1 of 2

চিলেকোঠার সেপাই – ৩৮

চিলেকোঠার সেপাই – ৩৮

কাল সন্ধ্যে থেকে আনোয়ারদের বাড়িতে কোঅরনটিনে থেকে এই বেরুলাম। চলেন, তাড়াতাড়ি নাশতাটাশতা করে নিই। সারাদিন প্রভিশনস নিয়ে ঘরে ফিরবেন। আমি সোজা বাসায় যাবো। কারফ্যু রিল্যাক্স করেছে মাত্র তিন ঘন্টার জন্যে। ওসমানের ঘরে ঢুকে শওকত গতরাতে আনোয়ারদের বাড়িতে ওর বড়োভাইয়ের সঙ্গে হুইস্কি খাওয়ার গল্প ছাড়ে। তা কি করে হয়? চাদে দাঁড়িয়ে ওসমান তো সারারাত শওকত ভাইকে আকাশে উড়তে দেখলো। আপনি সারারাত উড়ে বেড়াচ্ছিলেন না?
তা ওড়াই বলতে পারেন। মোর দ্যান হাফ এ বটল অফ শিভাঁজ রিগ্যাল ডিলাক্স হুইস্কি, ফিফটি ইয়ার্স ওল্ড। আনোয়ারের ভাই তিনটে পেগ মারতে না মারতেই ঘুমোতে গেলো, দেন ইট বিকেম অবলিগেটরি ফর মি টু ফিনিশ দ্য রেস্ট। শিওর, আইফেল্ট লাইক ফ্লাইং!’
আনোয়ারও তো আপনার সঙ্গে ছিলো? ‘আরে না। মওলানা ভাসানীর মিটিঙে আপনাদের কাউকে না পোয় গেলাম ওয়ারি। নো, হি ইজ স্টিল দেয়ার ইন রুরাল বেঙ্গল, ফাইটিং এ হার্ড ব্যাটল টু এলিমিনেট অল দ্য ক্লাস এনিমিজ! ওদের কোন আত্মীয় চিঠি লিখেছে, আনোয়ার নাকি ঘনিষ্ঠ আত্মীয়দের সঙ্গে মিসৰিহেভ করছে। হিজ মাদার ওয়াজ অন দ্য ভার্জ অফ উইপিং।
সিঁড়ি দিয়ে নামতে শওকত ভাই কথা বলা অব্যাহত রাখে, ওর মার সঙ্গে কথা বলছি, তো ওর ভাই এসে বলে, কারফ্যু ইমপোজ করেছে। ওদের ওখানেই থাকতে হলো। ওর ভাই আনোয়ারের ওপর মহা খাপ্পা, বলে এসব স্রেফ হঠকারিতা। বাঙালির জাতিসত্তা প্রতিষ্ঠার সময় এটা, এখন পাঞ্জাবিদের কোণঠাসা করো। এখন এইসব শ্রেণীশত্র মারার নামে এ্যাঁনার্কি তৈরি করলে বাঙালি মিডল ক্লাস সেটেন্ড হাতে পারবে?
*আপনি কি বললেন?
আমি বললাম, তাহলে এতো মানুষ মরছে কি মিডল ক্লাসকে ফ্লারিশ করার জন্যে?তাতে ভাইয়া খেপে গিয়ে শিভাঁজ রিগ্যালের বোতল নিয়ে এলো! দুটো তিনটে পেগ মেরে বোতলটা আনোয়ারের ঘরে আমার জিম্মায় রেখে চলে গেলো নিজের ঘরে।’
ভিড়ের মধ্যে হাটা বেশ মুশকিল। বেশির ভাগ লোকের হাতে বাজারের থলে। এর মধ্যে কয়েকটা রিকশা বেরিয়েছে, কিন্তু খালি রিকশা পাওয়া অসম্ভব।
পুলিশ ক্লাবের সামনে বাস থেকে লোক নামিয়ে দিচ্ছে। গুলিস্তানের ওদিকে মিলিটারি গুলি করছে, বাস আর যাবে না। নিজামি রেস্টুরেন্টের সামনে পানের দোকান থেকে শওকত ১০টা সিগার কিনলো, নিজামিতে ভিড় ঠেলে ঢুকে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে ২ জনে তন্দুরের রুটি ও ডাল-গোশত খেয়ে চায়ে চুমুক দিচ্ছে, এমন শোনা যায় বাইরে মিছিল চলছে। শামসুজ্জোহার রক্ত’-বৃথা যেতে দেবে না’, ‘জেলের তালা ভাঙবো’-শেখ মুজিবকে আনবো,-স্লোগান দিতে দিতে মিছিল ছুটে যাচ্ছে নবাবপুরের দিকে।
শওকত ভাই, চলেন মিছিলে যাই।’ ওসমানের আগ্রহে সায় দেওয়ার আগেই শওকত বলে, ‘রেডিও শোনেন, রেডিওতে কারফ্যু বিরতির সময় কমিয়ে দেওয়ার ঘোষণা করা হচ্ছে। আধঘণ্টার মধ্যেই ফের কারফ্যু জারি করা হবে শুনে লোকজন পাগলের মতো ছোটে। শওকত ৩ পাউণ্ড পাউরুটি কিনলো দেড়গুণ দামে, কলা কিনলো। ওসমান নিলো কয়েক প্যাকেট কিংস্টর্ক। দোকানপাট বন্ধ করার শব্দ পিঠে ধাক্কা দিয়ে মানুষের হাটার গতি অনেক বাড়িয়ে দেয়।
ওসমানদের সিঁড়ির গোড়ায় এসে শওকত বলে, ওসমান, আজ আমাকে আপনার সঙ্গে থাকতে হবে। গ্যাণ্ডারিয়ার বাড়ি পর্যন্ত পৌঁছতে রাস্তায় আর্মি নেমে যাবে।’
আসেন। এখন রিস্ক নেবেন না।’ আপনি ঘরে যান। দেখি ঐ দোকানটা থেকে টেলিফোন করে আসি। আম্মা খুব চিন্তা করবে।’
কিছুক্ষণ পর শওকত ঢুকে বলে, ‘আরে রাজশাহীতে জোহা ভাইকে মেরে ফেলেছে। আর্মি নাকি বেয়নেট খুঁচিয়ে মেরেছে!’
কাকে মেরেছে বললেন? ‘জোহা ভাইকে চেনেন না, না? আমাদের গ্যাণ্ডারিয়া পাড়ার ছেলে। রাজশাহী ইউনিভার্সিটির টিচার। খুব ব্রিলিয়ান্ট ছাত্র ছিলো! ছেলেবেলায় মিল ব্যারাকের মাঠে আমরা ক্রিকেট খেলতাম, জোহা ভাইও আমাদের সঙ্গে খেলতো। ফাস্ট ক্লাস ব্যাটসম্যান। বাসায় টেলিফোন করেছিলাম, তো আম্মা বললো যে রাজশাহী থেকে আজ ভোরবেলা খবর এসেছে। এরকম লোক হয় না রে ভাই!’
শওকত হঠাৎ চুপ করে। ওসমানের বিছানায় শুয়ে সেনাবাহিনীর অফিসারের হাতে নিহত বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক সম্বন্ধে শওকত স্মৃতিচারণ করে। কিছুক্ষণের মধ্যে তার নাক ডাকার আওয়াজ শোনা যায়।
ছাদে গিয়ে রেলিঙের ফাঁকে চোখ রেখে ওসমান দ্যাখে লোকজন ও যানবাহনশূন্য বিধবা রাস্তা শুয়ে রয়েছে ভোতা চেহারা করে। আকাশে রোদ চড়ে, রোদ নামতেও থাকে। দুপুরের পর ১জন বুড়ো লোককে দ্যাখা যায়, লোকটির হাতে হট-ওয়াটার ব্যাগ। আর্মির এক জওয়ান লোকটাকে কি হুকুম করলে বেচারা রাস্তায় বসে হাতজোড়া মাটিতে ঠেকায়। আর, ওসমান ভালো করে দেখে চিনতে পারে, এ তো রিয়াজউদ্দিন। সৈন্যটি হঠাৎ খুব জোরে চ্যাচায়, মাদারচোত, বাহেনচোত, বাহার নিকলে কিউ? তারপর গলা ফাটিয়ে পাকিস্তানী সেনাবাহিনীর সর্বোচ্চ দক্ষতার সঙ্গে কম্যাণ্ড করে, ফরওয়ার্ড ইস্টার্ট’ এই আদেশ অনুসরণ না করায় রিয়াজউদ্দিন তার লুঙি ঢাকা পাছায় বুট-শোভিত পায়ের লাথি খায় এবং হট-ওয়াটার ব্যাগ ফেলে তিড়িংবিড়িং করে ব্যাঙ লাফানো শুরু করে।
এই দেখে সেনাবাহিনীর লোকদের ওপর লাফিয়ে পড়ার জন্যে ওসমান রেডি হয়। কিন্তু এখানে রেলিঙ একটু উঁচু, ওসমানের মাথাও রেলিঙের সম্পূর্ণ এপারে। নিচে ডাইভ দিতে হলে তাকে প্রথমে রেলিঙের ওপর উঠে দাঁড়াতে হবে। তাই সই। রেলিঙের ওপরদিকের ফোকরে হাত রেখে ডান পা ওঠাতে যাচ্ছে নিচের একটি ফোকরে, এমন সময় কার হাত তার পিঠে। পা নামিয়ে নিলে পেছন থেকে কে বলে,কি করেন? দেখলে ব্যাটারা গুলি কইরা দিবো?
‘কে? রঞ্জকে পেছনে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে ওসমান তাকেও আহ্বান জানায়, ‘এসো, দুজনে শালদের ওপর লাফ দিয়ে পড়ি ওসমানের কপালে ও গলায় ঘাম গড়িয়ে পড়ছে, তার চোখ লাল এবং প্রসারিত। রঞ্জু তাড়াতাড়ি পেছনের দিকে হাটতে এবং একটু টার্ননিয়ে ঢুকে পড়ে ওসমানের ঘরে। বিছানায় শওকত তখনো ঘুমাচ্ছে। ওসমানও রঞ্জকে অনুসরণ করে। ছেলেটা বেশ ভয় পেয়েছে। রঞ্জুর ভয়-পাওয়া তাকে দারুণরকম একটা ধাক্কা দেয়, মাথার ভেতরটা নতুন করে ওলটাপালটা হয় : আহা! রাত্রিবেলা বরাদায় দাঁড়িয়ে পেচ্ছাব করতে করতে মানকচুর ঝাড়ে কালচে সবুজ আঁচল জড়ানো মোবারক মল্লিকের মাকে দেখে রঞ্জু বড়ডো ভয় পেয়েছে। প্রায় ১২ বছর পাগল হয়ে থাকার পর বুড়ি মারা গেলো গত সপ্তাহে। তা সে এখানে আসবে কোথেকে? আম্মা! আম্মা’-এরপর আর মনে ছিলো না। তার মাথায় পানি ঢালছিলো কে? আসগর চাচা? নাকি আব্বা নিজেই? কি জানি’-নাঃ এরকম ভয়কে প্রশ্ৰয় দেওয়া উচিত নয়।-ওসমান জানে এসব ভয় টাইট করতে হয় কি করে! দাঁড়াও রঞ্জু বলে রঞ্জুর কাধে হাত দিয়ে তাকে সে তার বুকের কাছে টেনে আনে এবং তার শ্যামবর্ণের গালে ও বেগুনি ঠোঁটে চুমু খায়। ২/৩ টি চুমু খেলে তার উত্তেজনা শান্ত হতে থাকে, তার চোখজোড়া ঢুলে আসে। আব্বা’ রঞ্জুর এই ভয়ানক আর্তনাদে ওসমান আবার চাঙা হয়। নাঃ! ছেলেটির ভয় একটুও কাটেনি। এতো ভয় কিসের? বা হাতে রঞ্জুর চুলের খুঁটি ধরে ওসমান ডান হাতে তার গালে ঠাস করে চড় লাগাতে শুরু করে। শওকত জেগে উঠে ধাক্কায় ওসমানকে সরিয়ে দেয়। ঘর থেকে বেরুতে বেরুতে রঞ্জু বলে, আব্বা ওসমানকে শওকত বেশ খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দ্যাখে, আপনার কি হলো? ফিলিং সিক? *আরে নাঃ ছেলেটা মিছেমিছে ভয় পেয়ে গিয়েছিলো। এতো ভয় পাবার কি হলো? *সে জন্য হোয়াই শুড ইউ স্ক্যাপ হিম? কি ব্যাপার? আপনার শরীর খারাপ? নিচে থেকে এসেছে মকবুল হোসেন। ‘না, ভালো আছি। রঞ্জু খামাখা ভয় পাচ্ছিলো, তাই একটু শাসন করে দিলাম। চেয়ারে বসে মকবুল হোসেন পান চিবায়, রঞ্জুর খবর বোধ হয় ঠিক নয়, ওসমান তো ভালোই আছে। কোনো ঝামেলা না হলেই ভালো। লোকটা চেয়ারে পা তুলে আয়েস করে বসে। কারফ্যু হইয়া কাম নাই কাজ নাই ঘরের মদ্যে বইসা খাওদাও আর ঘুমাও। তবে কোনো বিষয়ে সে অসন্তুষ্ট, যেমন, খালি এই মিলিটারিগুলি রাস্তায় ভদরলোকদের ধইরা বেইজ্জত করে, বুঝলেন? এইটা—।’
রাখেন রাখেন। ছাদের রেলিং থেকে লাফ দিয়ে শালাদের শেষ করে ফেলতে পারি, জানেন? দেখতেই খোদার খাসি, শালাদের গায়ে জোর আছে নাকি? শালাদের সব হাম্বিতামি দেশের আনআর্মড পিপলের ওপর। দ্যাখেন না, একটা ফ্লাইং কিক দিয়ে শালাদের কোথায় পাঠিয়ে দিই। দেখবেন? চলেন, ছাদে চলেন?
শওকত তার হাত ধরে, আরে কি শুরু করলেন? বসেন না চুপচাপ। ওসমান বিছানায় বসে কিন্তু তার গলা আরো চড়ে, আরে, আপনিতো খালি বাখোয়াজি করেন। রাতভর মদ খেয়ে এসে বুলি ছাড়েন। সাহস থাকে তো চলেন– ‘
শওকত বেশ ঘাবড়ে গেছে, আপনি বরং ঘুমিয়ে নিন। রাত্রে বোদহয় ভালো ঘুমাতে পারেননি? আবার সারাদিন আপনার বিছানা অকুপই করে রাখলাম আমি। আপনি খুমান। মকবুল হোসেন রীতিমতো ভয় পেয়েছে। আমি বরং যাই। উঠে দাঁড়িয়ে শওকতকে বলে, রাত্রে তো আপনারে থাকতেই হইবো। কারফ্যুর ভেতর যাইবেন ক্যামনে? ট্রাবল হইরে আমারে খবর দিয়েন। আমি দোতালায় থাকি। কবর দিতে হেসিটেড কইরেন না।
ওসমান হঠাৎ বলে, শওকত ভায়ের থাকার দরকার কি? খিজির চলে এলে আপনি শোবেন কোথায়? ইউ বেটার গো!
ওসমান সিদ্ধান্ত নেয় যে খিজির এলেই এই কারফ্যু-চাপা শহরের ঢাকনি উল্টিয়ে সে তার সঙ্গে বেরিয়ে পড়বে।
সন্ধ্যার পর পরই খিজির আসে। শওকত স্বস্তির নিশ্বাস ফেলে, রাস্তায় আর্মি নেই? কারফ্যুর ভেতর তুমি এলে কি করে?
ওসমানও খুব খুশি, তুমি সারাদিন ছিলো কোথায়? কাল রাত্রে তোমাকে কয়েকবার মিছিলে দেখলাম!’
কি কন? মাহাজনের গ্যাড়াকলের মইদ্যে পইড়া তামামটা রাইত আটকা থাকলাম। মাহাজনের খবর তো জানেন? মনে লয় বাচবো না। শরীলের একটা সাইড খরচা হইয়া গেছে, দোসরা সাইডটা লইয়া—।’
রহমতউল্লার শারীরিক কুশলতায় ওসমানের আগ্রহ নাই। আজ সারাদিন ছিলে কোথায়?
‘তামামটা দিন আউজকা আমার ঘরের মইদ্যে রাস্তার মোচড়টার মদ্যে মিলিটারির গাড়ি, বারাইবার পারি না। লগে বিড়ি উড়ি ভি নাই। বহুত ধান্দা কইরা ছুপায়া ছপায়৷ সালামত মিয়ার বন্ধ দোকানের বগলে গিয়া খাড়াইছিতো দেহি ঐ লাল বাড়ির নয়া ভাড়াইট সাবরে এক হামলায় মিলিটারিকান ধরাইয়া ওঠ-বস করায়। আমি আর নাই, এক্কেরে লোড় পাইড়া সিধা ঘরের মইদ্যো’ খিজির হি হি করে হাসে এবং হাসতে হাসতে ভদ্রলোকের হেনস্থা দ্যাখাবার জন্য নিজেই কান ধরে ওঠা বসা করে।—’বুঝলেন না? একটা সাব মানুষ৷ যহনই বারায়-, তহনই দেহি মাঞ্জা দিয়া বারাইতাছে, ক্যাপস্টান ফুকতাছে। হায় হায়, তারে ধইরা কানে হাত দিয়ে—।’ হসির দমকে খিজির গড়িয়ে পড়ে।
আরে রাখো’ ওসমান রাগে উঠে দাঁড়ায়, মানুষের ওপর অত্যাচার হচ্ছে, আর তুমি হাসো ঐ শালা মিলিটারির কান দুটো ছিঁড়ে আনতে পারলো না?
আঃ! চ্যাতেন ক্যালায়? কারফ্যুর মইদ্যে আমি একলা একলা মিলিটারির বালটা ছিড়বার পারুম?
কারফ্যুর ভেতর কি করতে পারে তাই দ্যাখার জন্য এবং দ্যাখাবার জন্য ওসমান ছাদে যায়। শওকত এই সুযোগে নিচু গলায় খিজিরের কাছে ওসমানের অসংলগ্ন কথাবার্তা ও তৎপরতার বিবরণ দেয়। রঞ্জকে চড় মেরেছে সে কথাটাও জানায় তবে চুমু খাওয়ার ব্যাপারটা চেপে যায়। খিজির পাত্তাই দেয় না, এইগুলি কিছু না। কয়দিন বারাইবার পারে না, তাই আন্টুপান্টু হইতাছে, বুঝলেন না?
রাস্তায় না নামলে হালায় মগজের মইদ্যে হাওয়া বাতাস খেলবার পারে না, তাই মাথাটা জাম হইয়া রইছে! খিজির তো অভিজ্ঞতা থেকে জানে যে কোনো রিকশা কয়েকদিন না চালালে চেনের ভেতর জং ধরে যায়, আবার রাস্তায় চাকা ঘোরালেই সব স্বচ্ছন্দ হয়ে আসে। এতে এতো ঘাবড়াবার কি হলো?-খিজিরের এখন ঘুম পাচ্ছে। হাই তুলতে তুলতে সে মেঝেতে বিছানা পাতে, শওকতকে পরামর্শ দেয়, খাইছেন? দোনোজন ঘুমাইয়া পড়েন। বাজে কয়টা? কিন্তু সময় জানার আগেই সে উঠে বসে, কান খাড়া করে কি শোনে। শওকত উদ্বিগ্ন হয়ে বলে, কি হলো?
দাঁড়ান। খিজির এবার উঠে দাঁড়িয়ে ছাদে গেলে শওকত দূর থেকে জমাটবাঁধা আওয়াজ শুনতে পায়। আওয়াজ ক্রমেই জোরদার ও স্পষ্ট হচ্ছে।
পাশের বাড়ি থেকে কোনো প্রতিবেশীকে উদ্দেশ করে কে যেন চিৎকার করে, কোথায় যেন মিছিল বেরিয়েছে। শুনছেন?
কোন বাড়ি থেকে জবাব আসে, গুলিস্তানের দিকে হতে পারে। ছাদে গিয়ে শওকত সেই অদৃশ্য ব্যক্তির ভুল সংশোধন করে, না। এটা আরো দূরের সাউণ্ড।’
ওসমান কিন্তু বুঝতে পারে যে রাস্তায় মিছিল চলছে। আকাশের মিছিলও বেরুবে। ডাঙা ও আকাশ জুড়ে এই আওয়াজ ক্রমেই এগিয়ে আসছে।
মিছিলের জায়গা সনাক্ত করার আগেই মানুষের সমবেত ধ্বনি খচিত হয় আগ্নেয়াস্ত্রের টকটকটক শব্দে। কিছুক্ষণের জন্য মানুষের কথা চাপা পড়ে অন্ত্রের দাপটে। ওসমান, শওকত ও খিজির রেলিঙে ভর দিয়ে নিচের রাস্তা দ্যাখে। অন্ধকার নির্জন রাস্তা দূরের গোলাগুলির শব্দে কাপছে। দেখতে দেখতে গোলাগুলির আওয়াজ ছাপিয়ে বেজে ওঠে মানুষের স্লোগান।
এবার কোনো প্রতিবেশী দোতলা থেকে উচ্চকণ্ঠে জানায়, নাখালপাড়ায় মিছিলে গুলি চলছে। আমার ছোটোভাই টেলিফোন করেছে, বিরাট প্রসেশন বেরিয়েছে।
মনে হচ্ছে মালীবাগের দিকে। অন্যদিক থেকে একজন চিৎকার করে, মালিবাগে নাকি বিরাট প্রসেশন বেরিয়েছে। আর্মি র্যানডম গুলি করছে।
দূরের গুলিবর্ষণ ও স্লোগানের ঠোকাঠুকি ক্রমেই স্পষ্ট হয়। এবার এই বাড়ির নিচের তলার লোকজনের কথাবার্তা শোনা যাচ্ছে। ‘গওসল আজম সু ফ্যাক্টরির কর্মীরা উত্তেজিত কিংবা ভীত। ছাদ থেকে চিৎকার করে খিজির তাদের নির্দেশ ছাড়ে, ‘তরা খাড়া। মমতাজ, ফালু, কাদির, লাটমিয়া-ব্যাকটি রেডি হও। একলগে বারাইয়া পড়ম।
দোতলা থেকে মকবুল হোসেন চিৎকার করে করে ছাদের উদ্দেশে, আপনারা ঘরে ঢোকেন। ঘরে ঢোকেন। আর্মি আসলে যামনে খুশি গুলি চালাইবো।’
খিজির চিলেকোঠার ঘরে ঢুকতে ঢুকতে বলে, ‘ওসমান সাব, লন যাই! আপনেও চলেন। তার শেষ বাক্যের লক্ষ্য শওকত। চলেন যাই। রাস্তায় বহুত মানুষ নামছে। অরা কয়জনরে আটকাইবো, কন? চলেন, যাই!’
ওসমান উত্তেজনায় কাপে, শওকত ভাই, চলেন। চলো চলো। কিন্তু এইসময় দূরের গুলিবর্ষণ মনে হয় চলে এসেছে একেবারে নিচের রাস্তায়। ওসমান তাই একটু অপেক্ষা করতে চায়। কিন্তু খিজিরের ধৈর্য নাই। ঘরের ভেতর দিয়ে ধ্যাবড়া পায়ের ধপধপ আওয়াজ তুলে খিজির সিঁড়ি দিয়ে নিচে নামে। ওসমান পিছে পিছে যাচ্ছিলো, শওকত তার হাত চেপে ধরে, দাঁড়ান। পাগল হলেন? ওসমান হাত ছাড়িয়ে নিতো, কিন্তু শওকতের হাত থেকে বেরিয়ে আসার মতো বল তার কবজিতে নাই।
ওসমানকে ফের ছাদেই যেতে হয়। শওকতের পাশে দাঁড়িয়ে রেলিঙে ভর দিয়ে দেখলো মাত্র ৭জন লোকের সঙ্গে শ্লোগান দিতে দিতে নামলো খিজির আলি, সান্ধ্য আইন সান্ধ্য আইন’–মানি না মানি না’, ‘আগুন জ্বালো আগুন জ্বলো—দিকে দিকে ‘আগুন জ্বলো’, জেলের তালা ভাঙবো’–’শেখ মুজিবকে আনবো। কয়েক মিনিটের ভেতর নানা দিক থেকে এইসব শ্লোগানের প্রতিধ্বনি বেজে ওঠে। মহল্লার গলি উপগলি শাখাগলি থেকে আরো সব লোক এসে ছুটছে খিজিরদের সঙ্গে। এতো লোক কোথেকে আসে? পাড়ায় কি এতো মানুষ আছে?-হ্যাঁ, এবার ওসমান ঠিক ধরতে পেরেছে। মহল্লার জ্যান্ত মানুষের সঙ্গে ভিড়ে গেছে ১০০ বছর আগে সায়েবদের হাতে নিহত, সায়েবদের পোষা কুকুর নবাবদের হাতে নিহত মিরাটের সেপাই, বেরিলির সেপাই, লক্ষ্ণৌ-এর মানুষ, ঘোড়াঘাটের মানুষ, লালবাগের মানুষ। গা একটু ছমছম করলেও ওসমান সামলে নেয়। না, তার ভয় কি? এই এলাকার সবাই জানে, ভিক্টোরিয়া পার্কে পামগাছগুলোর সঙ্গে ফাঁসিতে লটকানো সেই সব মানুষ অমাবস্যায়, পূর্ণিমায়, প্রতিপদে, একাদশীতে-মধ্যরাত্রি হলেই মহল্লা জুড়ে টহল দেয়, শক্রপক্ষের গুলিগালাজের আওয়াজ শুনে তাদের কণ্ঠনালীতে, জিভে ও টাকরায় সুড়সুড়ি দিচ্ছে, মহল্লা মাত করে জীবিত মানুষের সঙ্গে তারা স্লোগান দেয়, মানি না! মানি না। এর মধ্যে ২ দিকের বাড়িগুলোর উদ্দেশে ১টি তীক্ষ আহ্বান শোনা যায়, বিবিজানের সিনার মইদ্যে খোমাখান ফিট কইরা নিন্দ পাইড়েন না ভাইসাবেরা, মরদের বাচ্চ মরদ হইলে রাস্তায় নামেন। লোকটি কে? এতো মানুষের মধ্যে তাকে চেনা যায় না। কিন্তু তাকে খুঁজতে খুঁজতে ওসমান দ্যাখে যে কলতাবাজারের কবন্ধটাও মিছিলে যোগ দিয়েছে। অমাবস্যার রাতে, পূর্ণিমার রাতে মুণ্ডহীন এই সেপাই ছুটে বেড়ায় নবদ্বীপ বসাক লেন, নন্দলাল দত্ত লেন, নাসিরুদিন সর্দার লেন ও পাঁচভাইঘাট লেন জুড়ে। খিজির তাকে বহুবার দেখেছে, বজলু দেখেছে, ফালু দেখেছে, মহাজনের বাড়ি থেকে ফেরার সময় তাকে দেখে ফিট হয়ে গিয়েছিলো জুম্মনের মা। আজ দেখরো ওসমান। এখন কিন্তু কেউ তাকে ভয় পাচ্ছে না। মুণ্ডু নাই বলে বেচারা শুধু হাত তুলে তুলে স্লোগানে শামিল হচ্ছে। নাঃ। আর দেরি করা চলে না। ঘরে ঢুকে ওসমান জোর কদমে এগিয়ে চলে সিঁড়ির দরজার দিকে। শওকত হাত রাখে ওসমানের পিঠে, কোথায় যাচ্ছেন? কারফ্যু ভায়োলেট করলেই ফায়ার করবে।
করুক!’
না।-শওকত সিঁড়ির দরজা বন্ধ করে দেয়। সঙ্গে সঙ্গে মাথার ঠিক পেছনে টকাটক টকাটক গুলিবর্ষণ শুরু হলে শওকতের সঙ্গে ওসমানকেও বসে পড়তে হয় মেঝেতে।
গুলির শব্দ থামে, কিন্তু পা দুটোকে ওসমান কোনোভাব বাগে আনতে পাচ্ছে না। বাধ্য হয়ে সে উঠে দাঁড়ায়। পাজোড়ার অবস্থা তখন সাইকেলের চাকার মতো, চালাতে শুরু না করলে সমস্ত শরীরটা ধপাস করে পড়ে যাবে। পা ২টো তার নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যাচ্ছে। সামলাবার জন্য ওসমান তাই ঘরের ভেতর পায়চারি শুরু করে। ১পা, ২পা, ৩পা, ৪পা, ৫পা, ফেলতে ফেলতে বাইরে ফের গুলিবর্ষণ শুরু হয় এবং ১০ম কি ১১শ পদক্ষেপে ওসমান রীতিমতো লাফাতে শুরু করে। শওকত ভয় পেয়ে নিজে পিঠ দিয়ে চেপে ধরে সিঁড়িতে নামবার দরজা। এইভাবে লাফিয়ে লাফিয়ে সে ঘুরতে লাগলো। তবে জায়গা বড়ডো কম বলে কখনো তক্তপোষের সঙ্গে তার পা লাগে, কখনো মাথা ঠুকে যায় দেওয়ালের সঙ্গে। লাফাতে লাফাতে ছাদে চলে গেলে সিঁড়ির দরজার ডিউটি ছেড়ে শওকতকেও ছুটতে হয় ছাদে। ওসমান। এই ওসমান’-তাকে ধরার জন্যে শওকত তার পিছে পিছে ঘোরে। কিন্তু ওসমানের গতি নির্ণয় করা কঠিন। সে এই এখন ছাদের এ মাথায় তো মুহুর্তের ভেতর ছুটে যাচ্ছে সম্পূর্ণ উল্টোদিকে। ওদিকে রাস্তার গুলিবর্ষণ ও আর্তনাদের মধ্যে ঝলসে ওঠে শ্লোগানের ধ্বনি, মানি না, মানি না। একেকটি ধ্বনির ধারালো ঘায়ে ওর পা দুটো লাফিয়ে লাফিয়ে ওঠে। পা এখন তার এতো হান্ধা যে সে যেভাবে খুশি, যতোটা খুশি লাফাতে পারে। শওকত চিৎকার করে, ওসমান প্লিজ ছাদে থাকবেন না। ফায়ারিং হচ্ছে তা ছাদে তো ওসমান সবসময় থাকছেও না। লাফাতে লাফাতে ঘর-ছাদ, ছাদ-ঘর করে বেড়াচ্ছে। কখনো লাফায় একেবারে সোজা হয়ে, মুষ্টিবদ্ধ হাত ছোড়ে ওপরদিকে। এটা ছাদেও হচ্ছে, ঘরেও হচ্ছে। ঘরেও তো ছাদ রয়েছে, তাই লাফিয়ে মুষ্টিবদ্ধ হাত ছোড়ায় সময় ঘরে থাকলে তার হাত ঠুকে যাচ্ছ সিলিঙের সঙ্গে। রক্তাক্ত হাত আবার খোলা ছাদে জুলে ওঠে মশালের মতো। শওকত তার ছুটতে ছুটতে হাপায় আর হাপাতে হাঁপাতে ডাকে, ওসমান ওসমান!
সারারাত্রি হয়তো এরকম চলতো। সিঁড়ির দিককার দরজায় করাঘাত শুনে শওকত দরজা খুলে দেয়। ভেতরে ঢোকে মকবুল হোসেন, রঙ্গু, দোতলার আরেকজন ভাড়াটে এবং ঐ ভাড়াটের ভাই বা ছেলে বা শালা। এমনকি সিঁড়ির নিচের দিকের একটি ধাপে দাঁড়িয়ে রয়েছে রানু। লাফাতে লাফাতে ওসমান তখন চলে এসেছে ঘরের ভেতর। দোতলার ভাড়াটে বলে, ব্যাপার কি?
মকবুল হোসেন দাঁড়ায় লক্ষমান ওসমানের নাগালের বাইরে, ওসমান সায়েব কি হইলো, এ্যাঁ? লাফানো অব্যাহত রেখে ওসমান একটু হাসে। সে কিন্তু বুঝতে পাচ্ছে যে তার এই ব্যাপারটিতে এদের অনুমোদন নাই। কিন্তু নিজের পায়ের ওপর তার সমস্ত নিয়ন্ত্রণ শেষ। রঞ্জু সাহসের সঙ্গে তার দিকে এগিয়ে আসে, নাচেন কেন? এ্যাঁ? নাচেন কেন? রঞ্জু ঠাট্টা করলেও ওসমানের এই লাফানোকে নাচ বলা যায় বৈকি। তার পা পড়ছে নিয়মিত বিরতি দিয়ে এবং খুব মনোযোগ দিয়ে দেখলে এর মধ্যে তাল ও লয়ও চিহ্নিত করা সম্ভব। দোতলার ভাড়াটের ছেলে কিংবা শালা কিংবা ভাই—সেই ছেলেটিও রঞ্জুর সাহসে উৎসাহিত হয়ে ওসমানের সামনে গেলে তার পায়ের ধাক্কায় ছিটকে পড়ে যায় দেওয়াল ঘেঁষে। তাকে নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়ে তার বাবা কিংবা ভাই কিংবা ভগ্নিপতি। এবার রঞ্জু ও শওকত একসঙ্গে ২ দিক থেকে তার পা চেপে ধরার জন্য এগিয়ে আসে। ওসমান যখন খুব জোরে লাফিয়ে তক্তপোষের কাছাকাছি এসেছে, তক্তপোষে উঠে দাঁড়িয়ে শওকত তখন ডানহাত দিয়ে ধাক্কা দিলো তার কোমরে। সঙ্গে সঙ্গে রঞ্জু ঘুষি লাগায় ওসমানের উড়ন্ত হাঁটুতে। ওসমানের পাজোড়া শিরশির করে; কতোকাল আগে রেললাইনের কাছে বাবলাবনে দৌড়াতে গিয়ে পড়ে গিয়েছিলো, সে যেন নিজেই নিজের হাঁটুতে হাত বুলিয়ে দিচ্ছে। তার পাশে ছিলো কে? দুর্গাঁ? এই ঘটনা কি দুর্গার সিঁদুর-কেটা চুরির আগের না পরের? ধপাস করে পড়ে যেতে যেতে ওসমান মনে করতে পারলো না। মুণ্ডসমেত তার ধড় পড়েছে মেঝেতে, পাজোড়া তক্তপোষের ওপর। সবাই মিলে তাকে বিছানার ওপর ভালো করে শুইয়ে দেয়। এমনকি তার পায়ের তুলনায় মাথা নিরাপদ ভেবে মকবুল হোসেন পর্যন্ত ওসমানের মাথা বালিসে ঠিকঠাক করে বসিয়ে দেয়। দোতলা থেকে বালতি ভরে পানি এনে তার মাথায় ঢালতে ঢালতে দোতলার ভাড়াটে মত প্রকাশ করে, ডাক্তার দ্যাখাইতে হইবো।’
সবাই চলে গেলে শওকত তার পা টিপে দেয়। ওসমানের পায়ে বড়ডো সুড়সুড়ি লাগছে। কিন্তু উঠে বসার ক্ষমতা তার নাই, শুয়ে শুয়েই আস্তে আস্তে পা নাচায়। পায়ে পায়ে প্রায় নিঃশব্দ তালি বাজে, সমস্ত ঘর তার চারদিকে বো বো করে ঘুরতে থাকে।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *