৫. নিবেদন

প্রথম অধ্যায়। ইতিহাসের যুক্তি
পঞ্চম পরিচ্ছেদ । 
নিবেদন

আমি কোনও নূতন শিলালিপি বা তাম্রপট্টের সন্ধান পাই নাই, কোনও প্রাচীন গ্রন্থের খবর নূতন করিয়া জানি নাই, কোনও নূতন উপাদান আবিষ্কার করি নাই। যে-সমস্ত প্রাচীন গ্রন্থ বা লেখমালা সংকলিত ও সম্পাদিত হইয়াছে, অথবা সংকলন-সম্পাদনের অপেক্ষা করিতেছে নানা গ্রন্থাগার ও চিত্রশালায়, যে-সমস্ত তথ্য ও উপাদান পণ্ডিতমহলে অল্পবিস্তর পরিচিত ও আলোচিত, প্রায় তাহা হইতেই আমি সমস্ত তথ্য ও উপকরণ আহরণ করিয়াছি। কাজেই পূর্ববর্তী প্রত্নতাত্ত্বিক ও ঐতিহাসিক গবেষকদের সকলের কাছেই আমি ঋণী, বিশেষভাবে ঋণী এই অধ্যায়ের প্রথমেই যে সব মনীষীদের নামোল্লেখ করিয়াছি তাঁহাদের কাছে। এই ঋণ সগৌরবে ঘোষণা করিতে এতটুকু দ্বিধা আমার নাই। ইঁহারা যে কোনও দেশের গৌরব, এবং ইঁহাদেরই অকুণ্ঠ অবারিত দানের ঘোষণা এই গ্রন্থের পত্রে পত্রে ছত্ৰে ছত্রে। এই সমস্ত পূর্বাবিষ্কৃত উপাদান ও পূর্বসূরিদের রচনা আমার সম্মুখে বর্তমান না থাকিলে এই প্রয়াস অসম্ভব হইত। আমি শুধু প্রাচীন বাঙলার ও প্রাচীন বাঙালীর ইতিহাস একটি নূতন কার্যকারণসম্বন্ধগত যুক্তিপরম্পরায় একটি নূতন দৃষ্টিভঙ্গির ভিতর দিয়া বাঙালী পাঠকের কাছে উপস্থিত করিতেছি মাত্র। এই যুক্তিপারম্পর্য ও দৃষ্টিভঙ্গি সমাজবিজ্ঞানসম্মত ঐতিহাসিক যুক্তি ও দৃষ্টি বলিয়া আধুনিক ঐতিহাসিকরা বিশ্বাস করেন, আমিও করি। আমার বিশ্বাস, এই যুক্তি ও দৃষ্টি অনুসরণ করিলে প্রাচীন বাঙালীর ইতিহাসের যে সামগ্রিক গলতোভদ্র রূপ দৃষ্টিগোচর হয়, তাহা অন্য উপায়ে সম্ভব নয়।

তাহা ছাড়া, এই যুক্তি ও দৃষ্টিভঙ্গি লইয়া আমি প্রাচীন বাঙলা ও বাঙালীর সম্পূর্ণ ইতিহাস রচনার প্রয়াসও করিতেছি না। সে সময় হয়তো এখনও আসে নাই। নূতন নূতন উপাদান প্রায়শ আবিষ্কৃত হইতেছে। বর্তমানে উপাদান সুপ্রচুর নয়, উপাদনলব্ধ সংবাদও অল্পতর। আমি শুধু কাঠামো রচনার প্রয়াস করিয়াছি, ভবিষ্যৎ বাঙালী ঐতিহাসিকরা ইহাতে রক্তমাংস যোজনা করবেন, এই আশা ও বিশ্বাসে। আরও একটু আশা এই যে, এই যুক্তি ও দৃষ্টিভঙ্গি লইয়া বর্তমান সমাজ-বিজ্ঞানসম্মত উপায়ে তাঁহারা বাঙলার মধ্য ও উত্তর-পর্বের ইতিহাসও রচনা করিয়া তুলিবেন। সুযোগ ও অবসর ঘটিলে নিজের উপরও সে কর্তব্য পালনের দায়িত্ব রহিল, তাহা অস্বীকার করিতেছি না।

আমার কোনও কথাই শেষ কথা নয়। সত্যসন্ধী ঐতিহাসিকের কাছে শেষ কথা কিছু নাই; তাঁহার সব কথাই experiments with truth মাত্র। এই কাঠামো রচনার প্রয়াস সত্যে পৌঁছিবার নিম্নতম স্তর : এই স্তর যদি ভবিষ্যৎ ঐতিহাসিককে সত্যে পৌঁছিতে কিছুমাত্র সহায়তা করে, তবেই  আমার দেশের এবং আমার জাতির এই ইতিহাস-রচনা সার্থক বলিয়া মনে করিব |