প্রজাপতি – ০৫

প্রজাপতি – ০৫

যাই হোক, সেই প্রথম দিনের ছোঁয়াছুয়ির কথাই বলছিলাম, ওহ, তার যে কী এফেক্ট না, কতদিন ধরে যে চলেছিল, আর কী সব আশ্চর্য ঘটনা ঘটেছিল আমার মনের মধ্যে সেও একরকমের ভূতুড়ে ব্যাপার বললেই হয়। ছ’দিন হাঙার স্ট্রাইক চলেছিল, এস ডি ও এসেছিল, শেষ পর্যন্ত গভর্নিং বডির জাদুদের থেীতা মুখ ভোঁতা হয়েছিল, তবু খচ্চরগুলোর ওপর আজও আমার রাগ যায়নি, শহরের সেই মান্যিগণ্যি লোচ্চাগুলোর জন্যে কিনা ছটা দিন না খেয়ে থাকতে হয়েছিল। এখন তো মান্যিগণ্যি হওয়ার পলিসি সব শিখে গেছি, ওরা সব মুখোস আটা বদমাইস, তার সঙ্গে স্ট্যাটাস মেনটেন করে যাওয়া, আমার বড়দা মেজদা এখন যেমনটি হয়ে উঠছে। যা, তোরা তাই কর গিয়ে, আমি গুণ্ডাই থাকব। বাবাকেও দেখেছি, তোদেরও দেখছি, আমার কাছে নতুন কিছু না, একমাত্র তফাত হল, দাদারা রাজনীতি করে, বাবা তা করতো না।

কিন্তু সেই ছ-দিনের এফেক্ট, স্‌সাহ্‌ ছত্রিশ দিন ধরে চলেছিল। মনের সে যে কী একটা অবস্থা না, তা সে যাই হোক গে, অবাক হতে হয় যে-স্যারটির চাকরিতে বহালের জন্যে ছ-দিন না খেয়ে ছিলাম, তার সঙ্গেই পরে পরীক্ষার হলে—ধূ-র, সে কথা যাক গে, যে মেন গেট নিয়ে অতো ঝামেলা, সেই মেন গেট ঠিকই আছে, কিন্তু পাশ ঘেঁষে যতটা জমি ছিল, যেখানে আমাদের ক্যাম্প হয়েছিল, তার ওপরেই তো গভনিং বডির মেম্বার বে-নামেতে সেই বিল্ডিং হাঁকিয়েছে, এখন দেখা গিয়ে, সেখানে একতলাতে কী রমরমা বিজনেস চলেছে। ছেলেদের সিগারেট চা, খাতা পেন্সিল কলম লজেন্স তো বাদই দিচ্ছি, আরো কত কী রপোট চলেছে—তা যাকগে সে কথা, আমি শিখার কথাই বলছি, সেই ছ’দিনের এফেক্ট যে আমাকে কী সব কাণ্ড করে দিয়েছিল, কোথায় টেনে নিয়ে গিয়েছিল, কারণ তারপরেও আরো কয়েকবার শিখা আমাকে ছুয়েছিল—কিন্তু গুলি মারো সে সব কথায়, মোটের ওপর তারপর থেকে আমি আর শিখাকে ছেড়ে থাকতে পারিনি। থাকতে পারিনি মানে কী, একটা কুকুরের মতই প্রায় ওর পেছনেই লেগে আছি, তা বলে কি আর এদিক ওদিক টীক মারিনি, না শিখাই মারছে না, তবু শিখাকে আমি ছাড়তে পারিনি। কিছু যে পাইনি, তা না, তবে সেটা আমার কাছে পাওয়া বলে মানেই হয় না, সে পাওয়াটা যেন কিছুই না। অথচ আর কী-ই বা পাওয়া যেতে পারে, ওকে তো আর কেটেকুটে মাংস বানিয়ে খেয়ে ফেলা যায় না, যদিও এক এক সময় সত্যি মনে হয়, ওর ঠ্যাঙ দুটো ধরে ছিড়ে ফেলে দিই—সেই কী বিচ্ছিরি ব্যাপার, কিন্তু এ কথা আমার বারে বারে মনে হয়, পাইনি, পাইনি, ওকে আমি পাইনি। কী পাইনি, তা বুঝিয়ে বলতে পারি না, ওটাও একটা ভূতুড়ে ব্যাপারের মতনই, তবে এমনি ওর শরীর-টরীর সবই আমার দেখা জানা আছে, বেশ ভালভাবেই জানা আছে, আর সে জানাটা এমন একটা জানা, সত্যি, অন্য কোন মেয়ের কাছে সেটা কখনোই জানা যায় না। কিন্তু আমি কি, স্‌সাহ্‌, তাও বুঝিয়ে বলতে পারি নাকি, কী জানা আছে। ছাই, ওসব আমি বুঝিয়ে বলতে পারি না, কী জানা আছে, মোটের ওপর শিখাকে পেলে আর কোটি মেয়েও চাই না, এই আর কী, এবার বোঝ স্‌সাহ্‌, ব্যামোটা কোথায়। একে বলে ভূতে পাওয়া রোগ, ভূতুড়ে ব্যাপার। তবে এই শরীর-টরীর যে কারণে ভাবছিলাম, আমার সবই জানা আছে, এই যে শিকের গরাদের মত জামাটা ঢল খেয়ে যাওয়ায় ওর বুকের যতটা দেখা যাচ্ছে, সব আমার জানা, তবু হাতটা যেন দারুণ খিদেয় কেউ কেউ করছে, কারণ কিছুতেই খিদে মরে না, সব সময়েই নতুন নতুন মনে হয় |

কিন্তু ও কি সত্যি এদিকে ফিরবে না, একটা কথাও বলবে না! এবার আমি ওকে জোর করে ধরে, আমার দিকে ফেরাই। দু কাঁধের ওপর হাত রেখে আমার দিকে ফিরিয়ে ডাকি ‘এই!’

শিখা তৎক্ষণাৎ দু’ কনুই দিয়ে আমাকে ধাক্কা দিয়ে সরিয়ে দিল। হাতে প্রজাপতিটা ধরা, তা-ই কনুই দিয়ে আমার বুকের কাছে ধাক্কা দিয়ে, আমাকে সরাতে চাইল, আসলে ও নিজেই একটু সরে গেল আর আমার দিকে রেগে তাকালো। ওই যে সেই গান আছে না, এমন মাটিতে চাঁদের উদয়, কে দেখবি আয়, আমার ঠিক তেমনি করে বলতে ইচ্ছা করছে, মেয়ের এমন রাগ কে দেখবি আয়। একেবারে ছবি, মাইরি বলছি, সেই, সেই যে বলছিলাম না, সিনেমা সিনেমা। কিন্তু শিখা তো সত্যি আর সিনেমার ছবি না, মিছি মিছি রাগ দেখাচ্ছে না, ওর রেগে যাওয়া চোখ দুটোতে জলও রয়েছে, সেই ছবির মতই। আঁচলটা তেমনি লুটিয়ে পড়েই রইল, আর লাল নীল হলুদের ডোরাকাট জামাটা বুকের কাছে ফুলে ফুলে উঠতে লাগলো, জোরে জোরে নিশ্বাস পড়ছে কি না, তা-ই। ওর এরকম চেহারা, আমি আরো কয়েকবার দেখেছি, এই রকম রেগে যাওয়া লাল লাল চোখ, অথচ জল এসে পড়ায় একটা টল টল ছল ছল ভাব, নাকের পাটা একটু একটু ফোলানো, কাঁপা কাঁপা, ঠোঁট দুটো শক্ত করে টিপে রাখা। সেই একদিনের কথা আমার মনে আছে, অথচ সেটা প্রথম দিনের কথা না, বরং ও সেদিন বেশ খুশি মনেই রাজী হয়েছিল, আর তাতেই আমি বেশী ক্ষেপে গিয়েছিলাম কি না জানি না, এমন কাণ্ড করেছিলাম, যাচ্ছেতাই। আরে, খাবি তো, থালাটা ভেঙে চুরমার করে নাকি। উহ, সেদিন দেখেছিলাম, আমার কাছ থেকে ছাড়া পেয়ে—ওটাকে ছাড়া পাওয়া বলে না, নিস্কৃতি পাওয়া বলে, পেয়ে উঠে ঠিক এমনি করেই তাকিয়েছিল আমার দিকে কী সুন্দর হাসিখুশি ছিল তার একটু আগেই, আর কী মূর্তিই হয়ে উঠেছিল। কেবল একটা কথাই, নিচু গলায়, কিন্তু ফুঁসে উঠে বলেছিল, ‘পশু!’

তখন আমার চোখে নেশা থাকলেও, একেবারে ল্যাজ গুটিয়ে যাওয়া, চোখ পিটপিটনো কুকুরের মতন হয়ে গিয়েছিল। সে রাগ কাটাতে অনেকদিন লেগেছিল, অনেক হাতে পায়ে ধরতে হয়েছিল। কিন্তু সেটা ছিল ওর শরীরের ব্যাপার, আর এটা তো একটা প্রজাপতি। প্রজাপতিটার জন্যে সত্যি ও এরকম করছে, নাকি, অন্য কোন মতলবে আছে, যাতে এ-ই দিয়েই সকালবেলাটা ভাগিয়ে দিতে চায়। কারণ, জানে তো ও ওরকম করে থাকলে, আমি বিশেষ সুবিধা করতে পারব না, হয়তো চলেই যেতে হবে। অথচ, সত্যি তো আমি ওটাকে মারতে চাইনি। বললাম, ‘আমি কি ওটাকে মারতে চেয়েছি নাকি, ও নিজে তো— ‘

আমার কথা শেষ হবার আগেই, ঠিক যেমন করে ‘পশু বলে উঠেছিল একদিন, তেমনি নিচু স্বরে ফুঁসে বলে উঠলো, ‘গুণ্ডা!’

কথাটা শুনেই এমন হাসি পেয়ে গেল, আমি খ্যাল খ্যাল হেসে উঠলাম। বললাম, ‘গুণ্ডা বলছ?’

ও যেন প্রায় ঝাঁকিয়ে উঠলো, বলব, ‘হাজার বার বলব, একটা গুণ্ডা তুমি?’

আবার হেসে উঠে, আমি বললাম, সে তো সবাই বলে আমাকে।

‘আমিও বলব! গুণ্ডাকে গুণ্ডাই বলব।’

‘বল না বুঝি!’

‘আরো বলব, তুমি গুণ্ডা, গুণ্ডা, গুণ্ডা।’

যেন একটা ছোট মেয়ে ঝগড়া করছে, ঠিক এমনি ভাবে বলছে। হাসি পেলেও, আমার ভিতরে ভিতরে একটু রাগও হচ্ছে। একটা প্রজাপতির জন্যে—অথচ ও যেরকম করছে, তাতে এটা আমি জানি, ও সত্যি ন্যাকরা করছে না। বললাম, ঠিক আছে, আমি তো গুণ্ডাই।

‘তা-ই এটার সঙ্গেও গুণ্ডামি করতে হবে, না?

মানে প্রজাপতিটার সঙ্গে। আমি ওর কাছে গেলাম, ওর গলাটা ধরতে গেলাম, ও গোটা শরীরে একটা ঝাঁকুনি মেরে বললো, না।

আসলে, ওর চেহারা, রাগ, চোখ মুখ, শরীরের ঝাঁকুনি দেখে, আমার ভিতরটা অন্যরকম ভাবে তরতরিয়ে যাচ্ছিল। এ সে-ই, অনশনের দিনের মতই, ও ছিল একরকম মনে, আমার ওদিকে অন্যরকম। আমি বললাম, “কিন্তু আমি ওটা তোমার জন্যেই ধরতে চেয়েছিলাম।’

ও তেমনি ভাবেই বললো, ‘আমি তোমাকে মাথার দিব্যি দিয়েছিলাম, না? বারণ করলাম না তোমাকে। তবু তুমি ওই পালকের ছপটিটা দিয়ে মারলে, তবে ছাড়লে। রাক্ষস কোথাকার।

আবার আমার হাসি পেয়ে যাচ্ছিল, কিন্তু একটু সামলানো দরকার। প্রেমিকাটি বড় রেগে গেছে, সকালবেলাটা মূলে হা-ভাত হবে। অথচ রাক্ষস কথাটা শুনে এত হাসি পেতে লাগলো, তবে রাক্ষস বলে, ও যেন একটু শান্তি পেল, আর মুখের ভাবটা একটু জুড়িয়ে এল। যেরকম জুলছিল, যেন ভস্ম করে ফেলবে। আর স্‌সাহ্‌, প্রজাপতিটার কাণ্ড দেখ, ওটা এখনো পাখা ঝাপটাচ্ছে। তবে আগের মতন আর না, ছুঁড়ির হয়ে এসেছে, তবু কীরে বাবা, ও কি এক পাখাতেই উড়বে নাকি। তারপরে, ঠিক যা ভেবেছিলাম, শিখা তা-ই বললো, ‘তোমাকে যদি কেউ এভাবে মারে, এরকম আধমরা করে ফেলে দেয়, তখন তোমার কেমন লাগবে।’

‘আমি কি ওর মত পালাতে যাব নাকি যে, কেউ আমাকে ওরকম মারবে।’

‘ও কি পালাচ্ছিল নাকি! ও তো উড়ে উড়ে খেলছিল, নিজের মনে ছিল, কী করে জানলে, তোমার মধ্যে পিশাচটা জেগে উঠছে।’

সে কথাটা ঠিক, প্রজাপতিটার জানবার কথা নয়, আমি তখন কী চাইছিলাম। ও ওর নিজের মনেই ছিল। দেখলাম শিখা আচল তুলে, চোখ দুটো মুছে ফেললো, আস্তে আস্তে চেপে চেপে মুছলো, যাতে সকালবেলার পেনসিলে টানা কাজলটুকু না উঠে যায়। আমি তবু বললাম, ‘তুমি দেখেছিলে, ও কী রকম ছেউটি ছুঁড়ির মত করছিল।’

কথাটা শুনে, ভুরু কুঁচকে একবার যেন অবুঝের মত তাকালো, তারপরে বললো, ‘তোমার তো সবই কোন না কোন ছুঁড়ির মত, ছোটলোক কোথাকার।’

তবু ঠাণ্ডা হ মা, যা বলিস তা বল, একটু ঠাণ্ডা হ, মনে মনে এ কথাই বলি। অবিশ্যি তা-ই হয় শিখা, আগের থেকে অনেক ঠাণ্ডা হয়ে ওঠে। তবে সে-ই যেন কী দেখে একেবারে মোহিত হয়ে যাচ্ছে, সে ভাবটা তখনো যায়নি, নজরটা আবার প্রজাপতিটার দিকেই নেমে গিয়েছিল, আর নাকের পাশে, ঠোঁটের কোণে, কষ্টের কিছু দেখলে যেরকম হয়-না, সেইরকম দেখাচ্ছিল। আমি ওর কাঁধে একটা হাত রাখলাম, তখনি ঝাপট মারতে যাচ্ছিল, কিন্তু গিয়েও, কাঁধটা একটু কোঁচকালো মাত্র। আমি বললাম, ‘প্রজাপতিটার জন্যে সত্যি এত কষ্ট লাগলো।’

শিখা জবাব না দিয়ে মুখ তুললো, চুলের একটা গোছা ওর গালের ওপর এসে পড়েছে, তার পাশ দিয়ে একটা চোখ প্রায় ঢাকা দেখাচ্ছে, ও আমার দিকেই তাকালো। খানিকক্ষণ তাকিয়েই রইলো। কিছু বললো না, যেন আমাকে বোঝবার চেষ্টা করছে—বোঝবার আবার কী আছে কে জানে, আমি মোটের ওপর পুরোপুরি বিশ্বাস করতে পারি না, ওসব আমার একটু ন্যাকামি ন্যাকামিও লাগে, তবু ওই যে সেই, কী যেন একটা আছে ওর মধ্যে’, সে চিন্তাই খেলছে। ও মুখটা নামিয়ে, আবার দেখতে থাকে, থাকতে থাকতে বলে উঠলো, কী সুন্দর, ইস্! তোমার কষ্ট হচ্ছে না?’

আমার দিকে না তাকিয়েই ও বললো। কিন্তু কষ্ট কই, আমি তো সত্যি কোন কষ্ট পাচ্ছি না, বরং একটা কী রকম বিদকুটে ভাবই লাগছে আমার, নুলোর মত ডানাটা ঝাঁপাতে দেখে। কত কী-ই তো কত সময় এখানে সেখানে মরে পড়ে থাকতে দেখি, পোকা মাকড় ইদুর আরশোলা, এমন কী, অনেক মানুষকেও মরে পড়ে থাকতে দেখেছি, তার জন্যে কষ্ট তো কিছুই হয়নি কখনো। একটা উলটো ভাবই আসে, গা-টা কেমন করে ওঠে, খারাপ লাগে, সেটা কষ্ট লাগা না। শিখা আবার বললো, ‘আর জান, ওরা সত্যি সত্যি বিয়ের ঠাকুর।’

আমার মুখ দিয়ে প্রায় বেরিয়ে গিয়েছিল, ‘আমার ইয়ের ঠাকুর’, কিন্তু চেপে গেলাম। আচ্ছা, শিখা কি সত্যি সত্যি এ কথা বিশ্বাস করে নাকি, ওর মত রেপুটেড মেয়ে, শহরের নাম-করা—খেলোয়াড়ি যাকে বলে, সেই মেয়ে কি সত্যি এসব বিশ্বাস করে আমাকে শোনাচ্ছে। ভাল একটা বিয়ে-টিয়ের জন্যে বোধহয় মেয়েরা সবাই এটা বিশ্বাস করে, যেমন বেশ্যাদেরও দেখি, গঙ্গা থেকে নেয়ে ফেরবার সময়, শিবের মাথায় একটু জল না দিয়ে পারে না। কেন, তখনো কি তার শিবের মত বর পাবার আশা নাকি। স্‌সাহ্‌—এসব আমি জানি না। শিখা আবার বলে উঠলো, ‘মানে প্রেমের দেবতা’

তার মানে, বিয়ে প্রেম, এসব নিয়ে শিখার মাথাব্যথা, একটা ভাল বিয়ে, একটা ভাল প্রেম, এসব কিছু নেই বলেই প্রজাপতিটার জন্যে ওর এত মায়া। অথচ ওর কাছে ওসবের কী দাম আছে, তা এই নুলো পোকাটাই জানে। প্রেমের তো বাবা শেষ নেই, ওদিকে বিয়ে যে স্‌সাহ্‌, কতজনের সঙ্গে পাতিয়ে বসে আছে, কে জানে। তবে, ওর কথাগুলো শুনতে শুনতে আমার তখন আর ওসব মনে থাকে না। আমি ওর চিবুকে হাত দিয়ে, মুখটা তুলে ধরি, ও আমার দিকে তাকায়। তাকিয়ে চিবুকটা নামিয়ে নেবার চেষ্টা করতে, আমি বললাম, ‘এক ছক্কা উঠা লুঁ?’

চিবুকটা নামিয়ে নিতে গিয়ে, ও আমার মুখ তুলে আমার দিকে তাকালো, ভুরু কুঁচকে অবাক হয়ে—এরকম করলেই, আমার ঠোঁট চুলবুলিয়ে ওঠে, কারণ এখন ওর ঠোঁট দুটো আলগা হয়ে, সাদা কয়েকটা দাঁত দেখা যাচ্ছে, আর এই ভাব করে জিজ্ঞেস করলো, ছক্কা মানে?

আমি বললাম, সে তুমি বুঝবে না, ওসব হচ্ছে আলাদা জগতের কথা। মুচু মুচু, মুচু জান না? বলতে বলতেই শব্দ করে, ওর ঠোঁটের ওপর ঠোঁটটা ছুঁইয়ে দিই। ও অমনি ঠোঁট দুটো আরো ফুলিয়ে বলে উঠলো, ‘অসভ্য! অসম্ভব। তখন একেবারে হাত দিয়ে জড়িয়ে ধরে শুষে নিলাম, নিতে নিতেই টের পেলাম, ঠোঁট দুটোকে টেনে নেবার চেষ্টা করছে, কিন্তু—হুম, যা ভেবেছি, স্বাদে আর গন্ধে দুটোতেই টের পাওয়া গেল, সকালবেলা ও নিশ্চয়ই পরোটা আর বেগুন ভাজা খেয়েছে। ওকে ছেড়ে দিয়ে, সে কথাই জিজ্ঞেস করলাম, সকালবেলা পরোটা আর বেগুন ভাজা খেয়েছ, না?

শিখা প্রায ফুঁসে উঠে বললো, ‘বেশ করেছি, অসভ্য কোথাকার।

কিন্তু প্রজাপতিটা তখন ওর হাত থেকে পড়ে গেছে। ঠোঁট মুছতে মুছতে সেটাকে খুঁজতে গিয়ে, যেই এক পা সরেছে, অমনি প্রজাপতিটাকে পা দিয়ে চাপা দিয়ে ফেললো, বিয়ের ঠাকুর, প্রেমের দেবতাটির একেবারে স্বৰ্গলাভ, তাও শিখার পায়ের তলায় পড়ে, পেটটা একেবারে চেপটে গেছে। শিখা ডুকরে ওঠা বলতে যা বোঝায়, সেইরকম করে উঠলো। আমি বলে উঠলাম, ‘যাহ্‌ স্‌সাহ্‌!’

নিচু হয়ে সেটাকে ধরতে গিয়েও, শিখা হাত ফিরিয়ে নিয়ে এল, আমি পরিষ্কার দেখতে পেলাম, আসলে চমকে গিয়ে একটা কষ্টের ভাব হলেও, চেপটানো প্রজাপতিটাকে ধরতে ওর কী রকম বিঘনি লেগে গেছে। তবে, চেপটে গেলেও রসটস কিছু বেরোয়নি। দেখলাম, শিখা ওটাকে দেখতে দেখতে, কী রকম আনমনা হয়ে গেল, একটা যেন ভয় ভয় ভাব ওর চোখে ফুটে উঠলো, ও যে কপালে হাত ঠেকালো, নমস্কারের মত, সেটা ও নিজেই যেন জানে না। আর একটা পাখনা যে কোথায় গিয়ে পড়েছে, দেখাই গেল না। আমি এগিয়ে গিয়ে, প্রজাপতিটার পাখনা ধরে টেনে তুললাম, আস্তে আস্তে তুললাম, যাতে মেঝেতে খানিকটা আটকে না থাকে। পুরোটা তুলে, জানালার পর্দা সরিয়ে, বাইরে ফেলে দিলাম, যাহ্‌ আপদ বিদায় হল। ফেলে দিয়ে, আমি ফিরতেই শিখা বলে উঠলো, ‘তোমার জন্যই তো!’

কথাটার মধ্যে তেমন একটা রাগ ঝাঁজ যেন বিশেষ ফুটলো না, খালি একটা নালিশ মনে হল, তাও নালিশটা যে পুরোপুরি আমার ওপরেই, তাও যেন ঠিক মনে হল না। ওর মুখের ভাবটাও সেইরকমই প্রায়, তার ওপরে আবার চোখ জলে উলসে উঠবে কি না, কে জানে এক প্রজাপতি নিয়ে, সকালবেলাটা মাডার। ওর কাছে গিয়ে বললাম, ‘আচ্ছা বাপু আমার জন্যেই, যা পাপ হবে, তা আমারই, হয়েছে তো? এখন একটু চা খাওয়াও তো।’

বলতেই, ফরকে চলে গেল অন্যদিকে, যেতে যেতে বললো, ‘পারব না যাও।’ বলে একেবারে ঘরের বাইরে। উঠোনে, সেই কূয়াতলার কাছে। বাড়িটা সেকালের তো, অনেকখানি জায়গা, ফেরেব্‌বাজ মজুমদার এর নাম, কী কায়দা করেই না বাড়িটা বাগিয়েছিল, বেশ খানিকটা জায়গা, কয়েকটা গাছপালা, সীমানাটা রাঙচিতের বেড়া দিয়ে ঘেরা, বড় বড় রাঙচিতে, মানুষ ছাড়িয়ে ওঠা, বাইরের থেকে ভিতরের কিছু দেখা যায় না, আর কৃয়াটা উঠোনের এক কোণে। পদটি সরিয়ে—পদ যে এ বাড়িতে কেন আছে, কে জানে। আমাদের বাড়িতে আছে, তার একটা মানে বুঝি, এসব বাড়িতে আবার এত কিসের। পদটি সরিয়ে দেখি, শিখা নিজেই দড়ি ফেলে কুয়া থেকে জল তুলে, নিজের পায়ের ওপর ফেলে, পা দিয়ে ঘষে ঘষে ধুয়ে ফেললো। তার মানে, ওর গা ঘিনঘিন করছে, সেটা বোঝা গেল। পা ধুয়ে আবার এ ঘরেই এসে ঢুকলো, এ ঘরটাই হল ওদের বসবার ঘর, বন্ধুদের র‍্যালা রপোটের ঘরও। আমি ওদের বাপটার কথা ভাবি, লোকটা যে কখন বাড়িতে আছে, কখন নেই, কোন কাকপক্ষীও টের পায় না। আমি তো এ ঘরে কোনদিন দেখতেই পাইনি, আর যদি বা কোন সময় ঢুকতে বেরোতে দেখা হয়ে যায়, তাহলে যেন চেনানেই,শোনা নেই, আমিই বা কে, সে-ই বা কে, এমনি একটা ভাব করে চলে যায়। যেন সে বাড়ির মালিক না, ছেলেমেয়েরা তা ছেলেমেয়ে না, কে যায়, কে আসে, কোন দিকে লক্ষ্য নেই, তুমিও যা, আমিও তা-ই। ওদের দাদা দুটোও ঠিক সেইরকম, স্‌লাদের শিরদাঁড়া আছে কি না, বুঝতে পারি না। একেবারে বাপের মত না, একটু-আধটু কথা বলে, তার ওপরে আমি তো আবার দুই দাদারই সসত্ত্বর, কেননা, ওর দাদারা আমার দাদাদের দুই দলে। আমার দাদারা যখন আমার কেউ না, ওরাই বা কেন হবে। তা বলে, এক-আধটা কথা কোনরকমে বলা, যেন দেখতেই পাচ্ছে না, অথচ খুব যে একটা গোসা গোসা ভাব, তাও না, ওই ওদের বাপের মতই, নির্বিকার। যেন জানেই, আমি কার কাছে এসেছি, ওদের আমার কোন দরকার নেই; কিন্তু আমার দাদাদের বেলাও তো তা-ই, দাদারা কি ওদের কাছে আসে নাকি। দাদারা বা অন্যান্য যেসব ছেলেরা আসে, সকলেরই তো একদিকেই নজর, জানি না অবিশ্যি শিখার ছোট বোনটার দিকেও কারুর কারুর নজর আছে কি না, সেটিও বেশ তৈরী হয়ে উঠেছে, এ বছর কলেজে যেতেও আরম্ভ করেছে, তা বেশ, এ বড় মজার কল চলছে চলুক, মিস্তিরি ভাই থেম না। আমার দাদাদের সঙ্গেও যে শিখার দাদারা, এ বাড়িতে বেশী কথা বলে, তা না। দলের কথা তো অন্যখানে, এখানে ওসব বিশেষ হয় না, তবে একটা কথা তো চালু রাখা যাচ্ছে, “আমরা শিখার দাদার কাছে এসেছি। যেমন বেলাদির পুরুষ বন্ধুরা চালু রেখেছে ‘আমরা তো বেলার বাবার কাছে—হেঁ হেঁ হেঁ, মজুমদার মস্‌সাইয়ের কাছে এসসেছি। অথচ খোঁজ নিয়ে দেখ, কোন সময় কোন মজুমদারেরই পাত্তা নেই। আমার বাবা ওসব নেই, আমি শিখার কাছে আসি, কারুর বাপ দাদাদের কাছে না। কিন্তু এসব ভাবলেই, আমার মেজাজটা কী রকম গোলমাল হয়ে যায়, ভিতরটা কী রকম জুলতে থাকে, রাগে আর ঘেন্নায় মাথার ভিতরটা দপদপ করতে থাকে, আর এ সময়েই, একটা ভীষণ আক্রোশে শিখাকে ছিঁড়ে ফেলতে ইচ্ছা করে। আমি যেন এ সময়ে নিজের মনেই দেখতে পাই, সেই কৃষ্ণার মতই, শিখাকে ধরে বড়দা চুমো খাচ্ছে, না হয় সেই ঝিয়ের মেয়েটার মতই, মেজদা খামচে খামচে শিখাকে আদর করছে। আরো যারা আসে, তারাও ওইরকমই কিছু করছে, হয়তো অনেকটা আমার মতন। কোনদিন চোখে পড়লে, কাউকেই ছেড়ে কথা কইব না আমি। ছেলেবেলায় যেমন বাগানে ব্যাঙ পিটিয়ে মেরে ফেলতাম, সেভাবেই মেরে ফেলব, কিন্তু কোনদিনই কিছু চোখে পড়েনি, অথচ এরকম একটা চিন্তা আমাকে কিছুতেই ছেড়ে যেতে চায় না, যে কারণে, অন্যদের ছেড়ে, আমার নিজেকেই পিটিয়ে মেরে ফেলতে ইচ্ছা করে, মনে হয় আমাকে কেউ একটা কাঁটা খোঁচানো ফাঁদে আটকে রেখে মজা দেখছে, আর আমি মাথা কুটে মরছি সেখান থেকে বেরুবার জনো। তবু শিখাকে আমি বলতে পারি না, রাগারাগি খিস্তি-খেউর করি, সেটা না করে পারি না এক এক সময়—এই এখনই যেরকম মনের অবস্থা হয়ে উঠছে—ইচ্ছা হচ্ছে ওকে যা-তা বলে গালাগালি দিয়ে উঠি। কিন্তু একটা কোন হেস্তনেস্ত করতে পারি না, কারণ সেই যে সেই একটা ভূত চেপে আছে আমার ঘাড়ে, ‘ওর মধ্যে কী যেন একটা আছে। যেটা বেলাদিকে দেখলে কখনোই মনে হয় না। বেলাদি খারাপ জানি, তবু এক-একটা আছে না, জানছি খারাপ, বজাত বা খাণ্ডার না, নষ্ট অথচ একটা কী রকম কষ্টই হয় তাকে দেখলে। শিখা তাও না। তাও না, এও না, অথচ আমি যেন ওর কাছে যেতে যেতে কোথায় আটকে পড়ে আছি, নিজেই আটকে পড়ে আছি, নাকি শিখাই আটকে রেখেছে তাও বুঝতে পারি না। এ একটা জঘন্য পাপের মত মনে হয়।

শিখা পা ধুয়ে এসে ঘরে ঢুকলো, তখনো কাপড়টা খানিকটা টেনে তোলা, যেখানে ওর বেশ নিটোল পায়ের গোছার ওপরেই অল্প অল্প লোম দেখা যাচ্ছে, আর গোছার ওখানটা অনেক ফসা, যেন কচিলতার রঙের মত, আর তাতে অল্প অল্প লোমগুলোকে দেখাচ্ছে যেন ঠিক হালকা ছাড়া ছাড়া দুবার মতন। পা-টা ও মুছলো না, মিহি মিহি ধোয়া ভেজা পা, নখগুলো মাপ করে কাটা, তাতে দু-একদিন আগের পালিশ লাগানো দাগ এখনো রয়েছে। আলতার কোন দাগ নেই আজ, তবে মাঝে মাঝে ও আলতাও পরে। ও এসে টেবিলের কাছে, একটা কাঠের পুরনো চেয়ারে অনেকখানি চেপে বসলো, যাতে ওর পা মেঝে না ছোঁয়, আর সেইভাবে পা দুটো আস্তে আস্তে দোলাতে লাগলো, তাতে ওর কোমর বুক সবই এমনভাবে দোলা খেতে লাগলো যে—নিকুচি করেছে, কোন মানে হয় না। কিন্তু সেই নালিশ জানানো ভাবেই টেরে টেরে আমাকে দেখতে লাগলো, তখন আমি আবার চায়ের কথা বলতে গেলাম, আর তখুনি ও আবার বলে উঠলো, প্রজাপতিটা সত্যি সুন্দর ছিল।

এখন ও খানিকটা মন-মরা মন-মরা, মুষড়ে যাওয়া ভাবে যেন বললো। আমি বললাম, ‘এক কাজ কর না।’

‘কী।’

‘তোমার সেই কেশবদার দেওয়া, রুপোলি ফুটকি নীলাম্বরটা নিয়ে এস না।’

‘ওটা মোটেই কেশবদা দেয়নি, বাজে বকো না। কিন্তু ওটা দিয়ে কী হবে, শুনি?’

‘কেস্‌সবেন্দু দাদা যদি না দিয়ে থাকে, তাহলে তোমার পুন্‌নেন্দুদাদা দিয়েছে। নিয়ে এস না, ওটার থেকে খানিকটা কাপড় কেটে, একটা প্রজাপতি বানিয়ে দিচ্ছি, সেটাকেই টাঙিয়ে রেখ।’

এতক্ষণ পা দোলানি ছিল, আমার শেষের কথা শুনে ওর পা দোলানি বন্ধ হয়ে গেল। ভুরু কোঁচকালো, তারপরে ঘাড়টাকে বাঁকিয়ে বললো ‘ফাজিল, কাপড় কেটে প্রজাপতি বানাবে, না?’ বলেই, পা দুটো মাটিতে ঠেকিয়ে ঝুঁকে বললো, ‘আমার কেশবদা তোমারই বড়দা, আর আমার পূর্ণেন্দুদা, তোমারই মেজদা, সেটা ভুলে যাচ্ছ কেন।’

‘তবে আর কী, আমি একেবারে উদ্ধার হয়ে গেলাম। তবু বললে না, কে দিয়েছে শাড়িটা।’

‘ছোটলোকের মত কথা বলো না।’

‘র‍্যাশন ইনস্পেকটর অনিল তো চাল দিয়েই চালায়, কাপড়ও দেয় নাকি। ‘

শিখার প্রায় ফস মুখ এবার লাল হয়ে উঠলো, চোখ দুটোও সেইরকম। নিচু গলায়, ফুঁসে উঠে বললো, ‘ইতর।’

ও চেয়ার ছেড়ে উঠতে যাচ্ছিল, তার আগেই কাছে গিয়ে ওর কাঁধ চেপে ধরলাম! আমি হাসতেই চাইছিলাম যাতে ওকে জ্বালিয়ে খাক করে দিতে পারি, কিন্তু হাসিটা আসলে আমার দাঁতে দাঁত পেষার মতই ভিতরটা জ্বলছিল। কাঁধের ওপর থামচে ধরে এমনভাবে ওকে চেপে রাখলাম, যাতে হাজার ছটফট কবলেও নড়তে চড়তে না পারে। বললাম, যেন বেশ নরম গলায় বললাম, ‘কেন রে স্‌সিখু, আমার কথা কি সব মিথ্যা?’

বাহ্‌, নরম নরম গলায় কথা বলেও, নিজেরই মনে হল, আমি যেন বাঘের মত গর গর করে উঠলাম। শিখা রুষে উঠে মুখ তুলে আমার চোখের দিকে তাকালো। ওর চোখ দুটো ঠিক আগুনের মতই দপদপ করছে, অথচ যেন কিছু খুঁজে দেখলো আমার চোখে। নাকের পাটা ফুলে ফুলে উঠছে। সেইরকম ফুঁসে উঠে বললো, ‘তোমার মত একটা গুণ্ডাকে সে কথা আমি বলব না, নীচ কোথাকার।’

বলেই ও আমাকে আবার ঠেলে উঠতে চাইল, কিন্তু তা আমি দিচ্ছি না। এখন আমার মাথার মধ্যে যে রকম টগবগিয়ে ফুটছে, আর এরকম বাইরে কারুর সঙ্গে যদি লাগতো, তবে এতক্ষণে তার লাশ পড়ে যেত, নিদেন একটা রক্তারক্তি তো বটেই। এখানে সেরকম কিছু ঘটাতে চাইছি না, ওর লাশ ফেলে দেওয়া বা মাথাটা ফাটিয়ে দেওয়া—এই কি সেই অনশনের এক সন্ধ্যায় দেখা শিখা, কথাটা হঠাৎ একবার মনে হল, আর আমি ওর জামার মধ্যে একটা হাত টুকিয়ে দিলাম! ও আমার সেই হাতটা টেনে তুলতে চাইল কিন্তু এত শক্তি ওর নেই, তা ছাড়া এমনভাবে ধরেছি, বেশী টানাটানি করলে ওরই লাগবে—কাদা ডলে ঠেসে ছেড়ে দেব। কোথায় সুখ, স্‌সাহ্‌ কে জানে, সুখের আমি কিছু জানি না, বুঝি না, অনেকটা তো মনে হচ্ছে, বাবার টেবিলের তলায় নোংরা করে দেবার মতই যেন কিছু করছি—কেন করছি যেমন জানা ছিল না বা টেবিলের দরকারি কাগজ টেনে ছিঁড়ে দেওয়া, সেই রকম! অথচ আমি তো ওকে আদর করতেই চেয়েছিলাম। কী যে করছি, কিছুই যেন জানি না, বুঝতে পারছি না, কেবল একটা ভীষণ রাগ, ভীষণ আক্রোশ, অথচ একটা—কী বলব—অদ্ভুত যন্ত্রণা, যেন চোখে জল এসে পড়বে খুব জোরে কোথাও লাগলে, যেমন দাঁতে দাঁত চেপে রাখতে গিয়ে জল এসে পড়ে। আমি বললাম, তেমনি নরম গলাতেই, “আমি গুণ্ডা, আর সবাই ভাল, কেশব পূর্ণেন্দু অনিল……।’

কথা বলতে বলতে হাতকে আমি থামিয়ে রাখিনি, কিন্তু আমার কথা শেষ হবার আগেই, শিখা আবার একটা ঝটকা দিল, জোরে শব্দ করে কিছু বলতে গেল আর শব্দটা বেরুনো মাত্রই আমি ওর ঠোঁটে ঠোঁট চেপে দিলাম—দুটো ঠোঁট, কী তার স্বাদ কিছুই জানি না, যেন প্রাণপণ শক্তিতে কিছু একটা মুখে নিয়ে শুষতে লাগলাম, আর একটু পরেই রক্তের নোনা স্বাদ পেলাম, ঠোঁটের না মাড়ির কিছুই জানি না। শুষতে শুষতেই আমার চোখে পড়লো, শিখার চোখ দিয়ে জল পড়ছে, চোখের কোণ দিয়ে, গাল বেয়ে, আমার ঠোঁটের কষে এসে লাগছে, কিন্তু ও চোখ বুজে আছে, মুখে কষ্ট আর যন্ত্রণার ছাপ, তবু একটা হাত আমার বুকের ওপর রেখে তখনো ঠেলছে, পা দিয়ে আমার হাঁটুর কাছে ঠেলছে—যেন এর শেষ নেই, শেষ হবে না, কিন্তু—কিন্তু আমারই মনে হল, আমি পারছি না, আমার বুকের কাছে কী রকম করছে, চোখের সামনে যেন কিসের একটা পদ নেমে আসছে, আমার হাত-পায়ের জোর কমে যাচ্ছে, ঠোঁট আলগা হয়ে যাচ্ছে। আমি প্রায় গড়িয়ে পড়ে গেলাম ওর কোলের ওপর, টাইট প্যান্ট বলে, মেঝেতে হাঁটু গেড়ে পড়তে গিয়ে, পিছনে অনেকখানি পা ছড়িয়ে গেল, সেই অবস্থায শিখা উঠে দাঁড়ালো। ও যে হাঁপাচ্ছে, আমি তা শুনতে পাচ্ছি, কাছেই দাঁড়িয়ে আছে, তাও টের পাচ্ছি। আমিও হাঁপাতে হাঁপাতে কয়েক সেকেণ্ড পরেই ঠেলে উঠলাম, আর তৎক্ষণাৎ শিখা ঘর ছেড়ে বেরিয়ে গেল, যাবার আগে মনে হল, এক হাতে মাথার চুল ঠিক করতে করতে আর এক হাতে শাড়ির আঁচল দিয়ে ঠোঁট মুছে মুছে কী যেন দেখছিল—বোধহয় রক্ত।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *