দুমৌলবাদীদের বোঝাতে ব্যবহৃত হয়। (“…তাঁরা মার্ক্সবাদীই হন আর হিন্দুত্ববাদী ভারতীয় জনতা পার্টিই হন, তফাৎ ধরা পড়ে কেবল বুকনিতে।।”—আবদুর রউফ-এর ‘মহারাষ্ট্রে নতুন জমানা সাম্প্রদায়িক এবং প্রাদেশিক’, আনন্দবাজার পত্রিকা, ২১শে মার্চ, ১৯৯৫)

কেউ কেউ আবার ‘হিন্দু দক্ষিণপন্থা’ কথাটি ব্যবহার করেন ‘হিন্দুমৌলাবাদের’ প্রায় সমার্থক হিসেবে। (সুভাষীরঞ্জন চক্রবর্তী অনুদিত তপন বসু প্ৰমুখের ‘খ্যাকিপ্যান্ট গেরুয়া ঝাণ্ড’, ১৯৯৩) তবে এই হিন্দু দক্ষিণপন্থা বা ধর্মীয় দক্ষিণপন্থা (Religious right) শুনলে কেমন একটা খটকা লাগে। তাহলে ‘হিন্দু বামপন্থা’ বা ‘ধর্মীয় বামপন্থা’ নামে কোন কাঁঠালের আমসত্ত্ব হয় নাকি ?

পাশাপাশি বাংলা ‘সাম্প্রদায়িকতা’ শব্দটির কিছু ভিন্নতর ব্যঞ্জনা থাকলেও অনেকে বিশেষত ‘ধর্মীয় সাম্প্রদায়িকতা’-কে ধর্মীয় মৌলবাদের কাছাকাছি একটি অর্থে প্রায়শঃই ব্যবহার করেন—এমনকি তার অর্থ আরো প্রসারিতও করেন। (“ভারতীয় রাজনীতিতে ‘সাম্প্রদায়িকতা’ এই শব্দটি আদিতে প্রধানত ধর্মীয় সম্প্রদায়ের রাজনীতি, বিশেষত হিন্দু-মুসলমান রাজনীতি বোঝাতো। বর্তমানে শব্দটির অর্থ আঞ্চলিকতাবাদ, জন্মলব্ধ বৰ্ণাশ্রমবাদ ও গোষ্ঠীবাদে সম্প্রসারিত হয়েছে।”–ডাঃ ধীরেন্দ্ৰ নাথ গঙ্গোপাধ্যায়ের প্রবন্ধ সাম্প্রদায়িকতা : মনস্তাত্ত্বিক ও সমাজতাত্ত্বিক বিশ্লেষণ’, মানবমন।)

কেউ আবার ‘সাম্প্রদায়িকতা’ কথাটিকে শুধু ধর্মীয় ক্ষেত্রে ব্যবহার করেন, মনে হয়, ধর্মীয় মৌলবাদের প্রায় সমার্থক হিসেবে। (“কোনো ব্যক্তির মনোভাবকে তখনই সাম্প্রদায়িক আখ্যা দেওয়া হয় যখন সে এক বিশেষ ধর্মীয় সম্প্রদায়ভুক্তির ভিত্তিতে অন্য এক ধর্মীয় সম্প্রদায় এবং তার অন্তর্ভুক্ত ব্যক্তিদের বিরুদ্ধাচারণ এবং ক্ষতিসাধন করতে প্ৰস্তুত থাকে। এক্ষেত্রে কোন ব্যক্তিবিশেষের ক্ষতিসাধন করার মানসিক প্রস্তুতি সেই ব্যক্তির সঙ্গে সাক্ষাৎ পরিচয় অথবা বিরুদ্ধতা থেকে সৃষ্ট নয়। ব্যক্তি বিশেষ এক্ষেত্রে গৌণ, মুখ্য হল সম্প্রদায়।”—বদরুদ্দিন উমর-এর সাম্প্রদায়িকতা’, নবপত্র প্রকাশন)

তবে এঁরা সবাই সচেতন যে ধর্মীয় সাম্প্রদায়িকতা ও ধর্মীয় মৌলবাদ–এ দুটির মধ্যে বৈশিষ্ট্যগত কিছু পার্থক্য আছে। তাই সাধারণতঃ দুটিকে ভিন্ন ভাবেই ব্যবহার করা হয়। যেমন, ‘ভারতে সাম্প্রদায়িকতার বিপদ যে ক্রমবর্ধমান, এ বিষয়ে বোধহয় বিতর্কের অবকাশ নেই। …সাম্প্রদায়িকতাকে ইন্ধন জোগায় যে ধর্মীয় মৌলবাদ, তার প্রভাবও ক্রমবর্ধমান।” (‘সাম্প্রদায়িকতা ও ধর্মীয় মৌলবাদ’ শিরোনামের মুখবন্ধ; অনীক, সেপ্টেম্বর-অক্টোবর, ১৯৯০)

অন্যদিকে রবীন্দ্রনাথ যেভাবে ‘সাম্প্রদায়িক’, ‘সাম্প্রদায়িকতা’ বা ‘ধৰ্মসম্প্রদায়’ কথাগুলি ব্যবহার করেছেন তা তখন অপ্রচলিত কিন্তু আধুনিক পরিভাষার ‘মৌলবাদী’ ও ‘মৌলবাদের’ কাছাকাছি। (“… সম্প্রদায়ের নামে ব্যক্তিগত বা বিশেষ জনগত স্বভাবের বিকৃতি মানুষের পাপবুদ্ধিকে যত প্রশ্রয় দেয় এমন বৈজ্ঞানিক ভ্রান্তিতে কিংবা বৈষয়িক বিরোধেও না। সাম্প্রদায়িক দেবতা তখন বিদ্বেষবুদ্ধির, অহংকারের, অবজ্ঞাপরতার, মুঢ়তার দৃঢ় আশ্রয় হয়ে দাঁড়ায়; শ্ৰেয়ের নামাঙ্কিত পতাকা নিয়ে অশ্রেয় জগদব্যাপী অশান্তির প্রবর্তন করে-স্বয়ং দেবত্ব অবমানিত হয়ে মানুষকে অবমানিত ও পরস্পর-ব্যবহারে আতঙ্কিত করে রাখে। আমাদের দেশে এই দুর্যোগ আমাদের শক্তি ও সৌভাগ্যের মূলে আঘাত করছে।” কিংবা “ধৰ্মসম্প্রদায়েও যেমন সমাজেও তেমনি, কোনো এক পূর্বতনকালে যে সমস্ত মত ও প্রথা প্রচলিত ছিল সেগুলি পরবর্তীকালেও আপন অধিকার ছাড়তে চায় না।”—মানুষের ধর্ম, ১৯৩৩)

অন্যদিকে ‘মৌলজীবী’ বলে একটি অদ্ভুত শব্দও ব্যবহার করেছেন কেউ কেউ। প্রচলিত ‘মৌলবাদী’ শব্দটির অভিন্ন অর্থে ব্যবহার করলেও বুৎপত্তিগত অর্থে শব্দটি একটু খটােমটােই লাগে। (“…কী হিন্দু কী মুসলিম সমস্ত রকমের মৌলজীবীরা নানান ফাঁক ফোঁকর দিয়ে এই অসুস্থ কার্যপ্রবাহটা দাপটের সঙ্গে কায়েম করে চলেছে।” ইত্যাদি। সুজিত সেন-এর ‘সাম্প্রদায়িকতা : রাবীন্দ্ৰিক অভিজ্ঞান’; ‘সাম্প্রদায়িকতা : সমস্যা ও উত্তরণী’, ১৯৯১)

কিন্তু এরই পাশাপাশি এটিও সত্য যে মৌলবাদ-মৌলবাদী কথাগুলিও কিছু ব্যতিক্রমী পদ্ধতিতেই সৃষ্টি হয়েছে। অধ্যাত্মবাদ, পুঁজিবাদ, বিবর্তনবাদ, নারীবাদ, সাম্রাজ্যবাদ, সমাজবাদ, সাম্যবাদ, গান্ধীবাদ, মতবাদ, মার্কসবাদ ইত্যাদি শব্দগুচ্ছে সব সময়েই একটি বিশেষ্য শব্দের পরে ‘বাদ’ প্ৰত্যয় যোগ করে নতুনতর তাৎপর্যের নতুন শব্দ গঠন করা হয়েছে। কিন্তু মৌলবাদে ‘মৌল’ একটি বিশেষণ। সেক্ষেত্রে ‘মূল্যবাদ’ ও ‘মূল্যবাদী’ কথাগুলি হয়তো প্রচলিত পদ্ধতিগত বিচারে সঠিক হত। তবু কোনভাবে একসময় মৌলবাদ-মৌলবাদী কথাগুলি এত ভালভাবে চালু হয়েছে যে, একে এখন পাল্টানোর প্রচেষ্টা না চালানোই ভাল। সব সময় আগেকার নিখুঁত হিসেব আর নিয়ম মেনে ভাষার বিকাশ ও নতুন শব্দের সৃষ্টি হতেই হবে এমন ‘মৌলবাদী’ ভাবনা না থাকাই মঙ্গল।

তৈরী যেভাবেই হােক না কেন মৌলবাদ-মৌলবাদী কথাগুলি এখন হরদম ব্যবহৃত হচ্ছে। নানা জনে নানা ভাবে তার প্রয়োগ করছেন, অনেক ক্ষেত্রেই একটি অস্পষ্ট বা সাধারণ ভাসা ভাসা অর্থে। তবে সবক্ষেত্রে উগ্ৰ গোড়া ধর্মান্ধ মানসিকতার সঙ্গে তাকে অবশ্যই যুক্ত করা হচ্ছে। কিন্তু আমেরিকার ফাণ্ডামেন্টালিজম-এর অন্যান্য দিকগুলি, –যেমন বিবর্তনবাদ ও কমুনিজম বিরোধিতা কিংবা হান্ধা আমোদপ্রমোদ পরিহার করা ও ধূমপান-মদ্যপান না করার মত আচার-আচরণ, তথা ভোগবাদ বিরোধিতা ইত্যাদিকে গুরুত্ব দেওয়া হয় না। ফাণ্ডামেন্টালিজম-এর ভাবগত দিকটিই গ্রহণ করা হয়েছে। তবু আমেরিকায় সৃষ্টি হওয়া ফাণ্ডামেন্টালিজম ও ফাণ্ডামেন্টালিস্টদের একটি সংক্ষিপ্ত পরিচয় এখানে রাখার চেষ্টা করা যায়।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *