৩. ভারতীয় জনতত্ত্বে বাঙালীর স্থান

দ্বিতীয় অধ্যায় । ইতিহাসের গোড়ার কথা
তৃতীয় পরিচ্ছেদ – ভারতীয় জনতত্ত্বে বাঙালীর স্থান

ভারতীয় জনতত্ত্বে বাঙালীর স্থান

নৃতত্ত্ববিদেরা মনে করেন ভারতীয় জনসৌধের প্রথম স্তর নেগ্ৰিটো বা নিগ্রোবটু জন। আন্দামান দ্বীপপুঞ্জে এবং মালয় উপদ্বীপে যে নেগ্ৰিটো জনের বসবাস ছিল এ তথ্য বহু পুরাতন। কিছুদিন আগে হাটন, লাপিক ও বিরজাশংকর গুহ মহাশয় দেখাইয়াছিলেন যে, আসামের অঙ্গামি নাগাদের মধ্যে এবং দক্ষিণ ভারতের পেরাম্বকুলম এবং আন্নামালাই পাহাড়ের কাদার ও পুলায়ানদের ভিতর নিগ্রোবটু রক্তপ্রবাহ স্পষ্ট। ভারতীয় নিগ্রোবটুদের দেহবৈশিষ্ট্য কিরূপ ছিল তাহা নিশ্চয় করিয়া বলিবার উপায় কম, কারণ বহুযুগ পূর্বেই ভারতবর্ষের মাটিতে তাহারা বিলীন হইয়া গিয়াছিল। তবে বিহারের রাজমহল পাহাড়ের আদিম অধিবাসীদের কাহারও কাহারও মধ্যে কখনও কখনও যে ধরনের ক্ষুদ্রকায়, কৃষ্ণাভ ঘনশ্যাম, উর্ণাবৎ কেশযুক্ত, দীৰ্ঘমুণ্ডাকৃতির দেহবৈশিষ্ট্য দেখা যায়, কাদারদের মধ্যে যে মধ্যমাকৃতি নরমুণ্ডের দর্শন মেলে, তাহা হইতে এই অনুমান করা যায় যে, ভারত ও বাঙলার নিগ্রোবটুরা দেহগঠনে কতকটা তাহাদের প্রতিবাসী নিগ্রোবটুদের মতনই ছিল; বিশেষভাবে মালয় উপদ্বীপে সেমাং জাতির দেহগঠনের সঙ্গে তাঁহাদের সাদৃশ্য ছিল বলিয়া গুহ মহাশয় অনুমান করেন। বাঙলার পশ্চিম প্রান্তে রাজমহল পাহাড়ের বাগদীদের মধ্যে, সুন্দরবনের মৎসশিকারী নিম্নবর্ণের লোকদের মধ্যে, মৈমনসিংহ ও নিম্নবঙ্গের কোনও কোনও স্থানে কচিৎ কখনও, বিশেষভাবে সমাজের নিম্নতম স্তরের লোকদের ভিতর, যশোহর জেলার বাঁশফোঁড়দের মধ্যে মাঝে মাঝে যে কৃষ্ণাভ ঘনশ্যামবর্ণ, প্রায় উর্ণাবৎ কেশ, পুরু উল্টানো ঠোঁট, খর্বকায়, অতি দাপট নাকের লোক দেখিতে পাওয়া যায়, তাহা তো নিগ্রোবটু রক্তেরই ফল বলিয়া মনে হয়। নিগ্রোবটুদের এই বিস্তৃতি হইতে অনুমান করা চলে যে, এখন তাঁহাদের অবশেষ প্রমাণসাপেক্ষ হইলেও এক সময়ে এই জাতি ভারতবর্ষে এবং বাঙলার স্থানে স্থানে সুবিস্তৃত ছিল। কিন্তু বিচিত্র জনসংঘর্ষের আবর্তে তাহারা টিকিয়া থাকিতে পারে নাই। জার্মান পণ্ডিত ফন আইকস্টেডট্র কিন্তু ভারতবর্ষে নিগ্রোবটুদের অস্তিত্ব স্বীকার করেন না। তিনি বলেন, এ দেশে সন্ধানসম্ভাব্য আদিমতম স্তরে নিগ্রোবটুসম অর্থাৎ কতকটা ঐ ধরনের দেহলক্ষণবিশিষ্ট একটি নরগোষ্ঠীর বিস্তার ছিল, কিন্তু তাহারা যে নেগ্ৰিটো বা নিগ্রোবটু নরগোষ্ঠীরই লোক, এ কথা নিশ্চয় করিয়া বলা যায় না।

নিম্নবর্ণের বাঙালীর এবং বাঙলার আদিম অধিবাসীদের ভিতর যে জনের প্রভাব সবচেয়ে বেশি, নরতত্ত্ববিদেরা তাঁহাদের নামকরণ করিয়াছেন আদি-অষ্ট্রেলীয় (proto-Austroloid)। তাঁহারা মনে করেন যে, এই জন এক সময় মধ্য-ভারত হইতে আরম্ভ করিয়া দক্ষিণ-ভারত, গলে হইতে একেবারে অষ্ট্রেলিয়া পর্যন্ত বিস্তৃত ছিল। মোটামুটিভাবে ইহাদের দেহ বৈশিষ্ট্যের স্তরগুলি ধরা পড়ে ভারতবর্ষে, বিশেষভাবে মধ্য ও দক্ষিণ-ভারতের আদিম আধিবাসীদের মধ্যে, সিংহলের ভেড্ডাদের মধ্যে এবং অস্ট্রেলিয়ার আদিম অধিবাসীদের মধ্যে। এই তথ্যই বোধ হয় আদি-অষ্ট্রেলীয় নামকরণের হেতু যাহা হউক, মধ্য ও দক্ষিণ-ভারতের আদিম আধিবাসীরা যে খর্বকায়, কৃষ্ণবর্ণ, দীর্ঘমুণ্ড, প্রশস্তনাস, তাম্ৰকেশ এই আদি-অষ্ট্রেলীয়দের বংশধর এ সম্বন্ধে কোনও সন্দেহ নাই। পশ্চিম-ভারতে এবং উত্তর-ভারতের গাঙ্গেয় প্রদেশে যে সব লোকের স্থান হিন্দু সমাজবিন্যাসের প্রান্ততম সীমায় তাহারা, মধ্য-ভারতের কোল, ভীল, করোয়া, খারওয়ার, মূল ভূমিজ, মালপাহাড়ী প্রভৃতি লোকেরা, দক্ষিণ-ভারতের চেঞ্চু, কুরুব, য়েরুব প্রভৃতি লোকেরা, সকলেই সেই আদি অষ্ট্রেলীয় গোষ্ঠীর লোক। বেদে যে নিষাদদের উল্লেখ আছে, বিষ্ণু-পুরাণে যে নিষাদদের বর্ণনা করা হইয়াছে অঙ্গার-কৃষ্ণবর্ণ, খর্বকায়, চ্যাপটামুখ বলিয়া, ভাগবত পুরাণ যাহাদের বর্ণনা করিয়াছে কাককৃষ্ণ, অতি খর্বকায়, খর্ববাহু, প্রশস্তনাস, রক্তচক্ষু এবং তাম্রকেশ বলিয়া, সেই নিষাদরাও আদি-অষ্ট্রেলীয়দেরই বংশধর বলিয়া অনুমান করিলে অন্যায় হয় না। পুরাণোক্ত ভীল্ল-কোল্লরাও তাহাই। বর্তমান বাঙলা দেশের, বিশেষভাবে রাঢ় অঞ্চলের সাঁওতাল, ভূমিজ মুণ্ডা, বাঁশফোঁড়, মালপাহাড়ী প্রভৃতিরা যে আদি-অষ্ট্রেলীয়দের সঙ্গে সম্পৃক্ত, এ অনুমান নরতত্ত্ববিরোধী নয়। এই আদি-অষ্ট্রেলীয়দের সঙ্গে পূর্বতন নিগ্রোবটুদের কোথায় কোথায় কতখানি রক্তমিশ্রণ ঘটিয়াছিল তাহা বলা কঠিন, তবে কোথাও কোথাও কিছু কিছু যে ঘটিয়াছিল তাহা অনস্বীকার্য। তাহা না হইলে মধ্য-ভারতের, দক্ষিণ-ভারতের এবং বাঙলাদেশের আদি অষ্ট্রেলীয়দের মধ্যে দেহ-বৈশিষ্ট্যের যে পার্থক্য দেখা যায়, তাহার যথেষ্ট ব্যাখ্যা খুঁজিয়া পাওয়া যায়না। এ প্রসঙ্গে বলা উচিত, ফন আইকস্টেডট মোটামুটি এই আদি-অষ্ট্রেলীয় নরগোষ্ঠীর যে অংশ মধ্য ও পূর্ব-ভারতবর্ষের অধিবাসী তাঁহাদের নামকরণ করিয়াছেন ‘কেলিড্‌’ এবং সিংহলীয় অংশের ‘ভেডিড্‌’। ‘কোলিড্‌’ বা ‘কোলসম’ নামকরণ ভারতীয় ঐতিহ্যের সমর্থক; সেই কারণে আইকস্টেডটের এই নামকরণ গ্রহণযোগ্য।

ভারতবর্ষের জনবহুল সমতল স্থানগুলিতে যে জনের বাস তাঁহাদের মধ্য হইতে পূর্বোক্ত আদিম আধিবাসীদের দেহলক্ষণগুলি বাদ দিলে কয়েকটি বিশেষ লক্ষণ দৃষ্টিগোচর হয়। এই জনের লোকেরা দেহদৈর্ঘ্যে মধ্যমাকৃতি, ইহাদের মুণ্ডাকৃতি দীর্ঘ ও উন্নত, কপাল সংকীর্ণ মুখ খর্ব এবং গণ্ডাস্থি উন্নত, নাসিকা লম্বা ও উন্নত কিন্তু নাসামুখ প্রশস্ত, ঠোঁট পুরু এবং মুখগহুর বড়, চোখ কালো এবং গায়ের চামড়া সাধারণত পাতলা হইতে ঘন বাদামী। দক্ষিণ-ভারতের অধিকাংশ লোক এবং উত্তর ভারতের নিম্নতর শ্রেণীর প্রায় সকলেই উপরোক্ত বৈশিষ্ট্যসম্পন্ন দীৰ্ঘমুণ্ড জনের বংশধর, এবং এই দীর্ঘমুণ্ড জনেরাই ভারতীয় জনপ্রবাহে যে দীর্ঘমুণ্ডধারা বহমান তাহার উৎস। বাঙলাদেশেও উত্তম ও মধ্যম সংকর এবং অন্ত্যজ পর্যায়ে যে দীর্ঘমুণ্ডের ধারাচিহ্ন দেখা যায়, তাহাও মূলত এই নরগোষ্ঠীরই দান। এই গোষ্ঠীর আদি বাসস্থান কোথায় এবং বিস্তৃতি কোথায় ছিল তাহা নিশ্চয় করিয়া বলিবার উপায় নাই, তবে বিরজাশংকর গুহ মহাশয় প্রমাণ করিতে চেষ্টা করিয়াছেন যে, এক সময় এই দীর্ঘমুণ্ডগোষ্ঠী উত্তর-আফ্রিকা হইতে আরম্ভ করিয়া ভারতের উত্তর-পশ্চিম দেশগুলি পর্যন্ত বিস্তৃত ছিল; পরে নব্যপ্রস্তর যুগে ইহারা ক্রমশ মধ্য, দক্ষিণ ভারতে বিস্তৃতি লাভ করে এবং এইসব দেশে আদি-অষ্ট্রেলীয়দের সঙ্গে ইহাদের কিছু রক্তসংমিশ্রণ ঘটে।

এই সদ্যকথিত জন ছাড়া আরও দুইটি দীর্ঘমুণ্ড জন কিছু পরবর্তীকালেই ভারতবর্ষে আসিয়া বসবাস করিয়াছিল বলিয়া মনে হয়। এই দুই জনের কিছু কিছু কঙ্কালাবশেষ পাওয়া গিয়াছে সিন্ধু নদীর উপত্যকায়। মাকরান, হরপ্পা ও মহেন-জো-দড়োর নিম্নস্তরে প্রাপ্ত কঙ্কালগুলি হইতে মনে হয় ইহাদের মধ্যে একটির দেহগঠন ছিল সুদৃঢ় ও বলিষ্ঠ, মগজ বড়, ভূ-অস্থি স্পষ্ট, কানের পিছনের অস্থি বৃহৎ। এইসব দেহলক্ষণ পাঞ্জাবের সমরকুশল, দৃঢ় ও বলিষ্ঠ কোনও কোনও শ্রেণী ও বর্ণের ভিতর এখনও দেখা যায়। কিন্তু এই জন পাঞ্জাব অতিক্রম করিয়া পূর্ব ও দক্ষিণ দিকে আর অগ্রসর হইয়াছিল বলিয়া মনে হয় না। দ্বিতীয় দীর্ঘমুন্ড জনের পরিচয়ও মহেন-জো-দড়োর কোনও কোনও কঙ্কালাবশেষ হইতেই পাওয়া যায়। এই জনের লোকদের দেহগঠন তত সুদৃঢ় ও বলিষ্ঠ নয়, বরং ইহারা দৈর্ঘ্যেও একটু খর্ব, কিন্তু মুখাবয়ব তীক্ষ্ণ ও সুস্পষ্ট, নাসিকা তীক্ষ্ণ ও উন্নত, কপাল ধনুকের মতো বঙ্কিম। ইহাদের মধ্যে ভূমধ্য নরগোষ্ঠীর দেহলক্ষণের সাদৃশ্য অত্যন্ত সুস্পষ্ট, এবং অনুমান করা যায়, সিন্ধু উপত্যকার প্রাগৈতিহাসিক সভ্যতার যে পরিচয় হরপ্পা ও মহেন-জো-দড়োতে আমরা পাইয়াছি তাহা ইহাদেরই সৃষ্টি। উত্তর-ভারতে সর্বত্র সকল বর্ণের মধ্যেই, বিশেষভাবে উচ্চবর্ণের লোকদের ভিতর, এই দীর্ঘমুণ্ড নরবংশের রক্তধারা প্রবহমান এবং এই রক্তপ্রবাহের তারতম্যের ফলেই উত্তর-ভারত ও দক্ষিণ-ভারতের লোকদের মধ্যে এ ধারার কিছুটা অস্তিত্ব অস্বীকার করিবার উপায় নাই। বাঙলাদেশে এই দীর্ঘমুণ্ড জনের রক্তপ্রবাহের ধারা কতখানি আসিয়া পৌঁছিয়াছিল তাহা নিশ্চয়ই করিয়া বলা যায় না; কতকটা স্রোতস্পর্শ যে লাগিয়াছিল সে সম্বন্ধে সন্দেহ কী?

উপরোক্ত দীর্ঘমুণ্ড জনেরা যে জনস্তর গড়িয়া তুলিয়াছিল, উত্তর-পশ্চিম হইতে তাহার উপর এক গোলমুণ্ড জন আসিয়া নিজেদের রক্তপ্রবাহ সঞ্চারিত করিল। মনে রাখা প্রয়োজন যে, ইহাদের সঙ্গে গোলমুন্ড মোঙ্গোলীয় নরগোষ্ঠীর কোনই সম্বন্ধ নাই। এই জনের সর্বপ্রাচীন সাক্ষ্য সংগৃহীত হইয়াছে হরপ্পা ও মহেন-জো-দড়োতে প্রাপ্ত মুণ্ডকঙ্কাল হইতে। ইহাদের সঙ্গে পূর্ব-ইউরোপের দীনারায় এবং কতকাংশে আর্মানীয় জাতির সম্বন্ধ সুস্পষ্ট। এই জাতিই লাপোং, রিজলি, লুসসান ও রমাপ্রসাদ চন্দ-কথিত অ্যালপাইন (Homo Alpinus) নরগোষ্ঠী, বিরজাশংকর গুহ কথিত অ্যালপো-দীনায়ীয় নরগোষ্ঠী, ফন আইকস্টেডট কথিত পশ্চিম ও পূর্ব ‘ব্র্যাকিড’ বা গালমুণ্ড নরগোষ্ঠী। বাঙলাদেশের উচ্চবর্ণের ও উত্তম সংকর বর্ণের জনসাধারণের মধ্যে যে গোল ও মধ্যম মুণ্ডাকৃতি, তীক্ষ্ণ ও উন্নত এবং মধ্যম নাসাকৃতি ও মাধ্যমিক দেহ-দৈর্ঘ্যের লক্ষণ দেখিতে পাওয়া যায়, তাহা অনেকাংশে এই নরগোষ্ঠীরই দান। বস্তুত, বাঙলাদেশের যে জন ও সংস্কৃতি শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরিয়া গড়িয়া উঠিয়াছে, তাহার প্রায় সমগ্র মূল রূপায়ণই প্রধানত অ্যালপাইন ও আদি-অষ্ট্রেলীয়, এই দুই জনের লোকদের কীর্তি। পরবর্তী কালে আগত আর্যভাষাভাষী আদি-নর্ডিক নরগোষ্ঠীর রক্তপ্রবাহ ও সংস্কৃতি তাহার উপরের স্তরের একটি ক্ষীণ প্রবাহ মাত্র, এবং এই প্রবাহ বাঙালীর জীবন ও সমাজবিন্যাসের উচ্চতর স্তরেই আবদ্ধ; ইহার ধারা বাঙালীর জীবন ও সমাজের গভীর মূলে বিস্তৃত হইতে পারে নাই। যাহাই হোক, পামীর মালভূমি, তাকলামাকান মরুভূমি, আল্পস পর্বত, দক্ষিণ আরব ও ইউরোপের পূর্বদেশবাসী এই অ্যালপাইন জনের বংশধরেরা বর্তমান ভারতবর্ষে ছড়াইয়া আছে নানা স্থানে—গুজরাটে, কর্ণাটে, মহারাষ্ট্রে, কুর্গে, মধ্যভারতে, বিহারে নাগর ব্রাহ্মণদের মধ্যে, বাঙলায় ব্রাহ্মণ, কায়স্থ, বৈদ্য এবং উপরের বর্ণস্তরের সকল লোকদের মধ্যে। সর্বত্র সমানভাবে একই বৈশিষ্ট্য বিদ্যমান নাই, এ কথা সত্য, কিন্তু ভারতবর্ষে গোলমুণ্ড, উন্নতনাস মানুষের রক্তধারা যেখানে যে পরিমাণে আছে তাহার মূলে এই গোলমুণ্ড, উন্নতনাস অ্যালপাইন নরগোষ্ঠী উপস্থিত। ফন আইকস্টেডটের মতে এই নরগোষ্ঠীর তিন শাখা : পশ্চিম ব্র্যাকিড, যাহাদের বংশধর বর্তমান মহারাষ্ট্র ও কুর্গের অধিবাসীরা, গাঙ্গেয় উপত্যকার দীর্ঘদেহ ব্র্যাকিডরা এবং বাঙলা ও উড়িষ্যার পূর্ব ব্র্যাকিডরা। এই তিন শাখাই, তাঁহার মতে, আর্যভাষী ‘ইণ্ডিড’ নামক বৃহত্তর নরগোষ্ঠীর অন্তর্ভুক্ত।

কিন্তু যে জন বিশিষ্ট ভারতীয় সভ্যতা ও সংস্কৃতির জন্মদাতা এবং যাহারা পূর্বতন ভারতীয় সংস্কৃতির আমূল রূপান্তর সাধন করিয়া তাহাকে নবকলেবর নবরূপ দান করিয়াছিল, তাহারা এই অ্যালপাইন নরগোষ্ঠী হইতে পৃথক। এই নূতন জনের নরতত্ত্ববিদ্‌দত্ত নাম হইতেছে আদি-নর্ডিক (proto-Nordic) | এই আদি-নর্ডিক জনই বৈদিক সভ্যতা ও সংস্কৃতির সৃষ্টিকর্তা ভারতবর্ষে ইহাদের সুপ্রাচীন কোনও কঙ্কালাবশেষ আবিষ্কৃত হয় নাই; তবে, তক্ষশীলার ধর্মরাজিকা বিহারের ধ্বংসাবশেষের মধ্যে যে কয়টি নরকঙ্কাল পাওয়া গিয়াছে তাহা হইতে অনুমান হয়, ইহাদের মুখাবয়ব দীর্ঘ সুদৃঢ় ও সুগঠিত নাসিকা সংকীর্ণ ও সুউন্নত, মুণ্ডাকৃতি দীর্ঘ হইলেও গোলের দিকে ঝোঁক সুস্পষ্ট এবং নিচের দিকে চোয়াল দৃঢ় মাথার খুলি এবং মুখাবয়ব হইতে মনে হয়, ইহাদের দেহ ছিল খুব বলিষ্ঠ ও দৃঢসংবদ্ধ। উত্তর-পশ্চিম সীমান্ত প্রদেশের পাঠান, হিন্দুকুশ পর্বতের কাফীর প্রভৃতি কোমের লোকেরা, পঞ্জাব ও রাজপুতনার উচ্চশ্রেণীর ও বর্ণের লোকেরা ইহাদেরই বংশধর, যদিও শেষোক্ত দুই স্থানে পূর্বতন দীর্ঘমুণ্ড জাতির সঙ্গে ইহাদের সংমিশ্রণ একটু বেশি ঘটিয়াছে বলিয়া মনে হয়। উত্তর ও পশ্চিম ভারতে সর্বত্রই ইহাদের ধারাচিহ্ন পাওয়া যায়, কিন্তু তাহা সর্বত্র খুব বলিষ্ঠ ও বেগবান নয়। উত্তর-যুরোপের নর্ডিক জাতির সঙ্গে ইহাদের সম্বন্ধ ঘনিষ্ঠ এ কথা অস্বীকার করিবার উপায় নাই, তবে পার্থক্যও আছে, বিশেষভাবে চুল ও গায়ের রঙে। ভারতীয় নর্ডিক জাতির চুলের রং সাধারণত ঘন বাদামী হইতে ঘনকৃষ্ণ এবং চামড়া বাদামী হইতে রক্তিম গৌর। উত্তর-য়ুরোপের নর্ডিকদের চামড়া রক্তিম শ্বেত এবং কেশ পাতলা বাদামী হইতে শ্বেতোপম। এই পার্থক্য কতকটা জলবায়ু-নির্ভর সন্দেহ নাই, কিন্তু মূলত কতকটা পূর্বাপর ইতিহাসগত তাহাও অস্বীকার করা যায় না। সম্ভবত, বৈদিক আর্যসভ্যতার নির্মাতা নর্ডিকেরাই আদি-নর্ডিক, এবং ইহারাই পরবর্তীকালে উত্তরে যুরোপখণ্ডে গিয়া ক্রমশ নুতন দেহলক্ষণ উদ্ভব করিয়াছিল। ফন আইকস্টেডট এই বলিষ্ঠ ও দুর্জয় নরগোষ্ঠীর নামকরণ করিয়াছেন ‘ইন্ডিড’। যাহাই হউক, ইহাদেরই আর্যভাষা, সভ্যতা ও সংস্কৃতি ঐতিহাসিক কালে বহু শতাব্দী ধরিয়া ধীরে ধীরে বাঙলাদেশে সঞ্চারিত হইয়া পূর্বতন সভ্যতা ও সংস্কৃতিকে আত্মসাৎ করিয়া নূতনরূপে আত্মপ্রকাশ করিয়াছিল সন্দেহ নাই। কিন্তু বাঙালীর রক্ত ও দেহগঠনে এই আদি-নর্ডিক জনের বক্ত ও দেহগঠন বৈশিষ্ট্যের দান অত্যন্ত অল্প; সে ধারা শীর্ণ ও ক্ষীণ, এত শীর্ণ ও ক্ষীণ যে বাঙলাদেশের ব্রাহ্মণদের মধ্যেও তাহা খুব সূক্ষ্ম বিশ্লেষণ সত্ত্বেও সহসা ধরা পড়ে না। বর্তমান যুক্তপ্রদেশ, রাজপুতনা বা পঞ্জাবের ব্রাহ্মণদের সঙ্গে নরতত্ত্বের দিক হইতে বাঙালী ব্রাহ্মণের কোনও সম্বন্ধই যে প্রায় নাই তাহার কারণ এই তথ্যের মধ্যে নিহিত। ঐসব দেশের ব্রাহ্মণেরা যে সামাজিক ক্ষেত্রে বাঙালী ব্রাহ্মণের ব্রাহ্মণত্বের দাবি সম্পূর্ণ স্বীকার করেন না তাহার অন্যতম কারণ এই জনপার্থক্য নয় কি?

ইহা ছাড়াও আর একটি খর্বদেহ দীৰ্ঘমুন্ড জাতির অস্তিত্ব অনুমান করিয়াছেন নরতত্ত্ববিদ ফিশার সাহেব, এবং ইহাদের নামকরণ করিয়াছেন প্রাচ্য বা Oriental বলিয়া। ইহারা পাতলা গৌর, কিন্তু ইহাদের চুল ও চোখ কৃষ্ণবর্ণ এবং নাসিকা দীর্ঘ ও উন্নত। উত্তর আফগানিস্তানের বাদক্ষীরা, দীর্‌ হইতে খাইবার গিরিবর্ত্ম পর্যন্ত যে সব লোক বাস করে, চিত্রল হইতে হিমালয়ের সানুদেশ ধরিয়া নেপালের পশ্চিম প্রান্ত পর্যন্ত যে সব পার্বত্য জনের বাস, ইহারা সকলেই কমবেশি সেই প্রাচ্য জনের বংশধর। পঞ্জাবের হিন্দুসমাজের কোনও কোনও শ্রেণীতে এবং মুসলমানদের উচ্চশ্রেণীতে এই জনের শীর্ণ প্রবাহ কিছুটা ধরা পড়ে, কিন্তু বাঙলাদেশে ইহাদের রক্তধারা আসিয়া পৌঁছিতে পারে নাই, এমন-কি পর্বতশায়ী উত্তরাংশেও নয়। ফন্‌ আইকস্টেডট এই নরগোষ্ঠীর নামকরণ করিয়াছেন ‘উত্তর-ইন্ডিড’ বলিয়া; এবং ডেনিকার ও জিউফ্রিডা-রাগ্‌গেরী ইহাদেরই বোধ হয় বলিয়াছেন ‘ইন্দো-আফগানীয়’।

মোঙ্গলীয় নরগোষ্ঠীর সঙ্গে ভাররবর্ষের ঘনিষ্ঠতম পরিচয় পরবর্তী ঐতিহাসিক কালে। এইসব মোঙ্গলীয় নরগোষ্ঠী বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন দেশে ছড়াইয়াছে সন্দেহ নাই, কিন্তু ভারতবর্ষের জনপ্রবাহে ইহাদের স্পর্শ গভীরভাবে কোথাও লাগে নাই, একমাত্র আসাম, উত্তরের হিমালয়শায়ী নেপাল-ভোটান এবং পূর্ব প্রান্তে ব্ৰহ্মদেশশায়ী প্রত্যন্ত জনপদ ও অরণ্যবাসী লোকদের মধ্যে ছাড়া। চৈনিক তুর্কীস্থানের তুকী-ভাষাভাষী অথবা খিরগিজ, উজবেক প্রভৃতি লোকদের মতো যথার্থ মোঙ্গোলীয় জন বা কোম আজ পর্যন্ত ভারতীয় নরতত্ত্বের বহির্ভূত। তবে উত্তরে হিমালয়সানুদেশবাসী লিম্বু লেপচা, রংপা প্রভৃতি কোমের লোকদের মধ্যে তিব্বতী রক্তধারা সুস্পষ্ট। ইহাদের দেহাকৃতি মধ্যম হইতে দীর্ঘ, মুণ্ডাকৃতি গোল, গণ্ডাস্থি উন্নত এবং নাসিকাকৃতি দীর্ঘ ও চ্যাপটা। নেপালেও এই রক্তধারার প্রভাব ধরা পড়ে, তবে উত্তর ও পূর্বাঞ্চলে ক্রমশ ক্ষীয়মাণ।

আসামের উত্তর-পূর্বপ্রান্তশায়ী পার্বত্য দেশগুলিতে আবার একটি পৃথক মোঙ্গোলীয় রক্তধারার পরিচয় পাওয়া যায়। ইহাদের মুণ্ডাকৃতি ঠিক গোল নয়, গোলের ঠিক উল্টা অর্থাৎ দীর্ঘ, এবং অক্ষিপুট সম্মুখীন। ইহারা যে মোঙ্গোলীয় তাহার প্রমাণ ইহাদের চ্যাপটা নাক, উন্নত গণ্ডাস্থি, বঙ্কিম চক্ষু, উদ্দণ্ড কেশ, কেশবিহীন দেহ ও মুখমণ্ডল। দক্ষিণ-পশ্চিম চীন হইতে ইহারা ক্রমশ ব্ৰহ্মদেশ, মালয় উপদ্বীপ ও পূর্ব-দক্ষিণ সমুদ্রশায়ী দেশ ও দ্বীপগুলিতে ছড়াইয়া পড়িয়াছিল; পথে উত্তর-পূর্ব আসামে এবং উত্তর ব্ৰহ্মপুত্র উপত্যকায় মিরি, নাগা, বোদো বা মেচ প্রভৃতি লোকদের ক্তিতর, কোচ, পালিয়া, রাজবংশী প্রভৃতি লোকদের ভিতর ইহাদের একটি ধারাপ্রবাহ ধরা পড়িয়া গিয়াছে। আসামে এই ধারা সর্বত্রই, সমাজের সকল স্তরেই প্রবহমান, তবে উচ্চবর্ণগুলির ভিতর গোলমুন্ড অ্যালপাইন এবং কিছু পরিমাণে দীর্ঘমুণ্ড আদি-নর্ডিক ধারাও সুস্পষ্ট; এই শেষোক্ত দুই ধারাই আসামের হিন্দু সভ্যতা ও সংস্কৃতির ভিত্তি। ব্রহ্মপুত্র উপত্যকাধুত ধারাটির একটি প্রবাহ ঐতিহাসিক কালে বাঙলাদেশে আসিয়া ঢুকিয়া পড়ে, এবং রংপুর, কোচবিহার, জলপাইগুড়ি প্রভৃতি অঞ্চলে এইভাবেই খানিকটা মোঙ্গোলীয় প্রভাব আত্মপ্রকাশ করিয়াছে, কিন্তু তাহা সাধারণত সমাজের নিম্নস্তরে।

ব্ৰহ্মদেশে যে মোঙ্গোলীয় জনের সঙ্গে আমাদের পরিচয় ঘটে, তাহারা খর্বদেহ, তাঁহাদের মণ্ডাকৃতি গোল,—দীর্ঘ নয়, এবং চামড়ার রং আরও ঘোর। দীর্ঘমুণ্ড অহোমীয় মোঙ্গোলীয়দের সঙ্গে ইহাদের আত্মীয়তা থাকিলেও ইহারা একগোত্রীয় নয়; বরং ব্রহ্মদেশীয় গোলমুণ্ড মোঙ্গোলীয়দের সঙ্গে সমগোত্রীয়তা আছে ত্রিপুরা জেলার চাকমাদের, টিপরাইদের এবং আরাকানের এবং চট্টগ্রামাঞ্চলের মগদের। বাঙলাদেশের অন্যত্র কোথাও এই ব্ৰহ্ম-মোঙ্গোলীয় প্রভাবের পরিচয় পাওয়া যায় না এবং বাঙলার জনগণের রক্তপ্রবাহে ইহারা বিশেষ কোনও চিহ্ন রাখিয়া বায় নাই।

ভারতবর্ষের নরগোষ্ঠীপ্রবাহ সম্বন্ধে উপরে যাহা বলা হইল, পাশ্চাত্য ও ভারতীয় নৃতাত্ত্বিকেরা

ইতিহাসের গোড়ার কথা। ৩৫

মোটামুটি তাহা স্বীকার করেন। কিন্তু সাম্প্রতিক কালে লাইপত্সিগ স্যাক্সন ইনস্টিটিউটের ভারতীয় নৃতত্ত্বাভিযানের নেতা ব্যারন ফন আইকস্টেডট সমস্ত ভারতবর্ষ জুড়িয়া যে সুবিস্তৃত শারীর পরিমিতি গণনা করিয়াছেন, তাহার ফলে ভারতীয় নরগোষ্ঠীপ্রবাহে কিছু নতুন আলোকপাত হইয়াছে। ফন আইকস্টেডটের বিশ্লেষণ ও মতামত আমাদের দেশে বহুলপ্রচারিত নয়; অথচ নানা কারণে তাঁহার মতামত আলোচিত হইবার দাবি রাখে। প্রথমত, ভারতীয় নরতত্ত্ব জিজ্ঞাসায় তিনিই বোধহয় সর্বপ্রথম সমস্ত ভারতবর্ষ তাহার গণনা ও বিশ্লেষণের বিষয়ীভূত নিয়াছেন। দ্বিতীয়ত, তিনিই সকলের চেয়ে বেশি সংখ্যায় পরিমিতি লইয়াছেন। তৃতীয়ত, সমস্ত পরিমিতি একই মানদণ্ডানুযায়ী গৃহীত হইয়াছে; এবং চতুর্থত, যে বিচার পদ্ধতি অনুযায়ী পরিমিতি বিশ্লেষিত হইয়াছে তাহা একান্ত আধুনিক বিজ্ঞানসম্মত পদ্ধতি। পূর্বতন সকল মতামত বিচার করিয়া এবং সুবিস্তৃত ও সুগভীর গবেষণার ফলে তিনি যে সিদ্ধান্তে উপনীত হইয়াছেন, তাহার সংক্ষিপ্ত একটু পরিচয় লওয়া এ প্রসঙ্গে অবাস্তর নয়। তিনি বিভিন্ন নরগোষ্ঠীর যে নামকরণ করিয়াছেন, তাহা অনন্যপূর্ব না হইলেও একটু অসাধারণ। কিন্তু একটু গভীরভাবে বিবেচনা করিলে দেখা যাইবে, নামকরণ যাহাই হোক, বিভিন্ন নরগোষ্ঠীর যে যে বিশিষ্ট দেহলক্ষণের উপর এই নামকরণের নির্ভর সেই দেহলক্ষণ সম্বন্ধে পণ্ডিতদের মধ্যে মতের বিভিন্নতা খুব বেশি নাই। শ্রেণীনির্ধারণ সম্বন্ধে মতের বিভিন্নতা অবশ্যই লক্ষণীয়।

ফন আইকস্টেডটের মতে ভারতবর্ষে মোটামুটি তিনটি নরগোষ্ঠীর রক্তপ্রবাহ উপস্থিত। প্রত্যেক গোষ্ঠীতেই কয়েকটি শাখাগোষ্ঠী সংলগ্ন।

১. ভেড্ডিড্‌ বা ভেড্ডীয় নরগোষ্ঠী—উত্তর-দক্ষিণাত্যের পাতলা রং ও বলিষ্ঠ গড়নের উত্তর-গোণ্ডীয় গোষ্ট্ৰীয় লোকেরা এবং দক্ষিণ ভারতের ঘোরকৃষ্ণ ‘মেলিড্‌’ ও সিংহলের ভেড্ডারা এই ভেড্ডিড্‌ বা ভেড্ডীয় নরগোষ্ঠীর শাখা। লক্ষণীয় যে, কোল-মুণ্ডা নরগোষ্ঠীকে ফন আইকস্টেডট। বৃহত্তর গোষ্ঠীর অন্তর্ভুক্ত করিতেছেন না।

২. ‘মেলানিড্‌’ বা ‘ভারতীয় মেলানিড্‌’–এই নরগোষ্ঠীর প্রধান বাসস্থান দক্ষিণ ভারতের সমতল প্রদেশ, এবং বর্তমান তামিলভাষী লোকেরা ইহাদের বংশধর। উত্তরে হোদের মধ্যে এই ‘মেলানিড্‌’ রক্তস্পর্শ সুস্পষ্ট এবং আরও উত্তর গাঙ্গেয় উপত্যকায় ইহাদের কোনও কোনও ক্ষুদ্রতর শাখার দর্শন দুর্লভ নয়, বিশেষত, তথাকথিত নিম্নজাতদের ভিতর। কোলীয়রাও ইহাদেরি একটি সুবৃহৎ শাখা। এই হিসাবে ফন আইকস্টেডট কোল-মুণ্ডা নরগোষ্ঠীকে বর্তমান দ্রাবিড়ভাষী মেলানিড্ নরগোষ্ঠীর আত্মীয় বলিয়া মনে করিতেছেন; কোল-মুণ্ডা খাসিয়ারা যে আন পৃথক নরগোষ্ঠীর লোক তাহা বলিতেছেন না। তাহা ছাড়া, অন্যান্য নৃতাত্ত্বিকেরা বর্তমান দ্রাবিড়ভাষী লোকদের যে সব দেহলক্ষণসমূহের উপর নির্ভর করিয়া তাঁহাদের সঙ্গে ভারতবহির্ভূত মিশর-এশীয় বা ভূমধ্য নরগোষ্ঠীর আত্মীয়তার সন্ধান পাইতেছেন, মোটামুটি সেই দীর্ঘমুণ্ড উন্নতনাস নরগোষ্ঠীর লোকদেরই তিনি বলিতেছেন ভারতীয় ‘মেলানিড্‌’।

৩. ‘ইন্ডিড্‌’’ বা ভারতীয় নরগোষ্ঠী—ইহাদের প্রধানত তিন শাখা : ক. যথার্থ ‘ইন্ডিড্’; ইহারাই মোটামুটি যাহাদের আগে বলা হইয়াছে আদি-নর্ডিক; খ উত্তর ‘ইন্ডিড্’; অর্থাৎ মোটামুটিভাবে ফিশাল যাহাদের বলিয়াছেন প্রাচ্য বা ‘ওরিয়েন্টাল’; এবং গ. ‘ব্র্যাকিড’; ইহারা আর-একটি গালমুণ্ড নরগোষ্ঠী অর্থাৎ মোটামুটিভাবে আগে যাহাদের বলা হইয়াছে অ্যালপাইন বা আল্‌পো-দীনারীয়। এই ‘ব্র্যাকিড’দের আবার তিন উপধারা; অ. মহারাষ্ট্র দেশের ‘পশ্চিম ব্রাকিড্‌’; আ. বাঙলা ও উড়িষ্যার ‘পূর্ব ব্র্যাকিড’, এবং ই. গাঙ্গেয় উপত্যকার ‘দীর্ঘদেহ ব্র্যাকিড্‌’। যথার্থ ‘ইন্ডিড’দের বিস্তার বিনশন-প্রয়াগধৃত আর্যাবর্তে বা মধ্যদেশে, দক্ষিণ-ভারতের কেরল ভূমিতে এবং মিশ্রিতরূপে সিংহল দ্বীপেও।

ফন আইকস্টেডট আরও বলেন যে, দাক্ষিণাত্যের উত্তর-পশ্চিমাংশের কোনও কোনও অধিবাসীদের ভিতর আদি মোঙ্গোলীয় রক্তপ্রভাব সুস্পষ্ট, এবং তাহা বোধ হয় অপেক্ষাকৃত আধুনিক কোলভাষী লোকদের রক্তধারা দ্বারা স্পষ্ট। এই আদি-মোঙ্গোলীয় প্রভাব ভারতবর্ষের সর্বত্র সমভাবে বিস্তৃত নয়, তবে এখানে-ওখানে আকীর্ণ চিহ্ন পৃথক পৃথক ভাবে নানা স্থানে ধরা পড়ে। ইহা হইতে তিনি অনুমান করেন যে, ভারতবর্ষে এই মোঙ্গোলীয় প্রভাব খুব সুপ্রাচীন নয়।

দক্ষিণ-ভারতের অধিবাসীরা, তাঁহার মতে, নৃতত্ত্বের দিক হইতে অধিকতর সমন্বিত এবং সমন্বয়ের মূল ভিত হইতেছে সুবিস্তৃত আদিমতম নেগ্রিড রক্তপ্রবাহ। এই সমন্বিত নরগোষ্ঠীই ফন আইকস্টেডট-কথিত ‘মেলানিড্’ নরগোষ্ঠী এবং তাহাদেরই বংশধর বর্তমান মধ্যস্তরের তামিল। উচ্চ ও নিম্নস্তরে এই সমন্বয়ের সমগ্র ও সুস্পষ্ট রূপটি ধরা পড়ে না, কারণ উভয় স্তরেই অপেক্ষাকৃত সাম্প্রতিক বা প্রাচীনতর কালের অন্য নরগোষ্ঠীর রক্তস্পর্শ লাগিয়াছে; উচ্চস্তরে বোধহয় ‘ইন্ডিড’দের এবং নিম্নস্তরে ‘মালিড’দের। এই ‘মালিডা’রা পর্বতবাসী ভেড্ডিড নরগোষ্ঠীর সঙ্গে কমবেশি আত্মীয়তাসূত্রে আবদ্ধ। ইহাদের কাহারও মধ্যেই অপেক্ষাকৃত পরবর্তী কালের নিগ্রোবটু রক্তস্পর্শের চিহ্নমাত্র নাই, যদিও আদিমতম নিগ্রোবটু রক্তম্পর্শের কমবেশি প্রভাব সকলের মধ্যেই আছে, তবে সে প্রভাবও বহুদিন আগেই শুকাইয়া উবিয়া গিয়াছে।

সংখ্যায় ও বিস্তৃতিতে ভারতবর্ষে সর্বাপেক্ষ বলিষ্ঠ নরগোষ্ঠী হইতেছে ‘ইণ্ডিড্‌’রা। ফন আইকস্টেডটের মতে ইহারাই প্রাগৈতিহাসিক সিন্ধু সভ্যতার উত্তরাধিকারী এবং দ্রাবিড় ও বিশিষ্ট “ভারতীয়” আত্মিক সাধনার যথার্থ প্রতিনিধি। ‘ইণ্ডিড’ নরগোষ্ঠীর উত্তর-পশ্চিমাংশ বারবার মধ্য এশিয়ার নানা জন ও কোম দ্বারা আক্রান্ত ও পর্যুদস্ত হইয়াছে; আর্যভাষা কিন্তু তাহাতে কখনও শিথিলমূল হয় নাই, বরং তাহার প্রতাপ বরাবরই অম্লান ও অক্ষুন্ন ছিল। কিন্তু আর্যভাষীদের বাস্তব সভ্যতা ও মানস-সংস্কৃতি বারবার রূপান্তর ও সমন্বয় লাভ করিয়াছে। আর্যভাষাকে আশ্রয় করিয়া কিছু নর্ডিক রক্তপ্রবাহ, পরবর্তীকালে কিছু শক ও হুন রক্তপ্রবাহ এবং আরও পরবর্তীকালে মুসলমান অভিযান আশ্রয় করিয়া কিছু ওরিয়েন্টাল বা প্রাচ্য নরগোষ্ঠীর রক্তধারা ‘ইণ্ডিড্’ প্রবাহে সঞ্চারিত হইয়াছে। মূলে এই ‘ইণ্ডিড্’ নরগোষ্ঠী আদিমতম ভেড্ডীয় নরগোষ্ঠীর সঙ্গে সম্পৃক্ত। অতি প্রাচীনকাল হইতেই উত্তর হইতে ‘ইণ্ডিড্‌’দের দক্ষিণমুখী চাপে ক্রমশ ‘মেলানিড্’ নরবংশের সৃষ্টি এবং ভেড্ডিডদের চাপে ক্রমশ ‘মালিড’দের।

‘ইণ্ডিড্’ ও ‘মেলানিড’ নরগোষ্ঠী ও তাঁহাদের ভাষা সম্বন্ধে ফন আইকস্টেডটের উক্তি উদ্ধারযোগ্য। আমার মনে হয়, দ্রাবিড়ভাষীদের নরতত্ত্ব সম্বন্ধে একান্ত সাম্প্রতিক কালেও নরতাত্ত্বিকদের মধ্যে যে জিজ্ঞাসা বর্তমান তাহার একটা সন্তোষজনক মীমাংসা এই উক্তির মধ্যে পাওয়া যায়

The originally Dravidian Indids, whose descendants adopted the Aryan language, pushed over the Melanids, who in their turn adopted Dravidian idioms for which they are now the typical representatives. So, race and language do no more in India in anyway coincide. Races remained, but languages were shoven southward… The disturbing results of the idea of a Dravidian “race” are therefore easy to understand. The Dravida speakers of today are no more the same as four millenniums ago. At that time they were of Indid race, today they are prevailingly of Melanid race.

এই সুদীর্ঘ জাতিপ্রবাহের ইতিহাস আলোচনায় একটি তথ্য সুস্পষ্ট ধরা পড়ে। সেটি এই; নরতত্ত্বের দিক হইতে বাঙলার জনসমষ্টি মোটামুটি দীর্ঘমুণ্ড, প্রশস্তনাস আদি-অষ্ট্রেলীয় বা কোলিড়, দীৰ্ঘমুণ্ড, দীর্ঘ ও মধ্যোন্নতনাস মিশর-এশীয় বা ‘মেলানিড্’, এবং বিশেষভাবে গোলমুণ্ড, উন্নতনাস অ্যালপাইন বা ‘পূর্ব ব্র্যাকিড়, এই তিন জনের সমন্বয়ে গঠিত। নিগ্রোবটু রক্তেরও স্বল্প প্রভাব উপস্থিত, কিন্তু তাহা সমাজের খুব নিম্নস্তরে এবং সংকীর্ণ স্থানগণ্ডির মধ্যে আবদ্ধ। মোঙ্গোলীয় রক্তের কিছুটা প্রভাবও আছে, কিন্তু তাহাও উত্তর ও পূর্ব দিকে সংকীর্ণ স্থানগণ্ডির সীমা অতিক্রম করে নাই। আদি-নর্ডিক বা খাটি ‘ইণ্ডিড্’ রক্তপ্রবাহও অনস্বীকার্য, কিন্তু সে ধারা অত্যন্ত শীর্ণ ও ক্ষীণ। মোটামুটিভাবে ইহাই বাঙলাভাষাভাষী জন-সৌধের চেহারা, এবং এই জন-সৌধের উপরই বাঙালীর ইতিহাস গড়িয়া উঠিয়াছে। এই বিচিত্র সংকর জন লইয়াই বাঙলার ও বাঙালীর ইতিহাসের সূত্রপাত।

বাঙালীর অঙ্গপ্রত্যঙ্গ বৈশিষ্ট্যের বিশ্লেষণ এবং উত্তর-ভারতের বিভিন্ন বর্ণের এবং জনের উপরোক্ত নরতাত্ত্বিক বিবরণের তুলনামূলক আলোচনা হইতে বাঙালীর বিভিন্ন বর্ণ বা জাত সম্বন্ধে মোটামুটিভাবে এখন কতকগুলি ইঙ্গিত ধরিতে পারা যায়। খুব সংক্ষেপে প্রধান ও অপ্রধান কয়েকটি বর্ণ সম্বন্ধে সে ইঙ্গিত বিবৃত করিলেই সমগ্র চেহারাটি পরিষ্কার হইবে।

ব্রাহ্মণ-বৈদ্য-কায়স্থদের সম্বন্ধেই আগে বলা যাইতে পারে। বাঙলাদেশে ব্রাহ্মণরাই একমাত্র জাত যাহাদের সঙ্গে পঞ্জাবের ব্রাহ্মণদের এবং উত্তর-ভারতের অন্যান্য উচ্চবর্ণের সঙ্গে খানিকটা মিল আছে; কিন্তু তাহা অপেক্ষাও বাঙালী ব্রাহ্মণদের বেশি নরতাত্ত্বিক আত্মীয়তা দেখা যায় বাঙালী বৈদ্য ও কায়স্থদের সঙ্গে বস্তুত, বাঙালী ব্রাহ্মণ-বৈদ্য-কায়স্থ জনতত্ত্বের দিক হইতে একই গোষ্ঠীর লোক বলিলে কিছু অবৈজ্ঞানিক কথা বলা হয় না। জনতত্ত্বের দিক হইতে বলিতে পারা যায়, যে সব জাত (অর্থাৎ বৈদ্য-কায়স্থ, বৃহদ্ধর্মপুরাণের করণ ও অম্বষ্ঠ) দেহবৈশিষ্ট্যে ব্রাহ্মণদের যত সন্নিকটে, বাঙলাদেশে সেই সব জাত-এর সামাজিক কৌলীন্য তত বেশি। বাঙালী ব্রাহ্মণদের (এবং কায়স্থ-বৈদ্যদের) সঙ্গে পূর্ব-ভারতীয় আদিমতম অধিবাসীদের (যেমন, ছোটনাগপুর অঞ্চলের সাঁওতালদের, উত্তরাঞ্চলের গারো-খাসিয়াদের, নিম্নবঙ্গের রাজবংশী-বুনা ইত্যাদিদের), কিংবা নিম্নতম বর্ণ ও শ্রেণীর লোকদের (পোদ-বাগদী প্রভৃতি) রক্তসংমিশ্রণ বেশি ঘটিয়াছে, এমন প্রমাণ নাই। ঘটে যে নাই তাহার খানিকটা প্রমাণ পাওয়া যায় বঙ্গীয় স্মৃতিশাস্ত্রগুলিতে এবং ব্রাহ্মণ-বৈদ্য-কায়স্থদের, বিশেষভাবে ব্রাহ্মণদের, সামাজিক আচার-ব্যবহারে। নির্বিচার আন্তর্বিবাহ ও আন্তর্ভোজনে একটি আপত্তি বরাবরই তাঁহাদের ছিল, যদিও সেই আপত্তি সুপ্রাচীন কালে সর্বত্র সব সময় খুব কার্যকরী হয় নাই। আর এইসব আপত্তি ও সংস্কার তো খুবই ধীরে ধীরে গড়িয়া উঠিয়াছিল, একদিনেই তাহা কার্যকরী করা সম্ভব হয় নাই। সেই হেতুই ব্রাহ্মণদের সঙ্গে বৈদ্য-কায়স্থদের একটা জনতাত্ত্বিক আত্মীয়তা সহজেই লক্ষ করা যায়। বাঙলার অন্য কোনও বর্ণ বা জাত-এর সঙ্গে সেই আত্মীয়তার প্রমাণ নাই। আশ্চর্যের বিষয় সন্দেহ নাই, বাঙালী ব্রাহ্মণদের সঙ্গে গাঙ্গেয় ভারতের ব্রাহ্মণদের জনতাত্ত্বিক আত্মীয়তা বাঙালী ব্রাহ্মণ-বৈদ্য-কায়স্থদের জনতাত্ত্বিক আত্মীয়তা অপেক্ষা কম; বরং বাঙালী ব্রাহ্মণদের আত্মীয়তা মধ্যভারতীয় অব্রাহ্মণদের সঙ্গে বেশি। উচ্চতম বর্ণের বিহারীদের সঙ্গে বাঙলার উচ্চতম বর্ণের লোকদের কিছুটা আত্মীয়তা আছে। বাঙলা-বিহারের ভৌগোলিক নৈকটে এবং ঘনিষ্ঠ সাংস্কৃতিক আদান-প্রদানে সে মিল থাকা তো খুবই স্বাভাবিক; কিন্তু সে মিলও বাঙালী বৈদ্য-কায়স্থদের সঙ্গে মিলের চেয়ে অনেক কম। এইসব কারণে মনে হয়, বাঙালী ব্রাহ্মণ-বৈদ্য-কায়স্থ বর্ণের লোকেরা একটি বিশেষ ঐক্যবদ্ধ জনগোষ্ঠীর প্রতিনিধি, এবং জনতত্ত্বের দিক হইতে তাহারা একই গোষ্ঠীবদ্ধ। বৃহদ্ধর্মপুরাণোক্ত উত্তম সংকর বর্ণের অনেক বর্ণই এই জনগোষ্ঠীর সঙ্গে অল্পবিস্তর ঘনিষ্ঠ সম্পর্কে আবদ্ধ, এই অনুমানও বোধ হয় সঙ্গে সঙ্গে করা চলে। অন্তত, বাঙালী কায়স্থরা যে বাঙালী সদগোপ ও কৈবর্তদের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ আত্মীয়তাসূত্রে আবদ্ধ, ইহা তো নরতাত্ত্বিক পরিমিতি-গণনা হইতেই ধরা পড়ে; সদগোপদের সঙ্গে কায়স্থদের তো কোনই পার্থক্য নাই। প্রশান্তচন্দ্র মহলানবিশ তো বলেন, কায়স্থ, সদগোপ ও কৈবৰ্তরাই যথার্থই বঙ্গজন-প্রতিনিধি। বস্তুত, বাঙলাদেশের সমস্ত বর্ণের (বৃহদ্ধর্মপুরাণোক্ত উত্তম ও মধ্যম সংকর বর্ণের) সঙ্গে কায়স্থদের আত্মীয়তাই সবচেয়ে বেশি। বাঙলার বাহিরে এক বিহারে কিছুটা ছাড়া অন্যত্র কোনও বর্ণের সঙ্গেই ইহাদের বিশেষ কোনও মিল নাই, এবং এই তথ্য সদগোপ ও কৈবর্তদের সম্বন্ধেও সত্য কায়স্থ, সদগোপ ও কৈবর্তদের সঙ্গে (সদগোপ ও কৈবৰ্তরা ব্ৰহ্মবৈবর্তপুরাণ-কথিত সংশুদ্ৰ) সাঁওতাল, গারো, খাসিয়া বা বৃহদ্ধর্মপুরাণোক্ত অন্ত্যজ বর্ণের লোকদের কোনই রক্তসংমিশ্রণ ঘটে নাই, এ কথা নিঃসংশয়ে বলা যায়; তেমনই নিঃসংশয়ে বলা চলে যে, ছোটনাগপুর অঞ্চলের সাঁওতাল প্রভৃতিদের সঙ্গে বাঙলার পোদ্‌, বাগ্‌দী, বাওড়ী প্রভৃতি উপবর্ণের লোকদের সুপ্রচুর রক্তসংমিশ্রণ ঘটিয়াছে।

নমঃশূদ্রদের সম্বন্ধে নরতাত্ত্বিক পরিমিতি-গণনার ফলাফল একটু চাঞ্চল্যকর। এ তথ্য অন্যত্রও উল্লেখ করিয়াছি যে, দেহবৈশিষ্ট্যের দিক হইতে ইহারা উত্তর-ভারতের বর্ণব্রাহ্মণদের সমগোত্রীয়; বস্তুত, উত্তর-ভারতের বর্ণ-ব্রাহ্মণদের সঙ্গে বাঙালী ব্রাহ্মণ-বৈদ্য-কায়স্থদের চেয়েও বাঙালী নমঃশূদ্রদের আত্মীয়তা বেশি। অথচ এই নমঃশূদ্রেরা আজ সমাজের একেবারে নিম্নতম স্তরে! আমরা তাঁহাদের চণ্ডাল বা চাঁড়াল বলিয়া জানি, এবং বৃহদ্ধর্মপুরাণ রচনার কালেই ইহারা অন্ত্যজশ্রেণীভুক্ত। এই সামাজিক তথ্যের সঙ্গে নরতত্ত্বপ্রমাণগত তথ্যের যুক্তির ও ইতিহাস-সম্মত ব্যাখ্যার কোনও সম্বন্ধ এখনও কিছু খুঁজিয়া পাওয়া যায় নাই।

যাহাই ইউক উপরোক্ত সংক্ষিপ্ত বিবৃতি বাঙলার বিভিন্ন জেলার বিচিত্র বর্ণসমূহের ভিতর আপেক্ষিক সূক্ষ্ম ও স্থল পার্থক্য, একই বর্ণের মধ্যে দেহপরিমিতির ভেদবৈচিত্র্য ইত্যাদি খুঁটিনাটি বিচার করিলে বলিতেই হয়, এ সমস্তই বিচিত্র জন-সাংকর্যের দ্যোতক। জন-সাংকর্যের নরতত্ত্বগত বৈশিষ্ট্যের জৈব মিশ্রণের এমন চমৎকার দৃষ্টান্ত আর কী হইতে পারে। বস্তুত, স্মরণাতীত কাল হইতে এই ধরনের জন-সাংকর্যের দৃষ্টান্ত ভারতবর্ষের অন্যত্র খুব সুলভ নয়। এই মিশ্রণ এত গভীর ও ব্যাপক যে, নরতত্ত্বের দিক হইতে কোনও বিশিষ্ট বর্ণ, যত উচ্চ বা নিম্নই হউক না কেন, বা কোনও বিশিষ্ট স্থানে অধিবাসীদের একান্তভাবে স্বতন্ত্র করিয়া দেখিবার উপায় নাই।