২. উপরোক্ত অর্থে বাঙালীর ইতিহাস কেন রচিত হইতে পারে নাই

প্রথম অধ্যায়। ইতিহাসের যুক্তি
দ্বিতীয় পরিচ্ছেদ । 
উপরোক্ত অর্থে বাঙালীর ইতিহাস কেন রচিত হইতে পারে নাই

কেন হয় নাই তাহার কারণ খুঁজিতে খুব বেশি দূর যাইতে হয় না। উনবিংশ শতকের শেষপাদে এবং বিংশ শতকের প্রথম ও দ্বিতীয় পাদে ঐতিহাসিক গবেষণার যে পদ্ধতি ও দৃষ্টিভঙ্গি বাঙলাদেশে, তথা ভারতবর্ষে প্রচলিত সে পদ্ধতি ও দৃষ্টিভঙ্গি আমরা পাইয়াছি সমসাময়িক যুরোপীয়, বিশেষভাবে ইংরেজি ঐতিহাসিক আলোচনা-গবেষণার রীতিপদ্ধতি ও আদর্শ হইতে। এই আদর্শ পদ্ধতি ও দৃষ্টিভঙ্গি একান্তই ব্যক্তিকেন্দ্রিক, এবং রাজা ও রাষ্ট্রই এই গবেষণার কেন্দ্র। সামাজিক চেতনা এই আদর্শ ও পদ্ধতিকে উদ্বুদ্ধ করে নাই। স্থলদৃষ্টিতে দেখা যায়, রাষ্ট্রই সকল ব্যবস্থার নিয়ন্ত; যেদিকে তাকানো যায়, সেইদিকেই রাষ্ট্রের সুদীৰ্ঘবাহু বিস্তৃত, ইহাই দৃষ্টি আকর্ষণ করে; এবং সেই রাষ্ট্রও কোনও বিশেষ ব্যক্তি বা বিশেষ ব্যক্তি-সমষ্টিকেই যেন আশ্রয় করিয়া আছে, ইহাই সর্বজনগোচর হয়। অথচ, সেই রাষ্ট্রের পশ্চাতে যে বৃহত্তর সমাজ এবং সমাজের মধ্যে যে বিশেষ বিশেষ স্বার্থের লীলাধিপত্য তাহা সহজে চোখে ধরা পড়ে না। সমাজবিকাশের অমোঘ নিয়মের বশেই যে রাজা ও রাষ্ট্রের সৃষ্টি এ কথা উনবিংশ শতকের ইংরেজি ঐতিহাসিক আলোচনা-গবেষণা স্বীকার করে নাই। জীবনের অন্যান্য ক্ষেত্রে যেমন, ইতিহাস ও ঐতিহাসিক গবেষণার ক্ষেত্রেও তেমনই তখনও পর্যন্ত ইংলন্ডে এবং যুরোপেও অধিকাংশ পণ্ডিত মহলে ফরাসী বিপ্লবের ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যবাদের, কার্লাইলের বীর ও বীরপূজাদর্শের বিজয়-পতাকা উড়িতেছে। এদেশে আমরা তাহার অনুকরণ করিয়াছি মাত্র। ঐতিহাসিক উপাদান সংগ্রহের সঙ্গে সঙ্গে আমাদের দৃষ্টি সেইজন্যই বিশেষভাবে রাজা ও রাষ্ট্রের দিকেই আকৃষ্ট হইয়াছে, এবং সমাজ সম্বন্ধেও তথ্য যখন আহৃত ও আলোচিত হইয়াছে, তখন সমাজ অত্যন্ত সংকীর্ণ অর্থেই গ্রহণ ও প্রয়োগ করা হইয়াছে। কিন্তু উনবিংশ শতকের তৃতীয় পাদ হইতেই যুরোপের কোথাও কোথাও, বিশেষভাবে অস্ট্রিয়া ও জার্মানীতে, কিছুটা ফরাসী দেশেও, সমাজবিকাশের বিজ্ঞানসম্মত ঐতিহাসিক গবেষণার সূত্রপাত হয়, এবং তাহার ফলে সর্বত্র পণ্ডিতসমাজ এ কথা স্বীকার করিয়া লন যে, ধনোৎপাদনের প্রণালী ও বণ্টন-ব্যবস্থার উপরই বিভিন্ন দেশের ও বিভিন্ন কালের বৃহত্তর সমাজ-সংস্থান নির্ভর করে, বিভিন্ন বর্ণ, শ্রেণী ও স্তর এই ব্যবস্থাকে আশ্রয় করিয়াই গড়িয়া ওঠে। এই ব্যবস্থাকে রক্ষণ ও পালন করিবার জন্যই রাজা ও রাষ্ট্র প্রয়োজন হয়; এবং এই সমাজ ও রাষ্ট্র ব্যবস্থার উপযুক্ত পরিবেশ রচনা করিবার জন্যই একটি বিশেষ সংস্কৃতির উদ্ভব ও পোষণের প্রয়োজন হয়। সমাজ-বিকাশের এই বৈজ্ঞানিক ঐতিহাসিক ব্যাখ্যা ক্রমশ সমগ্র যুরোপে ছড়াইয়া পড়ে, এবং বিগত প্রথম মহাযুদ্ধের পর হইতে ইংরেজ ঐতিহাসিকদের মধ্যেও এই ব্যাখ্যার প্রভাব দেখা দেয়। য়ুরোপে যাহা উনবিংশ শতকের শেষ পদেই আরম্ভ হইয়াছিল, এবং যাহার ঢেউ কতকটা বঙ্কিমচন্দ্রের চিত্ততটে আসিয়া আঘাত করিয়াছিল, বিংশ শতকের প্রথম মহাযুদ্ধের পর হইতে ইংলন্ডেও তাহর প্রবর্তনা দেখা দেয়। ইহার কিছুদিন আগে হইতেই সমাজ, সামাজিক ধন, রাষ্ট্রের সঙ্গে সমাজের সম্বন্ধ, রাষ্ট্র, ধর্ম এবং সংস্কৃতি প্রভৃতির পারস্পরিক সম্বন্ধ ইত্যাদি লইয়া প্রামাণিক গ্রন্থ ইংলন্ডেও রচিত হইতেছিল; কিন্তু জনতত্ত্ব ও সমাজবিজ্ঞানের আলোচনার প্রসার ও প্রগতির সঙ্গে সঙ্গে এই নূতন ঐতিহাসিক দৃষ্টিভঙ্গির রূপ ক্রমশ আরো সুস্পষ্ট হইতেছে। আমাদের দেশের ঐতিহাসিক আলোচনা-গবেষণায় এই ইঙ্গিত আজ বিংশ শতকের দ্বিতীয় পাদেও ধরা পড়িল না! এইজন্যই আজ পর্যন্ত বাঙালীর বা ভারতবাসীর যথার্থ ইতিহাস রচিত হইতে পারিল না।

উপরোক্ত ধ্যান ও ধারণা-গত কারণ ছাড়া সমগ্র জনসাধারণের ইতিহাস রচিত না হওয়ার একটা বস্তুগত কারণও আছে; তাহা জনসাধারণের ইতিহাস-রচনার উপযোগী উপাদানের অভাব। প্রাচীন ভারতবর্ষের ইতিহাস সম্বন্ধে সমগ্রভাবেই এই অভিযোগ করা চলে, বাঙলাদেশের ইতিহাস সম্বন্ধে তো চলেই। রাজা, রাজবংশ, রাষ্ট্র, রাষ্ট্রদর্শ, রাজকর্মচারী ইত্যাদির কথাই প্রভূত যত্নে তিল তিল করিয়া সংগ্ৰহ করিতে হইয়াছে, তবে আজ আমরা এতদিনের পর আমাদের ইতিহাসের অল্পবিস্তর স্পষ্ট একটা রূপ দেখিতে পাইতেছি। এখনও এমন কাল ও এমন দেশখণ্ড আছে যাহার ধারাবাহিক ইতিহাস সংকলন অত্যন্ত আয়াসসাধ্য। রাজা ও রাষ্ট্রের ইতিহাস সম্বন্ধেই যেখানে এই অবস্থা, সেখানে বৃহত্তর সমাজ ও সমাজের ইতিহাস সম্বন্ধে উপাদানের অপ্রাচুর্য থাকিবে ইহাতে আর আশ্চর্য কী! সমগ্র ভারতবর্ষের কথা বলিয়া লাভ নাই; বাঙালীর ইতিহাস রচনা করিতে বসিয়া বাঙলাদেশের কথাই বলি। বাঙলার রাষ্ট্র ও রাজবংশাবলীর ইতিহাস যতটুকু আমরা জানি তাহার বেশির ভাগ উপাদান যোগাইয়াছে প্রাচীন লেখমালা। এই লেখমালা, শিলালিপিই হউক আর তাম্রলিপিই হউক, ইহারা অধিকাংশ ক্ষেত্রে হয় রাজসভাকবি রচিত রাজার অথবা রাজবংশের প্রশস্তি, কোনও বিশেষ ঘটনা উপলক্ষে রচিত বিবরণ, বা কোনও ভূমি দান-বিক্রয়ের দলিল, অথবা কোনও মূর্তি বা মন্দিরে উৎকীর্ণ উৎসর্গলিপি। ভূমি দান-বিক্রয়ের দলিলগুলিও সাধারণত রাজা অথবা রাজকর্মচারীদের নির্দেশে রচিত ও প্রচারিত। এই লেখমালার উপাদান ছাড়া কিছু কিছু সাহিত্য জাতীয় উপাদানও আছে; ইঁহাদের অধিকাংশই আবার রাজসভার সভাপণ্ডিত, সভাপুরোহিত, রাজগুরু অথবা রাষ্ট্রের প্রধান কর্মচারীদের দ্বারা রচিত স্মৃতি, ব্যবহার ইত্যাদি জাতীয় গ্রন্থ। ধোয়ীর ‘পবনদূত’, সন্ধ্যাকর নদীর ‘রামচরিত’, শ্ৰীধর দাসের ‘সদুক্তিকর্ণামৃত’—জাতীয় দুই চারিখানি কাব্যগ্রন্থও আছে; সেগুলি অধিকাংশ রাজা বা রাজসভাপুষ্টকবিদের দ্বারা রচিত বা সংকলিত। বৃহদ্ধর্ম, ব্রহ্মবৈবর্ত এবং ভবিষ্যপুরাণের মতো দুই-তিনটি অর্বাচীন পুরাণগ্রন্থও আছে; এগুলি রাজসভায় রচিত হয়তো নয়, কিন্তু রাজসভা, রাজবংশ অথবা অভিজাত সম্প্রদায়-কর্তৃক পুষ্ট ও ললিত ব্রাহ্মণ্য বুদ্ধিজীবী সম্প্রদায়ের রচনা। ইহা ছাড়া, অন্যান্য প্রদেশের সমসাময়িক লিপিমালা এবং গ্রন্থাদি হইতেও কিছু কিছু উপাদান পাওয়া যায়; কিন্তু এগুলির চরিত্রও প্রায় একই প্রকারের ফা হিয়ান, য়ুয়ান-চোয়াঙ, ইৎসিঙের মতন বিদেশী পর্যটকদের বিবরণী, গ্রীক ও মিশরীয় ভৌগোলিক ও ঐতিহাসিকদের বিবরণী, তিব্বতে ও নেপালে প্রাপ্ত নানা বৌদ্ধ ও অন্যান্য ধর্ম ও সম্প্রদায়-গত বিভিন্ন বিষয়ক পুঁথিপত্র হইতেও কতক উপাদান সংগৃহীত হইয়াছে, এখনও হইতেছে। কিন্তু, এ কথা মনে রাখা প্রয়োজন, বিভিন্ন বিদেশী পর্যটকের রাজ-অতিথিরূপে বা রাষ্ট্রের সহায়তায় এই দেশ পরিভ্রমণ করিয়াছিলেন, এবং তাহারা বিশেষ বিশেষ ধর্মসম্প্রদায়ের লোক ছিলেন। বিদেশী পাশ্চাত্য ভৌগোলিক ও ঐতিহাসিকের রচনাও অধিকাংশ ক্ষেত্রে লেখকদের শ্রেণী ও সম্প্রদায়-গত পাথদুষ্টিকে অতিক্রম করিতে পারে না। আর, তিব্বতে-নেপালে প্রাপ্ত পুথিগুলি তো একান্তভাবে শাদ ও ব্রাহ্মণ্য ধর্মের ছত্রছায়ায় বসিয়াই লেখা হইয়াছিল যতগুলি উপাদানের উল্লেখ করা হল তাহার অধিকাংশই রাজসভা, ধর্মগোষ্ঠী বা বণিকগোষ্ঠীর পোষকতায় রচিত। তবে রাজা, মা বা রাজবংশের অথবা অন্য কোনও অভিজাত বংশের প্রশস্তিলিপিগুলি হইতে এবং রামচরিতে’র মতো সাহিত্যগ্রন্থ হইতেই রাজ্য ও রাষ্ট্র সম্বন্ধে প্রত্যক্ষ সংবাদ পাওয়া যাইতেছে; আর আর্য-মঞ্জুশ্রীমূলকল্প জাতীয় অন্যান্য ধর্ম অথবা সাহিত্য গ্রন্থ, অন্যান্য স্মৃতি ব্যবহার ও পুরাণ গগু হইতে কিংবা ভূমি দান-বিক্রয়ের তাম্রপট্ট হইতে যে সংবাদ পাওয়া যাইতেছে তাহা পরোক্ষ। পাণভট্টের হর্ষচরিত, বিলহনের বিক্রমাঙ্কদেবচরিত বা কলহনের রাজতরঙ্গিণীর মতন কোনও ইতিহাস গ্রন্থ প্রাচীন বাঙলার ইতিহাস রচনায় সহায়তা করিতেছে না। এই অবস্থায়, রাজা, রাজবংশ, রাষ্ট্র ও যুদ্ধবিগ্রহের ইতিহাস-রচনার উপাদানই তো অপূর্ণ ও অপ্রচুর, সামাজিক ইতিহাসের তো কথাই নাই।

উপরোক্ত উপাদানগুলি বাঙলার বৃহত্তর সামাজিক ইতিহাসেরও উপাদান। সমাজ সম্বন্ধে যে গবাদ ইঁহাদের মধ্যে পাওয়া যায় তাহা যে শুধু পরোক্ষ সংবাদ তাহাই নয়, শুধু যে অপূর্ণ ও আপ্রচুর তাহাই নয়, কতকটা একদেশীয়, একপক্ষীয় হওয়াই স্বাভাবিক। প্রথমত, সামাজিক তিহাসের সংবাদ দেওয়া তাহদের উদ্দেশ্য নয়। যতটুকু সংবাদ পাওয়া যায় তাহা পরোক্ষভাবে, বিবৃত ঘটনা ও পারিপাশ্বিকের জন্য যতটুকু প্রয়োজন হইয়াছে তাহার প্রসঙ্গক্রমে। সেই দিক হইতে যাহা পাওয়া যায় তাহাই মূল্যবান এবং ঐতিহাসিকের নিকট গ্রহণযোগ্য সন্দেহ নাই। দ্বিতীয়ত, যেহেতু স্বভাবতই এই সব উপাদানের উৎপত্তিস্থল হইতেছে রাজসভা, অভিজাতসম্প্রদায় বা ধর্মগোষ্ঠী সেইহেতু স্বভাবতই তাহদের মধ্যে সমাজের অন্যান্য শ্রেণী বা গোষ্ঠী সম্বন্ধে যে সংবাদ পাওয়া যাইতেছে তাহ অত্যন্ত স্বল্প শুধু নয়, অপক্ষপাতদৃষ্টিও তাহার মধ্যে নাই। শিল্পী ও বণিকশ্রেণী, ক্ষেত্রকর ও সমাজ-শ্রমিক শ্রেণীর মতন সমাজের এমন প্রয়োজনীয় শ্রেণীদের সম্বন্ধেও এই সব উপাদান অধিকাংশ ক্ষেত্রেই নীরব। তাহা ছাড়া, প্রাচীন ভারতবর্ষের ইতিহাস, বিশেষভাবে সামাজিক ইতিহাস-রচনায় যে সাহায্য সমকালীন ধর্ম, স্মৃতি, সূত্র এবং অর্থশাস্ত্রজাতীয় গ্রন্থাদি হইতে পাওয়া যায়, প্রাচীন বাঙালীর ইতিহাস-রচনায় সেই ধরনের সাহায্য একাদশ-দ্বাদশ শতকের আগে পাওয়া যায় না বলিলেই চলে। অবশ্য অনেকে ধরিয়া লন যে, এই জাতীয় গ্রন্থাদিতে বর্ণিত সামাজিক অবস্থা তদানীন্তন বাঙলাদেশেও হয়তো প্রচলিত ছিল। তবু যেহেতু এই জাতীয় কোনও গ্রন্থ বাঙলাদেশে রচিত হইয়াছিল বলিয়া নিঃসংশয়ে বলা যায় না, সেই কারণে প্রাচীন বাঙলায় ইতিহাস-রচনায় তাহদের প্রমাণ অনুমানের অধিক মূল্য বহন করে না, এবং ঐতিহাসিকের কাছে অনুমানসিদ্ধ প্রমাণের মূল্য খুব বেশি নয়, যদি সমাজবিকাশের প্রাকৃতিক নিয়মম্বারা তাহা সিদ্ধ ও সমর্থিত না হয়। এই সব কারণেও বৃহত্তর সামাজিক ইতিহাস-রচনার দিকে, তথা বাঙালীর ইতিহাস-রচনার দিকে, আমাদের ঐতিহাসিকদের দৃষ্টি আকৃষ্ট হয় নাই।