১১. মুনি-ঋষিদের যৌনজীবন

মুনি-ঋষিদের যৌনজীবন

“পুত্রার্থে ক্রিয়তে ভার্যা৷” এটাই ছিল প্ৰাচীন ভারতের যৌন জীবনের সনাতন ধর্ম। নরক থেকে পূৰ্বপুরুষদের উদ্ধার করবার জন্যই পুত্র উৎপাদন করা হত। সেজন্য ধর্মশাস্ত্রকারগণ পুত্র উৎপাদনের প্ৰয়োজনীয়তার ওপর বিশেষ গুরুত্ব অৰ্পণ করেছিলেন । এটা যে সাধারণ লোকের জন্যই ব্যবস্থিত হয়েছিল, তা নয়। মুনি-ঋষিদের ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য ছিল। অগস্ত্য ও জরৎকারু মুনির কাহিনী এ সম্মন্ধে বিশেষ আলোকপাত করে । তার মানে, মাত্র সাধারণ মানুষরাই যে বিবাহ করতেন, তা নয়। মুনিঋষিরাও করতেন। ঋষিদের মধ্যে সপ্তর্ষিরাই হচ্ছেন প্রধান, কেননা তাঁরা হচ্ছেন মন্বন্তর বা যুগ প্রবর্তক । সপ্তর্ষিরা হচ্ছেন মরীচি, অত্ৰি, পুলহ, পুলস্ত্য, ক্ৰতু, অঙ্গিরা ও বশিষ্ট । এঁরা সকলেই বিবাহ করেছিলেন । এঁদের স্ত্রীদের নাম যথাক্রমে কলা, অনুসূয়া, ক্ষমা, হবিভূ, সন্নতি, শ্রদ্ধা ও অরুন্ধতী। পদ্মপুরাণ অনুযায়ী এঁরা সকলেই লোকজননী ।

মুনিঋষিরা যে মাত্র নিজ পূৰ্বপুরুষদের মঙ্গলের জন্যই বিবাহ করতেন, তা নয়। রাজারাজড়ারাও তাদের ডাকতেন। তঁদের দিয়ে নিজ নিজ স্ত্রীদের গর্ভে পুত্র উৎপাদনের জন্য ।

সাধারণ মানুষের মত মুনিঋষিদেরও যৌনবাসনা থাকত। আমরা অনেক ঊর্ধ্বরেতা মুনিঋষিদের দেখি, সুন্দরী অন্সরাদের দেখে রেতঃপাত করছেন। ( ঊর্ধ্বরেতা মানে যার বীর্য উৰ্ব্বরেতা হয়েছে, এবং যার কখনও রেতঃস্থলন হয় না ) । মাত্র পাণ্ডবরাই বহুপতিক ছিলেন না । মুনিঋষিরাও ছিলেন । গৌতমবংশীয়া জটিলা সাতটি ঋষিকে একসঙ্গে বিবাহ করেছিলেন । আবার বার্ক্ষী নামে অপর এক ঋষিকন্যা একসঙ্গে দশ ভাইকে বিবাহ করেছিলেন ।

।। দুই ।।

অগস্ত্য ও জরতকারু কাহিনী নিয়েই শুরু করা যাক । অগস্ত্য বেদের একজন মন্ত্রদ্রষ্টা ঋষি । বশিষ্টও একজন বড় ঋষি । ইনি সূর্যবংশের কুলগুরু ও কুল-পুরোহিত। আদিত্য যজ্ঞে মিত্র ও বরুণ উৰ্বশীকে দেখে যজ্ঞ কুম্ভের মধ্যে শুক্রপাত করেন। সেই কুণ্ডে পতিত শুক্র হতে অগস্ত্য ও বশিষ্টের জন্ম হয় । অগস্ত্য প্ৰতিজ্ঞা করেছিলেন যে তিনি চিরকাল অকৃতদার থাকবেন । কিন্তু একদিন ভ্ৰমণ করতে করতে দেখতে পেলেন যে তাঁর পিতৃপুরুষরা এক গুহার মধ্যে পা উপরে ও মাথা নীচের দিকে করে ঝুলছেন। তাদের জিজ্ঞাসা করে তিনি জানতে পারলেন যে বংশরক্ষা না করলে তঁদের সদগতি নেই। তখন অগস্ত্য বিবাহ করা স্থির করলেন । নিজ তপোবলে পৃথিবীর সমস্ত প্ৰাণীর সুন্দর ও শ্ৰেষ্ঠ অংশ নিয়ে তিনি এক পরমাসুন্দরী নারী সৃষ্টি করলেন। সমস্ত জীবের সৌন্দর্যের শ্রেষ্ঠ অংশ এই নারী লোপ করে নিয়েছিল বলে, এই নারীর নাম হল লোপামুদ্রা। লোপামুদ্রাকে পালন করবার ভার তিনি বিদর্ভরাজের ওপর দিলেন । মেয়েটি বড় হলে, অগস্ত্য তাকে স্ত্রীরূপে গ্রহণ করলেন। তখন তিনি লোপমূদ্রাকে সম্বোধন করে বললেন—“প্রিয়ে ! তোমার অভিলাষ বল, তুমি আমার দ্বারা কতগুলি সন্তানের জননী হতে চাও, একটি, না একশত, না এক সহস্ৰ ?” এরপর অগস্ত্য দৃঢ়স্যু নামে এক পুত্র উৎপাদন করলেন ।

জরতকারু ছিলেন একজন ঊর্ধ্বরেতা, ব্ৰহ্মচারী, মহাতপা মুনি। একদিন ভ্ৰমণ করতে করতে তিনি কতকগুলি লোককে নীচের দিকে মাথা করে বৃক্ষ শাখা থেকে ঝুলতে দেখলেন। প্রশ্নের উত্তরে তারা বললেন যে জরতকারু নামে তাদের এক পুত্র বিবাহ ও সন্তান উৎপাদন না করায় তাঁরা বংশলোপের আশঙ্কায় এরূপভাবে ঝুলছেন। জরতকারু আত্মপরিচয় দিয়ে বললেন যে পিতৃপুরুষদের মুক্তির জন্য তিনি সমনামা কোন মেয়েকে বিবাহ করতে পারেন, যদি ওই মেয়ের আত্মীয়রা স্বেচ্ছায় তাঁকে ভিক্ষাস্বরূপ কন্যা দান করে । তারপর জরতকারু মুনিকন্যাভিক্ষায় বেরিয়ে বাসুকীর ভগিনী জগৎকারুকে বিবাহ করেন । বিয়ের শর্ত হয় যে তিনি স্ত্রীর ভরণপোষণ করবেন না এবং স্ত্রী কিছু অন্যায় করলে তাকে ত্যাগ করবেন । কিছুদিন পরে জরতকারুর একটি পুত্র হয়। একদিন মহর্ষি নিজ স্ত্রীর কোলে মাথা রেখে নিদ্রিত আছেন । এমন সময় সায়ংসন্ধ্যাবন্দনাদির সময় অতিক্রান্ত হচ্ছে দেখে স্ত্রী মহর্ষির নিদ্রাভঙ্গ করেন । এই ব্যবহারে ক্রুদ্ধ হয়ে মহর্ষি স্ত্রীকে ছেড়ে চলে যান ।

।। তিন ।।

সপ্তর্ষিদের অন্যতম বশিষ্টের স্ত্রী অরুন্ধতী কর্দম প্ৰজাপতির ঔরসে দেবাহুতির গর্ভে জন্মগ্রহণ করেন । পতিভক্তি ও পাতিব্ৰত্যের জন্য তিনি আদর্শ রমণী বলে গণ্য হন। মহাভারতের অনুশাসন পর্বে লিখিত আছে পতিসেবারূপ ধর্মপথ যে নারী অনুসরণ করেন, তিনি অরুন্ধতীর মত স্বর্গেও পূজিত হন। সেজন্য বিবাহের কুশণ্ডিকাকালে মন্ত্র উচ্চারণের সময় নববধূকে অরুন্ধতী নক্ষত্র দেখানো হয়। বশিষ্টের শতপুত্র ছিল। কল্মাষপদ রাক্ষস বশিষ্টের শতপুত্রের সকলকেই ভক্ষণ করে। একমাত্র জ্যেষ্টপুত্ৰ শক্তির স্ত্রী অদৃশ্যন্তী গর্ভবতী ছিল। তার গর্ভেই পরাশরের জন্ম হয় । একদিন মৎস্যগন্ধা নামে এক ধীবর কন্যা যমুনায় নৌকা পারাপারে নিযুক্ত ছিল। পরাশর তখন সেই নৌকায় যাচ্ছিলেন। মৎস্যগন্ধাকে দেখে পরাশর কামাতুর হয়ে মৎস্যগন্ধার কাছে সঙ্গম প্রার্থনা করেন । সেই সঙ্গমের ফলেই বেদের বিভাগকর্তা ও পুরাণসমূহের রচয়িতা কৃষ্ণদ্বৈপায়ণ ব্যাসের জন্ম হয়।

কল্মাষপাদের কথা এখনও শেষ হয়নি । একদিন পথিমধ্যে কল্মাষপাদ বশিষ্টকে দেখে, তাঁকেও খেতে গেলে, বশিষ্ট কল্মাষপাদের গায়ে মন্ত্রপূত জল ছিটিয়ে দিলে কল্মাষপাদ শাপমুক্ত হন ও নিজ রাজ্যে ফিরে গিয়ে রাজ্যশাসন করতে থাকেন । তিনি বশিষ্টকে তার স্ত্রীর গর্ভে এক সন্তান উৎপাদন করতে বলেন । বশিষ্টের সঙ্গে এই সঙ্গমের ফলে রাজমহিষী গর্ভবতী হন । কিন্তু ১২ বছর কেটে গেলেও সন্তান ভূমিষ্ঠ হয় না। তখন রাজমহিষী এক পাষাণখণ্ড দিয়ে নিজের উদর বিদীর্ণ করে এক পুত্র প্রসব করেন । এই পুত্রের নাম অশ্মক ।

।। চার ।।

বিশ্বামিত্র বৈদিক যুগের একজন ব্রহ্মর্ষি এবং ঋগ্বেদের তৃতীয় মণ্ডলের সমস্ত সূক্তের মন্ত্রগুলির অভিবক্তা। ক্ষত্ৰিয়কুলে জন্মগ্রহণ করেও কঠোর তপস্যাবলে তিনি ব্ৰাহ্মণত্ব লাত করেন। তিনি ঊর্ধ্বরেতা ঋষি । এক সময় পুষ্করতীর্থে তিনি উগ্ৰ তপস্যায় রত ছিলেন। সেই সময় ইন্দ্রের প্রেরণায় অপ্সরা মেনকা পুষ্করতীর্থে স্নান করতে গেলে, বিশ্বামিত্র তার রূপে মুগ্ধ হন এবং তাঁর সহবাসে দীর্ঘ দশবছর অতিবাহিত করেন । এই সহবাসের ফলে মেনকার গর্ভে শকুন্তলা নামে এক কন্যা জন্মগ্রহণ করে। মেনকা কন্যাকে পরিত্যাগ করে চলে যায়। পরিত্যক্ত কন্যাকে কন্ধমুনি পালন করেন ।

গালব বিশ্বামিত্রের প্রিয় শিষ্য । শিক্ষান্তে বিশ্বামিত্র তাকে গৃহে প্ৰত্যাবর্তনের অনুমতি দেন। গা্লব গুরু দক্ষিণা দিতে চান । বিশ্বামিত্র বলেন তিনি এমন ৮০০ অশ্ব গুরুদক্ষিণ চান, যাদের কান্তি চন্দ্রের মত শুভ্র এবং একটি কর্ণ শ্যামবর্ণ। গালিব রাজা যযাতির কাছে গিয়ে প্রার্থনা জানায়। যযাতি এতগুলো অশ্ব দান করতে অসমর্থ হয়ে, গালবের হাতে নিজ কন্যা মাধবীকে দিয়ে বলেন যে, এই কন্যাকে নিয়ে তুমি রাজাদের হাতে সমর্পণ করলে কন্যার শুল্কস্বরূপ তারা ৮০০ অশ্ব দান করবেন ও তিনি দৌহিত্র পাবেন । গালব প্রথমে অযোধ্যার রাজা হর্যশ্বের কাছে যায় । রাজা হর্যশ্ব বলেন যে তাঁর মাত্র ২০০ অশ্ব আছে এবং তিনি এই কন্যার গর্ভে মাত্র একটি পুত্র উৎপাদন করতে চান। তখন মাধবী গালিবকে বলে– ‘এক মুনির বরে প্রত্যেকবার প্রসবের পর আমি কুমারী থাকব । অতএব আপনি ২০০ অশ্ব নিয়ে আমাকে এঁর হাতে দান করুন । পরে আরও তিনজন রাজার কাছে আমাকে দান করলে আপনার ৮০০ অশ্ব পূর্ণ হবে, এবং আমার চারপুত্ৰ লাভ হবে।’ এরপর গালব এইভাবে আরও ৪০০ অশ্ব সংগ্ৰহ করে, এবং বিশ্বামিত্রের কাছে গিয়ে বলে, আপনি ৬০০ অশ্ব গ্ৰহণ করুন, আর বাকী ২০০ অশ্বের পরিবর্তে মাধবীকে গ্ৰহণ করুন । বিশ্বামিত্র মাধবীকে গ্ৰহণ করেন, এবং তার গর্ভে এক সন্তান উৎপাদন করেন ।

চ্যবন মহর্ষি ভৃগু ও পুলোমার পুত্র। দীর্ঘকাল তপস্যা করে চ্যবন । জরাগ্রস্ত হন ও বাল্মীকি স্তুপে পরিণত হন। একদিন রাজা শৰ্যাতি তাঁর ৪০০০ স্ত্রী ও সুন্দরী কন্যাকে নিয়ে সেখানে বিহার করতে আসেন । বাল্মীক স্তুপ মধ্যে চ্যাবনের খদ্যোৎবৎ দীপ্যমান দুই চক্ষু দেখে সুকন্যা কৌতুহলবশতঃ, কাঁটা দিয়ে তা বিদ্ধ করে। চ্যাবনের অভিসম্পাতে রাজার সৈন্যদের মলমূত্র ত্যাগ বন্ধ হয়ে যায়। শর্যাতি এর কারণ জানতে পেরে চ্যাবনের কাছে মার্জনা ভিক্ষা করেন। চ্যবন বলেন, এই কন্যার সঙ্গে তার বিবাহ দিলে তিনি তাঁকে ক্ষমা করতে পারেন । একদিন স্নানান্তে নগ্ন সুকন্যার রূপে মুগ্ধ হয়ে অশ্বিনীকুমারদ্বয় তাকে প্ৰাৰ্থনা করেন । সুকন্যা তার স্বামীর প্রতি অনুরক্ত বলে জানান । প্রীত হয়ে অশ্বিনীকুমারদ্বয় তখন চ্যবনকে তার পুর্নযৌবন দান করেন। সুকন্যার গর্ভে চ্যাবনের প্রমতি নামে এক পুত্র হয়।

।। পাঁচ ।।

ঋষি উতথ্যের ঔরসে ও মমতার গর্ভে ঋষি দীর্ঘতমার জন্ম হয় । মমতা যখন গর্ভবতী ছিল, তখন তার দেবর দেবগুরু বৃহস্পতি তার সঙ্গম প্রার্থনা করে। মমতা বলে– ‘তোমার জ্যেষ্ঠ ভ্রাতা হতেই আমার গর্ভ হয়েছে, তোমার বীর্য অমোঘ্য, সুতরাং এরূপ সঙ্গম থেকে বিরত হও ।’ গর্ভস্থ শিশু বৃহস্পতিকে রেতঃপাত করতে নিষেধ করে। কিন্তু বৃহস্পতি শিশু ও তার মার কথা না শুনে, মমতার অসম্মতিতে রেতঃপাত করেন । শিশু নিজের পা দিয়ে শুক্র প্রবেশের পথ রুদ্ধ করে দেয়। এতে বৃহস্পতি ক্রুদ্ধ হয়ে গর্ভস্থ শিশুকে অভিসম্পাত করে–‘তুমি দীর্ঘতামসে প্রবিষ্ট হবে অর্থাৎ অন্ধ হবে ৷ উতথ্যের এই পুত্র অন্ধ হয়ে জন্মগ্রহণ করে ও এর নাম হয় দীর্ঘতমা । যত্রতত্র সঙ্গম করার জন্য অন্য মুনিগণ কর্তৃক পরিত্যক্ত হয়। দীর্ঘতমার স্ত্রী প্ৰদ্বেষীও স্বামীর আচরণে অসন্তুষ্ট হয়ে স্বামীকে ত্যাগ করে, ও তাকে ভেলায় করে গঙ্গায় ভাসিয়ে দেয় । অসুররাজ বলি স্নানের জন্য গঙ্গায় এসে ভাসমান দীর্ঘতমাকে তেজস্বী দেখে নিজ স্ত্রী সুদেষ্ণায় গর্ভে পুত্র উৎপাদনের জন্য তাকে নিজ গৃহে নিয়ে আসেন । সুদেষ্ণার গর্ভে দীর্ঘতমা অঙ্গ, বঙ্গ, কলিঙ্গ, পুণ্ড্র, ও সুহ্ম নামে পাঁচপুত্র উৎপাদন করেন ।

।। ছয় ।।

কশ্যপ একজন বিখ্যাত ঋষি । শ্ৰীমদভাগবত মতে মরীচি এর পিতা ও কলা এর মাতা । ইনি দক্ষ প্রজাপতির তেরোটি মেয়েকে বিবাহ করেন । এই কন্যারাই ত্ৰিজগতের সমস্ত লোকের জননী । কশ্যপের ছেলে বিভাণ্ডক মুনি । বিভাণ্ডক মুনি দীর্ঘকাল তপস্যায় শ্ৰান্ত হয়ে কোন হ্রদে স্নানরত ছিলেন । সেই সময় স্বর্গের অন্সর উর্বশীকে দেখে কামার্ত হয়ে জল মধ্যে রেতঃপাত করেন । এক তৃষিত হরিণী সেই রেতমিশ্রিত জল পান করাতে গৰ্ভিনী হয়ে ঋষ্যশৃঙ্গ মুনিকে প্রসব করে। ঋষ্যশৃঙ্গের সঙ্গে রাজা দশরথের কন্যা শান্তার বিবাহ হয়।

।। সাত ।।

উদ্যালকও একজন বিখ্যাত ঋষি । এর পুত্রের নাম শ্বেতকেতু । একদিন শ্বেতকেতু তাঁর পিতার নিকট বসেছিলেন । এমন সময় একজন ব্ৰাহ্মণ এসে তাঁদের সামনেই তাঁর মাতাকে যৌন আবেদন জানায় ও বলপূর্বক তার হাত ধরে নিয়ে যায় ও তার সঙ্গে রমণে প্ৰবৃত্ত হয়। এতে শ্বেতকেতু ক্রুদ্ধ হয়ে ওঠায়, উদ্ধালক পুত্রকে বলেন- “হে পুত্র! ক্রুদ্ধ হয়ে না, এটাই সনাতন ধর্ম। গাভীদের ন্যায় স্ত্রীরাও অরক্ষিতা ।” শ্বেতকেতু এই বাক্য অস্বীকার করে, এবং স্ত্রী-পুরুষের দাম্পত্য জীবন সম্বন্ধে এই নিয়ম প্রবর্তন করেন যে, যে নারী নিজ পতি ভিন্ন অপর পুরুষের সঙ্গে সংসর্গ করবে এবং যে পুরুষ পতিব্ৰতা স্ত্রীকে ত্যাগ করে অন্য স্ত্রীতে আসক্ত হবে, তারা উভয়েই ভ্ৰাণহত্যার পাপে নিমগ্ন হবে ।

।। আট ।।

মহর্ষি চুলি একজন ঊর্ধ্বরেতা শুভাচারী ও দ্যুতিমান ঋষি ছিলেন । রামায়ণের আদিকাণ্ডে আমরা পড়ি যে মহর্ষি চুলি ভীষণ তপস্যায় রত ছিলেন । সোমদা নামে এক গন্ধৰ্ব কন্যা তার সেবা করত । সোমদার প্রার্থনা মত সেই মহাষি তার গর্ভে ব্ৰহ্মদত্ত নামে একজন বিখ্যাত ব্ৰহ্মতপঃ সমন্বিত পুত্র উৎপাদন করে। রাজা কুশীনাভ তার হাতে তাঁর শত কন্যাকে সম্প্রদান করেন । পবনদেব একবার কুশীনাভের এই একশত কন্যাকে ধর্ষণ করবার চেষ্টা করেছিলেন । মেয়েগুলি পবনদেবের এই অভিলাষ প্ৰত্যাখ্যান করলে, পবনদেব তাদের কুব্জা করে দেন । কিন্তু বিবাহের পর ব্ৰহ্মদত্ত ওই কন্যাদের স্পর্শ করা মাত্র, তারা বিকুব্জা, ও পরামশোভান্বিত হয়।

রামায়ণের আর এক কাহিনী অনুযায়ী মাণ্ডকনি ঋষি মাত্র বায়ু আহার করে দশ হাজার বছর ঘোর তপস্যা করে । তাতে অগ্নি প্ৰভৃতি দেবতারা ভীত হয়ে তার তপস্যা ভঙ্গ করবার জন্য পাঁচজন অপ্সরাকে পাঠিয়ে দেন। মাণ্ডকনি তাদের রূপে মুগ্ধ হয়ে, তাদের স্ত্রীরূপে গ্ৰহণ করে এক সরোবরের মধ্যে গুপ্ত গৃহ নিৰ্মাণ করে সুখে বাস করতে থাকে। রাম বনবাসকালে এই সরোবরের নিকট এসে জলশূন্য সরোবর থেকে সঙ্গীত ধ্বনি উঠছে দেখে বিস্মিত হয়েছিলেন ।

।। নয় ।।

কানা-খোড়া ঋষিরাও মেয়েছেলের প্রতি লালায়িত হতেন । চক্ষুহীন ও পদহীন পরাবৃদ্ধ ঋষি কতকগুলি মেয়েকে বিবাহ করতে চেয়েছিলেন, মেয়েগুলি ঋষিকে দেখেই পালিয়ে যায় । কন্যাগণকে পালাতে দেখে পরাবৃদ্ধ ঋষি সকলের প্রত্যক্ষে উঠে দাঁড়ালেন এবং পঙ্গুতা সত্বেও মেয়েগুলিকে ধরবার জন্য তাদের পিছনে ছুটলেন । ( ঋগ্বেদ ২।১৫।০ )।

।। দশ ।।

ঋগ্বেদের প্রথম মণ্ডলের ১৭৯ সূক্তে অগস্ত্য ও তাঁর স্ত্রী লোপামুদ্রা সম্বন্ধে এক বিচিত্ৰ কাহিনী আছে। অগস্ত্য বহুকাল লোপামুদ্রার সঙ্গে যৌনসঙ্গম করে শ্রান্ত হয়ে পড়েছেন । তিনি জরাগ্রস্ত । নিরত জপতপে নিযুক্ত থাকেন । কিন্তু সেই অবস্থায় তাঁর হঠাৎ স্ত্রীসম্ভোগ করবার ইচ্ছা হয়েছে। তিনি প্রার্থনা করছেন – ‘যদিও আমি জপ ও সংযমে নিযুক্ত, তথাপি ভোগপ্রাপ্তিসাধনের কারণেই হোক বা অন্য কারণেই হোক আমার প্রণয়ের উদ্রেক হয়েছে। লোপামুদ্রা সমর্থ পতিতে সঙ্গত হউন, অধীরা যোষিৎ, বীর ও মহাপ্ৰাণ পুরুষকে উপভোগ করুক ৷’ ( ঋগ্বেদ ১।১৭৯।৪ ) ।

।। এগার ।।

উপরে মুনি ঋষিদের যৌনজীবনের যে সব কাহিনী দেওয়া হয়েছে, তা থেকে যে সব সিদ্ধান্তে উপনীত হওয়া যেতে পারে, সেগুলি এখানে সংক্ষেপে বলছি। বিবৃত কাহিনীসমূহ থেকে পরিষ্কার বুঝা যায় যে, ব্ৰহ্মচর্য পালন পূৰ্বপুরুষদের মঙ্গল সাধন করে নি। একমাত্র বিবাহ দ্বারাই সে মঙ্গল সাধিত হয়। অনেক সময় মুনি-ঋষির ব্ৰহ্মচর্য পালন ও তপস্যার দ্বারা ঊর্ধ্বরেত হতেন । কিন্তু একাধিক কাহিনী থেকে আমরা জানতে পারি যে সুন্দরী রমণী দর্শনে তাদের রেতের আবার অধোগতি হত। বিবাহ যে মাত্র পুরুষদের পক্ষেই বাধ্যতামূলক ছিল, তা নয় ; মেয়েদের পক্ষেও । মহাভারতের এক কাহিনী থেকে আমরা জানতে পারি যে মহাতপা মুনির মেয়ে শুভ্ৰা, বহু বর্ষ তপস্যার পর যখন স্বর্গে যেতে চাইল, তখন নারদ তার সামনে এসে বলল যে, “অনুঢ়া কন্যা কখনও স্বর্গে যেতে পারে না।” তাই শুনে শুভ্রা গালব মুনির ছেলে প্রাকশৃঙ্গকে বিবাহ করেছিল। মাধবীর কাহিনী থেকে আমরা জানতে পারি যে একই কন্যার একাধিকবার বিবাহ হতে পারত । সধবা মেয়েরও দ্বিতীয়বার বিবাহ সম্ভবপর ছিল। এরূপ কন্যাকে পুনর্ভু বলা হত। ঐরাবত দুহিতার স্বামী যখন গরুড় কর্তৃক নিহত হয়েছিল তখন অৰ্জুন তাকে বিবাহ করে তার গর্ভে ইরাবন নামে এক সন্তান উৎপাদন করেছিল। আবার গৌতম ঋষি যখন জনৈক নাগরিকের গৃহে ভিক্ষার্থে এসেছিল, তখন তাকে ভিক্ষাস্বরূপ এক বিধবা শূদ্ৰাণীকে দান করা হয়েছিল । গৌতম তাকে বিবাহ করে তার গর্ভে সন্তান উৎপাদন করে । সধবার পক্ষেও দ্বিতীয়বার বিবাহ প্ৰয়াসের দৃষ্টান্ত, নলের কোন সংবাদ না পেয়ে দময়ন্তীর দ্বিতীয়বার স্বয়ংবরা হবার চেষ্টা থেকে পাওয়া যায়। মাধবীর পর পর চার বার সন্তান প্রসবের পরও কুমারী থাকার প্রতিধ্বনি আমরা কুন্তীর যৌনজীবনেও পাই। বৃহস্পতির মমতার সঙ্গে সঙ্গম আমাদের দেবরণ প্ৰথাকে স্মরণ করিয়ে দেয় । অনুরূপভাবে দীর্ঘতমা কর্তৃক সুদেষ্ণার গর্ভে সন্তান উৎপাদন, আমাদের স্মরণ করিয়ে দেয় প্রাচীনকালে ব্যাপকভাবে প্রচলিত নিয়োগ প্রথা ।

।। বারো ।।

ঋষিপত্নীরা যে সব সময়ই পতিব্ৰতা হতেন, তা নয়। অহল্যার দৃষ্টান্ত থেকেই আমরা বুঝতে পারি। অহল্যা ইন্দ্ৰকে চিনতে পেরেও সে সময় কামার্তা ছিল বলে দুর্মতিবশতঃ ইন্দ্রের দ্বারা নিজের কামলালসা পরিতৃপ্ত করেছিল। অহল্যার অসতীপনা সম্বন্ধে কোন সন্দেহই থাকতে পারে না । কেননা, বাল্মীকি লিখে গেছেন যে ইন্দ্ৰ অহল্যাকে সম্বোধন করে বলেছিলেন “ঋতুকালং প্রতিক্ষ্যন্তে নাথিন সুসমাহিতে । সঙ্গমং ত্বহমিচ্ছামি ত্বয়া সহ সুমধ্যমে।” অহল্যা ইন্দ্ৰকে চিনতে পেরেও দুর্বুদ্ধিবশত ও রমণার্থে কৌতুহলী হয়ে যে ইন্দ্রের অভিলাষ পূর্ণ করেছিলেন, তা বুঝতে পারা যায় এই থেকে যে অহল্যা কৃতাৰ্থ ও পূৰ্ণমনোরথ হয়ে ইন্দ্রকে বলেছিল–“কৃতাৰ্থস্মি সুরশ্ৰেষ্ঠ গচ্ছ শীঘ্ৰমিতঃ প্রভো । আত্মানাঞ্চ মাঞ্চ দেবেশ সৰ্বথা রক্ষ গৌরাবৎ।।” সুতরাং অহল্যা যে সজ্ঞানে এবং সম্পূর্ণ স্বেচ্ছায় কামলালসা পরিতৃপ্ত করবার জন্য রমণাভিলাষ পূর্ণ করেছিলেন এবং নিজে ‘কৃতার্থা ও পূর্ণমনোরথা হয়েছিলেন’ সে বিষয়ে কোন সন্দেহ নেই।

এবার শ্বেতকেতু কাহিনী সন্মন্ধে কিছু বলব। পণ্ডিতরা সাধারণত বলেন যে শ্বেতকেতুই ভারতবর্ষে প্রথম বিবাহ প্রথা প্রবর্তন করেছিলেন । কিন্তু পূর্বে বিবৃত কাহিনী থেকে পরিষ্কার বুঝা যায় যে তার আগেই শ্বেতকেতু তার পিতামাতার সঙ্গে পরিবার মধ্যে বাস করতেন । তিনি মাত্র পাতিব্ৰত্য সন্মন্ধে নিয়ম প্রবর্তন করেছিলেন ।

3 Comments
Collapse Comments

চমৎকার

বিস্তারিত বিবরণ মনোযোগসহ পথ করে খুব ভালো লাগলো।

খুব সুন্দরভাবে হিন্দুদের অনাচার বর্ণনা করেছেন। ধন্যবাদ।

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *