চিলেকোঠার সেপাই – ৫৩

চিলেকোঠার সেপাই – ৫৩

তার জোড়পায়ের লাথিতে তালা ভেঙে দরজা খুলে গেলে ওসমান রাস্তায় পড়ে গিয়েছিলো চিৎপটাং হয়ে। ডান পায়ের পাতা তার ঢুকে যায় রাস্তার পাশে রাখা রিকশার স্পোকের ফাঁকে, তার পায়ের জায়গা সংকুলানের জন্য বেশ কয়েকটা স্পোককে ভেঙে যেতে হয়। বা পায়ের হাঁটুর নিচের দিকটা পড়ে টুকরা কাচের ওপর, ভাঙাচোরা খোয়াও ছিলো সেখানে, হাঁটুর নিচে তার থেতলে গেছে। ওসমানের মাথা পড়েছিলো নালার ঠিক কিনারে, লম্বা লম্বা চুলে নালার ময়লা থিকথিক করে। মাথার চাদি দিয়ে রক্ত বেরুচ্ছিলো। তবে ওসমান বেশিক্ষণ ঐ অবস্থায় থাকতে পারেনি, খিজিরের ধমকে লাফ দিয়ে উঠে দ্যাখে তার সামনে ও ওপরে, পাশে ও পেছনে ল্যাম্পোস্টের বাম্বের আলো ডিমের কুসুমের মতো ঘন। এর সঙ্গে মিশেছে হলুদ জ্যোৎস্না। এই মিশ্রিত আলো মলমের মতো ওসমানের গা জুড়িয়ে দেয়। তার সামনে খিজির। খিজির দাঁড়াও বলে ওসমান পা বাড়ায়। সে চলছিলো রাস্তার ডান দিক দিয়ে কিন্তু এদিকে লাইসেন্স-প্রার্থী রিকশার সারি। তাকে তাই চলতে হয় রাস্তার মাঝখান দিয়ে। কিন্তু খিজিরের গতি বড়ো দ্রুত, ওসমান তাই পা চালায় একটু জোরে। কুয়াশার নিচে ল্যাম্পোস্টে ল্যাম্পোস্টে ঢুলঢুল বাল্বগুলো মানুষের পদার্পণে চমকে জ্বলে ওঠে। এইসব বাঘের কম্পন ও হাল্কা কুয়াশার ধীরগতিতে রাত্রি গড়ায়। হাওয়ায় হাওয়ায় রাত্রির জমাট বাধা কালো শরীর রঙ বদলায়। আকাশ তাই এই কালো, এই কালচে নীল, এই গোলাপী কালো, এই গোলাপী নীল, আবার দেখতে দেখতে নীলচে-নীল। রাত্রিকালের শরীর একটু ভিজে, ওসমানের শীতশীত করছিলো। পায়ের গতি বাড়াবার সঙ্গে সঙ্গে শীতশীত ভাবটা কেটে যায়। ডানদিকে ও বাদিকে গলি-উপগলি সব ফাকা। কিন্তু রাস্তায় মানুষ না থাকলে কি হবে, আশেপাশের বাড়িঘরের মানুষের নিশ্বাসে প্রশ্বাসে গলি-উপগলি ফেপে উঠে গোটা সুভাষ বোস এ্যাঁভেনুকে ঠেলে নিয়ে যাচ্ছে জনসন রোডের মোহনায়। না, হাঁটার জন্যে ওসমানকে তেমন কোনো উদ্যম নিতে হয় না, রাস্তার স্রোতে তার পাজোড়া ঢেউয়ের মতো এগিয়ে চলেছে। মুশকিল এই খিজির আলিকে নিয়ে। লোকটা বারবার অদৃশ্য হয়ে যাচ্ছে। ওসমান একেকবারে হাক দেয়, খিজির দূর থেকে জবাব আসে, আহেনা’ একবার মনে হলো সে খুব কাছে চলে এসেছে, এটু জলদি করেন ওসমান সাব পাও দুইখান মনে লয় ইসকু মাইরা রাস্তার লগে ফিট কইরা দিচ্ছেন!’ তা ওসমান তো প্রায় দৌড়েই চলেছে, খিজিরের সঙ্গে পাল্লা দেওয়া কি সোজা কথা? খিজির চলে পানির মধ্যে মাছের মতো। দ্যাখো তো, এই লোকটির সঙ্গ নেওয়ার জন্য ছুটতে হয় ওসমানকে।
মিউনিসিপ্যালিটি অফিসের সামনে গোলাচি গাছের রোগা ১টি ডালের মোটা ছায়া পড়েছে ডাস্টবিনের ওপর। তার পাশে কুণ্ডুলি পাকিয়ে শোয়া কুকুরটা তাকে দেখে ঘেউঘেউ করে। তার ঘেউঘেউতে সাড়া দেয় কলতাবাজারের মাথায় যে পানির ট্যাঙ্ক সেখানকার ৩/৪টে কুকুর। মধ্যরাত্রে প্যাট্রোলপুলিসের সতর্ক বশির জবাবে যেমন বাঁশি বাজায় দূরের পুলিস, এই এলাকার কুকুরগুলাও তেমনি ১টার পর ১টা ঘেউঘেউ করে চলেছে। ইটার গতি কমিয়ে ওসমান ধমক দেয়, চুপ কর। কুত্তার বাচ্চা! খিজির কোথেকে হেসে ওঠে, আহেন ঐগুলি কিছু করবো না। ডাফরিন হোস্টেলের বাস্তুছুচোটি ঘরে ফিরছিলো ফুটপাথের ধার ঘেঁষে, ওসমানকে দেখে কিংবা তার পায়ের আওয়াজে সে চিটি করে ওঠে। সারি সারি রিকশার পাশ দিয়ে হেঁটে যাচ্ছিলো কালো-সাদা বিড়াল। সে একটু থমকে দাঁড়ালো, তারপর রাস্তা ক্রস করে গিয়ে দাঁড়িয়ে রইলো সেন্ট ফ্রান্সিস স্কুলের গেটের সামনে। টাইন আহেন। ফের খিজিরের গলা। এইবার ওসমান তাকে একেবারে সামনা-সামনি পায়। খিজির ঝুলছে ইলেকট্রিক তারের সঙ্গে, তারে ঝুলতে বুলতে লোকটা আবার কোথায় চলে গেলো?
মাথার ওপর ইলেকট্রিক তারের ঝাঁক ছুটে চলে ল্যাম্পোস্ট ছুয়ে ছুঁয়ে। তারের ভেতরকার বিদ্যুতের চলাচল খিজির নিশ্চয়ই স্পর্শ করতে পাচ্ছে। স্পর্শ করা কি বলছো? লোহার রডের মতো আঙুলগুলো দিয়ে ইলেকট্রিক তার মুচড়ে বিদ্যুৎ সে নিংড়ে নিচ্ছে নিজের হাড্‌ডিসার শরীরে। না হলে ব্যাটা এরকম স্পিড পায় কোথেকে? ওসমান এবার খুব জোরে দৌড়াতে শুরু করে। তার আশা ইলেকট্রিক তারের কাক ১বার না ১বার ছোঁ মেরে তাকে তুলে নেবে ঐ উঁচুতে, খিজিরের পাশে চলতে তখন আর তাকে কোনো বেগ পেতে হবে না।

ভিক্টোরিয়া পার্ক ঘিরে ২বার চক্কর দেওয়ার পর ওসমান গনি একেবারে আড়ালে পড়ে গেলো। তাহলে সে রাস্তা ধরলো কোনদিকের ?—এখন থেকে অনেক জায়গায় যাওয়া যায়। ওসমান কোথায় যেতে পারে?
নর্থব্রুক হল রোড ধরে শ্যামবাজার গেলে সামনে বুড়িগঙ্গা। বুড়িগঙ্গা পার হতে পারলে তাকে ঠেকায় কে?
ট্যাকসি-স্ট্যান্ডের ভেতর দিয়ে চিত্তরঞ্জন এ্যাঁভেনু বায়ে রেখে শাখারি পটি ক্রস করে চলে যেতে পারে ইসলামপুর। পাকুড়তলা, মিটফোর্ড, ইমামগঞ্জ পেরিয়ে চকবাজার। ব্যদিকে বড়ো কাটরার ভেতর দিয়ে হেঁটে গেলে সোয়ারি ঘাট। ওসমানের যেমন স্পিণ্ড তাতে মোগল আমলের বাড়ি-ঘর ছড়মুড় করে নদীতে টেনে ফেলে দিব্যি সাঁতরে সে চলে যেতে পারে নদীর ওপারে। ওপারে গ্রাম। ১টার পর ১টা গ্রাম যদি সে পেরিয়ে যায় তো তাকে ঠেকায় কে?
আবার ভিক্টোরিয়া পার্ক থেকে জনসন রোড হয়ে নবাবপুর ধরে দৌড়ালে পৌঁছে যাবে গুলিস্তান। গুলিস্তান এলাকায় যানবাহনের অভাব হবে না। ১টা বাসে চাপতে পারলে চলে যেতে পারে অনেকদূর।
আরেকটি রাস্তার কথা বিবেচনার মধ্যে রাখা দরকার। ভিক্টোরিয়া পার্কের উত্তরে পুরনো পানির ট্যাঙ্কের সামনে দিয়ে কলতাবাজার হয়ে ওসমান ছুটতে পারে দোলাই খালের দিকে। খালে খিজিরের ছায়া দেখে তার সঙ্গলাভের উদ্দেশে পানিতে ডাইভ দেওয়াটা ওসমানের সমীচীন হবে না। ডাইভ দিতে গেলে ওসমান আহত হতে পারে। কারণ সেখানে পানির চিহ্নমাত্র নাই, খাল বুজে রাস্তা তৈরি হচ্ছে। রহমতউল্লার মজুরেরা সেখানে ইট বিছায়, মেশিনে সুরকির সঙ্গে সিমেন্ট মেশায়, লম্বা লম্বারডের ওপর ঐগুলো ঢেলে রাস্তা বানায়। দিনের বেলা হলে আলাউদ্দিন মিয়াকে সেখানে পাওয়া যেতো। কারফ্যু বলে রাত্রে কাজ বন্ধ। দিনের বেলা হলে আর কেউ না হোক, জুম্মনটা ওসমানের আশেপাশে ঘুরঘুর করতো। কারফ্যুর দাপটে ছোড়াটা এখন কমলাপুর স্টেশন কি স্টেডিয়ামের বারান্দায় পড়ে পড়ে ঘুমাচ্ছে। আবার এমনও হতে পারে সে ঘুমিয়েছিলো সদরঘাট টার্মিনালে। জাহাজ ভিড়বার সময় বাশির গম্ভীর আওয়াজে তার ঘুম ভেঙে গেছে। জোড়াহাঁটুর মাঝখানে গুঁজে-রাখা প্রায়ার স্কু-ড্রাইভার খুঁজে না পেয়ে জুম্মন এদিক-ওদিক দেখছে। আচ্ছা, খিজির কি তার প্লায়ার ও কু-ড্রাইভারের জন্য জুম্মনকে রাস্তায় খুঁজে বেড়াচ্ছে? না, রাস্তায় লোক থাকবে কেন? রেডিও, টেলিভিশন, সংবাদপত্র ও সরকারী গাড়ি থেকে মাইকে প্রচারিত বিধি অনুসারে কারফ্যু বলবৎ থাকাকালে রাস্তায় কাউকে দ্যাখামাত্র গুলি করা হবে।
এই প্রসঙ্গে কারফ্যু প্রয়োগকারী সংস্থার খাকি পোষাকধারী সশস্ত্র সদস্যদের কথা মনে করা যায়। ১টি মাত্র বুলেট খরচ করে ওসমানের গতি তারা চিরকালের জন্য বন্ধ করে দিতে পারে। তবে জানের ভয়ডর তাদের কম নয়। মানুষের বাধ্যতামূলক গৃহবাস সম্বন্ধে নিশ্চিত হয়ে ল্যাজ গুটিয়ে তারা মাথা গুঁজে দিয়েছে তাদের অস্ত্রসজ্জিত ছাউনির নিরাপদ গহ্বরে।
দোলাই খালের ওপর নির্মীয়মান রাস্তা ধরে ওসমান এতোক্ষণ হয়তো চলে গেছে বংশাল, নাজিরা বাজারের দিকে। বুজে-ফেলা দোলাই খালের বহুকাল-আগেকার দাঁড় টানার তালে তালে পা ফেলে সে বোধহয় ঢুকে পড়েছে এই খালের ধারের কোনো বস্তিতে। এমনও হতে পারে যে খিজিরের পেছনে দৌড়াতে দৌড়াতে ওসমান টু মেরে চলেছে বস্তির ঘরে ঘরে। জুম্মনকে হয়তো খিজির সঙ্গে নিতে চায়। বস্তি এলাকায় টায়ার ও ন্যাকড়াপোড়া লোমশ ধোঁয়ার ভেতর ঝুলতে ঝুলতে খিজির জুম্মনকে খুঁজতেও তো পারে। তা খিজিরের পক্ষে সেটা এমন কিছু নয়। কিন্তু জলজ্যান্ত ১টা শরীর নিয়ে ওসমানের তো হাটা ছাড়া আর গতি নাই। গ্রহ-নক্ষত্রের ফোকাসে গোলাপি নীল, নীলচে নীল, গোলাপি সাদা এবং নীলচে সাদা আকাশের নিচে এবং পানিকাদা কফথুথু গুমুতের ওপর পা টানতে টানতে ওসমানের চেহারায় নতুন ধরনের দাগ পড়ছে। এখন খাকি বলে কালো বলো, সবুজ বলো সাদা বলো-কারো সাধ্যি নাই যে তাকে সেই ওসমান গনি বলে সনাক্ত করে।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *