প্রজাপতি – ১১ (শেষ)

প্রজাপতি – ১১

বাড়ি ঢুকে রান্নাঘরের কাছেই, ছোট ঘরটায়, যেখানে মোটরসাইকেলটা থাকে, রেখে বারান্দায় উঠে ঘরের দিকে গেলাম। তখনই বাবার কথা মনে পড়ে গেল, খোলা দরজা দিয়ে, অন্ধকারের মধ্যে ঢুকে, আগেই সুইচটা অন করে দিলাম। বাবা অমনি বলে উঠলো, ‘আহ্ নেভাও, নেভাও বলছি।‘

‘আচ্ছা, অন্ধকারে কেন বসে থাকেন, বলতে পারেন?’

‘না, তুমি বাতি নেভাও।‘

বলছে, কিন্তু তেমন রাগ রাগ ভাবে না, কখনোই আজকাল তা বলে না, কেবল দেখি চোখ দুটো, অবাক অবাক, চমকানো, যেন হঠাৎ কোথায় নিয়ে আসা হয়েছে। আমি বললাম, ‘আপনি মার কথা ভাবেন, না?’

‘বাতি নেভাও আগে, কথা শোন।‘

সুইচটা অফ করে দিলাম, বললাম, ‘বলুন না, রোজ রোজ এরকম বসে থাকেন কেন?’

‘ভাল লাগে।‘

‘অন্ধকারে?”

‘হ্যাঁ।‘

‘মায়ের সঙ্গে কথা বলেন?’

‘জানি না। তুমি সারাদিন বাড়ি আসনি আজ?’

‘না, আমার ভাল লাগছিল না। আমি চাকরি খুঁজছি, জানেন!’

‘তাই নাকি। তুমি চাকরি করতে চাও?’

‘চাই।‘

‘বেশ তো, তা হলে—‘

‘না, আপনার কাছে চাই না, নিজেই জোগাড় করে নেব। আপনি মেজদা বড়দা, আপনাদের কিছুই চাই না…। আমি যে কেন আপনার ছেলে, আর ওদের ভাই, কিছুই বুঝতে পারি না।‘

বলতে বলতে আমি বেরিয়ে এলাম, বাবা যেন কী বলতে যাচ্ছিলেন, ‘তুমি—।‘ থাক্‌ দরকার নেই, শুনতে চাই না, গ্যুন্নাই! কিন্তু একটু মাল খেতে ইচ্ছা করছে, আগে মেজদার ঘরটাই দেখলাম, বাতি জ্বেলে, নাহ্‌, আলমারিতে তালা। তারপরে, বড়দার ঘরে—একই অবস্থা, স্‌সাহ্‌—খচ্চরগুলো সব বন্ধ করে রেখে গেছে।

ঘরে ঢুকেই শুয়ে পড়লাম। এমন কি জুতোও খোলা হল না, কিন্তু আমি চিত হয়ে শুতে পারলাম না, যেন কেমন সব ফাঁকা লাগছে। তাই বুকটা মুখটা বিছানায় খুব জোরে চেপে শুয়ে পড়লাম। বাতি জ্বালিনি, দরজাটাও খোলাই রইল। এ সময়ে শুলাদা এল, গায়ে হাত দিয়ে বললো, ‘ ছোট খোকা, খেতে চল।‘

‘না। ‘

‘সারাদিন খাওনি, এখন আবার—’

এ লোকটা নিশ্চয় আমার মাকে মনে মনে পুরুষের মত ভালবাসতো, কথাটা এখন আমার আবার মনে হচ্ছে, কিন্তু আমি পা দাপিয়ে চেঁচিয়ে বললাম, ‘না, বলছি ঘুম পাচ্ছে, উঠতে পারছি না।‘

টের পাই, একটু পরেই শুলাদা চলে গেল। কিন্তু সত্যি আমার ভীষণ ঘুম পাচ্ছে, আর শিখার মুখ দেখতে পাচ্ছি, ‘আমাকে একটা চুমে দেবে।‘…

 

পরদিন ঘুম ভাঙলো অনেক বেলায়। বিছানা থেকে হাত বাড়িয়ে ঘড়িটা তুলে নিতে দেখি, এগারোটা বেজে গেছে। এখন মনে পড়ছে, কাল শুলাদা খাবার জন্যে যেন ডাকাডাকি করেছিল, কী জানি, ওকে বকেছি না মেরেছি, কী করেছি। তারপরেই শিখার কথা মনে পড়লো, তারপরে মনে পড়লো আজ হরতাল আর বড়বাবুদেরও কী একটা পেরকাশ্য অধিবেস্‌সন।

উঠে চান করে, খেয়ে, আবার ঘুমিয়ে পড়লাম। জেগে দেখলাম, পাঁচটা বাজে। বড়বাবু মেজবাবু যে কখন এলেন খেলেন কিছুই জানি না। প্যান্ট জামা পরে, মোটরবাইকটা নিয়ে বেরুলাম, এখন শিখার কাছে যাব।

আমাদের গলিটা থেকে বেরিয়ে, বড় রাস্তা দিয়ে খানিকটা উত্তরে যেতেই মোড়ের কাছে এসে দেখি, দু দিক থেকে দুটো মিছিল আসছে। আমি থেমে গেলাম। মোটরবাইকটা সরিয়ে নিয়ে, একটা দোকানের বারান্দায় দাঁড়ালাম, আর এতক্ষণে আমার খেয়াল হল, রাস্তায় প্রায় লোক নেই, গাড়ি ঘোড়া নেই, দোকানপাট সব বন্ধ, সব যেন শ্মশানের মতন খা খা করছে। আমার সামনের রাস্তাটা দিয়ে–মানে পুবদিকের রাস্তাটা দিয়ে মেজদাদের মিছিল আসছিল, আর উত্তর দিক থেকে বড়দাদের। দু দলই এমন জেদের গলায় চিৎকার করছিল, নিশ্চয় মোড়ে মাথায় এসে একটা কিছু করবে। আর কী আশ্চর্য, ওরা আসছে যেন, সমান সমান দূর থেকে, যেন মুখোমুখি দেখা হয়ে যায়। দু’দলেই মেলা পোস্টার ফেস্টুন নিশান। কেউ নেই, আমি কী করব, দাঁড়িয়ে দেখব নাকি। রমেশের মুখটা তখন আমি দেখতে পেয়েছি, আর ওদিকে কিষেণ, ওদের চোখ জ্বলছে। কারা যে কোনদিকে যাবে, বুঝতে পারছি না, আমার ঘাড়ের কাছে সেই জায়গাটা শিরশির করছে, অনেকগুলো চোখকে যেন আমি জ্বলতে দেখছি আমার দিকে, যেন আমাকে ছিঁড়ে খাবে। বড়দা মেজদা কোথায়। মিছিলের মধ্যে নাকি। ওরা প্রায় মুখোমুখি এসে গেছে, আমি নেমে যেতে গিয়েও দাঁড়িয়ে রইলাম—আচ্ছা, ওরা যাক, তারপরে যাব। কিন্তু ওদের মধ্যে কীরকম কথা কাটাকাটি শুরু হয়ে গেছে, আর ঠিক তখনই, কোথা থেকে একটা আধলা ইট আমার মাথায় এসে পড়লো। কে যেন বললো, ‘মার্‌ ওকে।‘ দেখতেই পেলাম না, কারা মারামারি করছে, কারণ আমার মাথা ফেটে চোখের ওপর দিয়ে রক্ত পড়ছিল, আমি দোকানের দরজায় হেলান দিলাম, বোধ হয় আবার সেলাই করতে হবে—কিন্তু আহ্, আমি খালি একটা আগুনের ঝিলিক দেখলাম চোখের সামনে, আর কান ফেটে যাওয়া একটা শব্দ। মনে হল, একটা ঝটকা লাগলো, আর ডানদিকের কী যেন একটা হালকা হয়ে গেল আমার শরীর থেকে, ডান চোখ দিয়ে একবার এক পলকেই দেখে বুঝলাম, আমার ঘড়ি-পরা ডান হাতটা নর্দমায় পড়ে গেল। কারা মারলো—আচ্ছা সেই প্রজাপতিটার কথা আমার মনে পড়লো, চোখে ভাসছে, সিল্ক নীলাম্বরী, রুপোলী ফুটকি ফুটকি—শিখার সেই শাড়িটার মতন, কে দিয়েছিল …. বুঝতে পারছি, পড়ে গিয়েছি বারান্দার ওপরে, কিছুই দেখতে পাচ্ছি না আর, শিখাকে বলেছিলাম, আজ বিকালে—আর ও বলেছিল, ‘কাল বাড়ি থেকে বেরিও না’, আমি বলেছিলাম, টুক করে একবার তোমাকে দেখে যাব …. উহ্ স্‌সাহ্‌, কী একটা কষ্ট—কিছুই ভাবতে পারছি না…কিছুই না…।

 

কী? কী? কীরকম যেন বাবার গলা শুনতে পাচ্ছি, কিছুই দেখতে পাচ্ছি না, মনে হচ্ছে চোখে কিছু বাঁধা, আর একটা ওষুধ ওষুধ গন্ধও পাচ্ছি, আর গোটা শরীরটা যেন একটা টনটনে ফোড়ার মতন। বাবার গলা শুনতে পাচ্ছি, ‘তুমি বলতে চাও তোমার দল মারেনি?’

‘না। আপনি নিকুকে জিজ্ঞেস করুন, ওরাই টুকুকে বোমা ছুড়ে মেরেছে। তা নইলে আমি হাসপাতালে আসতাম না ।‘

মেজদার গলাও শোনা গেল, ‘হাসপাতালে তো আমিও এসেছি। টুকুকে তোরাই তো মেরেছিস।‘

ওরা আমাকে এখনো ‘টুকু’ বলছে—মানে আমি তো সত্যি ওদের ভাই।

তারপরেই আশ্চর্য—আশ্চর্য, আমি শিখার গলা শুনতে পেলাম, মাইরি, শিখা বলছে, ‘থাক, এসব প্রসঙ্গ থাক কাকাবাবু। এদের যেতে বলুন, টুকুর এখনো জ্ঞান হয়নি।‘

টুকু! শিখা আমার নাম ধরে বলছে, আমি শিখাকে ডাকতে চাইলাম, কিন্তু কোন শব্দ করতে পারছি না। শুনতে পেলাম, বাবা বলছে, ‘টুকু খুব খারাপ ছিল, মানি, কিন্তু—কিন্তু—।‘

শিখার গলা শোনা গেল, ‘কাঁদবেন না কাকাবাবু।‘

উহ্‌রে বাব্বা, বাবা কাঁদছে, কিন্তু আমি শিখাকে ডাকছি, শব্দ করতে পারছি না। তারপরেই হঠাৎ শিখা বলে উঠল, ‘ডাক্তারকে ডাকা দরকার, মনে হচ্ছে জ্ঞান হয়েছে, কী রকম শব্দ হচ্ছে গলায়।’

ছাই হচ্ছে, আমি তো তোমাকেই ডাকছি, তোমাকেই, শিখা শিখা শিখা। হঠাৎ মনে হল, আমার ঠোঁটের কাছে যেন কিছু ছুঁয়ে গেল, ছুঁয়েই রইল, আমি টের পেলাম, শিখার আঙুল, আমার রক্ত জানে। তখন সব ভুলে আমি হাত তুলতে গেলাম, ডান হাতটা-কিন্তু কিছুই সেখানে আছে বলে মনে হল না, আর তখন সেই ঘড়িসুদ্ধ ডানহাতটা নর্দমায় পড়ে যাবার কথা আমার মনে পড়লো। আরে, এটা কার মুখ, মায়ের নাকি—হ্যাঁ, তাই তো—আরে, মায়ের পাশে একটা জান্ত লোক, সেই বচন ক্যাওরার মুখটাও দেখতে পাচ্ছি যেন, কী রে বাবা : শিখার গলা আবার শুনতে পেলাম, কোথায় যে একটু হাত দেব, বুঝতে পারছি না—ওকে কত বারণ করেছিলাম না বেকতে। এই কথা শুনেই প্রজাপতিটার কথা আমার মনে পড়ে গেল—কী আছে বাপু, আমি জন্মেছি, আমার খাবার আমিই খুঁজে নেব—ওই প্রজাপতিটার মনের কথা বলছি—যেন আমিও ওইরকমই কাল ভেবেছিলাম—আমি ঠিক আমার মতই, বাঁচব, খাবার খুঁজে খাব—মানে, প্রজাপতির যেমন দু’বার জন্ম হয়, আমারও সেইরকমই হবে–আমি—অন্য মানুষ হব—এই ছেলেটা আর না, শিখা যেমন চেয়েছিল, সেইরকম –কিন্তু, ‘তুমি রাক্ষস’। শিখার কথাটা মনে পড়ে গেল। শিখা তখন বলেছিল, আজ যেমন আমাকে মার খেতে হল, হয়তো মরব, কেননা, আমিও বোধহয় একটা ছেউটি ছুঁড়ির মতই ছটফট করছিলাম। উহ্ এত করে যে ডাকছি, ও জানতেও পারছে না। কেন, জানতে পারছে না কেন। শিখার গলা আবার শোনা গেল, “উহ্, কাকাবাবু, ওর সারা গায়ে মাথায় বড্ড কাঁচা রক্ত উপছে আসছে। কী রকম গোঙাছে।

কিন্তু শিখা, এত করে তোমাকে ডাকছি, তুমি শুনতে পাচ্ছ না নাকি। দেখছ, আর পারছি না ডাকতে, আর ডাকতে পারছি না। আমি শুধু ওর চুড়ির শব্দ পাচ্ছি, ঠিন ঠিন ঠিন।…. শিখা, হাতটা সরিয়ে নিও না, কোথাও যদি হাত রাখবার জায়গা না থাকে, তবে রক্তেই রাখ, রক্তেই রাখ-না না-হয়, সেই প্রজাপতিটা পায়ে চেপটে যাবার পরে কুয়াতলায় গিয়ে পা ধুয়ে ফেলার মত হাত ধুয়ে ফেলো। শিখা—তোমার পা দুটো তখন কী রকম ঠাণ্ডা ছিল। শিখা, হাত সরিও না।…

Leave a Reply to The Wild Cancel reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *