০১. দৈনন্দিন জীবন – যুক্তি । উপাদান

একাদশ অধ্যায় – দৈনন্দিন জীবন
প্রথম পরিচ্ছেদ – যুক্তি । উপাদান 

যুক্তি

দৈনন্দিন ব্যবহারিক জীবন, আমাদের প্রতিদিনের অশন-বসন, বিলাস-ব্যসন, চলন-বলন, আমোদ-উৎসব, খেলাধূলা প্রভৃতি যে আমাদের মনন ও কল্পনা, অভ্যাস ও সংস্কারকে ব্যক্ত করে, অর্থাৎ এ-গুলি যে আমাদের মানস-সংস্কৃতির পরিচয় বহন করে, এ-সম্বন্ধে আমরা যথেষ্ট সচেতন নয়। কোনো দেশকালবদ্ধ নরনারীর মনন-কল্পনা, ধ্যান-ধারণা, চিন্তা-ভাবনা প্রভৃতি শুধু ধর্মকর্ম-শিল্পকলা-জ্ঞানবিজ্ঞানেই আবদ্ধ নয় এবং ইহাদের মধ্যে শেষও নয়। জীবনের প্রত্যেকটি কর্মে ও ব্যবহারে, শীলাচরণ ও দৈনন্দিন ব্যবহারিক জীবনচর্যার মধ্যেও তাহা ব্যক্ত হয়। চর্চা যেমন সংস্কৃতির লক্ষণ, চর্যা বা আচরণও তাঁহাই, বরং এক হিসাবে চর্যা বা আচরণই চর্চাকে সার্থকতা দান করে, এবং উভয়ে মিলিয়া সংস্কৃতি গড়িয়া তোলে। চর্যার ক্ষেত্র সুবিস্তৃত। জীবনের এমন কোনো দিক বা ক্ষেত্র নাই যেখানে মানুষ মনন-কল্পনা বা ধ্যান-ধারণালব্ধ গভীর সত্য ও সৌন্দর্যকে জীবনের আচরণে ফুটাইয়া তুলিতে না পারে। দৈনন্দিন জীবনাচরণের ভিতর দিয়া এই সত্য ও সৌন্দর্যকে প্রকাশ করাই তো সংস্কৃতির মৌলিক বিকাশ। দৈনন্দিন জীবনের ব্যবহারিক দিকটায় এই আচরণ যতটুকু প্রকাশ পায় তাহার সবটুকুই সেই হেতু মানুষের মানস-সংস্কৃতিরই পরিচয়, এবং বোধ হয় তাহার মৌলিক পরিচয়ও বটে।

প্রাচীন বাঙলার মানস-সংস্কৃতির কথা বলিতে বসিয়া সেইজন্য দৈনন্দিন জীবনচর্যার কথাই সর্বাগ্রে বলিতেছি। কিন্তু, এই দৈনন্দিন জীবনের চলমান জীবন্তরূপ ফুটাইয়া তুলিবার উপায় তথ্যগত ইতিহাস-রচনায় নাই। সেই চলমান মানবপ্রবাহের জীবন্তরূপ সমসাময়িক কোনো সাহিত্যে কেহ ধরিয়া রাখেন নাই; অন্তত তেমন উপাদান আমাদের সন্মুখে উপস্থিত নাই। তবু, তথ্যগত ইতিহাসের উপর নির্ভর করিয়া আধুনিক সাহিত্য-রচয়িতারা সেদিকে কিছু কিছু সার্থক চেষ্টা করিয়াছেন। রাখালদাস বন্দ্যোপাধ্যায় মহাশয়ের ঐতিহাসিক উপন্যাস ‘শশাঙ্ক’ ও ‘ধর্মপাল’, হরপ্রসাদ শাস্ত্রী মহাশয়ের ‘বেণের মেয়ে’ সে-চেষ্টার উৎকৃষ্ট নিদর্শন। কিন্তু ঔপন্যাসিকের যে সুবিধা ঐতিহাসিকের তাহা নাই। কাজেই সে-চেষ্টা করিয়া লাভ নাই। আমি এই অধ্যায়ে দৈনন্দিন জীবনচর্যার যে-সব দিক ও ক্ষেত্র সম্বন্ধে নির্ভরযোগ্য সংবাদ বর্তমান শুধু সেই সব দিক সম্বন্ধে সংক্ষিপ্ত আলোচনার অবতারণামাত্র করিতেছি। কালক্ৰমানুযায়ী সবিস্তারে বলিবার মতো যথেষ্ট উপাদান আমাদের নাই আহার-বিহার, বসন-ভূষণ, খেলাধূলা, আমোদ-উৎসব প্রভৃতি সম্বন্ধে কিছু কিছু বিচ্ছিন্ন তথ্য শুধু বর্তমান। বিশেষ ভাবে এ-সব সংবাদ বহন করিবার জন্য কোনও গ্রন্থ সমসাময়িক কালে কেহ রচনা করেন নাই; অস্তত এ-যাবৎ আমরা জানি না। এমন কাব্য বা কাহিনীও কিছু নাই যেখানে সাধারণ মানুষের দৈনন্দিন জীবনযাত্রার সুসংবদ্ধ এবং সমগ্র পরিচয় কিছু পাওয়া যায়। স্পষ্টতই, যে-সব তথ্য আমরা পাইতেছি তাহ সমস্তই প্রায় পরোক্ষ, অর্থাৎ অন্য প্রসঙ্গের আশ্রয়ে যতটুকু উল্লিখিত ততটুকুই।

 

উপাদান

দ্বিতীয় অধ্যায়ে বলিয়াছি, আমাদের ব্যবহারিক ও সাংস্কৃতিক দৈনন্দিন জীবনের মূল অষ্ট্রিক ও দ্রবিড় ভাষাভাষী আদি কৌমসমাজের মধ্যে। সেই হেতু আমাদের দৈনন্দিন জীবনের প্রাচীনতম আভাস এই দুই ভাষার এমন সব শব্দের মধ্যে পাওয়া যাইবে যে-সব শব্দ ও শব্দ-নির্দিষ্ট বস্তু আজও আমাদের মধ্যে কোনও না কোনও রূপে বর্তমান। এই ধরনের কিছু কিছু শব্দের আলোচনা ইতিপূর্বেই করা হইয়াছে। আমাদের আহার-বিহার, বসন-ভূষণ ইত্যাদি সম্বন্ধে কিছু ইঙ্গিত এই সুদীর্ঘ শব্দেতিহাসের মধ্যে পাওয়া যাইবে। এই হিসাবে এই শব্দগুলিই আমাদের প্রাচীনতম ঐতিহাসিক উপাদান এবং নির্ভরযোগ্য উপাদানও বটে। প্রাচীন বৌদ্ধ ও জৈন-সাহিত্যেও কিছু পরোক্ষ উপাদান পাওয়া যায়, কিন্তু দুই একটি বিষয়ে ছাড়া এই সব উপাদান কতটা বাঙলাদেশ সম্বন্ধে প্রযোজ্য, নিঃসংশয়ে বলা কঠিন। কৌটিলোর অর্থশাস্ত্র ও বাৎস্যায়নের কামশাস্ত্র জাতীয় গ্রন্থেও কিছু কিছু সংবাদ ইতস্তত বিক্ষিপ্ত; শেষোক্ত গ্রন্থটির সংবাদ অপেক্ষাকৃত বিস্তৃততর, বিশেষ ভাবে বিলাস-বাসন ও কামচৰ্চা সম্বন্ধে, এবং বাঙলার নাগর-সভ্যতার প্রথম নির্ভরযোগ্য জীবনতথ্য এই গ্রন্থেই জানা যায়। এই দুইটি গ্রন্থ ছাড়া গুপ্তপূর্ব ও গুপ্ত-পর্বের বাঙলার দৈনন্দিন জীবনের কোনও খবর আর কোথাও দেখিতেছি না। গুপ্ত-পর্ব হইতে আরম্ভ করিয়া আদিপর্বের শেষ পর্যন্ত অসংখ লিপিমালায় আমাদের আহার্য ও পরিধেয়, বিভিন্ন অর্থনৈতিক স্তরে সাংসারিক জীবনের মান, সাংসারিক আদর্শ সম্বন্ধে টুকরো-টাকরা ইতস্তত বিক্ষিপ্ত সংবাদ একেবারে দুর্লভ নয়। কিন্তু সর্বাপেক্ষা বিস্তৃত ও নির্ভরযোগ্য তথ্য পাওয়া যায় সমসাময়িক প্রস্তর ও ধাতব দেবদেবীর মূর্তিগুলিতে এবং পোড়ামাটির অসংখ্য ফলকে, বিশেষভাবে শেষোক্ত উপাদানসমূহে । দেবদেবীর মূর্তিগুলি প্রায় সমস্তই প্রতিমা-লক্ষণ শাস্ত্রদ্বারা নিয়মিত ; সেই হেতু দেবদেবীদের বেশভুষা, অলংকরণ, দেহসজ্জা প্রভৃতিতে জীবনের যে চিত্র দৃষ্টিগোচর তাহা কতকটা আদর্শগত, ভাবমূলক ও প্রথাবদ্ধ মনন-কল্পনা দ্বারা রঞ্জিত ও প্রভাবিত হওয়া অসম্ভব নয় । কিন্তু পাহাড়পুরের অথবা ময়নামতীর বিহার-মন্দির-গাত্রের অগণিত পোড়ামাটির ফলকগুলি সম্বন্ধে এ কথা বলা চলে না । এই ফলকগুলিতে জনসাধারণের দৈনন্দিন জীবনযাত্রা তাহার অকৃত্রিম সারল ও বস্তুময়তায় প্রতিফলিত ; যে সব দিক সম্বন্ধে অন্যত্র কোনও সংবাদই প্রায় পাওয়া যায় না, লোকায়ত জীবনের সে সবদিকের নানা ছোট বড় তথ্য একমাত্র ইহাদের মধ্যেই দীপ্যমান। গ্রাম্য কৃষিজীবী সমাজের জীবনযাত্রার এমন সুস্পষ্ট ছবি আর কোথাও পাইবার উপায় নাই ।

পঞ্চম-ষষ্ঠ শতক হইতে আরম্ভ করিয়া দ্বাদশ-ত্রয়োদশ শতক পর্যন্ত দৈনন্দিন জীবনের কিছু কিছু খবর বাঙলার সুদীর্ঘ লিপিমালায়ও পাওয়া যায়। আহার-বিহার, বসন-ভূষণ এবং গ্রাম্য ও নগর-জীবন সম্বন্ধে বিচ্ছিন্ন তথ্য ইহাদের মধ্য হইতে আহরণ করা হয়তো কঠিন নয়, কিন্তু সে-সব তথ্য অধিকাংশ ক্ষেত্রে নানা কবি-কল্পনায়, নানা আলংকারিক অত্যুক্তিতে আচ্ছন্ন এবং কোনও কোনও ক্ষেত্রে হয়তো বহু অভ্যস্ত এবং সুপরিচিত রীতিপালন মাত্র, হয়তো যথার্থ বাস্তব জীবনের সঙ্গে তাহদের সম্বন্ধ শিথিল, অথবা একেবারেই নাই। বসন-ভূষণ এবং সাধারণ সামাজিক পরিবেশ সম্বন্ধে কিছুটা তথ্য অসংখ্য প্রস্তর ও ধাতব প্রতিমা-প্রমাণ হইতেও আহরণ করা সম্ভব, কিন্তু সে-সব তথ্য দৈনন্দিন ব্যবহারিক সাংস্কৃতিক জীবন সম্বন্ধে কতটা প্রযোজ্য নিঃসংশয়ে তাহ বলা কঠিন।

সর্বাপেক্ষা নির্ভরযোগ্য এবং বিস্তৃত খবর পাওয়া যায় সমসাময়িক সংস্কৃত ও প্রাকৃত অপভ্রংশ সাহিত্যে। বাঙলার সুবিস্তৃত স্মৃতি-সাহিত্য, বৃহদ্ধর্ম ও ব্রহ্মবৈবর্তপুরাণ, চর্যাগীতিমালা, দোহাকোষ, সদুক্তিকর্ণামৃত-ধৃত কিছু কিছু বিচ্ছিন্ন শ্লোক, প্রাকৃতপৈঙ্গলের কিছু কিছু শ্লোক, রামচরিত ও পবনদূতের মতন কাব্য প্রভৃতি গ্রন্থে সমসাময়িক বাঙালীর দৈনন্দিন জীবনের নানা তথ্য নানা উপলক্ষে ধরা পড়িয়াছে। কোনও সুসংবদ্ধ নিয়মিত বিবরণ কিছু নাই, কোনও বিশেষ দিক সম্বন্ধে পূর্ণাঙ্গ চিত্ৰও নাই; তবু এই সব গ্রন্থের ইতস্তত উল্লিখিত তথ্যাদি একত্র করিলে মোটামুটি একটা ছবি ধরিতে পারা হয়তো খুব কঠিন নয়। সদ্যোক্ত সমস্ত গ্রন্থেরই দেশকাল মোটামুটি সুনির্ধারিত, অর্থাৎ ইহাদের অধিকাংশই বাঙলাদেশে, এবং দশম হইতে দ্বাদশ-ত্রয়োদশ শতকের মধ্যে রচিত। শ্রীহর্যের নৈষধচরিতে দৈনন্দিন জীবন সম্বন্ধে কিছু বিস্তৃত সংবাদ পাওয়া যায়, কিন্তু তাহার বাঙালীত্ব সর্বজনগ্রাহ্য নয়। এ-সম্বন্ধে বিস্তৃত আলোচনার স্থান এই গ্রন্থ নয়, তবে নলিনীনাথ দাশগুপ্ত মহাশয় তাহার বাঙালীত্বের যে-সব যুক্তি ও প্রমাণ উপস্থিত করিয়াছেন তাহাতে নৈষধচরিতের বিবরণ বাঙলাদেশ সম্বন্ধে প্রযোজ্য নয়, একথা জোর করিয়া বলা যায় না। বিবাহ ও আহার-বিহার সম্বন্ধে কিছু কিছু রীতি-নিয়ম, কোনও কোনও তথ্য যেন বাঙলা দেশ সম্বন্ধেই বিশেষভাবে প্রযোজ্য বলিয়া মনে হয়। ভারতের অন্যত্র এসবের প্রচলন থাকিলেও শ্রীহর্ষ যেভাবে বর্ণনা দিতেছেন তাহাতে তো মনে হয়, তিনি বাঙালী হউন বা না হউন, এমন দেশখণ্ডের কথাই তিনি বলিতেছেন যেখানে এই সব রীতি, আচার, অভ্যাস ও সংস্কারের বহুল প্রচার বিদ্যমান, এবং সেই দেশখণ্ড হইতেছে বাঙলাদেশ।

অন্যান্য অধ্যায়ের মতো এ-অধ্যায়ে কালপর্বানুযায়ী তথ্য সন্নিবেশ করিয়া ধারাবাহিক একটা বর্ণনা দাড় করানো কঠিন; তথ্যই অত্যন্ত বিক্ষিপ্ত ও বিচ্ছিন্ন এবং তাহার অধিকাংশই দশম শতক পরবর্তী কালের; কিছু কিছু অবশ্য পূর্ববর্তী কালেরও, সন্দেহ নাই। কিন্তু পূর্ববর্তী বা পরবর্তীই হোক, এই অধ্যায়ের দৈনন্দিন জীবনের চিত্র মোটামুটিভাবে প্রাচীন বাঙলার সম্বন্ধে প্রযোজ্য, একথা বলিলে অন্যায় বলা হয় না। সুদীর্ঘ শতাব্দী ধরিয়া গ্রাম্য জীবনযাত্রার তেমন পরিবর্তন কিছু হইয়াছিল, এমন মনে হয় না।