1 of 2

চিলেকোঠার সেপাই – ৪৪

চিলেকোঠার সেপাই – ৪৪

বিছানায় দেওয়াল ঘেষে ঘুমাচ্ছে মন্টু। ওর পাশে বসে আনোয়ার খাম ছিঁড়ে চিঠি বের করে। ওসমানের হাতের লেখা বরাবরই খুব জড়ানো, কিন্তু এরকম দুর্বোধ্য তো কখনো ছিলো না। মনে হয় একটানে গোটা চিঠি লেখার চেষ্টা করেছে। হ্যারিকেনের সলতে উসকে দিয়ে ১টা ১টা করে অক্ষর ধরে ধরে অনেক কষ্টে আনোয়ার চিঠির পাঠোদ্ধার করে।

প্রিয় আনোয়ার,
তুমি মিছেমিছি গ্রামে গেলে। এখানে রাস্তায় রাস্তায় আগুন জ্বললো তুমি দেখতে পেলে না। বড়ো বড়ো দালান কোঠাও রেহাই পায়নি। আগুন নেভাতে মিলিটারি বুড়িগঙ্গা নদীর প্রবাহ ঘোরাতে গিয়েছিলো, তাতে ফল হয়েছে বিপরীত। রাস্তায় রাস্তায় নদী, নদীর পানির ওপর ভর করে জুলতে থাকে আগুন। খবরের কাগজ পাও? কাগজে এর নাম দিয়েছে নদী ও আগুনের যুগলপ্রবাহ। সেদিন রেসকোর্সে শেখ মুজিবুর রহমানের মস্ত বড়ো মিটিং হলে এই যুগলস্রোতোধারা চাপা পড়েছে। আমি এত ঘাবড়াই না! আমি তো খিজিরকে চিনি। খিজিরদের horizontal মিছিল দিন দিন প্রসারিত হচ্ছে। কপালে থাকলে তুমি দেখতে পাবে। না পারো তো আমি কি করবো? একটা পদ্য আছে জানো? ‘কেঁদে কেন মরো? আপনি ভাবিয়া দ্যাখো কার ঘর করে! এই পদ্যেই জবাব আছে। ইতি।
ওসমান।

চিঠির বাক্য স্পষ্ট। কিন্তু ওসমান এসব কি লিখেছে? ও কি ঠাট্টা করার লোক? ওসমানকে খুব দেখতে ইচ্ছা করে, ওর শরীর বোধ হয় খারাপ, কিন্তু আনোয়ার এখন গ্রাম ছেড়ে যায় কি করে? এতো কিছুর পরেও শয়তানদের ফণা নিচে নামে না। চেংটুর পরিষ্কারকরা বৈরাগীর ভিটায় এরা চুটিয়ে মিটিং করে অথচ চেংটুর ওপর রাগ এদের প্রতিদিন কেবল বেড়েই চলে। চেংটুকে নিয়ে ঢাকায় গেলে হতো। কিন্তু ও ঢাকায় যাবে কেন? ওসমানকে এর কথা লিখেছিলো, ওসমানের চিঠিতে কৈ তার কোনো উল্লেখ নাই তো! ওসমানের হলোটা কি? শরীর বোধ হয় খারাপ হয়ে গেছে। নোভালজিন ছাড়া ছেলেটা একটা দিনও স্বাভাবিক থাকতে পারে না। কতোবার বলা হয়েছে, এ্যাঁসিডিটির রোগীর এভাবে এ্যানালজেসিক খাওয়ার পরিণতি সাঙ্ঘাতিক হতে পারে। পেটে হয়তো আলসার বাধিয়ে বসেছে; এই রোগের জন্যেও চিঠি এলোমেলো হতে পারে। রোগে কষ্টে ওসমানের পাশে থাকার মতো কেউ নাই। ওসমানের প্রতি কর্তব্যবোধ আনোয়ারের মাথায় ১টি কাটা বেধায়: ওর কাছে থাকার জন্যেই একবার ঢাকায় যাওয়া উচিত। তবে কিছুক্ষণের মধ্যেই এই খোঁচাটা চুলকানোর আরাম দেয়, ঢাকায় যাওয়ার কথা ভাবতে ভাবতে চোখ জড়িয়ে আসে। ঘুম ভালো করে চেপে আসতেই জিন্না এ্যাঁভিনু্যর ফুটপাথ ধরে আনোয়ার হাটতে শুরু করে। হ্যাঁ, আউটার স্টেডিয়ামের দেওয়াল ঘেঁষে ফুটপাথ ধরে তাড়াতাড়ি হাঁটছে। সঙ্গে চেংটু। আনোয়ার খুব খুশি, চেংটুকে নিয়ে সে নানান জায়গায় যাবে। সবাইকে বলবে, এরকম কর্মী কেউ চোখে দেখেছে? ঢাকায় বসে তোমরা বিপ্লবের অবজেকটিভ কন্ডিশন দেখতে পাও, কিন্তু বিপ্লবের হাতিয়ার দেখতে চাও তো চেংটুকে দ্যাখো! কিন্তু চেংটুর হাতে ১টা হাতিয়ার থাকায় আনোয়ার উসখুস করে। ছোকরা তার পাশে ছিলো, এখন চলে গেলো ঠিক পেছনে। সামনে ট্রাফিকের লাল সংকেত জ্বলে উঠেছে, আনোয়ার সামনে এগোতে পারে না। দেওয়াল ঘেঁষে দাঁড়িয়ে সে আড়চোখে চেংটুর দিকে তাকায়। চেংটুর দা হাত বদল করে। আনোয়ার দেওয়ালের দিকে আরেকটু সরে। দেওয়ালের ঘষাটায় তার ডান হাতে ব্যথা করছে। হাতের ব্যথায় আনোয়ারের ঘুম ভাঙে।
কোথেকে মেয়েলি গলায় কান্নার আওয়াজ আসে হঠাৎ করে মনে হয়, মন্টু কোথায়? মন্টু না থাকায় ঘুমের মধ্যে আনোয়ার চলে এসেছে দেওয়ালের দিকে। ডান হাত তার চাপা পড়েছে নিজের শরীর ও দেওয়ালের মাঝখানে। তখন স্বপ্নের কথাটা মনে পড়ে। চেংটুকে সে ভয় পেলো কেন? চেংটুকে ভয় পাওয়ার গ্লানিতে আনোয়ার প্রায় মিনিটখানেক চুপচাপ শুয়ে থাকে। কিন্তু বাড়ির ভেতরের কান্নার আওয়াজ উথলে উথলে উঠছে। হঠাৎ ভয় হয় ঢাকা থেকে কোনো খারাপ খবর এলো না তো? আম্মার ব্লাড প্রেশার আজকাল খুব উঠানামা করে, যে কোনো সময় একটা স্ট্রোক হতে পারে। আনোয়ার প্রায় লাফিয়ে উঠে ভেজানো দরজা খুলে ভেতরের বারান্দায় দাঁড়ায়। উঠানের মাঝামাঝি গোল হয়ে বসে কাঁদছে কয়েকজন চাষী বৌ। না, তার মায়ের দুঃসংবাদে এদের ভেঙে পড়ার কথা নয়। আনোয়ার একটু আশ্বস্ত হলে জমিরের মা এসে তাড়া দেয়, ভাইজান, মুখ ধুয়্যা নেন। নাশতা ঠাণ্ডা হয়্যা গেলো। উঠানে কারা? জমিরের মার কাছে জানা যায় এদের ১জন হলো চেংটুর মা, ১জন তার চাচী, ১জন তার ভাবী এবং আরেকজন চেংটুর স্বামী-পরিত্যক্তা বোন।
চন্দনদহ বাজার থেকে এদিকে আসার রাস্তায় গ্রামের শুরুতেই বুড়ো গাব গাছ। গাব গাছের পাশে ধান-কাটা জমিতে নামবার ঢালে আজ ভোরবেলা চেংটুর লাশ পাওয়া গেছে। আনোয়ারদের বাড়ির বাইরে কাঁঠালতলায় ভিড়। পরিচিত ভঙ্গিতে হাঁটু ভেঙে মাটিতে বসে রয়েছে নাদু। তার সামনে হাতলওয়ালা চেয়ারে বড়োচাচা। নাদু মাঝে মাঝে মাটিতে হাতের চাপড় মারে এবং আল্লা ও নিহত চেংটুকে নানাভাবে আহবান করে। পোড়া পা টেনে টেনে ঘুরে বেড়ায় করমালি। উঁচু দাত দিতে তার নিচেকার পুরু ঠোঁট চেপে-ধরা। আনোয়ারকে দেখে তার দাঁতের চাপ শিথিল হয়, ‘ভাইজান, এটা কেমন হলো?
ধরা গলায় বান্দু শেখ বলে, কপাল।
ও চেংটু চেংটু। হারামজাদা তোর নাফ-পাড়া কেটে গেলো? বেন্ন্যামানষের ব্যাটা, চাষাভূষার ব্যাটা, তুই যাস বড়োনোকের সাথে তাল দিব্যার? বিলাপ করতে করতে নাদ
পরামাণিক মাথা রাখে বড়োচাচার পায়ে। বড়োচাচা তারা বিরলকেশ মাথায় আঙুল ছুয়ে ছলছল চোখে তাকায় সামনে।
আনোয়ারকে একটু আড়ালে ডাকে করমালি, ‘ভাইজান বোঝেন তো! আফসার গাজী কালও নাফ পাড়ছে, কয়, কোনো শালাক কিছুঁতেই ছাড়া হবো না। এখন বোঝেন।’
‘আলিবক্স কোথায়? আনোয়ার কোনো সিদ্ধান্ত নিতে পারে না। আলিবক্স ঠিক বুঝতে পারবে এ সময় কি করা দরকার।
তাই গেছে পুবে, চরের মধ্যে। নদীর ঐ পারে গোরুচোরেরা আবার দল পাকায়! এদিকে পাও দিলে তো এ্যাঁরা আলিবক্স ভাইজানোক সাফ কর্যা দিবো।
‘লাশ কোথায়?
লাশ আছে গাবতলাত। পুলিস না আসলে বলে লাশ ধরা যাবো না।
আনোয়ার বলে, পুলিসে কেস দেওয়া দরকার।
পুলিস করমালির উঁচু দাঁতের চাপে কথাটি এমনভাবে বেরোয় যে মাথা নিচু করে আনোয়ারকে একটু সরে দাঁড়াতে হয়।
গাবগাছতলায় ভিড় আরো বেশি। শহরের ছাত্রকর্মীরা এসেছে মেলা, আজ কর্ণিবাড়ি স্কুলের মাঠে জনসভা, তারই প্রচার করে বেড়াচ্ছে। কাঁদের হাতে চেংটু মারা পড়লো, এ নিয়ে কারো স্পষ্ট বা অস্পষ্ট ধারণা নাই, কিন্তু তার মৃতদেহ নিয়ে তারাই মিছিল করতে চায়। এই মৃতদেহ তারা পুলিসকে ছুঁতে দেবে না। খোড়াতে খোঁড়াতে করমালি এখানে এসে পড়েছে। আনোয়ারকে ডেকে বলে, ‘ভাইজান, আপনে কন না কিসক? এতোগুলা শিক্ষিত মানুষ আসছে, চেংটুকে কারা মারবার পারে, কি সমাচার কয়া দেন না!
কিন্তু প্রমাণ ছাড়া আনোয়ার আন্দাজে কথা বলে কিভাবে? এর ওপর চেংটুর বড়োভাই সোটকা পরামাণিক তেড়ে আসে করমালির দিকে, ‘হামার ভায়েক খায়াও তোরগোরে খিদা মেটে নাই? তোর কি? তোর পাওখানই পুড়ছে, পাও পুড়া তোর শালা এখন ভিক্ষা করার জুত হবো! তোরা বাপব্যাটা এখন একসাথে বাজারেত বস্যা থালি ধরলেই পয়সা।
ছাত্রদের মধ্যে যারা নেতৃস্থানীয় তারাও এই মৃতদেহ নিয়ে বাড়াবাড়ি করতে চায় না। এসব করা মানে আজকের মিটিঙের বারোটা বাজানো। তাদের কাছে চেংটুর বাবার করুণ বাসনাটি পৌঁছে দেওয়ার জন্য জালালউদ্দিন তৎপর। চেংটুর মৃতদেহ বৈরাগীর ভিটার পুরনো বাসিন্দাকে আরো উত্যক্ত করে তুলতে পারে। তাড়াতাড়ি ছেলের দাফন হলে তার রুহের আরাম হয়, জীন এবং পুলিসের ঝামেলা থেকে জীবিত লোকজনও রেহাই পায়। আনোয়ারের বড়োচাচারও ইচ্ছা তাই। ২পুরুষের চাকর নাদু পরামাণিকের ইচ্ছাটা পূরণ করার জন্য বড়োচাচা বড়ো উদগ্রীব।
আনোয়ার তাকিয়ে থাকে চেংটুর মুখের দিকে। ঠোঁটজোড়া তার দারুণভাবে চেড়ে-ধরা। কানের নিচে ছুরির গভীর দাগ। খোঁচা খোঁচা গোঁফদাড়ি সজারুর কাটার মতো খাড়া হয়ে চেংটুর মুখটাকে সকলের ধরাছোঁয়ার বাইরে রেখে দিয়েছে।
৪দিন পর আনোয়ার আরেকটা চিঠি পায়। শওকত ভাই ঠিকানা পেলো কোথায়? আনোয়ার ঠিক এতোটা ভাবেনি, ওসমানের অবস্থা যে রকম হয়েছে সে কল্পনাও করেনি। ওসমানকে প্রায়ই নাকি দ্যাখা যায় ভিক্টোরিয়া পার্কের সামনে। চুপচাপ দাঁড়িয়ে থাকে। স্টেডিয়ামের বারান্দায় ১দিন চিৎকার করে দৌড়াতে দ্যাখা গেছে। কাপড়চোপড় পরে খুব নোংরা। কথাবার্তার ব্যালান্স নাই। আনোয়ারের কথা খুব বলে, আনোয়ারের বড়ো ভাইয়ের সঙ্গে দ্যাখা করে ওর খবর নিয়েছে কয়েকবার। আনোয়ার কি কয়েকদিনের জন্যে ঢাকায় আসতে পারে? ওসমানকে দ্যাখাশোনা করা দরকার। কয়েকদিনের জন্যে বিপ্লব স্থগিত রেখেও আনোয়ার যেন একবার ঢাকায় আসে।-চিঠি পড়তে পড়তে আনোয়ার উদ্বিগ্ন হয়। আবার চিঠি পড়া শেষ হলে বুঝতে পারে যে উদ্বিগ্ন হওয়া উচিত আরো বেশি। ঢাকায় যাওয়া খুব দরকার। মাথার ভেতর তার নতুন হাওয়া খেলে এবং হাতপাগুলোর আড়ষ্টতা কাটে। শওকত ভাইয়ের ওপর এতোটা কৃতজ্ঞতা বোধ করে যে তার ছোটো শ্লেষটুকুওমিষ্টি লাগে।

গাবগাছতলায় পৌঁছবার আগে ঢেকুর উঠলে মুরগির কোর্মার স্বাদ বোঝা যায়। ভোরবেলা উঠে বড়োচাচী এর মধ্যে এতো আয়োজন করেছে। বড়োচাচী বাড়ি ফিরেছে পরশু সকালে, ২টো দিন গেছে বাড়ি ঝাড়পোছ করতে। আর আজ সকাল ৯টার বাসে আনোয়ার চলে যাবে শুনে সূর্য ওঠার আগে থেকেই রান্নাবান্নার প্রস্ততি নিতে শুরু করেছে। অতো সকালে আনোয়ার ভাত খেতে পারে না বলে এক গাদা পরোটা ভাজে, রাত্রে জ্বাল-দেওয়া মুরগির কোর্মা রাধে, এর ওপর ডিম ভাজা। চাচী নিজে বসে থেকে পাতে ১টা ১টা পদ তুলে দেয় আর বলে, ‘আবার কোনদিন আসো ঠিক আছে? খাও বাবা।
আমি তো বিশ পঁচিশ দিনের মধ্যে আবার আসছি চাটী!
আনোয়ারের এই কথায় আমল না দিয়ে বড়োচাচী তার প্লেটে তরকারি ঢালে, বারান্দার দিকে তাকিয়ে বলে, তোমার বাপ বছরে দুই বছরে তাও এক আধবার আসছে। ঐ বারান্দার উপরে বস্যা রোদ পোয়াছে আর কছে, ভাবী, পাটিসাপটা করল্যা না? আবার চরের মধ্যে থাকা পাখি ম্যারা নিয়ো আসছে, ভাবী ভালো করা রোস্ট করে তো! —দেখতে দেখতে কতোদিন হয়া গেলো!’ ঐ বারান্দায় ইজি চেয়ারে বসে বড়োচাচা চুপচাপ উঠান দ্যাখে।
এর মধ্যে এসে পড়ে জালালউদ্দিন, তাড়াতাড়ি করো। বাসের টাইম হলো।
সেই থেকে জালালউদ্দিন বকবক করেই চলেছে। আনোয়ার বগুড়া নেমেই যেন তার মামার সঙ্গে ভালো করে কথা বলে। ইয়াসিন সাহেবের এখন ঘন ঘন এলাকায় আসা উচিত। ফিল্ড এখন ভালো, এইসময় এলাকার সঙ্গে যোগাযোগ রাখা দরকার।
গাবগাছতলায় পৌঁছবার পর জালালউদ্দিন চুপ করে। কি হলো? কোর্মার ঢেকুরের গন্ধ চাপা পড়ে মৃতদেহের আবছা গন্ধে। গাবতলায় জবুথবু হয়ে বসে রয়েছে নাদু পরামাণিক। জালাল মাস্টার আস্তে আস্তে বলে, আহা! প্রত্যেক দিন এই জায়গায় অ্যাসা বস্যা থাকে। বার্ধক্যে পুত্রবিয়োগ!
‘ঢাকাত যাও?’ নাদু পরামাণিক উঠে দাঁড়ায়।
হ্যাঁ। এখন বাসে যাবো বগুরা। কাল সকালে ঢাকার ট্রেন ধরবো। আনোয়ার কৈফিয়ৎ দেয়, আমার এক বন্ধুর খুব অসুখ। একটু সেরে উঠলেই আমি ফিরবো।
নাদু ওদের সঙ্গে হাঁটে। ১টা ময়লা চাদরে তার গা জড়ানো। একটু একটু বাতাসে রোগা শরীর কাপে। তার দাড়ি চারদিকে ছড়িয়ে পড়ায় মুখের অভিব্যক্তি সংগঠিত হতে পারে না। আনোয়ার তাই বারবার দেখেও নাদুর চোখেমুখে শোক কি হতাশা সনাক্ত করতে পারে না।
চন্দনদহ বাজারের শুরুতে খয়বার গাজীর ধানকলের টিনের ছাদ সকালবেলার রোদে ঝকঝক করে। আজ হটবার নয়, তবু এদিক ওদিক লোকজন দেখে জালালউদ্দিন অবাক হয়, এতো মানুষ?
ধানকলের সামনে দাঁড়িয়ে রয়েছে আফসার গাজী। তার সঙ্গে শহর থেকে আসা কয়েকজন ছাত্রকর্মী। আফসার এগিয়ে আসে আনোয়ারের দিকে, নাদুকে জানায়, কি গো, পরশুদিন বড়ো মিটিং হলো বাজারের মধ্যে, তোমার ব্যাটার নাম করা প্রস্তাব পাস করলাম। তুমি আসলা না? তারপর সে তাকায় জালালউদিনের দিকে, আপনেও তো ভাষণ দিলেন। নাদুক কন নাই?
জালালউদ্দিন অপরাধীর মতো হাসে।
মাস্টার মানুষ বারো বছর মাস্টারি করলে কি জানি হয়?’ জালালউদ্দিনকে ঠাট্টা করার পর আফসার গাজী আফসোস করে চেংটুকে নিয়ে, চ্যাংড়া মানুষ। মাথা গরম করা কোপ মারলো বৈরাগীর ভিটাত। আগুনের জীব বাপু কোরান হাদিসে কি মিছা কথা কইছে? জিনের গাওত হাত পড়ছে। নাদুকে সে সান্তনা দেয়, মন খারাপ করা কি করব্যা? জুম্মার ঘরত ভালো করা শিরনি দিও। ট্যাকাপয়সা না হয় কিছু নিও।’
চেন্টুর মৃত্যুর পেছনে জিনের সক্রিয় ভূমিকা সম্বন্ধে জালালউদ্দিনও নিশ্চিত, মসজিদে শিরনি দেওয়ার জন্যে সে নিজেও কিছু চাঁদা দেওয়ার প্রস্তাব করে।
আফসার গাজীর প্রভাবে আনোয়ারের জায়গা হলো বাসে ড্রাইভারের সিটের পাশেই, বাসের ভেতরটা প্রায় ভরে গেছে, তবে বাস ছাড়তে এখনো অনেক দেরি, ছাদের ওপর লোক এখনো ওঠেনি। আনোয়ারের কাছে বিদায় নিয়ে আফসার গাজী একটু দূরে দাঁড়িয়ে জালালউদিনের সঙ্গে গল্প করে।
বাবা নাদু এগিয়ে আসে আনোয়ারের দিকে। আনোয়ার বাসে উঠতে গিয়েও ওঠে না, সেও একটু এগিয়ে যায় নাদুর কাছে।
বাবা’ নাদু দুই সিলেবলের শব্দের পুনরাবৃত্তি করে। তার ডান হাত হঠাৎ খুব কাপে। সেই হাত তার নোংরা চাদরের ভেতর ঢুকে পড়লে আনোয়ার ভয় পায় এবং সতর্ক হয়ে একটু সরে দাঁড়ায়। নাদুর হাত দিয়ে বের হয়ে আসে কালচে ন্যাকড়া জড়ানো পুটলি। নাদুর মুঠি এমন কাপছিলো যে আনোয়ার হাত বাড়িয়ে জিনিসটা না ধরলে ওটা পড়েই যেতো। পুটলি হাতে নিয়ে আনোয়ার জিগ্যেস করে, কি?
নাদু কাচুমাচু মুখ করে তার দিকে তাকায়, চেংটুর মা বেনবেলা করছে। খায়ো বাবা!
কি?
নাদুর চোখ এবার নিচের দিকে। অপরাধী স্ত্রীর পক্ষ থেকে সে কৈফিয়ৎ দিচ্ছে, চেংটুর মাও কয়টা পিঠা করছিলো। তোমাক খাবার দিচ্ছে!’
আনোয়ারের নাকমুখ হঠাৎ নোনা পানিতে বন্ধ হবার উপক্রম হয়। কালচে নোংরা ন্যাকড়া কিংবা তার ভেতরকার পিঠার গন্ধ কিছুই পাওয়া যায় না। তার নীরবতায় ঘাবড়ে গিয়ে নাদু উসখুস করে, আপন মনে প্রলাপ বকে, চেংটু এই পিঠা খুব পছন্দ করছে। হারামজাদা মাথাগরম আছিলো তো দাখো নাই কোটে কোটে ঘুরছে একদিন বাড়িতে যায়া কয়, ও মা, আলো-চাল কোটো তো! ভাপা পিঠা করো, আনোয়ার ভায়েক পিঠা খাওয়ামু-চেংটুর মা, বুঝলা না?–মেয়ামানুষ, মনমেজাজ ভালো থাকে না। অভাবের সংসার বাপু, ঘরত ভাতের চাউলেরই অনটন, পিঠা আর বানাবার পারে না। হারামজাদা অর মায়ের কাছে খালি তোমার গপ্পো করছে বাবা! তুমি আজ ঢাকাত যাবা শুন্যা ফজরের আগে আত থাকতে উঠছে, পিঠা বানায় আর কাব্দে মেয়ামানুষ তো খালি কাব্দে। মেয়েমানুষের স্বভাবের বিবরণ দিতে গিয়ে নাদু পরামাণিকের গলা ধরে আসে খায়ো বাবা মটোরের মদ্যে অনেকক্ষণ থাকবা, খিদা নাগবো। খায়ে।’ নাদুর কথা বারবার জড়িয়ে যাচ্ছে, মনে হয় বোবা যেন কথা বলার চেষ্টা করছে।
স্টার্ট দেওয়ার পরও বাস নড়ে না। নাদু এবার হাঁটু ভেঙে বসে পড়েছে বিশাল ডুমুর গাছের নিচে। তার পেছনে মতিলাল আগরওয়ালার পাটের গুড়ামের সামনে থেকে জালালউদ্দিন ও আফসার গাজী এগিয়ে এসে আনোয়ারের সঙ্গে কথা বলে চলে যায়। নাদুর বসে-পড়া শরীর দেখে আনোয়ার ভয় পায়, লোকটা উঠে দাঁড়িয়ে হাটতে পারবে তো? বাস চলতে থাকে ছেচড়াতে ছেচড়াতে। কাচা রাস্তায় স্পিড দেওয়া সম্ভব নয়। তবু দেখতে দেখতে নাদু পরামাণিক ও জালালউদ্দিন ও আফসার গাজী ও চন্দনদহ বাজার আড়ালে পড়ে যায়।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *