৪. এই গ্রন্থের যুক্তিপর্যায়

প্রথম অধ্যায়। ইতিহাসের যুক্তি
চতুর্থ পরিচ্ছেদ । 
এই গ্রন্থের যুক্তিপর্যায়

দ্বিতীয় অধ্যায় : বাঙালীর ইতিহাসের গোড়ার কথা

সমাজবিন্যাসের ইতিহাস বলিতে হইলে প্রথমেই বলিতে হয় নরতত্ত্ব ও জনতত্ত্বের কথা এবং তাহারই সঙ্গে অঙ্গাঙ্গিজড়িত ভাষাতত্ত্বের কথা। সেইজন্য বাঙালীর ইতিহাসের গোড়ার কথা বাঙালীর নরতত্ত্বের কথা, বিভিন্ন নরগোষ্ঠীর ভাষার কথা, বাঙালীর জন, ভাষা, সভ্যতা ও সংস্কৃতির অস্পষ্ট উষাকালের কথা। বাঙালীর আর্যত্ব কতখানি? পণ্ডিতেরা আর্যভাষাভাষী নরগোষ্ঠীর যে একাধিক তরঙ্গের কথা বলেন, যদি তাহা সত্য হয়, তাহা হইলে সেই আর্যত্ন কি ঋগ্বেদীয় আর্যভাষীদের না পামীর মালভূমি ও তবলামাকান মরুভূমি হইতে আগত আলপাইন আর্যভাষীদের নর্ডিক না প্রাচ্য আর্যভাষীদের, না আর কাহারও? আর্যপূর্ব জনদের কাহারা বাঙলাদেশের অধিবাসী ছিলেন; এই আর্যপূর্ব বাঙালীদের মধ্যে নেগ্রিটো, অস্ট্রিক, বা ভূমধ্যীয় নরগোষ্ঠীর আভাস কতটুকু দেখা যায়, কোথায় কোথায় দেখা যায়? মোঙ্গোলীয় ও ভোট-চীন নরগোষ্ঠীর কিছু আভাস বাঙালীর রক্তে, বাঙালীর দেহগঠনে আছে কি? থাকিলে কতটুকু এবং বাঙলার কোন কোন জায়গায়? আর্য ও আর্যপূর্ব জাতিদের রক্ত ও দেহগঠন বাঙালীর রক্ত ও দেহগঠনে কতটুকু, কী পরিমাণে সহায়তা করিয়াছে? ঐতিহাসিক কালে ভারতবর্ষের বাহিরের ও ভিতরের অন্যান্য প্রদেশের কোন কোন নরগোষ্ঠীর লোক বাঙলাদেশে আসিয়াছে এবং বাঙালীর রক্ত ও দেহগঠন কতখানি রূপান্তরিত করিয়াছে? বাঙলাদেশে যে বর্ণবিভাগ দেখা যায় তাহার সঙ্গে নরতত্ত্বের সম্বন্ধ কতটুকু?

ব্রাহ্মণ, বৈদ্য, কায়স্থ ইত্যাদি বর্ণের লোকেরা কোন নরগোষ্ঠী? সমাজে জলচল ক্ষুদ্রবর্ণের লোকেরা কোন নরগোষ্ঠী? জল-অচল নিম্ন বা অন্ত্যজ পর্যায়ের যে অসংখ্য লোক তাহারাই বা কোন নরগোষ্ঠী? রজক, নাপিত, কর্মকার, সূত্রধর ইত্যাদিরাই বা কে? সব প্রশ্নের উত্তর বাঙলার নরতত্ত্ব-গবেষণার বর্তমান অবস্থায় পাওয়া যাইবে না; তবু, যতটুকু নির্ধারিত হইয়াছে তাহারই বলে মোটামুটি একটা কাঠামো গড়িয়া তোলা যাইতে পারে। বাঙালীর জন-গঠনের এই গোড়াকার কথাটা না জানিলে প্রাচীন বাঙলার শ্রেণী ও বর্ণ বিভাগ, রাষ্ট্রের স্বরূপ, এক কথায় সমাজের সম্পূর্ণ চেহারাটা ধরা পড়িবে না।

তৃতীয় অধ্যায় : দেশ-পরিচয়

বাঙালীর ইতিহাসের দ্বিতীয় কথা, বাঙলার দেশ-পরিচয়। বাঙলাদেশের নদ-নদী পাহাড়প্রান্তর বনজনপদ আশ্রয় করিয়া ঐতিহাসিক কালের পূর্বেই যে সমস্ত বিভিন্ন কোম একসঙ্গে দানা বাধিয়া উঠিতেছিল তাহদের বন্ধনসূত্র ছিল পূর্বভারতের ভাগীরথী-করতোয়া লৌহিত্য-বিধৌত বিন্ধ্য-হিমালয়-বাহুবিধৃত ভূভাগ। এই সুবিস্তীর্ণ ভূভাগের জল ও বায়ু এই দেশের অধিবাসীদিগকে গড়িয়াছে; ইহার ভূমির উর্বরতা কৃষিকে ধনোৎপাদনের অন্যতম প্রধান উপায় করিয়া রচনা করিয়াছে; ইহার অসংখ্য মৎস্যবহুল নদনদী, তাহাদের শাখা ও উপনদীগুলি অন্তর্বাণিজ্যের সাহায্য করিয়া ধনোৎপাদনের আর একটি উপায় সহজ ও সুগম করিয়াছে। ইহার সমুদ্রোপকূল শুধু যে বহির্বাণিজ্যের সাহায্য করিয়াছে, তাহাই নয়, দেশের কোনও কোনও উৎপন্ন দ্রব্যের স্বরূপও নির্ণয় করিয়াছে। তাহা ছাড়া, এই দেশের প্রাচীন যে রাষ্ট্র ও জনপদ-বিভাগ তাহাও কিছুটা নিণীত হইয়াছে বাঙলার নদ-নদীগুলির দ্বারা। বাঙলার এই নদ-নদীগুলি, এই বন ও প্রান্তর, ইহার জলবায়ুর উষ্ণ জলীয়তা, ইহার ঋতু-পর্যায়, ইহার বিধৌত নিম্নভূমিগুলি, বনময় সমুদ্রোপকূল সমস্তই এই দেশের সমাজবিন্যাসকে কমবেশি প্রভাবান্বিত করিয়াছে। কাজেই বাঙলাদেশের সত্য ভৌগোলিক পরিচয়ও বাঙালীর ইতিহাসেরই কথা।

চতুর্থ অধ্যায় : ধনসম্বল

জাতি এবং দেশ হইতেছে সমাজ-রচনার ঐতিহ্য ও পরিবেশ। কিন্তু পূর্বেই বলিয়াছি, সমাজ-সৌধের বস্তুভিত্তি হইতেছে ধন। কাজেই প্রাচীন বাঙলার ধনসম্বল কী ছিল, ধনোৎপাদনের কী কী উপায় ছিল, কী কী ছিল উৎপন্ন বস্তু, কৃষি-শিল্প-বাণিজ্য ইত্যাদি কিরূপ ছিল এইসব তথ্য বাঙালীর ইতিহাসের তৃতীয় কথা। এই তিন কথা লইয়া বাঙালীর ইতিহাসের বস্তুভিত্তি এবং এই ভিত্তির উপরই গড়িয়া উঠিয়াছিল প্রাচীন বাঙালীর সমাজবিন্যাস।

পঞ্চম অধ্যায়; ভূমিবিন্যাস

এইমাত্র বলিলাম, প্রাচীন বাঙলায় কৃষি ছিল ধনোৎপাদনের অন্যতম প্রথম ও প্রধান উপায়। কৃষির সঙ্গে দেশের ভূমিব্যবস্থা জড়িত। এই ভূমিব্যবস্থার উপরই দেশের অগণিত জনসাধারণের মরণ বাচন নির্ভর করিত, এখনও যেমন করে। ভূমি কয় প্রকার ছিল, ভূমির উপর রাজার অধিকারের স্বরূপ কী ছিল, প্রজার অধিকারই বা কতটুকু ছিল, ভূমির মূলগ্রাহী কে ছিলেন, ভূমিদানের প্রেরণা কী ছিল, ভূমির সীমানা নির্দেশের ৬ায়ক ছিল। রাজস্ব কিরূপ ছিল, প্রজার দায়িত্ব কী ছিল, খাসপ্রজা, নিম্নপ্রজা, ভূমিহীন প্রজা ইত্যাদি ছিল কিনা, এক কথায় ভূমিব্যবস্থার কথা বাঙালীর ইতিহাসের পঞ্চম এবং সমাজবিন্যাসের প্রথম কথা। –

ষষ্ঠ অধ্যায় : বর্ণবিন্যাস

খাচীন ও বর্তমান বাঙলার সমাজবিন্যাসের দিকে তাকাইলে যে জিনিস সর্বপ্রথম দৃষ্টিগোচর হয় তাহা বর্ণ-উপবর্ণের নানা স্তর-উপস্তরে বিভক্ত সুনির্দিষ্ট সীমায় সীমিত বাঙালীর বর্ণসমাজ। পাওলাদেশে ক্ষত্রিয় ও বৈশ্য নাই, প্রাচীনকালেও ছিল বলিয়া মনে করিবার যথেষ্ট প্রমাণ নাই; আল্পসংখ্যক থাকিলেও তাহদের কোনও প্রাধান্য ছিল বলিয়া মনে হয় না। ইহার কারণ কী? বাহ্মণদের প্রাধান্য বাঙলাদেশে কিভাবে কখন প্রতিষ্ঠিত হইল ঃ বৈদ্য-কায়স্থ বৃত্তিধারী লোকেরাই লা কী করিয়া কখন বর্ণশুদ্ধ হইলেন? এবং ব্রাহ্মণদের পরেই তাহদের স্থান নিণীত হইল কিরূপে? অন্যান্য সংকর পর্যায়ের বিচিত্র জাতের এবং ম্লেচ্ছ পতিত-অন্ত্যজ পর্যায়ের যে সব লোকদের কথা প্রাচীন লেখমালায় ও সাহিত্যগ্রন্থাদিতে পাওয়া যায় তাহাদের পরস্পরের মধ্যে সম্বন্ধ কিরূপ, প্রত্যেকের স্বরূপ কী, বৃত্তি কী, দায় কী, অধিকার কী ছিল? বর্ণের সঙ্গে শ্রেণীর সম্বন্ধ কিরূপ ছিল, রাষ্ট্রে বিভিন্ন বর্ণের স্থান কিরূপ ছিল, রাজবংশের এবং রাষ্ট্রের সঙ্গে লণবিন্যাসের সম্বন্ধ কী ছিল ইত্যাদি সকল কথাই বাঙালীর ইতিহাসের কথা। এই কথা লইয়া বাঙালীর ইতিহাসে ষষ্ঠ অধ্যায়।

সপ্তম অধ্যায় : শ্রেণীবিন্যাস

আগে যে বাঙলার জনসাধারণের কথা বলিয়াছি তাহারা সকলেই তো কিছু কৃষক বা ক্ষেত্রকর ছিলেন না। এখনকার মতো তখনও বৃহৎ একটা চাকুরিজীবী সম্প্রদায়ও ছিল। ইঁহাদের অধিকাংশই ছিলেন রাজকর্মচারী। তাহা ছাড়া, ছোট ছোট মানপ বা দোকানদার হইতে আরম্ভ করিয়া বড় বড় বণিক, শ্রেষ্ঠী, সার্থবাহ, ব্যাপার ইত্যাদির সংখ্যাও কম ছিল না। কৃষক বা ক্ষেত্রকররা তো ছিলেনই। তাহা ছাড়া, অধ্যাপনা, দেবপূজা, পৌরোহিত্য, নীতিপাঠ, ধর্ম ও সংস্কৃতি চর্চা প্রভৃতি নানা বৃত্তি লইয়া ব্রাহ্মণ ও অন্যান্য বর্ণেরও স্বল্পসংখ্যক বুদ্ধিজীবী ব্যক্তি ছিলেন। সকলের শেষে সমাজের নিম্নতম বর্ণস্তর শ্রেণীতে চণ্ডাল পর্যন্ত অন্যান্য অকীর্তিত লোকও ছিলেন অগণিত। প্রাচীন বাঙালী সমাজ এইসব নানা শ্রেণীতে বিন্যস্ত ছিল। এইসব বিভিন্ন শ্রেণীর বৃত্তি, তাহদের পরস্পর সম্বন্ধ, তাহদের দায় ও অধিকার ইত্যাদি সম্বন্ধে যে স্বল্প কথা জানা যায় তাহা লইয়া বাঙালীর ইতিহাসের সপ্তম অধ্যায়।

অষ্টম অধ্যায় : গ্রাম ও নগরবিন্যাস

বিভিন্ন বর্ণ ও শ্রেণীর অগণিত জনসাধারণ বাস করিতেন হয় গ্রামে না হয় নগরে ৷ এখনকার মতো তখনও বোধ হয় বর্তমান কালাপেক্ষাও অধিকসংখ্যক লোক গ্রামেই বাস করিতেন। জনসাধারণ বলিতে তখন প্রধানত এই অগণিত গ্রামবাসীদেরই বুঝাইত, এমন মনে করা অযৌক্তিক নয়। এক-একটা গ্রাম কী করিয়া গড়িয়া উঠিত তাহার দুই-একটি প্রমাণ পাওয়া যায়। গামের সংস্থান কিরূপ ছিল, নগরের সংস্থান কিরূপ ছিল? ইঁহাদের বিশেষ বিশেষ রূপ কী ছিল? গ্রাম ও নগর এই দুয়ের সভ্যতার পার্থক্য কিরূপ ছিল? ধর্ম ও শিক্ষা-কেন্দ্র বাণিজ্যকেন্দ্রগুলির চেহারা কিরূপ ছিল? সমস্ত প্রশ্নের উত্তর হয়তো মিলিবে না; তবু যতটুকু জানা যায় ততটুকু জানাই প্রাচীন বাঙলাদেশ ও বাঙালীকে জানা। এই জানার চেষ্টায় বাঙালীর ইতিহাসের অষ্টম

নবম অধ্যায় : রাষ্ট্রবিন্যাস

এই যে বিভিন্ন শ্রেণী ও বর্ণের বিচিত্র জনসাধারণ, ইঁহাদের দৈনন্দিন জীবনের যে বিচিত্র কর্ম, বিচিত্র দায় ও অধিকার, তাহা ইহারা নির্বিবাদে পরস্পরের স্বার্থের সংঘাত বাঁচাইয়া নির্বাহ করিতেন কী করিয়া? ক্ষেত্রকর যে হলচালনা করিতে গিয়া নিজের জমির সীমা ডিঙাইয়া প্রতিবেশীর জমি লোভ করবেন না, তাহা দেখিবে কে যে বণিক পুণ্ড অথবা চম্পাপুরী-পাটলিপুত্র হইতে গোরুর গাড়ির লহরে অথবা নদীপথে সপ্তডিঙ্গায় পণ্য সাজাইয়া চলিয়াছেন তাম্রলিপ্তি, পথে দসু তাঁহাকে হত্যা করিয়া পণ্য লুটিয়া লইবে না, এই আশ্বাস তাহাকে দিবে কে? প্রত্যেকে স্বধর্মে ও স্বাধিকারে প্রতিষ্ঠিত থাকিয়া আপন আপন রুচি ও কর্তব্যানুযায়ী জীবন যাপন করিয়া যাইতে পারবেন, এই আশ্বাস সমাজ দিতে না পারিলে সমাজবিন্যাস সম্ভব হইতে পারে না। এই আশ্বাস দিবার, প্রত্যেককে স্বধর্মে ও স্বাধিকারে প্রতিষ্ঠিত রাখিবার যন্ত্রও হইতেছে রাষ্ট্র। ভিতর ও বাহিরের হাত হইতে দেশ ও রাজ্যকে রক্ষা করিবার যন্ত্রও এই রাষ্ট্র। সমাজ নিজের প্রয়োজনেই এই রাষ্ট্রযন্ত্র সৃষ্টি করে এবং রাষ্ট্রযন্ত্রের প্রধান পরিচালককে রাজা বা প্রধান বা নায়ক বলিয়া স্বীকার করে, তাহার ও র্তাহার রাজপুরুষদের এবং রাষ্ট্রযন্ত্রের নিয়ম-নির্দেশ মানিয়া চলে, রাষ্ট্রযন্ত্র পরিচালনার ব্যয়ভার নির্বাহ করে, রাজাকে শ্রদ্ধাদান করে, এবং তাহার ও রাষ্ট্রযন্ত্রের সর্বপ্রকার বাধ্যতা স্বীকার করে। ইহাই মহাভারতের শান্তিপর্ব বর্ণিত রাজধর্ম, অষ্টাদশ শতাব্দীর যুরোপের সামাজিক শর্তের মূল সূত্র। প্রাচীন বাঙলায় এই রাজা ও রাষ্ট্রযন্ত্রের স্বরূপ কী ছিল? রাষ্ট্রপ্রধান কাহারা ছিলেন, রাষ্ট্রযন্ত্র পরিচালনা কাহারা করিতেন। রাষ্ট্রের আয়ব্যয় কী ছিল? রাজস্ব কী কী ছিল, কিরূপ ছিল। রাষ্ট্রের সঙ্গে বর্ণ ও শ্রেণীর সম্বন্ধ কী ছিল, গ্রাম ও নগরগুলির সম্বন্ধ কী ছিল, ধনোৎপাদনে ও বন্টনে রাষ্ট্রের আধিপত্য কতটুকু ছিল? রাষ্ট্রের আদর্শ বিভিন্ন কালে কিরূপ ছিল? রাষ্ট্রের সঙ্গে সামাজিক সংস্কৃতির যোগ কিরূপ ছিল? এইসব বিচিত্র প্রশ্নের যথালভ্য উত্তর লইয়া বাঙালীর ইতিহাসের নবম অধ্যায়।

দশম অধ্যায় : রাজবৃত্ত

ধনসম্বল, ভূমিবিন্যাস, বর্ণবিন্যাস, শ্রেণীবিন্যাস, গ্রাম ও নগর-বিন্যাস, রাষ্ট্রবিন্যাস প্রভৃতি সবকিছুর সঙ্গে দেশের ইতিবৃত্তকথা, অর্থাৎ বিভিন্ন পৰ্ব-বিভাগের কথা, রাষ্ট্ৰীয় উত্থান-পতনের কথা, রাজা ও রাজবংশের পরিচয, রাষ্ট্ৰীয় আদর্শের পরিণতি, বিগ্রহ ও বিপ্লব, শান্তি ও সংগ্রাম প্রভৃতির বিবরণ ওতপ্রোতভাবে জড়িত। সমাজবিন্যাস ও রাষ্ট্রীয় ইতিবৃত্ত একে অন্যকে প্রভাবান্বিত করে, এবং দুইয়ে মিলিয়া ইতিহাসচক্রকে আরর্তিত করে। সেইজন্যই সমাজবিন্যাসের প্রেক্ষাপট হিসাবে এবং অন্যতম প্রধান প্রভাবক হিসাবে রাজবৃত্ত কথা অবশ্য জ্ঞাতব্য– রাজা এবং রাজবংশের স্থল ও বিস্তৃত বিবরণ হিসাবে নয়, সমাজের সঙ্গে ইঁহাদের এবং বিভিন্ন রাজপর্ব ও রাষ্ট্রাদর্শের সম্বন্ধের দিক হইতে। সেইজন্যই রাজবৃত্তকথা লইয়া এই ইতিহাসের অন্যতম সুদীর্ঘ অধ্যায়।

সর্বশেষে আসিতেছে প্রাচীন বাঙালীর মানস-সংস্কৃতির কথা। সংস্কৃতির প্রয়োজন কী? মানুষ তো শুধু খাইয়া পরিয়া দেহগত জীবনধারণ করিয়া বাচিয়া থাকে না। তাহার একটা মানসগত জীবনও আছে। এই মানসগত জীবন সকল মানুষের সমান নয়। যে শ্রেণী অথবা সমাজের সামাজিক ধনসম্বল যত বেশি সেই শ্রেণী ও সমাজের মানসজীবন তত উন্নত। এই মানসজীবনের প্রকাশই সংস্কৃতি। এই সংস্কৃতি সকল শ্রেণী ও বর্ণের লোকদের এক নয়, এক হইতে পারে না। সংস্কৃতির মূলে আছে কায়িক শ্রম হইতে অবসর; যে শ্রেণী ও বর্ণের সামাজিক ধনসঞ্চয় বা উদকৃত্ত ধন বেশি তাহারাই সেই ধনের বলে এই শ্রেণী ও বর্ণের এবং অন্য শ্রেণী ও অন্য বর্ণের কতকগুলি লোককে ধনোৎপাদনগত কায়িক শ্রম হইতে মুক্তি দিয়া অবসরের সুযোগ দিতে পারে। সেই সুযোগে তাহারা চিন্তা, অধ্যয়ন, শিল্পচর্চা ইত্যাদি করিতে পারেন, এবং তাহারা তাহাদের শ্রেণীগত, নিজস্ব ও বৃহত্তর সমাজগত মানসের চিন্তা, কল্পনা, ভাব ও অনুভাবকে রূপদান করিতে পারেন। প্রাচীন বাঙলায়ও তাঁহাই হইয়াছিল; ইহাই প্রাকৃতিক নিয়ম। যাহাই হউক, প্রাচীন বাঙলায় সংস্কৃতির রূপ আমরা দেখিতে পাই ধর্মকর্মের ক্ষেত্রে, শিল্পকলায় ও নৃত্যগীতে, জ্ঞানবিজ্ঞানে, ব্যবহারিক অনুশাসন সামাজিক অনুশাসন ইত্যাদিতে। এই সংস্কৃতির অর্ধেক পুরাতন ঐতিহ্যজাত; এই ঐতিহ্যের মধ্যে থাকে জনগত, বর্ণগত রক্তের স্মৃতি, পূর্বপুরুষদের সংস্কৃতির স্মৃতি; বাকি অর্ধেক সমসাময়িক সমাজবিন্যাসের প্রয়োজনে গড়িয়া উঠে। কাজেই অতীতের স্মৃতি ও বর্তমানের প্রয়োজন, এই দুই বস্তুই বিশেষ দেশ ও বিশেষ কালের সংস্কৃতির মধ্যে জড়াজড়ি করিয়া মিশাইয়া থাকে। প্রাচীন বাঙলায় এই সংস্কৃতির স্বরূপটি কী, সত্যকার চেহারাটা কী তাহা জানিবার প্রয়াস লইয়াই আমার বাঙালীর ইতিহাসের শেষ কয়েকটি অধ্যায়। সুস্পষ্ট স্বরূপ হয়তো জানা যাইবে না, জানিবার যথেষ্ট উপাদানও এ যাবৎ আবিষ্কৃত হয় নাই; তবু চেষ্টা করিতে দোষ নাই, মোটামুটি আভাস একটু পাওয়া যাইবে তো! তাহা ছাড়া, মানস-সংস্কৃতি প্রকাশ পায় নরনারীর দৈনন্দিন জীবনচর্যার ভিতর দিয়া, তাহদের আহার-বিহারে, বসন-বাসনে, আচার-ব্যবহারে। জনসাধারণের জীবনেতিহাস জানিতে হইলে এ সমস্ত বিষয়েরও আলোচনা অপরিহার্য।

একাদশ অধ্যায় : আহার-বিহার, বসন-বাসন, আচার-ব্যবহার, দৈনন্দিন জীবন

জনসাধারণের মানস-সংস্কৃতির পরিচয় শুধু ধর্মকর্ম, শিল্পকলা, সাহিত্য-বিজ্ঞানের মধ্যেই আবদ্ধ হইয়া থাকে না। শিথিলভাবে বলিতে গেলে, ইহারা মানস-সংস্কৃতির পোশাকী দিক : কিন্তু সংস্কৃতির আর-একটা আটপৌরে দিক আছে, এবং সেই দিকটাতেই জনসাধারণের জীবনচর্যার ঘনিষ্ঠতম পরিচয়। আহার-বিহার, বসন-বাসন, আমোদ-আহ্লাদ, দৈনন্দিন জীবনের সুখদুঃখ, উৎসব-আচার-ব্যবহার প্রভৃতির মধ্যে এই পরিচয় যেমন পাওয়া যায় এমন আর কোথাও নয়। দৈনন্দিন জীবনের আটপৌরে দিকটা লইয়া জনসাধারণের জীবনেতিহাসের অন্যতম প্রধান, অপরিহার্য এবং অবশ্য জ্ঞাতব্য একাদশ অধ্যায়।

দ্বাদশ অধ্যায় : ধর্মকর্ম

প্রাচীন বাঙালীর মানস-সংস্কৃতির প্রথম ও প্রধান পরিচয় তাহদের ধর্মকর্মে। বিচিত্র ধর্মসংস্কার, বিশ্বাস, পূজা, আচার-অনুষ্ঠান, বারো মাসে তেরো পার্বণ, অসংখ্য দেবদেবী ও অন্যান্য প্রতীক লইয়াই প্রাচীন বাঙালীর জীবন; তাহার দৈনন্দিন জীবনও এইসব লইয়াই একই সঙ্গে মধুর ও দায়িত্বময়। তাহার প্রাগৈতিহাসিক কৌম বিশ্বাস, সংস্কার, পূজা, আচার, অনুষ্ঠান ইত্যাদির উপর উত্তরকালে ক্রমে ক্রমে জৈন, বৌদ্ধ, ব্রাহ্মণ্য প্রভৃতি আর্যধর্মের নানাপ্রকার তান্ত্রিক আচার, পদ্ধতি ও অনুষ্ঠান ইত্যাদির প্রভাব পড়িয়া যে ধর্মবিশ্বাস কর্মানুষ্ঠান প্রভৃতি বিবর্তিত হইয়াছে, তাহার সঙ্গে উত্তর বা দক্ষিণ ভারতের অন্যান্য প্রদেশের বিশ্বাস ও অনুষ্ঠানের পার্থক্য প্রচুর। সমাজবিন্যাসের উপরও এইসব বিশ্বাস-অনুষ্ঠানের প্রভাব কম পড়ে নাই। বিশেষ বিশেষ বর্ণ ও  শ্রেণীতে বিশেষ বিশেষ দেবদেবীর, বিশেষ বিশেষ অনুষ্ঠান ও বিশ্বাসের প্রচারের মধ্যেও সমসাময়িক সমাজবিন্যাসের পরিচয় সুস্পষ্ট। ধর্মকর্মের বিবর্তন-ইতিহাসের ভিতর দিয়াও গইন জনসাধারণের জীবনের এবং সমাজবিন্যাসের ইতিহাস উজ্জ্বলতর হয়। সেইজন্য ধর্মকর্মের কথা লইয়া প্রাচীন বাঙালীর ইতিহাসের দ্বাদশ অধ্যায়।

ত্রয়োদশ অধ্যায় : শিক্ষাদীক্ষা-জ্ঞানবিজ্ঞান-সাহিত্য

ধর্মকর্ম শিল্পকলার মতো সমাজমানসের অভিব্যক্তি দেখা যায় সমসাময়িক সাহিত্যে, জ্ঞানবিজ্ঞান ও শিক্ষাদীক্ষায়। প্রাচীন বাঙলায় ইহাদেরও প্রধান আশ্রয় ধর্মকর্ম, ধর্মবিশ্বাস, সমাজ-সংস্কার ইত্যাদি। এইসব সমস্তই মানসোৎকর্ষের বা অপকর্যের, এক কথায় সংস্কৃতির লক্ষণ সন্দেহ নাই। ইহাদের কতক অংশ গড়িয়া উঠিয়ছিল দৈনন্দিন জীবনচর্যার এবং বৃহত্তম সমাজচর্যার বা অন্য ব্যবহারিক প্রয়োজনে, কতক একান্তই সৃষ্টির প্রেরণায়, বুদ্ধিগত, ভাবকল্পনাগত, চিস্তাগত, অভিজ্ঞতাগত মানসের আত্মপ্রকাশের যে স্বাভাবিক বৃত্তি তাহারই প্রেরণায়। এই আত্মপ্রকাশের রূপ ও রীতি বহুলাংশে সমাজবিন্যাস দ্বারা নিয়মিত হইয়া থাকে। আবার, সমাজবিন্যাসও ইঁহাদের দ্বারা প্রভাবান্বিত হয়। এই উভয়ের ঘাতপ্রতিঘাতেই যে শিক্ষা-দীক্ষা, সাহিত্য, জ্ঞান-বিজ্ঞান প্রভৃতি যুগে যুগে বিবর্তিত হইতে থাকে, এ তত্ত্ব বর্তমান সমাজতত্ত্বাদর্শে ও আলোচনায় স্বীকৃত। সেইজন্যই প্রাচীন বাঙলার ইতিহাসে ধর্মকর্ম-শিল্পকলার মতো শিক্ষাদীক্ষা-সাহিত্য-বিজ্ঞানের আলোচনাও সমসাময়িক সমাজবিন্যাস ও সমাজমানসের পরিচয় হিসাবেই বেশি, বিশুদ্ধ সাহিত্য বা বিজ্ঞান-মূল্যের দিক হইতে ততটা নয়। এই শিক্ষাদীক্ষা-জ্ঞানবিজ্ঞান-সাহিত্য লইয়া বাঙালীর ইতিহাসের ত্রয়োদশ অধ্যায়।

চতুর্দশ অধ্যায় :  শিল্পকলা

এই ধর্মকর্মের সঙ্গে অঙ্গাঙ্গি জড়িত প্রাচীন বাঙলার শিল্পকলা, নৃত্যগীত ইত্যাদি। শিল্পই হউক আর নৃত্যগীতই হউক, ইঁহাদের প্রথম ও প্রধান আশ্রয় ছিল ধর্মকর্ম, ধর্মকর্মানুষ্ঠান উপলক্ষেই নৃত্যগীতের প্রচলন হইয়াছিল বেশি; মূর্তি ও মন্দির ইত্যাদি তো একান্তভাবেই ধর্মাশ্রয়ী। রাজপ্রাসাদ অভিজাত বংশীয়দের বাসগুহ ইত্যাদি ইট-কাঠ নির্মিত হইত সন্দেহ নাই; চিত্রে, মূর্তিতে গৃহ সজ্জিত হইত; কিন্তু কাল, প্রকৃতি ও মানুষের ধ্বংসলীলার হাত এড়াইয়া আজ আর তাহাদের চিহ্ন বর্তমান নাই; যে দুই-চারিটি চিহ্ন বহু আয়াসে আবিষ্কৃত হইয়াছে তাহা প্রায় সমস্তই ধর্মকর্মশ্রিত। শিল্পকলা-নৃত্যগীতের দিক হইতে ইহাদের যাহা বিশুদ্ধ শিল্পমূল্য বা সংস্কৃতিমূল্য তাহা তো আছেই। ভারতীয় শিল্পের ইতিহাসে প্রাচীন বাঙলার শিল্পকলার একটি বিশেষ স্থানও আছে। কিন্তু বাঙালীর ইতিহাসে তাহার আলোচনার মূল্য সমাজমানসের দিক হইতেই বেশি; এবং তাহাই মুখ্য। এই শিল্পকলা-নৃত্যগীতের মধ্যে প্রাচীন বাঙালীর মন, তাঁহাদের সমাজবিন্যাস, পরিবেশ সম্বন্ধে তাঁহাদের মানসিক প্রতিক্রিয়া ইত্যাদি কিভাবে প্রকাশ পাইয়াছে, তাহাই আমাদের প্রধান আলোচ্য | এই আলোচনা লইয়া আমাদের ইতিহাসের চতুর্দশ অধ্যায়।

পঞ্চদশ অধ্যায় : ইতিহাসের ইঙ্গিত

ইতিহাস শুধু তথ্যমাত্র নয়। যে তথ্য কথা বলে না, কার্যকারণ-সম্বন্ধের ইঙ্গিত বহন করে না, যাহার কোনও ব্যঞ্জনা নাই, শুধুই বিচ্ছিন্ন তথ্য মাত্র, যে তথ্য কোনও যুক্তিসূত্রে গ্রথিত নয়, ইতিহাসে তাহার কোনও মূল্য নাই। সমস্ত তথ্যের পশ্চাতে কার্যকারণ-পরম্পরার অমোঘ নিয়ম সর্বদা সক্রিয়। এই নিয়মটি ধরিতে পারা, দেশকালধূত নরনারীর গতি-পরিণতির প্রকৃতিটি ধরিতে পারা, সমাজের প্রবহমান ধারাস্রোতের পশ্চাতের ইঙ্গিতটি জানাই ঐতিহাসিকের কর্তব্য।  কার্যকারণপরম্পরায়, যুক্তিশৃঙ্খলায় তথ্যসন্নিবেশ করিয়া যাইতে পারিলে তবেই সেই অমোঘ নিয়মটি, ইঙ্গিত ও প্রকৃতিটি জানা যায়। প্রাণহীন, নীরব, নীরস তথ্য তখন সজীব, মুখর ও সরস হইয়া উঠে। আমার তথ্যসন্নিবেশের মধ্যে ইতিহাসের সেই সজীব মুখরতা পরিস্ফুট হইবে কিনা জানি না; তবু সকল তথ্যের পশ্চাতে বাঙালীর আদি ইতিহাসের গতি-প্রকৃতির একটি সমগ্র ইঙ্গিত আমি মনন-কল্পনার মধ্যে ধরিতে চেষ্টা করিয়াছি। সে ইঙ্গিত আলোচ্য অধ্যায়গুলির স্থানে স্থানে পাওয়া যাইবে, বিশেষভাবে পাওয়া যাইবে রাজবৃত্ত অধ্যায়ে। তবু, সর্বশেষ অধ্যায়ে ইতিহাসের ইঙ্গিতটি একটি অখণ্ড অথচ সংক্ষিপ্ত সমগ্রতায় উপস্থিত করিতে চেষ্টা করিয়াছি।