৩.২ নয়া বসত

৩.২ নয়া বসত

এ গাঁয়ে একজন নূতন বাসিন্দা আসিয়াছে, খবরটা যারাই পাইল তারাই খুশি হইল। মালোপাড়ার সবচেয়ে যে ধনী ছিল, তারই গিন্নি কালোর মা ছেলেদের বলিয়া একখানা পোড়ে ভিটি কম দামে ছাড়িয়া দিল; ছেলেমেয়েরা হৈ চৈ করিয়া তার আগাছা সাফ করিল, তারপর পাড়ার পাঁচজনে মিলিয়া তার উপর একখানা ঘর তুলিয়া দিল।

নূতন ঘরে অনন্তদিগকে রাখিয়া একদিন তুই বুড়া বিদায় হইল। বিদায় দিতে ঘাটে আসিয়া অনস্তুর মা অনেকক্ষণ আত্মসম্বরণ করিয়া ছিল। ঘাটের মেয়ের কাজ ফেলিয়া এই বিদায়দৃশ্য দেখিতেছে।

তাদের নৌকাখানা মাঝ-নদীতে পড়িয়া আগাইয়া চলিয়াছে। এতটুকু পথ গিয়াই বুঝি দুই বুড়া শ্রাস্ত হইয়া পড়িয়াছে। দাঁড় বাহিতে বাহিতে হাতের কব্জিতে তারা কি কপালের ঘাম মুছিতেছে। অনন্তর মার মনে হইল তারা ঘাম মুছিবার ছল করিয়া দুইজনেই চোখের জল মুছিতেছে।

নৌকা আরো দূরে সরিয়া যাইতেছে। আরো আরো দূরে। অনেক ছোট দেখাইতেছে নৌকাখানাকে। মানুষ দুজনকেও এবার দেখাইতেছে অনেক অনেক ছোট। যেন ছুটি শিশু—যেন চাঁদের দেশের দুটি শিশু যাত্রাগানের বুড়ার পোষাক পরিয়া নাও বাহিয়া চলিয়াছে। এ জগতের নয় তারা। কেন আসিয়াছিল—আর থাকিবে না; ক্রমেই উপরে উঠিয়া ছোট হইয়া যাইতেছে—এখনই মিলাইয়া যাইবে।

অনন্তর মা এবার কাঁদিয়া উঠিল।

হয়ত মাটিতে পড়িয়া লুটাইয়া কাঁদিত। এই সময়ে একজন কে আগাইয়া আসিয়া তাকে ধরিয়া ফেলিল।

অশ্রুভরা চোখ তুলিয়া চাহিয়া দেখে, সে তারই সমবয়সী। তারই মত সে-জনারও বিধবার বেশ।

পাড়ার কৌতুহলী নারীরা বলাবলি করে সে কে, কোন দেশে বিয়া হইয়াছিল। ছেলের বাপ কবে মরিয়াছে—ছেলে তখন পেটে, না কোলে, না হাঁটিতে শিখিয়াছে।

কালোর মা মেজাজী মানুষ। স্বামী অনেক টাকা রাখিয়া মারা গিয়াছে। ছেলেরাও রোজগারী। পাড়ার সবাই মান্য করে। বছরে তার ঘরে পাঁচ ছ মণ শণ সূতা কাটা হয়। তাতে বড় বড় জাল বোনে, সে-জালে বড় বড় মাছ ধরে। অনেক টাকা ঘরে আসে।

সেই কালোর মারও কৌতুহল হয়। সকালে একবার দেখিয়া গিয়াছে। বিকালেও দেখিতে আসিল। কথাটা কি করিয়া তোলা যায় ভাবিয়া না পাইয়া শুধু বলিল, ‘কি লামা, তোর মা-আবাগি কি আমার মত?’

‘হ মা, ঠিক তোমার মত।‘

‘আছে?’

‘জানি না ত মা?’

‘অ৷ কপাল।‘

ঘর বানাইতে হাতের সম্বল ফুরাইয়া গিয়াছে। বাকি দিন কি ভাবে কাটিবে, কালোর মা চলিয়া গেলে সে তাই ভাবিতে বসে।

কিন্তু লোকে তাকে ভাবিবার অবসর দেয় না। একটু পরেই একদল বর্ষীয়সী নারী আসিল। কালোবরণের বাড়িকে বড়বাড়ি বলে। তার বাড়ি আর এ-বাড়ির মাঝখানে একটি বাঁশের বেড়া। সেই বেড়াতে কাপড় শুখাইতে দিয়াছিল। সেখানা আনিয়া বিছাইয়া দিবে কিনা ভাবিতেছে। তার। ভাবিবার অবসর না দিয়া মাটিতেই বসিয়া পড়িল।

একজন বলিল, ‘পান আছে মা?’

আরেকজন বলিল, ‘তামুক খাওয়া। আছে নি হুঙ্কাকলকি? তামুক আছে নি?’ অনন্তর মা মাটির সঙ্গে মিশিয়া যাইতে থাকে। তার ঘরে এসবের কিছুই নাই।

একজন কোমর হইতে সুচারু কাজ-করা একটি ছোট রঙিন থলে বাহির করিয়া হাতে হাতে পান বাটিয়া দিল। অনন্তর মাকেও একটা পান লইতে হইল। সে-নারীর দাতগুলি পানে কালোবর্ণ। দুই তিনটা পান গালে পুরিয়া আঙ্গুলের ডগায় খানিকটা চুন লাগাইল। চিবানোর ফাঁকে ফাঁকে তারই খানিকটা দাঁতে লাগাইতেছে। মুখখান হইয়াছে টকটকে লাল। অনন্তর মা অবাক হইয়া তার দিকে চাহিয়া রহিল।

‘কি দেখছ, মা, অপাক হইয়া? আমি খুব বেশি বটপাত খাই না। আমি আর কত খাই! আমার শাশুড়িএ যা বটপাত খাইত!’

‘বটপাতা?’ অনন্তর মা বিস্মিত হইয়া জিজ্ঞাসা করিল।

সে-নারী সঙ্গিনীর দিকে ইঙ্গিত করাতে কথাটা সে বুঝাইয়া দিল, ‘তাইনের শ্বশুরের নাম পাণ্ডব। পান কইতে পারে না, পানেরে কয় বটপাতা।‘

—‘আর তামুক খাইত আমার শ্বশুর। মাথায় এক ঝাঁকড়া বাবরি চুল। যমদূতের মত চোউখ। আম্‌রা ডরাইতাম। সারিন্দা বাজাইত আর তামুক খাইত।‘

—“আর আমার নন্‌দের শাশুড়ি। জামাই আইলে তারে ঠকান চাই। পান সাজাইয়া কইত, ‘পান খাও রসিক জামাই কথা কও ঠারে, পানের জন্ম অইল কোন অবতারে। যদি না কইতে পার পানের জন্মকথা, ছাগল হইয়া খা ও শাওড়াগাছের পাতা!’ —খাইত কোনো জামাই পান তার সামনে?”

এসব হাসিঠাট্টার কথাতে অনন্তর মার মন বসে না। বর্ষিয়সী রঙ্গিণীরা তার মন পায় না। মনে করে এ নারী অনেক দূরের। এইত একমুঠা মেয়ে। তাকেও দলে পাইবে না! অত দেমাক!

কিন্তু অনন্ত উহাদের মুখের দিকে চাহিয়া থাকে। এরা বুঝি রূপকথার দেশের। এদের মনেমনে অনেক গল্প জমা আছে, বলিলে কোনোদিন ফুরাইবে না।

—একজন গল্পের ঝাপি খুলিল, ‘আমার শ্বশুরের অনেক কিচ্ছা আছে। তুমরি খেলা জানত। উঠানের দুই দিকে দুই উস্তাদ খাড়াইত। একজন মন্ত্র পইড়া সাপ চালান দিত, আরেকজন ময়ুর চালাইয়া সেই সল্প সংহার করত। সেই মন্ত্র না জানা থাকলে মরণ। সেইজন আবার ফিরতি আগুন চালান দিত, অন্তজন বরুণ মন্ত্রে মেঘ নামাইয়া আগুন নিভাইত। একবার কামরূপ কামিখ্যা হইতে এক উস্তাদ বাস্তানী আইল আমার শ্বশুরের লগে তুম্রি খেলতে। পরথম খেলা হইল গাওয়ের আর এক উস্তাদের লগে। বাদ্যানী সরষার মধ্যে মন্ত্র পইড়া উস্তাদের পরাণ টিপ্যা ধরল— বাদ্যানী সরষাবান্ধা গিরোর মধ্যে টিপা দেয়, আর উস্তাদের নাক দিয়া গলগল কইরা রক্ত পড়ে। উস্তাদ এর পালটা মন্ত্র জানত না। আমার শ্বশুর আছিল কাছেই। বাদ্যানীরে এক ধাক্কায় মাটিতে ফালাইয়া সরষা-বন্ধন খুইল্য উস্তাদরে বাঁচাইল। বাদ্যানী রাইগ্য৷ আগুন। কইল, বাপের বেটা হওত, এই মারলাম ভীমরুল বাণ, বাঁচাও নিজেরে। আমার শ্বশুর ধূলাবৃষ্টি বাণে সব ভীমরুলরে কানা কইরা দিল, আর পাল্ট। এমন এক বাণ মারল—বাদ্যানীর পিন্ধনের শাড়ি কেবল উপরের দিকে ওঠে, কেবল উপরের দিকে ওঠে। তুই হাতে যতই নিচের দিকে টাইন্যা রাখতে চায়, শাড়ি ততই ফরাত, কইরা গিয়া উপরে উঠে। শেষে বাদ্যানী এক দৌড়ে তার নাওএর ভিতরে গিয়া লাজ বাঁচাইল।—’

আর বলা হইল না। কালোর মা আসিয়া আসর ভাঙিয়া দিল। সূর্যের উদয়ে যেমন আঁধার সরিয়া যায়, কালোর মার আবির্ভাবে তেমনি গল্পবাজ নারীরা, বেলা বেশি নাই এই অজুহাতে সরিয়া পড়িল।

 

বেলা কালোর মারও বেশি নাই। তিন বৌ সারারাত সূতা কাটিয়া শেষরাতে শুইয়াছিল। অল্প একটু ঘুমাইতেই কালোবরণের জালে যাওয়ার সময় হইল। ভোররাতে রোজ এরা জাল লইয়া নদীতে যায়। বেচার বৌরা কি আর করে। স্বামীর পাশ হইতে উঠিয়া কেউ তামাক-টিকার ডিবা, কেউ মালসা খলুই জালের পুটলি হাতে নিয়া বাহির হইয়া পড়ে। ততক্ষণে ফরসা হইতে থাকে। পাখপাখালির ডাক শুরু হয়। কালোর মা যতদিন বাঁচিয়া আছে এই সময়ে বৌদের উঠিতেই হইবে। সকল বাড়ির বৌদের আগে কালোর বাড়ির বৌদের স্নান করিয়া আসা চাই।

তারপর পূবের আকাশ রাঙা করিয়া সূর্য উঠিলে তিনচারিট পড়ে ভিটাতে জালের ঘের দিয়া আগের দিনের মাছ শুখাইতে দেওয়া চাই। কালোর মা ততক্ষণ তরুণ রোদ গায়ে লাগাইতে লাগাইতে তিতাসের পাড়ে গিয়া বাজারের ঘাটের দিকে মুখ করিয়া দাঁড়ায়। রাতের জেলেদের মাছেভর নৌকাণ্ডলিতে বাজারের ঘাট ছাইয়া ফেলে। তার উপর শত শত বেপারি ওঠা নামা করে। সোরগোলের অন্ত থাকে না। তাদেরই একজন কালোবরণের দৃষ্টি আকর্ষণ করিয়া বলে, তোমার মা দাঁড়াইয়া আছে। মার দাঁড়াইবার ভঙ্গিটিও রাজসিক। অল্পেতেই চেখে পড়ে। কালোবরণের ভাই এক দৌড়ে একঝাকা মাছ মার হাতে দিয়া যায়। বাড়িতে আনিলে পড়ে কোটার ধূম। দুই বেলার রান্নার মাছ রাখিয়া বাকি মাছ সেই জালের তলাতে রাখিয়া আসে। সারা গায়ের কণক তখন মালোপাড়ায় ভিড় করে। এ পাড়ায় আসিলে কাকেদেরও বেহায়াপনা বাড়ে। মানুষের চোখে ধূলা দিয়া কি করিয়া এক ফাঁকে জালের ঘেরের ভিতর থেকেই শোয়ানো মাছ টানিয়া নেয়। কিন্তু কালোর মা সজাগ। চৌকি পাতিয়া কঞ্চি হাতে নিয়া বসে। কাকের কয়েকটা ছোড়াপালক দড়িতে বাঁধিয়া কঞ্চির আগাতে ঝোলায়। সেই কঞ্চি নাড়িলে কাক কাছে আসে না, কেবল দূরে থেকে কী কী করে। কয়েকটি নাতি, নাতনি আছে। ছোট ছোট টুকরিতে মুড়ি লইয়া বুড়ির কোল ঘোঁসিয়া কেউ বসে, কেউ দাঁড়ায়। যেটি হাঁটিতে পারে না, শুধু দাঁড়াইতে পারে, তার হাত ধরিয়া, অন্য হাতে কঞ্চি দোলাইয়া বুড়ি ছড়া কাটে, ‘কাউয়ার দাদী মরল, কুল দিয়া ঢাকল, দূর হ কাউয়া দূর!’

এই কালোর মার কাছে সময়ের দাম আছে। তার কাছে অনন্তর মা তো দুগ্ধপোষ্য। যারা বিনা কাজে সময় কাটাইতে আসিয়াছিল, তারা চলিয়া গেলে বলিল, ‘কামকাজ নাই কোনো?’

কাজের মধ্যে ঘাটে গিয়া এক কলসি জল আনিতে হইবে। এ ছাড়া আর কি যে করিতে হইবে ভাবিয়া পায় না অনন্তর মা। অথচ করিতে হইবে অনেক কিছু। কাজ সে করিবে। কে তাকে হাতে ধরিয়া কাজ করার সন্ধান দেখাইয়া দিবে। কালোর মা কেবল কাজের তাড়া দিতে জানে, কাজের পথ দেখাইতে জানে না।

 

কাজের পথ যে-জন দেখাইয়া গেল সে সুব্‌লার বৌ।

অল্প বয়সে বিধবা। সেদিন ঘাটে সেই তাকে ধরিয়াছিল। তার সেই সমবেদনার নিঃশ্বাস এখনো অনন্তর মার চোখে মুখে বুকে লাগিয়া আছে।

 

 

সুবলার বৌ এ কয়দিন কেবল উঁকিঝুঁকি মারিতেছিল। এক থাকিলে দেখে মুখখানা ভার; গোমরা মুখের সঙ্গে ভাব করিতে যাওয়া নিরর্থক। যখন কাছে মানুষ থাকে, তখন মানুষ বলিতে ঐ কালোর মা। মুবলার বউ এই কালোর মাকেই সহিতে পারে না।

হরিণী যেমন নিজের কস্তুরীর গন্ধ অনুভব করে, সুবলার বউয়ের আবির্ভাবও অনন্তর মা তেমনি করিয়া অনুভব করিল। জেলে রমণীর ঘরে থাকিবে কাটা আ-কাটা সূতা, এক আধখানা অসমাপ্ত জাল, আর সূতাকাটার জালবোনার নানা কিসিমের সরঞ্জাম। এই যদি না রহিল তো জেলেনীর ঘরে আর কায়স্থানীর ঘরে তফাৎ রহিল কোথায়। ঘটিবাটিগুলিও দুই দিন মাজা হয় নাই, তাও তার দৃষ্টি এড়াইল না। মনেমনে সুবলার বউ বলিল, এর আলসেমি দুইদিনেই ভাঙ্গিতে হইবে। তার মাথার চুলে দেবদুলভ অজস্রতা। সাধ হয় খুলিয়া নাড়িয়া চাড়িয়া দেখে। মুখখান মলিন। তবু সুন্দর। চিবুক ধরিয়া নাড়িয়া দিলে বেশ হইত। সুন্দর চোখ দুইটি শুভদৃষ্টির সময় কার দিকে পূর্ণ দৃষ্টিতে চাহিয়াছিল। কেমন না জানি ছিল সে জন। কিন্তু সে তো আর নাই। এও তো আমারি মত বিধবা।

‘ছাওয়ালের বাপ কবে স্বগ গে গেল দিদি ‘

‘জানি না।’

‘বলি, মারা গেছে ত?’

‘জানি না।’

‘বিয়া হইছিল কোন গাঁয়ে?’

‘জানি না।’

‘আমি কই, বিয়া একটা হইছিল ত?’

‘জানি না দিদি ৷’

সুবলার বউ না চটিয়া পারিল না, ‘পোড়া কপাল! কই, এই ছাওয়ালটা হইছে বিয়া হইয়া ত?’

মনে মনে খানিক ভাবিয়া নিয়া এবারও আগের মতই জবাব দিল, ‘জানি না ত দিদি।‘

‘খালি জানি না, জানি না, জানি না। তুমি কি দিদি কিছুই জান না!—না কি জিভে কামড় শিরে হাত, কেমনে আইল জগন্নাথ? আসমান থাইক্য হইছে বুঝি।‘

অনন্তর মা অপমানে মরিয়া যাইতে থাকে।

‘ঘরখান যেন শূদ্রাণীর মন্দির। না আছে এক বোন্দা সূতা, না আছে একখান তক্‌লি। নিজে যেমন ফুল-বামনি,—

‘সূতা পাওয়া যাইব আইজ দুপুরে। ঐ বাড়ির বউঠাকুরাইনে দিবে।’

‘ও, কালোর মা? দর কত?’

‘জানি না। ধারে দিবে।’

সুবলার বউ গম্ভীর হইয়া গেল। এইত জগৎবেড় ফেলিয়াছে। এ দিকে রাঘব-বোয়াল আছে মনের আনন্দে।

‘ভাল মানুষের হাতেই পড়ছ দিদি!’

‘দিদি তুমি কি যে কও। কি সোনার মানুষ গে দিদি। কত আদর করে আমারে আর অনন্তরে?’

সুবলার বউ মনে মনে হাসে।

‘তুমি তারে সন্দে কর কেনে?’

“সন্দে করি কেনে? আমার অন্তরে বড় জ্বালা দিয়া রাখছে। এমন জ্বালা, যা কইবার উপায় নাই, দেখাইবার সাধ্য নাই।’

‘বুঝলাম।‘

বাপের ঘরে এক নাল সূতা। কাটিতে হয় নাই। শিখিবারও সুযোগ পায় নাই কোনোদিন। দশ শের সূতা লইয়া সে অথৈ জলে পড়িল।

দুপুরের পরে সুবলার বউ কতকগুলি সূতা কাটার হাতিয়ার লইয়া হাজির হইল। সেগুলি মাটিতে নামাইয়া বলিল, ‘এই নেও বড় টাকু, মোটা স্থতার লাগি, এই নেও ছোট টাকু, চিকন সূতার। আর এই একখানা পিঁড়ি দিলাম, ঘাটে গিয়া শণের লাছি এর উপরে আছড়াইয়া ধুইয়া আনবা। তার পর রইদে শুখাইবা। রাইতে আইয়া সব শিখাইয়া দিমু।‘

অনন্তর মা’র প্রথম চেষ্টার ফল দেখিয়া সুবলার বউ হাসিয়া খুন। বলে, ‘আমার দিদি কাটুনি সূতা কাটতে পারে, একনাল সুতায় হস্তী বান্ধা পড়ে।’

দ্বিতীয় দিনের ফল দেখিয়া খুশি হইয়া বলিল, ‘এইবার কাট চিকন সূতা ছোট টাকু লইয়া।’

সাত দিনে চৌদ্দ ‘নিড়ি’ সূতা হইল। সাতটা মোটা সূতার, সাতটা সরু সূতার। মোট এক টাকা ও সরু দুই টাকা সের দরে একদিন কৈবর্ত পাড়ার লোক আসিয়া পরমাদরে কিনিয়া নিল।

সূতা বিক্রির পর কালোর মা আসিয়া বসিল, বলিল, ‘পোড়া চোখের জ্বালায় বাঁচি না। বাওচণ্ডীর মত বাইর হইয়া গেল মানুষটা কে গ মা, কে?’

‘নাম ত জানি না মা। খালি মুখ চিনা। ঐ যে সূতা। আনতে গেছলাম—‘

‘ও, চিনছি। সুবলার বউ। সুবলা নাই, তার বউ আছে। আগে ডাকত বাসন্তী। আমি ডাকতাম রামদাস্যার ভাগ নি। আমার ছোট পুতের সাথে বিয়ার কথা হইছিল, সেই বিয়া হইল গগনের পুত সুবলার সাথে। সেই সুবলা মরল। ছেমড়ি তার নামের জয়ঢাক হইয়া রইল। অখন ছোট বড় সগলেই ডাকে সুবলার-বউ।’

‘আপনের ছোট ছাওয়ালের সাথে কথাবার্তা ঠিক হইয়া গেছল বুঝি?

‘হমা। তারও আগে হওনের কথা আছিল, রামকেশবের ঘরের কিশোরের সাথে। যে কিশোর অখন পাগল হইয়া বনে বনে ফিরে।‘

 

দুপুরে মঙ্গলার বউ বাসন লইয়া ঘাটে যাইবার সময়, পাশের রাস্তা দিয়া না গিয়া, অনন্তর মার উঠান দিয়া গেল এবং ঘরের দিকে উঁকি মারিয়া দেখিল। ফিরিবার সময়েও তেমনিভাবে ঘরের দিকে চাহিতে, ঘর হইতে সুবলার বউ ডাকিয়া বলিল, ‘অ মহনের মা, আজ যে দেখি আ-ঘাটাতে চন্দ্র উদয়।’

মঙ্গলার বৌ বিরক্ত হইল। সুবলার বউ যে উহাকে দিন-রাত আগলাইয়া রাখে ইহা ভাল লাগে না। একদণ্ড একা পাইবার যো নাই।

বিরক্তি মানুষকে অনেক সময় নির্মম করিয়া তোলে। মঙ্গলার বউ একটু আগাইয়া ছাঁইচের তলায় আসিয়া এক-প বারান্দার উপরে আর এক-পা নিচে রাখিয়া ঝুঁকিয়া পড়িল। তারপর হাতের তালুতে গাল ঠেকাইয়া বলার কথাটাকে গুরুত্বপূর্ণ করিয়া তুলিল, ‘কি লা মুবলার বৌ, আজ নগরে বাজারে কি সমস্ত কথাবার্তা শুনা যাইতাছে।’

‘কি সমস্ত কথাবার্তা?’

‘দশের বিচারের মধ্যে নাকি তাঁর কথাখান ‘উদার্‌চন’ হইব।’

‘কার কথা গো, আ মহনের মা, কার কথা?’

‘ছাওয়ালের মার।‘ মঙ্গলার বের কণ্ঠে শ্লেষ।

সুবলার বউ কথা না বাড়াইয়া তার ভুল শোধরাইয়া দিল, ‘দশজনের বিচারে তার কথা উঠব কেনে গো। সে কি কে’উর ‘বাপেন ধন সাপরে’ দিয়া খাওয়াইছে, না পথের মানুষ ডাইক্য আনছে যে দশজন তার বিচার করব! ভাল কইরা না শুইন্তা তোমরার মত উপর-ভাসা আমি কোনো কথা কই না, মহনের মা।’

সুবলার বউ সত্যই এত সহজে থামিল না, রাত্রের বৈঠকের সকল কথাই সে বলিয়া রাখিল—মাতব্বরের সকলে এতদিন বাড়িতে ছিল না। কেউ গিয়াছিল উত্তরে, বেপার করিতে; কেউ গিয়াছিল উজানে ধান কিনিতে, কারো হইয়াছিল জর। এখন সব লোক গায়ে আসিয়াছে। যার শরীর ভাল ছিল না তার শরীর ভাল হইয়াছে। গাখানা লোকজনে থমথম করিতেছে। সামাজিক বৈঠক হওয়ার এইত সময়। কত কথা জমিয়া আছে। কত লোকের নামে আচার-বিচার বাকি আছে। কালীপূজা সম্বন্ধে, গাঙের মাথট সম্বন্ধে, কথা তুলিবার আছে। সব কথার শেষে অনন্তর মারও একখান কথা উঠিতে পারে—সে সমাজ করিবে কার সঙ্গে, –তোমার সঙ্গে, না আমার সঙ্গে, না কালোর মার সঙ্গে।

সুবলার বৌয়ের কথার তোড়ে মঙ্গলার বৌ ভাসিয়া গেল।

কিন্তু অনন্তর মার ভয় করিতে লাগিল। দশজনের মধ্যে কথা উঠিবে ভাবিতে বুক তুরতুর করে। নূতন গায়ে নূতন মানুষ হইয়া আসার এমন ঝক্‌মারি।

সন্ধ্যার অল্প আগে দুইটি ছেলে বাড়িবাড়ি নিমন্ত্রণ করিতে আসিল। ছেলে ফুটি পাড়ার এক প্রান্ত হইতে শুরু করিয়া প্রত্যেক বাড়িতে বলিয়া গেল, ঠাকুর সকল, ঘরে নি আছ, আমার একখান কথা। ভারতের বাড়িতে আজ দশজনের সভা। তোমরার নিমন্ত্রণ। পান তামুক খাইবা, দশজনের দশ কথা শুনবা।’

বাঁধা কথা। অনন্তর মাও বাদ পড়িল না। বিশেষত বৈঠকের সঙ্গে যার মামলা জড়ানো থাকে, ঘোষক জনগণের আহ্বান তাকে বিশেষভাবে জানাইবে ইহাই নিয়ম।

 

অনন্তর মা একা কিছুতেই যাইত না। সুবলার বউ তাকে টানিয়া বাহির করিল।

তারা যখন ভারতের বাড়ি উপস্থিত হইল, বৈঠক তখন পুরাপুরি জমিয়া গিয়াছে।

ভারতের বাড়ির উঠান খুব প্রশস্ত। চারদিকের ভিটায় বড় বড় চারিটা ঘর। মাঝখানে উঠান উঁচু। কিছুদিন আগে এ উঠান অত প্রশস্ত ছিল না। ভারতের শুঁটকির কারবার। উঠানের মাঝখানে গভীর গর্ত খুড়িয়া নয় মাস আগে শুঁটকির খাদ দিয়াছিল। এখন চড়াবাজারে সেই শুঁটকি তুলিয়া পাইকারী দরে বেচিয়া ফেলিয়াছে। খাদ ভাঙ্গিয় উঠান সমান করিয়াছে, কিন্তু গর্ত বুজানোর পরও উদ্ধৃত্ত মাটি থাকিয়া যাওয়াতে উঠানটা গরবিনীর মত বুক টান করিয়া রাখিয়াছে।

মেয়ের যেখানে রাঁধে, ধান সিদ্ধ করে, মুড়ি-চিড়া করে, মাথায় তেল দেয়, উকুন বাছিয়া দেয় পরস্পরের, সেখানটাতে একটা আবদ্ধ বেড়া। তার ভিতর থেকে তারা উঠানের সবাইকে দেখিতে পায়, উঠান হইতে কেহ তাহাদিগকে দেখিতে পায় না। সেখানে বসিয়াছে মেয়েরা।

উঠান জুড়িয়া পাল খাটানো। মাঝখানে উত্তম বিছানায় বসিয়াছে পাড়ার গণ্যমান্ত লোক কয়জন। তাদের সবাই বড়—কেউ টাকার জোরে, কেউ গায়ের জোরে ভাইয়ের জোরে, কেউ বুদ্ধির জোরে। তবে যাদের বিচারবুদ্ধি বা উপস্থিত বুদ্ধি কিংবা কথার প্যাঁচ খাটানোর প্রতিভা আছে, সকল বৈঠকেই তাদের প্রাধান্ত। এই শ্রেণীর কেউ যদি ভ্রাতৃ ও অর্থবলে বলীয়ান হয়, তার কথার উপর কথা বলার সাহস কম লোকেরই হইয়া থাকে। এমনই যে ব্যক্তিটি মাঝখানে বসিয়া আছে, তার চোখমুখের চেহারা ও বসিবার ভঙ্গি অনন্তর মা’র দৃষ্টি প্রথমেই আকর্ষণ করিল।

সুবলার বউ বুঝাইয়া দিল, ‘এইজনেরেই কয় বড়-মাতব্বর।’ কানের কাছে মুখ নিয়া বলিল, ‘নাম রামপস্‌সাদ।‘

‘শিবের মতন চোখ, মণিগোঁসাইর মতন দাড়ি, এ-জনেরে দেইখ্যা, আমার জেঠার কথা মনে পড়ে ভইন। কোন দিক দিয়া বাড়ি।‘

‘এ গাওয়ে থাকে না। কালোর বাপের সাথে বিবাদ কইরা দশবচ্ছর আগে ঘরতুয়ার লইয়া যাত্রাবাড়ি গেছে। ঘাটে গেলে তিতাসের বাকে যে মঠ দেখা যায় তারই পরে কুড়ুলিয়া খাল। খালের ঐ পারের গাওয়ের নাম যাত্রাবাড়ি। সেই গাওয়ে আর মালো নাই, খালি কৈবর্তর থাকে।‘

তাঁর পরেই যিনি দৃষ্টি আকর্ষণ করেন, তাঁর চোখমুখ দুর্বাসার মত ক্রোধারক্ত। বয়স হইলেও যুবকের মত সটান।

—বড় মাতব্বরের পরেই এজনের কথা গ্রাহ্য হয়। কায়েত পাড়ায় যাত্রার দল হয়, তাতে তিনি মুনি-ঋষির পাঠ করেন। কেীপীন পরিয়া নামাবলি গায়ে দিয়া খড়ম পায়ে তিনি যখন আসরে ঢোকেন, ভয়ে তখন কারো মুখ দিয়া কথা ফোটে না। পৈতা ধরিয়া যখন রাজাকে অভিশাপ দিবার জন্য গর্জন করিতে করিতে সামনের দিকে ঝুকিয়া পড়েন, তখন আসরের চারিপাশের গরীব লোকগুলি তো দূরের কথা, অমন যে রাজা, হাতে তলোয়ার গায়ে ঝকমক করা পোষাক, সেও থর-থর করিয়া কাঁপিতে কাঁপিতে তাঁর পায়ের কাছে নত হয়। এমন তেজ এই জনের। নাম দয়ালচাঁদ।

জানিবার ও বুঝিবার মত আরো কয়েকজন এই দলে ছিল। সময় অল্প। দুই-এক কথাতে সুবলার বৌ দুইএকজনের পরিচয় দিল। এই জনের নাম নিতাইকিশোর। ঘুষ খাইয়া পেট মোটা করিয়াছে, কিন্তু চালে এক মুঠ ছন নাই। আর এই যে কানামানুষ, তিনি লোকের বিচার করিতে গিয়া ‘শ্বশুরের বিছানায় বউ শোয়ায়, জামাইর বিছানায় শাশুড়ী শোয়ায়’, তার নাম কৃষ্ণচন্দ্র। এই ‘দেড় নিয়তির’ জন্য চক্ষুধন খাইয়াছে।

আসরের চারিধারের আর যত সব নর-নারায়ণ, তারা কেবল কথা শোনার লোক, তামাক টানার লোক। কয়েকটি ছেলে হুকাকল্কি মালসা ডিবা লইয়া বসিয়া গিয়াছে। অনবরত ছিলিম ধরাইয়া হাতে হাতে চালাইয়া দিতেছে, আর সে সব হুকা পুরানো হইয়া পর পর তাদের হাতে ফিরিয়া আসিতেছে।

একটা পরিষ্কার ঝকঝকে বড় কাঁসার থালাতে কয়েক বিড়া ধোঁয়ামোছা পান, সুচিকণ মুপারি, মাজাঘষা কয়েকখানি বাটিতে চুন ও অন্যান্য মসলা। থালাখানা হাতে করিয়া মধ্য বিছানায় নমস্কার করল ভারত, দশজন পরমেশ্বর, আমার একখান কথা। পান নি দেওয়ার সময় অইছে?’

সকলেই সম্মতিসূচক দৃষ্টিতে তাকাইল। পরে রামপ্রসাদের দৃষ্টির ইঙ্গিত পাইয়া ভারত নিজে মাতবরদিগকে পান বাটিয়া দিল। পরে পাড়ার একটি ছেলের হাতে থালাখানা তুলিয়া দিল। সে ক্ষিপ্রহস্তে এই জনারণ্যে পান বাট। শুরু করিল। কিন্তু শেষ না করিতেই বৈঠকের ‘কথা’ আরম্ভ হইয়া গেল।

দয়ালচাঁদ দুর্বাসাসুলভ ভঙ্গিতে চারিদিকে তাকাইয়া লইল। তারপর রামপ্রসাদের মুখের উপর চোখ তুলিয়া জিজ্ঞাসু হইল। রামপ্রসাদের বয়স হইয়াছে। রঙ ইষৎ তাম্রবর্ণ। যৌবনে এর সোনার কান্তি ছিল। চামড়ার বার্ধক্য ঠেলিয়া নিজেকে জাহির করিয়াছে যে মোটা হাড়গুলি তারাই প্রমাণ দেয়, যৌবনে এর শরীরে অসুরের শক্তি ছিল। চোখ ফুটিতে দেবস্থলভ আবেশ। তার মধ্যে থেকেই দৃঢ়তার ক্ষাত্রতেজ ফুটিয়া বাহির হইতেছে। স্মৃষ্টিশীল প্রতিভা যেন এখনো তার মধ্যে আত্মপ্রকাশ খুঁজিয়া ফিরিতেছে। কোন এক সত্যবস্তুর সন্ধানে সুদূরে মেলিয়। রাখিয়াছে তাহার অনন্ত প্রশ্নের জবাবনা-পাওয়া বড় বড় দুটি চোখ।

দয়ালের নীরব জিজ্ঞাসায় সে চোখ প্রথমেই পড়িল কৃষ্ণচন্দ্রের উপর, ‘কই নগরের বাপ, কথা তোল।’

অন্ধের চোখ তুলিয়া চাওয়া না চাওয়া সমান। সে চোখ নিচের দিকেই নিবিষ্ট রাখিয়া খানিক পিট পিট করিয়া লইল, তারপর ভদ্র গলায় বলিল, ‘ভারত কই রে।‘

‘কাকা, এইত আমি ইখানে?’

‘ইখানে থাকলেই সারব? ত’র বাড়িতে দশজনেরে কি জন্য ডাকাইলে ক’।‘

বক্তব্য সকলেরই জানা। ঘরের মালিক তার বাসিন্দা। কিন্তু মাটির মালিক জমিদার। জমিদারের সঙ্গে সে-বাড়ির কোনো যোগ নাই। সে থাকে তার রাজসিক ঐশ্বর্যের মধ্যে ডুবিয়া। তহসিলদার রাখে। সেই আদায়পত্র করে, আদায় না হইলে নালিশ করিয়া প্রজা উচ্ছেদ করে জমিদারের সই লইয়া, সে-ই। প্রজা উচ্ছেদ হয়, সে জায়গাতে আরেক প্রজা  আসিয়া বসে। জমিদার নিজে আসিয়া সেখানে বাড়ি বাঁধে না। বাঁধিলে অনেক জমিদারের প্রয়োজন হইত। তারা সত্য নয় বলিয়াই সংখ্যায় তার কম। মানুষের মধ্যে তারা ব্যতিক্রম। রায়তেরাই সত্য। তাই ঘুরিয়া ফিরিয়া মাটির মালিক হয় তারাই। কাগজপত্রের মালিক নয়, বাসকরার মালিক। সেইরূপ তিতাসের মালিক জেলেরা। কাগজ-পত্রের মালিক আগরতলার রাজা। মাছ ধরার মালিক মালোরা।

প্রাচীনকালে নিয়ম ছিল মালোর রাজবাড়িতে বছরে একবার দশ ভার করিয়া মাছ দিবে। নির্দিষ্ট দিনে তার দশ জনে ভারি-ভারি দশটি ভার কাঁধে তুলিয়া বাতাসে ঢেউ তুলিয়া দৌড় দিত। কৃষ্ণচন্দ্র যৌবন কালে ইহা দেখিয়াছে। কিন্তু নদীর মাছ অনিশ্চিত বস্তু। কোনো নির্দিষ্ট দিনে দশ ভার পূর্ণ করিবার মত এত মাছ ধরা নাও দিতে পারে। কৃষ্ণচন্দ্র তখন যুবক। কর্তাদের মেজাজ ঠাণ্ডা থাকা কালে সে-ই গিয়া উাদের পায়ে ধরাধরি করিয়া গ্রামের পক্ষ হইতে বড় রকমের একট। বন্দোবস্ত পাকাপাকি করিয়া আসিল। আর মাছ দিতে হইবে না। বছরে একবার করিয়া মাছের বদলে, মাথট তুলিয়া রাজ-সরকারে পৌছাইয়া দিয়া আসিলেই চলিবে। পৌছাইয়া দিবার ভারও পড়িল তারই উপরে। গত তিন বৎসরের কথা। সকলেই যার যার মাথট তার হাতে দিয়াছে। কিন্তু সম্প্রতি রাজ-পিয়াদা জানাইয়া গিয়াছে, তিন বৎসরের খাজনা বাকি পড়িয়াছে, অতঃপর আর বাকি পড়া উচিত হইবে না। এবং অবিলম্বে সেই বাকি পড়া খাজনা লইয়া রাজসরকারে এ-গায়ের মালোদের উপস্থিত হওয়া উচিত।

আজিকার সভাতে রাজদূতের সেই ভীতিপ্রদর্শনের বিষয় প্রধান আলোচ্য হইলেও সামাজিক ব্যাপারের এবং কারো কারো ব্যক্তিগত বিষয়ের অনেক কথাই আলোচনার জন্য মপেক্ষমান। কিন্তু তাহার নিজের কৃতকর্মের কথাই সকলের আগে উঠিয়া পড়ে, এই ভয়ে কৃষ্ণচন্দ্ৰ জোর করিয়া মুখে একটু হাসি টানিয়া নত মুখেই বলিল, ‘কি আর কইব! ভারতের মাইয়ারে বিয়া দিতে লাগব, তারই কথা উদার্‌চন করবার জন্য বৈঠক ডাকাইছে, কথা কি আর আমরা বুঝতে পারি না। হাঁ করতে আলজিহবার টের পাই।‘

ভারত তার আড়াই বছরের নগ্না নন্দিনীকে রোরুদ্যমান অবস্থায় একটু আগে কোল হইতে নামাইয়া আসিয়াছে। তাহারই সম্পর্কে রসিকতা উঠিয়াছে দেখিয়া সেও চটপট উত্তর দিল, ‘মাত্‌বর কাকা থাকতে আমার মাইয়ার আবার বিয়ার ভাব্‌না। কাকা রাজি হইলে এই বৈঠকেই সাতপাক ঘুরাইয়া দিতে পারি।‘

কথাটা খুব হাসির। কৃষ্ণচন্দ্র মুখনিচু করিয়াই হাসিল। কেউ কেউ সে-হাসিতে যোগ দিল; অনেকেই দিল না। যার যোগ দিল না, একটু পরে ভারত যখন মূল কথা উত্থাপন করিল, তাদের মধ্যে তখন একটা অসন্তোষের গুঞ্জন উঠিয়া মিলিয়া গেল।

আসরের চারিপাশে সর্বসাধারণের স্তরের যারা বসিয়া ছিল, তাদের মধ্যে অনবরত হুকা  চলিতে লাগিল এবং কাসির মাত্রাটাও এই সময়ে চারিদিকেই একটু বাড়িল। মনের অসন্তোষ বহিরে প্রকাশের ভাষা হয়ত ইহাদের আছে। কিন্তু প্রতিষ্ঠাহীন জীবনে সহাসের স্বভাব-সুলভ অভাবই ইহাদিগকে যুগে যুগে দাবাইয়া রাখে। তাই ইহারা আগাইয়া আসিয়া সরবে মনের আলোড়নকে ভাষা দিয়া প্রকাশ করিতে পারে না। অন্যায়ের বিরুদ্ধে প্রতিবাদের সাহস হারাইলেও অন্যায়কে এরা কোনো যুগেই হজম করিয়া নেয় না। তাই কালে কালে দেশে দেশে এরা আগাইয়া সামনে আসিতে না পারিলেও এই অব্যক্তের দল প্রতিবাদ ঠিক জানায়। কোথাও হাসিয়া, কোথাও কাদিয়া, কোথাও শিষ দিয়া। আবার কোথাও তৈজসপত্র ভাঙ্গিয়া বা দেয়ালে মাথা ঠুকিয়া ও কেরোসিন-সিক্ত বস্ত্রাঞ্চলে দেশলাইর কাঠি ধরাইয়া। গোকনঘাট গ্রামের মালোদের সাধারণ স্তরের লোকেরা মাতব্বরের অন্যায় কাজের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানাইল সেদিন হুকা  টানিবার ছলে অনেকে এক সঙ্গে কাসিয়া।

দয়ালচাঁদের মুখ দিয়া অনুচ্চ স্বরে বাহির হইল, ‘আমি হইলে তিতাসের জলে তলাইয়া গিয়া মান বাঁচাইতাম।’

‘দশের বৈঠকে লক্ষ্মণ-বর্জনের পালাখান তুমি কইর না দয়ালবেপারি। ব্রজলীলার দিনে কুরুক্ষেত্তর ঘটাইয়া লাভ নাই।‘

‘কোন ত্রেতাযুগে কি কইয়া রাখছ অখন তারে ধইয়া জল খাও। ’

নিজেদের মধ্যে ব্যাপার। তাই মাতববররা ওর বেশি কথা বাড়াইল না। কেবল রামপ্রসাদ তিরস্কার করিল, কৃষ্ণচন্দ্র, মাত্‌বরগিরির মানমজ্জাদা তুমি বুঝি আর রাখতে চাও না।”

কৃষ্ণচন্দ্র খুব লজ্জা পাইল, বলিল, ‘আর কটা দিন ক্ষেমা কর।‘

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *