১. বাঙালীর ইতিহাসের অর্থ

প্রথম অধ্যায় ইতিহাসের যুক্তি
প্রথম পরিচ্ছেদ
বাঙালীর ইতিহাসের অর্থ

 বাঙলার ইতিহাস ও বাঙালীর ইতিহাসে প্রভেদ কোথায় এ কথা বিশদভাবে ব্যাখ্যা করিবার প্রয়োজন আছে বলিয়া মনে হয় না। যে বিষয়ের আলোচনার জন্য এই গ্রন্থ, তাহাকে বাঙলার ইতিহাস বলিলে আপত্তি করিবার কিছু নাই; তবু, বাঙালীর ইতিহাস যখন বলিতেছি তখন তাহার কারণ নিশ্চয়ই একটু আছে।

বাঙালীর ইতিহাসের অর্থ

স্বর্গত রাখালদাস বন্দ্যোপাধ্যায় মহাশয়ের ইংরেজি ভাষায় রচিত বাঙলার পাল রাজবংশের কাহিনী এবং তাহার বাঙ্গালার ইতিহাস বহুদিন প্রাচীন বাঙলার প্রামাণিক ইতিহাস বলিয়া গণ্য। কয়েক বৎসর আগে শেষোক্ত গ্রন্থের তৃতীয় সংস্করণ প্রকাশিত হইয়াছে; এখনও যে সে গ্রন্থের মূল্য পণ্ডিতমহলে স্বীকৃত ইহাই তাহার প্রমাণ স্বগত রমাপ্রসাদ চন্দ মহাশয়ের ‘গৌরাজমালা’ও ঐতিহাসিকের কাছে সুপরিচিত এবং মূল্যবান গ্রন্থ। ‘গৌড়রাজমালা’ প্রকাশিত হইবার পর শ্রীযুক্ত রমেশচন্দ্র মজুমদার, হেমচন্দ্র রায়চৌধুরী, নলিনীকান্ত ভট্টশালী, বিনয়চন্দ্র সেন, হেমচন্দ্র রায়, রাধাগোবিন্দ বসাক, প্রমোদলাল পাল, স্বগত ননীগোপাল মজুমদার, গিরীন্দ্রমোহন সরকার এবং আরও অনেক প্রখ্যাত পণ্ডিত ও মনীষী প্রাচীন বাঙলার রাজকীয় ইতিহাসের বিভিন্ন অধ্যায় রচনা করিয়া তুলিয়াছেন। এ কথা স্বীকার করিতেই হয় যে ইঁহাদের এবং অন্যান্য আরও অনেক গবেষকের সম্মিলিত চেষ্টা ও সাধনার ফলে আজ প্রাচীন বাঙলার ইতিহাস আমাদের কাছে অল্পবিস্তর সুপরিচিত; অন্তত মোটামুটি কাঠামো সম্বন্ধে অস্পষ্ট ধারণা কিছু নাই। কিন্তু, একটু লক্ষ্য করিলেই দেখা যাইবে, আজ প্রায় পঞ্চাশ বৎসরের গবেষণার ফলে, সমবেত চেষ্টার ফলে, প্রাচীন বাঙলার ইতিহাস সম্বন্ধে আমাদের যাহা জানিবার সুযোগ হইয়াছে তাহার অধিকাংশই প্রাচীন রাজবংশাবলীর কথা– রাজা, রাজ্য, রাজধানী, যুদ্ধবিগ্রহ এবং জয়পরাজয়ের কথা। সঙ্গে সঙ্গে রাষ্ট্রশাসনপদ্ধতি এবং রাজকর্মচারীদের সম্বন্ধে কিছু কিছু সংবাদ জানিবার সুযোগও হইয়াছে। প্রাচীন বাঙলাদেশ সম্বন্ধে যে সমস্ত লেখমালা ও যে কয়েকখানি সাহিত্যগ্রন্থ সম্পাদিত ও প্রকাশিত হইয়াছে তাহা হইতেও এইসব রাজকীয় সংবাদ ছাড়া কিংবা রাষ্ট্রশাসনপদ্ধতির কথা ছাড়া আর কিছু আহরণ করিবার চেষ্টা কিছুদিন পূর্ব পর্যন্ত বিশেষ কিছু হয় নাই। কোনও কোনও সম্পাদক, যেমন স্বগর্ত পদ্মনাথ ভট্টাচার্য, ননীগোপাল মজুমদার, গঙ্গামোহন লস্কর, পারজিটার, নগেন্দ্রনাথ বসু, লালমোহন বিদ্যানিধি, অক্ষয়কুমার মৈত্রেয়, কীলহর্ন, শ্ৰীযুক্ত নলিনীকান্ত ভট্টশালী, রাধাগোবিন্দ বসাক, দীনেশচন্দ্র সরকার, দীনেশচন্দ্র ভট্টাচার্য প্রমুখ পণ্ডিতেরা সমাজ সম্বন্ধেও কিছু কিছু তথ্যের প্রতি আমাদের দৃষ্টি আকর্ষণ করিয়াছেন। কিন্তু এই সমাজ সর্বত্রই বর্ণাশ্রমবদ্ধ সমাজ, এবং তাঁহাদের আহৃত সমাজ-সংবাদ অধিকাংশ ক্ষেত্রেই ব্রাহ্মণ ও অন্যান্য উচ্চতর বর্ণের সমাজ-সংবাদ। এ-যাবৎ সামাজিক অবস্থা বলতে অধিকাংশ ক্ষেত্রেই ‘সমাজ’ কথাটা অত্যন্ত সংকীর্ণ অর্থে, উচ্চতর বর্ণ-সমাজ অর্থে ব্যবহৃত হইয়াছে; এবং সে সংবাদও অত্যন্ত অপ্রচুর। মোটামুটি ইহাই ছিল কিছুদিন পূর্ব পর্যন্তও বাঙলার ইতিহাসের উপাদান। গ্রন্থাকারে বা প্রবন্ধকারে প্রাচীন বাঙলার যত ইতিহাসাধ্যায় রচিত হইয়াছে তাহতে রাজ্য, রাজা, রাজকর্মচারী, রাষ্ট্রশাসনপদ্ধতি এবং উচ্চতর বর্ণ-সমাজসম্পৃক্ত সংবাদ ছাড়া আর কিছু পাওয়া যায় না। ইহাই আমাদের বাঙলার ইতিহাস।

আরও কিছু আছে। ধর্ম, শিল্প ও সাহিত্য সম্বন্ধেও আমাদের কিছু কিছু জানিবার সুযোগ আছে। এ বিষয়ে সর্বাগ্রে স্বৰ্গত হরপ্রসাদ শাস্ত্রী মহাশয়ের নাম করিতে হয়। প্রাচীন বাঙলার সাহিত্য এবং বৌদ্ধ ও ব্রাহ্মণ্য ধর্মের স্বরূপ সম্বন্ধে তিনিই সর্বপ্রথম আমাদের সজাগ করিয়াছিলেন। তাহার এবং স্বৰ্গত অক্ষয়কুমার মৈত্রেয় মহাশয়ের প্রদর্শিত পথে শিল্প, সাহিত্য, ভাষা ও ধর্ম-সম্পৃক্ত সংবাদ আহরণ ও আলোচনায় স্বৰ্গত নগেন্দ্রনাথ বসু, গিরীন্দ্রমোহন সরকার, রাখালদাস বন্দোপাধ্যায়, শ্ৰীযুক্ত জিতেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়, নলিনীকান্ত ভট্টশালী, সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায়, সরসীকুমার সরস্বতী, অর্ধেন্দ্রকুমার গঙ্গোপাধ্যায়, প্রবোধচন্দ্র বাগচী, নলিনীনাথ দাশগুপ্ত, চিন্তাহরণ চক্রবর্তী, দীনেশচন্দ্র ভট্টাচার্য, যোগেশচন্দ্র রায়, শ্রীমতী স্টেলা ক্রামরিশ প্রভৃতি পণ্ডিত ও মনীষীরা নানাদিকে উল্লেখযোগ্য উদ্যম প্রকাশ করিয়া বাঙলার ইতিহাসের সীমা ও পরিধি বিস্তৃত করিয়াছেন। বরেন্দ্র অনুসন্ধান সমিতি, ঢাকার সরকারী চিত্রশালা এবং বাঙলার ও বাঙলার বাহিরের অন্যান্য ক্ষুদ্র বৃহৎ সাধারণ ও ব্যক্তিগত প্রত্নবস্তু-সংগ্রহের সহায়তায় প্রাচীন বাঙলার ভাষা ও সাহিত্য, ধর্ম ও শিল্প সম্বন্ধে আজ আমাদের জ্ঞান ও দৃষ্টি অনেকটা সুস্পষ্ট। ইঁহার এবং এইসব প্রতিষ্ঠান ভবিষ্যৎ ঐতিহাসিকদের পথ সুগম করিয়াছেন, সন্দেহ নাই। কিন্তু কিছুদিন পূর্ব পর্যন্তও এ কথা সত্য ছিল যে, কি বাঙলা কি ইংরাজি, কি অপর কোনও ভাষায় প্রাচীন বাঙলার সমাজ, সভ্যতা ও সংস্কৃতির পরিপূর্ণ একটা রূপ কেহ গড়িয়া তুলিবার চেষ্টা করেন নাই। ধর্ম, শিল্প ও সাহিত্য সম্বন্ধে আমরা যাহা জানিতাম তাহার অধিকাংশই বর্ণ-ধর্মের কথা—সে ধর্ম বৌদ্ধই হউক আর পৌরাণিক ব্রাহ্মণ্য ধর্মই হউক,—সভাশিল্প বা নাগর সমাজের অভিজাত শিল্পের কথা, সংস্কৃত সভা-সাহিত্যের কথা। যে ধর্ম বর্ণাশ্রমীদের, যে শিল্প বা সাহিত্য রাজসভায় বা বিত্তশালী বণিক অথবা গৃহস্থের পোষকতায় পুষ্ট ও লালিত, যে শিল্প বা সাহিত্য বর্ণাশ্রম ধর্মের, পৌরাণিক ব্রাহ্মণ্য ধর্মের ও শিল্পশাস্ত্রের অনুশাসন, সাধন-পদ্ধতি এবং লক্ষণদ্বারা শাসিত, সেই ধর্ম, শিল্প ও সাহিত্যের কথাই এ-যাবৎ আমরা পড়িয়া আসিয়াছি। লোকধর্ম, লোকশিল্প, লোকসাহিত্য প্রভৃতি সম্বন্ধে আমরা বহুদিন একেবারে সজাগই ছিলাম না। স্বৰ্গত হরপ্রসাদ শাস্ত্রী মহাশয় মাঝে মাঝে আমাদের একটু সজাগ করিতে চেষ্টা করিয়াছিলেন মাত্র।

বহুদিন আগে বঙ্কিমচন্দ্র দুঃখ করিয়া বলিয়াছিলেন, “বাঙ্গালার ইতিহাস চাই। নহিলে বাঙ্গালী কখনও মানুষ হইবে না…।” তিনি শুধু রাজা ও রাষ্ট্রের ইতিহাস-রচনা কামনা করেন নাই; চাহিয়াছিলেন বাঙলার সেই ইতিহাস যে-ইতিহাস বলিবে :

… রাজ্যশাসন প্রণালী কিরূপ ছিল, শান্তিরক্ষা কিরূপে হইত। রাজসৈন্য কত ছিল, কি প্রকার ছিল, তাহদের বল কি, বেতন কি, সংখ্যা কি?…কতপ্রকার রাজকর্মচারী ছিল…? কে বিচার করিত…রাজা কি লইতেন, মধ্যবর্তীরা কি লইতেন, প্রজারা কি পাইত, তাহাদের সুখদুঃখ কিরূপ ছিল? চৌর্য, পূর্ত, স্বাস্থ্য এসকল কিরূপ ছিল?…কোন ধর্ম কতদূর প্রচলিত ছিল? …তখনকার লোকের সামাজিক অরস্থা কিরূপ? সমাজভয় কিরূপ? ধর্মভয় কিরূপ-বাণিজ্য কিরূপ, কি কি শিল্পকার্যে পারিপাট্য ছিল? কোন কোন দেশোৎপন্ন শিল্প কোন কোন দেশে পাঠাইত? … ভিন্ন দেশ হইতে কি কি সামগ্ৰী আমদানি হইত, পণ্যকার্য কি প্রকারে নির্বাহ হইত?

আজ বহুদিন পর বঙ্কিমচন্দ্রের এই কামনা কিছু সার্থক হইয়াছে, বলা যায়। সম্প্রতি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আনুকূল্যে শ্রীযুক্ত রমেশচন্দ্র মজুমদারের সুযোগ্য সম্পাদনায় এবং প্রভূত শ্রম ও অধ্যবসায়ের ফলে ইংরাজি ভাষায় রচিত বাঙলার ইতিহাসের সুবৃহৎ প্রথম খণ্ড, অর্থাৎ প্রাচীন বাঙলার পরিপূর্ণ সুপরীক্ষিত, সআলোচিত তথ্যবহুল একটি সামগ্রিক ইতিহাস প্রকাশিত হইয়াছে। প্রায় সাতশত পৃষ্ঠায় বারোজন বাঙালী পণ্ডিত ও মনীষীর সমবেত প্রচেষ্টায় প্রসূত এই গ্রন্থকে বাঙলার প্রাচীন ইতিহাস সম্বন্ধে বিগত ৭৫ বৎসরের সম্মিলিত গবেষণার সমষ্টিগত ফল বলা যাইতে পারে। আলোচনারম্ভেই যে অভাব সম্বন্ধে অভিযোগ করা হইয়াছে, এই গ্রন্থ প্রকাশের ফলে সেই অভাব কিছুটা মিটিয়াছে এ কথা বোধ হয় বলা যায়। এ গ্রন্থ বাঙালীর পণ্ডিত ও মনীষার গৌরব, এমন উক্তি করিলে খুব অত্যুক্তি কিছু করা হয় না। সম্প্রতি রমেশবাবু এই সুবৃহৎ গ্রন্থের একটি বাঙলা সংক্ষিপ্তসারও প্রকাশ করিয়াছেন।

কিন্তু তৎসত্ত্বেও বাঙলার এই ইতিহাসকে বাঙালীর ইতিহাস বোধ হয় বলা চলে না। তাহার কারণ একটু সংক্ষেপে বলা যাইতে পারে। প্রথমত, ইতিহাসের কোনও যুক্তি, কার্যকরণ-সম্বন্ধের কোনও ব্যাখ্যা বা ইঙ্গিত এই ইতিহাস-পরিকল্পনার পশ্চাতে নাই; তাহা না থাকিবার ফলে প্ৰত্যেকটি অধ্যায় সুপরীক্ষিত, সুআলোচিত ও তথ্যবহুল হওয়া সত্ত্বেও এই গ্রন্থে সমসাময়িক বাঙালীর সমগ্র জীবনধারার যথার্থ পরিচয় ফুটিয়া উঠিতে পারে নাই। দ্বিতীয়ত, প্রাচীন বাঙলায় যাহাদের বলা যায় জনসাধারণ, যাঁহারা বর্ণসমাজের বাহিরে, পৌরাণিক ব্রাহ্মণ্যধর্মের বাহিরে অথবা বৌদ্ধধর্মের বাহিরে, যাহারা রাষ্ট্রের দরিদ্র ভূমিহীন প্রজা বা স্বল্পভূমিবান প্রজা বা সমাজশ্রমিক তাহাদের কথা এই গ্রন্থে যথেষ্ট স্থান পায় নাই; অথচ তাঁহারাই যে ছিলেন সংখ্যাগরিষ্ঠ এ সম্বন্ধে তো সন্দেহ নাই। যে লোকধর্ম, লৌকিক দেবদেবী, গ্রাম্য জনসাধারণের জীবনযাত্রা, গ্রামের সঙ্গে নগরের পার্থক্য ও-যোগাযোগের অধিকতর তথ্য, যে অর্থনৈতিক ভিত্তির উপর সমগ্র জীবনধারা প্রবহমান তাহার পূর্ণাঙ্গ আলোচনা জনসাধারণের এই ইতিহাসকে পূর্ণতর ও উজ্জ্বলতর করিতে পারিত, তাহা পরিপূর্ণ মর্যাদায় এই গ্রন্থভুক্ত হইতে পারে নাই | সত্য বটে, ইঁহাদের কথা বলিবার মতো যথেষ্ট তথ্য হয়তো আমাদের সম্মুখে উপস্থিত নাই; তবু, যতটুকু জানা যায় ততটুকু অন্তত প্রাচীন বাঙলাদেশকে বেশি জানা। তৃতীয়ত, এই গ্রন্থের প্রত্যেকটি অধ্যায় বিচ্ছিন্ন; একে অন্যের সঙ্গে অপরিহার্য অনিবার্য সম্বন্ধসূত্রে গ্রথিত নয়। সুলিখিত এবং তথ্যবহুল রাজকাহিনী ও রাষ্ট্রযন্ত্রের আলোচনা এই গ্রন্থের এক-তৃতীয়াংশেরও বেশি অধিকার করিয়া আছে; কিন্তু এত বেশি মূল্য পাওয়া সত্ত্বেও রাজ্য ও রাষ্ট্রযন্ত্রের সঙ্গে সমাজের বিভিন্ন দিকের যোগাযোগ সম্বন্ধে বিশেষ কিছু সচেতনতা এই অধ্যায়গুলিতে নাই। ভাষা এবং সাহিত্য গম্বন্ধে অধ্যায় দুইটি পাণ্ডিত্যপূর্ণ, তথ্যবহুল এবং অত্যন্ত সুলিখিত; কিন্তু ইঁহাদের মধ্যেও সাহিত্যের সঙ্গে সমসাময়িক সমাজ ও রাষ্ট্রের এবং অর্থনৈতিক অবস্থার সম্বন্ধের ইঙ্গিত অত্যন্ত কম। ধর্মের অধ্যায়ে লোকধর্ম, লৌকিক দেবদেবীর অস্তিত্বের স্বীকৃতি প্রায় নাই বলিলেই চলে; অথচ, বাঙলাদেশে উচ্চতর বর্ণসমাজে যে ধর্মের প্রচলন তাহার ভিত্তিভূমিই হইতেছে লোকধর্ম, লৌকিক দেবদেবী ও লৌকিক আচারানুষ্ঠান। সমাজ কথাটিও অত্যন্ত সংকীর্ণ অর্থে ব্যবহৃত হইয়াছে; তবু জনসাধারণের কথা যাহা কিছু তাহা সমাজ-অধ্যায়েই আছে। একমাত্র এই অধ্যায় এবং ইহার পরবর্তী অর্থনৈতিক অবস্থার অধ্যায়েই জনসাধারণ আমাদের দৃষ্টির বাহিরে পড়িয়া থাকে নাই। কিন্তু, এসব ক্ষেত্রেও ধর্ম, সমাজ ও আর্থিক অবস্থার সঙ্গে রাজা ও রাষ্ট্রের এবং গণ বিন্যস্ত, শ্রেণী-বিন্যস্ত বৃহত্তর সমাজের সম্বন্ধ নির্ণয়ের চেষ্টা যথেষ্ট করা হয় নাই।

রাষ্ট্র, সমাজ, ধর্ম, শিল্প, সাহিত্য, বিজ্ঞান, আর্থিক বিন্যাস প্রভৃতি সমস্ত কিছুই গড়িয়া তোলে মানুষ; এই মানুষের ইতিহাসই যথার্থ ইতিহাস। এই মানুষ সম্পূর্ণ মানুষ; তাহার একটি কর্ম অন্য আর একটি কর্ম হইতে বিচ্ছিন্ন নয় এবং বিচ্ছিন্ন করিয়া দেখিলে দেখা ও পরিচয় সম্পূর্ণ হয় না; একটি কর্মের সঙ্গে অপরাপর কর্মকে যুক্ত করিয়া দেখিলে তবেই তাহার সম্পূর্ণ রূপ ও প্রকৃতি দৃষ্টিগোচর হয়। দেশকালধৃত মানুষের সমাজ সম্বন্ধেও এ কথা সত্য এবং সর্বত্র স্বীকৃত। এই সত্য স্বীকৃতি না পাইলে ইতিহাস যথার্থ ইতিহাস হইয়া উঠিতে পারে না। কেমব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয় প্রকাশিত যে ভারতবর্ষের ইতিহাস ব্রিটিশ ইতিহাস-রচনার আদর্শ এবং আমরা আমাদের দেশে যে আদর্শ ও পদ্ধতি এ-যাবৎ অনুসরণ করিয়া আসিয়াছি তাহার মূলে পূর্বোক্ত তার স্বীকৃতি যথেষ্ট নাই। ইতিহাসের অর্থনৈতিক ব্যাখ্যার স্বীকৃতি বা অস্বীকৃতির যুক্তি না লিয়াও বলা যায়, উনবিংশ শতকের মধ্যপাদ হইতেই মানবিক তথ্য ও তত্ত্ব ব্যাখ্যা ও আলোচনায় এই সত্য স্বীকৃত যে, মানুষের সমাজই মানুষের সর্বপ্রকার কর্মকৃতির উৎস, এবং সেই সমাজের বিবর্তন-আবর্তনের ইতিহাসই দেশকালধৃত মানব-ইতিহাসের গতিপ্রকৃতি নির্ণয় করে। আমাদের দেশে ইতিহাসালোচনায় এই সমাজতাত্ত্বিক দৃষ্টি ও আলোচনা-পদ্ধতি আজও পূর্ণ স্বীকৃতি লাভ করে নাই। তাহা ছাড়া, এই দেশে রাজকাহিনী এবং রাষ্ট্রযন্ত্র-কাহিনী আজও ঐতিহাসিক গবেষণা ও আলোচনার একটা প্রধান স্থান অধিকার করিয়া আছে। ইহার কারণ অবশ্য সহজবোধ্য ও সুপরিজ্ঞাত। প্রাচীন ও মধ্যযুগীয় ভারতবর্ষের রাজসভায় রাজা ও রাষ্ট্রের পৃষ্ঠপোষকতায় যে-সব গ্রন্থ রচিত হইত তাহার মধ্যে রাজকাহিনী, রাষ্ট্রকাহিনী গ্রন্থের অপ্রাচুর্য ছিল না—রাজসভায় তাহা হইয়াই থাকে—কিন্তু এইসব গ্রন্থে দেশের সমাজবিন্যাস বা জ্ঞান-বিজ্ঞান সৃষ্টি ও আলোচনার যথেষ্ট স্থান বা মূল্য ছিল না। অথচ, রাজা ও রাষ্ট্র ভারতীয় সমাজব্যবস্থায় কখনও একান্ত হইয়া থাকে নাই। অষ্টাদশ শতক পর্যন্ত ভারতবর্ষের সর্বত্র আমাদের জীবন ছিল একান্তই সমাজকেন্দ্রিক, রাষ্ট্রকেন্দ্রিক নয়; আমাদের দৈনন্দিন জীবন, আমাদের যাহা কিছু কর্মকৃতি সমস্তই আবর্তিত হইত সমাজকে ঘিরিয়া। কিন্তু, উনবিংশ শতকে ইতিহাস-রচনার যে রীতিপদ্ধতি ও আদর্শের সন্ধান আমরা ইংরাজি শিক্ষার ভিতর দিয়া পাইয়াছি তাহা একান্তই রাজা ও রাষ্ট্র-কেন্দ্রিক। বিংশ শতকে তাহ অনেকটা সমাজ ও সংস্কৃতি আলোচনার দিকে মোড় ফিরিয়াছে সত্য, কিন্তু এখনও সমাজকেন্দ্ৰিক হইয়া উঠে নাই।

অথচ, দেশে রাজা বা রাজপাদোপজীবী কয়জন? রাষ্ট্রশাসনযন্ত্র যাঁহারা পরিচালনা করেন তাঁহারাই বা কয়জন? যুদ্ধবিগ্রহ নিত্য হইত না, সমগ্র ইতিহাসে তাহার স্থান কতটুকু? আজিকার দিনের সামগ্রিক যুদ্ধের মতো তখনকার দিনের যুদ্ধবিগ্রহ সমাজের মূল ধরিয়া টান দিত না। যুদ্ধ  সাধারণত যুদ্ধের স্থান, রাজা, সেনাধ্যক্ষ, সৈন্যবাহিনী, রাজসভা, রাজকর্মচারী— ইঁহাদের মধ্যেই আবদ্ধ ও সীমাবদ্ধ থাকিত। যুদ্ধের ফলাফল নিকট ও দূর ভবিষ্যৎকে একান্তভাবে রূপান্তরিতও করিতে পারিত না। রাজা ও রাজসভার বাহিরে ছিল অগণিত জনসাধারণ, বিভিন্ন বর্ণে বিভক্ত, বিভিন্ন ধর্মবিশ্বাসদ্বারা শাসিত, বিভিন্ন শ্রেণীর সীমায় সীমিত, ঠিক এখনও বাঙলাদেশে যেমনটি আমরা দেখি। তবু বর্তমান কালে, রাষ্ট্র যতটা সর্বগ্রাসী, রাষ্ট্র ও রাষ্ট্রীয় সমস্যা আমাদের দৈনন্দিন জীবনের সঙ্গে যতটা ওতপ্রোতভাবে জড়িত, প্রাচীনকালে এমনটি এতটা হইবার সুযোগ ছিল না। এক রাজা পরাজিত হইয়াছে, অন্য রাজা রাজমুকুট পরিয়া রাজসিংহাসনে বসিয়াছেন; তাহাতে অগণিত জনসাধারণের দৈনন্দিন জীবনের বৈপ্লবিক রূপান্তর কিছু ঘটে নাই, বৃহত্তর সমাজব্যবস্থারও খুব দ্রুত উলেট-পালট কিছু হইয়া যায় নাই; যাহা হইয়াছে তাহা ধীরে ধীরে এবং সমাজের উচ্চতর স্তরে।

আসল কথা, প্রাচীন ভারতবর্ষে রাজা ও রাষ্ট্রযন্ত্র সমগ্র সমাজব্যবস্থার রক্ষক ও নিয়ামক মাত্র। রাজা ও রাষ্ট্রের দায়িত্ব ছিল এই সমাজব্যবস্থাকে রক্ষণ ও পালন করা, আর সমাজের দায়িত্ব রাজা ও রাষ্ট্রকে প্রতিপালন করা। সমাজ আছে বলিয়াই রাষ্ট্র এবং রাজাও আছেন; সমাজহীন রাষ্ট্র কল্পনাও করা যায় না। রাজা ও রাষ্ট্রের পক্ষে ধন যেমন অপরিহার্য, সমষ্টির পক্ষেও তাহাই। ধনব্যবস্থা, ভূমিব্যবস্থা, শ্রেণীব্যবস্থা, রাষ্ট্রব্যবস্থা—সমস্তই সামাজিক ধনকে কেন্দ্র করিয়া; ধন না হইলে রাজা ও রাষ্ট্র প্রতিপালিত হয় না। এই ধন উৎপাদনের তিন উপায় প্রাচীন বাঙলায় দেখিতে পাওয়া যায়—কৃষি, শিল্প ও বাণিজ্য। এই তিন উপায় তিন শ্রেণীর করায়ত্ত : ভূমিবানশ্রেণী, শিল্পীশ্রেণী, বণিক-ব্যবসায়ী শ্রেণী। এই তিন উপায়ে উৎপাদিত অর্থদ্বারা সমাজ-ব্যবস্থা ও রাষ্ট্র-ব্যবস্থা প্রতিপালিত হইত এবং সদ্যকথিত তিন শ্রেণী ও রাষ্ট্র মিলিয়া উৎপাদিত ধন বণ্টনের ব্যবস্থা করিতেন। কাজেই, রাজা ও রাষ্ট্র ছাড়া সমাজ-ব্যবস্থার মধ্যে এই শ্রেণীর অর্থাৎ ধনোৎপাদক শ্রেণীর একটা বিশেষ স্থান ছিল, এবং রাজা ও রাজকর্মচারীদের অপেক্ষা ইহারা যে সংখ্যায় অনেক বেশি ছিলেন তাহ সহজেই অনুমেয়। অথচ, ইঁহাদের সম্বন্ধে আমাদের বিশেষ কিছু জানিবার সুযোগ নাই। ধনোৎপাদন, ধনবন্টন, ভূমিব্যবস্থায় ভূমিবানদের সঙ্গে ভূমিহীন কৃষককুল ও কৃষিশ্রমিকদের সম্বন্ধ, শিল্প-ব্যবসা-বাণিজ্যে শিল্পী-বণিক-ব্যবসায়ীদের সঙ্গে রাষ্ট্র ও সমাজের সম্বন্ধ, শ্রেণী-ব্যবস্থা ও বর্ণ-ব্যবস্থায় বর্ণের সঙ্গে শ্রেণী, বর্ণের সঙ্গে রাষ্ট্র, রাষ্ট্রের সঙ্গে শ্রেণীর সম্বন্ধ ইত্যাদি ব্যাপারে আমাদের কিছু জানিবার সুযোগ আজও অতি অল্পই আছে।

এই মাত্র যে ধনোৎপাদক শ্রেণী ও কৃষিশ্রমিকদের কথা বলিলাম, ইঁহাদের জীবনাচরণ যে শুধুই ধনসর্বস্ব, ধনকেন্দ্রিক ছিল, এ কথা বলা চলে না। ইঁহাদের রক্ষা ও পালন যাহারা করিতেন সেই রাজা ও রাজপাদোপজীবীদের জীবনে ধর্ম ও শিল্পের, শিক্ষা ও সাহিত্যের, এক কথায় সংস্কৃতিরও প্রয়োজন ছিল। সেই সংস্কৃতি স্বভাবতই এমন হওয়া প্রয়োজন ছিল যাহা তদানীন্তন সমাজ-সংস্থানের পরিপন্থী নয়। এই সংস্কৃতির পুষ্টি ও পালন ধনসাপেক্ষ : সেই ধন সমাজের উদকৃত্ত ধন। দৈনন্দিন একান্ত প্রয়োজনীয় ব্যয়ভার নির্বাহ করিয়া যে-ধন থাকিত সেই ধনের কিয়দংশ যাহারা দিতেন ও দিতে সমর্থ ছিলেন তাহারাই পরোক্ষভাবে উচ্চতর সমাজস্তরের সংস্কৃতির আদর্শ নির্ণয় ও নিয়ন্ত্রণ করবেন, ইহাই তো স্বাভাবিক। অপরোক্ষভাবে ইহাকে রূপদান করিতেন সমাজের বুদ্ধিজীবীরা—ব্রাহ্মণ্য ও বৌদ্ধ শাস্ত্রবিদেরা, জ্ঞান-বিজ্ঞানের অনুশীলকরা, এবং ইঁহাদের প্রায় সকলেই ছিলেন বৌদ্ধ অথবা পৌরাণিক ব্রাহ্মণ্য-ধর্মাশ্রয়ী। শিক্ষা ও ধর্মাচরণের, সামাজিক স্মৃতি ও ব্যবহারাদি, নিয়ম-আচার প্রভৃতি প্রণয়নের দায়িত্ব ছিল তাহদের। এ দায়িত্ব তাহারা পালন করিতেন বলিয়া সমাজের মধ্যে সমর্থ শ্রেণী বা শ্রেণীসমূহ জৈন, বৌদ্ধ, যতি ও ব্রাহ্মণদের প্রতিপালন ও ভরণপোষণের দায়িত্ব গ্রহণ করিত। সংস্কৃতির ধারক ও বাহক ইঁহাদের বর্ণ ও শ্রেণীগত স্থান ও ব্যবহার, রাষ্ট্রের সঙ্গে ইঁহাদের সম্বন্ধ, ধনোৎপাদক ও বণ্টক শ্রেণীদের সঙ্গে সম্বন্ধ ইত্যাদি ব্যাপার, এবং ইঁহাদের সৃষ্ট সংস্কৃতির আদর্শ সম্বন্ধে আমাদের ধারণা স্পষ্ট করিয়া লইবার সুযোগ আজও কম। ইহারা ছাড়া, সমাজের নিম্নতর স্তরগুলিতে নিরক্ষর জনসাধারণেরও একটা মানস-জীবন ছিল, সংস্কৃতি ছিল। এ সম্বন্ধেও আমাদের জ্ঞান স্বল্পই। অথচ, ইহারাও সমাজের বিশেষ একটি অঙ্গ, এবং এই সংস্কৃতির যথার্থ স্বরূপ ও ইতিহাস বাঙলার ও বাঙালীর ইতিহাসেরই কথা।

রাজা, রাজপাদোপজীবী, শিল্পী, বণিক, কৃষক, কৃষিজীবী, ভূমিবান সম্প্রদায় প্রভৃতি শ্রেণীর অসংখ্য লোকের বিচিত্র প্রয়োজনের সেবার জন্য ছিল আবার অগণিত জনসাধারণ। ইঁহাদের অশন-বসন, বিলাস-আরাম, সুখ-সুবিধা, দৈনন্দিন জীবনের বিচিত্র কর্তব্য প্রভৃতি সম্পাদনার জন্য প্রয়োজন হইত নানা শ্রেণীর, নানা বৃত্তির সমাজসেবক ও সমাজশ্রমিক শ্রেণীর অসংখ্যতর ইতর জনের—প্রাচীন লিপিমালায় যাঁহাদের বলা হইয়াছে অকীর্তিত বা অনুল্লিখিত জনসাধারণ। ইঁহাদের ছাড়াও সমাজ চলিত না, এই অকীর্তিত জনসাধারণও সমাজের অঙ্গবিশেষ, এবং সমাজ-ব্যবস্থার মধ্যে ইঁহাদেরও স্থান ছিল। অথচ, ইঁহাদের কথাও আমরা কমই জানি। ইঁহাদেরও ধর্মবিশ্বাস ছিল, দেবদেবী ছিল, পূজানুষ্ঠান ছিল, সংস্কৃতির একটা ধারা ছিল। উৎপাদিত ধনের খানিকটা— খুব স্বল্পতম অংশ সন্দেহ নাই— ইঁহাদের হাতে আসিত কোনও না কোন সূত্র ধরিয়া। এসব সম্বন্ধে আমাদের দৃষ্টি আজও যথেষ্ট সচেতন নয়।

কাজেই, রাজা, রাষ্ট্র, রাজপাদোপজীবী, শিল্পী, বণিক, ব্যবসায়ী, শ্রেষ্ঠী, মানপ, ভূমিবান মহত্তর, ভূমিহীন কৃষক, বুদ্ধিজীবী, সমাজসেবক, সমাজশ্রমিক, ‘অকীর্তিতান্‌ আওণ্ডালান্‌’ প্রভৃতি সকলকে লইয়া প্রাচীন বাঙলার সমাজ। ইঁহাদের সকলের কথা লইয়া তবে বাঙালীর কথা, বাঙালীর ইতিহাসের কথা। এই অর্থেই আমি ‘বাঙালীর ইতিহাস’ কথাটি ব্যবহার করিতেছি। বাঙালী-সমাজও এই বৃহত্তর অর্থেই বুঝিতেছি।

অথচ এই অর্থে বাঙলার অথবা বাঙালীর ইতিহাস সম্বন্ধে মনীষী ঐতিহাসিকেরা সকলেই কিছু একেবারে সজাগ ছিলেন না, এ কথা সত্য নয়। বঙ্কিমচন্দ্রের কথা আগে বলিয়াছি; তাঁহার মন দেশকালধৃত ইতিহাসের এই সমগ্ররূপ সম্বন্ধে সচেতন ছিল বলিয়া মনে হইতেছে। বঙ্কিমচন্দ্রের বহুদিন পরে আর-এক-বাঙালী ঐতিহাসিকের দৃষ্টিতেও এই বাঙালীর ইতিহাসের কল্পনা ধরা দিয়াছিল। ‘গৌড়রাজমালা’ গ্রন্থের ভূমিকায় স্বৰ্গত অক্ষয়কুমার মৈত্রেয় মহাশয় লিখিয়াছিলেন, ‘রাজা, রাজ্য, রাজধানী, যুদ্ধবিগ্রহ এবং জয়পরাজয়—ইহার সকল কথাই ইতিহাসের কথা। তথাপি কেবল এইসকল কথা লইয়াই ইতিহাস সংকলিত হইতে পারে না। বাঙালীর ইতিহাসের প্রধান কথা—বাঙালী জনসাধারণের কথা।’ এই বাঙালী জনসাধারণের কথা এযাবৎ বাঙলার ইতিহাসে সম্যক কীর্তিত হয় নাই।