৮.১ ভাসমান

৮.১ ভাসমান

এই পরাজয়ের পর মালোরা একেবারেই আত্মসত্তা হারাইয়া বসিল। তাদের ব্যক্তিত্ব, বৈশিষ্ট্য, সংস্কৃতি ধীরে ধীরে সবই লোপ পাইতে লাগিল। তাদের নিজস্ব একটা সামাজিক নীতির বন্ধন ছিল, সেইটিও ক্রমে ক্রমে শ্লথ হইয়া আলগা হইয়া গেল। একসঙ্গে কোন কাজ করিতেই তারা আর তেমন জোর পাইত না। সামান্ত বিষয় নিয়া তারা পরস্পর ঝগড়া করিত। এমন কি, ঘাটে নৌকা ভিড়াইবার সময়, কে আগে ভিড়াইবে এই লইয়া মারামারি পর্যন্ত হইত। জাল ফেলিবার সময় কার আগে কে ফেলিবে এ নিয়া তীব্র প্রতিযোগিতা হইত। তারই পরিণতিতে তাদের প্রধান দুইটি দলের মধ্যে মাথা ফাটাফাটিও হইত। অথচ এর আগে এসব কোনকালেই হইত না।

তাদের ছেলেরা হুকা  ছাড়িয়া সিগারেট ধরিল। তারা আগের মত গুরুজনদিগকে মানিত না। বাপখুড়াদের প্রতি তাদের ভক্তি যেমন হ্রাস পাইল, তেমনি সহানুভূতিও কমিয় গেল। রোজগারের প্রতি তাদের মনও আর আগের মত রহিল না। তিতাসের মাছ ফুরাইয়া গেলে মালোর আগে তোড়জোড় করিয়া প্রবাসে যাইত। এখন আর যায় না।

তাদের পাড়াতে তখন যাত্রাওয়ালাদেরই আধিপত্য। তারা যখন যার বাড়িতে খুশি, গিয়া বসিত। আলাপ জমাইত। সে আলাপে শেষে মেয়েরাও যোগ দিত। ইহা মালোদের কখনো কখনো অস্বস্তিকর লাগিত; কিন্তু ইহার প্রতিবাদ করার জোর পাইত না। মেয়েদের কাছে এই সব রাজা, রাজপুত্র, সেনাপতি, বিবেক এক একটা অসাধারণ পুরুষ। মালোরা বড় ভাইয়ের বউদের ডাকে শুধু বউ বলিয়া আর এর ডাকে, বউদি বলিয়া। মেয়েরা আরও খুশি হয়। ইহারা মালোপাড়ার বউঝিদের সম্বন্ধে নিজেদের পাড়ার যুবকদের কাছে নানা রসাল গল্প বলিত। ঐসব যুবকরাও কৌতুহলের বশে তাদের সঙ্গে আসিয়া মালোদের বাড়িতে বসিত। কথা বলিত। বলিত ভাল কথাই। কিন্তু মেয়েরা যখন ঘাটে যাইত, তারা তখন সুযোগ দেখিয়া শিষ দিত কিংবা আচমকা কোনো বিচ্ছেদের গানে টান দিত। এইভাবে মালোর অন্তঃপুরের শুচিতা পর্যন্ত হারাইতে বসিল।

মালোর এ সবই দেখিত এবং ইহার ফলাফলও বুঝিতে পারিত। কিন্তু প্রতিবাদ করার জোর পাইত না। চুপ করিয়া থাকিত এবং সময়ে সময়ে নিজেরাও এই গডডালিকা প্রবাহে গাঁ ভাসাইয়া দিত। মাঝে মাঝে এ নিয়াও ঝগড়া হইত। এবাড়ির লোক ওবাড়ির লোককে খোঁটা দিত। ওবাড়ির লোক রাগিয়া বলিত, ভেন্‌ভেন্‌ করিস না ত। আগে নিজের ঘর সামলা। তারপর পরের তরকারিতে লবণ দিতে আসিস। সত্য কথাই। তার নিজের ঘরের লোককে সামলাইতে গেলে, সেখানেও রাগারাগি হইত।

শেষে মেয়েদের বিলাসিতাও খুব বাড়িয়া গেল। সুযোগ পাইয়া স্যাকরারা নানারকম গহনার নমুনা লইয়া, মনোহারী দোকানের লোকের তেল গামছা সাবান লইয়া ঘনঘন আসা যাওয়া করিতে লাগিল। রোজগারের সময় যা রোজগার করিত এইভাবে অপব্যয় হইয়া যাইত। দুর্দিনের জন্য এক পয়সাও সঞ্চয় থাকিত না। তখন তারা উপবাসে দিন কাটাইত। ছেলেমেয়েরা খাইতে না পাইয়া কাঁদিত। মেয়েরা অনেক কাণ্ড করিবে বলিয়া ভয় দেখাইত। খাইতে দিতে পারিতেছে না বলিয়া লজ্জা পাইয়া পুরুষরা চুপ করিয়া থাকিত এবং নিরুপায়ের মত কেবল একদিকে চাহিয়া থাকিয়া জোরে জোরে হুকা  টানিত।

ক্রমে মনুষ্যত্বের পর্যায় হইতে তারা অনেক নিচে নামিয়া গেল। এত নিচে নামিয়া গেল যে, শত্রু নাকের ডগায় বসিয়া শক্ৰতা করিয়া গেলেও মুখ তুলিয়া চাহিতে পারিত না। রোষকষায়িত চক্ষু ভূমির উপর নিবদ্ধ রাখিয়া এক দল থুথু মাটিতে ফেলিয়া বলিত, দূর হ কুত্তা, দূর হ কাওয়া। দিনে দিনে তারা আরও নিচে তলাইয়া গেল। শেষে এমন হইল যে, লোন কোম্পানির বাবুর বন্দুকধারী পেয়াদা লইয়া আসিয়া টাকা আদায়ের জন্য মালোদের উপর যখন অকথ্য অত্যাচার চালাইয়া যথাসর্বস্ব লইয়া গেল, তখনও তারা কিছুই বলিতে পারিল না। গ্রামের কয়েকজন উৎসাহী ধনী ব্যক্তি মালোদের জন্য এখানে শহর হইতে ঋণদান কোম্পানির একটা শাখা আনিয়াছিল। সুদ খুব কম দেখিয়া মালোরা সকলেই হুজুগে মাতিয়া টাকা ধার করিয়াছিল। সে অনেক দিনের কথা। সেই থেকে প্রতি বৎসর চক্রবৃদ্ধি হারে কেবল সুদই যোগাইয়া আসিতেছে, আসল তেমনি অটুট আছে। এখন কোম্পানি উঠিয়া যাইতেছে। আসল আদায় হওয়া দরকার। তাই তারা পেয়াদী-সঙ্গে জবরদস্ত বাবু পাঠাইয়াছে। তার নাম বিধুভুষণ পাল। গ্রামের পালেদের সঙ্গে তার আত্মীয়তা ছিল। তাদের নিকট মালোদের প্রকৃত অবস্থা জানিয়া লইয়া মালোপাড়াতে আসিয়া রুদ্রমূর্তি ধরিল। বুড়াবুড়া মালোদের দাড়ি ধরিয়া টানিয়া জলে নামাইল। চোখ ঘুরাইয়া বলিল, ‘ক’ তোর কাছে কত আছে।‘ শীতকাল। তিতাসের জলে দাঁড়াইয়া ঠক ঠক করিয়া কাঁপিতে কাঁপিতেও তাদের মুখ দিয়া মিথ্যা কথা বাহির হইত না। সর্বত্র মিথ্যা কথা বলিতে পারিলেও তিতাসের জলে নামিয়া মিথ্যা বলা তাদের পক্ষে অসম্ভব ছিল। কেউ বলিত দুই টাকা আছে; কেউ বলিত এক টাকা বার আনা আছে। কেউ বলিত কিছুই নাই। সব ছাঁকিয়া তুলিয়াও তেমন কিছুই আদায় হইল না দেখিয়া শেষে তারা ঘরের থালা ঘটি বাটি, সূতার হাঁড়ি জালের পুঁটুলি বাহির করিয়া নিয়া ঘোড়ার গাড়িতে তুলিয়া চলিয়া যাইত। এর পর পড়িয়া যাইত কান্নাকাটির ধুম। এমন যে গ্রামের সবচেয়ে বুড়া রামকেশব, যার ছেলে পাগল হইয়া মরিয়াছে, যাকে জীর্ণ দেহ টানিয়া টানিয়া প্রতিদিন নদীতে মাছ ধরায় যাইতে হয়, তাকেও তারা রেহাই দিল না। তার দাড়ি ছিল লম্বা। ধরিবার বেশি সুবিধা হওয়ায় বিধু পাল তাকেই জলে নামাইয়া পাক খাওয়াইয়াছিল সব চাইতে বেশি। কিন্তু সে কাঁদে নাই। নিজেরা কাঁদিয়া ও চোখ মুছিয়া মালোরা যখন তাকে সান্ত্বনা দিতে আসিল, সে বলিল, উপরওয়ালা ফেলিয়াছে চৌদ্দসানকির তলায়, কাঁদিয়া কি করিব।

পালেরা বাজারের দোকানি। মালোদের অনেক জিনিসপত্র বাকি দিয়া রাখিয়াছে। তাদেরও আদায় হওয়া দরকার। তাই রোরুদ্যমান মালোদের প্রবোধ দিতে আসিয়া তারা বলিল, বিধু পাল কড়া মেজাজের লোক। কিন্তু লোক ভাল। সব নিয়াছে, কিন্তু তোমাদের নৌকাণ্ডলিতে হাত দেয় নাই।

কিন্তু এ দুঃসময় বেশিদিন থাকে নাই। আবার তিতাস নদীতে মাছ পড়ে। আবার তাদের হাতে পয়সা আসে। হারানো থালা ঘটি বাটি নূতন হইয়া ফিরিয়া আসে। ঘরে ঘরে সুতাকাটার ধুম পড়ে। নূতন নূতন জাল তৈয়ার হয়।

সে জালে নানাজাতের মাছ পড়ে। মালোদের মুখে আবার হাসি ফোটে।

 

কিন্তু বৎসর ঘুরিতে সে হাসিও একদিন মিলাইয়া গেল।

এই পাড়ারই রাধাচরণ মালো কি একটা স্বপ্ন দেখিয়াছে। মালোরা তাহাই আগ্রহভরে শুনিতেছে। শুনিয়া কেউ কেউ বলিতেছে, আরে দূর বোকা, তা কি হইতে পারে। আবার কেউ কেউ শুকনা মুখে বলিল, হইতে ত পারে না। কিন্তু যদি হয়।

রাতে দেখে, রাতে ফুরাইয়া যায়। স্বপ্ন আবার কোনদিন সত্য হয় নাকি?

হয়। যশোদারাণী স্বপ্ন দেখিয়াছিল গোপাল মথুরার মোকামে চলিয়া যাইবে। গেল না? সুবলার শাশুড়ী স্বপ্ন দেখিয়াছিল, জিয়লের ক্ষেপে গিয়া সুবল নাও-চাপ পড়িয়া মরিবে। মরিল না?

আরে, সে ত স্বপ্নের কথা বলিয়াছিল সুবল মারা যাওয়ার পর। আগে ত বলিতে পারে নাই। তবেই বোঝ্‌। তুইও এসব কথা প্রকাশ করিবি এখন না, স্বপ্ন ফলিয়া যাওয়ার পরে। এখন চুপ করিয়া থাক।

কিন্তু স্বপ্নদ্রষ্টা চুপ করিল না। তার স্বপ্ন যে কেবল নিশার স্বপ্নমাত্র নয়, সে স্বপ্নের আনুমানিক অনেক কিছুই যে দিনের বেলাতে স্বচক্ষেও লক্ষ্য করিয়াছে এসব কথা খুলিয়া বলিল।

‘এতদিন আমি কিছু কইনা তোরা বিশ্বাস করবি না এর লাগি। যাত্রাবাড়ির টেক ছাড়াইয়া কুড়ুইলা খালের মুখ হইতে বেওসাতেক উজানে একটা কুড় আছে না? বাপ দাদার আমল হইতে দেখি সোত সিধা চলে। না কি! সেইদিন জাল ধইরা দেখি জালখানা উল্টাইয়া নিল। সোত ঘুইরা গেছে। এমুন আচানক কাণ্ড! তোমরা ত অখন রাতের জাল বাও না, খোঁজখবরও রাখ না। সারারাত জাল লাগাইয়া উজানভাটি ঘুরি। গাঙের অন্ধিসন্ধি ভাল কইরা জানি। কয়দিন ধইরা দেখ তাছি, গাঙের হিসাবে কেমন একটা লড়চড় হইয়া গেছে। সোত যেখানে আড়, হইয়া গেছে সিধা; যেখানে সিধা, হইয়া গেছে আড়। সেই দিন হইতে মনে বিষম ভাবনা। কি জানি কি একটা হইব। মনে শান্তি নাই, চক্ষে নিদ্রা নাই। আছে খালি ভাবনা। কাল রাইতে মড়াপোড়ার টেকে জাল পাতলাম, মাছ উঠল না; গেলাম পাঁচভিটার টেকে, মাছ নাই; গেলাম গরীবুল্লার গাছের ধারে, কিন্তু জালে-মাছে এক করতে পারলাম না। ( যেখানেই যাই, দেখি সোত মন্দা। মাছের দূরে দূরে লাফায়, জালে পড়ে না। শেষে গেলাম কুড় ইলার খালের মুখে। দেখলাম, সোত খালি লাটুমের মত ঘোরে। জাল নামাইয়া পাটাতনের উপর কাত হইলাম। চোখে ঘুম নাই। কেবল একই চিন্তা, তিতাসের কি জানি কি যেন একটা হইতাছে। কোন একসময় চোখের পাতা জোড়া লাগল টের পাইলাম না। এমন সময় দেখলাম স্বপ্ন, তিতাস শুখাইয়া গেছে। এই স্বপ্ন কি মিছা হইতে পারে। দেখলাম, যে-গাঙে বিশ-হাতি বাঁশ ডুবাইয়া তলা ছোঁয়া যায় না, সেই গাঙের মাঝখান দিয়া ছোট একটা মানুষ হাঁইট্যা চলছে। যে যে জায়গা দিয়া সে গেছে, একটু পরেই দেখলাম সেই সগল জায়গায় আর জল নাই; শুক্‌না ৷ ঠন্‌ ঠন্‌ করতাছে। বুকটা ছাৎ কইরা উঠল। হাত পাও কাপতে লাগল। নাওয়ে আমি একলা। এমুন ডর করতে লাগল যে একবার চিৎকার দিয়া উঠলাম। শেষে তিনবার রাম নাম লওয়াতে ডর কমল। এমন স্বপ্ন দেখলে নি আর ঘুম হয়। ঘুমাইলাম না।’

শ্রোতারা সমবেদন জানাইল, আহা বড় দুঃস্বপ্ন দেখিয়াছে রাধাচরণ। মাথায় তেল দিয়া স্নান কর গিয়া।

তার স্বপ্নকে স্বপ্ন বলিয়াই সকলে উড়াইয়া দিল। কেউ বিশ্বাস করিল না। কিন্তু একটা কালোছায়ার মত কৌতুহলমিশ্ৰিত আশঙ্কা তাহাদিগকে পাইয়া বসিল। কুড়াইল৷ খালের মুখ হইতে উজানের দিকে যখনই জাল ফেলিতে যায়, ভয়ে ভয়ে বাঁশ দুটিকে খাড়া করিয়া একটু বেশি করিয়া ডোবায়। আর দুরু হুরু বুকে মুহূর্ত গোণে মাটিতে ঠেকিল কি না। আর কোথায় স্রোতের কি নড়চড় হইল পই পই করিয়া খোজে। খুঁজিতে খুঁজিতে সত্যই দেখিল, হিসাবে মিলে না, কোথায় যেন গোলমাল হইয়া গিয়াছে। তারা বহুপুরুষ ধরিয়া এই নদীর সঙ্গে পরিচিত। তাদের দিনেরাতের সার্থী বলিতে এই নদী। এর মনের অলিতে-গলিতে তাদের অবাধ পথ-চলা। এর নাড়ি-নক্ষত্র তাদের নখদপণে। কাজেই স্রোতের একটুখানি আড় টিপিয়াই বুঝিতে পারে কোথায় এর ব্যাধি ঢুকিয়াছে। বুঝিতে পারে এর বুকে কাছেই কোথাও খুব বড় একটা চর ভাসিতেছে।

তাদের হিসাব ভুল হয় না।

ভাসমান চরটা একদিন মোহনের জালের খুঁটিতে ধরা পড়িয়া গেল। সেটা ছিল ভাঁটার শেষ দিন। বড় নদী তার বহু জল টানিয়া নিয়াছে। এমন সব ভাঁটাতেই নেয়। আবার জোয়ারে ফিরাইয়া দেয়। যত ইচ্ছা দিয়াও যা থাকে, তিতাস তাকে নিয়াই থমথম করে। জলগৌরব তার কোনো কালে ম্লান হয় না।

মোহনের বুক ধড়াস ধড়াস করিতে লাগিল।

সে ছোটবেলা গল্প শুনিয়াছে। কোন এক সাধু খড়ম পায়ে দিয়া এই তিতাসের বুকের উপর দিয়া হাঁটিয়া পার হইয়া যাইত। সেটা শুধু মন্ত্রবলেই সম্ভব হইয়াছিল। পাঠকের নিকট শুনিয়াছে, বিশাল যমুনা নদী, অগাধ তার জলরাশি; আর ঝড়ে বৃষ্টিতে দুর্যোগপূর্ণ রাত। বাসুদেব কৃষ্ণকে লইয়া জলে নামিল এবং খাপুর খুপুর করিয়া হাঁটিয়া পার হইয়া গেল। সেটা শুধু তারা দেবতা বলিয়াই সম্ভব হইয়াছিল।

আর এখানে দিনে-দুপুরে। চর্ম-চোখের সামনে। জালট ফেলিতেই তার বাঁশ এই মাঝগাঙেও খুচ করিয়া তলার মাটিতে ঠেকিল। নৌকাটা কাঁপিয়া উঠিল, আর কাঁপিয়া উঠিল মোহন নিজে।

মোহন বাড়িতে আসিয়া স্তব্ধ হইয়া রহিল। পাড়ার লোকের ডাকাডাকি করিলে সহসা সে রাগে ফাটিয়া পড়িল, ‘মালোগুষ্টি যাত্রা করুক, কবি করুক, নাচুক, মারামারি কামড়াকামড়ি যা মন চায় করুক। আর ভাবনা নাই। গাঙ শুখাইছে।’

‘কি কইলি, আরে মহন কি কইলি? আরে আ মন-মোহন কি কইলি?

‘কইলাম। গাঙে নাইম্যা দেখ গিয়া।’

এখান হইতে আধ মাইল দূরে যাত্রাবাড়ির টেক। নৌকা লইয়া তারা সেখানে গিয়া বাঁশ ফেলিল। এই টেক হইতে শুরু করিয়া এই অভাসিত চর উজানে কোথায় যে শেষ হইয়াছে, তার কিনারা করিতে পারিল না। যারা স্নান করিতে নামিয়াছে, তাদেরই একজন বার-পানির নেশায় পা টিপিয়া টিপিয়া একেবারে মাঝ নদীতে আসিয়াছে দেখা গেল। মাঝ নদীতে তার মোটে গলাজল। এমন আশ্চর্য ঘটনা তারা জীবনে এই প্রথম দেখিয়াছে।

বড় বড় নদীতে এক তীর ভাঙে, অপর তীরে চর পড়ে। ইহাই ধর্ম। কিন্তু তিতাসের ধর্ম তা নয়। এ নদীর কোন তীরই ভাঙে না। কাজেই তার বুকে যখন চর পড়িল, সে চর দিনে দিনে জাগিতে থাকে আয়তনে বাড়িয়া, চৌড় বুক চিতাইয়া।

বর্ষাকালে জল বাড়িয়া তিতাস কানায় কানায় পূর্ণ হইল। বর্ষা অস্তে সে জল সরিয়া যাওয়াতে সেই চর ভাসিয়া বুক চিতাইয়া দিল। কোথায় গেল এত জল, কোথায় গেল তার মাছ। তিতাসের কেবল তুই তীরের কাছে দুইটি খালের মত সরু জলরেখা প্রবাহিত রহিল, তিতাস যে এককালে একটা জলেভরা নদী ছিল তারই সাক্ষী হিসাবে।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *