৮.৩ ভাসমান (শেষ)

৮.৩ ভাসমান

নদীতে নৌকা ভাসিলে উদয়তার ছইয়ের ভিতর চুপ করিয়া বসিয়া রহিল। একটি কথাও বলিল না। একটানা কোরা টানিতে টানিতে তার স্বামী অধৈর্য হইয়া পড়িয়াছিল। আর থাকিতে না পারিয়া শেষে নিজেই কথা কহিল, ‘নিত্যর মামী, অ নিত্যর মামী, একটু তামুক নি খাওয়াইতে পারে।‘

তারা নদীবক্ষে একে অন্ত্যকে পাইয়াছে অনেকদিন পরে। কিন্তু উদয়তারার মনে কোনই উৎসাহ নাই। সে নির্লিপ্ত ভাবে কলকেতে তামাক ভরিল, মালসার আগুনে টিকা গুঁজিয়া দিল, লাল হইলে তুলিয়া হুকাটা ছইয়ের বাহিরে বাড়াইয়া দিয়া নিস্পৃহ কণ্ঠে বলিল, ‘নেউক, হুঙ্কা নেউক।‘

বনমালীর জন্য এক অব্যক্ত বেদনা তার মনে অনবরত লুটোপুটি খাইতেছে, তার স্বামী কোরা টানিতেছে আর চারিদিক দেখিতেছে। দুই পারের চাষীদের গ্রামগুলি তেমনি সবুজ। কিন্তু মালোদের পাড়াগুলি যখনই চোখে পড়িতেছে, তখনই বেদনায় বুক টনটন করিয়া উঠিতেছে। গাছগাছালি আছে, কিছু দিন আগে যেখানে যেখানে ঘর ছিল তার অনেকই এখন খালি-ভিটা। ঘাটে আগে সারি সারি নৌকা ছিল, এখন আর নাই। মাঝে মাঝে দুই একটা কেবল বাঁধা রহিয়াছে। যেখানে তারা জাল শুখাইত, এখন সেখানে গরু চরিতেছে। ঘরগুলি কোথায় লুকাইয়াছে, ভিটাগুলি নগ্ন। তার উপরে বাঁশের খুঁটির গর্ত, ভাঙা উনানের গর্ত, শিলনোড়া রাখার সিড়ি, মাটির কলসী রাখার সিড়ি আধ-ভাঙ্গা পড়িয়া আছে। উঠানে ঝরাপাতার রাশি, তুলসীমঞ্চ ভাঙ্গিয়া শত খান। প্রদীপ দেখাইবার কেউ নাই। মাঝেমাঝে দুই একটি বাড়ি এখনো আছে। তারা বড়ঘর বেচিয়া ছোটঘর তুলিয়াছে।

‘রাধানগর কিষ্টনগর মনতলা গোঁসাইপুর সবখানের দেখি একই অবস্থা?’ বলিয়া হাত বাড়াইয়া হুঁকা লইল।

 

নৌকা ঘাটে ভিড়িলে, উদয়তারা নামিতে নামিতে পাড়াটার দিকে দৃষ্টিপাত করিয়া বলিল, ‘তোমার গেরামেও ত দেখি একই অবস্থা।’

সে অনেক দিন পর স্বামীর ঘর করিতে আসিয়াছে। সুবলার বউ তখন এই ঘাটেই স্নান করিতেছে। কিন্তু সেই যে গলা-জলে নামিয়া গাঁ ডুবাইয়াছে, আর উঠিবার নামও করিতেছে না।

‘কিলা বাসন্তী, জলে কি তোরে যাদু করছে। ‘টানে’ উঠবি না? তোর সাথে একখান কথা আছিল।’

সুবলার বউ গলা-জলে থাকিয়াই ঘাড় ফিরাইল, ‘বাসন্তী আছলাম ছোটবেলা, যখন মাঘমাসে ভেউরা ভাসাইতাম। তার পরে হইলাম কার বউ, তার পরে হইলাম রাঁড়ি। মাঝখানে হইয়া গেছলাম অনন্তর মাসী। অখন আবার হইয়া গেলাম বাসন্তী।’

‘আমারও ছোটকালেই বিয়া হইছিল। এই গাওয়ে আইয়া পাইলাম তোরে। বাড়ির লগে বাড়ি—দুইজনে এক সাথে গলায়-গলায় রইছি, তখনও যেমন তুই বাসন্তী অখনও তুই আমার তেমুনই বাসন্তী। নে উঠ, কথা আছে।‘

‘তোর সাথে আমার না একখান ঝগড়া আছিল কোন সত্যিকালে, মনে কইরা দেখ। তোর সাথে কথা কওন মানা।‘

উদয়তারার মন বেদনার্ত হইয়া উঠিল। যে-মানুষের গায়ে জীবনে কোনোদিন ‘ফুলটুঙি’র ঘা পড়ে নাই, তাকে সেদিন তারা কি নিষ্ঠুর ভাবে মারিয়াছিল। আজ সে নিস্তেজ, নিম্প্রভ। ঘাড়টা কেমন সরু হইয়া গিয়াছে। গালদুটি কেমন ভাঙ্গিয়া পড়িয়াছে। মাথা-ভরতি কি লম্বা চুল ছিল। আজ সে চুলের অর্ধেকও নাই। বনমালীর মত এও যৌবন থাকিতে বুড়ি হইয়া গিয়াছে। আজ তাহাকে দেখিলেই মায়া জাগে। আজ হইলে উদয়তারা নিজের কপাল খাইয়াও তাহার গায়ে হাত তুলিতে পারিত না।

অগত্যা সে নিজেই ধীরে ধীরে গলাজল পর্যন্ত নামিল। বলিল, একদিন তোর হাতের মার খাইলে বড় ভাল হইত ভইন, বুকটা ঠাণ্ডা হইত। তোরে মাইরা যে আনল জ্বলল, সে আনল আর নিবল না। মিছা না বাসন্তী। তুই মারবি আমারে?’

‘আমি মারুম তোর শত্তুররে। নিশত্তুরী। তুই লাউয়ের কাঁটা ফুইট্যা মর, তুই শুকনা গাঙে ডুইব্য মর।‘

দুইজনের মনই হালকা হইয়া গেল।

‘অনন্তর কথা জানবার মনে লয় না?’

‘অনন্ত? ও অনন্ত। অনন্ত অখন কার কাছে থাকে?’

—অনন্ত কি এখনও তেমন ছোটটি আছে যে, কারো কাছে থাকিবে। সে কত বড় হইয়াছে। শহরে থাকিয়া এলে-বিয়ে পাশ করিয়াছে। দাদা পোনার ভার লইয়া আসিতে দেখিয়া আসিয়াছে। কত কথা বলিয়াছে। ভদ্রলোকের সঙ্গে থাকে। দেখিতেও হইয়াছে ঠিক যেন ভদ্রলোক।

—সুবলার বউ কেমন উদাস হইয়া যায় : ভদ্রলোকের সঙ্গে থাকে। ভদ্রলোকে যদি তারে যাত্রা শিখাইয়া নষ্ট করিয়া ফেলে।

—আ লো, না লো, তারা বাজারের ভদ্রলোক না, তারা পড়ালেখার ভদ্রলোক। তোর একখানা আমার একখানা কাপড় কিনিয়া দিয়াছে। আমারখানা আমার পরণে তোরখানা ঐ ‘টানে’। স্নানের শেষে একেবারে কোমরে গুঁজিয়াই বাড়ি যাইবি।

সুবলার বউ হঠাৎ আনমনা হইয়া যায়। কি ভাবিতে থাকে। কথা বলে না।

‘কি লা বাসন্তী, মনে বুঝি মানে না। আমারও মানে না। আমার ত ভইন কৃষ্ণহারা ব্রজনারীর মত অবস্থা। কিন্তু পরের পুত, তোরও পেটের না, আমারও পেটের না।’

—দূর নিশত্তুরী। আমি বুঝি তার কথা ভাবি। আমি ভাবি অন্য কথা। গত বর্ষার আগে চরটা ছিল ওই-ই খানে। তারপর এইখানে। এখন যেখানে গাঁ ডুবাইয়া আছি। পরের বছর দেখিবি এখানেও চর। গাঁ ডোবে না। এইবারে যত পারি ডুবাইয়া নেই, জন্মের মত।

বছর ঘুরিতে মালোরা সম্পূর্ণ অচল হইয়া পড়িল। নদীর তুই তীর ঘেঁষিয়া চর পড়িয়াছে। একটিমাত্র জলের রেখা অবশিষ্ট আছে। তাতে নৌকা চলে না। মেয়েরা স্নান করিতে যায়, কিন্তু গাঁ ডোবে না। উবু হইয়া মাটি খুঁড়িতে খুঁড়িতে একটা গর্তের মত করিয়াছে। তাতে একবার চিৎ হইয়া একবার উপুর হইয়া শুইলে তবে শরীর ডোবে। তাতেই কোন রকমে এপাশ ওপাশ ভিজাইয়া তারা কলসী ভরিয়া বাড়ি ফিরে। জেলেদের নৌকাণ্ডলি শুকনা ডাঙ্গায় আটকা পড়িয়া চৌচির হইয়া যাইতেছে। জলের অভাবে সেগুলি আর নদীতে ভাসে না। মালোরা তবু মাছ ধরা ছাড়ে নাই। এক কাঁধে কাঁধ-ডোলা অন্য কাঁধে ঠেলা-জাল লইয়া তারা দলে দলে হন্যে হইয়া ঘুরিয়া বেড়ায়। কোথায় ডোবা, কোথায় পুষ্করিণী, তারই সন্ধানে। গ্রামে গ্রামান্তরে ঘুরিয়া কোথাও ডোবা দেখিতে পাইলে, শ্যেন দৃষ্টিতে তাকায়। দেহ হাড্ডিসার চোখ বসিয়া গিয়াছে। সেই গর্তে-ডোবা চোখ দুইটি হইতে জিঘাংসার দৃষ্টি ঠিকরাইয়া বাহির হয়। জালের সামনাটা জলে ডুবাইয়া ঠেলা মারিয়া সামনের দিকে দেয় এক দৌড়। দুই চারিটা মৌরলা উঠে আর উঠে একপাল ব্যাঙ। ব্যাঙ গুলি লাফাইয়া পড়িয়া যায়। মাছগুলি থাকে। সেগুলি বেচিয়া কয়েক আনা পাইলে তাতে ঘরে চাউল আসে, না পাইলে আসে না। মনমোহন সারাদিন ডোবায় ডোবায় জাল ঠেলিয়াছে, কিন্তু উঠিয়াছে কেবল ব্যাঙ। মাছ উঠে নাই। চাউল না লইয়া শুধুহাতে বাড়িতে ফিরিয়া আসিয়াছে। ডোলাটা একদিকে ছুড়িয়া ফেলিয়া জালটা একটা বেড়ায় ঠেকাইয়া রাখিল। তার বুড়ি মা শুখাইয়া দড়ির মত হইয়া গিয়াছে। কয়েক বছর আগে সে বিবাহ করিয়াছিল। খাইতে না পাইয়া তার বউও শুখাইয়া যাইতেছে। তার দিকে আর তাকানো যায় না। তার বাপ দাওয়ার উপর বসিয়া তামাক টানিতেছে। মা আর বউ দুইজনেই আগাইয়া আসিয়াছিল, চাউলের পুটুলি তার সঙ্গে দেখিতে না পাইয়া, নীরবে ঘরের ভিতরে চলিয়া গেল। আজ কারো খাওয়া হইবে না। কালও হইবে কিনা তাও জানা যায় নাই। অথচ বাপ কেমন নিরুদ্বিগ্ন মনে তামাক টানিতেছে।

বাপের হাত হইতে হুকাটা লইয়া খুব জোরে জোরে কয়েকটা টান দিতেই মনমোহনও বুঝিল, না এই বেশ।

 

অনেক মালো পরিবার গ্রাম ছাড়িয়া চলিয়া গিয়াছে। যারা আগেই গিয়াছে তারা ঘরদুয়ার জিনিসপত্র নৌকাতে বোঝাই করিয়া লইয়া গিয়াছে। যারা পরে গিয়াছে তারা ঘরদুয়ার জিনিসপত্র ফেলিয়াই গিয়াছে। তারা কোথায় গেল যাহারা রহিয়া গিয়াছে তারা জানিতেও পারিল না। তার কতক গিয়াছে ধানকাটায়, কতক গিয়াছে বড়নদীর পারে। সেখানে বড় লোকেরা মাছ ধরার বড় রকমের আয়োজন করিয়াছে। মালোরা সেখানে খাইতে পাইবে আর নদীতে তাদের হইয়া মাছ ধরিয়া দিবে।

যারা দলাদলি করিয়াছিল, মাছ ধরা বন্ধ হইয়া যাওয়ায় বাজারের পালেরা তাদের দয়া করিয়া কাজ দিয়া দিল, শহর হইতে তাদের জন্য মালের বস্তা ঘাড়ে করিয়া দোকানে আনিয়া দিবে আর রোজ চার আনা করিয়া পাইবে। সেই সব বস্তা বহিতে বহিতে তাদের কোমর ভাঙ্গিয়া গিয়াছে, তারা এখন বেঁকা হইয়া পড়িয়াছে। কাজ করিতে না পারিয়া তারা এখন কেবল মরিবার অপেক্ষায় আছে।

উদয়তারার স্বামী এই দলের। সে এখন লাঠির উপর ভর না করিয়া এক পাও চলিতে পারে না। সে কেবল জীর্ণ কোটরপ্রবিষ্ট চোখ মেলিয়া উদয়তারার দিকে চাহিয়া থাকে।

সুবলার বউ এতদিন সারারাত সূতা কাটিয়া অশক্ত বাপমার আর নিজের অন্ন জোগাইয়াছে। এখন আর কেউ সূতা কিনিতে আসে না। এখন সে উদয়তারকে লইয়া ‘গাওয়ালে’ যায়। পানসুপারি আর কিছু পোড়ামাটি লইয়া সারাদিন গ্রামে গ্রামে ঘোরে, সন্ধ্যাবেল এক এক পুঁটলি ধান লইয়া মেঠো পথ বাহিয়া ঘরে ফেরে।

কিন্তু তাতে কয়েক আনা পুঁজির দরকার। যাদের তাও নাই, তারা আর কি করে, দাঁতে দাঁত চাপিয়া ভিক্ষায় বাহির হইয়া পড়ে। জয়চন্দ্রর বউ এই দলের। সে যুবতী। কয়েকদিন হয় জয়চন্দ্র মরিয়া গিয়াছে। হাতে যা ছিল পোড়াইতে খরচ হইয়া গিয়াছে। একটি শিশু বুকে দুধ টানে আরেকটা শিশু সারাদিন খাই খাই করে। সে আর কি করিবে। অনেক দূরের গ্রামে গিয়া বাড়ি বাড়ি ভিক্ষা করে। ফিরিয়া মাসে সন্ধ্যার পর। ভয় হয় পাছে ধরা পড়ে। কিন্তু ধরা যেদিন পড়িল, সেদিন তার জয় জয়কার। আরও পাঁচজনে তাকেই অনুসরণ করিয়া ভিক্ষায় বাহির হইল। যেন সে একটা পথের সন্ধান দিয়াছে। কিন্তু সে পথ বড় পিছল। অনেকে চলিতে চলিতে হোঁচট খাইয়া সেই যে পড়িল, মুখ দেখাইবার জন্য আর উঠিল না। মালোপড়া হইতে তারা একেবারে নিশ্চিহ্ন হইয়া গেল।

যারা মরিয়া গিয়াছে তারা রক্ষা পাইয়াছে। যারা বাঁচিয়া আছে তারা শুধু ভাবিতেছে, আর কতদূর। তিতাসের দিক হইতে যেন উত্তর ভাসিয়া আসে, আর বেশি দূর নহে।

 

বর্ষা আর সত্যি বেশি দূরে নাই। তিতাসে নূতন জল আসিলে উহাদের দগ্ধ হাড় একটু জুড়াইত। কিন্তু মালোরা যেন জলছাড়া হইয়া ধুঁকিতেছে। আর অপেক্ষা করার উপায় নাই। জীবন নদীতে যে ভাঁটা পড়িয়াছিল, তারই শেষ টান উপস্থিত। তিল তিল করিয়া যে প্রাণ ক্ষয় হইতেছিল, তাহা এখন একেবারেই নিঃশেষ হইয়া আসিল।

ঘরে ঘরে বিছানায় পড়িয়া তার ছটফট করিতে লাগিল। পা টিপ টিপ করিতেছে; চোখ বসিয়া গিয়াছে গাল ভাঙ্গিয়া চোয়াল উঁচু হইয়া উঠিয়াছে। পাজড় বাহির হইয়া পড়িয়াছে। যেন প্রেতের মিছিল। এই দেহ টানিয়া টানিয়াই ঘাটের দিকে যায়। যদি দক্ষিণ হইতে স্রোত আসে, নদীতে যদি মাছ উজায়। কিন্তু আসিলেই বা কি। এই হাতে তারা না পরিবে নৌকা ভাসাইতে না পারিবে জাল ফেলিতে। এমনি শীর্ণ হইয়া গিয়াছে।

এমনি শীর্ণ হইতে হইতে উদয়তারার স্বামী একদিন বলিল, ‘আর ত খাড়া থাকতে পারি না।‘ সে বিছানা লইল।

তারপর বিছানা লইল বাসন্তীর বাপ-মা দুইজনে। তারা মরিয়া গিয়া বাসন্তীকে মুক্তি দিল। আর মুক্তি দিল মোহনকে তার বাপ। কিন্তু সে এক কাণ্ড করিয়া মরিল।

‘আমি কতবার মাথা কুটলাম, গাঁও ছাইড়া যাই। আমার কথা কেউ ‘বস্তুজ্ঞান’ করল না। দেহে ক্ষমতা থাকতে নিজেও গেলাম না। অখন পড়ছি চৌদ্দ-সানকির তলায়।’ এই বলিয়া সে টলিতে টলিতে বারান্দা হইতে উঠানে পড়িয়া গেল। পড়িবার সময় মোহনের দিকে হাত বাড়াইলে, মোহন ধরে নাই। মরিবার সময় মুখটা কি বিকৃত করিয়াছিল। চোখ ছটি খোলা। মরিতেছে না যেন মোহনের দিকে চাহিয়া বিদ্রুপ করিতেছে।

সুবলার বউ নিজেও আর উঠতে পারে না। পা টিপটিপ করে। মাথা ঘোরে। চোখের সামনে দুনিয়ার রঙ আরেকরকম হইয়া যায়। সে ভাবিয়া রাখিয়াছে, সকলের যা গতি হইয়াছে আমারও তাই হইবে। তার জন্য ভাবিয়া কোন লাভ নাই। কিন্তু ঘরে জল থাকা দরকার। শেষ সময়ে কাছে জল না থাকিলে নাকি ভয়ানক কষ্ট হয়। সকলেরই যখন এক দশা, তখন তার সময়ে কে কার ঘর হইতে জল আনিয়া তার মুখে দিবে। কলসী বহিবার সামর্থ্য নাই। দুই তিনটি লোটা লইয়া ঘাটে গেল। নদীতে তখন নূতন জল আসিয়াছে। চরটা জুড়িয়া ধানক্ষেত হন হন করিতেছে। তারই পাশ দিয়া জল পড়িতেছে। হু হু স্রোত বহিতেছে। ধানক্ষেতে কত ধান। এইখানেই তাদের মাছ ধরার অগাধ জল ছিল। ধীরে ধীরে একখানা নৌকা আসিয়া ঘাটে ভিড়িল। সে নৌকায় অনন্তবালা, তার বাপ কাক, মা কাকীরা আসিয়াছে। অনন্তবালা চিনিতে পারিয়া আগাইয়া আসিল। বলিল, তারা দেশ ছাড়িয়া দিতেছে। এইখান হইতে পায়ে হাঁটিয়া শহরে গিয়া রেলগাড়িতে উঠিবে। তারা আসাম যাইবে।

সুবলার-বউ অত দুঃখের সময়েও অনন্তর কথা না তুলিয়া পারিল না। শুনিয়াছে, ছোট সময়ে এই দুইটিতে খুব ভাব ছিল। পরে উমা যেমন শিবের জন্য তপস্যা করিয়াছিল, সেও তেমনি তপস্যা করিয়া চলিয়াছিল। পথ চাহিয়া বসিয়া ছিল। মালোর ঘরের মেয়ে অত বড় হইয়াছে বলিয়া কত কথা তাকে শুনিতে হইয়াছে।

‘অনন্তর কোনো খবর পাওয়া গেল না?’

‘অনেক খবর পাওয়া গেছে’, বলিয়া সে আরম্ভ করিল। বাবুদের সঙ্গে মিলিয়া সে লোকের উপকার করিয়া ফিরিতেছে। প্রথম যখন আসিল কেউ তাকে চিনিল না। বিরামপুরের ঘাটে নৌকা লাগাইয়াছিল। বলিয়াছিল, এ গায়ের লোকের কি কষ্ট। কাদির মিয়া বলিয়াছিল আমরা চাষা। ক্ষেতের ধান ঘরে আনিয়াছি, আমাদের কোন কষ্ট নাই। কষ্টে পড়িয়াছে মালোগুষ্টি, গাঙ শুকাইয়া যাওয়াতে। কিন্তু কেউ তাকে চিনিল না। চিনিল কেবল রমুর মা! আগাইয়া আসিয়া বলিল : বা’জি, তোমারে আমি চিনি। তোমার নাম অনন্ত। বনমালীর নৌকাতে তুমি ছোটবেলা এখানে আসিয়াছিলে। আমার রমুর সঙ্গে খেলা করিয়াছিলে। বাড়িতে আস। বাড়িতে নিয়া তাকে যত্ন করিয়া খাওয়াইল। সেইদিনই বনমালী দাদা মরিল। মালিকের কাছে পোনামাছ বুঝাইয়া দিয়া, খালি ভার লইয়া তিতাসের পারে পারে চলিতে চলিতেই যেখানে পড়িয়া মরিল, সে কাদির মিয়ার বাড়িরই কাছে। অনেক লোক জড়ো হইয়া তাকে দেখিল। কাদির মিয়া দেখিল। অনন্তও গিয়া দেখিল। কাদির মিয়া আর থাকিতে পারিল না। এই লোক আমার কত উপকার করিয়াছে, বলিয়া ধানের গোলা খুলিয়া দিল। বাবুরা নিয়া মালোদের বিতরণ করুক। অনন্ত তার নৌকায় সেই ধান চাউল লইয়া  আমাদের গ্রামে গেল; এক রাত্রি ছিল আমাদের বাড়িতে। কত কথা সে আমার কাকার নিকট বলিয়াছে।

—সব কথা বলিল, আর একখান কথা বলিল না?

—না। সেই কথা বলার তার সময় নাই। পরের দিন আরেক গ্রামে চলিয়া গেল। তোমাদের এ গ্রামেও কিবা আসে তারা।

সুবলার বউয়ের নিকট এ সমস্তই স্বপ্ন বলিয়া মনে হইল।

এমন কি যে অনন্তবালা সামনে দাঁড়াইয়া আছে, সেও যেন একটা স্বপ্ন মাত্র। একমাত্র সত্য চরের ধানগাছগুলি। কি অজস্র ধান ফলিয়াছে। দক্ষিণের ঐ অনেক দূরের শিবনগর গী হইতে আগে ঢেউ উঠিত। সে ঢেউ থামিত আসিয়া এই মালোপাড়ার মাটিতে ঠেকিয়া। এখন সেই সুদূর হইতে সেই ঢেউই যেন রূপান্তরিত হইয়া ধানগাছের মাথাগুলির উপর দিয়া বহিয়া আসে। সেই দিকে চাহিয়া সুবলার বউ ধীরে ধীরে চোখ মুদিল।

তখন মাঘ মাস। ঢোল বাজিতেছে, কাঁসি বাজিতেছে। নারীরা গান করিতেছে। তিতাসে কি জল। সেই জলে সে ভেউরা ভাসাইল, কাড়াকড়ি করিয়া লইয়া গেল তারা দুইজনে। সুবল আর কিশোর। তারপর আসিল বসন্তকাল। পরস্তাবের এক অজানা নারী উত্তরের খলাতে দোলউৎসবে নাচিতে গিয়া এক অজানা পুরুষকে দেখিয়া ভুলিল। হইল অনন্তর জন্ম। আর আজ এক অনন্তবালা তপস্যা করিতে করিতে শুখাইয়া গিয়াছে। সে কি আসিবে না! সে আসিল। এক কায়স্থের কন্যা এলে-বিয়ে পড়িবার সময় তাকে ভুলাইয়াছিল। পরে তার মা জানিতে পারিয়া বলিয়াছিল, অনন্ত ছেলেটি দেখিতে বেশ, পড়াশোনায় পণ্ডিত। কিন্তু ওতো জেলের ছেলে, তোর সঙ্গে তার কি। সেই কন্যা বুঝিল, বলিল, সত্যই ত তার সঙ্গে আমার কি? মনে আঘাত পাইয়া অনন্ত বাউণ্ডুলে হইল। শেষে মনে পড়িল, আমি ছোট কিসে। আমার অনন্তবালা তো আমারই পথ চাহিয়া আছে। তারপর একদিন দেখিতেছি দুখাই বাদ্যকর ঢোল আর তার ছেলে কাঁসি বাজাইতেছে। তেমনি এক তালের বাজনা। তবে দুখাইর ঢোলটা অনেক পুরানো আর তার ছেলেটা অনেক বড় হইয়া উঠিয়াছে। কিন্তু জামাইর মা হইবে কে। আবাগী মরিয়া বাঁচিয়াছে। বাঁচিয়া থাকিলে এখন না খাইয়া মরিত। ধরিতে গেলে আমারই দাবী সকলের আগে। আমি তার মা হইয়া ঘরের ছাঁইচে বসিব, সে বসিবে আমার কোলে। নারীরা তার মুখে চিনি দিবে, মুখে নিয়া সে চিনি থুথু করিয়া ফেলিয়া দিবে। নারীর উলু দিবে। তারপর সে মার কোল হইতে পালকিতে গিয়া বসিবে। কিন্তু উদয়তারাও তো মা হইতে চাহিতে পারে। ওদিকে রমুর মা রহিয়াছে। সে যদি আসিয়া বলে, আমি তাকে আর আমার রমুকে অভিন্ন দেখি। রমুর যদি মা হইতে পারি, আমি তবে তারও মা হইতে পারি। তখন এই সুবলার বউ ছাড়িয়া দিলেও, উদয়তারা তো ছাড়িয়া দিবে না। বিয়ে বাড়িতে তুমুল কাণ্ড বাঁধাইবে। দূর, একি স্বপ্ন! উদয়তারা মরিতেছে, মোহন মরিতেছে। মুখে জল দিতে হইবে। সে থাকিতে তারা তৃষ্ণ নিয়া মরিবে! জলে ঢেউ দিয়া ঘটি কয়টা ভরিল। সামনেই ধানক্ষেত। ধানগাছগুলি কোমরজলে দাঁড়াইয়া মাথা নাড়িতেছে। অত কাছে! লোটার ঢেউ সেগুলিকে গিয়া নড়াইয়া দিবে না ত! ওগুলি শত্রু। সারা গাঁয়ের মালোদের ওগুলিই তো মারিয়াছে। আবার চোখ বুজিয়া আসে।

পাড়াতে আর কেউ বাঁচিয়া নাই। কেবল দুইজন বাঁচিয়া আছে। ঘরকুয়ার কোথায় উঠিয়া গিয়াছে। একটা খালিভিটার উপর রান্না হইতেছে। একটা বড় হাঁড়িতে ভাত ভরতি। বাবুরা বিতরণ করিবে। বুড়া রামকেশব একটা মাটির সরা লইয়া টলিতে টলিতে আসিয়া দাঁড়াইতে, সরাতে ভাত তুলিয়া দিল। সুবলার বউ একটা মালসী লইয়া দাঁড়াইলে, তাকেও ভাত দিতে আসিল। সে অনন্ত। পাছে চিনিয়া ফেলে এই ভয়ে সে মুখ ফিরাইয়া নিঃশব্দে চলিয়া আসিল। কিন্তু একি স্বপ্ন! ঝপাৎ করিয়া একটা শব্দ হইল। সুবলার বউ সে শব্দে চমকিত হইয়া দেখে জলভরা লোটা তার শিথিল হাত হইতে মাটিতে পড়িয়া গিয়াছে।

 

ধানকাটা শেষ হইয়া গিয়াছে। চরে আর একটিও ধানগাছ নাই। সেখানে এখন বর্ষার সাঁতার-জল। চাহিলে কারো মনেই হইবে না যে এখানে একটা চর ছিল। জলে থই থই করিতেছে। যতদূর চোখ যায় কেবল জল। দক্ষিণের সেই সুদূর হইতে ঢেউ উঠিয়া সে ঢেউ এখন মালোপাড়ার মাটিতে আসিয়া লুটাইয়া পড়ে। কিন্তু এখন সে মালোপাড়ার কেবল মাটিই আছে। সে মালোপাড়া আর নাই। শূন্যভিটাগুলিতে গাছ-গাছড়া হইয়াছে। তাতে বাতাস লাগিয়া সে সে শব্দ হয়। এখানে পড়িয়া যারা মরিয়াছে, সেই শব্দে তারাই বুঝি বা নিশ্বাস ফেলে।

(সমাপ্ত)

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *