০১. প্রমীলা কেন পুরুষ ভজে?

প্রমীলা কেন পুরুষ ভজে?

(বিঃদ্রঃ ভালো করে প্রুফরীড করা হয়নি।)

মেয়েরা কেন পুরুষ ভজে। মনে হবে এ প্রশ্নটা খুবই সোজা ও সরল। কিন্তু তা মোটেই নয়। প্রশ্নটা অত্যন্ত কুটিল ও জটিল। কেননা, এ প্রশ্নের অন্তরালে নিহিত আছে আরও অনেক আমুষঙ্গিক প্রশ্ন। যথা, পুরুষ-ভজন করতে গিয়ে মেয়ের কেন পুরুষের আধিপত্য মেনে নেয়? আগেকার দিনের কথা ছেড়েই দিলাম। তখন তো মেয়ের ছিল অবলা ও অসহায়। অভিভাবক বা গুরুজনরা যা বলতেন, তারাও তাই করত। কিন্তু আজকের দিনে তো মেয়েরা শিক্ষিতা হয়েছে। অনেকে স্বাবলম্বীও হয়েছে। তা সত্ত্বেও তারা কেন পুরুষের আধিপত্য মেনে নেয়? অনেকে হয়ত বলবেন, এটা এক মাদিম অভিশাপ। কেননা, মেয়ের এক যৌনবুভুক্ষ নিয়েই ধরাপুষ্ঠে আবির্ভূত হয়েছিল। সেই আদিম যৌনক্ষুধার জন্যই মেয়ের পুরুষের সঙ্গ চায়। আদিম যৌনক্ষুধা নিবৃত্তির জন্যই যদি মেয়েরা এরূপ করে, তাহলে প্রশ্ন জাগে মেয়ের পুরুষের আধিপত্য না মেনে সেটা করতে পারে কিনা। আর আমরা যদি মনে করি মেয়েদের আদৌ কোনো সহজাত আদিম যৌনক্ষুধা নেই, তবে পুরুষের আধিপত্য মেনে নিয়ে তাদের দাম্পত্যজীবন যাপনের প্রয়োজন হয় কেন? হয়ত অনেকে বলবেন দম্পত্যজীবনে প্রবৃত্ত না হলে মেয়ের জীবনে একটা নিঃসঙ্গতা ও শূন্যত অনুভব করে সে কথা বললে স্বাভাবিকভাবেই প্রশ্ন ওঠে, সেটা বৈধ উপায়ে, না অবৈধ উপায়ে করা উচিত? জগতের প্রায় সব সমাজই চায় যে মেয়ে-পুরুষের যৌনজীবন বৈধ উপায়ে পালিত হওয়া উচিত। বৈধ উপায়ে যৌনজীবন পালন করা মানেই বিবাহে প্রবৃত্ত হওয়া। এ সম্পর্কেও প্রশ্ন অজস্র। বিবাহের পূর্বে অধিকাংশ মেয়েই তার জীবনসঙ্গী সম্বন্ধে নানারকম স্বপ্ন দেখে। কিন্তু বাস্তবজীবনে সে কল্পলোকের স্বপ্ন তো অধিকাংশ ক্ষেত্রেই স্বপ্নবিলাসে পরিণত হয়। কিন্তু তা সত্ত্বেও তারা পিতামাতা বা অভিভাবক কর্তৃক নির্বাচিত স্বামীর সঙ্গে মুখে ঘরকন্না করে কেন? আবার অনেক ক্ষেত্রে দেখা যায়, অভিভাবকের সম্মতিক্রমেই হোক বা বিনা সম্মতিতে হোক মেয়েরা যে স্ব-নির্বাচিত পুরুষকে বরণ করে, সেক্ষেত্রেও তাদের দাম্পত্যজীবন অসুখকর হয়। অনেক স্থলে আবার দেখা যায় যে, সুন্দরী মেয়ে কুৎসিত পুরুষকেই ভজনা করে। কেন? যেমন ভেসডেমন ওথেলোকে ভজন করেছিল। আবার কোনো কোনো ক্ষেত্রে মাতৃস্থানীয়া প্রৌঢ়া রমণী কেন প্রলুব্ধ হয় অল্পবয়স্ক তরুণকে বিবাহ করতে অথবা তার সঙ্গে দাম্পত্যজীবন যাপন করতে? প্রথম বিদ্রোহী নারী জর্জ সাদ-এর (George Sand) জীবনে তো এটা বারংবার ঘটেছিল। প্রখ্যাত ফরাসী ঔপন্যাসিক বালজাকের (Honor de Balzac) জীবনেও তাই। বালজাক তে দেখতে কুৎসিতই ছিল, কিন্তু তা সত্ত্বেও নয় ছেলের মা ৪৫ বছরের প্রৌঢ় মাদাম বার্নি কেন ২৩ বছর বয়সের বালজাককে বিয়ে করেছিল? আবার সেই কুৎসিত ও দেনার দায়ে নিষ্পেষিত বালজাকের জীবনেই ঘটেছিল আর-এক বিচিত্র ঘটনা। চিকিৎসকদের কাছে বালজাকের মৃত্যু আসন্ন ও সুনিশ্চিত শুনেও তার মৃত্যুর মাত্র ছ’মাস পূর্বে ঐশ্বর্যশালিনী ইভেলিন তাকে কেন বিবাহ করেছিল? এরকম বৈসাদৃশ্য থাকা সত্ত্বেও তারা তো পরস্পরের কাছে প্রেম নিবেদন করেছিল। উপন্যাসের জগতেও আমরা মেয়ে-পুরুষের অনুরূপ আচরণ দেখি। বিমল মিত্রের ‘কড়ি দিয়ে কিনলাম’ উপন্যাসে লক্ষ্মীর মত মার্জিতরুচিসম্পন্ন মেয়ে স্বামী দাতারবাবুর উপস্থিতিতেই কেন সুধাংশুর মত চরিত্রহীনের অঙ্কশায়িনী হয়েছিল? আবার তারই সহোদর সতী শ্বশুরবাড়ির অমানুষিক নির্যাতন সত্ত্বেও কেন স্বামীর কণ্ঠলগ্ন হয়েছিল এবং ঘোষালসাহেবের মত লম্পটের কামলালসার গ্রাস থেকে নিজেকে মুক্ত করবার জন্য চলন্ত ট্রেনের চাকার তলায় প্রাণ বিসর্জন দিয়েছিল? আবার শরৎচন্দ্রের পথের দাবী’-তে আমরা দেখি শশীর মত বেহালাবাদক শিল্পীকে ছেড়ে নবতারা কেন এক কারখানার মিস্ত্রিকে বিবাহ করেছিল? এরকম অগণিত প্রশ্ন নিহত আছে ‘মেয়েরা কেন পুরুষ ভজে?—এই প্রশ্নের পিছনে। এসব প্রশ্নের উত্তর মেয়েদেরই দেওয়া উচিত, আমার মত ৮৪ বছর বয়সের পুরুষের নয়। কেননা, পুরুষ প্রমীলাকে কতটুকু চেনে? মনে রাখতে হবে যে, যুগে যুগে নারী নির্যাতিত হয়েছে পুরুষের হাতে, অথচ নারী প্রেম ও সোহাগ দ্বারা পুরুষকে বেঁধে রাখতে চেয়েছে নিজের সান্নিধ্যে। হয়ত অনেকসময় সামাজিক নিন্দার ভয়ে নারী এরূপ প্রেম ও সোহাগের অভিনয় করে যায় এবং প্রকৃতপক্ষে তার মনের অন্তস্তলে অস্তঃসলিলার মত প্রবাহিত হয় অন্তরূপ ভাবনা-চিন্তা। তাহলে সেক্ষেত্রে নারী তো পুরুষের কাছে ছলনাময়ী ও রহস্যময়ী হয়ে দাড়ায়। তাই বলছিলাম, প্রমীলা কেন পুরুষ-ভজনা করে, এ প্রশ্নের উত্তর প্রমীলারই দেওয়া উচিত, কোনো পুরুষের নয়। কেননা, পুরুষ তে শত চেষ্টা করলেও প্রমীলার অবচেতন মনের গভীরে পৌছোতে পারবে না। তবুও আমি পুরাণ, ইতিহাস, বিজ্ঞান, নৃতত্ত্ব, উপন্যাস ও বাস্তব জীবনের সাহায্যে এ প্রশ্নের উত্তর দিতে চেষ্টা করব।

***

নারী কেন পুরুষ-ভজন করে, এ প্রশ্নের উত্তর পেতে হলে আমাদের প্রথমেই যেতে হবে সৃষ্টির সেই প্রথম দিনে, যেদিন সৃষ্ট নারী প্রথম পুরুষকে ভজনা করেছিল। এ সম্বন্ধে খ্রীস্টান পুরাণের সঙ্গে হিন্দু পুরাণের মতানৈক্য আছে। খ্রীস্টান পুরাণ অনুযায়ী ঈশ্বর পুরুষ ও নারী সৃষ্টি করে তাদের ছেড়ে দিয়েছিলেন স্বর্গের উদ্যানে বিচরণ করতে। তবে তিনি চাননি তাদের মধ্যে যৌনতৃষ্ণার উন্মেষ ঘটুক। সেজন্য তিনি নিষেধ করে দিয়েছিলেন তারা নিষিদ্ধ বৃক্ষের ফল যেন না খায়। কিন্তু নারী তো চির-কৌতুহলী। এক অদম্য কৌতুহলী মন নিয়ে সে জন্মগ্রহণ করেছে। তার সমগ্র সত্তাকেই আচ্ছন্ন করে আছে এই কৌতুহলী মন। সেই সহজাত কৌতুহলের বশীভূত হয়েই প্রথম নারী ইভ আস্বাদন করেছিল সেই নিষিদ্ধ বুক্ষের ফল। পরিণামে যা ঘটেছিল তা সকলেরই জানা আছে। সেটা তো অভিশাপ হয়েই দাঁড়িয়েছিল। স্বর্গ থেকে পৃথিবীতে পতন, যৌনমিলনের আকাঙ্ক্ষার উন্মেষ ও প্রজাসৃষ্টি।

কিন্তু হিন্দু পুরাণে প্রথম নারী এরকম কোন নিষেধাজ্ঞ দ্বারা শৃঙ্খলিত হয়নি। স্মৃষ্টির সূচনাতেই তারা স্রষ্টা কর্তৃক আদিষ্ট হয়েছিল ‘তোমরা উভয়ে রমণে প্রবৃত্ত হয়ে প্রজাস্বষ্টি কর।’ হিন্দু পুরাণে আছে জীবন-বিজ্ঞানের এক পরম সত্যের কথা। আদিতে স্ত্রী-পুরুষ বিভেদ ছিল না। বায়োলজিতেও আমরা সেই কথাই পড়ি আদিতে তাদের ইনফিউসরিয়া, অ্যামেব, স্পরোজেয়ান প্রভূতি এককোষীয় রূপ ছিল। তাদের যৌনজীবন ছিল না। এককোষগুলিই শতধা হয়ে সৃষ্টি বজায় রাখত। তারপর আসে স্ত্রী-পুরুষ বিভেদ ও যৌনজীবন। হিন্দু পুরাণ অনুযায়ী আদিতে স্রষ্টার নিজের কোনো যৌন-সত্তা ছিল না। স্রষ্ট হচ্ছেন প্রজাপতি ব্ৰহ্ম। তিনি প্রথম সৃষ্টি করেছিলেন সনৎকুমার, সনন্দ, সনক, সনাতন ও বিভু নামক পাঁচ ঋষিকে। তখন ষ্ট্রপুরুষ বিভেদ ছিল না বলে তাদের থাকতে হয়েছিল উধ্বরেতা হয়ে। সে অবস্থায় তো প্রজাসৃষ্টি হয় না। তাই ব্রহ্ম নিজেকে দু’ভাগে বিভক্ত করলেন। তাঁর এক অংশ পুরুষ ও অপর অংশ নারী হল। পুরুষের তিনি নাম দিলেন মনু, আর নারীর নাম দিলেন শতরূপা। তারা ব্ৰহ্মাকে জিজ্ঞাসা করল—‘পিতঃ, কোন কর্মের দ্বারা আমরা আপনার যথোচিত সেবা করব?’ ব্রহ্মা বললেন, ‘তোমরা মৈথুন কর্ম দ্বারা প্রজা উৎপাদন কর। তাতেই আমার তুষ্টি।’ তখন থেকে মৈথুন কর্মের প্রবর্তন হল। মনু ও শতরূপার পুত্রকন্যা থেকেই মানবজাতির বিস্তার হল।

***
দক্ষিণেশ্বরের ঠাকুর কামিনী-কাঞ্চন ত্যাগ করতে বলেছিলেন। তন্ত্রমতে নারীর দুই স্বরূপ—কামিনী ও জননী। শেষের স্বরূপটাই ঠাকুর গ্রহণ করেছিলেন সারদামণি সম্পর্কে। কিন্তু একই নারীর আরএকটা স্বরূপ আছে বলে তিনি সংসারী ভক্তদের পরিহার করেননি। যাদের পক্ষে নৈতিক হিসাবের স্ত্রী ও জননী পৃথক সংস্কার, তাদের পক্ষে এ ধারণা করা খুবই কঠিন। একজন ভৈরবের কথায় বলি–মাতৃভাবই বলে আর কামিনীভাবই বলো, দুই তো আরোপিত ভাব, আসলে তো সে একই কামিনীর দুই রূপ বা ভাব। গোড়াতেই তো প্রকৃতি কামিনী, সৃষ্টিতে সম্ভোগার্থেই তার সার্থকতা। তারপর যখন সৃষ্টি হয়ে গেল, সেই স্থষ্ট জীবের অসহায় ও তুর্বল অবস্থায় তার লালনপালন ও বৃদ্ধির জন্যই তো জননী-ভাবটি। নারীমাত্রই পরমাপ্রকৃতি, আদ্যাশক্তির অংশ। মনুষ্যসমাজের একটা নৈতিক সংস্কারকে সনাতন সত্য বলে মেনে নিলে তত্ত্বের দিক থেকে সত্য উদ্ধার করা অসম্ভব হবে। প্রকৃতির আসল ভাব অতি গুহ, অনির্বচনীয়। কেবলানন্দময়ী ভাব। তার বর্ণনা নেই। এজন্যই পরমহংসদেব একসময় মা-ঠাকরুনকে জিজ্ঞাসা করেছিলেন—“আমি তোমার কে? সে প্রশ্নের উত্তর তিনি নিজেই দিয়েছিলেন। বলেছিলেন, ‘তুমি আমার আনন্দময়ী গে৷’

***

এক কথায়, নারী আনন্দময়ী | কামিনী হিসাবেও সে আনন্দময়ী। জননী হিসাবেও সে আনন্দময়ী। কামিনীরূপে নারী স্মৃষ্টির অধিষ্ঠাত্রী; জননীরূপে নারী সৃষ্ট জীবের পালয়িত্রী। সেজন্যই অন্যান্য প্রাণীর তুলনায় মানুষের ক্ষেত্রে একটা ব্যতিক্রম দেখি। অন্যান্ত প্রাণীর ক্ষেত্রে আমরা দেখি সন্তান-উৎপাদনের জন্য যৌনমিলনের একটা বিশেষ ঋতু আছে। মাত্র সেই ঋতুতেই তাদের মধ্যে যৌনমিলনের আকাঙ্ক্ষা জাগে। তখন স্ত্রী ও পুরুষ একত্রে মিলিত হয়ে সন্তান-উৎপাদনে প্রবৃত্ত হয়। পশুজগতে সন্তান-উৎপাদন এভাবে সীমিত না হলে সমস্ত পৃথিবীই তো পশুতে ভরে যেত। সেটা প্রকৃতির অভিপ্রেত নয়। অন্তপক্ষে মানুষই শ্রেষ্ঠ জীব। মানুষই জগৎ পরিপূর্ণ করুক—এটাই প্রকৃতির অভিপ্রেত। সেজন্যই মনুষ্যসমাজে সন্তান-উৎপাদনের জন্য কোনো নিদিষ্ট ঋতু নেই। মানুষের ক্ষেত্রে সৃষ্টির উদ্দেশ্যে যৌনমিলনের বাসনা সকল ঋতুতেই জাগ্রত থাকে। এটা প্রকৃতির নির্দেশ। মানুষের ক্ষেত্রে নারীদেহ যেসব যৌন হরমোন (oestrogen) দ্বারা গঠিত হয় তাতে নারীর মনে যৌনমিলনের আকাঙ্খা (oestrus) সবসময়েই জাগ্রত থাকে। সেজন্যই নারী সবসময়েই পুরুষের সান্নিধ্য কামনা করে। এক কথায়, মানুষের মধ্যে স্ত্রী-পুরুষের পরস্পরের সান্নিধ্যে থাক। এক সহজাত প্রবৃত্তি। সুতরাং কামিনী হিসাবে নারীর আনন্দময়ী হবার পিছনে একটা বৈজ্ঞানিক কারণ আছে। আর জননী হিসাবে নারী আনন্দময়ী হয়ে যে বিরাজমান থাকে, তার পিছনেও বৈজ্ঞানিক কারণ বিদ্যমান। সে কারণটা হচ্ছে বায়োলজিক্যাল বা জীবজনিত। কারণ। শিশুকে লালনপালন এবং স্বাবলম্বী করে তুলতে অন্ত প্রাণীর তুলনায় মানুষের অনেক বেশি সময় লাগে। এ-সময় প্রতিপালন ও প্রতিরক্ষণের জন্য নারীকে পুরুষের আশ্রয়ে থাকতে হয়। এর জন্যই পরিবার-গঠনের প্রয়োজন হয়। মনে করুন, অন্য প্রাণীর মত যৌনমিলনের অব্যবহিত পরেই স্ত্রী-পুরুষ যদি পরস্পর থেকে বিচ্ছিন্ন হ’ত, তাহলে মনুষ্যসমাজে মা ও সন্তানকে কতই না বিপর্যয়ের সম্মুখীন হতে হ’ত।

***

প্রসঙ্গত আগের অনুচ্ছেদে আমরা নারীদেহে বিশেষ যৌন হরমোন বা oestrogen থাকার কথা বলেছি। নারীদেহে এসব যৌন হরমোন থাকার দরুন নারীমনে শুধুমাত্র যে যৌনমিলনের বাসনা শাশ্বত থাকে, তা নয়। নারীর সমস্ত দেহগঠনের ওপর এবং বিশেষ করে নারীদেহের আনুষঙ্গিক (secondary) বৈশিষ্ট্য প্রকাশের ওপরও এর প্রভাব বিস্তারিত হয়। এই প্রভাবের দরুনই নারীদেহ পুরুষদেহ থেকে পৃথকভাবে গঠিত হয়। তবে কতকগুলি গ্রস্থি বা glands-ও—এই বৈশিষ্ট্য রচনায় সাহায্য করে। প্রধান বৈশিষ্ট্য হচ্ছে যৌনযন্ত্রের। সন্তান ছেলে না মেয়ে সেটা প্রকাশ পায় তার জন্মের সঙ্গে সঙ্গে। সেটা যোনি-চিহ্ন থেকেই বুঝতে পারা যায়। কিন্তু সেটা বাহ্যিক চিহ্নমাত্র। গুরুত্বপূর্ণ পার্থক্য নারীদেহের অভ্যন্তরে গ্রথিত থাকে। নারীদেহের অভ্যন্তরে যে সহজাত বৈশিষ্ট্যমূলক যন্ত্র থাকে, তা হচ্ছে ডিম্বাশয় (ovary) ও গর্ভাশয় বা জরায়ু (uterus)। দশ-বারো বছর বয়স পর্যন্ত, তার মানে প্রথম রজঃনিঃসরণের সময় পর্যন্ত ছেলে ও মেয়েরা নিজেদের পরস্পরের সমকক্ষ মনে করে। সে সময় পর্যন্ত তারা পরস্পরের সঙ্গে স্বচ্ছন্দে মেলামেশা ও খেলাধুলা করে এবং দৈহিক শক্তি প্রদর্শনে পরস্পর পরস্পরের সঙ্গে প্রতিযোগিতা করে। কিন্তু তারপর যখন আনুষঙ্গিক লক্ষণসমূহ  (secondary characters) প্রকাশ পায়, তখন তারা বুঝতে পারে যে তারা পরস্পরের সমকক্ষ নয়। মেয়েদের এ-সকল আনুষঙ্গিক লক্ষণ হচ্ছে মাসিক রজঃনিঃসরণ, স্তনের স্ফীতি এবং সন্তান-প্রজননের পর সেই ফাত-স্তন ছদ্ধভাণ্ডারে পরিণত হওয়া, মুখমণ্ডলে কেশের অভাব ইত্যাদি। অপরপক্ষে, পুরুষের এরূপ মাসিক রজঃনিঃসরণ হয় না, স্তনের স্ফীতি ঘটে না এবং মুখমণ্ডল কেশাচ্ছন্ন হয়।

জরায়ুই হচ্ছে মেয়েদের প্রধান গুরুত্বপূর্ণ যন্ত্র, কেননা এরই মধ্যে ভ্রূণোদ্গম হয়ে শিশু তার অবয়বের পূর্ণতা পায়। প্রতিবার মাসিক রজঃনিঃসরণের সময় ডিম্বাশয় থেকে ডিম্বাণু নির্গত হয়। সে সময় যৌনমিলনের ফলে পুরুষের শিশু-নির্গত শুক্রাণু ডিম্বাণুকে নিষিক্ত বা ফলবতী করে। তখন সেই নিষিক্ত ডিম্বাণু জরায়ুর মধ্যে প্রবেশ করে ভ্রূন স্মৃষ্টি করে।

সুতরাং জরায়ু ও ডিম্বাশয় নারীদেহে এক বায়োলজিক্যাল কারখানা-বিশেষ। এ কারখানার মালিকানা-স্বত্ব একমাত্র নারীর। কিন্তু এ কারখানা সম্পূর্ণ অচল ও অকৰ্মণ্য অবস্থায় থাকে যদি-না সে পুরুষের সংস্পর্শে আসে। সেজন্য জননী হতে হলে নারীকে সম্পূর্ণ পুরুষনির্ভর হতে হয়।

অবশ্য মেয়েরা মুখ্যভাবে পুরুষনির্ভর না হয়েও জননী হতে পারে। সেটা নলের (test tube) সাহায্যে। কিন্তু সেরূপ ক্ষেত্রে নলজাতককে নিয়ে নানারূপ উৎকট সামাজিক সমস্ত উঠতে পারে। যথা, সে শিশুর প্রকৃত পিতা কে? সে শিশু বৈধ, না অবৈধ? সোশিওলজিক্যালি সে শিশু হয়ত বৈধ, কিন্তু আদালত বলবে যে বায়োলজিক্যালি সে-শিশু অবৈধ। তাহলে সে-শিশুকে তো ললাটে জারজ সন্তানের কালিমা নিয়েই জন্মগ্রহণ করতে হয়।

***

মানুষের আবির্ভাবের দিন থেকেই তো মেয়ের পুরুষ ভজছে। সে কত দিন? মানুষের প্রথম আবির্ভাব ঘটে আজ থেকে প্রায় পাঁচ লক্ষ বৎসর পূর্বে। আবির্ভাবের সময় থেকেই মানুষকে দুই সমস্যার সম্মুখীন হতে হয়েছিল—আত্মরক্ষা ও খাদ্যসংগ্রহের সমস্যা। মানুষকে বলা হয় . বুদ্ধিসম্পন্ন জীব বা homo sapiens | কিন্তু গোড়া থেকেই মানুষকে আত্মরক্ষা ও খাদ্যসংগ্রহ-সমস্যার সম্মুখীন হতে হয়েছিল বলে তার সমাধানের জন্য তাকে কারিগর বা homo faber-ও হতে হয়েছিল। ফলমূল ছাড়া তার প্রধান খাদ্য ছিল মাংস। মাংস আহরণের জন্য তাকে পশুশিকারে বেরুতে হ’ত। পশুশিকার ও আত্মরক্ষা-এই উভয়ের জন্যই তাকে আয়ুধ তৈরি করতে হত। এ আয়ুধগুলো মানুষ পাথর দিয়ে তৈরি করত। আয়ুধগুলো পুরুষরাই তৈরি করত। তাতে মেয়েদের কোনো ভূমিকা ছিল না। সেজন্যই প্রথম মানুষের বৈষয়িক জীবনে পুরুষের প্রাধান্ত এসে পড়েছিল। যেহেতু একমাত্র পুরুষই হচ্ছে homo faber ও বৈষয়িক কর্মকাণ্ডের হর্তাকর্তা, সেহেতু নারীকে পুরুষের প্রাধান্ত স্বীকার করে নিয়ে পুরুষের বশীভূত হয়ে থাকতে হত। নারীর তখন মাত্র একটাই সত্তা ছিল। সেটা হচ্ছে তার বায়োলজিক্যাল সত্তা। আর পুরুষের ছিল ছুটে সত্তা—বায়োলজিক্যাল ও বৈষয়িক বা ইকনমিক সত্তা। পুরুষের এই শ্রেষ্ঠত্বের জন্যই নারী তখন থেকেই পুরুষভজনা শুরু করে।

তাহলে দেখা যাচ্ছে যে, নারী পুরুষ-ভজনা করতে শুরু করেছিল দুই কারণে। প্রথমত, তার বায়োলজিক্যাল সত্তাকে রূপায়িত করবার জন্য সন্তান-উৎপাদনে পুরুষের সহযোগিতা। আর দ্বিতীয়ত, নারীকে ও তার সন্তানদের পুরুষ রক্ষা করে এবং তাদের জন্য খাদ্যসংগ্রহ করে দেয়। সেজন্য নারীর কাছে পুরুষ নমস্ত হয়ে দাড়ায় এবং নারী তার প্রেম ও সোহাগ দিয়ে পুরুষকে নিজ সান্নিধ্যে বেঁধে রাখতে সচেষ্ট হয়। নারী তার বায়োলজিক্যাল সত্তা নিয়েই ব্যস্ত থাকে। তাতেই তার সন্তুষ্টি। তাতেই তার আনন্দ।

পাঁচ লক্ষ বৎসর পূর্বে তার আবির্ভাবের সময় থেকে চার লক্ষ নব্বই হাজার বৎসর পর্যন্ত নারী এভাবেই পুরুষের বশীভূত হয়ে থাকে। এই চার লক্ষ নকবই হাজার বৎসরকে প্রত্নপলীয় যুগ বলা হয়। তারপর নবপলীয় যুগের সূচনা হয়। নবপলীয় যুগেই নারীর বায়োলজিক্যাল সত্তা ছাড়া আর একটা সত্তা প্রকাশ পায়। এটা হচ্ছে তার বৈষয়িক বা ইকনমিক সত্তা। এটা কী ভাবে ঘটেছিল তা এবার বলছি।

আগেই বলেছি যে, প্রত্নপলীয় যুগে মানুষের প্রধান খাদ্য ছিল পশুমাংস। পশুশিকার ছিল পুরুষের কর্ম। পশুশিকারের জন্য তাকে স্থান থেকে স্থানান্তরে যেতে হ’ত এজন্য সে-যুগের মানুষ ছিল যাযাবর। কোনো এক জায়গার পশুসম্পদ নিঃশেষিত হলে তাকে আবার নতুন জায়গায় যেতে হ’ত। অনেকসময়ে শিকারে বেরিয়ে পড়ার পর পুরুষের ফিরতে দেরি হত। এরকম সময়ে মেয়েরা ক্ষুধার তাড়নায় গাছের ফল, এবং ফলাভাবে বহু অবস্থায় উৎপন্ন খাদ্যশস্য খেয়ে প্রাণধারণ করত। তারপর মেয়েদের ভাবনা-চিন্তায় স্থান পায় এক কল্পনা। সন্তান-উৎপাদনের প্রক্রিয়া তাদের জামাই ছিল। যেহেতু ভূমি বন্য অবস্থায় শস্য উৎপাদন করে, সেইহেতু তারা ভূমিকে মাতৃরূপে কল্পনা করে নেয়। যুক্তির আশ্রয় নিয়ে তারা ভাবতে থাকে— পুরুষ যদি নারীরূপ-ভূমি (আমাদের সমস্ত ধর্মশাস্ত্রেই মেয়েদের ‘ক্ষেত্র’ বা ভূমি বলে বর্ণনা করা হয়েছে) কর্ষণ করে সন্তান উৎপাদন করতে পারে, তবে মাতৃরূপ-পৃথিবীকে কর্ষণ করে শস্ত উৎপাদন করা যাবে না কেন? তখন তারা পুরুষের লিঙ্গস্বরূপ এক যষ্টি বানিয়ে নিয়ে ভূমিকৰ্ষণ করতে থাকে। এখনও পৃথিবীর অনেক আদিম জাতি এরূপ কর্ষণ-যষ্টি দ্বারাই ভূমি কর্ষণ করে। Przyluski তার ‘Non-Aryan Loans in Indo-Aryans’ প্রবন্ধে দেখিয়েছেন যে ‘লিঙ্গ’, ‘লাঙ্গুল’ ও ‘লাঙ্গল’ এই তিনটি শব্দ একই ধাতুরূপ থেকে উৎপন্ন। মেয়ের এইভাবে ভূমিকৰ্ষণ করে শস্য উৎপাদন করল। যখন ফসলে মাঠ ভরে গেল তখন পুরুষরা তা দেখে অবাক হল। লক্ষ্য করল যষ্টি হচ্ছে passive, আর ভূমিরূপী পৃথিবী ও তাদের মেয়েরা হচ্ছে active। Active মানেই হচ্ছে শক্তির আধার। ফসল তোলার পর যে প্রথম নবান্ন উৎসব হল, সেই উৎসবেই জন্ম নিল লিঙ্গ ও ভূমিরূপী পৃথিবীর পূজা। এ সম্বন্ধে Clodd তার ‘Animism’ গ্রন্থে বলেছেন, ‘…in earth worship is to be found the explanation of the mass of rites and ceremonies to ensure fertilization of the crops and cattle and woman herself.’

(কী ভাবে লিঙ্গ ও শক্তিপূজার উদ্ভব হল, সে সম্বন্ধে বিশদ বিবরণ ও ব্যাখ্যা অবগত হবার জন্য বর্তমান লেখকের ‘Pre-Aryan Elements in Indian Culture’ দ্রষ্টব্য।)

কৃষির উদ্ভবের পরই মানুষ তার যাযাবর জীবন ছেড়ে দিয়ে স্থায়ী বসবাস শুরু করল। গ্রাম, এবং গ্রামের পর নগরের পত্তন ঘটল। মেয়েরা শুধু কৃষিরই উদ্ভব ঘটালো না, তারা বয়নবিদ্যা দ্বারা ঝুড়িচুপড়ি থেকে আরম্ভ করে বস্ত্রবয়ন পর্যন্ত আরম্ভ করল। ঋগ্বেদের ষষ্ঠ মণ্ডলের প্রথম সূক্তে বলা হয়েছে : ‘মেয়েরাই বস্ত্রবয়ন করতে জানে, আমরা জানি না।’ অনেক নৃতত্ত্ববিদ বলেন যে, কুলালের কাজও মেয়েরাই প্রথম শুরু করেছিল। এক কথায়, সভ্যতার সূচনা মেয়েদের দ্বারাই সম্পাদিত হয়েছিল। এসবই ঘটেছিল নবপলীয় যুগে।

***

মেয়েরা এখন আর মাত্র বায়োলজিক্যাল জীব নয়। তারা কৃষ্টির জগতে ঘটাল এক বিস্ফোরণ। মানুষের জীবনের জয়যাত্রার পথে তারা হয়ে দাড়াল পুরুষের সক্রিয় সহযাত্রী। তারা এখন শক্তিরূপেণ সংস্থিতা। সে সম্বন্ধে তাদের মধ্যে অনেকে সচেতন হয়ে উঠল। তাদের মধ্যে কেউ কেউ রব তুললো—“আমাদের দাবি মানতে হবে। কিসের দাবি? কর্ষিত ভূমির দাবি। তারা বললো, যেহেতু তারাই ভূমি কর্ষণ করে ফসল উৎপাদন করেছে, ভূমির মালিকান-স্বত্ব তাদের। তারা আরও বললো, যেহেতু ইহজগতে মাতাই সন্তানকে প্রসব করে এবং মাতাই সন্তানকে লালন-পালন করে, সেইহেতু সন্তানও মায়ের। প্রথম প্রথম পুরুষদের সে দাবি মেনে নিতে হল। এইভাবে উদ্ভূত হল মাতৃকেন্দ্রিক (matrilineal) সমাজ, অর্থাৎ যে সমাজে উত্তরাধিকার ও বংশপরিচয় মাতার দিক দিয়েই নিণীত হয়। এরূপ সমাজ বিক্ষিপ্তভাবে জগতের নানা জায়গায় ছড়িয়ে আছে। এসব সমাজে পারিবারিক সম্পত্তির উত্তরাধিকার মাতাকে ধরেই নেমে আসে। অর্থাৎ পারিবারিক সম্পত্তির মালিকানাস্বত্ব হয় মায়ের। মায়ের মৃত্যুর পর সে সম্পত্তি পায় মেয়ে, ও তারপরে মেয়ের মেয়ে। জগতের দু-চার জায়গায় এরূপ সমাজের অস্তিত্ব লক্ষ্য করে উনবিংশ শতাব্দীতে সুইটজারল্যাণ্ডের নৃতত্ত্ববিদ বাখোফেন (১৮১৫-৮৭) সিদ্ধান্ত করেছিলেন যে, মানুষের বিবর্তনের ইতিহাসে একসময় মাতৃশাসিত সমাজ (matriarchal society) ছিল। অর্থাৎ তখন মেয়েরাই পুরুষের ওপর আধিপত্য করত। কিন্তু পরবর্তীকালের নৃতত্ত্ববিদরা এ মতবাদ বাতিল করে দিয়েছেন। তাঁরা বলেন, মানুষের সামাজিক বিবর্তনের ইতিহাসে কোনে সময়েই মাতৃশাসিত বা নারীশাসিত সমাজ ছিল না। যা ছিল এবং এখনও কোথাও কোথাও দেখতে পাওয়া যায়, তা হচ্ছে মাতৃকেন্দ্রিক (matrilineal) সমাজ। এসব সমাজে উত্তরাধিকার বংশপরম্পরায় মাতাকে ধরেই নেমে আসে। এরকম সমাজ আমাদের দেশে কেরল-এ নায়ারদের মধ্যে প্রচলিত আছে। কিন্তু এসব সমাজে পরিবার বা গোষ্ঠীর ওপর আধিপত্য থাকে পুরুষের (মাতার ভ্রাতার), মেয়েদের নয়। বলা যায়, পরিবার বা গোষ্ঠী মাতৃশাসিত হয় না, কেবল পারিবারিক বা গোষ্ঠীগত সম্পত্তির মালিকানা মাতৃগত হয়। এসব সমাজের বিবাহপদ্ধতি লক্ষ্য করলেই এটা বুঝতে পারা যায়; আমি এখানে কেরল-এর মাতৃকেন্দ্রিক নায়ার সমাজের বিবাহপদ্ধতির বর্ণনা দিচ্ছি। নায়াররা ক্ষত্ৰিয়। নায়ার কুমারীদের যৌবনারস্তের সঙ্গে সঙ্গে নিজ জাতির কোনো নির্দিষ্ট গোষ্ঠীভুক্ত পুরুষের সঙ্গে বিবাহ হয়। পরে এই বিবাহের বিচ্ছেদ ঘটিয়ে নায়ার মেয়েরা পিতৃকেন্দ্রিক নাম্বুদ্রি ব্রাহ্মণদের সঙ্গে এক বিচিত্র যৌনসম্পর্কে আবদ্ধ হয়। এরূপ সম্পর্ককে ‘সম্বন্ধম” বলা হয়। ‘সম্বন্ধম’-সম্পর্ক অবিনশ্বর নয়। অনেকসময় কোনো কোনো নায়ার রমণীকে পর পর দশ-বারো জন নাম্বুদ্রি ব্রাহ্মণের সঙ্গে ‘সম্বন্ধম’-সম্পর্ক স্থাপন করতে দেখা যায়। এখানে বলা দরকার, প্রথম বিবাহের পর নায়ার রমণী কখনও তার স্বামীর পরিবারে বাস করতে যায় না। স্বামীই স্ত্রর পরিবারে কখনও কখনও রাত্রিবাস করতে আসে। আবার যখন সম্বন্ধম’-সম্পর্ক স্থাপিত হয়, তখনও নায়ার রমণী কখনও তার নাম্বুদ্রি প্রণয়ীর গৃহে বাস করতে যায় না। নাম্বুদ্রি ব্রাহ্মণও কখনও তার নায়ার প্রণয়িনীর গৃহে বাস করতে আসে না। সাধারণত নাম্বুদ্রি প্রণয়ী সন্ধ্যার পর যৌনমিলনের জন্য নায়ার রমণীর গৃহে আসে এবং মিলনাস্তে পুনরায় নিজ পিতৃকেন্দ্রিক পরিবারে ফিরে যায়। অনেকসময় নায়ার রমণী একই কালে একাধিক নাম্বুদ্রি ব্রাহ্মণের সঙ্গে ‘সম্বন্ধম’-সম্পর্ক স্থাপন করে। এরূপ ক্ষেত্রে এমন আচরণ বহুপতিক (polyandrous) রূপ ধারণ করে। যেক্ষেত্রে ‘সম্বন্ধম’সম্পর্ক এভাবে বহুপতিক রূপ ধারণ করে, সেক্ষেত্রে সকল পুরুষেরই ওই নায়ার রমণীর ওপর সমান যৌনাধিকার থাকে। একজন প্রণয়ী এসে দ্বারদেশে যদি অপর প্রণয়ীর ঢাল বা বশ দেখতে পায় তাহলে সে প্রত্যাগমন করে এবং পরবর্তী সন্ধ্যায় পুনরায় নিজের ভাগ্যপরীক্ষা করতে আসে।

মাতৃকেন্দ্রিক নায়ার পরিবারের মধ্যে বিবাহিত মেয়ের স্বামী, যেমন সেই পরিবারের মধ্যে বাস করে না, সেরূপ বিবাহিত পুরুষের স্ত্রীও সেই পরিবারের মধ্যে বাস করতে আসে না। ‘সম্বন্ধম’ ছাড়াও নায়ারদের মধ্যে নিয়মানুগ সাধারণ বিবাহপ্রথা প্রচলিত আছে। তবে নায়ার স্ত্রীরা স্বামিগুহে গিয়ে বাস করে না। সেক্ষেত্রে নায়ার স্বামী সন্ধ্যার পর স্ত্রীর সঙ্গে যৌনমিলনের জন্য স্ত্রর গৃহে এসে উপস্থিত হয়।

মাতৃকেন্দ্রিক নায়ার পরিবারের মেয়েদের সস্তানের অভিভাবক হচ্ছে মাতুল। সুতরাং পরিষ্কার বোঝা যাচ্ছে যে মাতৃকেন্দ্রিক (matrilineal) সমাজ মাতৃশাসিত (matriarchal) নয়। পুরুষরাই সেই সমাজের অধিপতি। তবে স্ত্রীলোক সমাজ বা রাষ্ট্রের অধিপতি হলেই যে সে-সমাজ মাতৃশাসিত (matriarchal) হবে, তা নয়। তা যদি হবে, তাহলে রানী এলিজাবেথের আমলে ইংরেজ সমাজ বা ইন্দিরা গান্ধীর প্রধানমন্ত্রিত্বের আমলে ভারতীয় সমাজকে মাতৃশাসিত (matriarchal) সমাজ বলতে হয়! বস্তুত নৃতত্ত্ববিদগণ পুখামুপুঙ্খরুপ পর্যালোচনার পর এই সিদ্ধান্তে উপনীত হয়েছেন যে, যদিও মাতৃকেন্দ্রিক (matrilineal) সমাজ জগতের স্থানে স্থানে পরিলক্ষিত হয়েছে, বাখোফেনের কল্পিত মাতৃশাসিত (matriarchal) সমাজের সন্ধান আজ পর্যন্ত কোথাও পাওয়া যায়নি। সুতরাং কৃষির উদ্ভবের পর মেয়েরা কোনো কোনো জায়গায় ভূমির স্বত্বাধিকার সম্বন্ধে যে দাবি তুলেছিল এবং ক্ষেত্রবিশেষে তাদের সে দাবি মেনে নেওয়া হয়েছিল, ত৷ সত্ত্বেও তারা পুরুষশাসিত সমাজেই বাস করত।

***

দেবতামণ্ডলীতে মাতৃদেবীর প্রাধান্ত মাতৃশাসিত (matriarchal) সমাজের ইঙ্গিত করে না। আমরা দেখি যে, কৃষির উদ্ভাবনের পর যখন মহাদেবীর (the Great Mother) পূজার সূচনা হয়েছিল, তখন মাতৃদেবীকে ‘কুমারী’ (virgin goddess) দেবতারূপে কল্পনা করা সত্ত্বেও ওই কুমারী-মাতৃদেবীকে একজন ভর্তা দেওয়া হয়েছিল। এটা আমরা প্রাচীন সুমের ও ভারত—এই উভয় দেশেই লক্ষ্য করি। ভারতে মাতৃদেবীর সবচেয়ে শ্রেষ্ঠ পূজা হচ্ছে দুর্গাপূজা। দুর্গ শিবজায় হিসাবে কল্পিত হলেও আদিতে তিনি যে কুমারী—তা মহাষ্টমীর দিন ‘কুমারীপূজা’ থেকেই বুঝতে পারা যায়।

আমাদের মূল প্রশ্ন–“মেয়েরা কেন পুরুষ ভজে?—সেই প্রশ্ন সম্বন্ধে পৌরাণিক কাহিনীসমূহ বিশেষ আলোকপাত করে। দেবীর উদ্ভবের কাহিনীটিই এখানে বিবৃত করা যাক। দেবতা ও অসুরদের মধ্যে প্রচণ্ড লড়াই চলছিল। প্রতিবারেই দেবতারা পরাহত হচ্ছিল। এমন হল যে অমুরাধিপতি মহিষাসুর দেবতাদের স্বর্গ থেকে তাড়িয়ে দিয়ে স্বৰ্গরাজ্য অধিকার করে নিল। তখন দেবতারা বিষ্ণুর কাছে গিয়ে তাদের দুর্গতির কথা জানাল, এবং এই বিপর্যয় থেকে তাদের রক্ষা করবার অনুরোধ করল। তখন বিষ্ণু দেবতাদের উপদেশ দিলেন— তোমরা সকলে নিজ নিজ স্ত্রীর সঙ্গে মিলিত হয়ে নিজ নিজ তেজের কাছে প্রার্থনা কর যে তোমাদের সমবেতভাবে উৎপন্ন তেজ থেকে যেন এক নারীমূতি আবির্ভূত হন। সেই নারীই এই অস্থরকে বধ করবেন। সমবেত তেজ থেকে যে নারীমূর্তি আবির্ভূত হলেন, তিনিই ছৰ্গা। দেবী মহিষাসুরের কাছে এলে, মহিষাসুর দেবীকে বলল–আপনার হাতে মরতে আমার কোনো দুঃখ নেই, কিন্তু আমি যেন আপনার সঙ্গে পূজিত হই। এই কাহিনী থেকে ছুটি জিনিস পরিষ্কার পরিস্ফুট হচ্ছে। প্রথম, জগৎ রক্ষার জন্য স্ত্রী-পুরুষের পরস্পর মিলিত হওয়া একান্ত প্রয়োজন। আর দ্বিতীয়, পুরুষ যেন নারীর সঙ্গে সমান পূজা পায়। এখানে নারীর কামিনী ও জননী-—এই দুই ভাবেরই সমন্বয় দেখি।

শিবজায়া সম্বন্ধে আর-এক পৌরাণিক কাহিনী শুমুন। শিব প্রথমে দক্ষরাজ-কন্ত সতীকে বিবাহ করেছিল। কিন্তু পিতার যজ্ঞস্থলে পতিনিন্দ শুনে সতী দেহত্যাগ করে। পরে সতী হিমালয়-পত্নী মেনকার গর্ভে জন্মগ্রহণ করে এবং মহাদেবকে পাবার জন্য কঠোর তপস্যায় রত হয়। এদিকে দেবতারা তারকাসুরের অত্যাচারে উৎপীড়িত হয়ে জানতে পারে যে মহাদেবের ঔরসে যে পুত্র জন্মাবে, সেই-ই তারকাসুরকে বধ করবে। সেজন্য পার্বতী ও মহাদেবের মিলন ঘটাতে মদন আসে, কিন্তু সে মহাদেবের কোপে ভস্মীভূত হয়। তারপর পার্বতী ও মহাদেবের মিলন হলে মদন পুনর্জীবন লাভ করে। এই মিলনের ফলেই কাতিকেয়র জন্ম হয় এবং কার্তিকেয় তারকাসুরকে বধ করে। এসব পৌরাণিক কাহিনীতে স্ত্রী-পুরুষের মিলনের ওপরই জোর দেওয়া হয়েছে এবং তার মধ্যেই নিহিত আছে ‘প্রমীলা কেন পুরুষ ভজে?’— এই প্রশ্নের উত্তর।

***

পৌরাণিক যুগের পূর্বে বৈদিক যুগ। বৈদিক যুগের মেয়েরা কি করত, সে সম্বন্ধে এখন কিছু বলি। সাধারণ বিবাহ তো বৈদিক যুগে প্রচলিত ছিলই, কিন্তু অনেকসময় মেয়েরা নিজেরাই স্বামী নির্বাচন করে নিত। এটা ঘটত সমন’ উৎসবে। ঋক্ ও অথর্ব বেদে এবং যজুর্বেদের বাজসনেয়ী সংহিতায় এই উৎসবের কথা উল্লিখিত হয়েছে। এ উৎসবটি অনেকটা ‘অলিম্পিক উৎসবের মত ছিল। এই উৎসবে যে যে-বিষয়ে দক্ষ, সে সে-বিষয়ে প্রতিযোগিতায় নিজ কৌশল দেখিয়ে পুরস্কার লাভ করত। ধনুর্বেত্তা, রথী, অশ্বারোহী, কবিগণ, মল্ল ও নটগণ, শস্ত্রজীবী সকলেই প্রতিদ্বন্দ্বিতায় অবতীর্ণ হ’ত। এটা সর্বজনীন উৎসব ছিল এবং সেই কারণে নানারকম আমোদ-প্রমোদের আয়োজন হ’ত। বারাঙ্গনারাও এই উৎসবে ধনলাভের আশায় উপস্থিত থাকত। কিন্তু যেটা আমাদের প্রাসঙ্গিক ব্যাপার, সেটা হচ্ছে কুমারী মেয়েরা মনোমত পাতলাভের আশায় স্থসজ্জিত হয়ে তথায় উপস্থিত থাকত ও পতি-নির্বাচন করত। ঋগ্বেদের সপ্তম মণ্ডলের জুয়ের সূক্তের পঞ্চম মন্ত্রে বলা হয়েছে, এরূপ কুমারীর যুবত। মেয়ে হ’ত। সুতরাং এ-থেকে পরিষ্কার বুঝতে পার। যাচ্ছে যে, বৈদিক যুগে যুবতী কুমারী মেয়ের কোন পুরুষকে ভজবে তা নিজেরাই নির্বাচন করত। সে অধিকার তাদের ছিল। মনে হয়, পরবর্তীকালে এটাই স্বয়ংবরপ্রথার রূপ নিয়েছিল। স্বয়ংবরপ্রথাতেও পুরুষকে প্রতিযোগিতায় অবতীর্ণ হয়ে। নিজ কৌশল প্রদর্শন করতে হত। তবেই অনুঢ়া কন্যা কোন পুরুষকে ভজনা করবার জন্ম গ্রহণ করবে, তা স্থরীকৃত হ’ত। ‘সমন’ উৎসবে যেমন স্ব-ইচ্ছা ও স্ব-মনোনয়নের একটা মূল্য ছিল, স্বয়ংবরপ্রথায় তা ছিল না। তবে পরবর্তীকালে স্বেচ্ছায় কোনো পুরুষকে ভজনা করার রীতি যে একেবারে ছিল না, তা নয়। তখন মেয়েরা যে পুরুষকে ভজনা করত, তাকে দিয়ে একটা শর্তপালন স্বীকার করিয়ে নিত। এটা আমরা গঙ্গা-শান্তনু ও শকুন্তলা-দুষ্মন্তের ক্ষেত্রে লক্ষ্য করি। প্রেমে পড়ে পুরুষরা সে-সব শর্ত মেনে নিত।

তবে মেয়েরা যে একজন পুরুষকেই ভজন করত, তা নয়। কোনে। কোনো সময়ে একসঙ্গে অনেক পুরুষকেও ভজনা করত। এটা আমরা পূর্বে উল্লিখিত নায়ার রমণীদের ক্ষেত্রে দেখেছি। বৈদিক যুগে আমরা জটিলাকে এরূপ করতে দেখি। জটিলার ছয় স্বামী ছিল। আবার মহাভারতীয় যুগে দ্রৌপদীর পঞ্চস্বামী ছিল। পরবর্তীকালের সমাজে একাধিক পুরুষকে ভজনা করবার ঘটনা হামেশাই ঘটেছে, তবে স্বামীঅন্তর পুরুষকে উপপতি বলা হত। এরূপ সম্পর্কের কথা আমরা পরে আলোচনা করব। উপস্থিত আমরা স্মৃতির যুগে যেতে চাই।

***

স্মৃতির যুগে মেয়েদের পুরুষ-ভজনা নানারকম বিধিনিষেধ দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হতে দেখি। বিবাহ-ই পুরুষ-ভজনার একমাত্র মাধ্যম হয়ে দাড়ায়! সুতরাং বিবাহপ্রথার উস্তবের আলোচনা এখানে অপ্রাসঙ্গিক হবে না। স্ত্র ও পুরুষের মধ্যে সমাজ-স্বীকৃত যৌনসম্পর্ককেই বিবাহ বলা হয়। মানুষের ইতিহাসের প্রথম অধ্যায়ে স্ত্রী ও পুরুষ পরিবার গঠন করে বাস করত বটে, কিন্তু ‘বিবাহ’ নামে এর কোনো সামাজিক স্বীকৃতি ছিল না। মনে হয় এটা এসেছিল একই নারীকে নিয়ে দ্বন্দ্ব, সংঘর্ষ ও রক্তপাতের পদক্ষেপে। এরূপ দ্বন্দ্ব, সংঘর্ষ ও রক্তপাত এড়াবার জন্যই “বিবাহপ্রথার উদ্ভব হয়েছিল। এরূপ দ্বন্দ্ব, সংঘর্ষ ও রক্তপাত প্রত্নোপলীয় যুগে একটা স্বাভাবিক ব্যাপার ছিল। পশুশিকারের জন্ম পুরুষকে তখন দূর-দূরাস্তরে যেতে হ’ত। নারীকে তখন অসহায় অবস্থায় থাকতে হত। নারীর সেই অসহায় অবস্থার সুয়োগ নিয়ে অন্ত পুরুষের পক্ষে তাকে ছিনিয়ে নিয়ে যাওয়া একটা সম্ভবপর স্বাভাবিক ঘটনা ছিল। এটা এড়াবার জন্যই মনে হয় মনুষ্যসমাজে পরিবারকে স্বীকৃতি দেবার একটা প্রয়োজন হয়েছিল। নৃতত্ত্ববিদগণ বিবাহপ্রথা’র উদ্ভবের এই কারণই দেন।

মহাভারতে এ-সম্বন্ধে যে কাহিনী অাছে সেটা উল্লেখ করা এখানে প্রাসঙ্গিক হবে। সে কাহিনী উল্লেখ করে, পরে আমি এ-সম্বন্ধে . আলোচনা করতে চাই ৷ মহাভারতের আদিপর্বে উল্লেখিত এই কাহিনীটিকে শ্বেতকেতু-কাহিনী বলা হয়। কাহিনীটি হচ্ছে এই : একদিন শ্বেতকেতু যখন পিতামাতার কাছে বসে ছিল তখন এক ব্রাহ্মণ এসে তার মায়ের সঙ্গে যৌনমিলন কামনা করে তাকে কক্ষান্তরে নিয়ে যায়। শ্বেতকেতু এতে ক্রুদ্ধ হয়। কিন্তু পিতা উদালক বলেন, স্ত্রীলোক গাভীর মত স্বাধীন। সহস্র পুরুষে আসক্ত হলেও তাদের অধৰ্ম হয় না। এটাই সনাতন ধর্ম। এই অবাধ যৌনমিলন নিবৃত্ত করবার জন্যই শ্বেতকেতু ভারতবর্ষে প্রথম বিবাহপ্রথার প্রবর্তন করেন।

উনবিংশ শতাব্দীর নৃতত্ত্ববিদগণ, যথা—-বাখোফেন (Bachofen) মরগান (Morgan) প্রমুখ বলতেন যে, আদিম অবস্থায় মনুষ্যসমাজে অবাধ-যৌনমিলন (promiscuity) প্রচলিত ছিল। তাদের মত অনুযায়ী বিবাহপ্রথা উদ্ভব হবার পূর্বে স্ত্রী-পুরুষের মধ্যে কোনোরূপ স্থায়ী যৌনসম্পর্ক ছিল না। তারা বলতেন যে অন্যান্য পশুর মত মানুষও অবাধ-যৌনমিলনে প্রবৃত্ত হ’ত। তাদের মতে আদিম অবস্থায় মামুষের মধ্যে যৌনাচার নিয়ন্ত্রণের জন্য কোনো অমুশাসন ছিল না। র্তারা বলতেন যে অনুশাসনের উদ্ভব হয়েছিল অতি মন্থরগতিতে, ধীরে ধীরে ও ক্রমান্বয়ে। তাদের সময়ে পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে যে নানারকম বিবাহপ্রথা প্রচলিত ছিল, সেগুলিকে তারা এক বিবর্তনের ঠাটে সাজিয়ে প্রমাণ করবার চেষ্টা করেছিলেন, মানুষের বর্তমান একপত্নীক বিবাহপ্রথা এইসকল ক্রমিক স্তরের ভেতর দিয়ে বিকাশলাভ করেছে। কিন্তু সন্তানকে লালন-পালন ও স্বাবলম্বী করে তোলবার জন্য মানুষের যে দীর্ঘ সময়ের প্রয়োজন হয়, একমাত্র এই জীবজনিত কারণই এ-কথা প্রমাণ করবার পক্ষে যথেষ্ট সহায়ক যে, মনুষ্যসমাজে গোড়া থেকেই স্ত্রী-পুরুষ পরস্পরের সংলগ্ন হয়ে থাকত। বস্তুত আদিম অবস্থায় স্ত্রীপুরুষ যে অবাধ যৌনাচারে রত ছিল, এই মতবাদ পূর্বোক্ত নৃতত্ত্ববিদগণের এক নিছক কল্পনামূলক অনুমান ছাড়া আর কিছুই নয়। এরূপ অবাধ যৌনমিলন মনুষ্যসমাজে কোনোদিনই প্রচলিত ছিল না। এমনকি বর্তমান সময়েও অত্যন্ত আদিম অবস্থায় অবস্থিত অরণ্যবাসী জাতিসমূহের মধ্যেও অবাধ যৌনমিলনের রীতি নেই। বস্তুত এইসকল অরণ্যবাসী জাতিসমূহের মধ্যে যে-সকল বিবাহপ্রথা প্রচলিত অাছে, তা অতি কঠোর অনুশাসন দ্বারা নিয়ন্ত্রিত। প্রকৃতির মধ্যে পর্যবেক্ষণ করলেও আমরা এর সমর্থন পাই। বনমানুষ, গরিলা প্রভৃতি যে-সকল নরাকার জীব আছে, তারাও দাম্পত্য-বন্ধনে আবদ্ধ হয়ে বাস করে। কখনও অবাধ 1মলনে রত হয় না। এইসকল কারণ থেকে স্পষ্টই প্রতীয়মান হয় যে, “বিবাহ’ আখ্যা দিয়ে তাকে সামাজিক স্বীকৃত দেওয়া হয়ে থাকুক আর নাই থাকুক, স্ত্রী-পুরুষ একত্রে মিলিত হয়ে ‘পরিবার’ গঠন করে সহবাস করবার রীতি মনুষ্যসমাজে গোড়া থেকেই প্রচলিত ছিল (লেখকের ‘ভারতে বিবাহের ইতিহাস’, তৃতীয় সংস্করণ দ্রষ্টব্য)। প্রখ্যাত নৃতত্ত্ববিদ ওয়েস্টারমার্ক (Westermarck) বলেন, পরিবার গঠন করে স্ত্রী-পুরুষের একত্র বাস করা থেকেই বিবাহপ্রথার উদ্ভব হয়েছে; বিবাহপ্রথা থেকে পরিবারের সূচনা হয়নি।’ মহাভারতে বিবৃত শ্বেতকেতু-উপাখ্যান থেকেও আমরা এর সমর্থন পাই। কেননা, বিবৃত কাহিনী থেকে পরিষ্কার বোঝা যায় যে, বিবৃত কাহিনীর আগেই শ্বেতকেতু তার পিতামাতার সঙ্গে পরিবার-মধ্যেই বাস করত।

***

স্মৃতির যুগে মেয়েদের পুরুষ-ভজা কী ভাবে নিয়ন্ত্রিত হয়েছিল, সেসম্বন্ধে বলতে গিয়ে আমরা অন্য প্রসঙ্গে চলে গিয়েছিলাম। স্মৃতির যুগে মেয়েদের পুরুষ-ভজনা স্মৃতিকারদের অমুশাসন দ্বারা নিয়ন্ত্রণমূলক গণ্ডির মধ্যে অবরুদ্ধ করা হয়েছিল। বৈদিক যুগে যে-কোনো মেয়ে যে-কোনো পুরুষকে ভজনা করতে পারত। এ-বিষয়ে কোনোরূপ সামাজিক বিধিনিষেধ ছিল না। কিন্তু চাতুৰ্বণ্য সমাজের অভু্যত্থানের সঙ্গে সঙ্গে এবিষয়ে বিধিনিষেধ এসে যায়। পুরুষ-নির্বাচন সম্বন্ধে নারী তার স্বাধীনতা হারায়। নিজ বর্ণের মধ্যে ভজনা করাই ‘বিধিসম্মত যৌনাচার’ বলে পরিগণিত হয়। তবে নিজ বর্ণের বাইরে যে বিবাহ করতে পারত না, তা নয়। নিজ বর্ণের বাইবেও বিবাহ করতে পারত। সেরকম বিবাহকে ‘অমুলোম’ ও ‘প্রতিলোম’ বিবাহ বলা হ’ত। যখন কন্যা নিজ বর্ণ অপেক্ষা উচ্চবর্ণের পুরুষকে বিবাহ করত, তাকে অমুলোম বিবাহ বলা হত। আর উচ্চবর্ণের কন্স যখন নীচবর্ণের পুরুষকে বিবাহ করত, তখন তাকে প্রতিলোম বিবাহ বলা হ’ত। কিন্তু প্রতিলোম বিবাহে উৎপন্ন সন্তানের ললাটে পড়ত কালিমা। কেননা, এরূপ অসবর্ণ বিবাহের ফলে বহু সঙ্কর জাতির উদ্ভব ঘটেছিল ও সমাজ এক সম্প্রসারিত রূপ ধারণ করেছিল। নতুন সামাজিক সংগঠনের মধ্যে এরূপ অসবর্ণ মিলনের ফসল হিসাবে যে-সকল নতুন জাতির উদ্ভব ঘটেছিল, তাদের স্থান ও মর্যাদা নির্দেশের পিছনে ব্রাহ্মণদের বেশ কিছু উষ্মা ছিল। কেননা, ব্রাহ্মণ বা ক্ষত্রিয় যদি পিত হতেন, তাহলে তাকে অম্বষ্ঠ বা উগ্র নামে অভিহিত করে সমাজে উচ্চ স্থান দেওয়া হ’ত। আর ব্রাহ্মণকন্যা যদি মাতা হতেন এবং পিতা শূদ্র হতেন, তাহলে তাদের সন্তানদের চণ্ডাল নাম দিয়ে সমাজেব একেবারে নীচে তার স্থান নির্দিষ্ট হ’ত। এককথায়, চণ্ডালের মা হ’ত ব্রাহ্মণকস্তা, আর অম্বষ্ঠের পিত হ’ত ব্রাহ্মণ। যেহেতু পিতৃকেন্দ্রিক সমাজে নারীর কোনো স্বাতন্ত্র্য ছিল না, সেজন্য ব্রাহ্মণকহাকে সমাজের এই বিধান মাথা পেতে নিতে হ’ত (লেখকের ‘হিন্দু সভ্যতার মৃতাত্ত্বিক ভাষ্য’ দ্রষ্টব্য)।

স্মৃতিকারদের দৃষ্টিভঙ্গিতে বিবাহ ছিল ধর্মবিহিত কর্তব্যকর্ম বা ‘সংস্কার’। সকল ব্যক্তির পক্ষেই এই কর্তব্যপালন বাধ্যতামূলক ছিল, বিশেষ করে পুত্র উৎপাদন করে নরক থেকে পিতৃপুরুষদের উদ্ধার করার জন্য। কেননা, সে-যুগের বুলিই ছিল ‘পুত্রার্থে ক্রিয়তে ভাৰ্যা’। যদিও মনুর মানবধর্মশাস্ত্রে আটরকম বিবাহের কথা বলা হয়েছে, এবং আপস্তম্ব ও বশিষ্ঠ ছয়রকম বিবাহের অনুমোদন করেছেন, তথাপি নীতির কারণে মাত্র সেই বিবাহকেই শাস্ত্রসম্মত বিবাহ বলে গণ্য করা হ’ত, যে-বিবাহে মন্ত্র উচ্চারিত হ’ত, হোম ও যজ্ঞ অনুষ্ঠিত হ’ত ও সপ্তপদীগমন অবলম্বিত হ’ত। ব্রাহ্মণের পক্ষে এই বিবাহই ছিল প্রশস্ত বিবাহ। তবে ব্রাহ্মণেতর জাতির মধ্যে আমুর-বিবাহের প্রচলন ছিল। আস্থর-বিবাহে মূল্যদান করে কন্যার পাণিগ্রহণ করা হত। সেজন্যই ‘মানবগৃহ্যসূত্রে বলা হয়েছে যে, বিবাহ মাত্র দুইপ্রকার—ত্ৰাহ্ম ও আমুর। যদিও মহাভারতীয় যুগে গান্ধৰ্ব ও রাক্ষস বিবাহ আদর্শবিবাহ বলে গণ্য হ’ত, স্মৃতির যুগে এই উভয়প্রকার বিবাহ অপ্রচলিত হয়ে গিয়েছিল। ধর্মশাস্ত্রসমূহে বলা হয়েছে যে, এরূপ বিবাহ করলে মানুষকে মহাপাপে লিপ্ত হতে হয়।

স্মৃতির যুগে মেয়েদের বিবাহ যে কেবল সর্বজনীন ছিল, তা নয়— বিবাহ বাধ্যতামূলকও ছিল। অর্থাৎ স্মৃতির যুগে মেয়েদের পুরুষ-ভজন করতেই হ’ত। যথাসময়ে মেয়েদের বিবাহ দেওয়ার প্রয়োজনীয়তা সম্বন্ধে সমস্ত স্মৃতিগ্রন্থেই বিশেষভাবে জোর দেওয়া হয়েছে। বলা হয়েছে যে, মেয়েদের পক্ষে বিবাহের উপযুক্ত বয়স হচ্ছে দশ, যখন মেয়ে ‘কথা’ আখ্যালাভ করে। পরাশর বিধান দিয়ে বলেছেন— ‘যথাসময়ে যদি মেয়ের বিবাহ দেওয়া না হয়, তাহলে সেই কন্যার মাসিক রজঃ অপর জগতে তার পিতৃপুরুষদের পান করতে হয়, এবং যে তাকে বিবাহ করে তাকে হতভাগা হতে হয়। বশিষ্ঠ, বৌধায়ন, নারদ ও যাজ্ঞবল্ক্য এ সম্পর্কে বেশ রুষ্ট হয়েই বলেছেন, ‘কুমারী অবস্থায় কষ্ঠা যতবার রজঃস্বলা হবে, ততবার তার পিতামাতা ও অভিভাবকদের ভ্রূনহত্যার পাপে লিপ্ত হতে হবে। গৌতম এ-সম্বন্ধে অন্ত স্মৃতিকারদের সঙ্গে মতৈক্য প্রকাশ করে বলেছেন, রজঃস্বলা হবার আগেই কন্যার বিবাহ হওয়া চাই।’

এখানে স্মৃতিযুগের প্রধান বুলি পুত্রার্থে ক্রিয়তে ভাৰ্যা’র সঙ্গে স্মৃতিকারদের বিধানের একটা বিরোধ দেখা যায়। কেননা, পুত্রউৎপাদনের জন্যই যদি ভাৰ্যারূপে নারীর প্রয়োজন হয়, তবে বিবাহের জন্য সে-নারীকে কেন প্রয়োজন হয় রজঃস্বলা হবার পূর্বে? এটা তো বায়োলজিক্যাল-বিরোধী বিধান। কেননা, নারী রজঃস্বলা না হওয় পর্যন্ত কখনও পুত্র-প্রজননে সমর্থ হয় না। সেদিক থেকে বৈদিক যুগের নারীর বিবাহ অনেক পরিমাণে যুক্তিসম্মত ছিল, কেননা বৈদিক যুগে সমর্থ যুবতী মেয়েরই বিবাহ হ’ত।

আজকের দিনে নারী অবশু স্মৃতিযুগের বায়োলজি-বিরোধী বিধানের শিকার নয়। ফুলমণির সেই শোকাবহ দুর্ঘটনার পর ১৮৯২ খ্রীস্টাব্দে বিবাহে সঙ্গমের বয়স বেঁধে দেওয়া হয়। তারপর ১৯২৮ খ্রীস্টাব্দের পর থেকে বিবাহের নূ্যনতম বয়সও বৃদ্ধি করা হয়েছে। বিবাহের এই নূ্যনতম বয়স বৃদ্ধির ফলে আজকের দিনে মেয়ে-পুরুষের বিবাহের বয়স ক্রমশই উধ্বগতি লাভ করছে। এ-বিষয়ে মেয়ে-পুরুষ আজ সমান। পিতৃশাসিত সমাজের মধ্যে বাস করলেও বিবাহের বয়স সম্বন্ধে মেয়েপুরুষ আজ সমান রীতির অধিকারী হয়েছে।

***

স্মৃতির যুগে আদর্শ বিবাহের জন্য নারীর যে মাত্র সবণেই বিবাহ হ’ত, তা নয়। তাকে গোত্র, প্রবর ও জ্ঞাতিত্ব পরিহার করতে হ’ত। স্মৃতি-পূর্ব যুগে মেয়েদের পুরুষ-ভজন। সম্বন্ধে কিন্তু সে-বিধিনিষেধ ছিল

না। জ্ঞাতিত্বের কথাই আমরা প্রথম ধরছি। ঋগ্বেদের দশম মণ্ডলের এক সূক্ত থেকে বোঝা যায় যে, জ্যেষ্ঠ ভ্রাতার মৃত্যুর পর তার বিধবা স্ত্রী দেবরের সঙ্গেই স্ত্রীরূপে বাস করত। সেখানে বিধবাকে বলা হচ্ছে : ‘তুমি উঠে পড়, যে দেবু তোমার হাত ধরেছে, তুমি তার স্ত্রী হয়েই তার সঙ্গে বসবাস কর। অথর্ববেদের একজায়গাতেও ঠিক অনুরূপ কথা ধ্বনিত হয়েছে। এককথায়, ঋগ্বেদের যুগে দেবর-ভজনার রীতি প্রচলিত ছিল। বস্তুত ভাবীর সঙ্গে দেবরের যে যৌন-ঘনিষ্ঠতা (leviration) থাকত, তা ঋগ্বেদের বিবাহ-সম্পর্কিত সূক্তও ইঙ্গিত করে। উক্ত সূক্তে দেবতাগণের নিকট প্রার্থনা করা হচ্ছে যে, তারা যেন নববধূকে দেবুর প্রিয়া ও অনুরাগের পাত্রী করে তোলেন। ঋগ্বেদের দশম মণ্ডলের অপর একস্থানেও বর্ণিত হয়েছে যে, বিধবা ভাবী দেবুকে তার দাম্পত্যুশয্যায় নিয়ে যাচ্ছে। ঋগ্বেদ ও অথর্ববেদ, এই দুই গ্রন্থেই স্বামীর কনিষ্ঠ ভ্রাতাকে দেবৃ’ বা দেবর’ বলা হয়েছে। এই শব্দদ্বয় থেকেও ভাবীর সঙ্গে দেবরের এইরূপ সম্পর্ক সূচিত হয়। কেননা, দেবর’ মানে দ্বি-বর বা দ্বিতীয় বর। এককথায়, মেয়েদের দেবরকে ভজনা করা সেযুগের রীতি ছিল।

এই সম্পর্কে স্বভাবতই আমাদের পরবর্তীকালের নিয়োগ-প্রথা’র কথা মনে পড়ে। কিন্তু নিয়োগ-প্রথাটা ছিল স্বতন্ত্র প্রথা। বৈদিক যুগে ভাবীর ওপর দেবরের যে যৌন-অধিকার থাকত, তা সাধারণ ও সৰ্বকালীন রমণের অধিকার। আর পরবর্তীকালের নিয়োগ-প্রথা ছিল মাত্র সন্তান-উৎপাদনের অধিকার। সন্তান-উৎপাদনের পর এ অধিকার আর থাকত না। আরও লক্ষ্য করবার বিষয় হচ্ছে এই যে, বিধবা ভাবীর ওপর দেবরের এই যৌন অধিকার অবিকৃত থাকার দরুন ঋগ্বেদে বিধবা-বিবাহের কোনো উল্লেখ নেই, যা পরবর্তীকালের গ্রন্থসমূহে দেখতে পাওয়া যায়। বেদে ব্যবহৃত জ্ঞাতিবাচক কয়েকটি শব্দ থেকেও আমরা বুঝতে পারি যে স্ত্রীলোকের একাধিক স্বামী থাকত।

তবে নিয়োগ-প্রথায় অ-সীমিত রমণ থেকে বিরত থাকার ব্যাপারে নারীর যে একটা অধিকার ছিল, তা পাণ্ডুর নিকট কুন্তীর নিবেদন থেকে আমরা বুঝতে পারি। বহুবার এরূপ রমণে প্রবৃত্ত হতে কুন্তী অস্বীকৃত হয়েছিল।

***

বর্তমানে উত্তর-ভারতের হিন্দুসমাজে বিবাহ কখনও নিকট-আত্মীয়ের মধ্যে হয় না। সেখানে বিবাহ গোত্র-প্রবর বিধির দ্বারা নিয়ন্ত্রিত। তাছাড়। উত্তর-ভারতে সপিণ্ডদের মধ্যেও কখনও বিবাহ হয় না। দক্ষিণভারতের হিন্দুসমাজে কিন্তু তা নয়। সেখানে মামা-ভাগনী ও মামাতোপিসতুতে ভাইবোনের মধ্যে বিবাহ হচ্ছে বাঞ্ছনীয় বিবাহ। আবার ওড়িশার হিন্দুসমাজে কোনো কোনো জাতির মধ্যে জ্যেষ্ঠ ভ্রাতার বিধবাকে দেবর কর্তৃক স্ত্রীরূপে গ্রহণ করা বাধ্যতামূলক।

হিন্দুসমাজের মতে আদিবাসী সমাজেও নিজ টোটেম-গোষ্ঠীর মধ্যে বিবাহ নিষিদ্ধ। কিন্তু উত্তর-পূর্ব সীমান্তের আদিবাসী সমাজভুক্ত লাখের, বাগনী ও ডাফল জাতির লোকের বিধবা বিমাতাকে বিবাহ করে। আবার গারে জাতির লোকেরা বিধবা শাশুড়ীকে বিবাহ করে। ওড়িশার আদিবাসী সমাজে শবর জাতির লোকেরা বিধবা খুড়ীকে বিবাহ করে।

সুতরাং মেয়ের যে কাকে ভজবে—দেবরকে, না জামাতাকে, না সপত্নী-পুত্রকে, না দেবর-পুত্রকে, না পিসতুতো ভাইকে, না মামাকে— সে-সম্বন্ধে সমাজ যা বিধান দেয়, তাদের তাই মানতে হয়। তবে বৌদ্ধসাহিত্য থেকে প্রকাশ পায় যে উত্তর-ভারতে একসময় তারা নিজ সহোদর ভাইকেই ভজনা করত। বৌদ্ধসাহিত্যের (স্বত্তনিপাত) একজায়গায় আমরা পাই, রাজা ওক্ককের (ইক্ষাকুর) প্রধান মহিষীর পাঁচ ছেলে ও চার মেয়ে জন্মগ্রহণ করে। ওই প্রধান মহিষীর মৃত্যুর পর রাজা এক যুবতীকে বিবাহ করেন। এই রানীর যখন এক পুত্র হয় তখন সে বলে যে, তার ছেলেকেই রাজা করতে হবে। রাজ তার প্রথম মহিষীর পাঁচ পুত্র ও চার মেয়েকে হিমালয়ের পাদদেশে নির্বাসিত করেন। সেখানে কপিলমুনির সঙ্গে তাদের দেখা হয়। কপিলমুনি তাদের সেখানে একটি নগর স্থাপন করে বসবাস করতে বলেন। এই নগরের নামই কপিলাবস্তু। ভ্রাতাদের মধ্যে জ্যেষ্ঠ অকৃতদার থাকে। আর অপর চার ভাই চার বোনকে বিবাহ করে। এ কাহিনীটি ‘মহাবস্তু’তেও আছে।

বৌদ্ধসাহিত্যের অপর এক কাইনী অনুযায়ী (অত থসূত্ত ও কুণালজাতক) অনুযায়ী শাক্যর ছিল পাঁচ বোন ও চার ভাই। এই কাহিনী অনুযায়ী জ্যেষ্ঠ ভগিনীকে তার মাতৃরূপে বরণ করে, আর চার ভাই চার বোনকে বিবাহ করে।

বৌদ্ধসাহিত্যের (বুদ্ধঘোষের ‘পরমজোতিকা’, ‘ক্ষুদ্দকপথ’) আরএক কাহিনী অনুযায়ী বারাণসীর রাজার প্রধান মহিষী একখণ্ড মাংসপিণ্ড প্রসব করেন। তিনি ওই মাংসপিণ্ডটিকে একটি পেটিকায় করে নদীতে ভাসিয়ে দেন। ওটা যখন ভেসে যাচ্ছিল তখন একজন মুনি ওটাকে তুলে সংরক্ষণ করেন। পরে ওই মাংসপিণ্ড থেকে একটি ছেলে ও একটি মেয়ে উৎপন্ন হয়। তাদের নাম লিচ্ছরী দেওয়া হয়। এদের ফুজনের মধ্যে বিবাহ হয় এবং ওরা বৈশালী রাজ্য স্থাপন করে।

এখানে উল্লেখনীয় যে, অথর্ববেদে পিতা-পুত্রী ও ভ্রাত-ভগিনীর মধ্যে যৌনমিলনের উল্লেখ আছে। পৌরাণিক এক কাহিনী থেকে আমরা জানি যে, নহুষ তার ‘পিতৃকন্যা’ বিরজাকে বিবাহ করেছিল ও তার গর্ভে ছয়টি সন্তান উৎপাদন করেছিল। বর্তমানকালে এরূপ যৌনাচারকে ইনসেস্ট’ (incest) বা অজাচার বলা হয়। তবে ষেসমাজের মধ্যে এরূপ সংসর্গ ঘটে, সেই সমাজের নীতিবিধানের ওপরেই নির্ভর করে—কোনটা অজাচার, আর কোনটা অজাচার নয়।

অজাচারের সামিল হচ্ছে ব্যভিচার। নারী যখন নিজ স্বামী ব্যতীত অপর পুরুষের সঙ্গে যৌনমিলনে প্রবৃত্ত হয়, তখন সেরূপ সংসৰ্গকে ব্যভিচার বলা হয়। স্মৃতিশাস্ত্রসমূহে বলা হয়েছে, যতরকম ব্যভিচার আছে, তার মধ্যে সর্বাপেক্ষ ঘৃণিত ও কদর্য হচ্ছে গুরুতল্প বা গুরুস্ত্রীগমন। অথচ প্রাচীন ভারতে এটা আকছার ঘটত। গুরুর অনুপস্থিতিতে গুরুপত্নীরা পুত্রস্তানীয় ও ব্রহ্মচর্যে রত শিষুদের প্রলুব্ধ করত তাদের সঙ্গে যৌনমিলনে রত হতে। এ-সম্বন্ধে মনস্তত্ত্ববিদরা কী বলবেন জানি না, তবে ষাট বৎসর পূর্বে বিলাতের এক পত্রিকায় একজন fossie of oilo asso co-footix: ‘I can think nothing more horrible than a woman proposing to a man’. কিন্তু বাস্তব জীবনে এরূপ horrible জিনিসই ঘটে। শিষ্যদের কাছে গুরুপত্নীদের যৌনমিলনের আকাঙ্ক্ষা প্রকাশ করা তারই উদাহরণ। ঋগ্বেদেও আমরা পড়ি, যমী তার সহোদর ভ্রাতা যমকে প্রলুব্ধ করছে তার সঙ্গে যৌনমিলনে রত হবার জন্য।

***

নারী ব্যভিচারে লিপ্ত হয় তখনই—যখন সে নিজ স্বামীকে ভজনা করতে চায় না, বা তার নিজ স্বামী স্থানান্তরে থাকে। শেষোক্ত পারস্থিতিটাই গুরুতল্পের ক্ষেত্রে খাটত। আদিম যৌনক্ষুধার প্রক্রিয়াতেই এটা ঘটে। এটা বিশেষভাবে প্রকাশ পেয়েছিল মধ্যযুগে, আমাদের দেশের কৌলীন্ত-শাসিত সমাজে। সে-সমাজের মেয়ের বিবাহের পর বাপের বাড়িতেই থেকে যেত। স্বামী কচিৎ-কদাচিৎ শ্বশুরবাড়ি আসত। কিন্তু শ্বশুরবাড়ি এলে কি হবে? বিনা দক্ষিণায় তারা কখনও স্ত্রীর সঙ্গে মিলিত হ’ত না। ভারতচন্দ্র তার ‘অন্নদামঙ্গল’-এ এর এক সুন্দর বর্ণনা দিয়েছেন। সেখানে এক কুলীনের মেয়ের মুখ দিয়ে তিনি বলিয়েছেন :

‘আর রামা বলে আমি কুলীনের মেয়ে।
যৌবন বহিয়া গেল বর চেয়ে চেয়ে॥
যদি বা হইল বিয়া কতদিন বই।
বয়স বুঝলে তার বড়দিদি হই॥
বিয়াকালে পণ্ডিতে পণ্ডিতে বাদ লাগে।
পুনর্বিয়া হবে কিনা বিয়া হবে আগে॥
বিবাহ করেছে সেটা কিছু ষাটি ঘাটি।
জাতির যেমন হৌক কুলে বড় আঁটি॥
দু-চারি বৎসরে যদি আসে একবার।
শয়ন করিয়া বলে কি দিবি ব্যাভার ॥
সূতাবেচা কড়ি যদি দিতে পারি তায়।
তবে মিষ্ট মুখ, নহে রুষ্ট হয়ে যায়॥’

এরূপ সমাজে যে-সব মেয়ের যৌনক্ষুধা প্রবল, তাদের ক্ষেত্রে যা ঘটত তা সহজেই অনুমেয়। উনবিংশ শতাব্দীর মধ্যভাগে রামনারায়ণ তর্করত্ব ও ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর সেটা খোলাখুলিই বলেছিলেন। রামনারায়ণ তাঁর ‘কুলীনকুলসর্বস্ব’ নাটকের চতুর্থ অঙ্কে পিতা-পুত্রের সংলাপের ভেতর দিয়ে সেটা বলেছেন। পুত্র তিন বৎসর শ্বশুরবাড়ি যায়নি। হঠাৎ খবর এল তার একটি কন্যাসন্তান হয়েছে। পুত্র আশ্চর্য হয়ে পিতাকে যখন এ-কথা বলছে, তখন পিতা বলছেন, ‘বাপু হে! তাতে ক্ষতি কি? আমি তোমার জননীকে বিবাহ করে তথায় একবারও যাই নাই, একেবারে তোমার সাক্ষাৎ হয়। কুলীনকস্তাদের যখন স্বামী ব্যতীতই গর্ভ হ’ত, তখন মেয়ের মায়েরা কী কৌশল অবলম্বন করে সেই সন্তানের বৈধতা পাড়াপাড়শীর কাছে জানাত তা বিদ্যাসাগরমশাই তার “বহুবিবাহ’ নিবন্ধে বিবৃত করেছেন।

***

আপস্তম্ব-ধৰ্মসূত্রে কুমারী মেয়ের সঙ্গে ব্যভিচার করাটা একটা গৰ্হিত অপরাধ বলে গণ্য করা হয়েছে। সেখানে বলা হয়েছে, যদি কোনো পুরুষ অনুঢ়া মেয়ের সঙ্গে ব্যভিচার করে, তবে তার সমস্ত সম্পত্তি বাজেয়াপ্ত করা হবে এবং তাকে দেশ থেকে তাড়িয়ে দেওয়া হবে। আরও বলা হয়েছে যে, রাজা সংশ্লিষ্টা কুমারীকে সমস্ত কলঙ্ক থেকে মুক্ত করবেন এবং তাকে তার অভিভাবকদের হাতে সমর্পণ করবেন, যদি অভিভাবক যথোচিত প্রায়শ্চিত্ত নিম্পাদনের ব্যবস্থা করে।

কিন্তু দেখা যায়, মহাভারতীয় যুগে কুমারী মেয়েদের যৌনসংসর্গ অনুমোদিত হত। বোধহয় তার আগের যুগেও হ’ত। কেননা, ছান্দোগ্য উপনিষদে আমরা দেখতে পাই, মহৰ্ষি সত্যকামের মাতা জবালা যৌবনে বহুচারিণী ছিলেন। মহাভারতে এরূপ সংসর্গের একাধিক দৃষ্টান্ত আছে। পরাশর-সত্যবতীর কাহিনী সুবিদিত। সত্যবর্তী যৌবনে যমুনায় খেয়া-পারাপারের কাজে নিযুক্ত থাকত। একদিন পরাশরমুনি তার নৌকোয় উঠে, তার অপরূপ সৌন্দর্যে মুগ্ধ হয়ে তার সঙ্গে যৌনমিলন প্রার্থনা করে। সত্যবতী তখন পরাশরকে বলে—নৌকোর মধ্যে আমি কী ভাবে যৌনকর্মে রত হব, কেননা তীর হতে লোকের আমাদের দেখতে পাবে। পরাশর তখন কুজ্যাটিকার স্মৃষ্টি করেন ও তারই অন্তরালে তার সঙ্গে যৌনমিলনে রত হন। এর ফলে কৃষ্ণদ্বৈপায়ন ব্যাসের জন্ম হয়। কুন্তীও কুমারী অবস্থায় সূর্যের সঙ্গে মিলনের ফলে কৰ্ণকৈ প্রসব করেন। মাধবী-গালব উপাখ্যানেও আমরা দেখি যে, প্রতিবার সন্তান-প্রসবের পরও মাধবী কুমারী ছিল। ওই যুগের সমাজে বিবাহের পূর্বে যে মেয়েদের যৌনসংসর্গ অনুমোদিত হ’ত এবং এরূপ যৌনসংসর্গের জন্য মেয়ের তাদের কুমারীত্ব হারাত না, ত৷ কুমারী মেয়েদের সন্তানদের বিশিষ্ট আখ্যা থেকে বুঝতে পারা যায়। এ-সম্বন্ধে কৃষ্ণ কর্ণকে বলেছেন, ‘কুমারী মেয়ের দু’রকম সন্তান হতে পারে—(১) কানীন ও (২) সহোঢ়। যে সন্তানকে কন্যা বিবাহের পূর্বেই প্রসব করে, তাকে বলা হয় ‘কানন। আর যে মেয়ে বিবাহের পূর্বে গর্ভধারণ করে বিবাহের পরে সন্তান প্রসব করে, সে-সন্তানকে বলা হয় সহোঢ়’। মহাভারতের অপর একজায়গায় ভীষ্ম যুধিষ্ঠিরকে বলছেন, ‘কুমারী মেয়ের দু’রকমের সন্তান হতে পারে। যে সন্তানকে সে বিবাহের পূর্বে প্রসব করে, তাকে বলা হয় কানীন, আর যে সন্তানকে সে বিবাহের পরে প্রসব করে, তাকে বলা হয় অরোঢ়। এসব থেকে বুঝতে পারা যায় যে, মহাভারতীয় যুগে কুমারী কন্যার পক্ষে গর্ভধারণ করা বিশেষ নিন্দনীয় ব্যাপার ছিল না।

***

এ-সম্পর্কে পরবর্তীকালের মুঘল-অন্তঃপুরের একটা রীতি উল্লেখের দাবি রাখে। মুঘল বাদশাহগণের মেয়ের (বাদশাজাদীরা) সাধারণত পবিত্র বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হ’ত না। তার আজীবন অবিবাহিত থেকে বিবাহিত জীবনের দৈহিক সুখ গোপনে উপভোগ করত। কথিত আছে, সম্রাট আকবর নাকি এই ঘৃণিত প্রথা প্রবর্তন করেছিলেন। মনে হয়, বাদশাজাদীর স্বামী ভবিষ্যতে সিংহাসনের উত্তরাধিকার নিয়ে বিবাদ করতে পারে এবং অসীম শক্তিশালিনী বাদশাজাদী স্বামীর স্বার্থের জন্য ভ্রাতা বা পিতার বিরুদ্ধে চক্রান্ত করতে পারে, এই আশঙ্কায় মুঘল সম্রাটগণ তাদের মেয়েদের বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ করতেন না।

আদিবাসী সমাজে অবিবাহিত ছেলেমেয়েদের মধ্যে যৌনাচার অনুমোদিত। যৌথ ঘুমঘরগুলিতে ছেলেমেয়েরা একত্রে রাত্রিযাপন করে। এগুলি তরুণ-তরুণীদের যৌনচর্চায় দক্ষতা অর্জনের সংস্থা হিসাবে ব্যবহৃত হয়। মধ্যপ্রদেশের গোণ্ডদের মধ্যে প্রচলিত ঘুমঘরগুলিকে ঘোটুল’ বলা হয়। মুণ্ড ও বিরহোড়রা এগুলিকে ‘গিতিওড়া’ বলে। আসামের গারো জাতিরা এগুলিকে লোকপণ্ডে’ বলে। নাগাদের মধ্যে এগুলিকে বলা হয় ‘মোরাং। যৌথ ঘুমঘরগুলির মধ্যে প্রসিদ্ধ হচ্ছে মুরিয়াদের ভেতর প্রচলিত ঘাটুল। মুরিয়াদের মধ্যে বিদ্যমান ঘোটুল পূর্ণবিকশিত ঘুমঘরের প্রতীক। ঘোটুলের ভিতরটায় নানারকম চিত্র অঙ্কিত ও খোদিত থাকে। অনেকস্থলেই এসকল চিত্র যৌন-অর্থব্যঞ্জক। কোনো কোনো ঘোটুলে প্রকাণ্ড আকারের পুরুষাঙ্গবিশিষ্ট এক তরুণ একটি তরুণীকে আলিঙ্গন করে ধরে আছে-এরূপ চিত্রও অঙ্কিত থাকে। ঘোটুলের মধ্যে যৌনজীবন অনুস্থত হলেও, প্রকৃত বিবাহের বয়স এলে তাদের অপরের সঙ্গে নিয়মানুগ বিবাহ করতে হয়। ঘোটুলের একটা বৈশিষ্ট্য হচ্ছে এই যে, কী সুন্দরী কী কুৎসিতা—সকল মেয়েই যৌনচর্চায় সমান অধিকার পায়। তবে তরুণ-তরুণীদের একই জুড়িদারের সঙ্গে তিনদিনের বেশি শুতে দেওয়া হয় না। (ঘোটুলের যৌনচর্চার পূর্ণ বিবরণের জন্য লেখকের ‘ভারতে বিবাহের ইতিহাস’ দ্রষ্টব্য)। ঘোটুল ছেলেমেয়েদের যৌনাচার অনুশীলনের একটা মাধ্যম-বিশেষ। এরূপ যৌনাচারের মধ্যে মেয়েদের পুরুষের আধিপত্য মেনে নেবার, বা পুরুষের মেয়েদের ওপর আধিপত্য প্রকাশের কোনো অবকাশই থাকে না। কেননা,সকল ছেলেমেয়েরই যৌনাচারে সমান অধিকার থাকে। তাছাড়া, এসব যৌনাচার শাশ্বত নয়। ঘোটুলের জীবন শেষ হলে মেয়ের অন্ত পুরুষকে বিবাহ করে এবং তার সঙ্গে মুখেই ঘর করে। ঘোটুল-জীবনের জুড়িদারের কোনো প্রভাব তাদের মনের ওপর ছাপ ফেলে না।

***

পুরুষের আধিপত্য না মেনে মেয়েরা যৌনাচারে লিপ্ত হতে পারে তু’রকমে। এক হচ্ছে সামান্যা’ বা বারাঙ্গনার জীবন যাপন করে। আরএকরকম হচ্ছে পুরুষ-ব্যতিরেকে বিকল্প উপায়ে। কিন্তু সমাজের স্বাস্থ্য ও সংহতির দিক থেকে এ-দুটোর কোনোটাই কাম্য নয়। সামান্ত বা বারাঙ্গনাদের সম্বন্ধে বিশদ আলোচনা করেছেন বাৎস্যায়ন তার “কামসূত্রে। বাৎস্যায়ন বারাঙ্গনাদের ছয় শ্রেণীতে ভাগ করেছেন; যথা— (১) পরিচারিকা, (২) কুলটা, (৩) স্বৈরিণী, (৪) নটী, (৫) শিল্পকারিকা ও (৬) প্রকাশবিনষ্ট। এদের প্রত্যেকেরই নিজ নিজ বৈশিষ্ট্য আছে। কোনো বারাঙ্গন-তুহিত বিবাহিত হয়ে যদি একবৎসর নিজ পতির কাছে ‘সতী হয়ে থাকে, এবং তারপর নিজের ইচ্ছেমত যৌনাচারে প্রবৃত্ত হয়,কিন্তু প্রাক্তন স্বামী এলে তার সঙ্গে একরাত্রি বাস করে তার পরিচর্যায় রত হয়, তবে সেরূপ নারীকে পরিচারিকা’ বলা হয়। ভরত-নাট্যশাস্ত্রে পরিচারিকা’র অবশ্য অন্য সংজ্ঞা দেওয়া হয়েছে। যে নারী স্বামীর ভয়ে অপরের গৃহে গিয়ে অপর পুরুষের সঙ্গে যৌনাচারে লিপ্ত হয়, তাকে কুলটা বলা হয়। যে নারী নিজ স্বামীকে গ্রাহা না করে নিজ গৃহে বা অন্য গৃহে অপর পুরুষের সঙ্গে যৌনাচারে লিপ্ত হয়, তাকে স্বৈরিণী” বলা হয়। যে নারী নাচগান করে, অথচ বেশ্বাবৃত্তিও করে, তাকে “নটী” বলা হয়। রজক, তন্তুবায় প্রভৃতি শিল্পীর ভাৰ্য যখন পতির অনুমতি নিয়ে বিত্তবান লোকের সঙ্গে যৌনাচারে লিপ্ত হয়, তাকে ‘শিল্পকারিকা’ বলা হয়। যে নারী স্বামী জীবিত থাকাকালীন বা তার মৃত্যুর পর প্রকাশ্যে অপরের সঙ্গে যৌনাচারে লিপ্ত হয়, তাকে ‘প্রকাশবিনষ্টা’ বলা হয়।

ৰৰ্তমানকালে আমরা তাদেরই বারাঙ্গন বলি, যারা অর্থপ্রাপ্তির আশায় অপর পুরুষগণের সঙ্গে কামাচারে প্রবৃত্ত হয়। এরূপ বারাঙ্গনা অবশ্য আমাদের দেশে ঋগ্বেদের আমল থেকেই ছিল। ‘সমন’ উৎসবে তাদের উপস্থিতির কথা আমি আগেই বলেছি। বাজসনেয়ী সংহিতা – থেকে আমরা জানতে পারি যে, তখন গণিকাবৃত্তি প্রচলিত ছিল। রামায়ণেও আমরা পাই, গণিকাদের নিযুক্ত করেই বিভাগুকমুনির পুত্র ঋষ্যশৃঙ্গকে অঙ্গরাজ্যে আনা হয়েছিল। মহাভারতে আমরা দেখি যে, রণক্ষেত্রে সৈনিকগণের মনোরঞ্জনের জন্য গণিকাদের শিবির স্থাপন করা হত। বৌদ্ধসাহিত্য থেকেও আমরা গণিকাবৃত্তি প্রচলনের কথা জানতে পারি। অম্বপালী, পত্নমাবতী, সালবতী, সিরিম, বিমলা, অৰ্ধকাশী প্রভৃতি গণিকাদের কথা আমরা বৌদ্ধসাহিত্যে পাই। একমাত্র আদিবাসী সমাজেই গণিক অনুপস্থিত।

পুরুষের আধিপত্য অস্বীকার করে মেয়েরা অবশু স্বাধীনভাবে সামান্সার জীবন যাপন করতে পারে, কিন্তু সেটা তো সামাজিক সংহতি ও স্বাস্থ্যের দিক থেকে কাম্য নয়। তাছাড়া, সৃষ্টি বজায় রাখতে হলে স্ত্রী ও পুরুষকে পরস্পরের সংলগ্ন থাকতেই হয়।

***

পুরুষের আধিপত্য মানা তো দূরের কথা, বিনা-পুরুষেই নারী যেভাবে তার যৌনাচারের অনুশীলন করতে পারে, তা হচ্ছে হস্তমৈথুন (masturbation) ও সমরতি-কামনা (lesbianism) l এ দুটোই হচ্ছে পুরুষবিমুখী অভ্যাস। হস্তমৈথুন হচ্ছে যোনিগহবরকে অঙ্গুলি-সঞ্চালন দ্বারা উত্তেজিত করে যৌনসুখ উৎপাদন করা। আর সমরতি-কামনা হচ্ছে এক নারীর অপর নারীর সহিত প্রণয়ীর সম্পর্ক স্থাপন করে কামাসক্ত হওয়া। হস্তমৈথুন যে নারীসমাজে ব্যাপকভাবে প্রচলিত আছে, তা আমরা হ্যাভলক এলিস, ফ্রয়েড, ক্যাথারিন ডেভিস, এডওয়ার্ড কাপেন্টার স্টেকেল ও মল (Moll)-এর গ্রন্থসমূহ থেকে জানতে পারি। বর্তমান শতাব্দীর শেষার্ধে এ-সম্বন্ধে বিশেষ সমীক্ষা করেছেন যুক্তরাষ্ট্রের কিনসে (Alfred Kinsey)। এই সমীক্ষা মেয়েদের স্বীকারোক্তির ভিত্তিতে করা হয়েছে। বিভিন্ন বয়স-পর্যায়ে শতকরা কতজন মেয়ে ও পুরুষ হস্তমৈথুনে লিপ্ত হয়, তা কিনসের রিপোটের ভিত্তিতে দেওয়া হল :

(১) বিশ বছর বয়সের মধ্যে—
পুরুষ ৯০ শতাংশ।
মেয়ে ৩০ শতাংশ।

(২) চল্লিশ বছর বয়সের মধ্যে—
পুরুষ ৯৫ শতাংশ।
মেয়ে ৮০ শতাংশ।

তাহলে দেখা যাচ্ছে যে, ২০—৪০ বছর বয়সের মধ্যেই মেয়েদের মধ্যে হস্তমৈথুন প্রবলভাবে বৃদ্ধি পায়। কিনসের রিপোর্ট থেকে আমরা আরো জানতে পারি যে, কুমারী মেয়েদের ক্ষেত্রে এটা খুবই ব্যাপকভাবে প্রচলিত; তবে বিবাহিত মেয়েরাও অধিকাংশ ক্ষেত্রে হস্তমৈথুনে লিপ্ত হয়। কিনসের রিপোর্টের এক অংশে পড়ি এবং সেটাই বোধহয় বিবাহিত মেয়েদের হস্তমৈথুনে লিপ্ত হবার কারণ। কিনসে বলেছেন, ‘For perhaps three-quarters of all males, orgasm is reached within three minutes after the initiation of the sexual relation…Considering many upper level females who are adversely conditioned to sexual situations that they may require ten to fifteen minutes of the most careful stimulation to bring them to climax, and considering the fair number of females who never come to climax in their whole lives, it is, of course, demanding that the male be quite abnormal in his ability to prolong sexual activity without ejaculation if he is required to match the female partner.”

এ সম্পর্কে D. H. Lawrence-এর উক্তি–‘Woman should not experience the orgasm’ একটা অবাস্তব উক্তি।

একজন অস্তিবাদী (existentialist) লেখিকা যিনি মেয়েদের যৌনজীবন সম্বন্ধে অনুশীলন করেছেন, তিনি হচ্ছেন সিমোন দ্য বভোয়ার। তিনিও বলেছেন, ‘It is certainly true that woman’s sex pleasure is quite different from man’s.’ এজন্য গণিকারাও হস্তমৈথুনে প্রবৃত্ত হয়।

সমরতি-কামনায় (lesbianism) পুরুষকে পরিহার করে দুই নারী পরস্পর প্রেমাবদ্ধ হয়ে হস্তমৈথুন বা অন্ত কোনো উপায়ে নিজেদের কামাচার থেকে যৌনসুখ উপলব্ধি করে। সিমোন দ্য বভোয়ার বলেছেন, ‘The lesbian in fact, is distinguished by her refusal of the male and her liking for feminine flesh; but every adolescent female fears penetration and masculine domination, and she feels a certain repulsion for the male body; on the other hand, the female body is for her, the male, an object of desire.”

আবার এ-সম্বন্ধে যুক্তরাষ্ট্রের জন হপকিন্স বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক Harold Roses বলেছেন, “As sexual modes have changed, increasing number of lesbian women have proclaimed the right to live their homosexual lives openly.”

কিন্তু এরূপ মনোবৃত্তি একটা অস্বাভাবিক ব্যাপার। পুরুষের সংলগ্ন হয়ে থাকাই মেয়েদের স্বাভাবিক ধর্ম। এর জন্য তাদের যে মাত্র পুরুষের আধিপত্য স্বীকার করতে হয়, তা নয়। অনেকসময় তারা পুরুষের হাতে দৈহিক পীড়নের জন্যও নিজেদের সমর্পণ করে। দৈহিক পীড়ন (masochism) থেকেই তাদের যৌনসুখ হয়। এ-সম্বন্ধে Havelock Ellis তাঁর ‘Psychology of Sex’ গ্রন্থে বলেছেন, “That the infliction of pain is a sign of love is widespread idea both in ancient and modern times. Lucian makes a woman say : He who has not rained blows on his mistress and torn her hair and her garments is not yet in love.”

Cervantes-ও তাঁর এক নভেলে এক নায়িকার মুখ দিয়ে বলিয়েছেন, ‘He does not know how to make me suffer a little. One cannot love a man who does not make one suffer a little.’

আবার Congreve-এর ‘Way of Life’-ে Millament বলেছেন : ‘One’s cruelty is one’s power.’ রবীন্দ্রনাথের ‘চার অধ্যায়’-এও এলা অতীনের পা জড়িয়ে ধরে বলছে, মারো আমাকে অন্তু নিজের হাতে। তার চেয়ে সৌভাগ্য আমার আর কিছু হতে পারে না।’ বস্তুত মেয়েরা স্বেচ্ছাতেই পুরুষের আধিপত্য মেনে নেয়, এবং তার জন্য মারধোর খাওয়ার জন্যও প্রস্তুত থাকে। তবে পুরুষের দিক থেকে নিজের আধিপত্য তুলে ধরবার যে প্রয়াস নেই, তা বলছি না। বস্তুত অনেক স্থলেই মেয়ে ও পুরুষ পরস্পরের আধিপত্য তুলে ধরবার চেষ্টা করে। সেক্ষেত্রে প্রকাশ পায় দ্বন্দ্ব, সঙ্ঘর্ষ ও মারধোর। এই তে আমার বাড়ির পাশের ফ্ল্যাট থেকেই শুনতে পাই। স্বামী ও স্ত্রী দুজনেই শিক্ষিত ও দুজনেই স্বাবলম্বী। স্বামী অফিস থেকে আগে ফিরে এসেছে। স্ত্রী শেষে ফিরে স্বামীকে তিরস্কার করে বলে—‘অফিস থেকে আগে ফিরেছে, চায়ের জলটা তো স্টোভে চাপিয়ে দিতে হয়, সেটাও পার না?’ এই নিয়ে দুজনে বচসা, তারপর ধস্তাধস্তি। স্ত্রী পাড়ার লোকের উদ্দেশ্যে চিৎকার করে, “আমাকে বাঁচান, আমাকে বাঁচান।’ তারপর সবই নীরব। এতে তাদের দাম্পত্যজীবনের সুখ ব্যাহত হয় না; আমার এক বন্ধুর মা বলতেন : বিবাহের পর প্রথম বৎসর স্ত্রী তার স্বামীর কথা শোনে, দ্বিতীয় বৎসরে স্বামী তার স্ত্রীর কথা শোনে, আর তৃতীয় বৎসরে স্বামী-স্ত্রী উভয়ের কথা পাড়ার লোক শোনে।

***

এসব থেকে মনে হয় যে, মেয়ের পুরুষের আধিপত্যটা দাম্পত্যজীবনের আনুষঙ্গিক ব্যাপার হিসাবেই গ্রহণ করে। আমি আবার সেই ভৈরব ও দক্ষিণেশ্বরের ঠাকুর রামকৃষ্ণের কথাতেই ফিরে আসছি। নারীর দুটি ভাব—নারী কামিনী ও জননী। মানুষের পারিবারিক জীবনে এ-ফুটি ভাবই গঙ্গা-যমুনার মতো সম্মিলিত ধারাতে প্রবাহিত। কামিনী হিসাবে নারীর আছে যৌনক্ষুধা। সেটার নিবৃত্তি করতে গিয়েই সে সন্তানবতী হয়। তখনই তার জননীরূপ প্রকাশ পায়। কিন্তু জননীরূপে সন্তানকে প্রতিপালন করতে হলে পুরুষকে তার দরকার হয়। সুতরাং পুরুষের আধিপত্য তাকে মানতেই হয়। এককথায় পুরুষ তার মাত্র প্রণয়ী নয়, পুরুষ তার সস্তানের জনক ও পালক, পুরুষ তার হাতিয়ার-বিশেষ।

জননী-ভাবটা যদি ছেড়েই দিই, কামিনী হিসাবে তার আদিম যৌনক্ষুধা নিবৃত্তির জন্য পুরুষ তার কাছে অপরিহার্য। সেজন্যই আমরা প্রথম বিদ্রোহী নারী সাদ (George Sand)-কে দেখি বারবার পুরুষের হাতে আত্মসমপণ করতে। বিংশ শতাব্দীতেও আমরা দেখেছি অস্তিবাদী লেখিকা সিমোন দ্য বভোয়ার (যিনি নারীজীবন সম্বন্ধে সবচেয়ে বেশি অনুশীলন করেছেন) কুমারী হয়েও আত্মসমপণ করেছেন পল দ্য সারতার (Paul de Sartre) কাছে। এ সম্পর্কে মনে পড়ে যায় শরৎচন্দ্রের শ্রীকান্ত ও রাজলক্ষ্মীকে। কিন্তু শরৎচন্দ্র শ্রীকান্ত ও রাজলক্ষ্মীর মধ্যে যে সম্পর্ক চিত্রিত করেছেন, সে সম্পর্কট সম্পূর্ণ অবাস্তব সম্পর্ক। এটা Platonic love-এর সম্পর্ক। বাস্তব জীবনে স্ত্রী-পুরুষের মধ্যে এরকম Platonic love-এর সম্পর্ক একেবারেই বিরল। সেদিক থেকে রবীন্দ্রনাথ তার চার অধ্যায়?-এ একেবারেই বাস্তব। সেখানে রবীন্দ্রনাথ বাস্তব ও জৈব সত্যের বাসরঘরে শেষ চুম্বন দিয়েই তাঁর কাহিনী শেষ করেছেন।

সারা পৃথিবীতে যদিও নারী ও পুরুষের সংখ্যা প্রায় সমান সমান, তা সত্ত্বেও নারী যে পুরুষের সমান নয়—অসমান, সে বিষয়ে সে খুবই সচেতন। শিক্ষাদীক্ষা, খেলাধুলা, পেশা ও কর্মনিযুক্ততায় নারী অনেকদূর এগিয়ে গেলেও সে তার জৈব জীবনে স্বাবলম্বী নয়। জৈব জীবনে নারী তখনই স্বাবলম্বী হয়, যখন সে পুরুষের কণ্ঠলগ্ন হয়ে থাকে। এজন্যই মধ্যযুগের নারী তার আর্তি প্রকাশ করেছিল এক গীতের মাধ্যমে। করুণ কণ্ঠে সে গেয়ে উঠেছিল—‘ওপার হতে বাজাও বাঁশী, এপার হতে শুনি।/ অভাগিয়া নারী আমি, সাঁতার নাহি জানি॥’

পুরুষকে না পেয়ে সে নিজেকে অভাগী বলেই মনে করেছিল।

***

এটা নারীর দুর্বলতা হোক বা আদিম অভিশাপই হোক, নারী শিক্ষিতাই হোক বা অশিক্ষিতাই হোক, সে চায় পুরুষের সান্নিধ্য; তার সঙ্গে জড়িয়ে থাকুক না কেন পুরুষের আধিপত্য। অশিক্ষিত নারীদের কথা ছেড়েই দিলাম; শিক্ষিত নারীদের প্রবণতা এ-সম্পর্কে সবাক সাক্ষ্য বহন করে। খবরের কাগজে পাত্র-পত্রিী চাই স্তম্ভটা দেখলেই এটা বুঝতে পারা যায়। আমার সামনে যে কাগজখানা পড়ে রয়েছে, সেখান খুলে দেখি শিক্ষিত মেয়েদের জন্য পাত্রের সন্ধান অসংখ্য। গুনে দেখি মাত্র একদিনের কাগজেই রয়েছে ১৫৩টা বিজ্ঞাপন। যাদের জন্য পাত্র খোজা হচ্ছে, তারা এম. এ, বি. টি. থেকে স্নাতক ও ফাস্ট-ক্লাস স্নাতক অনার্স। একজন আছে বি. কম., ম্যানেজমেণ্ট ডিপ্লোমাপ্রাপ্ত মেয়ে। তিনজন লাইব্রেরিয়ান ডিপ্লোমাপ্রাপ্ত। একজন ডাক্তার। বয়স ১৯ থেকে ৩৭। অধিকাংশ বিজ্ঞাপনেই বলা হয়েছে যে, পাত্রী ফর্সা ও সুশ্রী। ১৫৩ জনের মধ্যে ৬৫ জন চাকরিতে রত। কেউ অধ্যাপিকা, কেউ কেন্দ্রীয় সংস্থায় চাকরি করে, কেউ পাবলিক সার্ভিস কমিশনের স্টেনোগ্রাফার, আবার কেউ-বা শিক্ষিকা। দু-একজন আইনজ্ঞও আছে। কেউ কেউ অসবর্ণ বিবাহ করতেও রাজি। এককথায় সকলেই শিক্ষিতা ও আধুনিক স্ত্রী-স্বাধীনতার প্রতীক। কিন্তু সকলেই বিবাহিতা হবার জন্য লালায়িত। সকলেই পুরুষের সঙ্গিনী হতে চায়, যদিও জানে এর মানে পুরুষের আধিপত্য স্বীকার করা। এটা যে নিছক পাগলামি নয়, তা সকলেই স্বীকার করবেন। পুরুষ-ভজনার জন্য কেন এই প্রবণতা? তার কারণ আর কিছুই নয়, নারী কামিনী ও জননী। কামিনী হিসাবে আছে তার আদিম যৌনক্ষুধা, আর জননী হিসাবে আছে তার মাতৃত্বের গর্ব। মাতৃত্বের গর্ব যে কত গভীর, তা উনিশ শতকের ঔপন্যাসিক মিসেস উড-এর ‘ইস্ট লীন’ উপন্যাসখান পড়লেই বুঝতে পারা যায়। মাতৃত্বের গর্বই হচ্ছে ‘প্রমীলা কেন পুরুষ ভজে?’—প্রশ্নের উত্তর। তবে বৈধতার সঙ্গে প্রমীলা কাকে ভজবে, সেটা নির্ভর করে সামাজিক রীতিনীতি ও বিধানের ওপর।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *