৫. জন ও ভাষাতত্ত্ব

দ্বিতীয় অধ্যায় । ইতিহাসের গোড়ার কথা
পঞ্চম পরিচ্ছেদ – জন ও ভাষাতত্ত্ব

জন ও ভাষাতত্ত্ব

এ পর্যন্ত বাঙালীর জনতত্ত্ব বিশ্লেষণ করিয়া যাহা পাওয়া গেল ভাষাতত্ত্বের বিশ্লেষণের মধ্যে তাহার সমর্থন কতটুকু পাওয়া যায়, তাহা এখন দেখা যাইতে পারে। এ চেষ্টা আচার্য সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায় মহাশয় একাধিকবার সার্থকভাবেই করিয়াছেন; তবু মনে হয়, জনতত্ত্ববিশ্লেষণ লব্ধ তথ্যের দিকে দৃষ্টি আর-একটু সজাগ রাখিয়া বাঙলাদেশের জন ও ভাষাপ্রবাহের আলোচনা এবং পরস্পর সম্বন্ধ-নির্ণয়ের অবকাশ এখনও যথেষ্ট আছে। বস্তুত, পশিলুস্কি, ব্লক, লেভি, বাগচী ও চট্টোপাধ্যায় মহাশয় যেদিকে গবেষণার সূত্রপাত করিয়াছেন, সেদিকে সমস্ত সম্ভাবনা এখনও নিঃশেষিত হয় নাই। বাঙলাদেশের ভৌগোলিক সংস্থান ও গ্রাম্য জীবনের সমস্ত খুঁটিনাটির জ্ঞান লইয়া প্রবোধবাবু ও সুনীতিবাবুর ইঙ্গিতগুলি ফুটাইয়া তোলার যথেষ্ট প্রয়োজন আছে এবং আমার বিশ্বাস সেই ফলাফলগুলি জনতত্ত্ব গবেষণার ফলাফলের সঙ্গে যোগ করিলে বাঙালীর সমাজ ও সংস্কৃতির অনেক রহস্য উদঘাটিত হইবে।

ভারতবর্ষ ও পূর্ব-দক্ষিণ এশিয়ার দেশ ও দ্বীপপুঞ্জগুলির বিচিত্র ভাষার সুদীর্ঘ ও সুবিস্তৃত গবেষণার ফলে আজ এ কথা সর্বজনস্বীকৃত যে, আনাম, মালয়, তালৈঙ, খাসিয়া, কোল (অথবা মুণ্ডা), সাঁওতাল, নিকোবর, মালাক্কা প্রভৃতি ভূমির বিচিত্র বিভিন্ন অধিবাসীরা যে সব ভাষায় কথা বলে, তালৈ ও খুমের গোষ্ঠীর প্রাচীন সাহিত্য যে সব ভাষায় রচিত সেই ভাষাগুলি একই পরিবারভুক্ত। এই সুবৃহৎ ও সুবিস্তৃত ভাষা-পরিবারের পুরাতন নাম অস্ট্রো-এশীয়, আধুনিক নামকরণ অস্ট্রিক একটু মনঃসংযোগ করিলেই ধরা পড়িবে, এইসব অধিবাসীরা সকলই জন হিসাবে একই গোষ্ঠীর নয়; আনাম বা মালয়-মালাক্কা অঞ্চলে অষ্ট্রেলয়েড রক্তের সঙ্গে মোঙ্গোলীয় রক্তের বহুল সংমিশ্রণ হইয়াছে, অথচ কোল অথবা সাঁওতালদের মধ্যে মোঙ্গোলীয় প্রবাহ নাই, কিন্তু আদি-অষ্ট্রেলয়েড রক্তে অন্য জাতির রক্তপ্রবাহ কমবেশি সঞ্চারিত হইয়াছে। খাসিয়াদের তো মোটামুটি মোঙ্গোলীয় রক্তবহুলই বলা চলে। ইহা হইতে স্বতঃই অনুমান হয় ঐ সব ভূখণ্ডে সন্ধান-সম্ভাব্য আদিমতম স্তরে সর্বত্রই অস্ট্রিক ভাষার প্রচলন ছিল এবং যাহাদের মধ্যে ছিল তাহাদের পরিচয় যতটা পাওয়া যায়, তাহা হইতে দেখা যাইবে, ইহারা প্রায় সকলেই আদি-অষ্ট্রেলীয় জনগোষ্ঠীর অন্তর্গত, যেমন মুণ্ডা, কোল ও সাঁওতালেরা, ভূমিজ ও শবরেরা, মালয় ও আনাম অঞ্চলের অধিবাসীরা, নিকোবর দ্বীপপুঞ্জের লোকেরা। পরবর্তী কালে ইহাদের মধ্যে কমবেশি অন্য জনের রক্তসংমিশ্রণ হয়তো অনেক ক্ষেত্রেই হইয়াছে, এমনকি অনেক জায়গায় নূতন কোনও জন তাহাদের একেবারে আত্মসাৎ হয়তো করিয়া ফেলিয়াছে, যেমন করিয়াছে মালয়ে, আনামে, নিম্ন ব্রহ্মে যেখানে তালৈ ভাষাভাষী লোকের বাস, প্রভৃতি জায়গায়; কিন্তু পুরাতন জনের ভাষা তাহারা গ্রহণ করিতে বাধ্য হইয়াছে এবং নানা জন বিবর্তনের ভিতর দিয়াও সেই ভাষাপ্রবাহ আজ পর্যন্ত চলিয়া আসিয়াছে। উপরোক্ত তথ্য হইতে আর একটি তথ্য ধরা পড়ে যে, এই অস্ট্রিক ভাষা এক সময় মধ্য ভারত হইতে আরম্ভ করিয়া সাঁওতাল-ভূমি, আসাম, নিম্ন ব্রহ্ম, মালয়, আনাম,নিকোবর দ্বীপপুঞ্জ প্রভৃতি সমস্ত ভূখণ্ডে বিস্তৃত ছিল। লক্ষণীয় ইহাই যে, এই সমস্ত ভূখণ্ডই এক সময়ে আদি-অষ্ট্রেলীয়দের বাসভূমির অন্তর্ভুক্ত ছিল। বলিয়াছি, উপরোক্ত ভাষাগুলি সবই অস্ট্রিক পরিবারের; কিন্তু সঙ্গে সঙ্গেই এ কথাও বলা উচিত ছিল যে, এক পরিবারভুক্ত হইলেও ইহাদের মধ্যে আত্মীয়তার তারতম্য আছে; যেমন, তালৈঙ, মন-খমরের সঙ্গে কোলগোষ্ঠীর আত্মীয়তা বেশি, খাসিয়াদের সঙ্গে নিকোবরীর। কোল-মুণ্ডা খুব সম্পন্ন গোষ্ঠী; সাঁওতাল, মুণ্ডার, ভূমিজ, হো, কোড়ো, অসুরী, খাড়িয়া, জুয়াং, শবর, গদব প্রভৃতি সকল বুলিই এই গোষ্ঠীর এবং মধ্য-ভারতের পূর্বভাগ জুড়িয়া এইসব বুলিভাষী লোকদের বাস। আশ্চর্যের বিষয়, ইহারা সকলেই আদি-অষ্ট্রেলীয়। এই কারণেই অনুমান হয়, আদি-অষ্ট্রেলীয়দের ভাষাই হয়তো ছিল যাহাকে আমরা এখন বলিতেছি অস্ট্রিক যাহা হউক, এই ভূখণ্ডের দক্ষিণেই দ্রাবিড়ভাষী জনপদ এবং তাহার ফলে বলবত্তর দ্রাবিড়ভাষা কোলভাষার ভূখণ্ডে কোথাও কোথাও ঢুকিয়া পড়িয়াছে। অথচ, এ কথা আজকাল সর্বজনস্বীকৃত যে, দ্রাবিড় ভাষার সঙ্গে মুণ্ডার কোনওসম্বন্ধই নাই। আবার অন্যদিকে, উত্তরে, হিমালয়ের সানুদেশে এমন কতগুলি বুলি আজও প্রচলিত যেগুলি ভোট-বর্মী গোষ্ঠীর ভাষা হইলেও তাঁহাদের এমন কতগুলি লক্ষণ আছে যাহা মুণ্ডা ভাষারই বিশিষ্ট লক্ষণ। এই লক্ষণগুলি যে সেইসব দেশে এক সময়ে বহুল প্রচারিত মুণ্ডা বা অস্ট্রিক গোষ্ঠীর ভাষার লুপ্তাবশেষ, তাহা অস্বীকার করিবার উপায় নাই। শতদ্রু উপত্যকর কনবার বুলি হইতে আরম্ভ করিয়া নেপালের কনায়ী, বুনান, রংকস, দারমিয়া, চৌদাংসী বিয়াংসী, ধীমাশ প্রভৃতি বুলি পর্যন্ত প্রত্যেকটিতেই এই লুপ্তাবশেষ ধরা যায়। তাহা হইলে দেখা যাইতেছে, অস্ট্রিক ভাষার বিস্তৃতি শুধু পূর্বোক্ত দেশগুলিতেই নয়, এক সময় উত্তর-ভারতের অনেক স্থলেই ছিল। পরবর্তী যুগে দ্রাবিড় ও আর্যভাষা পশ্চিম দিকে এবং ভোট-বর্মী ভাষা পূর্বদিকে এই ভাষাকে ছিন্ন-বিচ্ছিন্ন করিয়া অধিকাংশ স্থলেই ইহকে গ্রাস করিয়া একেবারে হজম করিয়া ফেলিয়াছে; যে সব ক্ষেত্রে তাহা পারে নাই, বা নানা প্রাকৃতিক ও ঐতিহাসিক কারণে তাহা সম্ভব হয় নাই, সেই সব স্থানেই কোনও মতে দ্বীপের মতন আশ্রয়ের মধ্যে স্বল্পসংখ্যক লোকের বুলিতে আবদ্ধ হইয়া নিজের অস্তিত্ব বজায় রাখিয়াছে।

উত্তর ও পূর্ব ভারতের সর্বত্র (কাশ্মীরে, গুজরাতে, মহারাষ্ট্রে, কর্ণাটে, বিহারে, উড়িষ্যায়, বাঙলায়, আসামে, হিন্দুস্থানে, রাজপুতনায়, পঞ্জাবে, সীমান্তপ্রদেশে, বিশেষভাবে গাঙ্গেয় উপত্যকায় সর্বত্র) আর্যভাষার প্রবল প্রতাপ। এই আর্যভাষাই আর্য সভ্যতা ও সংস্কৃতির বাহন। এই আর্যভাষার প্রধান রূপ সংস্কৃত, যাহা প্রাকৃতজনের মধ্যে প্রাকৃত। এই প্রাকৃত-সংস্কৃতের অপভ্রংশ হইতে বর্তমান উত্তর, পূর্ব ও পশ্চিম ভারতের প্রাদেশিক ভাষাগুলির উৎপত্তি।। বাঙলাভাষা তাহার মধ্যে অন্যতম। এখন, যদি এ কথা প্রমাণ করা যায় যে, এই প্রাকৃত-সংস্কৃতের ভিতর অস্ট্রিক ভাষার শব্দ ও পদরচনারীতির প্রভাব আছে (হয় তাহা নিছক অস্ট্রিকরূপে, অথবা সংস্কৃতকরণের ছদ্মবেশে) তাহা হইলে বুঝিতে হইবে আর্যভাষাভাষী লোকদের আদিমতর স্তরে অস্ট্রিকভাষাভাষী লোকের বাস ছিল এবং এ তথ্যও ধরা পড়িবে যে, অস্ট্রিকভাষী লোকের যে বিস্তৃতি আমরা আগে দেখিয়াছি তাহাপেক্ষাও তাঁহাদের বিস্তৃতি আরও ব্যাপক আরও গভীর ছিল। ঠিক এই তথ্যটাই সুপ্রমাণিত ও সুপ্রতিষ্ঠিত করিতে প্রয়াস করিয়াছেন, পশিলুস্কি-ব্লক-লেভী বাগচী-স্টেন কোনো-চট্টোপাধ্যায় প্রভৃতি পণ্ডিতেরা। তাঁহাদের সুবিস্তৃত ও সুগভীর গবেষণার সকল কথা বলিবার প্রয়োজন নাই; অনুসন্ধিৎসু পাঠক তাহ দেখিয়া লইতে পরিবেন। আপাতত এ কথা বলিলেই ইতিহাসের প্রয়োজন মিটিতে পারে-যে, প্রাকৃতে-সংস্কৃতে হয় অস্ট্রিকরূপে না-হয় সংস্কৃত-প্রাকৃতের ছদ্মবেশে, বিশুদ্ধ প্রাকৃত-সংস্কৃত ভাষায় ও প্রাদেশিক ভাষাগুলিতে এমন অসংখ্য শব্দ ঋগ্বেদ হইতে আরম্ভ করিয়া আজ পর্যন্ত প্রচলিত আছে, এমন ব্যাকরণ ও পদরচনারীতি আছে যাহা মূলে অস্ট্রিক ভাষা হইতে গৃহীত, এবং এই গ্রহণ সুপ্রাচীন কাল হইতে আরম্ভ করিয়া অপেক্ষাকৃত আধুনিক কাল পর্যন্ত চলিয়া আসিয়াছে, বাঙালীর ইতিহাসে এমন কতগুলি শব্দ ও রীতির উদ্ধার করা যাইতে পারে, যাহা একান্তভাবে না হউক অন্তত বহুলভাবে বাঙলাদেশে এবং বাঙলার সংলগ্ন দেশগুলিতেই প্রচলিত। সব নির্ধারিত শব্দ উদ্ধার করা সম্ভব নয়, তাহার তালিকা উল্লিখিত পণ্ডিতদের রচনায় পাওয়া যাইবে; আমি শুধু সেইসব শব্দই উদ্ধার করিতেছি যেগুলির সঙ্গে বাঙালীর দৈনন্দিন জীবনযাত্রার সম্বন্ধ ঘনিষ্ঠ ও প্রায় অবিচ্ছেদ্য।

আসামে ও বাঙলাদেশে এক কুড়ি, দুই কুড়ি, তিন কুড়ি, চার কুড়িতে (বিশ বা বিংশ নয়) এক পণ, অর্থাৎ ৮০টায় এক পণ গণনার রীতি প্রচলিত আছে। হাটে বাজারে পান, সুপারি, কলা, বাঁশ, কড়ি এমনকি ছোট মাছ ইত্যাদি দ্রব্যও এখনও এইভাবেই গণনা করিয়া ক্রয়-বিক্রয় করা হয়। এই কুড়ি শব্দটি এবং এই গণনারীতিটি— দুইই অস্ট্রিক। সাঁওতালী ভাষায় উপুণ বা পুণ বা পণ কথাটির অর্থ ৮০ এবং সঙ্গে সঙ্গে ৪-ও। মূল অর্থ চার। অস্ট্রিকভাষাভাষী লোকদের ভিতর কুড়ি শব্দ মানবদেহের কুড়ি অঙ্গুলির সঙ্গে সম্পৃক্ত; কুড়িই তাঁহাদের সংখ্যাগণনার শেষ অঙ্ক এবং কুড়ি লইয়া এক মান। কাজেই এক কুড়ি, দুই কুড়ি, তিন কুড়ি, চার কুড়িতে (৪x২০=৮০) এক গুণ। এই অর্থে আশিও পণ, চারও পণ। এই পণও তাহা হইলে অস্ট্রিক শব্দ। আবার কুড়ি গোণ্ড বা গণ্ডতে এক পণ (=৮০), এ-ও অস্ট্রিক ভাষারই গণনা। অর্থাৎ এক গোণ্ড বা গণ্ডতে চার সংখ্যা; প্রত্যেক কুড়িতে (৪x৫) পাঁচটি গোণ্ড। এই গোণ্ড বা গণ্ডই বাঙলায় গণ্ডা যাহা চার সংখ্যার সমান। চার কুড়িতে এক গণ্ডা। এই গণ্ড হইতেই খ্ৰীষ্টপূর্ব প্রথম-দ্বিতীয় শতকের প্রাকৃত মহাস্থান শিলালিপির গণ্ডকমুদ্রা। ত্রয়োদশ শতক পর্যন্ত এই গণ্ডকমুদ্রার প্রচলন বাঙলাদেশে ছিল। গণ্ডক শব্দের অভিধানগত অর্থই হইতেছে; ভাগ, একপ্রকার গণনানীতি, চার সংখ্যার এক মান ধরিয়া গণনার রীতি, চার কুড়ি মূল্যের একপ্রকার মুদ্রা। দেখা গেল, এই সমস্ত গণনা পদ্ধতিটাই অস্ট্রিকভাষাভাষী লোকদের। আর কুড়ি মুদ্রা যেখানে গণনাক্রমে এতটা স্থান অধিকার করিয়া আছে, সেখানে ইহা তো সহজেই অনুমেয় যে, এই গণনাপদ্ধতি আদিম ভারত ও বৃহত্তর ভারতের সামুদ্রিক বাণিজ্যসমৃদ্ধ সভ্যতার সৃষ্টি। বাঙলা গুড়ি বা গুড়া ও গুটি, এই শব্দগুলিও গেণ্ড বা গণ্ডা শব্দ হইতে উদ্ভূত।

বাঙলা খাঁ খাঁ (করে ওঠা), খাঁখার (দেওয়া), বাঁখারি (বাখারি বা চেড়া বাঁশ), বাদুর, কানি (ছেঁড়া কাপড়ের টুকরা), জাং (জঙ্ঘা), ঠেঙ্গ (গোড়ালি হইতে হাঁটু পর্যন্ত পায়ের অংশ), ঠোঁট, পাগল, বাসি, ছাঁচ, ছাঁচতলা, ছোচ্ঞা, কলি (চুন), ছোট, পেট, খোস (পুরাতন বাঙলায় কচ্ছু), ঝোড় বা ঝাড়, ঝোপ, পুরাতন বাঙলায় চিখিল (কাদা), ডোম (প্রাচীন বাঙলার ডোম্ব-ডোম্বী), চোঙ্‌, চোঙ্গা, মেড়া (=ভেড়া), বোয়াল (মাছ), করাত, দা’ বা দাও, বাইগণ (বেগুন=সংস্কৃত বাতিঙ্গন, বাতিগণ), পগার (জলময় গর্ত বা প্রণালী), গড়, বরজ (পানের), লাউ, লেবু-লেম্বু, কলা, কামরাঙ্গা, ডুমুর প্রভৃতি সমস্ত শব্দই মূলত অস্ট্রিকগোষ্ঠীর ভাষার সঙ্গে ঘনিষ্ঠ সম্বন্ধে আবদ্ধ। বাঙলার প্রাচীন জনপদবিভাগের মধ্যে পুণ্ড-পৌণ্ড, তামলিত্তি-তাম্রলিপ্তি-দামলিপ্তি এবং বোধ হয় গঙ্গা (নদী) ও বঙ্গ—এই দুটি নামও এই একই অস্ট্রিকগোষ্ঠীর ভাষার দান। কপোতাক্ষ ও দামোদর, অন্তত এই দুটি নদীর নামও কোল কব-দাক্‌ এবং দাম-দাক্‌ হইতে গৃহীত। কোল দা বা দাক্‌-জল এবং দা বা দাক্‌ হইতেই সংস্কৃত উদক। অস্ট্রিকভাষাভাষী লোকেরা নিজেদের ভাষার কথা দিয়াই দেশের পাহাড় পর্বত নদনদী গ্রাম জনপদ ইত্যাদির নামকরণ করিয়াছিল, এই অনুমানই তো যুক্তি ও ইতিহাস সম্মত। তাহার কিছু কিছু চিহ্ন এখনও বাঙলা বুলিতে লাগিয়া আছে, যেমন শিয়ালদহ বা শিয়াল-দা, ঝিনাইদহ বা ঝিনাই-দা, বাঁশদহ বা বাঁশ দা (দহ=জলভরা গর্ত, নদীগর্ভের গর্ত); মুণ্ডা ঢেঙ্কি=বাঙলা টেকি, মুণ্ডা মোটো-বাঙলা মোটা। লেভি সাহেব তো বলেন, পুলিন্দ-কুলিন্দ, মেকল-উৎকল, উণ্ড্র-পুণ্ড্র-মুন্ডর, কোসল-তোসল, অঙ্গ-বঙ্গ, কলিঙ্গ-তিলিঙ্গ এবং সম্ভবত তক্কোল-কক্কোল, অচ্ছ-বচ্ছ, এই ধরনের জাতিবাচক যমজ নামকরণ পদ্ধতিটাই অস্ট্রিক। তাহার বচনটি উদ্ধৃতির যোগ্য—

Pulinda-Kulinda/ Mekala-Utkala (with the group Udra-Pundra-Munda), Kosala-Tosala, Anga-Vanga, Kalinga-Tilinga form the links of a long chain which extends from the eastern confines of Kashmir up to the centre of the peninsula. The Skeleton of the “ethnical system” is constituted by the hights of the central plateau; it participates in the life of all the great rivers of India except the Indus in the west and Kaveri in the south. Each of these groups forms a binary whole, each of these binary resites is united with another member of the system. In each ethnic pair the twin bears the same name, differentiated only by the initial K and T; K and P : zero and V, or M or P. This process of formation is foreign to Indo-European; it is foreign to Dravidian; it is on the contrary characteristic of the vast family of languages which are called Austro-Asiatic, and which cover in India the group of the Munda languages, often called also Kolarian.

“আর্যমঞ্জুশ্ৰীমূলকল্প” (অষ্টম শতক) নামক গ্রন্থে এই ভাষাগত বৈশিষ্ট্য সম্বন্ধে একটি মন্তব্য আছে এবং সম্ভবত প্রচলনস্থান সম্বন্ধেও একটু ইঙ্গিত আছে। তাহা এই প্রসঙ্গে উদ্ধার করা যাইতে পারে। এই গ্রন্থের কামরাঙ্গা ফলের উৎপত্তিস্থান ছিল কর্মরঙ্গাখাদ্বীপে (-যুয়ানচোয়াঙের কামলঙ্ক, চীনা গ্রন্থের লংকীয়া, লংকীয়া-সু), নাড়িকের দ্বীপে (নারিকেল দ্বীপ), বারুসকদ্বীপে (বর্তমান, বারোস), নগ্নদ্বীপ (বর্তমান, নিকোবর) বলিদ্বীপে এবং যবদ্বীপে। এইসব দ্বীপের ভাষা, ‘র’-কার-বহুল, অস্ফুট, অব্যক্ত (অস্পষ্ট বা দুর্বোধ্য?) এবং নিষ্ঠুর (কর্কশ, রূঢ়)।

কর্মরঙ্গাখাদ্বীপেযু নাড়িকের সমুদ্ভবে।
দ্বীপে বারুসকে চৈব নগ্ন বলি সমুদ্ভবে।।
যবদ্বীপে বা সত্ত্বেষু তদন্যদ্বীপসমুদ্ভবা।
বাচ রকারবহুলা তু বাচা অস্ফুটাং গতা।।
অব্যক্তা নিষ্ঠুরা চৈব সক্রোধপ্রেতযোনীষু।

যে বৈশিষ্ট্যের কথা “মঞ্জুশ্ৰীমূলকল্পে”র লেখক উল্লেখ করিয়াছিলেন, আর্যভাষার দৃষ্টিভঙ্গী হইতে অস্ট্রিক গোষ্ঠীর ভাষা সম্বন্ধে তাহা বলা কিছু অযৌক্তিক নয়। অস্ট্রিক ভাষায় ল’ ও ‘র’র বাহুল্য সত্যই লক্ষ করিবার মতো। এই অসুর ভাষাভাষী লোকদেরই ঋগ্বেদে অসুর বলিয়া অভিহিত করা হইয়াছে বলিয়া মনে করিলে অন্যায় হয় না।

“আর্যমঞ্জুশ্ৰীমূলকল্প” গ্রন্থের আর একটি সাক্ষ্য এই প্রসঙ্গে উল্লেখযোগ্য। গ্রন্থকারের মতে বঙ্গ, সমতট, হরিকেল, গৌড় ও পুণ্ডের লোকেরা অর্থাৎ পূর্ব ও পশ্চিম, দক্ষিণ ও উত্তর বঙ্গের লোকেরা অসুর ভাষাভাষী : “অসুরানাং ভবেৎ বাচা গৌড়পুণ্ড্রোদ্ভবা সদা”। কোল-মুণ্ডা গোষ্ঠীর অন্যতম প্রধান বুলির নাম এখনও অসুর বুলি; কাজেই এই বুলিই একসময় গৌড়ে-পুণ্ডে বহুলপ্রচলিত ছিল, এ অনুমান সহজেই করা চলে। মধ্য-ভারতের পূর্বখণ্ডে যে সব লোকেরা অসুর বুলিতে কথা বলিত তাহারা আদি-অষ্ট্রেলীয় পরিবারের লোক, সে সম্বন্ধে সন্দেহ বোধ হয় নাই। গৌড়-পুণ্ডের আদিমতম স্তরেও এই আদি-অষ্ট্রেলীয়দের বিস্তৃতি ছিল, এ কথাও নরতত্ত্ববিশ্লেষণ হইতে আগেই জানা গিয়াছে। ভাষার সাক্ষ্য হইতেও তাহা অনেকটা পরিষ্কার হইল। “মঞ্জুশ্রীমূলকল্পে”র গ্রন্থকার তাহা পরিষ্কার করিয়াই বলিলেন। আসামেও যে প্রাচীনতর কালে এই অসুর-ভাষাভাষী লোকের বিস্তৃতি ছিল, তাহা অনুমানেরও একটু কারণ আছে। কামরূপের বর্মণ রাজবংশের আদিপুরুষ সকলেই অসুর বলিয়া পরিচিত; অন্তত, সপ্তম শতকের রাজারা তাঁহাদের পূর্বপুরুষদের অসুর বলিয়াই জানিতেন এবং মহিরাঙ্গ অসুর, দানবাসুর, হটকাসুর, সম্বরাসুর, রত্নাসুর, নরকাসুর প্রভৃতি পূর্বপুরুষদের বংশধর বলিয়াই নিজেদের পরিচয় দিয়াছেন। ইহারা অসুর ভাষাভাষী ছিলেন বলিয়াই কি ইহাদের নামে তাহার চিহ্ন থাকিয়া গিয়াছে।

আর-একটি প্রাচীনতর সাক্ষ্য উদ্ধৃত করিয়াই এই অস্ট্রিক আদি অষ্ট্রেলীয় প্রসঙ্গ শেষ করিব। জৈনদের “আচারাঙ্গসূত্র” গ্রন্থে উল্লেখ আছে, মহাবীর (খ্ৰীষ্টপূর্ব ষষ্ঠ শতক) যখন পথহীন লাঢ় (রাঢ়দেশ), বজ্‌জভূমি ও সুব্‌ভভূমিতে (মোটামুটি, দক্ষিণ-রাঢ়) প্রচারোদেশে ঘুরিয়া বেড়াইতেছিলেন, তখন এইসব দেশের অধিবাসীরা তাহাকে আক্রমণ করিয়াছিল। কতকগুলি কুকুরও সঙ্গে সঙ্গে তাঁহাকে কামড়াইতে আরম্ভ করে, কিন্তু কেহই এই কুকুরগুলিকে তাড়াইয়া দিতে অগ্রসর হয় নাই। বরং লোকেরা সেই জৈন ভিক্ষুকে আঘাত করিতে আরম্ভ করে এবং ছু ছু (খুক্‌খু) বলিয়া চীৎকার করিয়া তাহাকে কামড়াইবার জন্য কুকুরগুলিকে লেলাইয়া দেয়। বাঙলাদেশে এখনও লোকে কুকুর ডাকিবার সময় চু চু বা তু তু বলে। অস্ট্রিক ভাষাগোষ্ঠীতে কুকুরের প্রতিশব্দ হইতেছে ছক্‌ (খ্‌মের), ছ্যুকে (কোন্‌ টু), ‘ছো’ (প্রাচীন খ্‌মের), ‘ছো’ (আনাম, সেদাং, কাসেং), ‘অছো’ (তারেং), ‘ছু’ (সেমাং), ‘ছুও’, ‘ছু-ও’ (সাকেই)। এই তথ্য হইতে বাগচী মহাশয় মনে করেন যে, বাংলা চু চু বা তু তু মূলত অস্ট্রিক প্রতিশব্দ হইতেই গৃহীত এবং চু চু বা তু তু বলিতে কুকুরার্থক বাঙলা দেশজ শব্দ; ওটা শুধু ধ্বন্যাত্মক ডাক মাত্র নয়, চু চু বা তু তু বলিতে কুকুরই বুঝায়। এ অনুমান সত্য হইলে রাঢ়ে-সুহ্মে খ্ৰীষ্টপূর্ব ষষ্ঠ শতকে অস্ট্রিক গোষ্ঠীর ভাষা প্রচলিত ছিল, তাহাও স্বীকার করিতে হয়। আর, ছিল যে তাহার অন্য প্রমাণ, এই দুই ভূখন্ডে এখনও অস্ট্রিকভাষাভাষী পরিবারভুক্ত অনেক সাঁওতাল ও কোলদের বাস দেখিতে পাওয়া যায়।

অস্ট্রিক ভাষা হইতে যেমন, ঠিক তেমনই দ্রাবিড় ভাষা হইতেও আর্যভাষা সংস্কুতে-প্রাকতেঅপভ্রংশে অনেক শব্দ, পদরচনা ও ব্যাকরণ-রীতি ইত্যাদি ঢুকিয়া পড়িয়াছে। আর্যভাষাভাষী লোকেরা যে দ্রাবিড়ভাষাভাষী লোকদের সংস্পর্শে আসিয়াছিল, এই তথ্য তাহার প্রমাণ। সংস্কৃত ভাষা বিকাশের বিভিন্ন স্তরে এবং প্রাকৃত-অপভ্রংশ হইতে উদ্ভূত বাঙলা ভাষায় এই দ্রাবিড় স্পর্শ কোন দিকে কতখানি লাগিয়াছে, তাহার ইঙ্গিত সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায় মহাশয় দিয়াছেন কতকটা বিস্তৃতভাবেই। এখানে তাহার সকল কথা বলিবার প্রয়োজন নাই; অনুসন্ধিৎসু পাঠক তাহা দেখিয়া লইতে পারেন। তাহার বহু শ্রম ও বহু মনন-লব্ধ গবেষণার ফলাফল আজ প্রায় সর্বজনস্বীকৃতি লাভ করিয়াছে; এই গৌরব সমগ্র বাঙালী জাতির। বক্ষ্যমাণ বিষয়ে তাহার বক্তব্য এই;

ls there any evidence about the class of speech that prevailed in Bengal before the coming of the Aryan tongue 2 There is, of course, the preserve of Kol and Dravidian (the Santals, the Malers, the Oraons) in the western fringes of the Bengali area, and of the Boda and Mon-Khmer speakers in the northern and eastern frontiers. There are, again, some unmistakably Dravidian affinities in Bengali phonetics, morphology, syntax and vocabulary; but these agreements with Dravidian are not confined to Bengali alone but are found in other NIA (New Indo-Aryan) also. Apart from that, local nomenclature in Bengal may be expected to throw some light on the question. The study of Bengali toponomy is rendered extremely difficult from the fact that old names, when they were not Sanskrit, have suffered from mutilation to such an extent that it is often impossible to reconstruct their original forms; especially when they are non-Aryan. Fortunately for us Bengal inscriptions, from the 5th century onwards, like the inscriptions found elsewhere in India, and occasionally works written in pre-Moslem Bengal, have preserved old forms of some scores of these names. But it is a pity that generally there was an attempt to give these names a Sanskrit look.

তৎসত্ত্বেও এইসব লিপি হইতে অসংখ্য নাম ও প্রমাণ উদ্ধার করিয়া সুনীতিবাবু দেখাইয়াছেন যে নামগুলিতে দ্রাবিড় প্রভাব সুস্পষ্ট। তাহার সুদীর্ঘ তালিকা উদ্ধার করিতে গেলে প্রসঙ্গের বিস্তৃতি বাড়িয়া যাইবার আশঙ্কায় আমি আর তাহা করিলাম না। তিনি আরও বলেন,

In the formation of these names, we find some words which are distinctly Dravidian; e.g.-jola, jota, joti-jotika etc.; hitti, hitthi-vithi, -hist (h)i etc.; -gadda, -gaddi; pola-vola and probably also, -handa. -vada, -kunda, -kundi, and cavati, cavada etc.; and besides there are many others which have a distinct non-Aryan look. The last word, as in Pindara-viti-jotika, Uktara-yota (jota), Dharmmavo-jotika, Nada-joti, Camyala-joti, Sik (ph)-gadi-joti, meaning channel, water-course, river, water, is found in modern Bengal place-names. …An investigation of place-names in Bengal, as in other parts of Aryan India, is sure to reveal the presence of non-Aryan speakers, mostly Dravidian, all over the land before the establishment of the Aryan tongue.

এই প্রসঙ্গে অসংখ্য প্রাচীন ও বর্তমান বাঙলাদেশের স্থানের নাম, নামের উপান্ত ‘ড়া’ (বাঁকুড়া হাওড়া রিষড়া, বগুড়া), গুড়ি (শিলিগুড়ি, জলপাইগুড়ি), জুলি (নয়নজুলি), জোল, (নাড়াজোল), জুড় (ডোমজুড়), ভিটা, কুণ্ডু প্রভৃতি শব্দ উদ্ধার করিয়া তিনি নিঃসন্দেহে প্রমাণ করিয়াছেন যে, ইহারা দ্রাবিড় ভাষার।

কিন্তু, নরতত্ত্ববিদের কাছে এই দ্রাবিড়ভাষাভাষী লোকদের সমস্যা বড় জটিল। সাম্প্রতিক নরতাত্ত্বিক পরিভাষায় দ্রাবিড় নরগোষ্ঠীর কোনও অস্তিত্বই নাই। দ্রাবিড় ভাষার নাম; নরগোষ্ঠীর নয়। প্রাক্-আর্য যুগে এই দ্রাবিড়ভাষাভাষী লোক কাহারা ছিল? ঐতিহাসিক যুগে দামিল-দ্রমিল-তামিল জাতির লোকদের ভাষা দ্রাবিড় সন্দেহ নাই; কিন্তু তাহারা কাহাদের বংশধর?

পূর্বে নরতত্ত্ব বিশ্লেষণে দেখা গিয়াছে, আদি-অষ্ট্রেলীয় নরগোষ্ঠীর পর একে একে তিনটি দীর্ঘমুণ্ড জাতি ভারতবর্ষের জনপ্রবাহে বাপাইয়া পড়িয়াছিল। ইহাদের মধ্যে দ্বিতীয় ধারাটি পাঞ্জাব অতিক্রম করিয়া পূর্বে বা দক্ষিণে বোধ হয় আর অগ্রসর হইতে পারে নাই। প্রথম ধারাটি মধ্য ও দক্ষিণ ভারতে বিস্তৃতি লাভ করিয়াছিল এবং সেখানে পূর্বতন আদি-অষ্ট্রেলীয়দের সঙ্গে তাঁহাদের খানিকটা সংমিশ্রণও এবং এই ধারাটিই হরপ্পা, মহেন-জো-দড়োর প্রাগৈতিহাসিক সিন্ধু সভ্যতার জননী। ইহার বিস্তৃতি লাভ করিয়াছিল উত্তর-ভারতের সর্বত্র. তবে উত্তর-পূর্ব ভারতে গঙ্গা-যমুনার উপত্যকায় পূর্বতন আদি-অষ্ট্রেলীয় কোল-মুণ্ডা-শবর-নিষাদ-অসুরদের বিস্তৃতি ও প্রতাপ প্রবলতর থাকায় ইহারা বিন্ধগিরি অতিক্রম করিয়া দক্ষিণ-ভারতে ছড়াইয়া পড়িতে বাধা হয়। পরবর্তী কালে অ্যালপো-দীনারীয় ও আদি-নর্ডিক আর্যভাষাভাষী জাতির বিভিন্ন তরঙ্গাঘাতে উত্তর ভারত হইতেও ইহারা ক্রমশ স্তরে স্তরে পূর্বে ও দক্ষিণে ছড়াইয়া পড়িতে বাধ্য হয়। এই প্রথম ও তৃতীয় ধারার দীৰ্ঘমুণ্ড দুইটি নরগোষ্ঠীর সমন্বয়ে যে জন গড়িয়া উঠে তাহারাই খুব সম্ভব দ্রাবিড়ভাষাগোষ্ঠীর বর্তমান তামিল-তেলুগু-মালয়ালী-ভাষাভাষী লোকদের পূর্বপুরুষ। তবে, সিন্ধুনদের নিম্ন-উপত্যকায় বেলুচিস্থানের দ্রাবিড়ভাষী ব্রাহুইদের অস্তিত্ব হইতে অনুমান হয়, এই দ্রাবিড় ভাষা ছিল সিন্ধু উপত্যকাস্থিত তৃতীয় ধারার দীর্ঘমুণ্ড নরগোষ্ঠীর ভাষা; অবশ্য এই অনুমান যথেষ্ট সিদ্ধ বলিয়া কিছুতেই গণ্য হইতে পারে না। যাহাই হউক, বাঙলাদেশে দ্রাবিড় ভাষার প্রচলনের দায়িত্ব প্রধানত এই দুই ধারার দীর্ঘমুণ্ড নরগোষ্ঠী দুইটির।

অ্যালপো-দীনারায় জাতির লোকেরা আর্যভাষাভাষী, কিন্তু তাঁহাদের ভাষার স্বরূপ কী ছিল, তাহা সঠিক বলিবার উপায় প্রায় নাই বলিলেই চলে। গ্ৰীয়ার্সন সাহেব গুজরাত, মহারাষ্ট্র, মধ্যভারত, উড়িষ্যা, কতকাংশে বিহার, বঙ্গদেশ ও আসামের outer Aryans বা বেদ বহির্ভূত যে সব আর্যভাষাভাষী লোকদের কথা বলেন এবং বৈদিক আর্যভাষা হইতে উদ্ভূত সিন্ধু-গঙ্গা উপত্যকার হিন্দী, রাজস্থানী প্রভৃতি ভাষা হইতে পৃথক গুজরাতী, মারাঠী, ওড়িয়া, বাঙলা, অহমীয়া প্রভৃতি আর্যভাষার যে কথা ইঙ্গিত করেন তাহা যদি সত্য হয় তাহা হইলে বাঙলা, মারাঠী, ওড়িয়া, গুজরাতী, অহমীয়া ইত্যাদি ভাষার মূল, প্রধান ও বিশিষ্ট রূপই যে অ্যালপো-দীনারায় জাতির ভাষারূপ তাহা অস্বীকার করিবার উপায় থাকে না। কারণ, গ্ৰীয়ার্সনের এই “Outer Aryans” যে অ্যালপাইন জাতিরই অন্যতম শাখা রমাপ্রসাদ চন্দ মহাশয় বহুদিন আগেই তাহা সুপ্রমাণ করিয়াছেন এবং নরতত্ত্ববিদেরা প্রায় সকলেই তাহা স্বীকার করেন।

মোঙ্গোলীয় ভোট-ব্রহ্ম ভাষার প্রভাব প্রাচীন অথবা বর্তমান বাঙলায় প্রায় নাই বলিলে খুব অযৌক্তিক হয় না। নরতত্ত্বের দিক হইতে মোঙ্গোলীয় রক্তপ্রবাহ বাঙালীর মধ্যে যেমন ক্ষীণ ও শীর্ণ মোঙ্গোলীয় ভাষা-প্রভাবও তাহাই। তবে উত্তরতম ও পূর্বতম প্রান্তের মোঙ্গোলস্পষ্ট লোকদের ভিতর চলতি বুলিতে কিছু ভোট-ব্রহ্ম শব্দের সন্ধান পাওয়া যায়। আর, অন্তত একটি নদীর নাম যে ভোট-ব্রহ্ম ভাষা হইতে গৃহীত তাহা নিঃসংশয়ে বলা যায়; এই নদীটি দিস্তাং বা তিস্তা যাহার পরবর্তী সংস্কৃত রূপ ত্রিস্রোতা।

যাহা হউক, অস্ট্রিক, দ্রাবিড় ও বেদ বহির্ভূত আর্যভাষা প্রবাহের উপর তরঙ্গের পর তরঙ্গ আসিয়া ভাঙিয়া পড়িল বৈদিক আর্যভাষা প্রবাহের প্রবল স্রোত। একদিনে নয়, দু-দশ বৎসরে নয়, শত শত বৎসর ধরিয়া এবং কালে কালে ক্রমে ক্রমে এই ভাষা সমস্ত পূর্বতন ভাষা-প্রবাহকে আত্মসাৎ করিয়া তাহাদের নবরূপ দান করিয়া, তাঁহাদের সংস্কৃতিকরণ সাধন করিয়া নিজের এক স্বতন্ত্র রূপ গড়িয়া তুলিল। তাহার ফলে যে সংস্কৃত ভাষার বিকাশ হইল তাহাতে অস্ট্রিক ও দ্রাবিড় শব্দ, পদবচনারীতি, ব্যাকরণ পদ্ধতি সমস্তই কিছু কিছু ঢুকিয়া পড়িল। সাম্প্রতিক কালে শব্দ ও ভাষাতাত্ত্বিকেরা তাহা অঙ্গুলিনির্দেশ করিয়া দেখাইয়া দিতেছেন। বাঙলাদেশেও তাহার প্রচলন হইল, কিন্তু দশম, একাদশ ও দ্বাদশ শতকের সংস্কৃত লিপিগুলিতে দেখা যাইবে, সেই সংস্কৃত ভাযায়ও এমন সব শব্দের দেখা পাওয়া যাইতেছে, এমন ব্যাকরণ বৈশিষ্ট্যের দর্শন মিলিতেছে যাহা বাঙলার বাহিরে দেখা যায় না; ‘বরজ’, ‘ডালিম্ব’ (সংস্কৃত দাড়িম্ব নয়), লগ্‌গাবয়িত্বা (লাগাইয়া অর্থে) ইত্যাদি তাহার কয়েকটি দৃষ্টান্ত মাত্র।

একান্তভাবে ভাষার দিক হইতে এই আর্যীকরণ সম্বন্ধে সুনীতিকুমার যাহা বলিয়াছেন তাহা উদ্ধারযোগ্য। এ কথা মনে রাখা প্রয়োজন যে, এই উদ্ধৃতির ভিতর আর্য বা অনার্য বলিতে তিনি আর্য ভাষা ও অনার্য ভাষাকেই বুঝাইতেছেন; যেখানে আর্য বা অনার্য নরগোষ্ঠী বলিতেছেন, সেখানেও আমি আর্য বা অনার্য ভাষাভাষী নরগোষ্ঠী হিসাবেই বুঝিতেছি, কারণ, আমি আগেই বলিয়াছি, নরতত্ত্বের দিক হইতে আর্য-নরগোষ্ঠী বা দ্রাবিড়-নরগোষ্ঠী— এই ধরনের কথা ব্যবহার করা অযৌক্তিক। অ্যালপো-দীনারায় নরগোষ্ঠীর লোকেরাও আর্যভাষাভাষী, আবার আদি-নর্ডিকেরাও তাহাই; আর দ্রাবিড়ভাষাভাষী লোকদের মধ্যে যে বিভিন্ন জন বিদ্যমান, সে ইঙ্গিতও আগেই করিয়াছি। এই কথাটা যাহাতে আমরা বিস্মৃত না হই সেই জন্য বন্ধনীর ভিতর আমি তাহা উল্লেখ করিয়া দিতেছি।

“ভারতবর্ষের সু-সভ্য, অর্ধ-সভ্য ও অ-সভ্য, সব রকমের অনার্য [ভাষাভাষী] আদিম অধিবাসীদের সঙ্গে আর্য [ভাষী]দের প্রথম সংস্পর্শ হয়তো বিরোধময়ই হইয়াছিল। কিন্তু অনার্য [ভাষাভাষী] ভারতে আর্য [ভাষী]দের উপনিবেশ স্থাপিত হইবার পর হইতেই উভয় শ্রেণীর মানুষ—অনার্য [ভাষী] ও আর্য [ভাষী]–পরস্পরের প্রতিবেশ-প্রভাবে পড়িতে থাকে। আর্য [ভাষী]রা বিদেশ হইতে আগত এবং পার্থিব সভ্যতায় তাহারা খুব উচ্চে ছিল না। আর্য [ভাষী]দের ভাষা আসিয়া দ্রাবিড় ও অস্ট্রিক ভাষাগুলিকে হীনপ্রভ করিয়া দিল; উত্তর-ভারতের কোল ও দ্রাবিড় [ভাষী] অনার্য ভাষীদের মধ্যে ঐক্যবিষয়ক ভাষার অভাব ছিল, আর্য [ভাষী] নরগোষ্ঠীর বিজেতৃ-মর্যাদা লইয়া আর্যভাষা সে অভাব পূর্ণ করিল। …আর্য[ভাষী নরগোষ্ঠীর] ভাষা ও আর্য[ভাষী নরগোষ্ঠীর] ধর্ম—বৈদিক ধর্ম ও বৈদিক হোম-যজ্ঞাদি অনুষ্ঠান—অনার্য [ভাষী]রা শিরোধার্য করিয়া লইল; অনার্যা[ভাষী] আর্য[ভাষী]র পুরোহিত-ব্রাহ্মণের শিক্ষাও মানিল। কিন্তু অনার্যা[ভাষী] নরগোষ্ঠীর ধর্ম মরিল না, তাঁহাদের ইতিহাস-পুরাণও মরিল না; ক্রমে অনার্যা[ভাষী] নরগোষ্ঠীর ধর্ম ও অনুষ্ঠান পৌরাণিক দেবতাবাদে পৌরাণিক পূজাদিতে, যোগচৰ্যায়, তান্ত্রিক মতবাদে ও অনুষ্ঠানে আর্যভাষীদের বংশধরদিগের দ্বারাও গৃহীত হইল। আর্য ও অনার্য ভাষা[ভাষী] নরগোষ্ঠী] এই টানা ও পড়িয়ান মিলাইয়া হিন্দু-সভ্যতার বস্ত্রবয়ন করা হইল।

“উত্তর-ভারতের গঙ্গাতীরের আর্য[ভাষী নরগোষ্ঠীর] সভ্যতার পত্তন এইরূপে হইল। এই সভ্যতায় আর্য[ভাষী নরগোষ্ঠী] অপেক্ষা অনার্যা[ভাষী নরগোষ্ঠী]র দানই অনেক বেশি–কেবল আর্য[ভাষী]দের ভাষা ইহার বাহন হইল। আর্য[ভাষী]দের আগমনের সময় হইতেই হইতেছিল; গঙ্গাতীরবর্তী দেশসমূহে ইহা আরও অধিক পরিমাণে হইল।. বাঙলাদেশে আর্য-ভাষা লইয়া যখন উত্তর-ভারতের—বিহার ও হিন্দুস্থানের—লোকেরা দেখা দিল, যখন উত্তর-ভারতের মিশ্র আর্য-অনার্য[ভাষী নরগোষ্ঠী] সৃষ্ট ব্রাহ্মণ্য, বৌদ্ধ, জৈন মতবাদ বাঙলাদেশে আসিল, তখন উত্তর-ভারতে মোটামুটি এক সংস্কৃতি ও এক জাত হইয়া গিয়াছে। রক্তের বিশুদ্ধি বোধহয় তখন কোনও আর্যভাষী বংশীয়ের ছিল না।”

ভাষা-বিশুদ্ধিও যে ছিল আর্যভাষী নরগোষ্ঠীর তাহাও তো মনে হয় না।