৪. ঐতিহাসিক কালে বাঙলার জনপ্রবাহ

দ্বিতীয় অধ্যায় । ইতিহাসের গোড়ার কথা
চতুর্থ পরিচ্ছেদ – ঐতিহাসিক কালে বাঙলার জনপ্রবাহ

ঐতিহাসিক কালে বাঙলার জনপ্রবাহ

জনপ্রবাহ তো একটি নিরবচ্ছিন্ন ধারা; সে ধারা কখনও একটা নির্দিষ্ট সময়ে আসিয়া ঠেকিয়া যাইতে পারে না এবং তাহার ইতিহাস কোথাও শেষ হইয়া যায় না। সেই ধারা আজও বহমান। কাজেই প্রাচীন বাঙলাদেশে ঐতিহাসিক কালে সেই চিরবহমান ধারায় আরও কোনও কোনও জনের রক্তস্পর্শ লাগিয়াছে কি না, লাগিলে কতটুকু লাগিয়াছে এবং সেই প্রবহমান ধারাকে কিভাবে কতটুকু রূপান্তরিত করিতে পারিয়াছে বা পারে নাই, তাহার পরিচয়ও এই সঙ্গেই লওয়া প্রয়োজন |

খ্ৰীষ্টীয় প্রথম শতকে গ্ৰীক ভৌগোলিক ও জ্যোতির্বিদ টলেমি (Ptolemy) তাঁহার ‘ইণ্ডিকা’-গ্রন্থে গঙ্গার পূর্বশায়ী দেশগুলির পরিচয় দিতে গিয়া মুরুণ্ড (Murandool) নামে এক জনপদের উল্লেখ করিয়াছেন। পঞ্জাব অঞ্চলে এক মুরুণ্ড উপকোমের উল্লেখ গ্রীক ঐতিহাসিকেরা একাধিকবার করিয়াছেন; ভারতবর্ষের ইতিহাসে এই মুরুণ্ডেরা সুপরিচিত। সমুদ্রগুপ্তের এলাহাবাদ প্রশস্তিতে এই মুরুণ্ডদের উল্লেখ আছে কুষাণবংশীয় দেবপুত্রশাহী-শাহনুশাহী এবং শকদের সঙ্গে। ইহা হইতে অনুমান হয় যে এই মুরুণ্ডরা জন হিসাবে শক-কুষাণদেরই সমগোত্রীয়। শক-কুষাণেরা এক মিশ্র জন। পূর্ব-ভারতে গঙ্গার পূর্বাঞ্চলে যে মুরুণ্ডদের কথা টলেমি বলিতেছেন তাহারা পঞ্জাবের মুরুণ্ডদেরই একটি শাখা হওয়া বিচিত্র নয়। তবে, এই মুরুণ্ডরা বাঙলাদেশে নূতন কোনও রক্তপ্রবাহ বহন করিয়া আনে নাই, তাহা কতকটা নিশ্চয় করিয়া বলা যায়।

বাঙলার বাহিরের অনেক রাজবংশের পরাক্রান্ত রাজারা সৈন্যসামন্ত লইয়া বহুবার বাঙলাদেশ আক্রমণ করিয়াছেন, কমবেশি অংশ-জয় করিয়াছেন, এবং তাহার পর বিজয়গর্ব লইয়া, বহুবিধ ঐশ্বর্য লইয়া স্বদেশ ফিরিয়া গিয়াছেন। সৈন্যসামন্ত ইত্যাদি সঙ্গে যাহারা আসিয়াছিল, তাহাদের অধিকাংশ বিজেতা প্রভুর সঙ্গেই ফিরিয়া গিয়াছে। কিছু যাহারা হয়তো স্থায়ী বাসিন্দারূপে থাকিয়া গিয়াছে তাহারা জনসমুদ্রে জলবিন্দুবৎ কোথায় যে বিলীন হইয়া গিয়াছে, তাহার কোনও হিসাব নাই। ইহারা ছাড়া, পাল ও সেন রাজাদের পট্টোলীগুলিতে এবং সমসাময়িক বাঙলার অন্যান্য লিপিতে দেখা যায়, অনেক অবাঙালী ভারতীয় কোম-উপকোমের উল্লেখ। ভূমি দান-বিক্রয়ের পট্টোলীগুলিতে দান-বিক্রয় যাহাদের নিকট বিজ্ঞাপিত করা হইতেছে, সেখানে বিভিন্ন রাজকর্মচারী, স্থানীয় মহত্তর, গৃহস্থ, কুটুম্ব ইত্যাদির পরই নাম করা হইতেছে নানা কোম ও উপকোমের। দৃষ্টান্তস্বরূপ মদনপালের মন্‌হলি পট্টোলীর তালিকাটি উদ্ধার করা যাইতে পারে; রাজকর্মচারীদের পরেই তালিকাগত করা হইয়াছে “গৌড়-মালব-চোড়-খস-তৃণ-কুলিক-কর্ণাট— লাট-ভট্ট” প্রভৃতি রাজসেবকদের। ইহাদের মধ্যে মালব, চোড়, খস, তৃণ, কুলিক, কর্ণাট, লাট সকলেই অবাঙালী; হুণেরা তো মূলত অ-ভারতীয়, কিন্তু ইতিপূর্বেই তাহারা অন্তত চার-পাঁচ শত বৎসর ধরিয়া এ দেশে বাস করিয়া ভারতীয় বনিয়া গিয়াছে। আমার ধারণা—অন্যত্র এ ধারণার কারণ বলিতে চেষ্টা করিয়াছি—এইসব অবাঙালী কোমের লোকেরা বাঙলাদেশে আসিয়াছিল বেতনভুক সৈনিকরপে, না-হয় রাজ-সরকারে একান্ত নিম্নস্তরের কর্মচারী রূপে। বৃহদ্ধর্মপুরাণ এবং ব্রহ্মবৈবর্তপুরাণে এই রকম কয়েকটি ভিন-প্রদেশী কোমের খবর পাইতেছি, যথা, খস, যবন, কম্বোজ, খর, দেবল বা শাকদ্বীপী, ব্রাহ্মণ। যে ভাবেই হউক এইসব লোকেরা ক্রমশ বাঙলাদেশেরই বাসিন্দা হইয়া গিয়াছিল এবং এ দেশেরই বিশাল জনসমুদ্রে নিজেদের বিলীন করিয়া দিয়াছিল। বাঙলাদেশের জনপ্রবাহের বেগবান ধারায় কবেই ইহারা নিশ্চিহ্ন হইয়া গিয়াছে। কর্ণাট হইতে কল্যাণের চালুক্য রাজবংশ, তামিলভূমি হইতে চোল রাজবংশ একাদশ শতকে বাঙলাদেশে সার্থক বিজয়াভিযান প্রেরণ করিয়াছিল; যে সব সৈন্যসামন্ত এইসব অভিযানের সঙ্গে আসিয়াছিল, তাহাদের কিছু কিছু এই দেশে থাকিয়া যাওয়া অসম্ভবও নয়। ইহাদের আগে মালবরাজ যশোধৰ্মাও এক অভিযানে পূর্ব-ভারতে আসিয়াছিলেন। প্রতিহারবংশীয় রাজারাও বাঙলাদেশে একাধিক বিজয়াভিযান প্রেরণ করিয়াছিলেন। শৈলবংশীয় রাজারাও এক সময়ে এ দেশে এক সমরাভিযান পাঠাইয়াছিলেন। এইসব বিচিত্র সেনাবাহিনীর কিছু কিছু অংশ হয়তো পশ্চাতে থাকিয়া গিয়াছিল এবং তাহারাই যে পরবর্তীকালে মালব, চোড় (চোল), কর্ণাট, লাট, প্রভৃতি নামে রাজসেবক হইয়া পাল ও সেন-লিপিগুলিতে দেখা দেয় নাই, তাহা কে বলিবে? হুণ, খস ইত্যাদিরাও হয়তো এইভাবেই আসিয়া থাকিবে। খসেরা তো হিমালয়ের সানুদেশের পার্বত্য জন; ভোট-চৈনিক রক্তের প্রভাব ইহাদের মধ্যে থাকা স্বাভাবিক। ধর্মপালের খালিমপুর লিপিতে বাঙলাদেশের মন্দিরে লাটদেশীয় ব্রাহ্মণ পুরোহিতের উল্লেখ আছে। আদি-মধ্যযুগের দু-একটি লিপিতে বাঙলার বাহিরের ভিন্ন-প্রদেশাগত ব্রাহ্মণকে ভূমিদানের উল্লেখ আছে। অন্যান্য বর্ণের লোকেরাও নিশ্চয়ই নানা কাজে এ দেশে আসিয়াছিল এবং অনেকেই কালক্রমে এ দেশেরই বাসিন্দা হইয়া গিয়াছিল। ইহাদের মধ্যে অন্ধ্ররাও পাল আমলে, বোধ হয় তাহারও আগে, বাঙলাদেশে আসিয়াছিল। একটু অন্য প্রসঙ্গে লিপিগুলিতে ইহাদেরও নাম পাওয়া যায় একেবারে চণ্ডালদের সঙ্গে। কেন যে সমাজের একেবারে নিম্নতম স্তরে চণ্ডালদের সঙ্গে ইহাদের স্থান নির্ণীত হইয়াছিল, তাহা বোঝা যায় না। যাহাই হউক, যে ভাবেই আসিয়া থাকুক, এবং সমাজের যে স্তরেই থাকুক, অগণিত জনপ্রবাহের মধ্যে ইহারা সংখ্যায় এত স্বল্প এবং ইহাদের প্রত্যেকের ধারা এত ক্ষীণ যে, জনতত্ত্বের দিক হইতে আজ আর তাদের পৃথক করিয়া চিনিয়া লইবার উপায় নাই, বিরাট বেগবান প্রবাহের মধ্যে তাহারা একবারে নিশ্চিহ্ন হইয়া অঙ্গীভূত হইয়া গিয়াছে। তাহা ছাড়া ইহারা সকলেই তো পূর্ববর্ণিত কোনও না কোনও বৃহত্তর জনের অঙ্গীভূত ছিল এবং সে সব জাতি ঐতিহাসিক যুগের পূর্বেই বাঙলাদেশে তাহাদের রক্তপ্রবাহ সঞ্চার করিয়া গিয়াছিল; যাহারা পারে নাই, তাহাদের ঐতিহাসিক বংশধরেরা পরবর্তী কালে যে স্বল্প সংখ্যায় বাঙলাদেশে আসিয়াছিল, যে ক্ষীণ ধারা সঙ্গে আনিয়াছিল, তাহাতে সুস্পষ্ট নিদর্শন আঁকিয়া দেওয়া সম্ভব ছিল না।

রাজা-রাজকুমারেরা অনেক সময় ভারতবর্ষেরই ভিনপ্রদেশী রাজকুমারীদের বিবাহ করিয়া আনিতেন; বাঙালী পাল-রাজারাই করিতেন, কর্ণাট-দেশাগত সেন-রাজারা তো করিতেনই। পুরুষানুক্রমে কয়েক পুরুষ ধরিয়া এইরূপ হইয়াছে, এমন দৃষ্টান্তও আছে। রাজারাজড়ার তো কানও বর্ণ নাই; কাজেই মহিষী নির্বাচন করিতে গিয়া জন-বর্ণ দেখিবারও প্রয়োজন হইত না, রাজবংশ হইলেই চলিত; এখনও তো তাহাই চলে। বিশেষত, রাষ্ট্রীয় ও সামরিক কারণ থাকিলে তো কথাই নাই। কিন্তু ই ধরনের দৃষ্টান্তও বিরাট জনগণপ্রবাহে জলবিন্দুবৎ; কাজেই, মুষ্টিমেয় ভিন্নপ্রদেশাগত নারীও বিশাল জনসমুদ্রে বিলীন হইয়া গিয়াছেন। ইহাই প্রাকৃতিক নিয়ম।

সদ্যোবর্ণিত এইসব দৃষ্টান্ত ছাড়া বাঙলার ইতিহাসে কয়েকটি রাজবংশের পরিচয় আছে যাহারা বিভিন্ন প্রদেশ হইতে বাঙলায় আসিয়া নিজেরা রাজবংশ প্রতিষ্ঠা করিয়া এ দেশের কমবেশি অংশে রাজত্ব করিয়াছেন, পুরুষানুক্রমে বসবাস করিয়াছেন এবং এই দেশেরই বিরাট জনগণপ্রবাহে কালক্রমে বিলীন হইয়া গিয়াছেন। তুর্কী বিজয়ের পূর্ব পর্যন্ত বাঙলাদেশে এই রকম তিন-চারিটি প্রধান প্রধান রাজবংশের পরিচয় পাওয়া যায়। সপ্তম শতাব্দীর শেষার্ধে খড়গ নামে একটি রাজবংশ সমতট অঞ্চলে প্রায় তিন-চার পুরুষ রাজত্ব করিয়াছিলেন; খড়েগাদ্যম, জাতখড়গ, দেবখড়গ ও রাজ-রাজভট—এই চারিজন রাজার নাম আমরা জানি। খড়গ—এই উপান্ত নামটি কেমন যেন সন্দেহজনক এবং ভিনপ্রদেশী অবাঙালীর নাম বলিয়াই মনে হয়, অথচ ইহারা কোথা হইতে আসিয়াছিলেন জানিবার উপায় নাই। তিন পুরুষ ধরিয়া ইহারা অন্তত উপান্ত নামে নিজেদের জনপরিচয় অক্ষুঃ রাখিয়াছিলেন, কিন্তু চতুর্থ পুরুষে তাহা পরিত্যাগ করিয়া একেবারে যেন দেশি বাঙালী বনিয়া গিয়াছিলেন। দশম শতকে কাম্বোজাখা নামে আর এক রাজবংশ গৌড়ে কিছুদিন রাজত্ব করিয়াছিলেন। দিনাজপুর জেলার বাণগড়ে প্রাপ্ত একটি স্তম্ভলিপিতে ইহারা “কাম্বোজাম্বয়জ গৌড়পতি” বলিয়া উল্লিখিত হইয়াছেন; ইরদা তাম্রপট্টেও ইহাদের উল্লেখ আছে। এই কাম্বোজাম্বয়জ রাজারা কাহারা? কোথা হইতে ইহারা আসিয়াছিলেন? দেবপালের মুঙ্গের-শাসনে এক কাম্বোজের উল্লেখ আছে, কিন্তু সেই কাম্বোজদেশ যে উত্তর-পশ্চিমের গান্ধার দেশের সংলগ্ন দেশ, এ সম্বন্ধে কোনও সন্দেহ নাই। কিন্তু বাণগড় স্তম্ভলিপি ও ইরদাপট্টের কাম্বোজ যে মুঙ্গের-শাসনের কাম্বোজ, আমার তাহা মনে হয় না। বহুদিন আগে রমাপ্রসাদ চন্দ মহাশয় বলিয়াছিলেন এবং সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায় মহাশয় তাহা সমর্থন করিয়াছিলেন যে, এই কাম্বোজরা তিব্বত, ভোটান প্রভৃতি হিমালয়ের সানুদেশেরকোনও মোঙ্গোলীয় জনের শাখা এবং বর্তমান উত্তরবঙ্গের কোচ-পলিয়া-রাজবংশীয়দের পূর্বপুরুষ। সুনীতিবাবু কাম্বোজের সঙ্গে কোচ শব্দের একটা শব্দতাত্ত্বিক যোগও অনুমান করিয়াছিলেন; কিন্তু তিনি এই মত এখন পরিত্যাগ করিয়াছেন; কেন করিয়াছেন, জানি না। আসামের পূর্বতম প্রান্তে চীনদেশের সীমায় য়ুনান প্রদেশকে ত্রয়োদশ শতক পর্যন্ত প্রাচ্য ভৌগোলিক ও ব্যবসায়ীরা গান্ধার বলিয়াই অভিহিত করিতেন; ত্রয়োদশ শতকেও রসিদ-উদ-দীন এই দেশকে গান্ধার বলিয়াই উল্লেখ করিয়াছেন। এই গান্ধারেরই সংলগ্ন এক কাম্বোজদেশ যে ছিল না, কে বলিবে? বিশেষত, পূর্ব-দক্ষিণ সমুদ্রশায়ী চম্পাভূমি সংলগ্ন কম্বুজদেশ যখন পূর্ব হতেই এত সুপরিচত? তাহা ছাড়া, ব্ৰহ্মদেশের পেগু শহরের নিকটস্থ পঞ্চদশ শতকের সুদীর্ঘ কল্যাণী শিলালিপিতে রাজা ধৰ্ম্মচেতি ঐ দেশে বৌদ্ধধর্মের ইতিহাস ও ধর্মসংস্কারের যে বিবরণ উৎকীর্ণ করাইয়াছিলেন, তাহাতে কম্বোজ সঙ্ঘ নামে এক বৌদ্ধ ধর্মগোষ্ঠীর উল্লেখ দেখিতে পাওয়া যায়। ইহারা যে সেই উত্তর-পশ্চিম সীমান্তের কাম্বোজদের সঙ্গে সম্পূক্ত, এ কথা সহজে বিশ্বাস করা যায় না। আমার তো মনে হয়, আসামের পূর্ব-সীমান্তের গান্ধার সংলগ্ন একটা কম্বোজ দেশ ছিল, এবং বাঙলার কাম্বোজরাজবংশ সেই দেশ হইতে আগত। যদি তাহা হয়, তাহা হইলে ইহারা মোঙ্গোলীয় পরিবার অন্তর্ভুক্ত ছিলেন, এই অনুমান অসংগত নয়, এবং বাণগড় শিলালিপির সাক্ষ্য স্বীকার করিলেও ইহারা যে এ দেশে আসিয়া এ দেশের শৈবধর্মে দীক্ষিত হইয়াছিলেন তাহাও স্বীকার করিতে হয়। বৃহদ্ধর্মপুরাণ এবং ব্রহ্মবৈবর্তপুরাণে বাঙলাদেশে যে সব অবাঙালী জনের নাম করা হইয়াছে তাঁহাদের মধ্যে কম্বোজ অন্যতম। ব্ৰহ্মপুত্র উপত্যকা হইতে একাধিক মোঙ্গোলীয় জন যে প্রাচীনকালে বাঙালীর জনপ্রবাহে রক্তধারা মিশাইয়াছে, এ কথা আগেই উল্লেখ করিয়াছি। বস্তুত, বাঙলা ও আসামের প্রাচীন ইতিহাসে ঐ অঞ্চল হইতে একাধিক সমরাভিযান ব্ৰহ্মপুত্র-করতোয়া অতিক্রম করিয়া বাঙলাদেশে বিস্তৃত হইয়াছিল, তাহার প্রমাণ পাওয়া যায়। কামরূপরাজ ভাস্করবর্মার স্বল্পকালস্থায়ী উত্তরবঙ্গ ও কর্ণসুবর্ণাধিকার তাহার একটিমাত্র দৃষ্টান্ত।

আর এক বর্মণ রাজবংশ একাদশ ও দ্বাদশ শতকে পূর্ববঙ্গে প্রায় পাঁচ-ছয় পুরুষ ধরিয়া রাজত্ব করিয়াছিলেন। কেহ কেহ অনুমান করেন, এই বর্মণেরা বাঙলার দক্ষিণে কোনও প্রদেশ, সম্ভবত উড়িষ্যা বা অন্ধ্রদেশ হইতে আগত। কিন্তু যে ভিনপ্রদেশাগত রাজবংশ বাঙলাদেশে আসিয়া প্রায় দুইশত বৎসর ধরিয়া রাজত্ব করিয়াছিলেন এবং বাঙালীর সমসাময়িক সমাজবিন্যাসকে আমূল বদলাইয়া স্মৃতি-শাসনের রূপান্তর ঘটাইয়া সমাজের উচ্চস্তরে নূতন এক সমাজবিন্যাস গড়িয়া তুলিয়াছিলেন, সেই সেন রাজবংশের কথা এই প্রসঙ্গে সর্বাপেক্ষা উল্লেখযোগ্য। এই সেন রাজারা নিজেদের পরিচয় দিয়াছেন “কর্ণাট-ক্ষত্ৰিয়” বলিয়া। তাহারা যে দক্ষিণ ভারতের কর্ণাটদেশ হইতে আসিয়াছিলেন, এ কথা আজ সর্বজনবিদিত। কর্ণাটদেশবাসী চালুক্য রাজবংশ একাদশ শতকে বাঙলা ও বিহারে একাধিক সমরাভিযান প্রেরণ করিয়াছিলেন; এইসব অভিযানের সঙ্গে যে সব সৈন্যসামন্তরা আসিয়াছিলেন, তাঁহারাই যে পরবর্তী কালে তিরহুত ও নেপালে “কর্ণাটক” রাজবংশ, রাঢ়ে ও বঙ্গে “কর্ণাটক-ক্ষত্ৰিয়” রাজবংশ প্রতিষ্ঠা করিয়াছিলেন, এ অনুমান ইতিহাসসম্মত। সেন রাজারা সাধারণত বৈবাহিক আদান-প্রদান ভিনপ্রদেশের রাজবংশের সঙ্গেই করিতেন—রাজারাজড়া তো তাহা করিয়াই থাকেন; কিন্তু এ কথাও সত্য যে, দুই শত বৎসরে তাঁহারা একেবারে বাঙালী বনিয়া গিয়াছিলেন এবং বাঙালীর জনপ্রবাহ নিজেদের বিলীন করিয়া দিয়াছিলেন। কর্ণাটদেশের উচ্চবর্ণের লোকেরা তো জন হিসাবে মোটামুটি গোলমুণ্ড, উন্নতনাস অ্যালপাইন পরিবারভুক্ত; উচ্চবর্ণের বাঙালীরাও তাহাই। কাজেই, কর্ণাট-ক্ষত্রিয় সেন রাজবংশ বাঙলাদেশে এমন নূতন কোনও রক্তধারা বহন করিয়া আনেন নাই যাহা বাঙলাদেশে ছিল না; আনিলেও সে ধারা এত ক্ষীণ ও শীর্ণ যে, বেগবান স্রোতপ্রবাহে কোথায় যে তাহা মিশিয়া গিয়াছে, আজ আর তাহা ধরা পড়িবার উপায় নাই।

তুর্কীবিজয়ের পরও বাঙলাদেশে এই ধরনের শীর্ণ রক্তধারার স্পর্শ কিছু কিছু লাগিয়াছে। ভারতবর্ষের বাহির হইতে যেটুকু আসিয়াছে, তাহার দৃষ্টান্ত দুই-চারিটি দেওয়া যায়। কিছু কিছু আরবী মুসলমান পরিবার বাণিজ্যব্যপদেশে বাঙলাদেশে আসিয়া বসবাস করিয়াছে; নোয়াখালি-চট্টগ্রাম অঞ্চলে এবং বাঙলার অন্যান্য জেলায়ও স্বল্পসংখ্যায় ইহাদের দর্শন মেলে। শতাব্দীর পর শতাব্দীর আবর্তে ইহারা বাঙালী মুসলমানদের সঙ্গে এক হইয়া গিয়াছে। নেগ্রিটো-রক্তসম্পৃক্ত হাবসীদের কথাও বলা যায়; বাঙলাদেশে প্রায় পাঁচ-ছয়জন হাবসী সুলতান বহুদিন ধরিয়া রাজত্ব করিয়াছেন। তাহা ছাড়া দিল্লী-আগ্রার অনুকরণে এ দেশেও হাবসী প্রহরী রাখার চলন কিছু কিছু ছিল। ইহারাও বাঙালীর রক্তেই নিজেদের রক্ত মিশাইয়াছে; তাহার কচিৎ নিদর্শন হঠাৎ চোখে পড়িয়া যায় বাঙালী হিন্দু-মুসলমানের উচ্চস্তরেও। কৃষ্ণবর্ণ, প্রশস্ত নাসা, উর্ণাবৎ রুক্ষ কেশ, পুরু উলটানো ঠোঁট দেখিয়া হঠাৎ চমক লাগিয়া যায়। আরাকানী মগ প্রভাবও উল্লেখ করা যায়। ষোড়শ ও সপ্তদশ শতকে পর্তুগীজ ও মগ জলদস্যুর উৎপাতে বাঙলার সমুদ্র উপকূলশালী জেলাগুলি পর্যুদস্ত হইয়াছিল; ইহারা চুরি-ডাকাতি করিয়া মেয়ে ধরিয়া লইয়া আসিত আরাকান প্রভৃতি অঞ্চল হইতে এবং এ দেশ হইতে বাহিরে লইয়া যাইত। এইসব মেয়ে বিক্রয় করাই ছিল ইহাদের ব্যাবসা। বরিশাল, খুলনা, চট্টগ্রাম, নোয়াখালি প্রভৃতি স্থান ছিল এই ব্যাবসার কেন্দ্র। এইভাবে কিছু কিছু মগরক্তও বাঙালীর রক্তপ্রবাহে সঞ্চারিত হইয়াছে। ভরার মেয়ে র যে গীত ও প্রবাদ-কাহিনী আমাদের দেশে প্রচলিত তাহা বোধহয় নিরর্থক স্বপ্নকল্পনা মাত্র নয়। এইভাবেই শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরিয়া বাঙলাদেশে জাতি-সমন্বয় চলিয়াছে, চলিতেছে এবং সমগ্র জীবনপ্রবাহকে সমন্বিত গতি ও রূপ দান করিতেছে।