প্রথম খণ্ড
দ্বিতীয় খণ্ড
তৃতীয় খণ্ড

২৯. তান্ত্ৰিক ধ্যানধারণার নারীপ্রাধান্য

তান্ত্ৰিক ধ্যানধারণার নারীপ্রাধান্য

প্রজনন ও উৎপাদনের সাদৃশ্য-নির্ভর এই জাদুবিশ্বাসটির আলোচনা অবশ্যই বিস্তারিতভাবে করতে হবে। কেননা তান্ত্রিকাদি ধ্যানধারণার উৎস অন্বেষণে এই জাদুবিশ্বাসটিই আমাদের কাছে সবচেয়ে মৌলিক সূত্র।

কিন্তু এই জাদুবিশ্বাসটির বিভিন্ন বিকাশ সংক্রান্ত আলোচনা তোলবার আগে তান্ত্রিকাদি ধ্যানধারণার সবচেয়ে মৌলিক বৈশিষ্ট্য নিয়ে আলোচনা তুলবো। বৈশিষ্ট্যটি হলো নারী-প্রাধান্য বা শক্তি-প্রাধান্য বা দেবী-প্রাধান্য। আমরা দেখাবার চেষ্টা করবো, এই শক্তি-প্রাধান্য বা নারী-প্রাধান্যের ব্যাখ্যা পাওয়া যাবে কৃষি-আবিষ্কারের বাস্তব পরিস্থিতির মধ্যেই : কৃষি-কাজ মেয়েদের আবিষ্কার, কৃষি-আবিষ্কারের প্রাথমিক পর্যায়ের ধ্যানধারণা তাই অনিবাৰ্যভাবেই নারীপ্রধান।

প্রথমে দেখা যাক, তান্ত্রিকাদি ধ্যানধারণার ক্ষেত্রে নারীপ্রাধান্য সত্যিই কী রকম। স্যর্‌ আর্থার এ্যভেলন(৪০৪)  বলছেন :

…we have in the Tantras the recognition of the fine principle that this doctrine and its expression in ritual are…for all, whatever be their race or caste or sex. This, marks a great advance on the parochial restrictions of the Vedas which are so often placed in opposition to the Tantra by English writers. The Sudra and woman are under none of the Vaidik bans. What, again, can be finer than the high veneration of woman which the Tantra inculcates. The Sufi author of the Dabistan, describing, in the seventeenth century, the Shaktas, speaks of the Mother of the World in the following charmful passage: “This Maya is the maker of the productions of this world and of its inhabitants, and the Creator of the Spirits and of the bodies: the universe and its contents are born from Her: from respect of the said productions and of the mentioned effects She is entitled Jagadamba, or Mother of the Universe …This sect hold women in great esteem and call them Shaktis, and to ill-treat a Shakti-that is, a women—is held to be a crime.” As H. H. Wilson also himself points out, women, as manifestation of the Great Cause of all, are entitled to respect and even to veneration. Whoever offends them incurs the wrath of Prakriti, Mother of all, whilst he who propitiates them offers worship to Prakriti Herself. And so, at a time when, as some allege, in accordance with the Vedas, the rite of Sati was being practised, and many a woman was being horribly oppressed, it was the Mahanirvana Tantra which forbade it on the grounds above stated. In conformity, also, with these views, we find that according to the Tantra, alone of the great Shastras, a woman may be a spiritual teacher (guru) and initiation by her achieves increased benefit.

অর্থাং, সংক্ষেপে, তন্ত্রমতে জাত-জাতি এবং স্ত্রী-পুরুষ নির্বিশেষে সকলেই এই মতবাদ ও আচার-অনুষ্ঠানের অধিকারী। স্ত্রী-শূদ্রের বিরুদ্ধে যে বৈদিক নিষেধ তন্ত্রের ক্ষেত্রে তার অভাব দেখা যায়। সপ্তদশ শতাব্দীর সুফি লেখক শাক্তদের বর্ণনায় বলেছেন,—এই সম্প্রদায়ের মতে মায়া থেকেই জগতের জন্ম, তাই তাকে জগদম্বা বলা হয়। শাক্তরা মেয়েদের বিশেষ শ্রদ্ধার চোখে দেখে, মেয়েদের প্রকৃতি বলে উল্লেখ করে, তাই মেয়েদের প্রতি দুর্ব্যবহার শাক্তদের কাছে প্রকৃতির বিরুদ্ধেই অপরাধ-বিশেষ। এইচ. এইচ. উইলসনও বলছেন, শাক্তমতে মেয়ের আদি-কারণের প্রতীক, তাদের প্রতি দুর্ব্যবহার করলে প্রকৃতি ক্রুদ্ধ হন, তাদের উপাসনা করলে প্রকৃতিরই উপাসনা করা হয়। এই কারণেই, সতীদাহ-প্রথার দরুন এ-দেশে যখন বহু নারী নির্যাতিতা হতো তখন মহানিৰ্বাণতন্ত্র এই প্রথাকে গৰ্হিত বলেছে। সমস্ত শাস্ত্রের মধ্যে একমাত্র তন্ত্রশাস্ত্র অনুসারেই মেয়েদের পক্ষে গুরু হওয়া সম্ভব, এমন কি মেয়েদের কাছে দীক্ষা নেওয়াই উত্তম।

তুলনায়, বৈদিক ঐতিহের পুরুষ প্রাধান্য কী রকম চূড়ান্ত নারী-বিদ্বেষে পরিণত হয়েছিলো তা অনুমান করা যেতে পারে বৈদান্তিক শঙ্করাচার্যের মনোভাব থেকে। শঙ্কর(৪০৫) বলছেন, নরকের দ্বার কী? না, নারী।

গ্ৰীক সভ্যতার ক্ষেত্রে এই নারীবিদ্বেষ সামগ্রিকভাবে সমাজকে কোন নৈতিক অধঃপতনের গভীরে নিয়ে গিয়েছিলো তার আলোচনা এঙ্গেলস্-এর গ্রন্থে দেখতে পাওয়া যায় :, the degradation of women recoiled on the men themselves and degraded them too—নারীর এই অধঃপতন পুরুষদের উপরেও প্রভাব বিস্তার করলো এবং তাদেরও অধঃপাতিত করলো। এও যেন এক রকম প্রকৃতির নিয়ম। আর তাই তন্ত্র-প্রসঙ্গে শ্ৰীযুক্ত পাঁচকড়ি বন্দ্যোপাধ্যায়(৪০৭) মন্তব্য করছেন :

শঙ্করাচার্য নারীকে নরকের দ্বার বলিয়াছিলেন, সেইহেতু ব্ৰহ্মানন্দগিরি শঙ্করাচার্যকে খুব একহাত তিরস্কার করিয়াছেন। তন্ত্ৰমতে নারীই আদ্যাশক্তিরূপিণী—জগন্ময়ী—জগজ্জননী; সুতরাং নারী পুজনীয়া, অৰ্চনীয়া, সাদরে রক্ষণীয়া। খৃস্টানধর্মে নারীকে শয়তানের প্রলুব্ধা জীব বলিয়া নির্দেশ করা হইয়াছে। খৃস্টানধর্ম অনুসারে নারীসঙ্গ শয়তানের প্ররোচনায় হইয়া থাকে। অতএব মেয়েমানুষ ও মৈথুন খৃস্টানধর্মের সিদ্ধান্ত অনুসারে মহাপাপজ। রামেন্দ্রসুন্দর ত্রিবেদী বলেন যে, খৃস্টানধর্মের এবং হঠযোগী নিষ্কামকর্মীদিগের নারীর প্রতি এই বিতৃষ্ণার ভাব গোড়াকার বৌদ্ধধর্মের প্রভাবেই ঘটিয়াছিল। আমরা এ-সিদ্ধান্ত অমান্য করিতে পারি না। কিন্তু মজা এই, যে ধর্ম বা সাধন পদ্ধতিতে নারীর অত্যন্ত নিন্দা আছে, সেই ধর্মের ধাৰ্মিকগণ পরে লাম্পট্যদোষে দুষ্ট হইয়া অধঃপাতে গিয়াছে। বৌদ্ধধর্মের অধঃপতন লাম্পট্যদোষেই ঘটিয়াছিল; খৃস্টানধর্মের অধঃপতনও এই লাম্পট্যদোষেই ঘটে।

