প্রথম খণ্ড
দ্বিতীয় খণ্ড
তৃতীয় খণ্ড

৩২. গ্রামদেবতা ও মোহেনজোদারোর বসুমাতা

গ্রামদেবতা ও মোহেনজোদারোর বসুমাতা

মনিয়ার উইলিয়মস্(৪৯২), হপ্‌কিন্স(৪৯৩) ও প্রমুখ ইয়োরোপীয় বিদ্বানের প্রমাণ করতে চেয়েছিলেন যে, হিন্দুধর্মে আৰ্য-পূর্ব, বা তাঁদের পরিভাষায়, দ্রাবিড়-দের যদিই বা কোনো অবদান থাকে তাহলে তা নেহাতই নগণ্য এবং হিন্দুধর্মের যেটা হলো সবচেয়ে বীভৎস ও কুৎসিত দিক সেইটুকুই ওই অনার্যদের অবদান। অপরপক্ষে ওপ্পার্ট(৪৯৪) প্রমুখ গবেষকের হিন্দুধর্মের ক্ষেত্রে এই অনার্যদের অবদানটাকেই বড়ো করে দেখাবার চেষ্টা করেছেন।

মোহেনজোদারো ও হরপ্পা আবিষ্কার হবার পর, স্যর্‌ জন মার্সাল(৪৯৫) বললেন, এই পুরোনো মতদ্বৈতের উপর নতুন আলোকপাত হলো; কেননা মোহেনজোদারো ও হরপ্পায় খুঁজে পাওয়া গেলো প্রাক্-আর্য যুগের বাস্তব কীর্তি। এই প্রসঙ্গে প্রাক্-আর্য যুগের যে বাস্তব কীর্তিগুলিকে স্যর্‌ জন মার্সাল সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ও মূল্যবান মনে করলেন তা হলো অজস্র পোড়ামাটির ছোটোছোটো নারীমূর্তি। এই জাতীয় নারীমূর্তি হরপ্পা এবং মোহেনজোদারো উভয় স্থানেই পাওয়া গেলে—শুধু তাই নয়, বেলুচিস্তানের স্থান-বিশেষেও প্রত্নতত্ত্বমূলক খননকাজের ফলে এই জাতীয় বহু মূর্তি আবিষ্কৃত হয়েছে। স্যর্‌ জন অনুমান করেছেন, এগুলির মধ্যে কয়েকরকম মূর্তিকে হয়তো নিছক খেলার পুতুল মনে করা যেতে পারে; কিন্তু সবগুলিকে পুতুলমাত্র মনে করবার অবকাশ নেই। এগুলির মধ্যে কয়েক-রকম মূর্তির সঙ্গে ধর্মবিশ্বাসের যোগাযোগ থাকবার সম্ভাবনা খুবই বেশি। দৃষ্টান্ত হিসেবে স্যর জন উল্লেখ করছেন, একরকম নারীমূর্তির কোলে সন্তান, আর একরকম নারীমূর্তির গর্ভে সন্তান। এবং তিনি মন্তব্য করছেন, সন্তান-কামনায় মেয়েরা হয়তো ওই রকম সন্তানবতীর মূর্তি মানত করতো। আজো ভারতবর্ষের পিছিয়ে-পড়া অঞ্চলে, নজির হিসেবে স্যর জন বলছেন, মাতৃত্বের কামনায় মাতৃমূর্তি মানত করবার প্রথা দেখা যায়। তাই তাঁর মতে এগুলির ব্যাখ্যা হলো : ex-voto offerings, perhaps with a magical significance, for the purpose of procuring offspring। এইখানে বলে রাখা যায়, অনুরূপ দৃষ্টান্তের আলোচনা-প্রসঙ্গে অধ্যাপক জর্জ টম্‌সন(৪৯৬) দেখাচ্ছেন, এ-জাতীয় দৃষ্টান্তকে মানত-মূলক মনে করা অসঙ্গত; কেননা, এর মূলে রয়েছে জাদুবিশ্বাস এবং ধ্যানধারণার ক্রমবিকাশের দিক থেকে মানতমূলক মনোভাবের চেয়ে এই জাহুবিশ্বাস অনেক প্রাচীন পর্যায়ের পরিচায়ক। সেদিন থেকে, ex-voto offerings এবং magical significance—এই দুটি কথা পরস্পর-বিরোধী হতে পারে। তাছাড়া, একটু পরেই স্যর জন নিজেই দেখাচ্ছেন, সন্তান কামনা ছাড়াও এই মাতৃমূর্তিগুলির সঙ্গে ফসল-কামনা মূলক জাদুবিশ্বাসের যোগাযোগ থাকা খুবই সম্ভব।

অবশ্যই, স্যর জন বলছেন, হরপ্পা-মোহেনজোদারোতে পাওয়া নারীমূর্তির মধ্যে বেশির ভাগই হলো এক-ধাঁচের : প্রায় নগ্ন, দাঁড়ানো ভঙ্গি, পরিপাটি করে চুল বাঁধা, ইত্যাদি। বেলুচিস্তান অঞ্চল থেকে পাওয়া নারীমূর্তিগুলির সঙ্গে এগুলির তফাত আছে। বেলুচিস্তানের মূর্তিগুলি পূর্ণাঙ্গ নারীমূর্তি নয় : মাথা, ধড় এবং তারপর শেষ—মিনোয়ান ও মিসিনিয়ান মাতৃদেবীদের মতো। পরের যুগের বসুমাতার বা Earthgoddess-এর সঙ্গে এই মূর্তিগুলির মিল খুব বেশি।

পার্সিয়া থেকে শুরু করে ইজিয়ন পর্যন্ত সুবিস্তীর্ণ দেশ জুড়ে বহু জায়গাতেই ওই সিন্ধু-উপত্যকা ও বেলুচিস্তান থেকে পাওয়া মাতৃমূর্তির অনুরূপ মূর্তি পাওয়া গিয়েছে : ইলাম, মেসোপটেমিয়া, ট্রান্সক্যাসপিয়া, এসিয়ামাইনর, সিরিয়া, প্যালেস্টাইন, সাইপ্রাস, ক্রিট, বালকান, ইজিপ্ট। স্তর, জন বলছেন, এই মূর্তিগুলি সম্বন্ধে সাধারণত বলা হয়, এগুলি হলো মহামাতৃমূর্তি (Great Mothers) of rosextet; মূর্তি (Nature Goddess),আনাতোলিয়ায় এই মাতৃতন্ত্রের উদ্ভব হয়েছিলো এবং তারপর তা পশ্চিম এসিয়ার নানা দিকে ছড়িয়ে পড়েছে : মাইরেস্-এর ধারণায় এই মাতৃতন্ত্র আনাতোলিয়া বা সিরিয়া থেকে মেসোপটেমিয়ার দিকে বিস্তৃত হয়েছিলো, দ্য-মর্গান মনে করেন মেসোপটেমিয়া থেকেই এগুলি পশ্চিম দিকে বিত্তারলাভ করেছিলো। স্যর জন মার্সাল বলছেন, বেলুচিস্তান এবং সিন্ধু উপত্যকায় এই মাতৃতন্ত্রের পরিচয় পাবার দরুন প্রমাণ হলো যে, এর আগে পর্যন্ত ওই মাতৃতন্ত্রের বিস্তার যতোটুকু মনে হতো, আসলে তার চেয়ে বিস্তারটা অনেক বেশি : পৃথিবীর যে-দেশই এর জন্মস্থান হোক না কেন, এ-বিষয়ে কোনো সন্দেহ নেই যে, নব্যপ্রস্তর যুগেই—এমন কি হয়তো প্রত্ন-প্রস্তরযুগেও প্রাচ্যের বহুদূর পর্যন্ত তার প্রভাব বিস্তৃত হয়েছিলো। ইতিপূর্বে অন্যত্র যে-সব মাতৃমূর্তি পাওয়া গিয়েছে সেগুলির সঙ্গে সিন্ধুসভ্যতার মাতৃমূর্তিগুলির সাদৃশ্য অত্যন্ত গভীর; তাই এ-সিদ্ধান্ত সংবরণ করা কঠিন যে, . সিন্ধুসভ্যতার ওই মূর্তিগুলিও বসুমাতার মূর্তিই এবং পশ্চিমাঞ্চলের অনুরূপ মূর্তি যে-উদ্দেশ্য সাধন করেছে এগুলিও নিশ্চয়ই তা সাধন করতো। হরপ্পা-মোহেনজোদারো আবিষ্কৃত হবার পর এই সিদ্ধাস্তের গুরুত্ব অত্যন্ত বেড়ে গেলো; কেননা দেখা গেলো নীল-নদ থেকে সিন্ধু-নদ পর্যন্ত সুবিস্তীর্ণ ভূখণ্ড জুড়ে একটানাভাবে—যে-ভূখণ্ড শুধুমাত্র ভৌগোলিকভাবেই সংযুক্ত নয়, তাম্র-প্রস্তর যুগে যার মধ্যে সংস্কৃতিক যোগাযোগও বর্তমান ছিলো,—এই মাতৃমূর্তিগুলি মাটি চাপা পড়ে রয়েছে। এই জাতীয় মাতৃকা সম্বন্ধে স্যর জন মার্সাল(৪৯৭) মন্তব্য করলেন :

ওই হলো মাতৃকা বা মহামাতৃকা এবং “প্রকৃতির” নমুন—ষে-প্রকৃতি থেকে ক্রমশ “শক্তি’র উদ্ভব হয়েছিলো। গ্রামদেবতারা তারই প্রতিনিধি। এই গ্রামদেবতাদের নাম বহু প্রকারের এবং স্থানবিশেষে তাদের গুণাগুণের মধ্যেও পার্থক্য আছে, কিন্তু তারা প্রত্যেকে একই শক্তির মূর্ত বিগ্রহ।–এই মাতৃক জননশক্তির স্রষ্টা। পশ্চিম এসিয়ার মাতৃকাদেবীদের মতোই এগুলিরও উদ্ভব যে মাতৃপ্রধান সমাজে হয়েছিলো সে-কথা খুবই সম্ভবপর মনে হয়। সে-সম্বন্ধে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত যাই হোক না কেন, এ-বিষয়ে কোনো প্রশ্নই ওঠে না যে, অনার্য দেশবাসীদের জাতীয় দেবদেবীদের মধ্যে এই মাতৃকারা খুব গুরুত্বপূর্ণ স্থান দখল করেছিলো। তার নানা রকম পরিচয় পাওয়া যায়। আদিম ট্রাইবদের মধ্যে এই মাতৃকাগুলির জনপ্রিয়তা চোখে পড়ে; তাছাড়া, এদের অনুষ্ঠান-উৎসবাদি ব্যাপারেও ব্রাহ্মণদের বদলে নীচজাতির অদূতেরা প্রধান অংশ গ্রহণ করে—উক্ত আছুতেরা পুরোনো ট্রাইবের লোক এবং তারাই জানে কেমন করে মানুষের কথা ওই মাতৃকাদের কর্ণগোচর করা যায়। আর্যপূর্ব ট্রাইবগুলির মধ্যে কোনো কোনোটি কখনোই হিন্দুধর্মের অন্তভূক্ত হয়নি। এই ট্রাইবগুলির মধ্যে মাতৃকা বা বস্থমাতার উপাসনা বিশেষ জোরালো হয়ে আছে দেখা যায়। বৈদিক পুরাণজগতে দেবীর অপ্রধান; বৈদিক আৰ্যদের বস্থমাতা পৃথিবী’ আসলে মহামাতৃকা বা দেবীমাতা থেকে সম্পূর্ণ স্বতন্ত্র।

মোহেনজোদারোর দেবীমূর্তি-প্রসঙ্গে স্যর জন মার্সালের ওই মন্তব্যগুলি আধুনিক ভারততত্ত্ববিদ-দের উপর অত্যন্ত ন্যায়সঙ্গতভাবেই গভীর প্রভাব বিস্তার করেছে। কেননা, প্রধানত এই মন্তব্যের নির্দেশ অনুসারে অগ্রসর হয়েই আধুনিক বিদ্বানদের মধ্যে অনেকে বলছেন, শাক্ত মতবাদ শুধুই যে আজকের দিনে আমাদের দেশে বেঁচে রয়েছে তাই নয়—এর ইতিহাস অনেক হাজার বছরের পুরানো। দ্বিতীয়ত, এ-মতবাদের বিকাশ অতীতকালে শুধুমাত্র আমাদের দেশের গণ্ডিটুকুর মধ্যেই আবদ্ধ ছিলো না, দেশান্তরেও তার বিকাশ ঘটেছিলো। যেমন মহামহোপাধ্যায় গোপীনাথ কবিরাজ(৪৯৮) বলছেন :

An enquiry into the ancient cultures would show that the cult of Sakti is very old in India as in other parts of the world. And it is quite possible that it existed along with Saiva and Pasupata cults in the days of the pre-historic IndusValley civilization. প্রাচীন সংস্কৃতি সংক্রান্ত অনুসন্ধানের ফলে দেখা যায়, শাক্ত পুজা-পদ্ধতি পৃথিবীর অন্যান্য দেশের মতোই ভারতবর্ষের ক্ষেত্রেও অত্যন্ত সুপ্রাচীন। খুব সম্ভব, প্রাগৈতিহাসিক সিন্ধু সভ্যতাতে শৈব ও পাশুপত পূজাপদ্ধতির পাশাপাশি এই শাক্ত পূজাপদ্ধতিও বর্তমান ছিলো।

তাই বলে এই শাক্ত-পূজাপদ্ধতিকে শুধুমাত্র অতীতের ঘটনা মনে করা চলবে না। মহামহোপাধ্যায় গোপীনাথ কবিরাজ(৪৯৯) তাই বলছেন :

The cult of Sakti produced a profound influence on general Indian thought. A topographical survey of India would show that the country is scattered over with numerous centers of Sakti-sadhana. It was widespread in the past and has continued unbroken till today.
শাক্ত-পূজাপদ্ধতি সামগ্রিকভাবে ভারতীয় চিন্তাধারার উপর অত্যন্ত গভীর প্রভাব বিস্তার করেছে। স্থানবিবরণের দিক থেকে ভারতবর্ষের আলোচনা করলে দেখা যায়, দেশের উপর অসংখ্য শক্তিসাধনার কেন্দ্র ছড়ানো রয়েছে। অতীতে এই শাক্ত-ধর্ম অত্যন্ত প্রবল ছিলো এবং আজকের দিন পর্যন্ত তা অবিচ্ছেদ্যভাবেই চলে আসছে।

আজো ভারতবর্ষের বুকে শক্তি-সাধনার কতো অসংখ্য কেন্দ্র ছড়ানো আছে তার নজির দেখাবার জন্যে মহামহোপাধ্যায় গোপীনাথ কবিরাজ স্যর জন উদ্রফের “শক্তি ও শাক্ত” গ্রন্থের উল্লেখ করেছেন। এ-বিষয়ে সন্দেহ নেই যে, উদ্রফ্‌ প্রমুখের গবেষণা অনুসরণ করে শক্তি-সাধনার কেন্দ্রের দিক থেকে ভারতবর্ষের একটি মানচিত্ৰ আঁকলে তা অত্যন্ত চিত্তাকর্ষক হবে। এবং স্যর জন মার্সালের মন্তব্যকে আমরা যদি গুরুত্ব দিতে প্রস্তুত থাকি তাহলে মানতে হবে শাক্ত ধ্যানধারণার সঙ্গে সম্ভবত মাতৃপ্রধান সমাজ-ব্যবস্থার যোগাযোগ ছিলো। ভক্টর এরেন্‌ফেস্‌ল্‌ মাতৃপ্রধান(৫০০) সমাজ-ব্যবস্থা ও তার স্মারকগুলির দিক থেকে ভারতবর্ষের বাস্তবিকই একটি মানচিত্র প্রস্তুত করেছেন। এই মানচিত্রের সঙ্গে শক্তি-সাধনার কেন্দ্রের দিক থেকে আঁকা আমাদের প্রস্তাবিত মানচিত্রটির তুলনা করলে শাক্ত ধ্যানধারণার উৎস সংক্রান্ত সমস্যার উপর নিশ্চয়ই আলোকপাত হতে পারে। দুঃখের বিষয়, মহামহোপাধ্যায় গোপীনাথ কবিরাজ মহাশয়ের চেতনায় এই তুলনামূলক পদ্ধতির কথা— এবং এর উপর নির্ভর করে বৈজ্ঞানিক জ্ঞানলাভের সম্ভাবনার কথা,—একবারও উদিত হয়নি। তার বদলে তিনি শাক্ত ধ্যানধারণার আলোচনা প্রসঙ্গে শুধুমাত্র নিগুঢ় অধ্যাত্মতত্ত্বের অন্বেষণেই আত্মনিয়োগ করেছেন। এবং ঠিক এই কারণেই তার অমন প্রগাঢ় পাণ্ডিত্য সত্ত্বেও শক্তি ও শাক্ত সম্প্রদায় সংক্রান্ত তাঁর আলোচনা বৈজ্ঞানিকভাবে ব্যর্থ হয়েছে। শাক্ত ধ্যানধারণার উপর বৈজ্ঞানিক আলোকপাত করবার বদলে তিনি শুধুই অধিবিদ্যামূলক কূট বিচারের অবতারণা করেছেন। অথচ, তাঁর রচনা থেকে যে-দুটি কথা উপরে উদ্ধৃত করেছি সেই দুটির প্রতিই তিনি যদি উপযুক্ত গুরুত্ব দিতে সম্মত হতেন তাহলে তাঁকে স্বীকার করতে হতো যে, শাক্ত ধ্যানধারণার আদি ও অকৃত্রিম রূপটির মধ্যে অধিবিদ্যামূলক ওই জাতীয় কূট তত্বের অন্বেষণ করাই অপ্রাসঙ্গিক ও বিজ্ঞান-বিরুদ্ধ প্রচেষ্টা হতে বাধ্য। কেন,—সে কথা স্পষ্টভাবে দেখা দরকার। স্যর জন মার্সালের মন্তব্য অনুসারে শাক্ত মতবাদের আদি-আকৃত্রিম রূপটিকে খুঁজে পাবার প্রধানত দু’রকম উপায় আছে। এক : হরপ্পা-মোহেনজোদারো এবং সে-আমলের সিন্ধু-নদ থেকে নীল-নদ পর্যন্ত সুবিস্তৃত ভূখণ্ড জুড়ে মাটি-খুঁড়ে-পাওয়া মাতৃমূর্তিগুলির তাৎপর্য নির্ণয় করে। দুই; আধুনিক ভারতবর্ষের ট্রাইব্যাল ও আধা-ট্রাইব্যাল অঞ্চলের গ্রামদেবতাগুলির তাৎপর্য নির্ণয় করে। অবশ্যই, এ-বিষয়ে কোনো সন্দেহ নেই যে, মধ্যযুগে রচিত তান্ত্রিক ও শৈবাদি পুঁথিপত্রের মধ্যে অধিবিদ্যামূলক তত্ত্বের পরিচয় পাওয়া যায়। কিন্তু এগুলি স্পষ্টই অধ্যারোপের ফল— প্রাগৈতিহাসিক ধ্যানধারণার উপর বা, যা একই কথা, সমাজ-বিকাশের অত্যন্ত প্রাচীন পর্যায়ের ধ্যানধারণার উপর মধ্যযুগীয় ও অপেক্ষাকৃত আধুনিক ধ্যানধারণার অধ্যারোপ। তান্ত্রিকাদি রচনায় এই জাতীয় অধিবিদ্যামূলক ধ্যানধারণা যে অধ্যারোপেরই পরিণাম তার একটি স্পষ্ট প্রমাণ হলো এই অধিবিদ্যামূলক ধ্যানধারণাগুলির মধ্যে অসংলগ্নতা ও পরস্পর-বিরোধিতা : বিভিন্ন বৌদ্ধসম্প্রদায়ের তত্ত্ব, বৈদাস্তিক তত্ত্ব প্রভৃতি নানা প্রকার তত্বের পরিচয় পাওয়া যায় তান্ত্রিক পুঁথিপত্রগুলির মধ্যে। তাই স্পষ্টই বোঝা যায়, উত্তরযুগে এই জাতীয় তত্ত্ব কৃত্রিমভাবে শাক্ত ধ্যানধারণার উপর আরোপিত হয়েছে বা এই জাতীয় তত্বের কাঠামোর মধ্যে কৃত্রিমভাবে শাক্ত ধ্যান ধারণাগুলিকে পুরে দেবার চেষ্টা করা হয়েছে। ফলে, শাক্ত মতবাদের আলোচনায় গবেষক যদি এই অধিবিদ্যামূলক কূট তত্ত্বের উপরই দৃষ্টি আবদ্ধ রাখেন,–দুঃখের বিষয়, মহামহোপাধ্যায় গোপীনাথ কবিরাজ তাই আবদ্ধ রেখেছেন,—তাহলে শাক্ত মতবাদকে উপলক্ষ্য করে হলেও তার আলোচনা প্রকৃতপক্ষে মধ্যযুগীয় কূট অধিবিদ্যার আলোচনাই হয়ে দাঁড়াবে,—মহামহোপাধ্যায় গোপীনাথ কবিরাজের আলোচনা যে-রকমটা হয়ে দাঁড়িয়েছে।

মোহেনজোদারো-প্রসঙ্গে স্যর জন মার্সালের মন্তব্যই আধুনিক বিদ্বানদের এ-বিষয়ে সচেতন করেছে যে, একদিকে মোহেনজোদারোর ওই নারীমূর্তিগুলি থেকে এবং অপরদিকে আধুনিক ভারতবর্ষের গ্রামদেবতাগুলির স্বরূপ-উপলব্ধির দিক থেকে—শাক্ত মতবাদের আদি-অকৃত্তিম রূপটিকে চেনবার

চেষ্টা করা যায়। তাই আমাদের পক্ষে এখানে সুস্পষ্টভাবে দেখা দরকার এ-বিষয়ে স্যর জন মার্সাল ঠিক কী বলছেন(৫০১) :

মোহেনজোদারো বা হরপ্পায় শক্তিবাদ সংক্রান্ত কোনো অপরোক্ষ প্রমাণ পাওয়া যায়নি। এই কথাটি আমি খুব স্পষ্টভাবে বলে রাখতে চাই। যেটুকু প্রমাণ আছে তা প্রধানতই ইংগিতমূলক। ভারতবর্ষে শক্তি উপাসনা অত্যন্ত সুপ্রাচীন। বসুমাতার পূজাপদ্ধতি থেকেই এর জন্ম এবং শিবপূজাপদ্ধতির সঙ্গে এর ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক। তাছাড়া, পশ্চিম-এসিয়ার রকমারি পূজাপদ্ধতির সঙ্গে এই শাক্ত উপাসনার কয়েকটি অঙ্গের সাদৃশ্য এত গভীর যে, আমরা তার কথা এড়িয়ে যেতে পারি না, বা, সিন্ধু উপত্যকার মানুষদের মধ্যে এর অস্তিত্বের সম্ভাবনাকে উড়িয়ে দিতে পারি না। শক্তিবাদের মূল কথা হলো, যৌন দ্বৈতভাব।…আদিম মাতৃকাউপাসনার এই বিকাশটির মধ্যে, দেবী পরিণত হয়েছেন নারী-শক্তির ব্যক্তিত্বসম্পন্ন রূপে (শক্তি) বা এক অনাদি সত্যে (প্রকৃতি); এবং চিরন্তন পুরুষ-তত্ত্বের (পুরুষ) সঙ্গে মিলিত হয়ে তিনি বিশ্বের এমনকি দেবতাদেরও স্রষ্টা ও মাতা হয়েছেন (জগন্মাতা বা জগদম্বা)। সর্বোচ্চ রূপের দিক থেকে তিনি হলেন মহাদেবী, শিবের সঙ্গিনী, যাঁর (শিবের) পুজোর সঙ্গে, আমরা আগেই বলেছি, শক্তিবাদ অবিচ্ছেদ্য সম্বন্ধে আবদ্ধ হয়েছিলো। তবুও তিনি শিবের স্রষ্টা ও শিবের চেয়েও বড়ো বলে কল্পিত হয়েছেন।…শক্তিবাদের অনেক তত্ত্ব ও আচার অনুষ্ঠান উত্তর যুগের হিন্দুধর্মের অবদান এবং তা প্রধানতই আর্য-প্রভাবের ফল। কিন্তু তার মৌলিক অঙ্গগুলি সুনিশ্চিতভাবেই অনার্য এবং এগুলি যৌন দ্বৈতের ধারণা থেকে উদ্ভূত–যে-যৌন-দ্বৈতের ধারণা, বাৰ্থ বলছেন, ভারতবর্ষের মতোই পুরোনো।

মেডিটারেনিয়ানের কিনারায়, এসিয়া মাইনর-এ, মাতৃকা-তন্ত্রের যে-বিকাশ দেখা যায় তার সঙ্গে শক্তিবাদের তুলনা করে স্যর জন মার্সাল(২০২) বলছেন:

মৌলিক ধ্যানধারণার দিক থেকে এই (এসিয়ামাইনরদের) পূজাপদ্ধতিগুলির সঙ্গে ভারতীয় শক্তিবাদের সাদৃশ্য যথেষ্ট স্পষ্ট। এই পূজাপদ্ধতিগুলির কেন্দ্রে আছেন মাতা বা প্রকৃতি দেবী, যিনি আত্মদেহ থেকে নিজের সঙ্গী দেবতাটির সৃষ্টি করেছেন–ঠিক যেমন ভারতবর্ষের দেবীমাতা শিবকে সৃষ্টি করলেন আর তারপর এই দেবতাটির সঙ্গে মিলিত হয়েই সবকিছুর জন্ম দিলেন…। ওই দেবীমাতার পূজাপদ্ধতির অঙ্গ হলো নির্বিচার যৌনমিলন ও রক্তবহুল বলিদান। এই পূজাপদ্ধতির সঙ্গে ভারতবর্ষীয় শক্তিপূজার আশ্চর্য সাদৃশ্যের কথা বহুদিন থেকেই স্বীকৃত হয়েছে; এবং একথাও স্বীকৃত হয়েছে যে, একজাতীয় সমাজ-ব্যবস্থা থেকেই (অর্থাৎ মাতৃপ্রধান সমাজ-ব্যবস্থা থেকেই) উভয়ক্ষেত্রে (অর্থাৎ ভারতবর্ষে এবং ভারতবর্ষের বাইরে) এই পূজাপদ্ধতির উদ্ভব হয়েছিলো : প্রাক্-আর্য যুগে ভারতবর্ষ ও নিকট-প্রাচ্য উভয় দেশেই মাতৃপ্রধান সমাজ ছিলো বলে অনুমান করা হয়। যে-কথাটি স্বীকার করা হয়নি—এবং হরপ্পা-মোহেনজোদারো আবিষ্কৃত হবার শুধুমাত্র পরই যা দেখতে পাওয়া সম্ভবপর হলে,—তাই যে, তাম্রপ্রস্তর যুগেও ভারতবর্ষ ও পশ্চিম-এসিয়া একই সংস্কৃতির বন্ধনে আবদ্ধ ছিলো!

সুদূর প্রাগৈতিহাসিক যুগে ভারতবর্ষের সঙ্গে পশ্চিম এসিয়ার সাংস্কৃতিক যোগাযোগ ছিলো কি না এবং যদিই বা ছিলো তাহলে তা ঠিক কোন ধরনের যোগাযোগ,—এ-বিষয়ে প্রত্নতত্বমূলক গবেষণার মূল্যকে ছোটো করবার প্রশ্ন নিশ্চয়ই ওঠে না। কিন্তু গবেষকের দৃষ্টি যদি শুধুমাত্র এই প্রশ্নটির উপর আবদ্ধ থাকে যে, ‘এ-দেশ থেকে শক্তিবাদ ওদেশে রপ্তানি হয়েছিলো, না, ওদেশ থেকে তা এদেশে আমদানি হয়েছিলো?’(৫০৩)—তাহলে তা আমাদের বর্তমান সমস্যা-প্রসঙ্গে অনেকাংশেই অবান্তর হতে বাধ্য। কেননা, এই আমদানি-রপ্তানি সংক্রান্ত প্রকল্পগুলির পরিণতি শেষ পর্যন্ত যাই হোক না কেন, বর্তমানে আমাদের কাছে সবচেয়ে প্রাসঙ্গিক প্রশ্ন হলো, সেই সুদূর অতীতে এই জাতীয় ধ্যানধারণা ও বিশ্বাস-অনুষ্ঠান ঠিক কোন ধরনের পার্থিব প্রয়োজন মেটাবার চেষ্টা করেছে? এই শক্তিবাদের বাস্তব কারণ ঠিক কী? কোন উদ্দেশ্য চরিতার্থ করবার চেষ্টায় মানবচেতনায় এই শক্তিবাদের আবির্ভাব হয়েছিলো? কোনো-না-কোনো বাস্তব কারণ নিশ্চয়ই ছিলো, নিশ্চয়ই ছিলো কোনো-না-কোনো পার্থিব প্রয়োজন মেটাবার তাগিদ। কেননা শক্তিবাদ– তথা, যে-কোনো রকম ধ্যানধারণাই হোক না কেন,—নিশ্চয়ই অকারণও হতে পারে না, স্বয়ম্ভুও হতে পারে না। মানুষের পক্ষে পারিপার্থিক পৃথিবীটাকে আয়ত্বে আনবার চেষ্টার পরিণাম হিসেবেই ধ্যানধারণার পক্ষে মানুষের চেতনায় আবির্ভূত হওয়া সম্ভবপর।

প্রত্নতাত্ত্বিকেরা বলছেন, সিন্ধুসভ্যতার ওই বসুমাতাগুলির সঙ্গে প্রাচীন পৃথিবীর অন্যান্য স্থানের বসুমাতাগুলির আশ্চর্য সাদৃশ্য আছে। যদি তাই থাকে তাহলে অনুমান করতে হবে, যে-উদ্দেশ্য সাধন করবার জন্য, যে-পার্থিব পরিবেশে, প্রাচীনকালের অন্যান্য দেশের মানুষেরা এই বসুমাতা মূর্তিগুলি গড়েছিলো, সেই উদ্দেশ্যেই প্রাচীনকালের সিন্ধুউপত্যকার মানুষেরাও গড়েছিলো তাদের বসুমাতা-মূর্তি। প্রত্নতত্ত্ববিদের যদি মূর্ত তথ্যের নির্ভরে সত্যিই প্রমাণ করেন যে, অন্যান্য দেশের শক্তিবাদ সিন্ধুসভ্যতার শক্তিবাদকে প্রভাবিত করেছিলো, কিংবা, সিন্ধুসভ্যতার শক্তিবাদ প্রভাবিত করেছিলো অন্যান্য দেশের শক্তিবাদকে,—তাহলেও, এই পার্থিব প্রয়োজন মেটানোর তাগিদটির কথা সত্যিই ছোটো হয় না। কেননা, ওই পার্থিব প্রয়োজনের দাবি মেটাবার তাগিদ ছাড়া কোনো মানবদলের মনেই এই শক্তিবাদের ঠাই হওয়া সম্ভব নয়(৫০৪)। ঘুরিয়ে বললে বলা যায়, দেশোদ্ভূতই হোক আর বিদেশাগতই হোক, শক্তিবাদের বিকাশের জন্য উপযুক্ত ক্ষেত্রের প্রয়োজন। এই ক্ষেত্রটির অভাবেই পশুপালনজীবী বৈদিক মানুষদের জীবনে শক্তিবাদের বিকাশ সম্ভবপর হয়নি। কিংবা, প্রত্নতত্ত্বেরই নজির রয়েছে যে, একই দেশে এবং একই জাতির জীবনে মৌলিক পরিবর্তন দেখা দেবার ফলে ওই বাস্তব-প্রয়োজনের তাগিদে রূপান্তর ঘটেছে—তাই শক্তিবাদের প্রভাবও বিলুপ্ত হয়েছে : এই জাতীয় নজির থেকে অনুমান করা যায়, শক্তিবাদের সম্যক-উপলব্ধি ব্যাপারে ওই পার্থিব প্রয়োজনের প্রসঙ্গটিই সবচেয়ে মৌলিক। অধ্যাপক জর্জ টমসনের(৫০৫) রচনা অনুসরণ করে এখানে কয়েকটি প্রত্নতত্ত্বমূলক দৃষ্টান্ত উল্লেখ করা যায়।

ডানিউব-সংস্কৃতির প্রথম পর্যায়ে (Phase I) সামান্য কিছু কিছু ছোটো স্ত্রীমূর্তি পাওয়া গিয়েছে। দ্বিতীয় পর্যায়ে এ-জাতীয় মূর্তি পাওয়া গিয়েছে অজস্র। তৃতীয় পর্যায়ে এ-জাতীয় মূর্তি অনুপস্থিত। তার মানে, ওই প্রাচীন সংস্কৃতির মামুষের যে-পার্থিব প্রয়োজনের দরুন এ-রকম মূর্তি গড়েছে, তৃতীয় পর্যায়ে পৌঁছবার পর সে-প্রয়োজনের তাগিদ নিশ্চয়ই কমে গিয়েছিলো। তাহলে প্রশ্ন ওঠে, এই তৃতীয় পর্যায়ের জীবন-যাপন পদ্ধতির বৈশিষ্ট্য কী? অধ্যাপক গর্ডন চাইল্ড দেখাচ্ছেন, তৃতীয় পর্যায়ের বৈশিষ্ট্য হলো, পশুপালন ও যুদ্ধবিগ্রহ। যদি ভাই হয় তাহলে সে-পর্যায়ে শুধুই যে মেয়েদের মহিমা ক্ষুণ্ণ হবার কথা তাই নয়, পৃথিবীতে উর্বর-শক্তি সঞ্চার করবার তাগিদও শিথিল হওয়া সম্ভবপর।

রুমানিয়ার গুমেলনিটা-সংস্কৃতির প্রথম পর্যায়ে দেখা যায় ছোটো ছোটো অজস্র মৃত্তিকা-মূর্তি—সমস্তই নারীমূর্তি। দ্বিতীয় পর্যায়ে নারীমূর্তির অভাব নেই কিন্তু তারই সঙ্গে পুরুষ-মুর্তির আবির্ভাবও চোখে পড়ে। ওমেলনিটা-সংস্কৃতির ধ্বংসস্তূপের উপর আর একটি পরবর্তী সংস্কৃতির স্বাক্ষর পাওয়া যায়। তার বৈশিষ্ট্য হলো, পাথরের তৈরী তীরের ফলক আর যুদ্ধের কুড়ুল। এই সংস্কৃতির স্বাক্ষরগুলির মধ্যে নারীমূর্তি চোখে পড়ে না।

অধ্যাপক জর্জ টম্‌সন এ-জাতীয় প্রত্নতত্ত্বমূলক আরো প্রমাণের উল্লেখ করছেন। সেগুলি পরীক্ষা করলে দেখা যায়, একই স্থানে এবং একই জাতির মানুষদের বেলায় জীবনধারণ পদ্ধতিতে মৌলিক পরিবর্তন দেখা দেবার ফলে এ-জাতীয় নারীমূর্তি রচনার প্রেরণাও ফুরিয়ে গিয়েছে। তার থেকেই অনুমান করা যায় যে, মাতৃমূর্তি-রচনার এই প্রেরণাটি মানবমনের কোনো শাশ্বত বা সনাতন বৃত্তির বিকাশ নয়; তার বদলে এর মূলে রয়েছে জীবনধারণ সংক্রান্ত পার্থিব প্রয়োজন। সেই একই প্রয়োজনের তাগিদে স্বতন্ত্র দেশের মানবদল পরস্পর নিরপেক্ষভাবেই মাতৃমূর্তি রচনায় মন দিতে পারে। কিংবা প্রত্নতত্ত্বের নজির থেকে যদি এ-কথা প্রমাণিত হয় যে, ওই সুদূর প্রাগৈতিহাসিক যুগে এ-দেশের মাতৃকাতন্ত্র ওদেশের মাতৃকাতন্ত্রকে প্রভাবিত করেছে তাহলেও, ‘এই প্রভাব কী করে সম্ভবপর হলো?’ সে-প্রশ্নের উত্তরে মানতেই হবে, জীবন-সংগ্রামের চাহিদার দরুন ওদেশের মানুষও নিশ্চয়ই একই পার্থিব প্রয়োজন বোধ করেছিলো—তা না হলে, এই মাতৃকাতন্ত্রের বিকাশের জন্য তাদের মনে উপযুক্ত জমিই তৈরি হবার কথা নয়।

স্যর জন মার্সালের যুক্তি অনুসরণ করে আমরা যদি এই মাতৃমূর্তিগুলিকে শক্তিবাদের বাস্তব প্রতীক বলে গ্রহণ করতে রাজি হই তাহলে আমাদের পক্ষে স্বীকার করা প্রয়োজন, শাক্ত-মতবাদের প্রকৃত তাৎপর্য হৃদয়ঙ্গম করবার কাজে সবচেয়ে গুরুতর প্রশ্ন হবে, এ-মতবাদ মানবউন্নতির কোন ধরনের পর্যায়ে ঠিক কোন ধরনের উদ্দেশ্য চরিতার্থ করতে চেয়েছিলো?

প্রত্নতত্ত্বলব্ধ ওই মাতৃমূর্তিগুলি যে উর্বর-শক্তির কামনাতেই রচিত হয়েছিলো—এ-বিষয়ে আধুনিক বিদ্বানদের মধ্যে অনেকেই সম্পূর্ণ নিঃসন্দেহ। কিন্তু ওই প্রাচীন মানুষদের কাছে উর্বরা-শক্তির কামনা বলতে ঠিক কী বুঝিয়েছে এবং এই মাতৃমূর্তিগুলির সাহায্যে তারা কী ভাবে সে-কামনা সফল করবার চেষ্টা করেছে—এ-বিষয়ে স্পষ্টতর ধারণা পাবার প্রয়োজন আছে।

আমরা ইতিপূর্বে দেখেছি, এ-বিষয়ে একটা মত হলো, মূর্তিগুলি মানতমূলক। মাতৃত্বের কামনায় মেয়েরা তখনকার কালে এ-জাতীয় মাতৃমূর্তি মানত করতো। শুধুই যে মোহেনজোদারোর মাতৃমূর্তিগুলি প্রসঙ্গে এই জাতীয় মানত-মূলক মনোভাবে অনুমান করা হয়েছে তাই নয়, প্রাগৈতিহাসিক গ্রীসের এ-জাতীয় মূর্তিকেও অনেকে মানত-মূলক মনে করেছেন। কিন্তু অধ্যাপক জর্জ টম্‌সন(৫০৬) দেখাচ্ছেন, এই মানত-মূলক উপচার (Votive offerings) বলে শব্দকে পরিহার করাই বাঞ্চনীয়। কেননা, তার দরুন, বিষয়টি সম্বন্ধে আমাদের একটা সংস্কারগত ধারণ হতে পারে। এ-কথায় কোনো সন্দেহ নেই যে, ওই মূর্তিগুলির মধ্যে বিশেষ করে পরের যুগের মূর্তিগুলি মানতমূলক বলেই মনে হয়; কিন্তু এগুলির সবই মানত-মূলক নয়। এবং,

…their neolithic antecedents must have belonged to predeistic cults in which the very idea of an offering was unknown(৫০৭).
এগুলির অগ্রবর্তী নব্যপ্রস্তরযুগের মূর্তিগুলি নিশ্চয়ই প্রাক্-ঈশ্বর পর্যায়ের অনুষ্ঠানাদির অন্তর্গত, ঘে-পর্যায়ে পুজোপচারের ধারণাটিই অজ্ঞাত ছিলো।

মানত করে এবং মনোবাঞ্ছা পূরণ হলে পর যে-পুজোপচার দেওয়া হয় তাকেই মানত-মূলক উপচার বলে : আপনি বিপদে পড়েছেন, আপনি তখন ঈশ্বরের কাছে প্রতিজ্ঞা করলেন যে, এই বিপদ থেকে উদ্ধার পেলে আপনি তাকে অমুক বা তমুক জিনিস দেবেন। প্রায়ই দেখা যায়, মনোবাঞ্ছা পূরণ হবার আগেই প্রতিশ্রুত দ্রব্য ঈশ্বরকে দেওয়া হচ্ছে। আজকের দিনে যাঁরা মানসিক করছেন তারা হয়তো এই বলে সান্ত্বনা পেতে পারেন যে, তাদের পক্ষে সবটাই ঈশ্বরভক্তির পরিচয়। আসলে কিন্তু তা নয়। এর মূলে রয়েছে অত্যন্ত আদিম পর্যায়ের এক জাতীয় বিশ্বাস ও অনুষ্ঠান। গ্রীসে গরু ভেড়ার রোগ হলে চাষিরা মাটির ষাঁড় গড়ে মন্দিরে দিয়ে আসতো, দেবী ডিমিটর যাতে মাটির ষাঁড় পেয়ে আসল ষাঁড়কে বাঁচিয়ে দেন। ঘটনাটিকে মানত হিসেবে দেখতে গেলে, দেবীকে খুশি করবার বদলে বরং বোকা বানাবার চেষ্টাই চোখে পড়ে : নকল ষাঁড়ের বদলে তার কাছ থেকে আসল ষাঁড় আদায় করে নেবার চেষ্টা। দেবীই বা কেমন বুদ্ধিমতী যে ওই রকম একটা বাজে জিনিস পেয়ে খুশি হয়ে তার বদলে অমন ভালো জিনিস দিয়ে বসবেন? আসল কথা হলো, এই পুরো ঘটনাটির পিছনে অত্যন্ত প্রাকৃত পর্যায়ের একরকম বিশ্বাস টিকে রয়েছে—তারই নাম জাদুবিশ্বাস। মনে রাখা দরকার, এই জাদুবিশ্বাসের সঙ্গে দেবদেবীকে তুষ্ট করবার বা খুশি করবার, করুণা চাওয়ার বা আশীৰ্বাদ চাওয়ার মৌলিক পার্থক্য রয়েছে। কেননা, জাদুবিশ্বাস হলো প্রাক্‌-অধ্যাত্মবাদী পর্যায়ের চেতনা। জাদুবিশ্বাসের মূল কথা, প্রার্থনা-উপাসনা নয়—তার বদলে প্রকৃতিকে বশ করবার চেষ্টাই। তার মধ্যে প্রায় সবটাই অবশ্য মনগড়া, কল্পনা। কিন্তু তবুও প্রার্থনা-উপাসনা নয়। বৃষ্টির একটা নকল তুলে আকাশে আসল বৃষ্টি ডেকে জানবার আয়োজন করা, বা শক্রর একটা মোমের মূর্তি পুড়িয়ে শক্রকে বিনাশ করবার চেষ্টা করা—এগুলি আর যাই হোক ঈশ্বরের কাছে আশীর্বাদ ভিক্ষা করা নয়। তেমনি, মাটি দিয়ে সুস্থ ষাঁড়ের নকল করে আসল ষাঁড়কেও সুস্থসবল করে তোলবার আয়োজন; তার মধ্যে বাস্তব প্রাকৃতিক জ্ঞানের অভাব যতোই বিকট হোক না কেন, কৃপাভিক্ষার মনোভাব নেই,–যদিও অবশ্যই উত্তরযুগে, আধুনিক আধ্যাত্মিক অর্থে দেবদেবীদের জন্ম হবার পর, ওই আদিম জাদু-বিশ্বাসটির উপর উত্তরযুগের প্রার্থনা-উপাসনার মনোভাব এসে জমেছে : দেবী ডিমিটর যেন নকল ষাঁড় পাওয়ার খুশিতেই আসল ও সুস্থ ষাঁড় ফিরিয়ে দেবেন(৫০৮)।

প্রাগৈতিহাসিক সংস্কৃতির স্মৃতিচিহ্ন ওই মাতৃমূর্তিগুলিকেও তাই মানত-মূলক মনে না করে জাদুবিশ্বাস-মূলক মনে করাই সঙ্গত ও স্বাভাবিক। এবং সে জার্হবিশ্বাসের মূল কথা শুধুমাত্র মানবীর পক্ষে সন্তান-কামনাই নয়— প্রকৃতির ফলপ্রসূতার কামনাও।

mohenjo daro mother goddess

স্যর জন মার্সাল যে-মূর্তিগুলিকে বিশেষ-করে মানত-মূলক উপচার বলে সন্দেহ করছেন সেগুলির মধ্যে প্রধানতই হলো, অস্তঃসত্ত্বা নারীর মূর্তি। মোহেনজোদারোর আমলে এই অন্তঃসত্ত্বা মাতৃমূর্তিগুলির তাৎপর্য মানত-মূলক হয়ে দাঁড়িয়েছিলো কিনা, সে-আলোচনা স্বতন্ত্র। তান্ত্রিকাদি ধ্যানধারণার আদি-তাৎপর্য অনুসন্ধানে আমাদের কাছে যে-বিষয়টি আপাতত সবচেয়ে প্রাসঙ্গিক তা হলো, এ-জাতীয় মূর্তিরচনার পিছনে আদিমতম মানববিশ্বাসের রূপটা কী রকম? কিংবা, কোন বিশ্বাস থেকে এই জাতীয় মূর্তি রচনার প্রেরণা জন্মেছে? আমাদের পদ্ধতি অনুসারে, সে-বিশ্বাসের সন্ধান পাওয়া যেতে পারে আজকের পৃথিবীতেও যে-সব মানবদল পিছিয়ে-পড়া দশায় আটকে রয়েছে, তাদের ধ্যানধারণা পরীক্ষা করলে। বস্তুত, স্যর জন মার্সালের নিজের মন্তব্য বিশ্লেষণ করলেও এ-জাতীয় একটা যুক্তির উপরই নির্ভর করার পরিচয় পাওয়া যায়। সিন্ধুসভ্যতার মাতৃমূর্তি প্রসঙ্গেই তিনি(৫০৯) বলছেন, এ-দেশের কোনো কোনো আর্য-পূর্ব ট্রাইব কখনোই হিন্দুত্বের আওতায় এসে পড়েনি। কিন্তু এই অসভ্য মানুষগুলির মধ্যেই যে সভ্য মানুষদের ভুলে-যাওয়া অতীতকে দেখতে পাওয়া যেতে পারে, স্যর জন মার্সাল সে-সম্ভাবনার উপর সচেতনভাবে জোর দেননি।

অস্তঃসত্ত্বা মানবী সংক্রান্ত একটি আদিম বিশ্বাস হলো, তার স্পর্শে প্রকৃতি ফলপ্রসূ হয়ে ওঠে।

জুলুদের(৫১০) মধ্যে দেখা যায়, শস্য-বৃদ্ধির কামনায় অন্তঃসত্ত্বা মেয়েরা শস্য পেশাই করে ক্ষেতের উপর ছড়িয়ে দিচ্ছে। সুমাত্রায় মিনাংদের(৫১১) মধ্যে প্রথা হলো, ধানের-গোলা তৈরি করবার সময় কোনো অন্তঃসত্ত্বা মেয়েকে কিছুটা চাল খেতে হবে, কেননা তাদের বিশ্বাস এইভাবেই ধানেধানে গোলা ভরে যাবে। নিকোবার দ্বীপের(৫১২) আদিবাসীদের বিশ্বাস, অন্তঃসত্ত্বা নারীর উপস্থিতির ফলে, বা বাগানে যদি অন্তঃসত্ত্বা নারী বৃক্ষরোপণ করে তাহলে বাগান সুফলা হবে। আদিম ও অসভ্য মানুষদের মধ্যে এ-জাতীয় ধারণা অত্যন্ত ব্যাপক এবং এমনকি ইয়োরোপের চাষীদের লোককথায় (৫১৩) আজো এ-জাতীয় বিশ্বাসের রেশ খুঁজে পাওয়া যায়।

The condition of the pregnant woman is often thought to have magical power, especially for fruitfulness……Probably for similar reasons pregnant cows were sacrificed at the Roman Fordicidia to the earth ‘pregnant with the seed’, the unborn calves burned, and their ashes used at the Parilia(৫১৪)।
বিশেষ করে প্রকৃতিকে সুফলা করবার ব্যাপারে প্রায়ই মনে করা হয়েছে যে, মানবীর অন্তঃসত্ব অবস্থার জাদুশক্তি আছে।..খুব সম্ভব এই কারণেই রোমান ফর্ডিসিডিয়ায় বীজগর্ত পৃথিবীর কাছে অন্তঃসত্বা গাভী বলি দেওয়া হতো, পেরিলিয়ায় বাছুরের ভ্রূণ পুড়িয়ে তার ছাই ব্যবহার করা হতো।

——————-
৪৯২. M. Monier-Williams RTLI 57-8.
৪৯৩. E. W. Hopkins RI542.
৪৯৪. Oppert OII 574.
৪৯৫. J. Marshall op. cit. 1:48.
৪৯৬. G. Thomson SAGS 246.
৪৯৭. J. Marshall op cit. 1:51.
৪৯৮. S. Radhakrishnan HPEW 401.
৪৯৯. Ibid. 402.
৫০০. O. R. Ehrenfels MRI-a# sạtvề đề Tiafõẽ #*I
৫০১. J. Marshall op. cit. 1:57.
৫০২. Ibid.
৫০৩. G. Thomson SAGS 238. cf. G. Thomson AA4: “Since the function of all social institutions, alien or indigenous, is to satisfy some need, the origin of this or that custom is not explained by saying that this was borrowed from abroad. As Ferguson remarked, ‘nations borrow only what they are nearly in a condition to have invented themselves’ “.
৫০৪. G. Thomson SAGS 239.
৫০৫. Ibid. 238.
৫০৬. Ibid. 246.
৫০৭. Ibid. 245.
৫০৮. Ibid. 246.
৫০৯. J. Marshall op. cit. 1:52.
৫১০. ERE 10:244.
৫১১. Ibid.
৫১২. Ibid.
৫১৩. Ibid.
৫১৪. Ibid.