1 of 2

চিলেকোঠার সেপাই – ৩৫

চিলেকোঠার সেপাই – ৩৫

আরে আসেন, আসেন। ওসমানকে অভ্যর্থনা জানাবার জন্য আধশোয়া অবস্থা থেকে রহমতউল্লা ইজিচেয়ারের ক্যানভাসে একটু সোজা হয়ে বসলো, আপনার লগে আমার কথা আছে, বসেন। পাশেই হাতলওয়ালা চেয়ারে বসলো ওসমান, কিন্তু রহমতউল্লা কথা চালিয়ে যায় তার কয়েকজন মিস্ত্রীর সঙ্গে, দোলাই খালের উপর নির্মীয়মাণ রাস্তার কোনো অংশে সিমেন্টের অতিরিক্ত ব্যবহার হয়েছে বলে সে ঝাড়া ১০ মিনিট ধরে তাদের বকে। তারপর তাদের ছাটাই করার হুমকি দিয়ে রহমতউল্লাহ ইজি চেয়ারে আরাম করে ফিরে আসে তার প্রায় শোয়া অবস্থায়। ওসমানের মনে হয়, এতোক্ষণ বরং ভালো ছিলো। ওসমানকে এখন যদি সে তার মেয়ের সঙ্গে বিয়ের প্রস্তাব দেয় তো সে জবাবটা দেবে কি? এই প্রস্তাব মেনে নেওয়া তার পক্ষে অসম্ভব। কিন্তু প্রত্যাখ্যান করবে কিভাবে? বলা যায় যে, তার বাবা বা কোনো গুরুজন এখানে নাই, তাদের সঙ্গে কথাবার্তা না বলে সে কিছুই করতে পারবে না। রহমতউল্লা বলবে, ওসমান তার বাবাকে চিঠি লিখুক। কিংবা ঠিকানা দিলে রহমতউল্লা নিজেই চিঠি লিখতে পারে।-ওসমানের বাড়িঘর নাই, সে বিয়ে করে কিভাবে? —রহমতউল্লা বলতে পারে, তাতে কি? তার নিজের মেলা বাড়ি আছে। না, রহমতউল্লার বাড়ি ওসমান কক্ষনো নিতে পারে না। তবে কি-না কোনো শুভাকাঙ্ক্ষীর এরকম প্রস্তাব প্রত্যাখ্যানের ভঙ্গি বিনীত হওয়া উচিত। রহমতউল্লার মেয়েকে সে কোনোভাবেই বিয়ে করতে যাচ্ছে না, সিতারার জন্য হন্যে হয়ে অপেক্ষা করছে আলাউদ্দিন মিয়া। কিন্তু মেয়েটা সম্বন্ধে একটু বিবেচনা থাকা ভালো। রানুর সঙ্গে মাখামাখিটা বড়ডো বেশি হয়ে যাচ্ছে। রানুর ভাবনা মাঝে মাঝে এমন করে বেঁধে যে এতোটা উত্তেজনা সহ্য করা কঠিন। এমন কি তার এ্যাঁসিডিটি বেড়ে যাচ্ছে, যখন তখন মাথাও ধরে। নোভালজিন আর এ্যাঁন্টাসিডের বাধ্যতামূলক ব্যবহার আর কতো সহ্য করা যায়?=বরং অন্য কেউ যদি তার মধ্যে একটু স্পন্দন তৈরি করতে পারে তো ১টা ব্যালান্স হয়, তখন এ্যাঁন্টাসিড আর নোভালজিনের জায়গায় রানু আর রহমতউল্লার মেয়ে তার ভেতর সামঞ্জস্য বিধানের দায়িত্বটা পালন করতে পারে।
আপনার লগে খিজিরে থাকে? মহাজনের এই প্রশ্ন শুনে ওসমান ফ্যালফ্যাল করে তাকায়। চায়ের পেয়ালায় সশব্দে চুমুক দিয়ে রহমতউল্লা বলে, ঐটারে তো চিনেন না! নেমকহারামের বাচ্চা নেমকহারাম! চুরি চামারি কইরা আমার গ্যারেজটারে পল্টনের ময়দান বানাইবার তালে আছিলো। মনে লয় শেখ মুজিবের মিটিং করনের জায়গা বানাইবার নিয়ত করছিলো। আলাউদিনে ভি তারে রাখবার পারলো না! আপনারে কইয়া রাখলাম!’
আমার কোনো অসুবিধা হচ্ছে না। ওসমানের এরকম প্রতক্ষ্য প্রতিক্রিয়া শুনে রহমতউল্লা নড়েচড়ে বসে। তা সে যতোই নডুক, ওসমান এখন অনেক কথা বলতে সক্ষম। মেয়ের সঙ্গে ওসমানের বিয়ে দেওয়া রহমতউল্লার সম্ভাব্য প্রস্তাবের কথা ভেবে সে একটু আগে মিষ্টি মিষ্টি লজ্জা পাচ্ছিলো—এই গ্রানিতে ওসমান বেপরোয়া হয়ে ওঠে, খিজিরিকে আমার খারাপ লোক মনে হয় না।
আপনেরা কারে খারাপ কন, কারে ভালো কন, সেইটা আপনেগো ব্যাপার। মগর ঘর যহন ভাড়া লইলেন তহন একলা থাকনের কথাই তো কইছিলেন। ‘না আমি একা থাকবো এরকম কথা বলে ভাড়া নিইনি।’ আহা, চ্যাতেন কেন? রহমতউল্লা চটে না, আপনার ভালার লাইগাই কইছিলাম। হালায় চোর তো আছেই, আবার আকামকুকাম যা তা করবার পারে। শুওরের বাচ্চার চোখ দুইখান দেখেছেন? মানুষ ভি খুন করবার পারে, বোঝেন?
‘না, আমার মনে হয় না। খিজির আমার সঙ্গেই থাকবে। আপনার যদি আপত্তি থাকে তো আপনি আমাকে লিখিতভাবে জানাবেন। যদি আমাকে উচ্ছেদ করতে চান তো উকিলের নোটিস পাঠাতে হবে। ওসমান উঠে দাঁড়ায়। এরপরও রহমতউল্লার কোনো বিকার নাই। চিৎকার করে কাজের লোককে পান আনতে বলে সে ওসমানকে হাত দিয়ে বসতে ইশারা করে, আরে বসেন। আপনার লগে কথা আছে কইলাম না? ওসমান ফের বসে, কিন্তু বিরক্ত হয়, এতোক্ষণ তাহলে হলোটা কি?
এর মধ্যে নারিন্দার মোড় থেকে কাঁঠালপাতার ঠোঙায় তেহরি এসে পড়লো। ২টো প্লেটে তেহারি সাজানো হলে খান’ বলে রহমতউল্লা ধোঁয়া-ওঠা তেহারির ভেতর থেকে ছোটো ছোটো গোশতের টুকরা গুছিয়ে একদিকে রাখলো। খেতে খেতে তার গুরুত্বপূর্ণ কথাটি শুরু করলো, মকবুল সাবের মাইয়ারে তো আপনে পড়ান, না?
টেবিলের নিচে ওসমানের পা দ্রুত নড়তে শুরু করে, প্লেটের কোণ থেকে সে পরপর ৩বার সালাদের গাজর ও টোম্যাটো খেয়ে ফেলে।
মাইয়া তো মনে হয় ভালোই? ওসমান কিভাবে রহমতউল্লাকে প্রতিহত করবে মনে মনে তার প্ল্যান করতে চায়। কিন্তু হয় না। রানুর সঙ্গে ওসমানের মেলামেশার অছিলা তুলে বাড়িওয়ালা কি তাকে উচ্ছেদ করবে? কেন, ওসমান কি মাগনা থাকে?-খিজিরকে সহ্য করতে না পেরে আমাকে উচ্ছেদ করতে চাও এখন রানুর সঙ্গে আমার মেলামেশার অজুহাত ধরে। আর কাল যখন খিজির নিজেই এসে তোমার বাড়ি দখল করবে, তখন তাকে উচ্ছেদ করার ক্ষমতা তোমার হবে? তখন?-ওসমানের এইসব নীরব উত্তেজনা চিড় খায় রহমতউল্লার ঘর্ঘর গলার আওয়াজে, কইলেন না, মাইয়া কেমুন?
‘কেন? একটা সম্বন্ধ করবার চাই। খাওয়া শেষ করে রহমতউল্লা টেবিলে রাখা চিলমচিতে হাত ধোয়, কুলকুচো করে এবং মুখ মুছে খিলাল করে। এই লাইগা আপনারে ডাকছিলাম। আমার এক সাড়ু ভাই, তার পোলার লগে বিয়া দিবার চায়। আমার সাভূভাইয়ের-।
আপনার সাডুভাই? হ। নবাবপুরে হার্ডওয়ারের দোকান আছে। নাজিরা বাজার আলাউদ্দিন রোডে সাইকেল পার্টসের দোকান। রেশন দোকান আছে কয়েকটা। আবার ওয়ার্ডের মেম্বার, বহুত পুরানা মেম্বার, নবাব সাবগো আমলে বাইশ পঞ্চায়েত আছিলো, নাম হুনছেন?–তহন থাইকাই ওরা- বলতে বলতে হঠাৎ তার মনে পড়ে, আরে আপনে দেখছেন তো ঐদিন আইছিলো। এই পয়গাম ঠিক করতেই আমার কাছে আইছিলো। পরে আলাউদিনের কাছে গেলো। শুনলাম আপনাগো সাথে জয়েন করবার কথা কইছে।’
হ্যাঁ, হ্যাঁ। পাকিস্তান মাঠে মিটিঙে বক্তৃতা করেছে। বিডি মেম্বার থেকে রিজাইন করলেন।
চিনছেন? রহমতউল্লা উৎসাহিত হয়, উনির পোলা। উনির বিবি, মানি আমার বিবিসায়েবের বড়োবোন মাইয়ারে দেখছে, পোলায় ভি দেখছে। দোনোজনের পছন্দ। পোলায় আবার মায়েরে ছাড়া কিছু বোঝে না। তা ঐদিন আমি গিয়া মাইয়ারে ডাইকা
কথাবার্তা কইলাম। রংটা ময়লা। তা হোক। এমনিতে আদব কায়দা জানে। ভালো। মকবুল মিয়ারে আমি কইছি।’
উনি কি বললেন? কি কইবো? পোলার তো টাকাপয়সার অভাব নাই। দোকানপাট, তেজারতি তো আছেই, অর বাপে আবার মার্কেট বানাইতাছে।’
ঐ যে স্কুল ভেঙে মার্কেট বানাচ্ছে? আরে, ঐটা লইয়াই তো ভাইসাবে আমার ফাইসা গেছে। ইস্কুলের লগে জমিন অগো, এজমালি সম্পত্তি। ইস্কুল বিল্ডিং বহুত পুরানা, নবাব সলিমুল্লা সাবের ভি আগে আতিকুল্লা সাব কয়দিনের লাইগা নবাব হইছিলো, উনার জমানার ইস্কুল। ইস্কুল বিল্ডিং ধইসা পড়ে দেইখা ঐটা মেরামত করনের কন্ট্রাক্ট পাইছিলো ভাইসাবে। ঐ বিল্ডিং মেরামত কইরা ফায়দা নাই, আবার ভাইঙা পড়বো। ইস্কুল ভাইঙা তাই নিজের জমিনের লগে মিলাইয়া মার্কেট তুইলা দিছে। পাবলিকে বহুত চেতছে। ভাইসাবে আমার একবার এদিক ফাল পাড়ে, একবার ওদিক ফাল পাড়ে। অহন তাই আওয়ামী লীগের লগে লাইন দিবার চায়। আমারে কয়, আপনে ঠিকই আছেন, আপনে পুরানা দল লইয়া থাকেন, আমি যাই অগো লগে। আমি কই, ভাইসাব পুরানা চাল ভাতে বাড়ে। একবার যে মসজিদের মইদ্যে—। এই দীর্ঘ সংলাপে ভায়রার বৈষয়িক ও রাজনৈতিক তৎপরতা সম্বন্ধে রহমতউল্লার মনোভাব বোঝা যায় না। এই নিয়ে ওসমানের মাথা ঘামাবার দরকার কি? রহমতউল্লার প্রস্তাবে মকবুল হোসেনের প্রতিক্রিয়া জানাটা বরং অনেক জরুরি। তা মকবুল সায়েব আপনাকে কি বললেন?’
উনার কথা ক্লিয়ার না। কয়, মাইয়া নাকি ল্যাখাপড়া করতে চায়। আবার পোলায় বিএ পাশ নাকি এইটা জিগায়। আরে, বিএ এমএ রাস্তার মইদ্যে গড়াগড়ি যাইতাছে।
‘আমি কি করবো?
আপনে এটু কইবেন। আপনে কইলে মনে লয় মাইয়া না করবো না। রহমতউল্লাহ মিষ্টি করে হাসে, ভালো কইরা বুঝাইয়া কইয়েন। এমুন দুলা পাইবো কে? আপনেরে মনে হইলো অর বাপে ভি খুব মানে।

তাই কি?-ঘরে ফিরে প্যান্ট শার্ট না খুলেই বিছানায় শুয়ে ওসমান এই সমস্যার সমাধান খোজার চেষ্টা করে। ঠিক সমস্যা নয়, প্রশ্ন বলা চলে।—রানুর বাবা মকবুল হোসেন তার ওপর কতোটা ভরসা করে? তা করে বৈকি! কারফ্যুর সময় রাস্তায় কোনো আওয়াজ হলে ছুটে চলে আসে এই ঘরে। লোকটা বেশিরকম ভীতু, কোনো বিপদের আঁচ করলেই ওসমানের সঙ্গে তাই নিয়ে কথা বলে ভয়ের ধারটা ভোতা করে নেয়। মকবুল হোসেন এলে রহমতউল্লার প্রস্তাবটা সরাসরি বলা ঠিক হবে? লোকটা যাচ্ছেতাই রকম মেরুদণ্ডহীন। বাড়িওয়ালাকে স্পষ্ট ভাবে হ্যাঁ বলেনি কেন? মেয়ের বাপ হয়ে সে কি বুঝতে পাচ্ছে না যে রানুক্রমেই তার নাগালের বাইরে চলে যাচ্ছে? গতকাল, না পরশু? নাকি তার আগের দিন? কবে যেন বিকালবেলা, হ্যাঁ বিকালবেলাটা ঠিক মনে আছে, রানুকে দেখে ওসমানের মাথা ঝিমঝিম করছিলো। ওসমান তখন বাইরে থেকে ফিরছে, রাস্তা থেকে ওপরে চোখ মেলে দ্যাখে রানু শাড়ি তুলে নিচ্ছে রেলিঙ থেকে। তার চোখে হঠাৎ ফোকাস মারে রানুর চোখ। হ্যাঁ, রানুর চোখ আলোয় ঝকঝক করছে। এতো আলোয় ওসমানের চোখে ধাঁধা লাগে, অন্ধকার স্যাঁতসেতে সিঁড়িতে বেয়ে ওপরে উঠতে উঠতে সে মনে করতে চেষ্টা করে, ঠিক এরকম ধারালো চোখ সে আর কোথায় দেখেছে? কোথায়? এক্ষুনি মনে পড়লো, হ্যাঁ, এই চোখ একদিন ঠিকরে পড়েছিলো রহমতউল্লার দিকে। রহমাতউল্লা ভাগ্যিস ঐ চোখে চোখ রাখেনি, নইলে শালা মহাজনের জং-ধরা চোখজোড়া পুড়ে ছাই হয়ে যেতো। ঐ চোখজোড়া ছিলো রানুর বোবা বোনের। পরশু বিকালবেলা রানু কি তার চোখের কোটরে বোনের চোখের মণি সেট করে নিয়েছিলো? এটা যদি পার্মানেন্ট হয় তো মকবুল হোসেনের কপালে দুঃখ আছে।
আপনের বই। রঙ্গু খোলা দরজা দিয়ে ঘরে ঢুকে বসতে বসতে ছবিওয়ালা ক্যালেন্ডারের পাতায় মোড়ানো একটা বই ওসমানের হাতে তুলে দেয়, আপাকে পড়তে দিছিলেন না? নেন।’
টেবিলে পথের পাঁচালী রাখতে রাখতে ওসমান ওপরের মলাট দ্যাখে, বাঃ! খুব সুন্দর মলাট দিয়েছে তো?
আপা দিছে। বইটা খুইলা দ্যাখেন। ‘আজ তোমরা পড়তে এলে না যে? আপনে তো ঘরেই ছিলেন না। আমি বই নিয়া দুইতিনবার আসলাম। খুইলা দ্যাখেন না!
‘কেন? পাতাটাতা ছিড়তে পারে। আপায় বললো, বই ফেরত নেওয়ার সময় দেইখা নিতে হয়।
করুণ চোখ করে ওসমান তাকায় রঞ্জুর দিকে। রানু তার সম্বন্ধে ভাবেটা কি? রানু যদি ওসমানের ১টি বইয়ের পাতা ছিঁড়ে ফেলে তো তাতে কি এসে যায়? রানুর কাছে ওসমান কি ১জন অতি সতর্ক, স্বার্থপর ও মালিকানা সচেতন ব্যক্তি?
খোলেন না’। রঞ্জু অধৈর্য হয়ে নিজেই চেয়ার ছেড়ে উঠে বিছানায় তার পাশে বসে পথের পাঁচালীর মাঝামাঝি খুলে ফেললে ওসমানের চোখে পড়ে রুলটানা কাগজের ছোটো ১টি টুকরা। সেখানে রানুর হাতের লেখা। ওসমান পর পর কয়েকটি টোক গেলে এবং হঠাৎভয়-পাওয়া ছেলের মতো রানুর লেখা চিরকুট ওভারটেক করে চোখ গুঁজে দিলো চিরকুটের নিচে বইয়ের মুদ্রিত লাইনগুলোর ওপর দুপুরে কেহ বাড়ি নাই, কৌটাটা হাতে লইয়া অন্যমনস্ক ভাবে দাঁড়াইয়া রহিল, বৈশাখ দুপুরের তপ্ত রৌদ্রভরা নিৰ্জ্জনতায় বাশবনের শনশন শব্দ অনেক দূরের বার্তার মত কানে আসে। আপন মনে বলিল-দিদি হতভাগী চুরি করে এনে ওই কলসীটার মধ্যে লুকিয়ে রেখে দিইছিলো !
কিন্তু দুর্গার সিঁদুর কৌটা চুরি আবিষ্কারের গ্লানি ও দুঃখ ওসমানকে একটুও আড়াল দেয় না; দুর্গার মতো বোন তার কোনোদিন ছিলো না বলে তার অকালমৃত্যুর শোক থেকে সে নিদারুণভাবে বঞ্চিত। রানুর চিরকুটটা তাকে পড়তেই হয়: বাড়িওয়ালা আজও এসেছিল। অব্বাকে দেখা করতে বলিয়াছে। আমার ভয় লাগে। কাহারও ইচ্ছা হইলে দায়িত্ব পালন করুক -পড়া শেষ হতে না হতে ওসমানের শরীরের রক্ত সব মাথায় ওঠে, মাথার করোটি ভেদ করে উপচে ছলকে পড়ার উপক্রম হয়। হয়তো তাই সামলাবার জন্যে মনোযোগ দেয় রানুর বানান ভুলে। রানুর বাক্যবিন্যাসের সাধু ও চলিত রীতির গোলমাল বড়ো প্রকট। অঙ্ক করাবার ফাঁকে ফাঁকে রানুর বাঙলাটাও দাখা দরকার। রানুর আঙুল ধরে ধরে তার বানান ঠিক করে দেবে। ওসমান এখনি নিজের হাতে রানুর কালো ও রোগা আঙুলের নরম স্পর্শ পাচ্ছে। শরীরের পুলকে এক পলকের জন্য চোখ বন্ধ করলে রানুর চোখের মণি ঝকঝক করে ওঠে। সেই ধারালো আভায় তার নিজের চোখের নিরাপত্তা বিঘ্নিত হতে পারে ভেৰে সঙ্গে সঙ্গে চোখ খুলে পাশে তাকায়, সেখানে রঞ্জুর মুখ। চট করে চোখ ফিরিয়ে নেয় রানুর চিঠিতে। ১বার ২বার ৩বার ৪বার ৫বার পড়তে পড়তে রানুর চোখ থেকে ধার-করাআলোতে উদ্ভাসিত তার চোখ দিয়ে শুষে নেওয়া হয় চিঠির আভা ৷ আভা মিলিয়ে গেলে পড়ে থাকে চিঠির ধড়, প্রাণহীন চিঠির লাশ বড়ো অস্বস্তিকর। রানুর এই চিঠি লেখার মানে কি? রানুকে তো ঘুণাক্ষরেও ওসমান কোনো দায়িত্ব নেওয়ার কথা বলেনি। তাহলে? রানু কি চায় যে বাবাকে বলে হার্ডওয়্যার, রেশন দোকান ও স্কুল ভেঙে তৈরি মার্কেটের মালিকের সঙ্গে তার বিয়েটা ওসমান ঠেকিয়ে দিক ? কোনো মেয়েকে তার ইচ্ছার বিরুদ্ধে বিয়ে দেওয়ার আয়োজন প্রতিহত করতে ওসমান সবসময় প্রস্তুত। বিশেষ করে সেই মেয়ে যদি তার সাহায্য চায় তো কথাই নাই, তার নিরাপত্তার জন্যে এগিয়ে না যাওয়া আর রায়টের সময় আক্রান্ত কোনো মহিলার আর্তনাদে সাড়া না দেওয়া একই ধরনের অপরাধ। কিন্তু রানু এখানে গোটা ব্যাপারটাকে প্যাচালো ও গোলমেলে করে ফেলছে। রামু যে শুধু একা বাঁচাতে চাইছে তা নয়। ওসমানের হাত ধরে হ্যাঁচকা টান দিচ্ছে। ওসমানকে সে পালাতে বাধ্য করতে চায়। ওসমান কোথেকে পালাবে? —কিংবা রানুকে নিয়ে কোথায় পালাবে? আর রানুকে নিয়ে পালাবে কিভাবে? সামনে, পেছনে, ডানদিকে সব গলি, সরু ও রোগ গলি। গলির মোড়ে মোড়ে ময়লা-উপচানো ডাস্টবিন, খোলা ম্যানহোল, নালায় থিকথিক করছে গুমুত গলির মাথায় মাথায় জড়ানো জাপটানো তারের জটওটায়ালা মাথার পোল থেকে ঝুলছে ইলেকট্রসিটির ছেঁড়া তার। আবার দাখো, বড়ো রাস্তায় ট্রাফিক জাম, রিকশায়, ট্রাকে, বাসে, স্কুটারে, ঠেলাগাড়িতে, কারে, হোণ্ডায়, সাইকেলে গেরো-লাগা জামের ভেতর চলা কি সোজা কাজ? আর শালা ট্রাফিক পুলিস কি-না তাকে দেখতে পেয়ে ট্রাফিক জাম ছাড়াবার কাজ বাদ দিয়ে, ট্রাক ড্রাইভারের কাছ থেকে ঘুষ নেওয়া স্থগিত রেখে বাশি বাজাতে বাজাতে এগিয়ে আসছে তারই দিকে। তার পিঠের ওপর রানুর জ্যান্ত ধড়, এই ধড় নিয়ে দৌড়বার গতি পাওয়া যায় না। এই বিছানা, এই চিলেকোঠার ঘর, এই বাড়ি থেকে দৌড়ে পালাবার জন্যে ওসমানের পায়ের পাতা কাপে ডান পাৰিছানা থেকে নিচে নামিয়ে দিলে সেটা মেঝে স্পর্শ করে ও সেখানেই একটু একটু দোলে। পায়ের দুলুনি স সা করে বাড়ে এবং ধাক্কা খায় রঞ্জুর বা পায়ের সঙ্গে। এমনি সাদামাটা করে বললে, তার ডান পায়ে সে মৃদু লাথি দিতে থাকে রঙ্কুর বা পায়ে। রঞ্ছ একটু সরে বসেও রেহাই পায় না, কারণ ওসমানের পায়ের কাপন বেড়েই চলে। এখন নিজের বা পাটি নামিয়ে দিলেই ওসমান ছুটে বেরিয়ে একটা দৌড় দিতে পারে বাইরে। রানু কিন্তু বুঝতেই পারবে না, ভো দৌড়ে ওসমান চলে যাবে, চলে যাবে তাদের কলপাড়ে। টিউবওয়েলের হ্যাঁণ্ডেল ধরে পাম্প করে কলসিতে পানি ভরছে আম্মা। কলপাড় পার হয়ে ছাইগাদার পাশে নেবুতলায় দাঁড়িয়ে সে ডাক শোনে, রঞ্জ রঞ্জ কিন্তু ওসমান দাঁড়াতে পাচ্ছে কৈ? তার পায়ে যেন পাল খাটানো হয়েছে, ডাঙার ওপর তরতর করে পা বেয়ে নিয়ে সে চলে বিলের কিনার ঘেঁষে, পার হয়ে যায় দীপচাদ মুচির বাড়ি, আরেকটু, আর একটুখানি গেলেই রেললাইন। রানু যে কখন খসে পড়েছে পিঠ থেকে ওসমান খেয়াল করেনি। দুর্গটিা থাকলে আজ একসঙ্গে রেলগাড়ি দাখা যেতো। অনেক দূর থেকে দুর্গা তাকে ডাকে, রঞ্জু! রঞ্জু!—দুর্গা? না আম্মা?—ওসমান বিড়বিড় করে সেই ঝাপশা ডাকের প্রতিধ্বনি করে, রঞ্জু! রঞ্জু!
জী? চেয়ার থেকে উঠে দাঁড়ায় রঞ্জু, ওসমানের দিকে বড়ো বড়ো চোখে তাকায়, কি হলো?
ওসমানও উঠে দাঁড়ালে রঞ্জ সিঁড়ির দিকের দরজায় সরে যায়, আমি এখন যাই। আপনি কিছু লেইখা দিবেন?
ওসমান হাঁপাতে হাঁপাতে বসে পড়ে, পরে। এ্যাঁ? পরে কেমন?

দরজা খুইলা ঘুমান? খিজির আলি ঘরে ঢুকলে ওসমান শুয়ে শুয়েই হাই তোলে, ‘ন’, ঘুমোলাম কোথায়? এতে রাত করলে যে?
পিয়ারু সর্দারের খবর জানেন? খুশি হয়ে খিজির জানায় পোস্তগোলার পিয়ারু সর্দার, ৫০/৫৫টা রিকশার মালিক, আজ মৌলিক গণতন্ত্রী পদ থেকে রিজাইন দিয়েছে, পোস্তগোলার মাঠে আজ সে মিটিং করলো। আলাউদ্দিন মিয়াও মিটিঙে ছিলো, তাকে বেবি ট্যাকসি চালিয়ে নিয়ে গিয়েছিলো খিজির নিজে। এখন আইয়ুব খানের দালালীতে একনিষ্ঠভাবে লেগে রয়েছে পুলের ওপার হাবিব ফকির আর এদিকে রহমতউল্লা। তা এদের আর বেশি দিন টিকতে হবে না। রহমতউল্লার অবস্থা পাগলা কুত্তার মতো, লোকজন দেখলেই খালি ঘেউঘেউ করে, আরে মিয়া মিলিটারির তো ডাণ্ড দ্যাহো নাই। মিলিটারি ভালো কইরা নামলে এইগুলি ফাল-পাড়া কৈ যাইবো, দেইখো।’ আজ সন্ধ্যার পর তার ব্লাড প্রেশার খুব বেড়ে গিয়েছিলো, আলাউদ্দিন মিয়া খোজ নিতে গেলে তার সঙ্গে ভালো করে কথাও বলেনি। খিজির বুঝতে পারে না, ঐ ইবলিসটার জন্যে আলাউদ্দিন মিয়ার এতো মাথাব্যথা কিসের? মহাজনের মেয়ে সিতারা তো আলাউদ্দিন মিয়ার হাতে চলেই এসেছে। এখন তার আর ভাবনা কি?-এমনকি সেদিন খিজিরকে দিয়ে আলাউদ্দিন মিয়া হীরা আওর পাথর ছবির টিকিট নিয়ে এলো। খিজির ছাড়া আর কেউ জানে না, ছবি দেখতে গিয়েছিলো আলাউদ্দিন মিয়া আর সিতারা। ওসমান কারো কাছে ফাস না করে তো খিজির একটা কথা বলে। কি? বেবি ট্যাকসি চালিয়ে ওদের মধুমিতা সিনেমায় নিয়ে গিয়েছিলো খিজির নিজে। হীরা আওর পাথর দ্যাখার মতো একটা বই বটে। জেবা-ওয়াহিদ মুরাদের অভিনয়, ৪বার দেখেও খিজিরের আশ মেটেনি।—ঐ ছবির কাহিনী বলতে বলতে খিজিরের স্বর ওঠানামা করে। হঠাৎ একেকটি রিকশা কি স্কুটর চলার আওয়াজে রাত বাড়ে কয়েক ধাপ করে। জেবা ও ওয়াহিদ মুরাদের পরিণতি শোনাবার আগেই খিজির ঘুমিয়ে পড়ে। তার বিড়ির আগুন জ্বলে না, তার নিশ্বাসের বাজনা ছাপিয়ে ওঠে ঘরের নীরবতা। ওসমানের বুক কাপে: হাড্‌ডি ব্যাটা কি ঘুমিয়ে পড়লো? এখন ছুটে বাইরে বেরুবার জন্য ওসমানের পাজোড়া যদি ফের কাপে তো কি হবে?

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *