৪.৩ জন্ম মৃত্যু বিবাহ

৪.৩ জন্ম মৃত্যু বিবাহ

সকালে পাগল আবার যা ছিল তাই হইয়া গেল।

অনন্তর মা রাতে চোখ বুজে নাই। সুবলার বউ, মঙ্গলার বউ, অনন্ত অকাতরে ঘুমাইতেছে। আর ঘুমাইতেছে বুড়ি। বুড়া রাতের জালে গিয়াছে, আসিতে অনেক দেরি হইবে। বেলা হইয়াছে। কিন্তু অনন্তর মার দিকে কেহই চাহিয়া থাকে নাই। তার বুক ধড়াস ধড়াস করিতে লাগিল। একখানি ধুচনিতে কয়েক খানি পিঠা তুলিয়া পরিপাটি করিয়া সাজাইল। মনে চিন্তার ঢেউ। পাগলের চোখে সারারাত ঘুম ছিল না। বারান্দায় বেড়া-দেওয়া খুপড়িতে সে ছিল। দা দিয়া মেঝের মাটি চষিয়া ফেলিয়াছে। অনন্তর মা তার সামনে গিয়া দাঁড়াইল। সে ঘাড় তুলিয়া চাহিল, দা উচাইয়া কোপ মারিতে আসিল। অনন্তর মা নড়িল না। এক হাতে ধুচনি আগাইয়া দিল আরেক হাতে তার পিঠে মাথায় স্পর্শ করিতে লাগিল। কোনো সুন্দরী যেন বনের এক জানোয়ারকে বশ করিতে যাইতেছে। পাগল তার দায়ের উদ্যত কোপ থামাইল, কিন্তু শান্ত হইল না। দায়ের ঘাড়ের দিকটা দিয়া অনন্তর মার পিঠে আঘাত করিল। অনন্তর মা ভ্ৰক্ষেপ করিল না। একটু হাসিবার চেষ্টা করিয়া একখানা পিঠা তার মুখে তুলিয়া দিল। পাগল মুখ ফিরাইয়া উঠানে নামিল, নামিয়া একদিকে দৌড় দিল।

অনন্তর মার বুক আশায় ভরিয়া উঠিল। তার পাগল হয়ত একদিন ভাল হইয়া যাইবে।

সেদিন সুবলার বৌর গলা জড়াইয়া অনন্তর মা অনেকক্ষণ কাঁদিল। কিন্তু সুবলার বৌ এ কান্নার কোনো অর্থ খুঁজিয়া পাইল না।

মাঘের শীত গিয়া ফাল্গুনের বসন্ত আসিল। পাগলের বাড়ির মন্দার গাছে প্রায়ই একটা কোকিল ডাকে। অনন্তর মা সুযোগ পাইলেই গিয়া দাঁড়ায়। তাকে এক নজর দেখিয়া আসে। কিন্তু দেখা দেয় না, চোরের মত যায়, পাছে পাগলের নিকট নিজে ধরা পড়ে। চৈত্রের শেষে বসন্ত যাই যাই করিতেছে। এমন সময় আসিল দোল পূর্ণিমা। উত্তরের শুকদেবপুরের মত এ গায়ের মালোরাও দোল করিল, হোলি-গান গাহিল। সুবলার বৌ নিজে স্নান করিল, অনন্তকে, তার মাকে স্নান করাইল। পরে অনন্তকে দিয়া বাজার হইতে আবির আনাইয়া বলিল, ‘চল দিদি উত্তরের আখড়ায় রাধামাধবেরে আবির দিতে যাই।’

রাধামাধব জ্যান্ত কেউ নয়। বিগ্রহ। তাকে আবির দিলে কি হইবে। সে তো আর পাল্টা আবির দিতে পারিবে না। চুপ করিয়া থাকিবে আর যত দেও তত আবির গ্রহণ করিবে। তবু এতে নূতনত্ব আছে। দশজন স্ত্রীলোকের মাঝে মিশিয়া একটু আনন্দ করা যাইবে। অনন্তর মা বলিল, ‘চল যাই।’

পাগলের উঠান দিয়া পথ। কোথা হইতে ছুটিয়া আসিয়া পথ আগলাইয়া দাঁড়াইল। আব্দার ধরিল, ‘আ গোপিনী, আমারে আবির দে।’

সুবলার বৌ বিরক্ত হইয়া বলিল, ‘ভারি আহ্লাদের পাগল। তারার পাগল তারা বাইন্ধা রাখতে পারে না। কয়, পরের পাগল হাততালি, আপনা পাগল বাইন্ধ রাখি। ছাইড়া দেয় কেনে? পাড়াপড়শীরে জাদ করার লাগি ’ সে কোনমতে পাশ কাটাইয়া বিপদ হইতে মুক্তি পাইল। অনন্তর মা তার পিছনে ছিল। আবেগে চঞ্চল হইয়া এক ঝাকা চুলদাড়ির উপর মুটামুঠ আবির মাখাইয়া দিল। চোখের কোণে রহস্য করিতে করিতে পাগল বলিল, ‘আমার আণবির কই হি হি হি? বলিয়া সে এক ধাক্কায় আবিরের থালা অনন্তর মার হাত হইতে মাটিতে ফেলিয়া দিয়া ঘরে গিয়া দরজা বন্ধ করিল।

সুবলার বৌ হতবুদ্ধি হইয়া বলিল, ‘একি করলা তুমি দিদি।‘

অনন্তর মা হাসিয়া বলিল, ‘আইজকার দিনে সকলে সকলেরে রাঙাইছে। পাগলেরে ত কেউ রাঙাইল না ভইন। আমি একটু রাঙাষ্টয়া দিলাম।‘

‘কেউ যদি দেখত?‘

‘ত হইলে কইতাম তারে, পাগলে আমারে পাগলিনী করছে।’

‘মস্করা রাখ দিদি। কোন দিন তোমারে ধইরা পাগলে না জানি কি কইরা বসে, আমি সেই চিন্তাই করি দিদি। কি কারণে পাগল হইছে সেই কথাখান ত তুমি জান না।’

‘জানি গো জানি, মনের মানুষ হারাইয়া পাগল হইছে।’

‘তুমি ত তার মনের মানুষ মিলাইয়া দিতে পার না।’

‘তা পারি না। তবে চেষ্টা কইরা দেখতে পারি, আমি নিজে তার মনের মানুষ হইতে পারি কিনা?’

‘বসন্তে তোমার মন উতালা করছে দিদি। তোমার অখন একজন পুরুষ মানুষ দরকার।’

অনন্তর-মা কথাটা মানিয়া নিয়া চুপ করিয়া রহিল। প্রতিবাদ করিয়া কথা বাড়াইল না। মার আঁচল ধরিয়া অনন্ত চুপ করিয়া দাঁড়াইয়া ছিল। তার দিকে ইশারা করিয়া চাপাগলায় বলিল, ‘যা-তা কইও না ভইন। পুলা রইছে, দেখ না?’

অনন্ত আমোদ পাইতেছে। রূপকথার রাজ্যের লোকের ‘মত পাগলটার চেহারা। আর তার মা ওটাকে আবির মাখাইতেছে। পাগলটা আবিরের থালা ফেলিয়া দিয়াছে। মার আতগুলি আবির নষ্ট হইয়াছে। অনন্ত নত হইয়া মাটি হইতে আবির তুলিতেছিল। সুবলার বউ তার একখানা হাতে ধরিয়া জোরে সোজা করিয়া বলিল, ছত্তোরি, যামুন রাধামাধবেরে আবির দিতে। তারে আবির দিয়া লাভ কি। আয়রে অনন্ত।’

ঘরে গিয়া সে অনন্তকে আবির মাখাইল, চুমা খাইল, বুকে চাপিয়া ধরিল, ছাড়িয়া দিয়া আবার বুকে চাপিয়া ধরিল। অনন্তর মুখখান সুন্দর, চোখ দুটি সুন্দর, শরীরখানা সুন্দর। যখন কথা বলে কথাগুলি সুন্দর। যখন কোনদিকে চাহিয়া থাকে তখন তাকে অনেক অনেক বড় মনে হয়।

‘না দিদি, মন ঠাণ্ডা কর। পুরুষ মানুষ দিয়া কি হইব। তারা বৃষ্টির পানি-ফোটা, ঝরলেই শেষ। তারা জোয়ারের জল। তিলেক মাত্র মুখ দিয়া নদীর বুক শুইন্যা নেয়। এই অনন্তই আমরার আশা ভরসা। দুইজনে এরেই মানুষ কইরা তুলি চল। এ-ই একদিন আমরার দুঃখ ঘুচাইব।‘

 

অনন্তর মা যখন সূতা কাটিতে বসে, বৈশাখের উদাস হাওয়া তখন সামনের গাছগাছালি হইতে শুকনা পাতা ঝরাইয়া লইয়া তার ঘরে আসিয়া ঢোকে। এই সময়ের দমকা হাওয়া অনেককেই চমকাইয়া দেয়। অনন্তর মার বুকের শূন্যতাটুকু তখন বেশি করিয়া তার নিজের কাছে প্রকাশ হইয়া পড়ে। কিন্তু হাওয়া উদাস হইলে কি হইবে। বড় দুরন্ত। খামক কতকগুলি ঝরাপাতা রাখিয়া দিয়া তার ঘরখানাকে নোংরা করিয়া যায়। ঝাঁটাইয়া দূর করিয়া দিয়াও উপায় নাই, সে সে করিয়া সেগুলি আবার ঘরেই ঢুকিয় পড়ে। ‘তুত্তোর মরার পাতার জালায় গেলাম।’—নিরুপায় হইয়া সে দরজা বন্ধ করিয়া দেয়। এমন সময় এক ঝাপট দমকা হাওয়ার মতই অনন্ত আসিয়া উপস্থিত হয়। আম কুড়াইতে গিয়াছিল। এ হাওয়াতে গাছের পাতা যেমন ঝরে, তেমনি আমও ঝরে। তুই হাতে যাহা পারিয়াছে, বুকের সঙ্গে চাপিয়া ধরিয়া তাহাই নিয়া আসিয়াছে। দরজা বন্ধ দেখিয়া ডাক দেয়, মা, ছুয়ার ঘুচা, দেখ, কত আম। এই ডাকে সাড়া না দিয়া পারে না। দরজা খুলিয়া তাকে ঘরে নেয়। দেখি! কত আম। তোর মাসিরে ডাক দিয়া আন। অনন্ত একদৌড়ে ছুটিয়া যায়। সে ডাকে সুবলার বৌও সাড়া না দিয়া পারে না।

 

বর্ষায় খুব কষ্টে পড়িল। অনন্তর মা খায় কি। এই সময়ে মাছ খুব পড়ে। কিন্তু তার আগেই সকলের জাল বোনা শেষ হইয়া যায়। তারপর আর কেউ সূতা কিনিতে আসে না।

সূতাকাটাতে আর হাত চলে না। বিক্রি হয় না, কাটিয়া কি লাভ! তার সংসার অচল হইয়া পড়িতেছে। পেট ভরিয়া খাইতে না পারিয়া অনন্ত দিনদিন শুখাইয়া যাইতেছে।

সুবলার বৌ মা-বাপের চোখ এড়াইয়া এক আধ ‘টুরি’ চাউল আনিয়া দেয়, দুই একটা তরিতরকারি, এক-আধটা মাছ, একটু মুন, তেল, কয়েকটা হলুদ। তাতেই বা কত চলিবে। তাও বেশি দিন দিতে পারিল না। একদিন হাতেনাতে ধরা পড়িয়া গেল। মা-বাপের সংসারে পড়িয়া আছে সে। জলের উপরে ভাসিতেছে। পা বাড়াইয়া মাটির কঠিনতা সে কোনোকালে পাইল না। সে আর কি করিবে। মা বকিল, বাপে বকিল। সকল গালমন্দ সে মুখ বুজিয়া সহিয়া লইল। তারা তাকে অনন্তর মার বাড়ি আসিতে নিষেধ করিল। সে নিষেধ মানিয়া নেওয়া ছাড়া তারও কোনো উপায় রহিল না।

অনন্তর মা কোনোদিকে চাহিয়া ভরসা দেখে না। খড়ের চাল ফুটা হইয়া গিয়াছে। রাতদিন জল ঝরে। বেড়া এখানে ওখানে ভাঙ্গিয়া গিয়াছে। হু হু করিয়া ঠাণ্ডা বাতাস ঢোকে। পরণের কাপড়খানাতে ভাল করিয়া কোমর ঢাকিতে গেলে বুক ঢাকা পড়ে না, বুক ঢাকিতে গেলে উরুদুইটির খানে খানে ফরসা চামড়া বাহির হইয়া পড়ে। যেখানটাতে জল পড়ে না, তেমন একটু জায়গা দেখিয়া অনন্তকে লইয়া  চুপ করিয়া বসিয়া থাকে। কাঁথা বালিস ভিজিতেছে লক্ষ্য করিয়া সেগুলিকে কাছে নিয়া আগলাইয়া বসে। এভাবে অনন্তর মার দিন আর কাটিতে চায় না।

 

সুবলার বৌর মতিগতি খারাপ হইয়া যাইতেছে। একদিন তার মা ইহা আবিষ্কার করিল। পশ্চিম পাড়াতে থাকে, বাঁশের ধনু মাটির গুলি লইয়া পাখি মারিয়া বেড়ায়, মাথায় বাবরি চুল, নাম তার ময়না। আঁস্তাকুড়ের পাশের ছিটুকি গাছের জঙ্গল। ময়না সেখানে একটা পাখিকে তাক করিয়াছিল। লক্ষ্যভ্রষ্ট হওয়াতে গুন গুন করিয়া গান ধরিয়াছিল, ‘টিয়া পাললাম, শালিখ পাললাম, আরও পাললাম ময়না রে। সোনামুখী দোয়েল পাললাম, আমার কথা কয় না রে।‘ সুবলার বউ আঁস্তাকুড়ে জঞ্জাল ফেলিতে গিয়া তার সঙ্গে হাসিয়া কথা কহিয়াছে। আর তার মা নিজের চোখে দেখিতে পাইয়াছে। দেখিয়া, রাগে গরগর করিতে করিতে, বুড়া বাড়ি আসিলে তাহাকে বলিয়া দিয়াছে।

দুইজনের ঝগড়া বকুনির পর সুবলার-বেয়েরও মুখ খুলিয়া গেল, ‘আমি ময়নার সাথে কথা কমু, তার সাথে পুরীর বাইর হইয়া যামু। তোমরা কি করতে পার আমার। খাইতে দিব না, খামু না, পরতে দিব না, পরুম না। কিন্তুক আমি বাইর হইয়া যামুই। তোমরার মুখে চুনকালি পড়ব, আমার কি। আমার তিন কুলে কারুর লাগি ভাবনা নাই। একলা গতর আমি লুটাইয়া দেমু, বিলাইয়া দেমু, নষ্ট কইরা দেমু, যা মনে লয় তাই করুম, তোমরা কথা কইতে পারব না। মনে কইরা দেখ কোন শিশুকালে বিয়া দিছল। মইরা গেছে। জানলাম না কিছু, বুঝলাম না কিছু। সেই অবুঝকালে ধর্মে কাঁচারাড়ি বানাইয়া থুইছে। সেই অবধি পোড়া কপাল লইয়া বনেবনে কাইন্দা ফিরি। তোমরা ত সুখে আছে। তোমরা কি বুঝ বা আমার দুঃখের গাঙ, কত গহীন। আমার বুঝি সাধ আহ্নাদ নাই। আমার বুঝি কিছুর দরকার লাগে না।‘

‘হারামজাদী পোড়ামুখী কয় কি রে, বলিয়া দীননাথ আগুন হইয়া খড়ম আনিতে গেল। পরিবার তাহাকে মানাইয়া বলিল, ‘তুমি অখন বাইর হইয়া যাও। আমার মাইয়ারে আমি সমঝামু।‘

মা সান্ত্বনার স্বরে মেয়েকে বলিল, ‘পোড়াকপালি, তুই কি দশজনের বৈঠকে তোর বাপেরে ভক্তি দেওয়াইতে চাস। তার মান ইজ্জত আছে না?’

‘আছে ত আছে। তাতে আমার কি এমন সাতবংশ উদ্ধাব পাইছে? ভাবছিলাম আমারই দুঃখের দুঃখী অনন্তর মার মত সার্থী পাইয়া, অনন্তর মত ছাইলা কোলে পাইয় সব জ্বালাযন্ত্রণা জুড়ামু। তোমরা আমারে তার কাছে যাইতে দিবা না। দিবা না যখন, আমি মানুষ ধরুম। দেখি তোমরা কদিন আমারে ঘরে বাইন্ধা রাখতে পার।’

‘অ-লো পোড়াকপালি, অখনই যা। অনন্তর মার কাছে তুই অখনই যা। তবু পুরুষ মানুষ থাইক্য মনটারে ফিরাইয়া রাখ।‘

‘মা, তুমি ত জান, আজ দুই দিন অনন্তর মার পেটে দানাপানি নাই।’

‘লইয়া যা। দুই টুরি চাউল লইয়া যা। একটা ঝাগুর মাছ আছে, লইয়া যা। আর যা যা তোর মনে লয়, লইয়া যা। অ-লো, অখনই যা।’

‘মা! অনন্তর মার কাপড়খানা ছিড়া রোঁয়া রোঁয়া হইয়া গেছে। আমার ত তিনখান কাপড়। একখান দেই?’

‘তোর ঠাকুরের কাছে জিগাইয়া পরে কমু, তুই অখন যা। না না, শুন, তোর ঠাকুরেরে জানাইবার কাম নাই। অনন্তর মারে একটা কাপড় তুই দিয়া দে।‘

সুবলার বৌয়ের পুরুষমানুষের অভাব সেই মুহুর্তেই মিটিয়া গেল।

ভাদ্রমাসে মাছের পুরা জো। এ সময় কাটা সূতার দর বাড়িয়া গেল। মাছের গুঁতায় অনেক নূতন জাল ছিন্নভিন্ন হইয়া যায়। জেলেরা দামের দিকে চায় না। মোটা চিকন মাঝারি সবরকম সূতা। তার যে-কোন দামে কিনিয়া নেয়। অনন্তর মার সকল সূতা একদিনে বিক্রি হইয়া গেল। তার একদণ্ড কথা বলার অবসর নাই। টেকো তার ঘুরিয়াই চলিয়াছে। একদিন লক্ষ্য করিয়া দেখিল, টেকোতে পাক দিতে দিতে তার গৌরবর্ণ উরুতে কালো দাগ বসিয়া গিয়াছে। এত সূতা সে কাটিয়াছে। এত সব সূতায় তারই ঘরে জাল তৈয়ার হইতে পারিত। সে জালে সারারাত মাছ ধরার পর বিহানে তার ঘরে ঝাঁকাভরা মাছ আসিত! কোঁচড়ভরা টাকা পয়সা আসিত! আর-সব লোকের বাড়িতে কত সমারোহ। তাদের পুরুষেরা কিসিম বলিয়া দেয়, নারীরা সেই অনুযায়ী সূতা। কাটে। ভাল হইলে পুরুষেরা কত সুখ্যাতি করে। পাকাইতে গিয়া, ছিঁড়িয়া গেলে, মিষ্ট কথায় কত গালি দেয়। নারীরা মুখ ভার করিয়া বলে, যে-জন ভাল সূতা কাটে তারে নিয়া আসুক। কোন্দলের পরে ভাব হইয়া ঘরখানা মধুময় হইয় উঠে। সে-সকল ঘরে পাঁচ রকমের কাজ হয়। আর তার ঘরে হয় কেবল এক রকম কাজ। সূতা কাটা।

সুবলার বৌকে পাইয়া অনন্তর মা মনের আবেগ ঢালিয়া দেয়, ‘তুমি না কইছিল ভইন আমার একজন পুরুষ চাই। হ, চাই-ইত। পুরুষ ছাড়া নারীর জীবনের কানাকড়ি দাম নাই।’

‘পুরুষ একটা ধর না।’

‘কই পাই।’

‘পাগলারে ধর।’

‘ধরতে গেছলাম। ধরা দিল না।’

‘ঠিসারা কইর না দিদি।‘

‘আমি ভইন ঠিসারা করি না। সত্য কথাই কই। পাগল। যদি আমারে হাতে ধইরা টান দেয়, আমি গিয়া তার ঘরের ঘরনী হই। আর ভাল লাগে না।’

সুবলার বউ হতবুদ্ধি হইয়া যায়, ‘অত মানুষ থাকতে এই পাগলার দিকে নজর গেল তোমার? অত যদি মন উচাটন হইয়া থাকে, জল আনতে গিয়া যারে মনে ধরে চোখের ঠার দিয়ো! ‘

‘পুরুষ কি ভইন কেবল এর-ই লাগি? পরের ঘরে চাইয়া দেখ, সংসার চালায় পুরুষে। নারী হয় তার সঙ্গের সাখী। আমার যত বিড়ম্বনা ’

‘না দিদি, তুমি পাগলের লাগি পাগলিনী হইয়া গেছ। এই পাগলেই একদিন তোমারে খাইব। আচ্ছা, সত্য কইরা কও তো দিদি, পাগলে যারে হারাইছে, সে জনা কি তুমি?’

‘পাগলে কারে কই হারাইছে, তার আমি কি জানি। আমি কেবল জানি, এক্‌লাজীবন চলে না। পাগলেরে পাইলে তারে লখ্‌ কইরা জীবন কাটাই।’

সুবলার বউ দীর্ঘনিশ্বাস ছাড়িয়া বলে, ‘আমারও দিদি সময় সময় মন অচল হইয়া পড়ে। কিন্তু আমি পতিজ্ঞা কইর রাখ্‌ছি, এই ভাবেই চালামু।‘

 

তার সঙ্গে অনন্তর মার তফাৎ আছে। ভবানীপুরে যতদিন ছিল তখন তার বুক ভরিয়া ছিল একদিকে অনন্ত, আর একদিকে শিশুর মত সরল দুই বুড়া। তিলেকের জন্যও কোনোদিন অনন্তর মার মন বিচলিত হয় নাই। মন তার বিচলিত আজকেও হয় নাই। নিজেকে শুধু সে শ্রান্ত ক্লান্ত বোধ করিতেছে। যে আলোক-স্তম্ভ লক্ষ্য করিয়া এতদিন সে পথ চলিয়াছিল আজ তার পাদদেশের অন্ধকারে দাঁড়াইয়া দেখে, তার আর এখন চলার শক্তি নাই। পাগল নিজে আসিয়া তার ভার নিক, নয় তো তাকে ঘরে ডাকিয়া নিয়া মারিয়া ফেলুক। সুবলার-বউর মধ্যে বিপ্লবী নারী বাস করে। কিন্তু অনন্তর মার মনে বাসা বাঁধিয়াছে এক সর্বনাশ৷ সাংসারিক কামনা। সে সংসারী হইতে চায়। সে আসিয়া তাহাকে লইয়া ঘর বাঁধুক। কিন্তু পাগল কি কোনোদিন কারো মনের কথা বোঝে।

সুবলার বউ একদিন বলিয়াছিল, তিন বছর আগে দুইজন বিদেশী নারীপুরুষ আসিয়াছিল। খালের পারে তার বাপকে পাইয়া তারা জিজ্ঞাসা করিয়াছিল, রামকেশবের ছেলে কিশোর কোন বাড়িতে থাকে। আমাদিগকে সেই বাড়িতে নিয়া চল। সেই বাড়িতে আসিয়া দেখে ঘরে এক যম-কালে বুড়া আর এক শুকনা বুড়ি, আর, এক পাগল বারান্দাতে বসিয়া প্রেতকীর্তন করিতেছে। যাকে দেখিতে আসিয়াছে, তাকে দেখে না। পাগলকে চিনিতে পারিয়া তার হাত দুটি ধরিয়া বলে, ‘অ কিশোর, আমার মাইয়ারে কষ্ট লুকাইয়া রাখছ বাবা, কও।’ পাগল তখন ঠিক ভাল মানুষের মত বলে, ‘নয়া গাঙ্গের মুখে তারে ডাকাইতে লইয়া গেছে।’ তারা আর তিলেক বিলম্ব করে নাই। তখনই স্টেশনে গিয়া গাড়ি ধরিয়াছিল।

তার বাপ মা যাহা জানিয়া গিয়াছে, তারপর আর কোনোদিন তারা এদিকে আসিবে না।

এক বুড়া আছে। তাকে বাপ বলিয়া ডাক দিলে মেয়ের মত তুলিয়া নিবে। বলিবে আমার ঘরের লক্ষ্মী ঘরে আসিয়াছে। কিন্তু সব কথা শুনিয়া বলিবে ডাকাতে তোমাকে নষ্ট করিয়াছে। আমার ঘরে তোমার স্থান হইবে না। পাগল যদি কোনদিন ভাল হয়, সেও বলিবে, ডাকাতে তোমারে অসতী করিয়া ছাড়িয়া দিয়াছে। তুমি যে সতী, তার কোন প্রমাণ নাই। তখন আমার অনন্তর যে কোনো উপায়ই থাকবে না। অথচ ভগবান সাক্ষী, নৌকার ভিতর হইতে তুলিয়া নিবার সময় তারা একবার মাত্র ছু ইয়াছিল। তারপর তাকে বসাইয়া নৌকা চালাইবার সময় সে ঝুপ করিয়া জলে পড়িয়া গেল। জেলের মেয়ে। নদীর পারে বাপের বাড়ি। শিশুকাল হইতে সাতারের অভ্যাস। দম বন্ধ করিয়া এক ডুবে অনেক দূর যাইতে পারে। ডাকাতেরা তাকে আর পায় নাই। নদীর কিনারাতে গিয়া সে অচৈতন্য হইয়া পড়িয়াছিল। ভাগ্যে সে আর কারে হাতে না পড়িয়া গৌরাঙ্গ আর নিত্যানন্দ দুষ্ট বুড়ার হাতে পড়িয়াছিল। তারা দুই ভাই, ছোট নৌকায় বড় নদীতে মাছ কিনিতে যাইতেছিল। সকালবেলা তীরের দিকে চাহিয়া দেখে এই অবস্থা। জ্ঞান ফিরিয়া আসিলে তারা তাকে বলিয়াছিল, তুমি কি মা কোনো বামুন কায়েতের মেয়ে। সে বলিয়াছিল না বাবা আমি জেলের মেয়ে। তারা বলিয়াছিল তোমার বাপের বাড়ী কোথায়, কি করিয়া পাঠাইব। সে বলিয়াছিল সেখানে আর পাঠাইবার কাজ নাই। তোমাদের সঙ্গে লইয়া চল। এই তার ইতিহাস।

সে কি সব থাকিতেও এই অপরিচয়ের মধ্যেই নিঃশেষ হইয়া যাইবে। কিন্তু অনন্ত! সে তার বাপকে চিনিল না, তার বাপও তাকে চিনিল না, এ যে বড় নিদারুণ। সুবলার বউ কেবল একটা দিক বুঝিয়াই নাড়াচাড়া করে। সেও বুঝিবে না অনন্তর মার কতদিক ভাবিয়া দেখিতে হয়।

একটা ধারণা কি জানি কেন তার মনে বদ্ধমূল হইয়াছে যে পাগল একদিন ভাল হইয়া যাইবে। রোজ রোজ অনন্তর মাকে দেখিতে দেখিতেই তার মাথা ঠিক হইয়া যাইবে। তাকে দেখিয়া মুগ্ধ হইবে, পরোক্ষে তার সেবা পাইয়া তার প্রতি দরদী হইয়া উঠিবে। অনন্তর মাকে ভাল করিয়া কোনোদিন সে দেখে নাই। সে নিজে বলিয়া না দিলে ও কিছুতেই চিনিতে পারিবে না। যারা চিনিতে পারিত সেই তিলক, সুবল,— তারা এখন স্বর্গে। কি ভাল মানুষ তারা ছিল। কতভাবে তার সাহায্য করিয়াছে। ওর সঙ্গে তারা কত আত্মজনার মত কাজ করিয়াছে। তারা স্বর্গ হইতে আশীৰ্বাদ করুক, পাগল যেন তাকে না চিনিয়া ভালবাসিয়া ফেলে। সেই ভালবাসারই সূত্র ধরিয়া সে যেন পাগলের ঘরনী হইতে পারে একটা নতুন কাজ হইবে। লোকে নিন্দা করিবে। কিন্তু এ নিন্দ সহ করা অসাধ্য হইবে না। তা ছাড়া, দেশে দেশে একটা কথা উঠিয়াছে বিধবাদের বিবাহ দেও। পুরুষ যদি বউ মরিলে আবার বিবাহ করিতে পারে, নারী কেন স্বামী মরিলে আবার বিবাহ করিতে পারিবে না। তার স্বামী কি মরিয়াছে? হা, তার স্বামী স্মৃতির দিক দিয়া মনের দিক দিয়া এখন মরিয়া আছে। সেই দিন তার পুর্নজন্ম হইবে। সে নিজেও সব জানিয়া শুনিয়া জড়ভরত হইয়া আছে। তাও প্রায় মরিয়া থাকারই মত। সেদিন তার ও নবজন্ম হইবে। আর অনন্ত। তার কি হইবে। অনন্ত কার পরিচয়ে সংসারে মুখ দেখাইবে। সে সমস্যার ও সমাধান হইবে। তাকে একটা রূপকথা শুনাইব।—অর্থাৎ আসল কথাটাই, যা ঘটিয়াছে সেই সত্য কথাটাই তাকে শুনাইয়া রাখিব। সে তাতে আমোদই শুধু পাইবে না, মার সাহসের কথা, কষ্ট সহ করার ক্ষমতার কথা শুনিতে শুনিতে বিস্ময়ে স্তম্ভিত হইয়া যাইবে। গৌরব বোধ করিবে মার জন্য। পাগলকেও তুনিয়ার অজানা এমন সব স্মৃতিকথা শুনাইব যে, সে তার মনের গভীরে বিশ্বাসকে ঠাঁই না দিয়া পরিবে না, এই তার সেই মালাবদলের বউ। সেবায় যত্নে মুগ্ধ করিয়া, হাসিতে খুশিতে তার মন পূর্ণ করিয়া, ওর জীবনে তার অপরিহার্যতাকে কায়েম করিয়া নিয়া, একদিন সে সত্যের মূর্ত ব্যঞ্জনার মধ্যে দিয়া জানাইবে ডাকাতেরা তার কেশাগ্রও স্পর্শ করে নাই। সেই রাত্রিতেই সে নদীতে পড়িয়া সব কিছু বাঁচাইয়াছে। তার পাগল নিশ্চয়ই ভাল হইয়া উঠিবে।

 

শীতের সময়ে পাগলের অবস্থা নিদারুণ খারাপ হইয়া গেল। বাঁধিয়া রাখা যায় না। ঘরের জিনিসপত্র তো আগেই ভাঙ্গিয়াছে। এখন পরের জিনিসপত্রও ভাঙ্গিতে শুরু করিয়াছে। পথের মানুষকে ডাকিয়া আনিয়া মারে। পাগলামির এ অবস্থা বড় ভয়ানক।

তার বাপ গলা ছাড়িয়া কাঁদে। সহিতে না পারিলে মারে। মারের দরুণ দেহে জখমের অন্ত নাই।

একদিন কোথা হইতে আর এক পাগল আসিয়া জুটিল। দুই পাগলে মিলিয়া তামাক খাইল এবং অনেক হাসির কাণ্ড করিল। সে-পাগল যাইবার সময় কিশোরের জখমগুলির উপর আরও জখম করিয়া গেল। সেই হইতে কিশোরের মাথায় এক দুবুদ্ধি চাপিয়াছে। সে নিজের গায়ে নিজে জখম করিয়া চলিল। তার গায়ে এত জখম হইল যে, তার দিকে আর তাকানোই যায় না। অনন্তর মা কুলের বাধা লাজের বাধা ঠেকাইয়া কাজে নামিল। সে নিজে ঘোরাঘুরি করিয়া এক কবিরাজের কাছ হইতে গাছগাছড়ার ওষুধ আনিল। সাবানে গরমজলে ঘা ধুইয়া সে ওষুধের প্রলেপ দিল। প্রথম প্রথম তাকেও খুব মারধর করিত। শেষে শ্রান্ত হইয়া আত্মসমর্পণ করিল। লোকে দেখিল এক সুন্দরী একটা পোষা জানোয়ারকে সেবা যত্নে আবেগে দরদে ভাল করিয়া তুলিতেছে। মুখে কেউ কিছু বলিল না। অনন্তর মার বড় দয়ার শরীর, এই সুমন্তব্য করিয়াই নীরব রহিল। একটা লোক মরিতে যাইতেছে, মানবতার খাতিরে এক নারী পর হইয়াও আপন জনের মত ভাল সেবা যত্নে বাঁচাইয়া তুলিতেছে, এতে দোষ নাই, ঈশ্বর সন্তুষ্ট হয়। এতে ধর্ম হয় পুণ্য হয়, আর, একজনার পুণ্যের জোরে সারা গায়ের কল্যাণ হয়—সুবলার বউ পরিচিত অপরিচিত সকল মহলে এই কথা জোর গলায় প্রচার করাতে কারও মুখ দিয়া কোন বিপরীত কথা বাহির হইল না।

শীতের শেষে পাগলের রূপ বদলাইয়া গেল। আশায় অনন্তর মার বুক ভরিয়া উঠিল। সুবলার বউ মুখে বিরক্তি প্রকাশ করিল, কয়েকটা ধারালো মন্তব্যে অনন্তর মাকে বিদ্ধ করিল। কিন্তু মন পড়িয়া রহিল কি এক দুজ্ঞেয় রহস্যকে হৃদয়ঙ্গম করার দিকে।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *