• Skip to main content
  • Skip to header right navigation
  • Skip to site footer

Bangla Library

Read Bengali Books Online (বাংলা বই পড়ুন)

  • নতুন সব বই
  • লেখক
  • সিরিজ
  • বইয়ের ধরণ
  • পুরানো সব ক্যাটাগরি
  • My Account →
  • নতুন সব বই
  • লেখক
  • সিরিজ
  • বইয়ের ধরণ
  • পুরানো সব ক্যাটাগরি
  • My Account →
  • বাংলা ডিকশনারি
  • বাংলা কৌতুক
  • বাংলা লিরিক
  • বাংলা রেসিপি
  • হেলথ টিপস এন্ড নিউজ

বাংলা নতুন/পুরাতন বইয়ের পিডিএফ ডাউনলোড/সন্ধান করতে আমাদের বাংলা পিফিএফ সাইটে ক্লিক করুন।

Bangla PDF

চিলেকোঠার সেপাই – ৫১

লাইব্রেরি » আখতারুজ্জামান ইলিয়াস » চিলেকোঠার সেপাই (উপন্যাস) » চিলেকোঠার সেপাই – ৫১

চিলেকোঠার সেপাই – ৫১

বন্ধ কপাট ইয়েস বন্ধ কপাট, আগডুম বাগডুম ইন খোলা মাঠ, ম্যান অফ দি কপাট ম্যান ইনদি কপাট, দুই তিনচার পাঁচ ছয় সাত আট, কর্নেলে জেনারেলে করলো লোপাট, কপাট বন্ধ হলে কপাটি জমাট, স্টেমিটিল সিডেটিভ ঝপট ঝপাট, ম্যান ইন দি কপাট ইয়েস বন্ধ কপাট।–দিনে দিনে ওসমানের ছড়া লম্বা হয়, ঘণ্টায় ঘণ্টায় বাড়ে। মাঝে মাঝে কয়েকটা লাইন তার ঝরে পড়ে, পরদিন সদ্যোজাত লাইনের সঙ্গে কোনোটা ফিরে আসে, কয়েকটি লুপ্ত হয় চিরকালের জন্যে। ওসমান প্রায় সবসময় এসব গুনগুন করে, কখনো কথা বাদ দিয়ে এমনি সব ভাজে, কখনো বেশ দরাজ গলায় আবৃত্তি করে, মাঝে মাঝে বিকট স্বরে চাচায়। তবে চ্যাচানোটা কম, বিড়বিড় করে বলতেই সে ভালোবাসে। শুনতে শুনতে আনোয়ারের একরকম মুখস্থ হয়ে গেলো, এমনকি নিজেও সে ছড়াটির কোনো লাইন গুনগুন করছে। শওকত ভাই ১দিন এসব শুনে কাগজে লিখে রাখতে বললে, সাইকিয়াট্রিস্টকে দাখালে ওসমানের চিকিৎসায় কাজে লাগতে পারে।
আজ বিকালবেলা ১টা ১ইঞ্জেকশন নেওয়ার পর থেকে ওসমান একটু শান্ত। এমনকি রাত্রে মাছে ঝোল দিয়ে ভাত খেতে বসে খিজিরকে খাওয়াবার জন্য ভাতের লোকমা শূন্যে ছুড়লো না, বরং নিজেই চেটেপুটে খেয়ে হাত না ধুয়েই চুপচাপ বসে রইলো। আনোয়ার হাত ধুতে বললে সে স্বরচিত ছড়া খুব মিহিদুরে আবৃত্তি করতে লাগলো।
ওসমানের নিস্তেজ চেহারা দেখে আনোয়ার তার পাশে বসে, আস্তে আস্তে জিগ্যেস করে, ওসমান বাড়ি যেতে ইচ্ছে করে? তোমার আব্বাকে টেলিগ্রাম করে দিই? টেলিগ্রাম করেনি, তবে চিঠি দেওয়া হয়েছে। ইন্ডিয়ার সঙ্গে যোগাযোগ করা মুশকিল। ওসমানের পাসপোর্টও নাই, পাসপোর্ট পাওয়া খুব কঠিন। এর ওপর ওসমানকে পাসপোর্ট অফিসে হাজির করলে ওকে পাসপোর্ট তো দেবেই না বরং বাপ কোথায়, মা কোথায়—এসব ধরে একটা যা তা কাণ্ড করে বসবে। আনোয়ার তবু ফের জিগ্যেস করে, ওসমান বাড়ি যেতে ইচ্ছে করে?
ওসমানের লালচে চোখে গাঢ় লাল প্রলেপ পড়ে, গাঢ় খয়েরি মণিজোড়া ২ ফোটা মধুর মতো তরল হয়ে ছড়িয়ে পড়ে। কিন্তু মাত্র কয়েক পলকের জন্য। দেখতে দেখতে তরল মধুবিন্দু ফের জমাট বাধে এবং চোখের গাঢ় লাল রঙ হয় লালচে। জমাটবাঁধা মণিজোড়ায় এলোমেলো দৃষ্টি পুরু সর ফেলে। ওর চোখের এই রঙবদল দেখে আনোয়ারের মায়া হয়। ওসমান উঠে এবার শুয়ে পড়ো, কেমন?
কেন? বাড়ি যেতে বললেন যে? ওসমান উঠে দাঁড়ায়, জানলা দিয়ে উকি দেয় ছাদে, ছাদের শূন্যতার উদ্দেশে বলে, খিজির, একটু দাঁড়াও। আমি আসছি।
কোথায় যাবে ওসমান? আনোয়ারকেও উঠে দাঁড়াতে হয়, এখন ঘুমাও।
খিজির আমি রেডি। বলে ওসমান মিষ্টি হেসে মাথা নোয়ায় আনোয়ারের দিকে, আচ্ছা আসি। সিঁড়ির দিকে যেতে যেতে সে অনুরোধ করে, ছিটকিনিটা খুলে দিন।
ওসমানের অবধারিত বিস্ফোরণ ঠেকাবার জন্য আনোয়ার চট করে ঐ দরজার কাছে চলে যায় এবং ওসমানের প্রতি তার ব্যবহার বদলাতে বাধ্য হয়, ওসমান, গোলমাল করো না, বিছানায় শুয়ে পড়ো।
এই ধমকেই ওসমান এই লোকটার ওপর তার স্বল্পস্থায়ী আস্থা সম্পূর্ণ হারিয়ে ফেলে এবং খিজির, একটু দাঁড়াও বলতে বলতে তার এটো হাতে ছিটকিনি খোলার উদ্যোগ নেয়। সঙ্গে সঙ্গে আনোয়ারের ডান হাত চলে যায় দরজার ছিটকিনিতে। বা হাত দিয়ে ওসমান আনোয়ারের ডান হাতের ওপর খুব জোরে ঘুষি মারে, এতোটাই জোরে যে তার বেগে আনোয়ারের হাতটা নিচে নেমে আসে। এই সুযোগে ওসমান ছিটকিনি খুলে ফেলে। কিন্তু আনোয়ার তার সমস্ত শরীর দিয়ে আটকে রেখেছে গোটা দরজা, তাই দরজা খুলতে পারে না। ওসমান তখন চিৎকার করে খিজিরের সাহায্য চায়, খিজির আরে এসো না, আমাকে দরজা খুলতে দিচ্ছে না তো!’ ওসমান তার ২হাত দিয়ে আনোয়ারের ডান হাত চেপে ধরেছে, তার বা হাতটা পড়েছে একটু বেকায়দায়, সেটা কোনো কাজে লাগনো যাচ্ছে না। আনোয়ার ভয় পায়, ওসমানের হাতে যে প্রবল বল টের পাওয়া যাচ্ছে তা কিন্তু অস্বাভাবিক। রাত্রি বাজে ১০টা, বাইরে কারফ্যু, এই অন্ধকারে অপঘাতে মৃত খিজির কি ওসমানের ওপর সাঙ্ঘাতিক ভাবে ভর করলো? ১ জন মৃত ও ১ জন জীবিত মানুষের সম্মিলিত শক্তির সঙ্গে সে পারবে কেন? ভয়ে আনোয়ারের গলা শুকিয়ে আসে, আজ রাত্রে এদের সঙ্গে আবার কোনো দুর্ঘটনা না ঘটে। জীবিত মানুষের গলা শোনাবার জন্যে নিজেই চিৎকার করে ওঠে, ওসমান, তুমি এ কি শুরু করলে? সরে যাও, এখান থেকে সরো!
জানলা দিয়ে ঢুকতে পারবে না? দাঁড়াও, ছাদের দরজা খুলে দিচ্ছি। খিজিরকে এই নির্দেশ দিয়ে ওসমান তাকে ঘরে ঢোকবার জন্য ছাদের দিককার দরজা খোলার উদ্দেশ্যে এদিকের দরজা থেকে সরে দাঁড়ায়। সঙ্গে সঙ্গে আনোয়ার ওর ২টো হাতই ধরে ফেলে। তার হাতগুলো আনোয়ারের জোড়হাতের ভেতর নড়াচড়া করে। টানতে টানতে আনোয়ার তাকে বিছানার দিকে নেওয়ার চেষ্টা করে। টানা হ্যাঁচড়ার এই ব্যায়াম করার ফলে ব্যায়ামের নিয়ম অনুসারে আনোয়ারের শরীরে বল ফিরে আসে। তবে ওসমানের সঙ্গে পারা অতো সোজা নয়। ১ ধাক্কায় আনোয়ারকে সে প্রায় ঠেলে ফেলেই দিয়েছিলো। তবে এই ধাক্কাটা সামলাতে গিয়ে আনোয়ারের বেশ সুবিধাও হলো। তাকেও ১টা ধাক্কা দিতে হয়, অতর্কিত ও অপ্রত্যাশিত এই ধাক্কায় ওসমান ছিটকে পড়ে বিছানার ঠিক মাঝখানে। ওসমানের ওপর লাফিয়ে পড়ে ওর ২ বাহুর ওপর শক্তি প্রয়োগ করে আনোয়ার ওকে চিৎকরে শুইয়ে দিলো। ২বাহুমূলে নিজের ২হাত চেপে ধরে আনোয়ার ওয়ার্নিং দেয় ওসমান, বাড়াবাড়ি করো না। সোজা হাসপাতাল পাঠিয়ে দেবো। কতো ধানে কতো চাল এখানে বুঝতে পারে নি, না?
আপনি না বললেন আমি বাড়ি যেতে পারবো। আমাকে রিলিজ করে দেন না, বাড়ি যাই। আমি বাড়ি যাবো।
বাড়ি যাবে বললেই বাড়ি যাওয়া যায়? ওসমানকে সম্পূর্ণ কবজ করতে আনোয়ার ওর মুখ ভাংচায়, বাড়ি যাবো! বাইরে বেরুলেই বাড়ি?
‘রাস্তায় নামলেই বাড়ি যাওয়া যাবে। খিজির সব চেনে, বেরুলেই ও বাড়ি নিয়ে যাবে।’ ওসমান ফের ওঠার চেষ্টা করছে। আনোয়ারের হাতে তালুতে ওসমানের বাহুমূলের পেশীর কাপনি বেশ ভালোভাবে টের পাওয়া যায়। ওসমান এবার ওর পা দিয়ে আনোয়ারকে এলোপাথাড়ি আঘাত করতে শুরু করে। বুদ্ধি করে আনোয়ার তখন লাফ দিয়ে উঠে বসে ওসমানের পেটের ওপর, আবার তার ২বাহুর ওপর থেকেও আনোয়ার হাত কিন্তু সরায়নি। তাকে একটু উপুড় হয়ে থাকতে হচ্ছে। এমনি উপুড় হয়ে রাত্রি কাটাতে হলে বিপদ। তার মুখে লাগছে ওসমানের ফোস ফোস নিশ্বাসের বাতাস, এতো গরম, যে আনোয়ারের কপাল, চিবুক ও নাকের ডগায় ঘাম জমে গেলো। আনোয়ার এখন কি করতে পারে? তাকে সিদ্ধান্ত নিতে হলো না। কারণ ওসমান হঠাৎ করে খুব জোরে খুধু ছুড়ে দিলো আনোয়ারের মুখে। সদ্য ভাত খাওয়া মুখের লালা তার কপালে, চোখে, নাকে, ঠোঁটে, গালে ও চিবুকে। সারা গা নিখিন করে। আঠালো থুথু তার চোখের সামনে লম্বা পর্দার মতো ঝোলে। পর্দা জুড়ে বসে রাত জেগে পাড়াশোনা করে আনোয়ার। আই এ পরীক্ষার পড়া করতে হচ্ছে, আবুলের মা ঢোকে চায়ের ফ্লাস্ক হাতে। টেবিলে ফ্লাস্ক রেখে আবুলের মা বলে, ‘আম্মায় কইছে, বেশি রাইত কইরেন না, শরীল খারাপ করবো। আবুলের মায়ের ঘষা ঘষা কণ্ঠস্বরে তার ১৭ বছর বয়সের কান খসখস করে, শরীর হঠাৎ বলকাতে থাকে এবং চেয়ার থেকে উঠে দাঁড়িয়ে কাজের মেয়েটিকে সে জড়িযে ধরে। আবুলের মা খুব চমকে গিয়েছিলো, আরে ছাড়েন, ছাড়েন। আঃ! কি করতাছেন? ছাড়েন। তার এই আবেদন অগ্রাহ্য করে তাকে ঠেলে ঠেলে খাটের কাছে এনে এমনি করে শুইয়ে দিয়েছিলো। মেয়েমানুষ হলে কি হয়, তার বাহু ওসমানের বাহুর চেয়ে নরম নয়, বরং আরো রোগ, আরো কঠিন। কোনো ভাবে হ্যাঁচকা টানে তাকে শুইয়ে আনোয়ার তার ওপর শোবার চেষ্টা করছে, এক সময় মেয়েটি তার মুখে খুধু ছুড়ে ফেললো। তারও ছিলো এমনি সদ্য-ভাত খাওয়া মুখের আঠালো খুখু, আনোয়ার লাফিয়ে নেমে দাঁড়িয়েছিলো মেঝেতে। ১০বছর আগেকার এই ঘটনায় সে এখন দারুণভাবে অপমানিত বোধ করছে। ওসমান কিন্তু থুথু ছোড়া অব্যাহত রেখেছে, মাঝে মাঝে বিড়বিড় করছে, শালা কর্নেলের বাচ্চা, কথা দিয়ে কথা রাখলি না। এবার কিন্তু আনোয়ার ওসমানের পেট থেকে লাফিয়ে নামলো না। বরং আরেকটু চেপে বসে ওসমানের ডান গালে প্রথমে এবং পরে বা গালে ঠাস ঠাস করে অন্তত ৭/৮টা চড় মারলো। নাকের ওপর লাগালো বেশ সলিড ওজনের ১টা ঘুষি। ওসমান এতেই নেতিয়ে পড়েছিলো, আনোয়ার তার ওপর টেবিল থেকে কড়া ডোজের ৩টে সিডেটিভ ট্যাবলেট জোর করে ঢুকিয়ে দিলো তার মুখের ভেতর ওসমান অবশ্য ট্যাবলেটগুলো খুখুর মতো ছুড়ে দিতে চাইলেও পারলো না, সেগুলো আটকে রইলো তার ঠোঁট ও দাঁতের ফাঁকে।
ওসমান নিস্তেজ হয়ে পড়লে আনোয়ার বসে থাকে তক্তপোষের ধার ঘেঁষে। ধ্বস্তাধস্তির পর তার শরীর ভেঙে পড়ছে। একটু শোবার জন্য শরীর কাঙাল হয়ে ওঠে। কিন্তু এখন শোওয়া মানে ঘুম। ঘুমিয়ে পড়াটা নিরাপদ নয়। ওসমান যদি উঠে পড়ে? উঠে যদি ছাদে চলে যায়? ছাদের দিকের দরজা ভেতর থেকে তালা লাগানো। সিঁড়ির দিকের দরজায় বাইরের ১টি কড়ায় তালা ঝুলছে। আনোয়ার উঠে সেই তালা খুলে লাগালো ভেতরদিকে শিকলের সঙ্গে। সিঁড়ির নিচে রাস্তার সঙ্গে যে দরজা সেখানে তালা আছে কি-না আনোয়ারের জানা নাই। দরকারটা কি? এই ঘরের তালা ওসমান যদি খুলতে যায় তাকে সামলানো হবে তখনি।
তবে আনোয়ারের বড়ডো ঘুম পাচ্ছে। চা খেলে হতো। টেবিলে আবুলের মায়ের রেখে-যাওয়া ফ্লাস্ক খুঁজতে গিয়ে সে চমকে ওঠে, আরে সে কি আজকের ঘটনা? সে কি এখানে? –নিচে থেকে চা খেয়ে এলে হয়। কিন্তু কারফ্যুর রাতে তার জন্যে দোকান খুলে রেখেছে কে? -ওসমানের ঘুমিয়ে পড়ার নিশ্বাসে আনোয়ারের চোখ আরো চুলে চুলে আসে। ওসমানের পাশে সরু জায়গাটায় শুতে শুতে ভাবে একটু গড়িয়ে নিলে ফ্রেশ লাগবে, রাত জাগতে তখন কষ্ট হবে না। কিন্তু এখন ক্লান্তি তো একটুও কাটে না, মনে হয় লম্বা রাস্তা ধরে সে হাঁটছে। এটা কোন রাস্তা?–তাই বলো! চন্দনদহ বাজার থেকে সে হেটে চলেছে নিজেদের গ্রামে। গাবতলায় গোরুর গাড়ির চাকায় ক্ষয়-হওয়া জায়গায় আনোয়ার হোচট খায়। এর ফলে সে চমকে ওঠে। কিন্তু ঘুম ভাঙে না, তন্দ্রার পাতলা একটি পরতে ভেসে উঠেই ডুবে যায় ঘুমের অনেক ভেতরে।

স্বপ্নে গ্রামের রাস্তায় পা হড়কে যাওয়ায় ঘুমের ভেতর চমকে উঠে ডান পায়ের অবস্থান পাল্টায় আনোয়ার। ঐ পায়ের ধাক্কায় জেগে ওঠে ওসমান। সঙ্গে সঙ্গে কপাল ও ঠোঁটের ব্যথা কনকন করে ওঠে। বলতে গেলে এই ব্যথাই তাকে অনেকক্ষণ ধরে একটু একটু করে ঠেলছিলো। ভালোভাবে জেগে ওঠবার পর ব্যথা কিন্তু ভেঁাতা হয়ে আসে। মনে হয় তাকে জাগিয়ে তোলা ছাড়া তার কপাল ও ঠোঁটের ব্যথার আর কোনো ভূমিকা নাই। শরীর জুড়ে অবসাদ! অনেকক্ষণ ঘুমাবার পর এই অবসাদ থাকে। তবে এটা কাটানো এমন কিছু কঠিন নয়। গায়ে হাতে পায়ে বলসঞ্চারের জন্য চোখ বন্ধ করে ওসমান একাগ্রচিত্ত হলো। ফলে অনেকদূর পর্যন্ত দেখতে পাচ্ছে। ছাদের রেলিং টপকে ওসমান পড়ে যাচ্ছে নিচে। ঠোঁটে ও কপালে চোট লাগলো কি তখনি? তার পরনে হাওয়াই শার্ট, শার্টের পকেটে এস্ত্রয়ডারি-করা প্যাগোড়া। আর কিছু স্পষ্ট নয়। ছাদ থেকে ঐ অতর্কিত পতনের পর সে চলে যায় অনেক নিচে, সেখানে কালো পানির অগাধ গভীর বিল। বিলের ওপরকার চেহারা ঝাপশা। গভীর পানির তলায় বিলের হিমকাদাময় আদুরে পেটের ভেতর সে সাতরাচ্ছিলো, তখন কে তাকে খুব জোরে ধাক্কা দেয়। কে সে? কবেকার নৌকাডুবির পর নৌকার ভাঙা গলুই গাথা ছিলো বিলের তলায়, তার সঙ্গে হয়তো তার মাথা ঠেকে গিয়েছিলো। অথবা বিলের প্রধান ব্যক্তিত্ব জনাব রাঘব বোয়াল, সিতার-ই-ইমতিয়াজ, হেলাল-ই-জুরাত কিংবা তার পরিষদ জনাব বাঘা শোল তমঘা-ই খিদমত ঘাই মেরেছিলো, সেই ঘায়ে তার কপাল টনটন করছে। এই ব্যথা একটু ভেঁাতা হয়ে গেলেও এর সাহায্যেই বিলের ছলছল স্পন্দন চেনা যাচ্ছে। বিলের গভীর ঘন বুক থেকে কখন যেন সে উঠে এসেছে ডাঙার ওপর। বিলের কলি খুলে ওসমান ফুটে বেরিয়েছে, সমস্ত শরীর তার একেবারে টাটকা ও নতুন। চোখ মেললে দ্যাখে, সে গুয়ে রয়েছে এই ঘরে, এই বিছানার ওপর। মেঝেতে বসে চাষাভূষা চেহারার ১টি লোক তার দিকে হা করে তাকিয়ে ছিলো। এখন বুঝতে পাচ্ছে, ঐ লোকটাকেও ওরা বন্দি করে রেখেছিলো। বোকাসোকা গ্রাম্য মানুষটি দিব্যি ছাড়া পেয়ে বেরিয়ে গেলো আরে ওসমানের কি-না এই বন্দিত্ব ঘোচার কোনো লক্ষণই নাই।
আহেন, বারাইয়া আহেন। অ ওসমান সাব, আহের না! জানলার বাইরে দাঁড়িয়ে ডাকে খিজির। খিজিরকে দ্যাখামাত্র ওসমানের সবকিছু মনে পড়ে গেলো। এইতো তার পাশে শুয়ে রয়েছে ১সেন্ট্রি। এই পাহারাদার কে? একে চেনা চেনা মনে হয়। হ্যাঁ, এইবার চিনতে পারে, ব্যাটা মিলিটারির লোক। মেজর না কর্নেল? আরে দূর! অতো সোজা? ব্যাটম্যান কি জওয়ান টওয়ান কিছু হবে। পুলিস-কনস্টেবলও হতে পারে। তবে ভাবসাব দেখে মনে হয় ব্রিগেডিয়ার কি মেজর জেনারেল। হতেও পারে। এতো ক্ষমতাবান অফিসার না হলে ওসমানকে এভাবে আটকে রাখে? এর হাত থেকে রেহাই পাবার উপায় কি? মিলিটারির লোক-মানুষকে যতোভাবে পারো বন্দি করে রাখার যাবতীয় ফন্দি রপ্ত করাই এদের জীবনের পরম সাফল্য। লেখাপড়া জানে না, এমনকি যুদ্ধটাও ঠিকমতো করতে পারে না; অথচ দ্যাখো শালারা কি মৌজে থাকে! তো নিজের দেশের নিরীহ নিরস্ত্র মানুষকে বন্দি করার ফন্দির্টুকু না জানলে কি এতো মৌজ মারতে পারে?
ওসমান সাব বারাইয়া আহেন দেরি হইয়া যায়, আহেন!
খিজির বড্‌ডো তাগাদা দিচ্ছে। বুঝতে পাচ্ছে না, এই জানোয়ারটির হাত থেকে বেরিয়ে আসা কতো কঠিন কাজ! এদের হলো ওয়ান-ট্যাক ব্রেন। খুলির ভেতর যা ঢোকানো হলো তাই সেট হয়ে গেলো চিরকালের জন্য। তাই নিয়ে দিনরাত ঘোৎ ঘোৎ করবে। খাটি ও নির্ভেজাল শুওরের বাচ্চা। এদের মধ্যে আবার বড়ো বড়ো পজিশন নিয়ে যারা তারা হলো শুওরের বড়োভাই গণ্ডারের মতো। ১দিকে দৌড়াতে শুরু করলে আশেপাশে তাকায় না। গন্তব্যে বলে আদৌ কিছু আছে? —ওসমান মাথা তুলে পাশের লোকটির হাত ও পা দ্যাখে, সেখানে নখ ও থাবা লুকিয়ে রেখে ব্যাটা গভীর ঘুমে অচেতন।
ডরান ক্যালায়? খিজির ফের তাগাদা দেয়, দুপুরবেলা দেখলেন না ঐ গেরাইম্যা চাষাটা কেমুন ফাল পাইড়া গেলো গিয়া! এই মিলিটারি হালায় কতো ডাক পাড়লো, কিছু করবার পারলো? আপনে খালি ঘরের মইদ্যে বইয়া মুঠঠি মারেন।
খিজির কথা বলছে একা, কিন্ত এইসব বাক্যে কোরাসের আভাস। অনেক লোক থাকলে এই মেজর না কর্নেল না দারোগা না কনস্টেবল না মেজর জেনারেলকে ভয় পাবার কি আছে? তবু সাবধানের মার নাই, ওসমান ভালো করে ঘুমন্ত লোকটির মুখ পরীক্ষা করতে থাকে।
আরে আহেন না কতো মানু বারাইয়া আহে! আপনে দেহি দিন নাই, রাইত নাই, হোগাখান একবার উপ্তা কইরা একবার চৌকির লগে ঠেকাইয়া খালি খোয়াব দ্যাহেন! ওঠেন! গতরটা ঝাড়া দেন!
কিন্তু বেরিয়ে যাবো বললেই বেরুনো যায়? এই ঘরের ২টো দরজাতেই তালা। তার ওপর পাশে ডিউটি দিচ্ছে শাসলো সেন্ট্রি। ওসমান খুব সাবধানে উঠে বসে। এই সামান্য নড়াচড়ায় সেন্ট্রি শালা ঘুমের মধ্যে সাড়া পায় এবং অস্ফুট স্বরে বলে, এই আবদুল, আমার ঘড়িটা- ওসমান এবার নিশ্চিত হলো: না ব্যাটা ঘুমিয়েছে ঘুমাও, গভীরভাবে ঘুমাও। ঘুমের মধ্যেও তোমার ঘড়ির ভাবনা!
কি হইলো? মরলেন নাকি? আহেন না?
নাঃ খিজিরের বিবেচনাবোধ কম। আরো খিজিরের কি? খিজিরের ঘর নাই, বাড়ি নাই, দরজা নাই, ছিটকিনি নাই, তালা নাই, টেবিল নাই, ঘড়ি নাই, ঘণ্টা নাই, মিনিট নাই। ইচ্ছা হলো আর সোজা বেরিয়ে পড়লো। আমি কি তাই পারি?
আমরা যাই। আপনে মিলিটারি হালার তলায় উপ্ত হইয়া নিন্দ পাড়েন!
তক্তপোষের সস্তা কাঠ ক্যাঁচক্যাঁচ করে। ঠাণ্ডা মেঝেতে পা পড়লে ওসমানের মাথা শিরশির করে ওঠে। না, ভয় কিসের? কর্নেল না মেজর না দারোগা না মেজর জেনারেল ব্যাটা কাদার মধ্যে মুখ গুঁজে ঘোৎ ঘোৎ করে ঘুমায়। ঘরে আলো জ্বলছে, ওসমান আস্তে করে সুইচ টিপে অন্ধকার করে দিলো। বাইরের আলোয় মশারির আড়ালে লোকটির ঘুমন্ত মুখ ভারি দুঃখী দুঃখী মনে হয়। লোকটি কে? কেএম ওসমানের করোটিতে ১টির পর ১টি ঢেউ খেলে -লোকটি কে? কে? —ঢেউয়ের গতি ক্রমে দ্রুত হয়, তীব্র ও দ্রুতগতিতে ঢেউয়ের মাথার ফেনায় টুটাফাটা কয়েকটি ছবি চিকচিক করে ওঠে কার সঙ্গে হেঁটে হেঁটে ওসমান রাস্তা পাড়ি দিচ্ছে। হাঁটছে তো হাঁটছেই। রথখোলার মোড় মস্ত বড়ো-মার্কা ১টা গাড়ি লাল রঙের আভাস দিয়ে কোথায় হারালো। ঢেউ চলে যায় দূরের কোনো অদৃশ্য তটভূমিতে, কিছু দ্যাখা যায় না।-না, দ্যাখার জো নাই। দাখার দরকার নাই। ওসমান সোজা হয়ে দাঁড়ালো।
আসছি খিজির! আলো না থাকলেও এই ঘরের সব কিছু তার জানা। টেবিলের ওপর এলোমেলো বইয়ের স্তৃপ, প্লেট, বাটি, পানির গ্লাস, সিগ্রেটের প্যাকেট, দেশলাই। আলনায় ময়লা কাপড়, মেঝেতে লুঙি ও গেঞ্জি। ওসমানের বুক টনটন করে। এরকম হচ্ছে কেন?–আরে নাঃ আসলে টনটন করছে তার তলপেট। ওদিকে ছাদের দরজায় তালা। ওসমা বাধ্য হয়ে ঘরের ভেতরেই লুঙি তুলে পেচ্ছাব করতে শুরু করলো। পাইপ দিয়ে পানি ঢালার মতো নুনু ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে পেচ্ছাব করে। টেবিলের বইপত্র ভিজে যায়, প্লেটে কুসুম-গরম হলুদাভ পানি জমে, আলনার কাপড় ভেজে এবং সব দিয়ে গুয়ে যা থাকে তাই দিয়ে ভিজিয়ে দেয় উপুড়-হয়ে-শোয়া সেন্ট্রির নাদুসনুদুস পাছাখানি। এতেও তার ঘুম না ভাঙায় ওসমান বীরপুরুষের মতো বালিশের নিচে হাত দিয়ে বার করে নেয় চাবির গোছা।
সিঁড়ির দিকে দরজায় লাগানো তালা খুলতে তার ১ মিনিটও লাগে না। চাবির গোছাটি সে ছুড়ে ফেলে জানলা দিয়ে, খুব জোরে ছেড়ে, ছাদ পেরিয়ে, ছাদের রেলিং ডিঙিয়ে চাবির গুচ্ছ পড়ে যায় নিচে। সেন্ট্রি ব্যাটা চাবিটা না পেয়ে বেশ ধাদায় পড়বে, এটা ছাড়া আর আর মানুষকে সে বন্দি করবে কিভাবে?
দরজা তো খোলা হলো। কিন্তু নিচে নেমে কি হবে? রাস্তায় হাজার হাজার রিকশা, রিকশার ভেতর লুকিয়ে রয়েছে মিলিটারি। হাড্‌ডি খিজির বলে, কি হইলো?
রাস্তায় মিলিটারি।
মিলিটারির মায়েরে বাপ রাস্তা অগো জমিদারি? চুতমারানির দালান ইমারত ব্যাকটি কবজ করছে। রাস্তাভি দখল করবো?
ওসমানের সামনে অন্ধকার খাদ। এই খাদের ভেতর নিচে নামবার সিঁড়ি। কিন্তু সিঁড়ি দিয়ে নামতে ওর কোনো অসুবিধা হয় না। আগডুম বাগডুম খোলা মাঠ ঘাট, ম্যান অফ দি কপাট, ম্যান ইনদি কপাট,-গুনগুন করে গাইতে গাইতে ওসমান নিচে নামে, কোনো ধাপে পা হড়কায় না। তবে সিঁড়ির শেষ ধাপে নেমে ধাক্কা খায় দরজার সঙ্গে। তাকে আটকাবার জন্যে দরজা নিজেই এগিয়ে এসেছে। ওপরের ছিটকিনি খুলে দরজায় ঠেলা দিলে কপাট দুটো একটু ফাক হলো। বাইরের আলো চিকন রেখার ওপর চড়ে ভেতরে ঢুকে সিঁড়ির প্রথম কয়েকটি ধাপ পর্যন্ত ময়লা হলুদ করে তোলে। দরজায় আরেকবার ধাক্কা দিয়ে ওসমান বুঝতে পারে আলোর রেখা আর চওড়া হবে না। দরজায় তালা লাগানো, কপাটজোড়ার ফাক ঐ কয়েক ইঞ্চির বেশি বাড়ানো যাবে না। তাহলে?—এখন কি তবে ফিরে যেতে হবে ঐ কামরায়? তক্তপোষে শুয়ে ঘুমাবার সম্ভাবনায় ওসমান হাই তোলে, শরীর এলিয়ে পড়তে চায়। কিন্তু শোবে কোথায়? যেখানে শোবে একটু আগেই তো সেখানটায় পেচ্ছাব করে এলো। তাহলে?
কি হইলো? নিচে আইয়া খাড়াইয়া থাহেন?
দরজা বন্ধ। তালা লাগানো। চাবি কার কাছে তুমি জানো?
চাবির গুলি মারেন। বাইর হন।
কোনদিক দিয়ে বেরুবো?
মুসিবত! আরে মিয়া আপনে আছেন ঘরের মইদ্যে, তালা ভি ঘরের মইদ্যে দরজার লগে! ক্যামনে বারাইবেন ঠিক পান না? হায়রে মরদ।
কপাট কপট ইয়েস বন্ধ কপাট, আগডুম বাগডুম ঘোড়াভূম মাঠ দোয় পড়ার মতো বিড়বিড় করতে করতে ওসমান সমস্ত শক্তি দিয়ে দরজায় ধাক্কা দিলো। তারপর ‘দুই তিন চার পাঁচ ছয় সাত আট, কর্নেলে জেনারেল করলো লোপাট’ বলে গুণে গুণে ৮ বার ধাক্কা দিলে দরজায় বিকট আওয়াজ হয়। কিন্তু দরজায় ফাক যেমন ছিলো তেমনি থাকে।
আইলেন?
তালা ভাঙা যাচ্ছে না।
ভিতরে খাড়াইয়া ভি তালা ভাঙবার পারেন না। মরদ হইয়া পয়দা হইছিলেন তো? হিজড়াগো লগে লইয়া আমাগো কাম নাই। আমরা যাই গিয়া। খিজির সত্যি সত্যি রওয়ানা হলে ওসমান একটু বিচলিত হয়। না, তাড়াতাড়ি করা দরকার। সিঁড়ির কয়েকটা ধাপ উঠে ফেরদৌড়ে নেমে দরজার গায়ে সে প্রবল বেগে লাথি লাগায়। এরকম ১বার ২বার ও ৩বার তার জোড়া পায়ের লাথি খেয়ে তালার কড়া খুলে গেলো। কপাটজোড়া হা হয়ে ভয়-পাওয়া কোনো ভিখারি এবং তার ছায়ার মতো একটু একটু কাঁপে।

Category: চিলেকোঠার সেপাই (উপন্যাস)
পূর্ববর্তী:
« চিলেকোঠার সেপাই – ৫০
পরবর্তী:
চিলেকোঠার সেপাই – ৫২ »

Reader Interactions

Leave a Reply Cancel reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

বাংলা লাইব্রেরি : উল্লেখযোগ্য বিভাগসমূহ

লেখক ও রচনা

অনুবাদ সাহিত্য

সেবা প্রকাশনী

ডিকশনারি

কৌতু্ক / জোকস

লিরিক

রেসিপি

কোরআন

হাদিস

ত্রিপিটক

মহাভারত

রামায়ণ

পুরাণ

গীতা

বাইবেল

বিবিধ রচনা

বাংলা ওসিআর

Download Bangla PDF

হেলথ

লাইব্রেরি – ফেসবুক – PDF

top↑