০৪. জীবনচিত্র – বাসনা ও ব্যসন

একাদশ অধ্যায় দৈনন্দিন জীবন
প্রথম পরিচ্ছেদ । জীবনচিত্র – বাসনা ও ব্যসন

নাগরাদর্শ

প্রাচীন বাঙালী সমাজের নানা কামবাসনা ও ব্যসনের কথা প্রসঙ্গে বর্তমান ও অন্যান্য অধ্যায়ে বলা হইয়াছে। এখানে সমস্ত সাক্ষ্য একত্র করিয়া সার সংকলন করা অনুচিত হইবে না। খ্ৰীষ্টীয় তৃতীয়-চতুর্থ শতক হইতেই বাঙলাদেশ, স্বল্পাংশে হইলেও, উত্তর ভারতীয় সদাগরী ধনতন্ত্রের অন্তর্ভুক্ত হইয়াছিল এবং উত্তর ভারতের নাগর-সভ্যতার স্পর্শও তাহার অঙ্গে লাগিয়াছিল; বাৎস্যায়নীয় নাগরাদর্শ বাঙলার নাগর-সমাজেরও আদর্শ হইয়া উঠিয়াছিল। গৌড়ের যুবক-যুবতীদের কামলীলার কথা, তাহদের বাসনা ও ব্যসনের কথা এবং গৌড়-বঙ্গের রাজান্তঃপুরের মহিলারা যে নির্লজ্জভাবে ব্রাহ্মণ, রাজকর্মচারী ও দাস-ভৃত্যদের সঙ্গে কাম-ষড়যন্ত্রে লিপ্ত হইতেন তাহার বিবরণ বাৎস্যায়নই রাখিয়া গিয়াছেন। সে বিবরণ পড়িলে মনে হয়, ভিন-প্রদেশীরা গৌড়-বঙ্গের যুবক-যুবতীদের এই ধরনের কামবাসনা ও ব্যসনকে খুব সুনজরে দেখিতেন না। স্মৃতিকার বৃহস্পতির কয়েকটি শ্লোক দেবলভট্টের স্মৃতিচন্দ্রিক গ্রন্থে ও ভট্ট নীলকণ্ঠের ব্যবহার-ময়ূখ গ্রন্থে উদ্ধত হইয়াছে; তাহা হইতে জানা যায়, বৃহস্পতি দুই কারণে বাঙালী দ্বিজবর্ণের লোকদের নিন্দা করিয়াছেন: প্রথম কারণ, তাহদের মৎস্য ভক্ষণ; দ্বিতীয় কারণ, তাহদের সমাজের নারীরা দুনীতিপরায়ণা! শুধু বাৎস্যায়নের কালেই নয়, তাহার পরও প্রাচীন বাঙালী বোধ হয় কামবাসনায় সংযম অভ্যাসে অভ্যস্ত হয় নাই। ধোয়ীর পবনদূতেও দেখিতেছি, কামচরিতার্থতার অবাধলীলা কবি সোৎসাহে এবং সাড়ম্বরে বিবৃত করিয়াছেন। পবনদূত এবং রামচরিত উভয় কাব্যেই, যে ভাবে সভানন্দিনীদের উচ্ছসিত স্তুতিগান এবং তাহাদের বিলাসলীলা বর্ণনা করা হইয়াছে, তাহাতে মনে হয়, নাগর-সমাজের সমৃদ্ধ উচ্চস্তরে ইহাদের আকর্ষণ ও প্রভাব স্বল্প ছিল না, এবং ইহারা নাগর-সমাজের বিশেষ অঙ্গ বলিয়া বিবেচিত হইতেন।

কেশবসেনের ইদিলপুর লিপি ও বিশ্বরূপসেনের সাহিত্য-পরিষদ লিপিতে আছে, প্রতি সন্ধ্যায় এইসব সভানন্দিনীদের নপুর-বাংকারে সভা ও আমোদগ্রহগুলি পরিপূরিত হইত। সন্দেহ নাই, রাজসভায় এবং বিত্তবান সমাজে এই নন্দিনীদের বিশেষ একটা স্থান ছিল। তাহা ছাড়া নগরে ও গ্রামে বিত্তবানদের ঘরে দাসী রাখার প্রথা যে প্রায় সর্বব্যাপী ছিল, তাহা তো জীমূতবাহনই দায়ভাগ গ্রন্থে বলিয়াছেন। টীকাকার মহেশ্বর বলিতেছেন, দাসী রাখা হইত শুধু কামচরিতার্থতার জন্য! এই ধরনের দাসী রাখার প্রথা বাঙলাদেশের বহুদিন প্রচলিত। বাৎস্যায়নও ইহাদের কথা উল্লেখ করিয়াছেন। এই দাসীরা অস্থাবর সম্পত্তির মতো যথেচ্ছ ক্রীত ও বিক্রীত হইতেন; দায়ভাগ গ্রন্থে বলা হইয়াছে, উত্তরাধিকার সূত্রে একাধিক ব্যক্তি যদি একটি মাত্র দাসীর অধিকারী হন, তাহা হইলে সেই দাসী প্রত্যেকের অংশানুযায়ী পর পর প্রত্যেকের অধিকারে থাকিবেন।

এর উপর ছিল আবার দেবদাসী প্রথা। বাঙলাদেশে এই প্রথার প্রথম উল্লেখ অষ্টম শতকে, এবং তাহা কলহনের রাজতরঙ্গিণী গ্রন্থে, নর্তকী কমলা প্রসঙ্গে। কমলা ছিলেন পুণ্ডবর্ধনের কোনও মন্দিরের প্রধান দেবদাসী, নৃত্যগীতবাদ্যে সুনিপুণা, বিবিধ কলায় কলাবতী। দেবদাসীরা সাধারণত প্রায় সকলেই নানা কলানিপুণা হইতেন, কমলা আবার তাহাদের মধ্যে ছিলেন আরও উচ্চস্তরের। কিন্তু তাহা হইলেও দেবদাসীরা বিত্তবান ও প্রভাবশালী সমাজের কামবাসনা পরিপূরণের সঙ্গিনী হইতেন, সন্দেহ নাই, এবং এই হিসাবে বাররামাদের সঙ্গে তাহদের পার্থক্য বিশেষ কিছু ছিল না। রামচরিতকাব্যে তো ইহাদের স্পষ্টত দেব-বারবনিতাই বলা হইয়াছে; পবনদূতে বলা হইয়াছে বাররামা। কলহনের সুদীর্ঘ কমলা-কাহিনী প্রসঙ্গে সমসাময়িক বাঙলার দেবদাসীদের জীবনযাত্রা এবং সমাজের উচ্চকোটির লোকদের নৈতিক আদর্শ, বাসনা ও ব্যসনের মোটামুটি একটু পরিচয় পাওয়া যায়। কিন্তু পাল আমলে এই প্রথা খুব বিস্তৃত ছিল না; পরে দক্ষিণী প্রভাব ও সংস্পর্শের ফলে ক্রমশ দেবদাসী প্রথা দেশে বিস্তার লাভ করে এবং সেন-বর্মণ আমলে দেবদাসীরা সমাজে উচ্চস্তরের মন ও কল্পনা, কামনা ও বাসনাকে একান্ত ভাবে অধিকার করিয়া বসেন। বিজয়সেনের দেওপাড়া-প্রশস্তি এবং ভট্টভবদেবের লিপিতে যে ভাবে ইহাদের বিলাসলাস্য ও সৌন্দর্যলীলা বর্ণনা করা হইয়াছে এবং প্রশস্তিকারেরা যে ভাবে ইহাদের উপর কবিকল্পনার সুনির্বাচিত রূপকালংকার বর্ষণ করিয়াছেন তাহতে এসম্বন্ধে সংশয়ের অবকাশ আর কিছু নাই। ধোয়ী কবি ইহাদের আখ্যা দিতেছেন বাররামা, কিন্তু সঙ্গে সঙ্গেই বলিতেছেন, ইহাদের দেখিলে মনে হয়; লক্ষ্মী যেন স্বয়ং সুহ্মদেশে অবতীর্ণ হইয়াছেন তাহার পতি মুরারীর পাশে। তিনিই ইঙ্গিত করিতেছেন, সেন বংশীয় রাজাদের পাশে সর্বদা স্বভাবসুন্দরী বারনারীরা অবস্থান করিতেন, মনে হইত যেন মুরারীর পাশে লক্ষ্মী। আর, ভবদেব-ভট্ট বলিতেছেন, বিষ্ণুমন্দিরে উৎসর্গকৃত শত দেবদাসীরা যেন কামদেবতাকে পুনরুজ্জীবিত করিয়াছেন, তাহারা যেন কামাতুর জনের কারাগুহ, যেন সঙ্গীত, লাস্য এবং সৌন্দর্যের সভামন্দির!

 

ব্রাহ্মণাদর্শ

অথচ, অন্যদিকে সমসাময়িক ব্রাহ্মণ স্মৃতি গ্রন্থাদি পড়িলে মনে হয়, সমাজের নৈতিকাদশ উচ্চে তুলিয়া ধরিবার জন্য চেষ্টার ত্রুটি ছিল না। ব্রাহ্মণ্য লেখকেরা এবং সমাজের নেতারা সকল প্রকার দুর্নীতি এবং সংযমশাসনবিহীন বল্লাহীন কাম-বাসনার বিরুদ্ধে নিজেদের কষ্ঠ ও লেখনী নিয়োগ করিয়াছিলেন। সমসাময়িক লিপিমালা পাঠ করিলে স্বতই মনে হয়, তাঁহারা জনসাধারণের সন্মুখে যে সব নৈতিকাদশ তুলিয়া ধরিতে চাহিয়াছিলেন তাহ চিরাচরিত ঔপনিষদিক, পৌরাণিক এবং রামায়ণ-মহাভারতীয় ব্রাহ্মণ্য নৈতিকাদশেরই সমষ্টি; সে আদর্শ পাতিব্ৰত্যের, শুভ্ৰ শুচিতার, স্থৈর্য ও সংযমের, শ্রী, শ্লীলতা ও ঔদার্যের, দয়া, দান ও ক্ষমার। প্রায়শ্চিত্তপ্রকরণ গ্রন্থে সর্বপ্রকারের দুনীতি, কামাতুরতা, মদ্যাসক্তি, চৌর্য এবং পরনারী ও পরপুরুষগমনের নিন্দ করা হইয়াছে, এবং এই সব অপরাধের জন্য সর্বোচ্চ দণ্ডের এবং প্রায়শ্চিত্তের বিধান দেওয়া হইয়াছে। সঙ্গে সঙ্গে অনুশীলন করিতে বলা হইয়াছে, সত্য, দান, শুচিতা, দয়া এবং সংযম প্রভৃতি গুণের।

 

পল্লীর জীবনাদর্শ

আংশিকত এই ধরনের আদর্শপ্রচারের ফলে, আংশিকত বৃহত্তর পল্লীসমাজের ধনোৎপাদন ব্যবস্থা ও সামাজিক জীবন-বিন্যাসের ফলে সাধারণ ভাবে প্রাচীন বাঙালী জীবনের ভারসাম্য নষ্ট হইতে পারে নাই। যে সব বিলাস-ব্যসন ও অসংযত কামনাবাসনার কথা একটু আগে বলিয়াছি, তাহা সাধারণত নাগর-সমাজের মধ্যেই সীমাবদ্ধ ছিল; পল্লীবাসীরা এই সব নাগরাচার পছন্দ করিতেন না, এবং ইহাদের বিরুদ্ধে পল্লীপতিদের দৃষ্টি সদ্যজাগ্রত ছিল। গোবর্ধনাচার্যের একটি শ্লোকে তাহার আভাস আগেই আমরা পাইয়াছি। বৃহত্তর পল্লীসমাজে জীবনের একটি সরল শান্ত

সহজ আদর্শ ছিল সক্রিয়, এবং সমসাময়িক কালের এই আদর্শকে ব্যক্ত করিয়াছেন কবি শুভাঙ্ক।

বিষয়পতিরলুব্ধ ধেনুভিধাম পূতং
কতিচিদভিমতায়াং সীমি সীরা বহন্তি
শিথিলয়তি চ ভাৰ্যা নাতিথেয়ী সপর্য্যাম
ইতি সুকৃতিমনেন ব্যঞ্জিতং নঃ ফলেন৷।

বিষয়পতি (অর্থাৎ, স্থানীয় শাসনকর্তা) লোভহীন, ধেনুদ্বারা গৃহ পবিত্র, নিজ নিজ ক্ষেত্রে উপযুক্ত চাষ হয়, অতিথি পরিচর্যায় গৃহিণী কখনও ক্লান্ত হন না,–এই সব ফল দ্বারা ইঁহার পুণ্য (বা সুকৃতি) আমাদের নিকট ব্যঞ্জিত হইয়াছে।

ইহাই ছিল পল্লীবাসী কৃষিনির্ভর প্রাচীন বাঙালী সমাজের মধ্যবিত্ত লোকদের জীবনাদর্শ। এই সমাজের সুখ-স্বাচ্ছন্দ্যের আদর্শের ইঙ্গিত প্রাকৃতপৈঙ্গলের দুই একটি পদেও পাওয়া যায়।

পুত্ত পবিত্ত বহুত্ত ধণা ভক্তি কুটুম্বিণি সুদ্ধমণা।
হাক তরাসই ভিক্ষগণা কো কর বববর সগগমণা৷

পুত্র পবিত্রমনা, প্রচুর ধন, স্ত্রী ও কুটুম্বিনীরা শুদ্ধচিত্তা, হাঁকে ত্রস্ত হয় ভৃত্যগণ–এই সব ছাড়িয়া কোন বর্বর স্বর্গে যাইতে চায়!

অন্য একটি পদে আছে:

সের এক্ক জই পাঅই ঘিত্তা
মণ্ডা বীস পকাইল ণিত্তা৷
টঙ্ক এক্ক জই সিন্ধব পাআ ।
জো হউরঙ্ক সো হউ রাআ৷

এক সের,ঘি যদি পাই তবে নিত্য বিশটা মণ্ডা পাকাই; যদি এক টাকার সৈন্ধব পাওয়া যায় তবে হোক সে নিঃস্ব, তবু সে রাজা!

 

দরিদ্র নিম্নবিত্ত সমাজে বাঙালীর সনাতন দুঃখ কষ্ট লাগিয়াই ছিল; “হাড়িতে ভাত নাই, নিতাই উপবাস, অথচ ব্যাঙের সংসার বাড়িয়াই চলিয়াছে’,ক্ষুধায় শিশুদের চোখ ও পেট বসিয়া গিয়াছে, তাহদের দেহ শবের মত শীর্ণ, ভাঙা কলসীতে এক ফোটা মাত্র জল ধরে’, ‘পরিধানে জীর্ণ ছিন্ন বস্ত্র, সেলাই করিবার মত সূচও নাই ঘরে’, ‘ভাঙা কুঁড়েঘরের খুঁটি নড়িতেছে, চাল উড়িতেছে, মাটির দেয়াল গলিয়া পড়িতেছে —এই সব ছবি সমসাময়িক সাহিত্যে দুর্লভ নয়। নানা প্রসঙ্গে এই ধরনের কিছু কিছু দৃষ্টান্ত উদ্ধার করিয়াছি; এখানে আর তাহার পুনরুল্লেখ করিয়া লাভ নাই।

দারিদ্র্যাভিশাপক্লিষ্ট নিরানন্দ জীবনের একমাত্র আনন্দ বোধ হয় ছিল গ্রামের সম্পন্ন গৃহস্থ বাড়ির পার্বণ ব্রত, সম্পন্নতর গৃহের পূজা-উৎসব, এবং দরিদ্রতর স্তরের নানা আদিম কৌমগত যৌথ নৃত্য, গীত ও পূজা। এই সব আশ্রয় করিয়াই মাঝে মাঝে গ্রামের সাধারণ লোকেরা তাহদের দৈনন্দিন দারিদ্র্য-দুঃখ মুহুর্তের জন্য ভুলিয়া থাকিতে চেষ্টা করিতেন।

দশম-একাদশ শতকের বাঙালীর নানা টুকরোটাকরা জীবনচিত্র কল্পনায় আঁকিয়া তোলা যায় বাঙালী কবিকুলরচিত সদুক্তিকর্ণামৃত নানা প্রকীর্ণ শ্লোকগুলি হইতে। বর্ষার গ্রাম কৃষকযুবকের সুখস্বপ্ন আকিয়াছেন কবি যোগেশ্বর; হেমন্তে বাঙলার গ্রামাঞ্চলের শোভা ও সূর্যোদয়, মধ্যাহ্ন ও সন্ধ্যা, বাঙলার ভাষা, বাঙলার ধর্মকর্ম—বিশেষভাবে শিব ও গৌরী কল্পনা—, সাধারণ মানুষের প্রেম, সুখ-দুঃখ, দারিদ্র্য, ঋতুচর্যা, যুদ্ধ, শৌর্য, কীর্তি প্রভৃতি সম্বন্ধে নানা শ্লোক সদুক্তিকর্ণামৃতে ইতস্তত বিক্ষিপ্ত। কিছু কিছু বর্তমান গ্রন্থে নানাপ্রসঙ্গে নানা অধ্যায়ে উদ্ধার করিয়াছি; সব উদ্ধার করা সম্ভব নয়। বাঙলার জনসাধারণের যে সব চিত্র এই শ্লোকগুলিতে ফুটিয়া উঠিয়াছে তাহা যে শুধু সুন্দর, বস্তুময় এবং কাব্যময় তাহাই নয়, অন্যত্র, অন্য উপাদান, অন্য সাক্ষ্যপ্রমাণে তাহা দুর্লভ। কিন্তু, বাঙালী ঐতিহাসিকদের দৃষ্টি আজও এই সব সমসাময়িক জীবন-সাক্ষ্যের প্রতি আকৃষ্ট হয় নাই!

 

চর্যাগীতিতে গার্হস্থ্য জীবনের চিত্র

চর্যাগীতির অনেকগুলি গীতেও বাঙালীর সমসাময়িক গার্হস্থ্য-জীবনের চিত্র দৃষ্টিগোচর। দেশে চোর-ডাকাতের উপদ্রব বোধ হয় বেশ ছিল, সমর্থ প্রহরীর প্রয়োজন হইত, দরজায় তালা লাগাইতে হইত। কাহ্নপাদ বলিতেছেন:

সুনবাহ তথতা পহারী
মোহ ভাণ্ডার লই সআলা অহারী॥

শূন্য গৃহে তথতা প্রহরী; মোহভাণ্ডার সকলই কাড়িয়া লইয়া গিয়াছে।

 

আর, সরহপাদের দোহায় আছে, “জই পবন-গমন-দুআরে দিঢ় তালা বি দিজ্জই”। ঘরে তালা লাগাইবার ইঙ্গিত চর্যাপদেও আছে (৯নং)। আয়না ব্যবহারের কথাও আছে (৪৯নং)। চুরি-ডাকাতি যে হইত, সন্দেহ কি? একটি গীতে কুকরীপাদ বলিতেছেন:

আঙ্গণ ঘরপণ সুন বিআতী।
কানেট চোরে নিল অধরাতী।।
সুসুরা নিদ গেল বহুরী জাগঅ
কানেট চোরে নিল কা গই মাগঅ॥

অঙ্গন ঘরের কোণেই হে অবধূতি, শোনো, কানেট অর্ধরাত্রে চোরে লইয়া গেল, শ্বশুর পড়িল ঘুমাইয়া, বহুড়ি আছে জাগিয়া, কানেট নিল চোরে, কোথায় গিয়া আবার তাহা মাগিবে ! (কানের গহনা কানে পরিয়াই ঘরের বৌ পড়িয়াছিল ঘুমাইয়া, মাঝরাত্রে চোর আসিয়া গহনাটি চুরি করিয়া লইয়া গেল। শ্বশুর তখনও ঘুমে; কিন্তু ভয়ে ভয়ে জাগিয়া বসিয়া আছে বৌ। মনে বড় ভয় ও ভাবনা; চোরের ভয় একদিকে, অন্যদিকে গহনাটি চুরি গিয়াছে— লজ্জা ও অর্থদণ্ড দুইই। কার কাছে চাহিলেই বা গহনা আর পাওয়া যাইবে!)

এই গীতটির মধ্যে ঘরের বৌ-এর একটু চঞ্চল চরিত্রের ইঙ্গিতও যে নাই, এমন নয়। ভয় ও লজ্জা কতকটা সেই জন্যও; শ্বশুর কী বলিবেন, এই ভাবনা! এই গীতে একটু পরেই আছে, বৌটির এতই ভয় যে, দিনের বেলা কাকের ভয়েই চিৎকার করিয়া ওঠে, অথচ রাত্রি হইলেই কোথায় যে চলিয়া যায় সে !

দিবসই বহুড়ি কাগ ডরে ভাঅ।
রাতি ভইলে কামরু জাঅ॥

এই পদটিতে অসতী কুলবধূ সম্বন্ধে সর্বভারত প্রচলিত একটি উক্তির প্রতিধ্বনি অত্যন্ত সুস্পষ্ট।

তখনকার দিনেও গৃহকর্তা ও গৃহকর্ত্রীর একত্র বসিয়া খাওয়া নিন্দনীয় ছিল, দেশাচারে অসিদ্ধ ছিল। দোহাকোষে আছে:

ঘরবই খজ্জই ঘরিণীএহি জঁহি দেসহি অবিসার।

বিবাহে বরপক্ষ কর্তৃক যৌতুক-গ্রহণের কথা আগেই বলিয়াছি। যৌতুকের লোভে অনেকেই নিম্ন জাতের ভিতর হইতে কন্যাগ্রহণেও আপত্তি করিতেন না।

দোহাকোষে একটি অর্থবহ দোহা আছে। পরনারীতে আসক্ত পুরুষদের দোহাকার উপদেশ দিতেছেন:

নিঅ ঘরে ঘরিণী জাব ণ মজ্জই।
তাব কি পঞ্চবণ্ণ বিহারিজ্জই॥

নিজের ঘরে আপন গৃহিণী যে পর্যন্ত না মজেন সে পর্যন্ত কি পঞ্চবর্ণে বিহার করা যায়?

বঙ্গাল দেশের সঙ্গে বোধ হয় তখনও পশ্চিম ও উত্তরবঙ্গের বিবাহাদি সম্পর্ক প্রচলিত ছিল না। তাহা ছাড়া, পশ্চিম ও উত্তরবঙ্গবাসীরা বোধ হয় বঙ্গালবাসীদের খুব প্রীতির চক্ষেও দেখিতেন না। সরহপাদের একটি দোহায় আছে: “বঙ্গে জায়া নিলেসি পরে ভাগেল তোহর বিণাণা”, অর্থাৎ, বঙ্গে (পূর্ববঙ্গ হইতে) লইয়াছিস স্ত্রী, পরে (তাহার ফলে) ভাগিল তোর বিজ্ঞান (তোর বুদ্ধি গেল খোয়া) । ভুসুকুপাদের একটি গানে আছে, ভুসুকু যেদিন চণ্ডালীকে নিজের গৃহিণী করিলেন সেদিন তিনি যথার্থ ‘বঙ্গালী’ হইলেন । অর্থ বোধ হয় এই যে, আগে শুধু জন্মে ‘বঙ্গালী’ ছিলেন, চণ্ডালীকে যোগসঙ্গিনী করায় যথার্থ ‘বঙ্গালী’ হইলেন ।

 

শবর-শবরী এবং অন্যান্য অন্ত্যজ বর্ণের জীবনযাত্রা

শবরদের সম্বন্ধে নানা অধ্যায়ে নানা প্রসঙ্গে নানা কথা বলা হইয়াছে। চর্যাগীতির একাধিক গীতে ইহাদের দৈনন্দিন জীবনযাত্রা সম্বন্ধে অনেক তথ্য জানা যায়। ইহারা বাস করিতেন বড় বড় পাহাড়ের সুউচ্চ শিখরচুড়ায় (বরগিরিসিহর উত্ত্বঙ্গ মুণি সবরে জহি কিঅ বাস– কাহ্নপাদ)। ধর্মকর্ম অধ্যায়ে পর্ণশবরীর ধ্যান-প্রসঙ্গে শবরপাদের একটি গীত উদ্ধার করিয়াছি, এই গীতটিতে শবর-শবরীদের পাহাড়ী জীবনযাত্রার সুন্দর বর্ণনা-আছে। জনবসতি হইতে দূরে উঁচু পাহাড়ে শবর-শবরীদের বাস; শবরী গুঞ্জার মালা পরেন গলায়, কটিতে জড়ান ময়ূরের পাখ, কানে পরেন কুণ্ডল। উন্মত্ত শবর নেশার ঝোকে শবরীকে যান ভুলিয়া; তখন শবরী তাহাকে ডাকিয়া আনিয়া আবার ঘর সামলান। কুঁড়ে ঘরে খাটিয়ার উপর তাহাদের সুখশয়ন; সেই খাটিয়ায় নিবিড় তাহাদের মিলন। তাম্বুল (পান) আর কপূর তাহদের পূর্বরাগের উপাদান। শরধনু লইয়া শিকার তাহাদের জীবিকা। এক একদিন শবর রাগ করিয়া অনেকদূরে পাহাড়ের গুহায় চলিয়া যান; শবরী তখন একা একা তাহাকে খুঁজিয়া বেড়ান। এই শবরপাদেরই (ইনি কি নিজেই শবর ছিলেন?) আর একটি গীত আছে শবরদের জীবনযাত্রা সম্বন্ধে; এ চিত্রটিও সুন্দর ও বস্তুময়।

গঅণত গঅণত তইলা বাড়ী হিয়েঁ কুরাড়ী।
কণ্ঠে নৈরামণি বালি জাগন্তে উপাড়ী৷
… …
হেরি সে মোর তইলা বাড়ী খসম সমতুলা।
সুকড় এ সেরে কপাসু ফুটিলা।
… …
কঙ্গুচিনা পাকেলা রে শবর-শবরী মাতেলা।
অনুদিন শবরো কিম্পিন চেবই মহাসুহোঁ ভোলা৷
চারিপাসেঁ ছাইলারে দিয়া চঞ্চালী।
তহিঁ তোলি শবরে ডাহ কএলা কান্দই সগুণ শিআলী॥

পাহাড়ের উপর প্রায় আকাশের গায়ে শবর-শবরীর বাড়ি; বাড়ির চারধারে কার্পাস গাছে ফুল ফুটিয়া আছে। চিনা ধান (কাগনী ধান) পাকিয়াছে, আর শবর-শবরীদের জীবনে উৎসব লাগিয়াছে। চারিদিকে শকুন আর শেয়ালের বড় উপদ্রব; ইহারা ক্ষেতে পড়িয়া পক্ক শস্য নষ্ট করে; বাঁশের চাঁচারীর বেড়া দিয়া সেই জন্য চিনা ধানের ক্ষেত রক্ষা করিতে হয়। ইঁদুরের উপদ্রবও ছিল; একটি চর্যাগীতে তাহারও ইঙ্গিত আছে।

ডোম, নিষাদ প্রভৃতিরা গ্রামের বাহিরে উঁচু জায়গায় বাস করিতেন; ব্রাহ্মণ প্রভৃতি উচ্চবর্ণের লোকেরা ইঁহাদের ছুঁইতেন না। নৌকায় ছিল ইঁহাদের যাওয়া আসা; বাঁশের তাঁত, চাঙাড়ি ইত্যাদি তৈরি ও বিক্রয় ছিল ইঁহাদের বৃত্তি। নলের তৈরি পেটিক ছাড়িয়া লোকেরা বাঁশের এই সব জিনিস কিনিত। একাধিক চর্যাগীতে এই সব উক্তির সাক্ষ্য বিদ্যমান। বাঙলাদেশের নানা জায়গায় এই ধরনের নিম্নজাতীয় যাযাবর নরনারী আজও দেখা যায়; নৌকাই ইহাদের বাড়িঘর, এবং আজও বাঁশের নানা জিনিস তৈরি করিয়া গ্রামে গ্রামে বিক্রয় করা ইহাদের ব্যবসা। মৎস্যজীবী, তন্তুবায়, ধুনুরী, সূত্রধর প্রভৃতি বৃত্তির টুকরোটাকরা ছবিও দৃষ্টিগোচর হয়। অন্যত্র নানাপ্রসঙ্গে সে সব উল্লেখ করিয়াছি। একটি গীতে সূত্রধর বা ছুতোর সম্বন্ধে বলা হইয়াছে—“জো তরু ছেব ভেবউ ন জানই”, যে গাছ ছেদন ও ভেদনের কৌশল জানেনা। স্পষ্টতই বোঝা যাইতেছে, এই দুই কর্মেরই একটা বিশেষ কৌশল ছিল যাহা সকলের আয়ত্ত ছিল না।

অন্ত্যজ বর্ণের যাযাবর ডোম-শবর-পুলিন্দ-নিষাদ-বেদে প্রভৃতিদেরই অন্যতম বৃত্তি ছিল সাপ-খেলানো, যাদুবিদ্যার নানা খেলা দেখানো ইত্যাদি। সাপের উপদ্রব খুবই ছিল; মনসা-পূজাই তাহার অন্যতম সাক্ষ্য। রাজসভায় জাঙ্গলিক বা বিষবৈদ্য অন্যতম রাজপুরুষ ছিলেন; জাঙ্গুলি সাপেরই অন্য নাম। সাপের কামড়ে অনেককেই প্রাণ দিতে হইত; সেই জন্য ওবা বা বিষবৈদ্যদের সমাজে একটা স্থান ছিল; ইঁহারাই ছিলেন সাপুড়ে। উমাপতিধরের একটি শ্লোকে এই সাপ খেলানোর সুন্দর বর্ণনা আছে।

ক্ষুদ্রাস্তে ভূজগাঃ শিরাংসি নময়ত্যাদায় যেষামিদং
ভ্রাতর্জাঙ্গলিক ত্বদাননমিলন্মস্থানুবিন্ধং রজঃ।
জীর্ণস্তেষফণীন যস্য কিমপি ত্বাদৃগগুণীন্দ্ৰব্ৰজা-
কীর্ণক্ষ্মাতলধাবনাদপি ভজতানম্রভাবং শিরঃ।।

ভাই জাঙ্গলিক (সাপুড়ে), তোমার এই সাপগুলি ছোট ছোট; তোমার মুখের মন্ত্রপড়া ধূলি ইহাদের মাথা নমিত করিয়া দিতেছে। এই ফণাধারী সাপটি বোধ হয় জীর্ণ (অর্থাৎ প্রবীণ বা অভিজ্ঞ), কেননা তোমার মতো গুণী দ্বারা পূর্ণ মাটিতে ধাবন করিয়াও ইহার মাথা নম্রভাব হইতেছে না (অর্থাৎ নমিত হইতেছে না)।

গোবর্ধন আচার্যের একটি শ্লোকে আছে:

কিং পরজীবৈর্দীব্যসি বিস্ময়মধুরাক্ষি গচ্ছ সখি দূরম্‌।
অহিমধিচত্বরগগ্রাহী খেলয়তু নির্বিঘ্ন।।

হে সখি, সাপ খেলা দেখিতে দেখিতে তোমার চোখ বিস্ময়ে বিস্ফারিত হইয়া মধুরতর দেখাইতেছে। অতএব, কেন তুমি পরের জীবনকে বিপদাপন্ন করিতেছ? তুমি দূরে সরিয়া যাও, সাপুড়ে প্রাঙ্গণে নির্বিঘ্নে সাপ খেলা দেখাক।

সর্বানন্দ বলিতেছেন, বেদিয়ারা সাপখেলা দেখাইয়া ভিক্ষা করিয়া বেড়াইত।