তান্ত্রিকাদি আচার অনুষ্ঠানগুলিও উত্তরকালের বিপরীত পরিস্থিতিতে টিকে থাকতে গিয়ে কী ভয়ংকর বীভৎসতায় পর্যবসিত হয়েছিলো, তার আলোচনা অবশ্যই স্ত্রীযুক্ত পাঁচকড়ি বন্দ্যোপাধ্যায় উত্থাপন করছেন না; এবং আমরাও যেহেতু বর্তমানে তান্ত্রিকাদি ধ্যানধারণার উৎস-সন্ধানে অগ্রসর হয়েছি সেইহেতু এখানে আমাদের পক্ষেও সে-আলোচনা বিশেষভাবে প্রাসঙ্গিক হবে না। আমাদের যুক্তির বর্তমান পর্যায়ে যেটুক কথা বিশেষভাবে প্রাসঙ্গিক তা হলে, তান্ত্রিকাদি ধ্যানধারণার নারী-প্রাধান্য এবং এইদিক থেকে ভারতীয় সাংস্কৃতিক ঐতিহের পুরুষ-প্রধান বৈদিক ধারাটির সঙ্গে এই তান্ত্রিক ধারার মৌলিক প্রভেদ।

আমাদের এই মন্তব্যের বিরুদ্ধে কয়েকটি আপত্তি উঠতে পারে।

প্রথমত, তর্ক করে কেউ বলতে পারেন, তন্ত্র হাজার হোক শিবোক্তশাস্ত্র—অতএব এই শাস্ত্রের প্রকাশভঙ্গির মধ্যেই প্রমাণ রয়েছে যে, এখানে পুরুষের ভূমিকা সত্যিই গৌণ নয়।

দ্বিতীয়ত, তর্ক করে আরো বলা যেতে পারে, তান্ত্রিক সাধনায় ভৈরবীর স্থান থাকলেও পুরুষ সাধকদের দৃষ্টান্ত একটুও বিরল নয়। অথচ, আমাদের যুক্তি যদি ঠিক হয়,—অর্থাৎ কৃষি-কেন্দ্রিক জাদু-অনুষ্ঠানই যদি তন্ত্রের উৎস হয় এবং সে-অনুষ্ঠান যদি একান্তভাবেই মেয়েলি ব্যাপার হয়—তাহলে তন্ত্র সাধনাও নারী-প্রধান হবার কথা।

একে একে এই দুটি যুক্তির বিচার করা যাক।

প্রথমত তান্ত্রিক গ্রন্থগুলির রচনাভঙ্গি। শ্রীযুক্ত পাঁচকড়ি বন্দ্যোপাধ্যায়(৪০৮) একবার বলেছিলেন, “হাতের লেখা পুঁথি না পাইলে তন্ত্রের অনেক তত্ত্ব ঠিকমত বুঝা যায় না”। আমাদের মন্তব্য হলো, এমন কি ওই হাতের লেখা পুঁথিগুলিও যেহেতু অনেক উত্তরকালের সৃষ্টি সেইহেতু এগুলির রচনাভঙ্গি থেকে তন্ত্রের আদি ও অকৃত্রিম তাৎপর্য অনুমান করবার সুনিশ্চিত অবকাশ নেই। এ-রচনাভঙ্গি অর্বাচীন বলেই যে অনেকাংশে কৃত্রিম, এখানে তার সামান্ত প্রমাণ দেওয়া যায়।

এক, শাস্ত্রীয় প্রমাণ :

পদ্মপুরাণে পাষণ্ডোৎপত্তি অধ্যায়ে লিখিত আছে, লোকদিগকে ভ্ৰষ্ট করিবার জন্যই শিব নামের দোহাই দিয়া পাষণ্ডীরা অভিনব মত প্রকাশ করিয়াছে। (৪০৯)

এবং শ্ৰীমদ্ভাগবতের চতুর্থ স্কন্ধের দ্বিতীয় অধ্যায়ে ভৃগুও বলছেন(৪১০),

নষ্টশৌচ মূঢ়ধিয়ো জটাভস্মাস্থিধারিণ।
বিশস্তু শিবদীক্ষায়াং যত্র দৈবস্তুরাসবম্।।
ব্ৰহ্মা চ ব্রাহ্মণাশ্চৈব যদ্‌যূয়ং পরিনিন্দথ।
সেতুং বিধরণং পুংসামত পাষণ্ডমাশ্ৰিতাঃ।।
পবিত্রতাভ্রষ্ট মূঢ়বুদ্ধি জটাভষ্ম ও অস্থিধারীগণ শিবদীক্ষায় প্রবেশ করুন, যেখানে দৈবস্থরা ও আসব রহিয়াছে। ব্ৰহ্মা ও ব্রাহ্মণগণ, যাঁহাদের আপনারা এত নিন্দা করেন, তাহারাই পুরুষদিগের সেতুস্বরূপ, এইজন্যই আপনারা পাষণ্ডত্ব প্রাপ্ত হইয়াছিল।

অতএব, শাস্ত্রকারদের মতেই তন্ত্রের পক্ষে ওই শিবোক্ত-শাস্ত্র সাজবার চেষ্টাটা নেহাতই কৃত্রিম। এবং এই কৃত্রিমতা আরো প্রকট হয়ে পড়ে তন্ত্রসাধকদের ভঙ্গি থেকে।

তন্ত্রসাধকদের মনোভাব কী রকম?

তন্ত্রের শাক্ত সাধকগণ বলেন যে, শিব ত স্থাণুসদৃশ, একটা বিদ্যমানতার দ্যোতকমাত্র, তাঁহার উপাসনা করি কোন হিসাবে? শক্তি না থাকিলে শিব ত শব, অথচ শক্তিশূন্য শিব হইতেই পারেন না। অতএব, শিব আছেন, মাথার উপর থাকুন, আমরা মায়ের–আদ্যাশক্তির উপাসনা করিব। কারণ, তিনিই ত সব—তিনি মেধা, তিনি মায়া, তিনি লজ্জা, তিনি ক্ষমা, তিনি বুদ্ধি, তিনি ধৃতি, তিনি বিদ্যা, তিনি ছায়া, তিনি শান্তি, তিনি ক্ষান্তি—তাঁহাকে পুজা করিব না ত কাহার পুজা করিব?(৪১১)

অতএব, ওই প্রথম আপত্তির উত্তর দিয়ে আমরা সিদ্ধান্ত করতে চাই যে, যদিও উত্তরযুগে তান্ত্রিক গ্রন্থাদি শিবোক্ত-শাস্ত্র হিসেবেই রচিত হয়েছে তবুও রচনাভঙ্গির এই বৈশিষ্ট্য থেকে তান্ত্রিক ধ্যানধারণার নারীপ্রাধান্য সত্যিই অস্বীকৃত হয় না।

দ্বিতীয়ত, সাধনপদ্ধতির কথা।

আমাদের যুক্তি যদি ঠিক হয় তাহলে অনুমান করা প্রয়োজন যে, আধুনিক কালে তন্ত্রসাধক বলতে যদিও বহু (প্রধানতই?) পুরুষসাধককে দেখতে পাওয়া যায়, তবুও এককালে এ-সাধনা একান্তভাবেই নারীদের এক্তিয়ারে ছিলো।

এ-কথা অনুমান করবার মতো কোনো তথ্য আছে কি? আছে।

আচারভেদ তন্ত্র(৪১২) বলছে :

পঞ্চতত্ত্বং খপুষ্পঞ্চ পুজয়েৎ কুলযোষিতম্।
বামাচারো ভবেত্তত্র বামা ভূত্বা যজেং পরাম॥
পঞ্চতত্ব অথবা পঞ্চমকার, খপুষ্প অর্থাৎ রজস্বলার রজঃ ও কুলস্ত্রীর পূজা করিবে। তাহা হইলে বামাচার হইবে। ইহাতে নিজে বামা হইয়া পরাশক্তির পুজা করিবে।

বামা ভূত্বা যজেং পরাম্—পরাশক্তিকে বামা হয়ে পূজা করতে হবে। এবং এ-কথা শুধুমাত্র আচারভেদ তন্ত্রের কথা নয়, তন্ত্রের একটি প্রধানতম কথা। তাই স্যর্‌ ভাণ্ডারকার বলছে,(৪১৩) :

The ambition of every pious follower of the system is to become identical with Tripurasundari, and one of his religious exercises is to habituate himself to think that he is a woman. Thus the followers of the Sakti school justify their appellation by the belief that God is a woman and it ought to be the aim of all to become a woman.
এই সম্প্রদায়ের নিষ্ঠাবান অনুসরকের উচ্চাকাঙ্খা হলো, ত্রিপুরাসুন্দরীর সঙ্গে অদ্বৈতভাব স্থাপন করা এবং এই সাধনপদ্ধতির একটি অঙ্গ হলো নিজেকে নারী জ্ঞান করতে অভ্যস্থ হওয়া। অতএব, শাক্ত সম্প্রদায়ের অনুগামীরা নিজেদের পদবীটিকে এই বলে ব্যাখ্যা করেন যে, ঈশ্বর নারীই এবং নারীত্বই সকলের আদর্শ।

তন্ত্রসাধকেরা এই রকম নারীভাবে সাধনা করবার চেষ্টা করেন কেন? এ-প্রশ্নের মাত্র একটিই বৈজ্ঞানিক উত্তর সম্ভবপর : তন্ত্রসাধনা আদিতে নারীদেরই সাধন-পদ্ধতি ছিলো—নারীভাবে সাধনার চেষ্টাটা তারই স্মারক।

পৃথিবীর অন্যান্য নানান ধর্মের বেলাতেও অনুরূপ ঘটনা ঘটতে দেখা যায়; যে-সাধনা আদিতে শুধুমাত্র মেয়েলি ব্যাপার ছিলো তা উত্তরকালে পুরুষদের এক্তিয়ারে আসবার পরও সাধন-পদ্ধতি ও সাধকের ভঙ্গির মধ্যে নারীপ্রাধান্যের স্মারক টিকে থেকেছে।

রবার্ট ব্রিফল্ট(৪১৪) দেখাচ্ছেন এবং অজস্র তথ্যের পর্যালোচনার ভিত্তিতেই দেখাচ্ছেন, কৃষিকেন্দ্রিক জাদু-অনুষ্ঠান থেকেই উত্তরকালের নানা ধর্মসম্প্রদায়ের উদ্ভব হয়েছে। এবং কৃষিকেন্দ্রিক অনুষ্ঠান থেকে উদ্ভূত বলেই আদিতে এই সম্প্রদায়গুলি মেয়েদের গুহ্যসম্প্রদায় মাত্র ছিলো। পরে এগুলির মধ্যে পুরুষদের প্রবেশাধিকার এবং ক্রমশ প্রাধান্যও দেখা দিয়েছে। কিন্তু তা সত্ত্বেও অতীত নারীপ্রাধান্যের স্মারক মুছে যায়নি। তাই বহুক্ষেত্রেই দেখা যায়, পুরুষ পুরোহিতদেরও নারীভাবে সাধনা করতে হচ্ছে এবং সাধনার সময় নারী সাজতে হচ্ছে।

তন্ত্র-সাধনাও সেই রকমই। বামাভাবে, বামা হয়ে, সাধনা করতে হবে।

বামাচার নামটির পিছনেও এই ইতিহাস লুকোনো আছে কি না তা ভেবে দেখা যেতে পারে। আমরা ইতিপূর্বে বাম শব্দকে কাম অর্থে গ্রহণ করেছি —বামাচার অর্থাৎ কামাচার(৪১৫)। কিন্তু ওই বামাচার নামটির—বিশেষ করে তন্ত্রসাধনার ক্ষেত্রে বামাচার নামটির—পিছনে আরো কিছু লুপ্ত ইতিহাস থাকা অসম্ভব নয়। এ-সাধনা এককালে স্ত্রী-আচার মাত্র ছিলো বলেই হয়তো একে এখনো বামাচার বলা হয়। “কাহারও মতে ইহারা অনেক বেদবিরুদ্ধ বিপরীত আচরণ করিয়া থাকেন বলিয়া বামাচারী নামে খ্যাত”(৪১৬)। অবশ্যই বাম বা বামা কোনো শব্দকেই আক্ষরিক অর্থের দিক থেকে বেদবিরুদ্ধ ব্যাঞ্জক বলে গ্রহণ করবার অবকাশ নেই। তবুও উদ্ভূত মতবাদ অন্তত একটা অর্থে ভ্রান্ত নয় : বৈদিক আচার পুরুষপ্রধান বলেই স্ত্রী-আচার বা বামাচার স্বভাবতই বেদবিরুদ্ধ। অবশ্যই এই বামাচার নামটির নজির দেখিয়েই যদি দাবি করা হয় যে, তন্ত্রসাধনা এককালে স্ত্রী-আচার মাত্র ছিলো, তাহলে আপত্তি তুলে হয়তো বলা হবে, তন্ত্রসাধনা বলতে শুধুমাত্র বামাচার নয়; নিত্যাতন্ত্রে ও কুলার্ণবে(৪১৭) সাত প্রকার আচারের কথা লিখিত আছে। কিন্তু এ-হেন আপত্তির বিরুদ্ধে খোদ তান্ত্রিকেরা যে ঘোরতর আপত্তি তুলবেন সে-বিষয়ে কোনো সন্দেহ নেই। কেননা,

এখনকার বঙ্গীয় তান্ত্রিকগণের মধ্যে বামাচার ও দক্ষিণাচার উভয়াচার মিশ্রিত দেখা যায়। কিন্তু প্রকৃত তান্ত্রিকেরা একথা স্বীকার করেন না। বামকেশ্বর তন্ত্রে ৫১ পটলে লিখিত আছে :–
আচারো দ্বিবিধো দেবি বামদক্ষিণভেদতঃ।
জন্মমাত্ৰং দক্ষিণং হি অভিষেকেন বামকম্।
দেবি! বামাচার ও দক্ষিণাচার ভেদে আচার দুই প্রকার। জন্মমাত্র দক্ষিণ এবং অভিষেক হইলে বামাচারী হয়।(৪১৮)

তাহলে অকৃত্রিম তন্ত্রসাধনা বলতে বামাচারই এবং বামাচার নামটির পিছনে ওই গোপন ইতিহাস থাকা অসম্ভব নয় যে, তান্ত্রিকাচার এককালে স্ত্রী-আচার। মাত্রই ছিলো।

—————
৪০৪. A. Avelon PT Preface xvii.
৪০৫. পাঁচকড়ি বন্দ্যোপাধ্যায় : রচনাবলী ২:৩২০।
৪০৬. F. Engels OFPPS 107.
৪০৭. পাঁচকড়ি বন্দ্যোপাধ্যায় : রচনাবলী ২:৩২০।
৪০৮. ঐ ২:২৫৭।
৪০৯. বিশ্বকোষ ৭:৫০৭-৮।
৪১০. ঐ ৭:৫০৭।
৪১১. পাঁচকড়ি বন্দ্যোপাধ্যায় : রচনাবলী ২:২৯৭।
৪১২. বিশ্বকোষ ৭:৫১২।
৪১৩. R. G. Bhandarkar VS 146.
৪১৪. R. Briffault op. cit. 2:525, 526, 530-4, 541 ; 3:129ff.
৪১৫. পৃ. ১০২-১২।
৪১৬. বিশ্বকোষ ৭:৫১৩।
৪১৭. ঐ ৭:৫১২।
৪১৮. ঐ ৭:৫১৩।