তাবু ছেড়ে ছুটে আসে

আকাশে উটে কুঁজ, বাঁকা ছোরা হয়ে ঝোলে
চাঁদ, চোখে ঘুমের নাছোড় আঠা, তাঁবু কাঁপে অশান্ত হাওয়ায়।

“এ কিসের শব্দ শুনি? এ কেমন গান,
যা সুরেলা বুলবুলও পারে না গাইতে, আসে ভেসে
আমার তাঁবুতে? এরকম আর্তস্বরে
কে ডাকছে লায়লা লায়লা বলে? আমার কায়েস ছাড়া, হায়,
কে আর ডাকতে পারে আমাকে এখানে? এরকম
মর্মমূল-ছেঁড়া ডাক কার হতে পারে আর বলে
ব্যাকুল লায়লা তাঁবু ছেড়ে ছুটে এসে
দাঁড়ায় প্রশস্ত পথে। নেকাব ছিল না মুখে তার।
যেনো সে হরিণী এক, গায়ে যার লেগেছে আগুন
অকস্মাৎ বেখেয়ালে। শিশির-ঝরানো
আওয়াজে লায়লা করে উচ্চারণ, আমার উন্মাদ
যে-জন তোমরা তার দিকে কেন ছুঁড়ছো পাথর
বার বার? কী ওর কসুর, বলো? তোমাদের কারো
কোনো ক্ষতি করেনি যে, তাকে
কেন দিচ্ছো সাজা মিছেমিছি? দ্যাখো কী হাল করছো তার।
মাথা ফেটে রক্ত ঝরছে, অথচ
একেবারে বেখবর সে এখন, শুধু লায়লার
নামে গান বাঁধে,
যে গান মুদ্রিত হয় ধু ধু মরুভূতে, পান্থপাদপে, নহরে
এবং হরিণ শাবকের পিঠে। দ্যাখো কায়েসের
বিলাস-ছোপানো
পোশাক হয়েছে আজ মজনুর শতচ্ছিন্ন মলিন লেবাস।
দোহাই খোদার, ওকে কোরো না পীড়ন,
বরং আমাকে দাও জুলুমের রূঢ় দাগ, যত দিতে চাও।
লায়লা কাতর কণ্ঠে আরো কিছু কথা
বলে সেই প্রস্তর নিক্ষেপকারীদের উদ্দেশে, ‘সেদিন এক
নামাজীর সেজদার সামনে দিয়ে কায়ক্লেশে হেঁটে
গিয়েছিল ফোস্কাময় পায়ে
যে-মজনু তাকে সে ধার্মিক জোরে সোরে
শাসালেন, “হে নাদান, দেখছো না পড়ছি নামাজ?’
হে প্রবীণ, মাফ চাই আমি,
এই অভাজন একজন মানবীর প্রেমে মশগুল হয়ে
তাকে ছাড়া অন্য কিছু দ্যাখে না দু’চোখে,
অথচ আপনি ত্রিলোকের মালিকের এবাদতকালে এই
নগণ্য লোকের ছায়া দেখে
এলেন বিদ্বেয়ে তেড়ে এবাদত ছেড়ে? মজনুর
জবাবে লজ্জিত বর্ষীয়ান
আবার গেলেন ফিরে জায়নামাজের মখমলে।
“এ রকম যে মানুষ, তাকে কেন হানছো আঘাত”,
বলে কায়েসকে বুকে টেনে নিয়ে অশ্রুপাত করে
লায়লা এবং মজনুর বুক হয় দীর্ঘশ্বাস,
“মিনতি কোরো না আর হে লায়লা আমার, হানুক
নিষ্ঠুর আঘাত ওরা, যত ইচ্ছে ছুঁড়ুক পাথর,
লায়লা তোমার নাম উচ্চারণ করলেই পাথর নিমেষে
রূপান্তরে বেহেশতের ফুল! প্রিয়তমা,
ক্ষমা কর তোমার এ প্রেমিকের বেহদ উদ্ভ্রান্ত আচরণ।
বন্দনায় মুড়ে দিতে গিয়ে অখ্যাতির কালো তাজ
দিয়েছি পড়িয়ে তোমাকেই; নিজেই নিজের বৈরী এ কায়েস।

“কী আর করার আছে ক্ষমা ভিক্ষা ছাড়া? যদি আমি
লায়লা লায়লা ডেকে এ মরুর বুকে,
কখনো ঘুরে না বেড়াতাম রাত্রিদিন ঘুমহীন, খাদ্যহীন,
তাহলে মতোনা
কখনো তোমার বদনার। দুই কাবীলার ঘোর রেষারেষি
কলহ বিবাদ আজ আমাদের দুজনকে বিপন্ন করেছে।
আমার হৃদয় যদি কণ্ঠ হয়ে করে উচ্চারণ
তোমার মধুর নাম, তবে আমি তাকে
কী করে থামাবো, বলো? ঘোড়ার কংকালময় বালিয়াড়ি আর ফণিমনসায়
সর্বদা থাকবে লেগে আমার নিজস্ব হাহাকার।
মৃত্যুর পরেও তুমি হেঁটে যাবে কবরের ওপারে, কাঙ্ক্ষিত
অমরতা নামক সঙ্গীর হাত ধরে,

এখানে প্রতিটি ফুল বাতাসের কানে রটাবে তোমার নাম।
জীবন তো দীর্ঘশ্বাস হয়ে রইলো, বিচ্ছেদ মলিন;
মৃত্যুর দরজা ছাড়া মিলনের স্বতন্ত্র প্রবেশদ্বার নেই।