৭. জনপ্রবাহ ও মানস-সংস্কৃতি

দ্বিতীয় অধ্যায় । ইতিহাসের গোড়ার কথা 
সপ্তম পরিচ্ছেদ –  জনপ্রবাহ ও মানস-সংস্কৃতি

জনপ্রবাহ ও মানস-সংস্কৃতি

বাস্তব সভ্যতার উপাদান-উপকরণ এবং তাহার সঙ্গে জনপ্রবাহের সম্বন্ধের কিছু আভাস লইতে চেষ্টা করা গেল। এইবার মানস-সংস্কৃতি এবং জনপ্রবাহের খানিকটা সম্বন্ধ নির্ণয়ের চেষ্টা করা যাইতে পারে।

অস্ট্রিক ভাষাভাষী আদি-অষ্ট্রেলীয়দের কথাই সর্বাগ্রে বলিতে হয়, কারণ ভারতীয় নিগ্রোবটুদের মানস-সংস্কৃতি সম্বন্ধে প্রায় কিছুই আমরা জানি না। অস্ট্রিক ভাষাভাষী প্রাচীন ও বর্তমান জনদের সম্বন্ধে যতটুকু জানা যায় এবং অনুমান করা যায়, তাহাতে মনে হয়, ইহারা অতি সরল ও নিরীহ প্রকৃতির লোক ছিল। ঐতিহাসিক যুগে ইহাদের বিবর্তন ও পরিবর্তনের গতি ও প্রকৃতি দেখিয়া মনে হয়, ইহাদের মধ্যে দৃঢ়তা ও সংহতির কিছু অভাব ছিল; সহজেই ইহারা পরের নিকট বশ্যতা স্বীকার করিত এবং আত্মসমর্পণ করিয়াই নিজেদের অস্তিত্ব বজায় রাখিত। বারবার অধিকতর পরাক্রান্ত জাতির নিকট রাষ্ট্ৰীয় ও অর্থনৈতিক বশ্যতা স্বীকার করিয়াও যে ইহারা নিজেদের জনগত বৈশিষ্ট্য ও প্রকৃতি আজও বজায় রাখিতে পারিয়াছে, তাহাতে মনে হয় এই বশ্যতা স্বীকার করিয়াও স্বকীয় বৈশিষ্ট্য বজায় রাখাই ইহাদের প্রাণশক্তির মূল। বর্তমান শবর বা সাঁওতাল, ভূমিজ বা মুণ্ডা প্রভৃতির জীবনাচরণ একটু মনোযোগ দিয়া দেখিলে মনে হয়, ইহারা কিছুটা কল্পনাপ্রবণ, দায়িত্বহীন, অলস, ভাবুক এবং কতকটা কামপরায়ণও বটে। ভারতবর্ষের ইতিহাসে শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরিয়া এত বিবর্তন-পরিবর্তন হইয়াছে, কিন্তু ইহাদের প্রকৃতিগত বৈশিষ্ট্য তাহাতে বিশেষ বদলাইয়াছে বলিয়া মনে হয় না।

এই অস্ট্রিক ভাষী আদি-অষ্ট্রেলীয়েরা মানুষের একাধিক জীবনে বিশ্বাস করিত, এখনও করে। কাহারও মৃত্যু হইলে তাহার আত্মা কোনও পাহাড় অথবা গাছ অথবা কোন জন্তু বা পক্ষী বা অন্য কোনও জীবকে আশ্রয় করিয়া বাঁচিয়া থাকে, ইহাই ছিল ইহাদের ধারণা; পরবর্তী কালে এই ধারণাই হিন্দু পুনর্জন্মবাদ ও পরলোকবাদে রূপান্তরিত হয়। মৃতদেহ ইহারা কাপড় অথবা গাছের ছালে জড়াইয়া বৃক্ষস্কন্ধে অথবা ডালে ঝুলাইয়া রাখিত, বা মাটির নীচে কবর দিয়া তাহার উপর বড়ো বড়ো পাথর সোজা করিয়া পুঁতিয়া দিত, অথবা স্ত্রীলোক হইলে কবরের উপর লম্বালম্বি করিয়া শোয়াইয়া দিত (গন্দ, কোরক, খাসিয়া প্রভৃতিরা এখনও ঠিক যেমনটি করে), মৃতব্যক্তিকে মাঝে মাঝে আহার্যও দান করিত, যেমন এখনও করে। এইসব বিশ্বাস ও রীতিই পরবর্তী কালে হিন্দুসমাজে গৃহীত হইয়া শ্ৰাদ্ধাদি কার্যে মৃতের উদ্দেশে পিণ্ডদান ইত্যাদি ব্যাপারে রূপান্তরিত হইয়াছে। লিঙ্গ-পূজাও ইহাদের মধ্যে প্রচলিত ছিল বলিয়া মনে হয়। ‘লিঙ্গ’ শব্দটিও তো অস্ট্রিক ভাষার দান, এবং কোনও কোনও নৃতত্ত্ববিদ খাসিয়াদের সমাধির উপর যে দীর্ঘাকার পাথর দাঁড় করানো এবং শোয়ানো থাকে তাহাকে যথাক্রমে লিঙ্গ ও যোনি বলিয়া অনুমানও করিয়াছেন। বস্তুত, পলিনেশীয় ভাষায় এখনও ‘লিঙ্গ’ তাহার সুপরিচিত অর্থেই ব্যবহৃত হয় এবং তাহার তুষ্টিবিধানের চেষ্টাও সুবিদিত। পশিলুস্কি এই সম্বন্ধে বলিতেছেন :

The phallic cults, of which we know the importance in the ancient religions of Indo-China, are generally, considered to have been derived from Indian Saivism. It is more probable that the Aryans; have borrowed from the aborigines of India the cult of Linga as well as the name efthe idol. These popular practices despised by the Brahmanas were ill-known in old times. If we try to know them better, we will probably be able to see clearly why so many non-Aryan words of the family of Linga have been introduced into the language of the conquerors.

অস্ট্রিকভাষীরা বিশেষ বিশেষ বৃক্ষ, পাথর, পাহাড়, ফলমূল, ফুল কোনওবিশেষ স্থান, বিশেষ বিশেষ পশু, পক্ষী ইত্যাদির উপর দেবত্ব আরোপ করিয়া তাহার পূজা করিত। এখনও খাসিয়া, মুণ্ডা, সাঁওতাল, শবর ইত্যাদি কোমের লোকেরা তাহা করিয়া থাকে। বাঙলাদেশে পাড়াগায়ে গাছপূজা তো এখনও বহুলপ্রচলিত, বিশেষভাবে শেওড়াগাছ ও বটগাছ; আর, পাথর ও পাহাড়-পূজাও একেবারে অজ্ঞাত নয়। বিশেষ বিশেষ ফল-ফুল-মূল সম্বন্ধে যে সব বিধি-নিষেধ আমাদের মধ্যে প্রচলিত, যে সব ফল-মূল আমাদের পূজাচনায় উৎসর্গ করা হয়, আমাদের মধ্যে যে নবান্ন উৎসব প্রচলিত, আমাদের ঘরের মেয়েরা যে সব ব্রতানুষ্ঠান প্রভৃতি করিয়া থাকেন, ইত্যাদি, বস্তুত, আমাদের দৈনন্দিন অনেক আচার-অনুষ্ঠানই এই আদিম অস্ট্রিক-ভাষাভাষী জনদের ধর্মবিশ্বাস ও আচার-অনুষ্ঠানের সঙ্গে জড়িত। একটু লক্ষ্য করিলেই দেখা যাইবে, ইহাদের অনেকগুলিই কৃষি ও গ্রামীণ সভ্যতার স্মৃতি ও ঐতিহ্যের সঙ্গে জড়িত। আমাদের নানা আচারানুষ্ঠানে, ধর্ম, সমাজ ও সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে আজও ধান, ধানের গুচ্ছ, দূর্বা, কলা, হলুদ, সুপারি, নারিকেল, পান, সিন্দূর, কলাগাছ প্রভৃতি অনেকখানি স্থান জুড়িয়া আছে। লক্ষণীয় এই যে, ইহার প্রত্যেকটিই অস্ট্রিক ভাষাভাষী জনদের দৈনন্দিন জীবন ও সংস্কৃতির সঙ্গে ঘনিষ্ঠ সম্বন্ধে আবদ্ধ। বাঙলাদেশে, বিশেষভাবে পূর্ববাঙলায়, এক বিবাহ ব্যাপারেই ‘পানখিলি’, ‘গাত্রহরিদ্রা’, ‘গুটিখেলা’, ‘ধান ও কড়ির স্ত্রী-আচার’ প্রভৃতি যে সব অবৈদিক, অস্মার্ত ও অব্রাহ্মণ্য, অপৌরাণিক অনুষ্ঠান ইত্যাদি দেখা যায় তাহাও তো এই কৃষি-সভ্যতা ও কৃষি-সংস্কৃতির স্মৃতিই বহন করে। ধান্যশীর্ষপূর্ণ যে লক্ষ্মীর ঘটের পূজা বাঙলাদেশে প্রচলিত তাহার অনুরূপ পূজা তো এখনও ওঁরাও-মুণ্ডাদের মধ্যে দেখা যায়; ইহাদের ‘সরণা’ দেবীর মাথায় ধান্যশীর্যের জটার কল্পনা সুপ্রাচীন। শ্রাদ্ধাদি ব্যাপারে অথবা অন্য কোনও শুভ কাজের প্রারম্ভে ‘আভ্যুদয়িক’ নামে পিতৃপুরুষের যে পূজা আমরা করিয়া থাকি, তাহাও তো আমরা এই অস্ট্রিক ভাষী লোকদের নিকট হইতেই শিখিয়াছি বলিয়া মনে হয়। এই ধরনের পিতৃপুরুষের পূজা এখনও সাঁওতাল, ওঁরাও, মুণ্ডা, শবর, ভূমিজ, হো ইত্যাদির মধ্যে সুপ্রচলিত। শরৎকুমার রায় মহাশয় তো বলেন, ভারতে শক্তিপূজার প্রবর্তন সম্ভবত ইহারাই প্রথম করে। ওঁরাও প্রভৃতি জাতির চাণ্ডী নামক দেবতার সহিত হিন্দু চণ্ডীদেবীর সাদৃশ্য দেখা যায়। অর্ধরাত্রে উলঙ্গ হইয়া ওঁরাও অবিবাহিত যুবক-পূজারী চাণ্ডী স্থানে গিয়া চাণ্ডীর পূজা করে।

বাঙলাদেশে হোলি বা হোলাক উৎসব এবং নিম্নশ্রেণীর মধ্যে চড়ক-ধর্মপূজার মিশ্রিত সমন্বিত রূপ বিশ্লেষণ করিলে এমন কতকগুলি উপাদান ধরা পড়ে যাহা মূলত আর্যপূর্ব আদিম নরগোষ্ঠীদের মধ্যে এখনও প্রচলিত। নিম্নশ্রেণী ও নিম্নবর্ণের অনেক ধর্মানুষ্ঠান সম্বন্ধেই এ কথা বলা যাইতে পারে।

দ্রাবিড়ভাষী লোকদের মানসপ্রকৃতিও ইহাদে র প্রাচীন সাহিত্য ও শিল্পকলা এবং প্রাগৈতিহাসিক তাম্র-প্রস্তর যুগের ধ্বংসাবশেষ হইতেই কিছু কিছু অনুমান করা যায়। মনে হয়, ইহারা খুব কর্মঠ ও উদ্যমশীল, সংঘশক্তিতে দৃঢ়, শিল্প-সুনিপুণ এবং কতকটা অধ্যাত্মরহস্যসম্পন্ন প্রকৃতির লোক ছিল। প্রাচীন তামিল সাহিত্য যদি প্রামাণিক হয় তাহা হইলে ইহাদের প্রকৃতিতে ভাবুকতার এবং সঙ্গে সঙ্গে তীক্ষ্ণ বাস্তব দৃষ্টিভঙ্গিরও অস্তিত্ব স্বীকার করিতে হয়। ইহাদের মধ্যে

সভ্যতার উন্নতির সহিত শ্রেণীবিভাগের বৃদ্ধি পাইয়াছিল। দ্রাবিড় সমাজের শ্রেণীবিভাগের সর্বোচ্চ ছিল ‘মাল্লের’ বা রাজা, তারপর পর্যায় অনুসারে ‘বল্লাল’ বা সামন্ত রাজা [বল্লালসেনের নামের বল্লালের সঙ্গে এই বল্লাল কথাটির কি কোন অর্থগত সম্বন্ধ আছে?], তারপর ‘বেল্লাল’ বা ক্ষেত্রস্বামী বা কৃষক, তারপর ‘বণিত’ বা ব্যবসায়ী। এইসব শ্রেণী ছিল উচ্চ বা ‘মলোর’, তারপর শ্রমজীবী বা ‘বিলইবলার’, আর সর্বনিম্নে দাস জাতি বা ‘আদিওর’। প্রত্যেক শ্রেণীর মধ্যে আবার বহু বিভাগ ছিল। উচ্চ-নীচ ভেদ প্রবণতা দ্রাবিড়ভাষাভাষী নরগোষ্ঠীর মধ্যে বিশেষভাবে পরিস্ফুট হইয়াছিল। উহাদের অস্পৃশ্যতাবোধ ক্রমে ভারতের বর্তমান বংশগত অনমনীয় জাতিভেদ-প্রথায় পরিণত হইল। সম্ভবত দ্রাবিড় নরগোষ্ঠীর মধ্যে হঠযোগের প্রচলন হওয়ায় এই অস্পৃশ্যতাবোধ আরও প্রবল হইয়াছিল। পরিশেষে ইহারা যখন আর্যনর্ডিক নরগোষ্ঠীর সংস্পর্শে আসিল, তখন দেখিল আর্যেরা শুচিপ্রবণতার জন্য অপরিচ্ছন্ন দ্রাবিড়পূর্ব নরগোষ্ঠীর সংস্পর্শ বর্জনের প্রচেষ্টা করিতেন। তাহাতে এই দ্রাবিড়দের বাহ্য শুচিবোধ আরও উত্তেজিত হইল।

শরৎচন্দ্র রায় মহাশয়ের এই ব্যাখ্যা সম্পূর্ণ স্বীকার না করিয়াও বলা যাইতে পারে, দ্রাবিড় ভাষাভাষী লোকদের অস্পৃশ্যতাবোধ এবং শ্রেণী-পার্থক্যবোধ পরবর্তী কালে আর্যভাষী সমাজে বেশ খানিকটা সঞ্চারিত হইয়াছিল। যোগধর্ম ও আনুষঙ্গিক সাধনপদ্ধতি যে ইহাদের কাহারও কাহারও মধ্যে প্রচলিত ছিল তাহা তো প্রাগৈতিহাসিক সিন্ধু-সভ্যতাই অনেকটা প্রমাণ করিয়াছে।

আর্য এবং পরবর্তী পৌরাণিক হিন্দুধর্মে মূর্তিপূজা, মন্দির, পশুবলি, অনেক দেবদেবী, যথা, শিব ও উমা, শিবলিঙ্গ, বিষ্ণু ও শ্ৰী প্রভৃতি যে স্থান অধিকার করিয়া আছে তাহার মূলে দ্রাবিড়ভাষী লোকদের প্রভাব অনস্বীকার্য। যাগযজ্ঞও, যতদূর জানা যায়, ভূমধ্য-নরগোষ্ঠীর মধ্যেই যেন বেশি প্রচলিত ছিল। প্রাচীন মিশরে, আসিরিয়া ও ব্যাবিলনের সুপ্রাচীন ধ্বংসাবশেষের মধ্যে যজ্ঞবেদীর নিদর্শন কিছু কিছু মিলিয়াছে এবং আশ্চর্যের বিষয় এই যে, অরণি ও ব্রীহি, যজ্ঞের যে দুটি প্রধান উপাদান, এই দুইটি শব্দই সম্ভবত মূলত দ্রাবিড় ভাষার সঙ্গে সম্পূক্ত। অবশ্য ইহাও হইতে পারে, যাগযজ্ঞ ভারতীয় আর্যভাষী আদি-নর্ডিকদের উদ্ভূত ধর্মানুষ্ঠান; কিন্তু যেহেতু ভারতের অন্যান্য নর্ডিক নরগোষ্ঠীর মধ্যে তাহার প্রচলন দেখা যায় না, সেই হেতু অনুমান একান্ত অসংগত না-ও হইতে পারে যে, ভূমধ্য-নরগোষ্ঠীর সংস্পর্শে আসিয়াই আবেস্তীয় আর্যভাষী ও ঋগ্বেদীয় আর্যভাষীরা এই যাগযজ্ঞের পরিচয় লাভ করিয়াছিল এবং ঋগ্বেদীয় আর্যভাষীরা ভারতবর্ষে আসিবার আগেই তাহা হইয়াছিল, এমনও অসম্ভব নয়। পশুবলি যে ভূমধ্য-নরগোষ্ঠী-সম্পূক্ত প্রাগৈতিহাসিক সিন্ধুতীরবাসী লোকদের মধ্যে প্রচলিত ছিল, মহেন-জো-দড়োর ধবংসাবশেষ তাহা কতকটা প্রমাণ করিয়াছে। এই মহেন-জো-দড়োর ধ্বংসাবশেষের মধ্যেই লোকের বাসের অনুপযোগী ক্ষুদ্রবৃহৎ এমন কয়েকটি গৃহ আবিষ্কৃত হইয়াছে যেগুলিকে কতকটা নিঃসংশয়েই মন্দির বা পূজাস্থান ইত্যাদি বলা যায়। কেহ কেহ তাহা স্বীকারও করিয়াছেন। এক্ষেত্রেও আশ্চর্য এই যে, ‘পূজন বা ‘পূজা’, এবং ‘পুষ্প’ (এই শব্দ দুইটি ঋগ্বেদেই আছে)—এই দুটি শব্দই দ্রাবিড়ভাষাগোষ্ঠীর সঙ্গে সম্পৃক্ত। লিঙ্গপূজা এবং মাতৃকাপূজা যে সিন্ধুতীরের প্রাগৈতিহাসিক লোকদের মধ্যে প্রচলিত ছিল, তাহাও প্রমাণ করিয়াছে হরপ্পা-মহেন-জো-দড়োর ধবংসাবশেষ। অবশ্য এই দুটি পূজা সর্পপূজার সঙ্গে সঙ্গে পৃথিবীর অনেক আদিম অধিবাসীদের মধ্যেই প্রচলিত ছিল, তবু ভারতবর্ষে ইহার যে রূপ আমরা দেখি তাহা যে আর্যভাষীরা ভারতীয় আর্যপূর্ব ও অনার্য লোকদের সংস্পর্শে আসিয়া ক্রমশ গড়িয়া তুলিয়াছিল, এই অনুমানই যুক্তিসংগত বলিয়া মনে হয়। লিঙ্গপূজাই ক্রমশ শিবের সঙ্গে জড়িত হইয়া শিবলিঙ্গ ও শক্তি-যোনি পূজায় রূপান্তরিত হয় এবং মাতৃকাপূজা ও সর্পপূজা ক্রমশ যথাক্রমে শক্তিপূজায় ও মনসাপূজায়। দ্রাবিড়ভাষীদের আণ-মন্দি=পুং বানর-দেবতার ক্রমশ বৃষকপি এবং পরবর্তী কালে হনুমান-দেবতায় রূপান্তর অসম্ভব নয়। তেমনই অসম্ভব নয় দ্রাবিড়ভাষীদের বিণ্‌ বা আকাশ-দেবতার রূপান্তর বিষ্ণুতে, এবং তাহা সুপ্রাচীন কালেই হয়তো হইয়াছিল। বৈদিক বিষ্ণুর যে রূপ আমরা দেখি তাহাতে যেন দ্রাবিড়ভাষীদের আকাশ-দেবতার স্পর্শ লাগিয়া আছে। শিব সম্বন্ধে এ কথা আরও বেশি প্রযোজ্য। শ্মশান-প্রান্তর-পর্বতের রক্ত-দেবতা একান্তই দ্রাবিড়ভাষীদের শিবন যাহার অর্থ লাল বা রক্ত এবং শেম্বু যাহার অর্থ তাম্র; ইনিই ক্রমে রূপান্তরিত হইয়া আর্যদেবতা রুদ্রের সঙ্গে এক হইয়া যান। পরে শিবন=শিব, শেম্বু-শম্ভূ, রুদ্র-শিব এবং মহাদেবে রূপান্তর লাভ করেন। এই ধরনের সমন্বিত রূপ পৌরাণিক অনেক দেবদেবীর মধ্যেই দেখা যায়, এ কথা ক্রমশ পণ্ডিতদের মধ্যে স্বীকৃতি লাভ করিতেছে। দৃষ্টান্তবাহুল্যের আর প্রয়োজন নাই। এই সমন্বিত রূপই আর্যভাষীদের মহৎ কীর্তি এবং ভারতীয় ঐতিহ্যে তাঁহাদের সুমহান দান।

মহেন্‌-জো-দড়োর ধ্বংসাবশেষ হইতে মনে হয় সেখানকার লোকেরা মৃতদেহ কবরস্থ করিত, কেহ কেহ আবার খানিকটা পোড়াইয়া শুধু অস্থিগুলি কবরস্থ করিত।

অ্যাল্‌পো-দীনারায় নরগোষ্ঠীর মানস-সংস্কৃতি সম্বন্ধে কিছুই বলিবার উপায় নাই। তবে, মহেন-জো-দড়োর উপরিতম স্তরের ধ্বংসাবশেষ হইতে মনে হয়, ইহারা মৃতদেহ বা শব (এটি দ্রাবিড়গোষ্ঠীর শব্দ) আগে পোড়াইয়া ভস্মশেষ একটি পাত্রে রাখিয়া তাহা কবরস্থ করিত। আগেই বলিয়াছি, আর্যভাষী নর্ডিকেরা ইহাদের ভাষাজ্ঞাতি অ্যালপো-দীনারায় লোকদের প্রীতির চক্ষে তো দেখিত না, বরং ‘ব্রাত্য’ বা পতিত বলিয়া ঘৃণা করিত। এই ‘ব্রাত্য’রাও অন্যদিকে বৈদিক আর্যভাষীদের যাগযজ্ঞ, আচারানুষ্ঠান প্রভৃতিকে প্রীতির চক্ষে দেখিত না। এককথায় এই দুই গোষ্ঠীর মানস-সংস্কৃতি একেবারেই বিভিন্ন ছিল, এ অনুমান কতকটা নিঃসংশয়েই করা যায়।

ভারতীয়, তথা বাঙলাদেশের মানস-সংস্কৃতিতে মোঙ্গোলীয় ভোটত্ৰহ্ম বা চৈনিক বা অন্য কোনও নরগোষ্ঠীর স্পর্শ বিশেষ কিছু লাগে নাই। লাগিলেও তাহা এত ক্ষীণ যে, আজ আর তাহা ধরিবার কোনও উপায় নাই।

বাঙলাদেশে, শুধু বাঙলাদেশেই বা কেন, সমগ্র উত্তর ভারতেই আজ বিশুদ্ধ নিগ্রোবটু অবলুপ্ত; বহুদিন আগেই তাহারা কোথায় যে বিলীন হইয়া গিয়াছে আজ আর তাহা বুঝিবারও উপায় নাই।

অস্ট্রিক, মিশ্র অস্ট্রিক ও নেগ্ৰিটো; দ্রাবিড়, মিশ্র দ্রাবিড় ও অস্ট্রিক; মিশ্র নেগ্রিটো ও দ্রাবিড় এবং মিশ্র অস্ট্রিক-নেগ্রিটো-দ্রাবিড়, এইসব জনগণ, যখন উত্তর-ভারতের অনার্য জনরূপে নিজ মিশ্র ধর্ম ও সংস্কৃতি লইয়া বাস করিতেছে, যখন দেশ ছিল খণ্ড, ছিন্ন ও বিক্ষিপ্ত, এবং দেশে কোনও ঐক্য-বিধায়িনী কেন্দ্রাভিমুখী শক্তিও ছিল না— এমন সময়ে ধীরে ধীরে প্রচণ্ড শক্তিশালী, একান্তরূপে কৰ্মী, অপূর্ব কল্পনাশীল, disciplined বা শৃঙ্খলাসম্পন্ন, সুদৃঢ়রূপে সংঘবদ্ধ, গুণগ্রাহী কিন্তু আত্মসমাহিত, বাস্তবে সভ্যতায় কিঞ্চিৎ পশ্চাৎপদ অথচ নুতন বস্তু উপযোগী হইলে গ্রহণ করিতে সদা-চেষ্টিত, এমন আর্য [ভাষী] জাতি ভারতে দেখা দিল। আর্য ভাষীরা আসিয়া খণ্ড ছিন্ন ও বিক্ষিপ্ত ভারতকে এক ধর্মরাজ্যপাশে, এক ভাষা ও এক সংস্কৃতির গ্রন্থিতে বাঁধিয়া দিল। …ভারতবর্ষে তাঁহারা বৈদিকধর্ম ও দেবতাবাদ এবং বেদের কিছু কিছু মন্ত্র বা সুক্ত লইয়া আসিল; তাহারা আনিল তাঁহাদের নিজস্ব সংস্কৃতি; সেই সংস্কৃতিতে বাবিল ও আসুরীয় এবং পশ্চিম-এশিয়ার অন্য সভ্য (ভূমধ্য) নরগোষ্ঠীর প্রভাব যথেষ্ট পরিমাণে ছিল।