পদ্মা নদীর মাঝি – ৭.৩

পদ্মা নদীর মাঝি – ৭.৩

গ্রাম ছাড়িবার তিন সপ্তাহ পরে কুবের ও গণেশ গ্রামে ফিরিয়া আসিল। চাঁদপুরে তাহাদের নামাইয়া দিয়া হোসেন নৌকা লইয়া কোথায় চলিয়া গিয়াছে। হোসেনের মুসলমান মাঝিরা চাঁদপুরে অপেক্ষা করিতেছিল।

গোপিকে নিয়া ইতিমধ্যে অনেক কাণ্ড হইয়া গিয়াছে। কুবের যেদিন চলিয়া গেল সেইদিনই গোপির পা ভয়ানক ফুলিয়া ওঠে। বাড়িতে পুরুষ কেহ নাই, কী করিবে ভাবিয়া না পাইয়া মালা কাঁদিয়া অস্থির হইছিল। তারপর রাসু আসিয়া সব ব্যবস্থা করিয়াছে। কত যে করিয়াছে রাসু গোপির জন্য, শত মুখেও মালা তাহা বলিয়া শেষ করিতে পারিবে না। সেইদিনই গোপিকে রাসু আমিনবাড়ির হাসপাতালে নিয়া গিযছিল, রাত্রেই গোপির হাঁটুতে আবার অস্ত্র করা হয়। সে এখনও হাসপাতালে আছে, প্রায়ই রাসু তাহাকে দেখিতে যায়। ডাক্তার আশ্বাস দিয়াছে হাড় ভাঙিয়া মাংসপেশির জট ছাড়াইয়া গোপির হাঁটু এবার ঠিক করিয়া দেওয়া হইয়াছে, একটু খোঁড়াইলেও সে হাঁটিতে পরিবে।

কুবের ফিরিয়াছে খবর পাইয়া রাসু আসে। কুবের দুটো একটা কৃতজ্ঞতার কথা বলিতেই সে একেবারে গলিয়া যায়। মাথাটা একবার চুলকাইয়া রাসু কযেকটা টোক গেলে। তারপর হঠাৎ বলিয়া বসে, গোপিবে দিবা মাঝি আমারে?

কুবের গম্ভীর হইয়া যায়। বলে যে বাস্ততা কীসের? গোপি তো পড়িয়া আছে হাসপাতালে, আগে সে ফিবিয়া আসুক? রাসু তবু পাড়াপীড়ি করিতে থাকে। গোপির পা ভালো হইয়া যাইবে শুনিয়া অবধি সে ব্যগ্র হইয়া উঠিয়াছে, এই সময় কুবেরের কাছে কথা আদায় করিয়া না রাখিলে পরে হয়তো সে মত বদলাইয়া ফেলিবে। গোপির পঙ্গুতা আরগ্য হওয়া যখন অনিশ্চিত ছিল তখন কথাটা পাকাপাকি করিয়া নেয় নাই বলিয়া বড়ো এখন অনুতাপ হইয়াছে রাসুর।

শেষে কুবের বলে, কাইল কমু রাসু।

রাত্রে সে পরামর্শ করিল মালার সঙ্গে। পরামর্শ করিয়া স্থির হইল যে, রাসূ যদি দেড়কুড়ি টাকা পণ দেয় আর দুকুড়ি টাকার গহনা দেয় গোপিকে তবে এ বিবাহ হইতে পারে। তার কমে হইবে না।

পরদিন রাসু আসিল। কুবেরের দাবি শুনিযা সে ভড়কাইয়া গেল। বলিল, অত টাকা কই পামু?

কুবের তার কী জানে? এই কটা টাকা যদি সে বিবাহে খরচ করিতে না পারে, বিবাহের পর বউকে তবে সে খাওয়াইবে কোথা হইতে?

রাসু মাথা নিচু করিয়া থাকে। মালা তাহার মুখের দিকে চাহিয়া বুঝি মমতা বোধ কবে, কুবেরকে ইশারায় কাছে ডাকিয়া ফিসফিস করিয়া টাকার পরিমাণটা কিছু কমাইতে বলিয়া দেয়। কিন্তু মেয়েমানুষের পরামর্শে ভুলিবার পাত্র কুবের নয। গম্ভীর অবিচলিত মুখে সে বসিয়া থাকে বেড়ায ঠেস দিয়া, চক্ষু মুদিয়া যেন ঘুমাইয়া পড়ে।

অনেকক্ষণ পরে রাসু বলে, আইচ্ছা দিমু।

বলিয়া সে উঠিয়া যাইতে চায় কিন্তু এবার কুবের তাহাকে খাতির করিয়া বসায়, আগ্রহ সহকারে গল্প জুড়িয়া দেয় ময়নাদ্বীপের। রাসুর না জাগে উৎসাহ, না আসে মুখরতা। কী হইল রাসুর; এতদিনের স্বপ্ন তাহার সফল হইবে জানিয়া আহ্লাদ হইল না কেন? তামাক সাজিয়া খানিকক্ষণ টানিয়া হুঁকাটি নামাইয়া রাখিয়া কুবের আড়ালে যায়। কদিন আগেও তাহারা হুঁকা কাড়াকড়ি করিয়া তামাক টানিয়াছে কিন্তু এখন কিনা রাসু তাহার ভাবী জামাতা, ওর হাতে এখন আর হুঁকা দেওয়া যায় না, ওর তামাক খাওয়ার সময় সামনে থাকা যায় না।

দিন তিনেক পরে কুবের আমিনবাড়ি গিয়া গোপিকে দেখিয়া আসিল। হাসপাতালের খাবার খাইয়া বিছানায় শুইয়া শুইয়াই গোপি দিব্যি মোটাসোটা হইয়াছে, পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন থাকার জন্য রঙের যেন তাহার খোলতাই হইয়াছে বেশ। দিন সাতেক পরে সে ছুটি পাইবে।

রীতিমতো শীত পড়িয়াছে এখন। জেলেপাড়ার ছেলেবুড়ার শরীর রুক্ষ হইয়া খড়ি উঠিতে আরম্ভ করিয়াছে। মালার চামড়া কিন্তু চিরদিন মসৃণ, হাজার শীতেও কখনও তাহার গা ফাটে না। কপিলারও বুঝি ফাটে না। যে তেলটাই কপিলা খরচ করে শরীরের পিছনে! মাঠে পালং শাকের পাতাগুলিতে যে সরস লাবণ্য ফুটিয়া আছে, কপিলার দেহে হয়তো তার অভাব নাই। মালার বোন তো সে। মালার চেয়ে সে হাজার গুণে শৌখিন।

কাজকর্ম নাই, বাড়ি বাড়ি ঘুরিয়া কুবের সময় কাটায়। পীতম মাঝির অসুখ হইয়াছে, বুড়ে বয়সে তাহার সেবা করিবার কেহ নাই, যুগী তাই আসিয়া বাপের কাছে আছে। পীতম সেবা গ্রহণ করে মেয়ের কিন্তু দিবারাত্রি তাকে গাল দিয়া কিছু রাখে না। যুগীর হাতের জল খাইয়া চিরদিন নরকে পচিবার সাধ যে তাহার নাই, সব সময় এই কথাটা সে ঘোষণা করে এবং ঘোষণা করিতে করিতে গলা কাঠ হইয়া আসিলে যুগীব দেওয়া জল খাইয়াই তৃষ্ণা মেটায়। পীতমের টাকা আছে অনেক। বলে, টাকার লোভে যুগী তাহার সেবা করিতে আসিয়াছে কিন্তু একটি পয়সা সে যুগীকে দিয়া যাইবে না। যা কিছু তাহার আছে সব সে কালই বাবুদের জিম্মা করিয়া দিবে, তার পলাতক ছেলেটা ফিরিয়া আসিলে সব সে পাইবে। ছেলেটা পীতমের ফিরিয়া আসিল বলিয়া।

রাসু একবার পীতমকে দেখিতে আসিয়াছিল, পীতম তাহাকে দূর দূর করিয়া খেদাইয়া দিয়াছে। রাতারাতি খুন করিয়া ময়নাদ্বীপ ফেরত ডাকাতটা যে তার সর্বস্ব লুটিয়া লইবে অত বোকা পীতম নয়। রাসু কাছে আসিলে সে তার ঠাং খোঁড়া করিয়া দিবে। শীর্ণ হাত দুটি উঁচু করিতেও পীতমের কষ্ট হয়, রাসুর ঠ্যাং সে কেমন করিয়া খোঁড়া করিবে সেই জানে!

কুবেরের কাছে রাসু মনোবেদনা জানায়। একমাত্র ভাগনে সে পীতমের, তাকে পীতম ত্যাজ্য করিয়া দিল! কত দুঃখ-কষ্ট পাইয়া সে ফিরিয়া আসিল ময়নাদ্বীপ হইতে, দুদিন বাড়িতে ঠাঁই দিল না, অম্লান বদনে খেদাইয়া দিল রাস্তায়। মরিবার সময় এখন কাছে থাকিয়া একটু সেবা করার জন্য সে ব্যাকুল হইয়াছে, তাতেও বুড়া তাহাকে সন্দেহ করিবে, বাড়িতে ঢুকিতে দিবে না? তা ছাড়া, নিজের ভাগনে সে পীতমের, বুড়ার টাকাপয়সা বাড়িঘরের একটা অংশ কি তার পাওয়া উচিত নয়? কাকে ও সব দিয়া যাইবে বুড়া?

কুবের বলে, পোলার লাইগা থুইয়া যাইব কয়।

রাসু বলে, পোলা! বাঁইচা আছে নাকি স্যায়? গাঙে ডুইবা গেছে গা কবে।

আলস্যে সময় কাটায় কুবের, গ্রামের জোয়ান মানুষগুলি জীবিকা অর্জনের জন্য বাহির হইয়া যায়, গ্রামে থাকে শুধু বুড়া, শিশু ও নারীর দল, কুবের শুধু শুনিতে পায় পাকা মুখের আপশোশ আর নরম গলার কলহ। দেখা হইলেই হীরু জেলে অনন্তবাবুর নাম করিয়া কুবেরকে পরিহাস করে। কোনোদিন কুবের রাগে, কোনোদিন তাহার মন খারাপ হইয়া যায়। আজ কতকাল অনন্তবাবু গ্রামে নাই, কলিকাতার বাবু তিনি, জেলেপাড়ায় রাত্রে স্কুল খুলিবার মতলবে কবে তিনি দু-চারবার কুবেরের বাড়ি যাতায়াত করিয়াছিলেন, এখনও তাহা মনে করিয়া রাখা কী জন্য? শুধু কুবেরের বাড়ি তো নয়! কী পাগলামি মেজোবাবুর আসিয়াছিল কে জানে, জেলেপাড়ার মানুষগুলির সঙ্গে অন্তরঙ্গ হওয়ার জন্য সময নাই অসময় নাই আসিয়া হাজির হইতেন, বাড়ি বাড়ি ঘুরিয়া দেশের নাম করিয়া কী যেন সব বলিতেন দুর্বোধ্য কথা। কতদিন নির্জন দ্বিপ্রহরে কত বাড়ির ভিতর হইতে মেজোবাবুকে কুবের বাহি্র হইতে দেখিয়াছে। তাহার পঙ্গু অসহায় স্ত্রীব নামের সঙ্গেই শুধু মেজোবাবুর নামটা হীরু জড়ায় কেন?

হীরুকে একদিন কুবের মারিবে। বেদম মারিবে! বাড়ি বাড়ি ঘুরিয়া সময় কাটায় কুবের, মনটা তাহার ভালো নাই। জগা মাঝির বউ যেন কপিলার অনুকরণ করিয়া হাঁটিতে শিখিয়াছে, ভিজা কাপড়ে পথ চলিতে চলিতে চমকাইয়া উঠিয়া পিছনে কুবেরকে দেখিয়া তাহার চোখে সন্দেহ ঘনাইযা আসাব আগে কুবেবের তো অন্যমনস্কতা ঘোচে না। অপ্রতিভ হইতে হয় কুবেরকে। নকুলের বাড়ির সামনে কুলগাছটার তলে একদিন কপিলার পাযে কাঁটা বিঁধিয়াছিল। মিছে কথা, কাঁটা বিঁধে নাই। উঃ, বলিয়া কুবেরকে জড়াইয়া ধরিবার ছল সেটা কপিলার। কেতুপুরে দুর্গা-প্রতিমা দেখিয়া ফিরিবার সময় সেদিন কী ছলনাময়ীই কপিলা হইয়া উঠিয়াছিল।

গোপিকে আনিবার নাম করিয়া কুবের একদিন ভোর ভোর গ্রাম ছাড়িয়া বাহির হইয় পড়িল। শ্যামাদাসের বাড়ি আকুরটাকুর গ্রামে, হাঁটা পথে বারো তেরো মাইল। খেতের আল দিয়া আঁকিয়া বাঁকিয়া চলিতে কতবার যে কুবের ভাবিল ফিরিয়া আসে, আকুরটাকুরে পৌঁছিযা একটা পুকুরে মুখ হাত ধুইতে নামিয়া কতবাব সে যে পুকুবঘাট হইতেই সোজা আমিনবাড়ির দিকে হাঁটিতে আরম্ভ করা স্থির করিয়া ফেলিল তার হিসাব নাই!

তবু শেষ পর্যন্ত শ্যামাদাসের বাড়ির দরজাতেই পথ শেষ হইল তাহার।

শ্যামাদাস মাঠে গিযাছিল। কিন্তু শ্যামাদাসের মা বোন ঘর-বাড়ি জুড়িয়া আছে, কপিলা এখানে ঘোমটা-টানা বউ। কুটুম্বকে শ্যামাদাসের মা খাতির করিয়া বসিতে দিল, কুশল ও এদিকে আসিবাব প্রয়োজন জিজ্ঞাসা করিল। শ্যামাদাসের বাড়িঘর দেখিয়া কুবের মনে মনে পীড়িত হইয়া উঠিয়ছিল, ভালোরকম জবাব দিতে পারিল না। চার ভিটায চারখানা বড়ো বড়ো ঘর শ্যামাদাসের, চারিদিক লেপা-পোছা ঝকঝকে ঘরের মধ্যে উঁকি দিলে কত জিনিস চোখে পড়ে,—কাঠের সিন্দুক, বেতের ঝাঁপি, বাসনকোসন—কত কিছু। উঠানের একপাশে ধানের মরাই, অপর পাশে গোযাল ঘর। লক্ষ্মীশ্ৰী মাখানো সম্পন্ন গৃহস্থের ঘরসংসার, কুবেবের ভাঙা কুটিবের তুলনায বৈকুণ্ঠপুরী। বুকেব ভিতরে টাটায় কুবেরের। এই বৈকুণ্ঠের লক্ষ্মী গিয়া তাহার ভাঙা ঘরে শাকান্ন খাইয়া কটা দিন কাটাইয়া আসিয়াছিল বলিয়া আজও সে আকাশকুসুম রচনা করে, ভাবে আজও লক্ষ্মীর মন পড়িয়া রহিয়াছে কেতুপুরে তাহার সেই নোংরা নীড়টিতে! কী বোকাই কুবের ছিল!

কপিলা জিজ্ঞাসা করে, খবর কী মাঝি? কী মনে কইবা আইলা? ভালা নি আছে

পোলাপানরা?

ডুরে শাড়ি পরিয়াছে কপিলা, চুলের তেলে কপাল তাহার ভিজিয়া গিয়াছে, দেহ যেন উথলিযা উঠিয়াছে কপিলার, বর্ষার পদ্মার মতো। কী ভীষণ খুশি মনে হইতেছে কপিলাকে। নিজের মলিন কাপড় ও চাদরটির লজ্জায় কুবেরের ছুটিয়া পলাইতে ইচ্ছা হইতে থাকে।

কয়েক মিনিট সাধারণ কথাবার্তা বলিয়া কপিলা আবার রাঁধিতে যায়। আরও খানিকক্ষণ আলাপ করিয়া কপিলার শাশুড়িও প্রস্থান করে। বাড়ির দু-একটি ছেলেমেয়ে শুধু ঘোরা-ফেরা কবে কুবেরের কাছে, তারপর তারাও চলিয়া যায়। কুবের বসিয়া থাকে একা। বোকা, নোংরা, অপদার্থ কুবের। ময়নাদ্বীপের এনায়েত ও বসিরের কথা কুবেরের মনে পড়ে—মনে পড়ে জ্যোৎস্নালোকে হোসেনের কুটিরের দাওয়ায় বন্দী এনায়েতের ভাত খাওয়া; যার জন্য দ্বীপের অধিবাসীদের কাছে করার সে মার খাইয়াছে, তারই আনিয়া দেওয়া ভাত! হোসেনের কল্যাণে কদিন পরে মিলনও তাদের হইবে—প্রকাশ্য, সামাজিক, আইনসঙ্গত মিলন। কী আশ্চর্য ভাগ্য লইয়াই এক একটা লোক জন্মায় জগতে! বসিয়া থাকিতে থাকিতে পথ চলার শ্রান্তিতে ঢুল আসে কুবেরের। আধ-জাগা আধ-ঘুমানো অবস্থায় সে স্বপ্ন দেখিতে থাকে, রচনা করিয়া চলে আকাশকুসুম। সর্বশক্তিমান হোসেনকে সে যেন বলিয়াছে কপিলাকে পাইলে সপরিবারে সে ময়নাদ্বীপে গিয়া বাস করিবে— গণেশকেও বলিয়া সে রাজি করিবে যাইতে। হোসেন তাহার চিরন্তন হাসি হাসিয়া যেন বলিয়াছে, তাই করুম কুবির বাই, তাই করুম—আইনা দিমু কপিলারে। তারপর যেন একদিন—

কপিলা আসিয়া বলে, থাকরা নাকি মাঝি?

কুবের বলে, না।

দুইদিন থাইকা যাও? আইছ ক্যান কও দেহি?

সুবচনীর হাটে যামু মন কইরা বাইরইছি কপিলা। তা ভাবলাম তরে দেইখা যাই।

কপিলা মুচকি হাসিয়া বলে, সুবচনীর হাট নাকি আইজ?

কুবের বিবর্ণ হইয়া বলে, না?

হাটে গিয়া ঘুমাইয়া থাকগা মাঝি, কাইল হাট কইরা বাড়িত যাইয়ো, বলিয়া কপিলা রান্নাঘরে চলিয়া যায়। কুবের উঠিয়া নামিয়া যায় উঠানে। লাউমাচার কাছে গিয়া সে দাঁড়ায়। লজ্জায় মুখখানাতে তাহার মাচার উপরকার উপুড় করা কালো হাঁড়িটার ছায়া পড়ে যেন। কপিলার সঙ্গে সে কেন পারিয়া উঠিবে? পদ্মানদীর বোকা মাঝি সে, এক হাটে কিনিয়া কপিলা তাহাকে আরেক হাটে বেঁচিয়া দিয়াছে। অনেকদিন আগে।

দুপুরবেলা বাড়ি ফিরিয়া কুবেরকে দেখিয়া শ্যামাদাস খুশি হইল। দুজনে পুকুরে স্নান করিয়া আসিয়া একসঙ্গে খাইতে বসিল, অতিথি আসিয়াছে বলিয়া কপিলা আজ অনেক রান্না করিয়াছে। কিন্তু খাদ্যে কুবেরের রুচি ছিল না। কুবেরের হঠাৎ আসিবার কারণটা শ্যামাদাসও জানিতে চাহিল। কুবের এবার এক আশ্চর্য মিথ্যা রচনা করিয়া বসিল। হোসেন মিয়ার ময়নাদ্বীপে গিয়া বাস করিতে চাহিবে এমন যদি কেহ জানা থাকে শ্যামাদাসের? অনেক সুবিধা সেখানে বাস করার। বাড়ি-ঘর অন্নবস্ত্র জমিজমা সব এখন বিনামূল্যে পাওয়া যাইবে, দশ-বিশবছব পরে দ্বীপে বসতির বিস্তার হইলে তখন নামে মাত্র খাজনা ধার্য হইবে জমির, পুরুষানুক্ৰমে স্বত্ব জন্মিবে জমিতে। শ্যামাদাস যদি দশজনকে এই সুবর্ণ সুযোগের সংবাদ জানায় আর কেহ ময়নাদ্বীপে যাইতে রাজি হইলে কুবেরকে যদি খবর দেয়, বড়ো ভালো হয় তবে।

শ্যামাদাস অবাক হইয়া বলিল, চা বাগানের ঠিকাদারি নিছ নাকি মাঝি, আঁই?

চা বাগান? কীসের চা বাগান? শ্যামাদাস চলুক না, ময়নাদ্বীপ দেখিয়া আসিবে? আজই চলুক।

তুমি যাওনা ক্যান ময়নাদ্বীপি? শ্যামাদাস জিজ্ঞাসা করিল। কুবের থতোমতো খাইয়া বলিল, যামু। আমিও যামু। আজ এখানে থাকিয়া যাওয়ার জন্য কুবেরকে অনেক অনুরোধ করিল শ্যামাদাস। কিন্তু থাকিবার উপায় কি আছে কুবেরের! গ্রামে গ্রামে ঘুরিয়া তাহাকে ময়নাদ্বীপের বারতা প্রচার করিতে হইবে।

সুবচনীর হাটের ভিতর দিয়া আমিনবাড়ির পথ। হাটের শূন্য চালাগুলি খাঁ খাঁ করিতেছিল, পথের ধারে স্থায়ী দোকান ও আড়তগুলি শুধু খোলা আছে। একটা খাবারের দোকানের সামনে নড়বড়ে বেঞ্চটাতে কুবের বসিয়া পড়িল। ভয়ানক শীত করিতেছিল কুবেরের, শরীরটা ছমছম করিতেছিল আর চোখ দুটো করিতেছিল জ্বালা। হুড়মুড় করিয়া জ্বর যে আসিতেছে অনেকক্ষণ আগেই সে তাহা টের পাইয়াছিল। বেঞ্চিটা রোদে সরাইয়া নিয়া চাদর মুড়ি দিয়া সে শুইয়া পড়িল। ক্ৰমে অপরাহু হইয়া আসিল, দোকানের ছায়া কুবেরকে অতিক্ৰম করিয়া হাটের চালাগুলির মাথায় উঠিয়া গেল, কুবের তেমনিভাবে পড়িয়া রহিল বেঞ্চিটাতে। শেষে ময়রা তাহাকে ডাকাডাকি আবম্ভ করিয়া দিল।

জ্বর আসিবার মুখে ভোজ খাইয়াছিল, অবস্থা বড়ো শোচনীয় হইয়া পড়িয়াছে কুবেরের। কপিলার স্বামী শ্যামাদাসের অবস্থা ভালো বলিয়া, গরিব সে, জ্বর গায়ে পথে নামিয়া আসিয়াছিল, এত জ্বর যে আসিবে কুবের তো ভাবিতে পারে নাই। মাথার মধ্যে যেন কুয়াশা নামিয়াছে আর শব্দ হইতেছে গমগম। কোথায় কী অবস্থায় সে পড়িয়া আছে তাও মাঝে মাঝে গোলমাল হইয়া যাইতেছে সব,–সমুদ্র তরঙ্গ, দুর্গাপূজার আলো, অন্ধকার একটা চাঁচেব বেড়ার বাহিরে সারিসারি ঘুমন্ত মানুষ, বারবার জাল নামানো উঠানো, ঝাঁকে ঝাঁকে সাদা মাছের লাফালাফি সব একাকার হইয়া যাইতেছে। ময়রা মুখের চাদর সরাইয়া দিলে কুবের আরক্ত-চোখে তাহার মুখের দিকে চাহিয়া থাকে, বিড়বিড় করিয়া বলে, শ্যামাদাসেরে খবর দিবা, আকুরটাকুরের শ্যামাদাস?

সন্ধ্যার পর কুবের আবার ফিরিয়া গেল কপিলার কাছে, তাহাকে বিছানায় শোয়াইযা একটা মোটা কাঁথা তাহার গায়ে চাপাইয়া দিয়া কপিলা রাঁধিতে গেল। অন্ধকার ঘরে কুবের শুইয়া রহিল একা।

শেষরাত্রে ঘাম দিয়া কুবেরের জ্বর ছাড়িয়া গেল। সেই সঙ্গে ঘুমও ভাঙিয়া গেল তাহার, আর ঘুম আসিল না। একটা বিশ্রী বোটকা গন্ধে বড়ো অস্বস্তি বোধ করিতে লাগিল। অল্প অল্প আলো হইলে সে উঠিয়া বসিল। ঘরখানা খুবই ছোটো, ঘরের অর্ধেক জুড়িয়া পাটের স্তুপ আব দরজার কাছে প্রকাণ্ড একটা পাঁঠা বাঁধা, শুইয়া শুইয়া দাড়ি নাড়িয়া জাবর কাটিতেছে।

শরীরটা বড়ো দুর্বল বোধ হইতেছিল কুবেবের। ধীরে ধীরে উঠিয়া সে বাহিরে গেল। কপিলা উঠানে গোবর লেপিতেছিল, বলিল, কিবা আছ মাঝি?

কুবের ক্ষীণস্বরে বলিল, জ্বর নাই। আমি অখন যামু কপিলা।

এখনই যাইবে কুবের, এই ভোরে? নাইবা গেল সে আজ দুর্বল শরীর লইয়া? একটু সুস্থ হইয়া কাল গেলে হয় না? অন্তত কিছু খাইয়া যাক সে। এখনই দুধ দুহিয়া কপিলা জ্বাল দিবে, একটু দুধ খাইয়া যাক।

না, কুবের কিছু খাইবে না। প্রয়োজন নাই। পাঠা ও পাটের সৌরভে তার পেট ভবিয়া গিয়াছে। বিষণ্ণ মুখে কুবের মাথা নাড়ে। পদ্মানদীর কূল ছাড়িয়া দশ মাইল তফাতে চলিয়া আসিয়াছে সে, মন কেমন করিতেছে তার। পদ্মার বাতাস গাযে না লাগিলে, কেতুপুরের মেছো গন্ধ না শুকিলে, সে সুস্থ হইবে না।

কপিলা গোবর লেপা স্থগিত করিয়া বলে, গোসা করছ মাঝি? গোসা কইরো না। ঘরভরা মাইনষের পাল, ঘর নি আছে আর তোমারে দিমু শোওনের লাইগা?

কুবের বলিল, হ রে কপিলা, হ! ব্যাজাল পারিস না, তর ব্যাজালে গাও জ্বলে।

গাও জ্বলে মাঝি? গাও জ্বলে?

হ, জ্বলে! গোবু ছাগল ভাবস আমারে তুই, খেলা করস আমার লগে। তরে চিনা গেলাম কপিলা, পরনাম কইরা গেলাম তরে।

কপিলা ফিসফিস করিয়া বলে, চুপ কর মাঝি, বেবাকে শুনবো। যাইবা যাও, কী আর কমু তোমারে? এউক্‌কা কথা কইয়া দিই মাঝি, মাথা খাও, দিদিরে কথাডা কইয়ো। কইয়ো, কপিলা পরের ঘরের বউ, পরের শাসনে কপিলার মুখে রাও নাই। অতিথ কই থাকবো, অতিথ কী খাইবো, কপিলারে কেডা তা জিগায়? দুষি কইরো মাঝি, শাইপো—কিন্তু এই কথাডা কইয়ো দিদিরে, মাথা খাও মাঝি, কইয়ো।

কার লগে কথা কস বউ?–ঘরের ভিতর হইতে শাশুড়ি জিজ্ঞাসা করে।

কপিলা চাপা সুরে বলে, যাও গা মাঝি। ক্যান আইছিলা তুমি?

 

আমিনবাড়ির হাসপাতাল হইতে গোপিকে সঙ্গে করিয়া জলপথে কুবের গ্রামে ফিরিল। তাহার শীর্ণ চেহারা দেখিয়া মালা বারবার জিজ্ঞাসা করিল, কী হইয়াছিল তাহার, ফিরিতে এত দেরি হইল কেন? প্রশ্নগুলিকে এড়াইয়া গেল কুবের। অল্প সময়ের মধ্যে অকস্মাৎ অনেকগুলি বিচিত্র অভিজ্ঞতা কুবেরকে যেন নতুন মানুষ করিয়া দিয়াছে, নদী ও নদীতীরের একটানা জীবনে তাহার গত কয়েকটি মাস চিরস্মরণীয়। কোথায় ছিল কপিলা, কোথায় ছিল আশ্বিনের ঝড়, কোথায ছিল ময়নাদ্বীপ! সব একসঙ্গে ভিড় করিয়া আসিয়াছে তাহার জীবনে।

গ্রামে ফিরিয়া কুবের দেখিল, রাসু ইতিমধ্যে পীতমের সঙ্গে ভাব করিয়া ফেলিয়াছে। যুগীর ছেলে হইয়াছে, পীতমকে কে আর দেখিবে, কাজটা তাই পাইয়াছে রাসু। যুগীর মতো রাসুকেও সে সর্বদা শাপান্ত করে, রাসু নীরবে সেবা করে বুড়ার, রাগও করে না, দুঃখিতও হয় না। রাসুর ধৈর্য দেখিয়া কুবের খুশি হয়, পীতম খুশি থাকিলে রাসু হয়তো কিছু পাইবে টাকা-কড়ি, গোপিরই ভালো হইবে তাহাতে। এমন কী, পীতমকে দেখিতে গিয়া তার কাছে রাসুর কিছু কিছু প্রশংসাও করিয়া আসে কুবের। বলে, মনটা ভালো রাসুর, দয়া-মায়া আছে রাসুর বুকে, নকুল-টকুলের মতো পাজি সে নয়। পীতম শোনে কিন্তু বিশ্বাস করে না। বলে, অরে তুই চিনস না কুবির, অ ডাকাইত। একদিন আমার বুকে চাকু মাইরা সর্বস্ব নিয়া পালাইবো হারামজাদা, তুই আছস কোন তালে!

কুবের প্রতিবাদ করে। না, রাসু সে রকম নয়। বড়ো ভালো রাসু।

কয়েকদিন পরে হোসেন মিয়া ফিরিয়া আসিলে কুবেরের অলস দিনগুলি শেষ হয়। রকমারি ব্যবসা হোসেনের, ধান, পাট, বিড়ির পাতা, তামাক, গুড়, চিনি, মশলাপাতি এক একরাব এক একরকম বোঝাই নিয়া কুবের বন্দর হইতে বন্দরে যাতায়াত করে। গোয়ালন্দের অপর তীরে একবার সাতশো ছাগল আসিয়া হাজির, সারাদিন ধরিয়া কুবের তাহাদের নদী পার করিল। ছাগলের গন্ধে বারবার তাহার মনে পড়িতে লাগিল কপিলার বাড়িতে এক কষ্টকর রাত্রিযাপনেব কথা। পরের বাড়িতে পরের শাসনে নিরুপায় নির্বাক বউ কপিলা যেখানে তাকে পাট-জমানো পাঁঠা-বাঁধা ভাঙা ঘরখানায় শুইতে দিয়াছিল।

তারপর একদিন চাঁদপুর যাওয়ার হুকুম পাওয়া গেল। তাড়াতাড়ি যাইতে হইবে, দিবারাত্রি নৌকা বাহিয়া যাওয়া চাই। গণেশ বিরক্ত হইয়া গজগজ করিতে লাগিল। শম্ভু ও বগা বহুদিন হোসেনের অধীনে কাজ করিয়াছে তারা কিছুই বলিল না, প্রাণপণে বইঠা বাহিয়া কুবেরকে অবাক করিয়া দিল। হোসেনকে কিছু কিছু কুবের এখন চিনিতে পারিয়াছে। সাধারণত সময়ের হিসাব হোসেনের একটু শিথিল, নৌকার খেপ দিতে মাঝিরা দেরি করিলে কিছু সে বলে না, শম্ভু ও বগা তাই গা ছাড়িযা দিয়া বইঠা ধরে, কুবেরের তাড়া গ্রাহ্য করে না। কিন্তু হোসেন যখন মুখ ফুটিয়া বলে যে দ্রুতগতির প্রয়োজন, শম্ভু ও বগার সমস্ত শৈথিল্য তখন অন্তর্হিত হয়। এমনভাবে বইঠা বাহিতে থাকে তাহারা যেন ভূতে পাইয়াছে তাহাদের। মনে মনে সায় দেয় কুবের। এমনিভাবেই কাজ নিতে হয় বটে মানুষের কাছে, এমনই কৌশলে। একটু দেরিতে যখন কিছুই আসিয়া যায় না, মাঝিদের সঙ্গে তখন বকবিকি না করিলে, তাড়াতাড়ির সময় দুবার বলিতে হয় না, এতটুকু ইঙ্গিত পাইলে আলস্য-পরিতৃপ্ত মাঝিরা সহসা অতিমাত্রায় কর্মঠ হইয়া ওঠে।

হোসেনের বহুমুখী প্রতিভার পরিচয় কুবের প্রতিনিয়তই পায়। বিস্তৃত তাহার কর্মক্ষেত্র, এখানে ওখানে ছড়ানো তাহার জীবন, এলোমেলো তাহার চলাফেরা,—তবু চারিদিকে সামঞ্জস্য, সব নিয়মে বাঁধা। একটা জটিল বিশৃঙ্খলায় সে সব শৃঙ্খলাবদ্ধ করিয়া দিয়াছে।

চাঁদপুরে হোসেন মিয়া নৌকায় যোগ দিল। ময়নাদ্বীপের পথেই এবারও নৌকা চলিল, নোয়াখালির উপকূলে ক্ষুদ্র একটি গ্রামের কাছে নৌকা বাঁধা হইল। নৌকায় বোঝাই দেওয়া হইল নারিকেল। বোঝাই শেষ হইল কিন্তু নৌকা খুলিবাব হুকুম হোসেন দিল না। দুদিন সেইখানে নিষ্কর্ম হইয়া তাহারা বসিয়া রহিল।

তৃতীয় দিন সন্ধ্যার সময় নদীর মোহনার দিক হইতে মুসুরি বোঝাই প্রকাণ্ড একটা সমুদ্রগামী বোট আসিয়া ভিড়িল পাশে, চট্টগ্রামবাসী এক বৃদ্ধ মুসলমান নামিয়া আসিয়া অনেকক্ষণ হোসেনের সঙ্গে করিল পরামর্শ। বোট হইতে তারপর ত্রিপল মোড়া কী যেন আসিল এই নৌকায়, ছইযের মধ্যে পাটাতনের তলে হোসেন তাহা লুকাইয়া ফেলিল। তারপর হোসেন ও বৃদ্ধ মুসলমানটি নামিয়া গেল তীরে, গুনিয়া গুনিয়া হোসেন কতকগুলি নোট তাহার হাতে দিল, নৌকায় ফিরিয়া আসিয়া বলিল, নাও খোলো কুবির বাই।

বড়ো কৌতুহল হইতেছিল কুবেরের। পাটাতনের নীচে কী লুকাইযা রাখিয়াছে হোসেন? হোসেনকে প্রশ্ন করিবার সাহস কুবেরের হইল না। অনেক রাত্রে নৌকা বাঁধিয়া রাঁধিবার আয়োজন করিবার সময শম্ভুকে সে চুপিচুপি জিজ্ঞাসা করিল।

শম্ভু বলিল, আপিম মিয়া, আপিম। চুপ যাও।

আপিম? চুপিচুপি আপিমের ব্যবসা করে হোসেন? এ তো ভালো কথা নয়! নানাদিকে কত উপার্জন হোসেনের, এইসব অসদুপায়ে অর্থ সংগ্রহের চেষ্টা কেন তার? তা ছাড়া, চোরাই আপিমের ব্যাবসা করা তো সহজ বিপদেব কথা নয়। ধরা পড়িলে কী উপায় হইবে তখন? কুবেরের ভয় করিতে লাগিল। হোসেন মিয়ার সঙ্গে যেদিন সে ভিড়িয়াছে, সেইদিন হইতে সে জানে একদিন অনিবার্য বিপদ আসিবে, একেবারে সর্বনাশ হইয়া যাইবে, আজ কুবের বিপদের স্বরূপটা বুঝিতে পারিল। আজ হোক, কাল হোক হাতে পড়িবে হাতকড়া, তারপর দু-দশবছর জেলের বাহিরে কুবেরকে আর খুঁজিয়া পাওয়া যাইবে না।

ছইযের ভিতরটা হোসেন মিয়া দখল করিয়াছে, নৌকার উন্মুক্ত অংশে হোগলার ঢাকনি চাপাইয়া মাঝিরা শয়ন কবে। শুইয়া শুইয়া কুবের অনেক আবোল-তাবোল চিন্তা করিল। একবার ভাবিল, এবার গায়ে ফিরিয়া হোসেন মিয়ার নৌকায় আর সে কাজ করিবে না। জেলে যাওয়ার চেযে না খাইয়া মরাও ভালো। কিন্তু না খাইয়া মরার সঙ্গে কুবেরের পরিচয় আছে। হোসেন মিয়ার সঙ্গে ভিড়িয়া জীবনে সে প্রথম সচ্ছলতার সুখ জানিয়াছে, এই কাজ ছাড়িয়া দিলে যে অবস্থা তাহার হইবে খানিকক্ষণ সে বিষয়ে চিন্তা করিয়া কুবের বুঝিতে পারে জানিয়া শুনিয়া ইচ্ছা করিয়া দারিদ্র্যকে বরণ করিবার ক্ষমতা আর তাহার নাই। ক্ষোভে কুবেরের চোখে জল আসে। এ কী অন্যায় হোসেন মিয়ার। এই সব বিপজ্জনক কাজগুলি বাদ দিলেও তাহার তো কাজের অভাব নাই, সে সব কাজে ব্যাপৃত না রাখিয়া কুবেরকে কেন সে এই বিপদের মধ্যে টানিয়া আনিয়াছে? তারপর কুবের ভাবে, এই সব ভয়ংকর কাজের সহায়তা যদি তাকে করিতে হয়, বিপদের ভাগ যদি তাহার থাকে, লাভের অংশও তো তার পাওয়া উচিত? জেলে যাওয়ার ঝুঁকি যার সে কী শুধু বইঠা বাহিবার মজুরিই পাইবে?

মনে মনে কুবের কলহ করে হোসেনের সঙ্গে। কল্পনায় সে বারবার এই ঘটনাগুলি ঘটাইয়া যায় : হোসেনের অন্যায়টা বুঝাইয়া দিতে সে ভারী অনুতপ্ত হয়, তাড়াতাড়ি কোমরের কালো বেল্ট হইতে একতাড়া নোট নিয়া সে কুবেরকে দেয়। চার ভিটায় চারখানি বড়ো বড়ো ঘর তোলে কুবের, গোয়াল করে, ধানের মরাই করে, ঝাকার উপর লাউলতা তুলিয়া দেয়। তারপর একদিন কপিলাকে নিমন্ত্রণ করে। কপিলার পা দুটি জড়াইয়া ধরিয়া বলে যে তাকে ছাড়িয়া থাকিতে বুক ফাটিয়া গিয়াছে কুবেরের—ও কপিলা, আমারে ফেইলা আর যাইস না, যাইস না-আমি নি মইরা গেলাম কপিলা তরে না দেইখা?

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *