1 of 2

চিলেকোঠার সেপাই – ৩৩

চিলেকোঠার সেপাই – ৩৩

মঞ্চ ছিলো পল্টন ময়দানের শেষ মাথায়। এদিকে স্টেডিয়ামের বারান্দায় পিলারের গায়ে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে সিগ্রেট ধরাবার জন্য দেশলাইয়ের বাক্সে কাঠি ঠুকলো ওসমান, সঙ্গে সঙ্গে মঞ্চের নিচে, ৫ কি ৬ হাত সামনে দপ করে আগুন জ্বলে উঠলো। ভারি চমৎকার তো! কি করে হলো? সিগ্রেট ফেলে দিয়ে ওসমান ছুটে চললো অগ্নিকুণ্ডের দিকে। তার জ্বালানো কাঠি থেকে অতোদূরে আগুন জুলবে, আর সে কি-না দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে সিগ্রেট ফুকবে এখানে? পায়ের আঙুলে চাপ দিয়ে একটু উঁচু হয়ে ওসমান দেখলো মঞ্চ থেকে আইয়ুব খানের বিশাল বপুটাকে ধরে ছুড়ে ফেলা হচ্ছে আগুনের কুণ্ডে। ভিড়ের ভেতর এগিয়ে যাওয়ার কায়দা ওসমানের বেশ রপ্ত করা আছে। এর কনুইতে একটু ধাক্কা দিয়ে, ওর পিঠ একটুখানি ঠেলে,আবার কখনো মঞ্চের দিকে প্রবাহিত কোনো জনস্রোতে গা ভাসিয়ে দিয়ে ২/৩ মিনিটের মধ্যে সে পৌঁছে যায় মঞ্চের সামনে। তার গায়ে আগুনের আঁচ লাগছে, কিন্তু আইয়ুব খানের দাহ দাখার স্পৃহায় সেটুকু সহ্য করতেই হবে। কিন্তু তার ভাগ্যটা খারাপ, আগুনে মুখ থুবড়ে-পড়া আইয়ুব খানের শরীর দেখতে পারলো কেবল পলকের জন্য। মঞ্চের ওপর থেকে এবং মঞ্চের পেছনে গ্যালারি থেকে ছুড়ে-ফেলা মোহাম্মদ আইয়ুব খানের ‘ফ্ৰেণ্ডস নট মাস্টাস বইয়ের ইংরেজি ও বাঙলা সংস্করণ শূন্যে ডিগবাজি খেয়ে পড়ে তার রচয়িতার পিঠের ওপর। নিজের লেখা বইয়ের। অজস্র কপির আড়ালে আইয়ুব খান অদৃশ্য হয়ে যায়। ফ্রেণ্ডস নট মাস্টার্স-এর সবুজ ও সাদা মলাট আইয়ুব খানের অগ্নিশয্যায় পাকিস্তানী পতাকার বিভ্রম তৈরি করে ডানা ঝাপটায়। তারপর প্রেসিডেন্টের বপুর সঙ্গে চড়চড় আওয়াজ করে পোড়ে। বই ছাড়াও কাগজ, ছেঁড়া কাপড়, পুরনোটায়ার, টুকরা কাঠ ও জুতাস্যাণ্ডেলের জ্বালানির নিচে ফিল্ড মার্শাল মোহাম্মদ আইয়ুব খান ক্ষীণ কণ্ঠে ঘেউঘেউ করে। কিন্তু তাকে দ্যাখা যায় না। দগ্ধ প্রেসিডেন্টকে এক নজর দাখার আশায় ওসমান এদিক ওদিক থেকে ঝোকে, ওদিক থেকে ঝোকে। ১বার তার পায়ের পাতার একটুখানি দাখা গেলো। আরেকটু ঘুরে সামনে গেলে আরো অঙ্গপ্রত্যঙ্গ। কিন্তু এই সময় তার পিঠে হাত পড়ে আলতাফের, এই ওসমান, ওসমান। আরে এতো কাছে চলে এসেছে ? আগুন ছড়িয়ে পড়লে মারা পড়বে।’
আগুন আর ছড়াবে কি করে? আইয়ুব খান পুড়ে শেষ। দেশলাইয়ের কাঠি জ্বালালাম কিন্তু আমি।
তাই নাকি? প্রথমে মশাল জ্বলিয়ে দেওয়া হয়েছিলো। আলতাফ তার হাত ধরে, চলো, মিটিং শেষ। চা খাবো।’
অনেক কষ্টে ভিড় ঠেলে স্টেডিয়ামের বারান্দায় পৌঁছে ফের ভিড় ঠেলতে হয়।
ইসলামিয়া রেস্টুরেন্টের মস্ত বড়ো ঘরটা লোকে ঠাসা। টেবিল ১টাও খালি নাই। যতো লোক বসে রয়েছে তার প্রায় দ্বিগুণ দাঁড়িয়ে রয়েছে চেয়ার খালি হওয়ার অপেক্ষায়। মাঝামাঝি ১টা টেবিল থেকে সিকানদার ডাকে, এই যে আলতাফ।
সিকানদারের সঙ্গে আলতাফ এবং ইফতিখারের সঙ্গে ওসমান চেয়ার ভাগাভাগি করে বসে। ওসমান বসেই খবর দেয়, আইয়ুব খানের ক্রিমেশন দেখলে না? এখন প্রেসিডেন্ট হবে কে?
আলতাফ রায় দিলো, পূর্ব পাকিস্তানে আইয়ুব খানের সম্পূর্ণ পতন হয়ে গেছে। ওর বই বোধহয় আর একটাও থাকলো না।
বই কি বলছো? পাকিস্তানের ফ্ল্যাগ জড়িয়ে ওকে পোড়ানো হলো। কেউ কেউ করে গোঙাচ্ছিলো।
শওকত হেসে ফেলে, আপনার কথা শুনে মনে হচ্ছে হি হাজ ফিজিক্যালি বিন বার্নট টু এ্যাঁশেস।
‘আরে তাই তো হলো! পুড়ে ছাই হবে না তো সোনার মূর্তিতে পরিণত হবে? আইয়ুব খানের শরীরের অঙ্গপ্রত্যঙ্গ পোড়াবার বিবরণ দেওয়ার উপক্রম করলে ওসমানকে থামিয়ে দেয় শওকত, আইয়ুব খানের বই পোড়াবার দরকার কি? হিজ বুক ডাজ নট রিপ্রেজেন্ট হিম। হি ইজ এ সাব-লিটারেট জেনর্যাল লাইক এনি অফ হিজ সাবঅর্ডিনেন্টস ইন দি আর্মি। বই লেখা তার কাজ নয়, এই বই লিখেছে আলতাফ গওহর।
আলতাফ সায় দিলে শওকত বলে, সিভিল সার্ভিসের লোকজন সব সময় ডিক্টেটরদের ডোমেস্টিক সার্ডেন্টের সার্ভিস দেয়। খোজ নিয়ে দ্যাখেন আইয়ুব খান হাগলে ছুচে দেয় কারা? আবার তাদের নিজেদের হোগাও সবসময় ক্লিন করে রাখতে হয়-।
‘কেন? সকলের হাসির হুল্লোড়ে সিকানদার এই প্রশ্ন করে। হাসে না কেবল ওসমান। পুড়িয়ে ফেলার পর আইয়ুব খানের মলত্যাগ এবং সিভিল সার্ভেন্টদের দিয়ে শৌচকার্য করিয়ে নেওয়া তার কাছে বাহুল্য মনে হয়। মহা উৎসাহে সিকানদারের প্রশ্নের জবাব দেয় শওকত, দে হ্যাঁভ টু রিমেইন অলওয়েজ প্রিপেয়ারড টু গেট ফাকড় বাই দেয়ার মাস্টার এ্যাঁণ্ড দ্য মাস্টার মে রিফিউজ এ ডার্টি এ্যাঁনাস!
সবাই দ্বিগুণ তিনগুণ বেগে হাসে। শওকত হাসতে হাসতেই আলতাফকে বলে, যেসব বাঙালি ব্যুরোক্র্যাটের ওপর আপনারা ডিপেন্ড করছেন তারাও কিন্তু একসেপশন নয়।
আমরা নির্ভর করি পিপলের ওপর, সব বাঙালি আমাদের সঙ্গে আছে। বিশেষভাবে বাঙালি সার্ভেন্টরা, আর্মির প্রোমোশন-না পাওয়া-। সবাই। শোষিত বাঙালি মাত্রেই আমাদের সঙ্গে থাকবে। আগরতলা মামলা সাজিয়ে আইয়ুব খান বাঙালি রাজনৈতিক নেতৃত্বের পেছনে সিভিল সার্ভিস, আর্মি, নেডি, এয়ার ফোর্সের লোকজন-সবাইকে ঐক্যবদ্ধ হতে বাধ্য করলো। এই মামলা উইথড্র করতেই হবে, তখন কি নেতাকে এরা অস্বীকার করতে পারবে?
‘আগরতলা উইথড্র করা অসম্ভব। আর্মি টলারেট করবে না।’ আর্মির চেয়ে পিপল অনেক শক্তিশালী।’ আগরতলা উইথড্র করলে আর্মি আইয়ুব খানকে সরিয়ে দেবে। ওসমান এই সুযোগট নেয়, আরে আইয়ুব খানকে তো পুড়িয়ে মারা হলো। কিন্তু তার বিবৃতিতে পাত্তা না দিয়ে আলতাফ জবাব দেয় শওকতের কথার, মানুষ যেভাবে আগুন হয়ে আছে তাতে শেখ সাহেবকে রিলিজ না করলে সিচুয়েশন নর্মাল করা অসম্ভব।
তাহলে তাকে রিলিজ করে মানুষকে ঠাণ্ড করে মার্শাল ল ইমপোজ করতে পারে। আর্মি তখন আগরতলা উইথড্রলের কমপেনসেশন করবে ইন দেয়ার ওন ওয়ে। তখন রেসিস্ট করতে পারবেন?
নিশ্চয়ই। শেখ সাহেব বেরিয়ে এলে আন্দোলন আরো স্পষ্ট পথে, স্পষ্ট গন্তব্য ধরে চলবে। শুধু এজিটেটরদের দিয়ে আন্দোলন চলে না। নেতার হাতেই আন্দোলন সুনির্দিষ্ট লক্ষ্যে চলতে পারে।’
শোনেন আলতাফ, শেখ সাহেব সবচেয়ে পপুলার নেতা, দেয়ার ইজ নো ডাউট এ্যাঁবাউট ইট। কিন্তু তার যে ধরনের পার্সোনালিটি, যে ধরনের পলিটিক্যাল ফেইথ এ্যাঁন্ড ব্যাকগ্রাউন্ড,—তা কি এই মুভমেন্টের লিডারশিপের জন্য এ্যাঁডেকুয়েট? সংগঠন আছে না? আমাদের মতো সংগঠন আর কি আছে, বলেন? কিন্তু আপনাদের সংগঠনের ক্যারেক্টার আর এই মুভমেন্টের ক্যারেক্টার আলাদা। দ্যাখা যাক। পিপল শেষ পর্যন্ত কাঁদের নেতৃত্ব মেনে নেয়। দেখবেন শেষ পর্যন্ত কে টেকে!’
আপনারা যদি টেকেন তো ওনলি এ্যাঁট দ্য কস্ট অব দ্য মুভমেন্ট। মুভমেন্টটাও নষ্ট হবে, আর্মি তখন আপনাদের শেষ করবে।’
অতো সোজা?’ এবার ওসমান তার প্রত্যক্ষ পর্যবেক্ষণ প্রকাশ করার জন্য আরেকটি উদ্যোগ নেয়, আইয়ুব খানকে যেভাবে জ্যান্ত পোড়ানো হলো তাতে এই আন্দোলন নষ্ট করা– ‘
‘আরে রাখেন। শওকত বিরক্ত হয়ে বলে, কয়েকটা বই পোড়ালে আইয়ুব খান মরে না। আইয়ুব খান গেলে আরেক আইয়ুব খান আসবে। ওয়েস্ট পাকিস্তানের সব আইয়ুব খানকে শেষ করলে বাঙালিদের মধ্যে নতুন আইয়ুব খান এমার্জ করবে।’
অফিসে পরদিন কামালকে একা পেয়ে ওসমান কথাটা তুলতে গেলো, কাল পল্টনের মিটিঙে গেলেন না? স্টেজের সামনে আইয়ুব খানকে পোড়ানো হলো, দেখতে পারলেন না? আমি দেশলাইয়ের কাঠ জ্বালালাম—। কামালের সামনে খবরের কাগজ, কাগজের প্রথম পৃষ্ঠায় ছাপা ছবি দেখিয়ে বলে, ‘হ্যাঁ, ফ্রেণ্ডস নট মাস্টার্সের মেলা কপি পোড়ানো হলো। আগে থেকে জানলে অফিসের কপিগুলো নিয়ে যেতাম। গতবার অফিসে পঞ্চাশ কপি কেন হলো না?
আরে না। বই না। আমি নিজে দেখলাম পাকিস্তানের ফ্ল্যাগ জড়িয়ে আইয়ুব খানের বডি আগুনে ছুড়ে ফেলা হলো।’
কামাল তার পাশে এসে দাঁড়ায়, আপনার শরীর খারাপ? আপনার চোখ এতো লাল কেন? রাত্রে ঘুম হয়নি?
ওসমান গতকালের দৃশ্য আরো বিশদ ব্যাখ্যা করতো, কিন্তু এর মধ্যে বসের ঘর থেকে কামালের ডাক আসে।
দুপুরবেলা খেয়েদেয়ে ঘরে ফেরার কিছুক্ষণ পর আসে রানু। আইয়ুব খানের খবরটা রানু বোধহয় জানে না। ওসমান কিছু বলার আগেই রানু জানায় যে সে ২টো খবর দিতে এসেছে। কাল বিকালবেলা বাড়িঅলা আসছিলো। আপনারে দ্যাখা করতে বলছে।
কি খবর বলো তো? কাল রাত্রে ফেরার সময় রাস্তায় তোতামিয়াও বললো। ব্যাপার কি?
রানু এবার দ্বিতীয় খবরটি বলে, আর ঐ যে আপনার সঙ্গে থাকে, রিকশাআলা, সে বইলা গেলো আজ বিকালে নাকি মিটিং। পাকিস্তান মাঠে মিটিং? পাকিস্তান মাঠ কোথায়?
আলাউদ্দিন মিয়া নাকি আপনারে মিটিঙে যাইতে বলছে। কিসের মিটিং? আচ্ছা পাকিস্তান মাঠ আর্মানিটোলায় না?
পাকিস্তান মাঠ আগা সাদেক রোডে। মিটিঙের কথা অবশ্য আলতাফও বলেছিলো- কিন্তু মিটিংসম্বন্ধে রানুর আগ্রহ নাই। সে নতুন প্রশ্ন করে, আচ্ছা, ঐ লোকটা, খিজির না মিজির, ও কি আপনার সঙ্গে সবসময় থাকবে?
কেন? খিজির সম্বন্ধে রানুর ওরকম তুচ্ছ করে কথা বলা ওসমানের কানে লাগে, কেন? ও তোমার কি ক্ষতি করলো?
আমার কি করবে? কিন্তু বাড়িআলা দেখলাম ওর উপরে খুব চেতা। ও নাকি পাকা চোর বাড়িআলার গ্যারেজে কাজ করতো, রিকশার পার্টস চুরি করলে বাড়িআলাওকে বার কইরা দিছে তো উঠছে আলাউদ্দিন মিয়ার গ্যারেজে। আবার আলাউদ্দিন মিয়ার স্কুটার বলে কারে বেইচা দিছে, তার ওখান থাইকা উঠছে আপনার ঘরে! বাড়িআলা বলে-।
বাড়িওয়ালা কি আমাকে ওয়ার্নিং দিতে এসেছিলো? শোনো, বাড়িওয়ালার তেজ আর বেশিদিন নেই। বাড়িওয়ালার যে বাপ, আরে বাপ কি?-বাপের বাপ, বাপের বাপের বাপ,- এই মেয়েটির কাছে আইয়ুব খানকে জীবন্ত দগ্ধ করার বিবরণ দিতে পারলে ভালো হয়, ঘটনাটিকে সে রূপক হিসাবে নেবে না, জলজ্যান্ত ঘটনা বলে বিশ্বাস করবে, গতকাল পল্টনের মিটিঙে আইয়ুব খানকে জ্যান্ত ধরে আগুনে পোড়ানো হলো। একেবারে ছাই হয়ে গেছে। আইয়ুব খানের দাহ আজ উদযাপন করা হবে পাকিস্তান মাঠে।
রানু তার বিবৃতিকে রূপক অর্থে নেয় না, আবার কোনো গুরুত্বও দেয় না। আঃ! আপনি চটেন কেন? আপনার সম্বন্ধে বরং ভালো ভালো কথা বললো, বলে, ওসমান সায়েব খুব ভদ্রলোক মানুষ, খিজিররে তাই না করতে পারে নাই। আমি শুইনা মনে মনে হাসি।
ওসমান খুব ভদ্রলোক-এই কথায় রানু হাসে কেন? ওসমানের কোনো আচরণে কি কোনোদিন অশোভন কোনো কিছু সে লক্ষ করেছে? নাকি তার ধারণা যে ওসমান ভদ্রতার ভাণ করে, আসলে সে পাকা শয়তান? ওসমানের স্বভাবে হিপ’ক্র্যাসির আবিষ্কার কি রানুর মনে মনে হাসার কারণ?
বাড়িওয়ালা তোমাদের বাসায় এসেছিলো কেন? ভাড়া বাড়াতে চায় নাকি? না, না। এই প্রথম দেখলাম বাড়ি ভাড়ার তুলনায় মিউনিসিপ্যালিটির ট্যাক্স বেশি বইলা হায় হায় করলো না। রাত্রে স্বপ্লে নাকি ভাইয়ারে দেখছে! তাই আব্বার সঙ্গে দ্যাখা করতে আসছিলো। কয়, কয়টা অসৎ লিডারের পাল্লায় পইড়া দেশের জুয়েল জুয়েল ছেলেগুলি স্পয়েল হইতাছে। কয়, দ্যাখেন মরেও ভালোগুলি। কয়, চালাকগুলি মিটিঙে যায়, মিছিলে যায়, কিন্তু সেইগুলি মরে না। তাদের কিছু হয় না। ভাইয়ার কথা কয়, মরে খালি তালেবের মতো নিরীহ সাদাসিধা পোলাপান।
ওসমান আড়চোখে রানুর মুখ দ্যাখে। কথাগুলো কি বাড়িওয়ালার? নাকি ওসমান সম্বন্ধে নিজের মন্তব্য রানু সেট করে দিচ্ছে রহমতউল্লার মুখে। রানু কি তাকে খুব সতর্ক ও ভীতু গোছের মানুষ বলে গণ্য করে?-আজ, আজ নয় কাল-নাকি পরশু?-ওসমান যে দেশলাইয়ের কাঠি ঠুকে অগ্নিকুণ্ডতৈরি করলো, সেখানে জ্যান্ত পুড়িয়ে মারা হলো পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট ফিল্ড মার্শাল মোহাম্মদ আইয়ুব খানকে,—সে কথা রানুকে বিশ্বাস করাবে সে কি করে? অকপটতা, মনোবল ও আন্তরিকতাকে আরু তালেবের মৃত্যুর কারণ ভেবে রানু তার সঙ্গে তুলনা করছে ওসমানের। ওসমান জানে যে তার মুখ দেখে রানু এইসব ভুল ধারণা করে বসে আছে। নাকি এটাই ঠিক? তার স্বভাবে তেজের অভাব বোধহয় তার মুখে স্পষ্ট ফুটে উঠে। তাহলে আইয়ুব খানকে জ্যান্ত পোড়াবার অগ্নিকুণ্ডে সে প্রথম কাঠিটি ছুড়লো কি করে? সে বোধহয় ছোড়েনি। তাহলে কে ছুড়লো। ঠিক খবরটা দিতে পারবে কে? শওকত ছিলো, আলতাফ ছিলো, ইফতিখার ছিলো, সিকানদার ছিলো,-এদের কারো সঙ্গে দ্যাখা হলে জিগ্যেস করলেই তারা আসল তথ্য জানিয়ে দেবে। তাহলে তো একবার বাইরে যাওয়া দরকার। ঠিকঠাক জেনে এসে রানুকে বেশ বুক ফুলিয়ে বলা যায়, ‘আইয়ুব খানকে জ্যান্ত পুড়িয়ে মারার মূলে কে, বলোতো রানু?—রানু বিবেচনা করে দেখতে পারে, পুলিসের গুলিতে নিহত হলেই কেউ উন্নত স্তরের জীবে রূপান্তরিত হয় না। তালেব কি খুব বীরপুরুষ ছিলো? দূর। সে মিছিলে গেছে হুজুগে মেতে নীলখেতের মোড়ে গুলিবর্ষণ শুরু হলে বোকার মতো দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে শ্লোগান দিয়েছে। তালেব তো কিছুদিন পাগলও ছিলো। অস্বাভাবিক প্রকৃতির বিকৃতমস্তিষ্ক এক যুবক প্রকৃত পরিস্থিতি উপলব্ধি করতে ব্যর্থ হওয়ায় পুলিসের হাতে মারা পড়েছে; এতে তার ছোটবোনের গর্ব করার কি হলো?—আবু তালেবকে পাগল বিবেচনা করে একটু চাঙা হতে না হতেই ওসমানের ভুলটা ভাঙে। নাঃ! পাগল হলে তালেব ওয়াপদায় চাকরি করতো কি করে? অবশ্য চাকরি ও মানসিক সুস্থতা অবিচ্ছেদ্য নয়, মানসিক সুস্থতা চাকরির কোনো শর্ত নয়। তবে পাড়ার লোকে কেউ বলেনি যে তালেবের কোনোরকম অস্বাভাবিকতা কোনোদিন লক্ষ করা গেছে। নাঃ! ওসমান একটি দীর্ঘশ্বাস চাপে, জন্ম থেকে মৃত্যু পর্যন্ত আরু তালেব সম্পূর্ণ সুস্থ মানুষ ছিলো। কিন্তু যাই হোক না কেন, রানু কি তার নিহত ভাইকে সামনে রেখে পৃথিবীর যাবতীয় পুরুষমানুষকে বিচার করবে? তাহলে তো শহীদ ছাড়া কাউকে তার পছন্দ হবে না। পুলিস-মিলিটারির গুলিতে শহীদের বৌ হিসাবে নিজেকে কল্পনা করে রানু কি খুব সুখ পায়?-ওসমান হেসে ফেললে রানু বলে, কি, হাসেন কেন?
‘এমনি। বাড়িআলা প্রশংসা করছে শুইনা খুব খুশি, না? রানুও হাসে, যান, বাড়িআলার সাথে আজ দ্যাখা করেন। কয়, আপনে নাকি রাগ করতে জানেন না? মুরুব্বি দেখলেই সালাম দেন, মাথা নিচা কইরা হঁটেন। দেখবেন, চোখ নিচের দিকে থাকলে সামনে কিছু দেখতে পারবেন না, কোনদিন গাড়ির তলায় চাপা পড়বেন!’
রানুর এই বিরামহীন সংলাপ হাসির কুচিতে খচখচ করে। প্রত্যেকটি কুচি ওসমানের কানে বেঁধে এবং তা অনূদিত হয় এইভাবে: তুমি শালা একটা মেরুদণ্ডহীন হিপ’ক্র্যাট। তোমার উচিত বাড়িওয়ালার সঙ্গে লাইন করা। রানু বলে, আপনারে যেমন পছন্দ, মনে হয় বাড়িআলা আপনের সঙ্গে সম্বন্ধ করতে চায়!
সম্বন্ধ? কিসের সম্বন্ধ? সম্বন্ধ বোঝেন না? ঢঙ করেন, না? বাড়িআলার মেয়ে আছে না একটা? খুব সুন্দর! গাড়ি পাইবেন, টেলিভিশন পাইবেন। বাড়ি তো আছেই!
রাজত্ব ও রাজকন্যা একসঙ্গে? ‘তো কি? ছেলেরা আবার কি চায়? গাড়ি না দেয়, রিকশা তো আছে! রিকশা ভরা গ্যারেজ পাইবেন! রানুর ঠোঁটের দুই কোণ সঙ্কুচিত হয়, রিকশার কথা বলার সময় জিভের তেতো ধাক্কায় শব্দগুলো বেশিরকম স্পষ্ট। ওসমান বলতে চাইলো, অনিশ্চিত রাজকন্যার আশায় থেকে নিশ্চিত রাজকন্যাটিকে সে হারাতে রাজি নয়।-কিন্তু ডায়ালগটি কিভাবে ছাড়বে তাই ঠিক করার আগেই রানু হঠাৎ দাঁড়ায় এবং তার চোখে চোখ রেখে বলে, আপনারা, আপনারা, আপনারা না-বাক্য স্থগিত রেখে সে মুখ ফেরায় অন্যদিকে। ফলে দ্যাখা যাচ্ছে তার প্রোফাইল। প্রোফাইলে রানু সবসময় বেটার, কিন্তু এখন তাকে অপরিচিত কোনো মেয়ের মতো লাগছে। ওসমানের খুব পিপাসা পায়, কিন্তু রানুর ঠোঁটের ওপরকার ভাঁজ ও নাকের ডগায় ঘামের বিন্দু এক ফোটা জমেনি। পিপাসায় ওসমানের গলা শুকিয়ে আসে, ভাবে কুজো থেকে পানি ঢেলে খেয়ে নেবে। কিন্তু রানুকে ডিঙিয়ে যায় কিভাবে? বিশেষ করে রানুর ঠোঁটজোড়া যেভাবে কাঁপছে তাতে একটা দুর্ঘটনা পর্যন্ত ঘটে যেতে পারে। তার সেকেন্ড ব্র্যাকেট মার্কা ঠোঁট কাঁপতে কাঁপতে হাল্কা বেগুনি থেকে গাঢ় বেগুনি হয়। রানুর ডান চোখের কোণে পানির ফোটা টলটল করে। নুন মেশানো হাল্কা ঘোলাটে পানির বিন্দুটা পড়ে গেলে মুখের ব্যালান্স নষ্ট হতে পারে,-ওসমান এরকম ভয় করতে করতে রানু তার বাক্য সম্পূর্ণ করে, আপনার না সব পারেন। সব পারেন। চোখের নোনতা শিশিরবিন্দু তার টলে পড়েছে, ডান গালে সরু রেখায় প্রবাহিত হয়ে মিলিত হয়েছে চিবুকের ভৌলে। নোনতা ও ঈষৎ ঘোলা শিশিরের রোগা স্রোতে চুমুক দেওয়ার জন্য ওসমানের খটখটে ঠোঁট, জিভ ও টাকরা তিরতির করে কাপে। ওসমান হঠাৎ করে নিশ্চিত হলো যে আইয়ুব খানকে দগ্ধ করার জন্য তৈরি অগ্নিকুণ্ডে সে একটি জ্বলন্ত কাঠি ফেলেছিলো। খবরটা রানুকে এক্ষুনি দেওয়া দরকার। ওসমান দাঁড়িয়ে রানুর মাথার ওপর ও ঘাড়ে তার হাত রাখলে হাল্কা করে। কথা বলার আগে রানুকে আরেকটু কাছে টানে, একটি তীব্র চুমুতে তার গালের চোখের ও চিবুকের নোনা পানি সবটা শুষে নেবে। কিন্তু রানুর মাথার চুলের কাটা ওসমানের বুকের বাদিকে একটু একটু খোঁচা দিচ্ছে। এটা আবার এ্যাঁসিডিটির ব্যথা নয় তো? দুপুরবেলা খালি পেটে কাপের পর কাপ চা এবং ১টির পর ১টি সিগ্রেট খেলে এই জায়গাটার নিচে চিনচিন করে ব্যথা করে। ঘন্টাখানেক আগে ভরপেট খেয়ে এসেছে বলে সেই ব্যথা কি আরো ওপরে উঠে এলো? ঘরে এ্যাঁন্টাসিড ট্যাবলেট নাই, বেরিয়েই দুটো মেরে দেবে। কিন্তু তার নিজের ঘর থেকে তাকে এখন উদ্ধার করে কে? সে বিড়বিড় করে, একেবারে পাগল! ভাইটা ছিলো আস্ত পাগল, বোনটাও তাই।’
আবু তালেবকে ঘোরতর উন্মাদ বলে ঘোষণা করে ওসমান লঘুভার হয়। নিশ্চিন্ত মনে রানুকে চুমু খাবে বলে ওর গোটা মুখ জড়িয়ে ধরার জন্য ওসমান নিজের আঙুলগুলোকে তৈরি করতে করতেই তার হাতের ফাঁক দিয়ে মাথা গলিয়ে রানু ঘর থেকে ছিটকে বেরিয়ে যায়।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *