1 of 2

চিলেকোঠার সেপাই – ৩০

চিলেকোঠার সেপাই – ৩০

এখন পর্যন্ত পচার বাপের কোনো খবর নাই। গোরু নিয়ে হেঁটে রওয়ানা হলেও ৪টে চর ও ৩টে খেয়ানৌকা পার হতে দেড় দিনের বেশি সময় লাগার কথা নয়।
জালাল মাস্টার বলে, তোমরা রাস্তায় তাকে দ্যাখো নাই? না। আনোয়ার ও করমালি তো এসেছে রাত্রে, রাত্রিবেলা কি দেখবে? তাদের রাস্তাও ছিলো আলাদা। হঠাৎ মুখ খোলে নবেজউদ্দিন, চাচামিয়াকে অরা অশিদ দিছিলো? কিসের রশিদ?-নবেজউদ্দিন কথা বলে কম, এতো লোকের সামনে কিছু বলা তার পক্ষে আরে৷ কঠিন। সবাই মিলে তার ওপর হামলে পড়লে সে জানাতে বাধ্য হয় যে জরিমান নিয়ে গোরু ফেরত দেওয়ার সময় হোসেন ফকির একটা কাগজে সই করে, সেই কাগজে কিসব লেখা থাকে। সেটাই হলো হোসেন আলির দেওয়া ছাড়পত্র। চরের মাঝে মাঝে কয়েকটা চেকপোস্ট বসানো হয়েছে, পশ্চিমে আসার পথে প্রধান চেকপোস্টটি চালুয়াবাড়ি খেয়া-ঘাটের পোয়া মাইল দক্ষিণে। রশিদ দ্যাখাতে না পারলে ওরা ধরে নেয় যে এই গোরু হোসেন আলির বাথান থেকে চুরি-করা। গোরু কেড়ে নিয়ে তখন ওদের নিয়ম মতো শাস্তি দেয়।
আনোয়ারের মনে পড়ে, তাইতো হোসেন ফকির বলছিলো সম্পূর্ণ জরিমান না দিলে রশিদ দেওয়া হয় না। তবে পচার বাপ রশিদ নিলো কি-না খেয়াল করিনি।’
নবেজউদ্দিন অবাক হয়, জরিমানা ব্যামাক না নিয়াই গোরু দিলো? জালাল মাস্টার মাথা নাড়ে, রশিদ নেওয়া উচিত ছিলো।
কিসের রশিদ?’ করমালি তার বাড়ির ভেতর থেকে পান এনে সকলের সামনে রাখে। শালা মনে হয় তশীলদার হছে। গোরুচোরের অশিদ নেওয়া লাগবো কিসক? পুবের মানুষ সব খাড়া হয় আছে, পশ্চিম থাকা হামরা একবার যাই তো পুবের মানষের সাথে একত্তর হয়া হোসেন ফকিরের গুষ্টি সাফ করা হবো। কি কন আনোয়ার ভাই?
কিন্তু কথাটা আনোয়ার কিভাবে পাড়বে বুঝতে পাচ্ছে না। ভোরবেলা বাড়ি পৌঁছে চেংটুকে সব বলা হয়েছে, মনে হয় তার কাছে আলিবক্স খবর পাঠিয়েছে আগেই। দুপুরে খাওয়া দাওয়ার পর করমালির বাড়ির সামনে জালাল মাস্টারের চাষের জমিতে মিলিত হওয়ার বুদ্ধি চেষ্ট্রর, এখানে প্রায় ২৫/৩০ জন লোক এসেছে তারই কথায়। কিন্তু জালালউদ্দিনকে আসতে বললো কেন? আজ রাত্রে এতোগুলো মানুষের ধারাবর্ষ যাত্রার প্রস্তাব জালাল মাস্টার নাকচ করলে এদের সবাইকে রাজি করানো মুশকিল হবে। লোকটাকে এরা সবাই মানে।
হামরা ইগল্যান বুঝি। হঠাৎ করে উঠে দাঁড়ায় বাদু শেখ, তাই পাদে, তাই কোতে, গুছিটায় কলাপাতে। প্রবাদটি ব্যাখ্যাও করে সে, হাগে খয়বার গাজী, গু ছিটায় হোসেন আলি। ধরলে দুয়োটাকই ধরা লাগে।
নাদু পরামাণিক প্রতিবাদ করে, খয়বার গাজী থাকে এটি, আর চর হলো তোমার পাঁচ ছয় কোশ ভটিত। আসুন্দা কথা কস কিসক?
এই সময় কাঁদতে কাঁদতে আসে ১১/১২ বছরের ১টি ছেলে। ময়লা গেঞ্জি গায়ে, গেঞ্জিটা তার চেয়ে দ্বিগুণ বয়সের লোক পরলে ফিট করতো। ছেলেটির সবুজ ডোর-কাটা লুঙি হাঁটুর কাছে তোলা। চোখের পানিতে তার খড়ি-ওঠা কালো গালে কাদার পলেস্তারা পড়েছে। এ হলো পচার বাপের নাতি, পচার ৩ কি ৪ নম্বর পয়দা। নোনা পানিতে জড়ানো বিলাপ থেকে তার দুঃখের কারণ বোঝা কঠিন। মনোযোগ দিয়ে তার বিলাপ ও বাক্য শুনে করমালি চিৎকার করে, ‘কি কস? কেডা কলো? তাঁই কোটে? করমালি চিৎকার করে কাঁদতে কাঁদতে পচার বাপের বাড়ির দিকে যায় এবং তাকে অনুসরণ করে জমায়েতের আর্ধেক লোক। কয়েক মিনিটের মধ্যে চেষ্ট্র গিয়ে তাকে নিয়ে আসে। কি খবর?-পচার সম্বন্ধী তার জামাইকে দিয়ে খবর পাঠিয়েছে যে চালুয়াবাড়ি চরে কাশবনের ভেতর পড়ে রয়েছে পচার বাপের লাশ। পচার সম্বন্ধীর জামাইকেও চেষ্ট্র ধরে এনেছে। এতোগুলো মানুষের সমবেত জেরার জবাবে সে জানায় যে গতকাল তার শ্বশুর গিয়েছিলো চালুয়াবাড়ি হাট, নৌকা থেকে পচার বাপের লাশ দেখে ভয়ে বাড়ি ফিরে তাকে পাঠিয়ে দিয়েছে।
করমালি কাঁদে আর হায় হায় করে, পচার বাপের বাড়িতে সাবালক পুরুষমানুষ কেউ নাই। পচা তার জোয়ান ছেলেকে নিয়ে গেছে পশ্চিমে, খিয়ার অঞ্চলে। সে কি এখানে? বাঙালি নদী পেরিয়ে ৭ ক্রোশ পথ হেঁটে করতোয়া, করতোয়ার ওপার বগুড়া থেকে ট্রেন চেপে যেতে হয়। তালোড়াও যেতে পারে, কাহালুও যেতে পারে। এমন কি দুপচাচিয়৷ আদমদিঘিও হতে পারে। খিয়ার এলাকায় এখন ধান কাটার ধুম। ১০/১৫ দিন আগে তার এামে ফেরার কোনো সম্ভাবনা নাই। এখন খরচাপাতি করে কে? করমালির ঘরে কাল সকালের ভাত পর্যন্ত নাই। বাশের খুঁটি কেটে পচার বাপ তার সারা জীবনের সঞ্চয় সব নিয়ে গেলো গোরু খালাস করতে। তার পয়সা বেশির ভাগই বেঁচে গেলো, কিন্তু ভোগে লাগলো না। কোমরের টাকার খুতি কি লাশের সঙ্গে গাথা থাকবে?
অতো চিন্তা করিস কেন? জালাল মাস্টার ধরা গলায় আশ্বাস দেয়, আমরা কি জীবিত নাই? পচার বাপ তোর জ্যাঠা হয়, আমার কি কেউ নয়? সে কি দীর্ঘকাল আমার জমি বর্গাচাষ করে নাই? এখন লাশ আনার বন্দোবস্ত করা লাগে। মোসলমানের লাশ, মাটির মধ্যে না যাওয়া পর্যন্ত তার উপরে আজাব হবে। জালালউদ্দিনের আশ্বাসবাণী শুনে করমালি গলা ছেড়ে কাঁদে, ও জ্যাটো! জ্যাটো গো! ডাকাতগোরে ঘর থাকা তুমি গোরু আনবার গেলা কিসক গো? তার এই প্রশ্নবোধক বিলাপে ওদিকে তার বাপের ঘর ও পচার ঘরে প্রবলরকম কোলাহল শুরু হয়। হাত ও পাছায় ভর করে ছেচড়ে ছেচড়ে, প্রায় গড়িয়ে চলে আসে করমালির বাপ। বাতে পঙ্গু লোকটি খুব শব্দ করে কাদতেও পারে না, কেবল ইনিয়ে বিনিয়ে বিলাপ করে। নিহত ভাইয়ের সঙ্গে তার সম্পর্ক অনেকদিন থেকে খারাপ। তার বিলাপেও এই তথ্য উপস্থিত। যেমন তাদের বাপ মরলে তার জমির ১০ আনা ভাগ দখল করে নেয় পচার বাপ। এই নিয়ে মামলা করতে গিয়ে তার ২১ শতাংশ জমি বিক্রি করে করমালির বাপ আজ নিঃস্ব চাষা। নামমাত্র দামে তার সব জমি কিনে নিলো আফসার গাজী। আবার মামলায় পচার বাপকে সাহায্য করে খয়বার গাজী। বগুড়ার হামিদ মুক্তারের কাছে এমনকি চিঠিও নাকি দিয়েছিলো পচার বাপের কাছ থেকে কম পয়সা নেওয়ার অনুরোধ জানিয়ে। ফ্যাসফ্যাসে গলায় করমালির বাপ বিলাপ করে, মিয়াভাই গো! খয়বার গাজীর বুদ্ধি নিয়া হামার সৰ্ব্বোনাশ করল্যা, আবার তারই মানষের হাতোত তুমি জান দিলা গো! আনোয়ার উসখুস করে, আজকের দিনটা করমালির বাপ এইসব প্রসঙ্গ না তুললেই পারে। আবার দ্যাখো, করমালির মামা মন্তাজ কানা সায় দেয় ভগ্নীপতির কথায়, মানুষটা বড়ো ভয়পাদুরা আছিলো গো। গাজীগোরে কাকো দেখলে তাই ভয়ে সিটকা লাগছে, আবার তাই মরে খয়বার গাজীর ইশারায়! এই ধরনের কথাবার্তা জালালউদ্দিন পছন্দ করে না, আন্দাজে কথা কওয়া কি ভালো? খয়বার মিয়ার হাত আছে, তুমি জানো ? সে পরামর্শ দেয়, থানায় একটা এজাহার করা লাগে, আজই করলে ভালো হয়।
থানা পুলিস সব খয়বার গাজীর খুতির মদ্যে। বান্দু শেখ পুলিস সম্বন্ধে তার মতামত জানালে জালালউদ্দিন নতুন পথ খোজে, তাহলে ডিসি সায়েবের বরাবর একটা পিটিশন করা হোক। পিটিশনের কপি দেওয়া লাগবো এসপি সায়েবের কাছে। এসপি সায়েবের অফিসের হেড ক্লার্ক আফাজ মিয়া আমার ছাত্র না হলেও তমিজের ভায়রা ভাই। তমিজ আমার সাক্ষাৎ ছাত্র, এখনো দ্যাখা হলে পায়ে হাত দিয়া সালাম করে।’
প্রাক্তন ছাত্রদের মধ্যে জালালউদিনের প্রভাব প্রতিপত্তির বর্ণনা থামিয়ে দেয় কানা মন্তাজ, উগলান সবই খয়বার গাজীর কেনা।
মারলে খয়বার গাজীর মানষেই মারছে। হোসেন অলিও তো তারই চাকরি করে।’ চেন্টুর কথা থেকে মনে হয় এই ব্যাপারে সে একেবারে নিশ্চিত, এখন সোগলির যাওয়া লাগে চালুয়াবাড়ি। সোগলি না গেলে চাচার লাশ দিবো না
চলো, আর বুদ্ধি নাই, চলো।’ চেংটু হাত তুলে সবাইকে থামায়, ‘পদুমশহর, কর্ণিবাড়ি, দরগাতলাত খবর দেওয়া হছে। জোড়গাছাত খবর দিবো বান্দু, ঘাটাল থাকা নাও নিয়া আসবো কাবেজ। পচার বাপের লাশ না পাওয়া গেলে যাওয়া লাগবো ধারাবর্ষা। হোসেন ফকিরের সাথে বোঝপড়া হবো। চলো!
সবাই হৈ চৈ করে ওটে, চলো। লাঠি সড়কি নেওয়া লাগবে না? লাগবো না? দাও কুড়াল লাঠি সড়কি বল্লা বাটি-যাই যা পারো ন্যাও। ‘হোসেন ফকিরেব নিৰ্ব্বংশ করো’ , উত্তেজিত শব্দমালা ক্রমেই তেজী ও দ্রুত হয়। জালালউদ্দিন ভয় পায়, এই মূখদের কাণ্ডজ্ঞানের বড়ো অভাব। হোসেন ফকিরের গায়ে হাত তোলার পরিণতি কি হতে পারে এরা কি আন্দাজ করতে পারছে? আনোয়ারের বিবেচনাবোধে তার আস্থা একটু বেশি, আনোয়ার, এতো তাড়াতাড়ি ধৈর্যচ্যুতি ঘটা কি ভালো?
কি করবে বলেন? নিরীহ বুড়ো মানুষটাকে মেরে ফেললো, ধৈর্য থাকে কি করে! ভাইজান, আপনের সাথে আলিবক্স ভায়ের কথাবার্তা তো হয়াই গেছে। করমালি সামনে এসে বলে, ‘আপনে থাকলে হামরা হিরদয়ে বল পাই।’ আনোয়ার দেখছিলো, এতো সিরিয়াস ১টা সিদ্ধান্ত নেওয়া হলো, তাকে ১ বার কেউ জিগ্যেসও করলো না। এই সিদ্ধান্ত নেওয়ার ব্যাপারে তার কোনো ভূমিকাই নাই। সুতরাং এর পরিণতিতেও তার দায়িত্ব থাকার কথা নয়। দায়িত্ব থেকে মুক্ত হওয়ার ফলে আনোয়ার লঘুভার হয় বটে, কিন্তু নিজের ভার কমে যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে তার পায়ের নিচের মাটিও ঝুরঝুর করে সরে পড়ে। করমালির অনুরোধে দাঁড়াবার জায়গাটি ফের জমে শক্ত হয়।
বান্দু শেখ এসে বলে, ‘ভাইজান, আপনেক যাওয়াই লাগবো।
গেলে তাড়াতাড়ি চলো। তোমার তৈরি হয়ে নাও! রাত হচ্ছে কিন্তু। আনোয়ার শুনতে পাচ্ছে যে হোসেন আলি ফকির ও তার সাঙ্গপাঙ্গদের মেরে পচার বাপের মৃতদেহ ছিনিয়ে আনার সমবেত সংকল্প ঘোষণার চিৎকার বটগাছের শিশির-ভেজ পাতায় সপসপ এবং নিচের শুকনা পাতায় সরসর সাড়া তুলছে। চাদের অল্প আলোয় দ্যাখা যায় যে গোটা বটগাছ তার ডালপালা, পাতার বহর, ঝুড়ি, থাম, শিকড় ও ছাদ নিয়ে তিরতির করে কাপছে। আর ঐ জীন? না, বটগাছের পুরনো বাসিন্দার কোনো সাড়া নাই, মানুষের সমবেত আওয়াজে টিকতে না পেরে সে শালা নতুন করে উড়াল দিয়েছে অন্য কোথাও। মাটিতে বসে থেকেও আনোয়ারের পা কাপে। এটা আর কতোক্ষণ? সকলের সঙ্গে একবার রওয়ানা হলে পায়ের কাপন, বুকের কাপন কোথায় যাবে! এরকম সরাসরি অংশগ্রহণের সুযোগ জীবনে কবার আসে? এইতো, রাত থাকতে থাকতে ৫০/৬০ জন মানুষের সঙ্গে সে রওয়ানা হবে চালুয়াবাড়ি। পচার বাপের হত্যাকারীদের খতম করে যমুনা পার হয়ে ধারাবর্ষা। হোসেন আলিকে ধরে নিয়ে সোজা ডাকাত-মারা চর। বাথানের সব গোরু খুলে দাও, খতম করো হোসেন আলি ফকিরকে!—মনে পড়ে?—একবার নিজের কিষানকে খুঁটির সঙ্গে বেঁধে পুড়িয়ে মেরেছিলি, মনে আছে?—এইবার বুঝবি মানুষের হাতে মরতে কেমন লাগে। ধারাবর্ষা থেকে ফিরে এসে ধরে খয়রার গাজীকে। ব্যাটা এখান থেকে কলকাঠি নাড়ো, মানুষের গোরু চুরি করে তার কাছ থেকেই আদায় করো। কারো জমিতে তারা বর্গ করতে না পারে সেই ফন্দি আঁটে? সবাই এসে তোমার পায়ে পড়ুক, তুমি ইচ্ছামতো মানুষের ভিটাটুকু পর্যন্ত কজা করে তাকে তোমার গোলাম বানাও।-এইবার? এইতো ভেতর থেকে ভাঙতে শুরু করেছে, ওপরটা আপনাআপনি ধসে পড়তে আর কতোক্ষণ?
‘না, আনোয়ারের যায়া কাম নাই।’ জালালউদিনের অভিভাবকসুলভ নির্দেশে আনোয়ার এমন ঠাণ্ডা চোখে তার দিকে তাকায় যে, লোকটা এই আবছা আলোতেও তার তীব্রতা আঁচ করে মুখ ফেরায়। আরো ঠাণ্ডা বাক্যে আনোয়ার তার সিদ্ধান্ত জানায়, ‘আমি তো যাবোই। চেংটু বলে, ‘ভাইজান আপনের যাওয়া হবে না। গোলমাল তো ভালোমতোই হবো, কার বাশের ডাং যে কার উপরে পড়বো দিশা পাওয়া যাবো না। ঘাটাও আপনে ভালো করা চেনেন না !’
চেংটুর ওপর সরাসরি রাগ করা যায় না। আনোয়ারের মনটা খুব খারাপ হয়ে যায়। আমি কি বাচ্চা ছেলে? না একটা গাধা যে গোলমাল হলে সামলাতে পারবো না? পথঘাট চিনতে পারবো না কেন? আনোয়ারের উত্তেজনা চাপা থাকে না, তোমাদের বুকে সাহস আছে, আর আমার বুক হলো হাড্‌ডিমাংসের পিণ্ড?
না না ভাইজান হামি সেই কথা কই নাই। আপনে গেলে আপনাক মানা করে কেটা? আপনে থাকলে হামরা থাকমু আপনার পাছে। আপনে যা করেন, যা হুকুম করবেন, উরুজোগার দিয়া হামরা তাই করমু!’
আনোয়ার বড়ো কাচুমাচু হয়। ছি, ছি সে কি নেতৃত্বের জন্য হন্যে হয়ে উঠেছে? চেষ্ট্র তাকে ভাবলো কি? সে যা বলবে এরা তাই করবে—সে এরকম চাইবে কেন? এ পর্যন্ত এদের কোনো নির্দেশই তো সে দেয়নি। সে শুধু ওদের সঙ্গে থাকবে, সহকর্মী হয়ে তাদের কাজে অংশ নেবে। এতে চেংটু আপত্তি করে কেন?
চেন্টু তার হাত ধরে একরকম হিড়হিড় করে টেনে নিয়ে যায় করমালির ঘরের সামনে গোরুর জাবনা খাওয়ার গামলার পাশে। মোলায়েম ও নিচু গলায় সে মিনতি করে, আপনে এটি থাকলে হামাগোরে একটা কাজ হয় ভাইজান আর কেউ ঐ কাম পারবো না। আলিবক্স ভাইও কয়া দিছে, আপনি ছাড়া আর কারো উপরে ঐ কামের ভার যেন না দেই!
তাকে তাহলে থাকতে হচ্ছে আলিবক্সের নির্দেশে?-আনোয়ারের বুক একটু সঙ্কুচিত হয়, সেখানে জানান দিয়ে যায় চিনচিন ব্যথা। এর চেয়ে চেংটুর নির্দেশ মানা অনেক সহজ। তবে এখানে তার ওপর অর্পিত দায়িত্বের কথা শুনে আনোয়ার আর কথা বলতে পারে না। কি?–না, সবাই চরের দিকে চলে গেলে আনোয়ার যেন খয়বার গাজীর ওপর চোখ রাখে। ওরা যে অনেক শক্তিশালী হয়ে ফিরে আসবে এ ব্যাপারে চেংটু নিঃসন্দেহ। এসে ধরা হবে খয়বার গাজীকে। এবার তার চূড়ান্ত বিচারের পালা। আনোয়ার লক্ষ্য রাখবে, খয়বার গাজী যেন গ্রাম ছেড়ে পালাতে না পারে। কিভাবে?–চেংটু ভয়ে ভয়ে হাসে, ধরেন আপনেও বড়োলোকের ঘরের ছেলে, তাইও বড়োলোক! চেংটুর কথাটা বুঝতে পারায় তাকে বড়োলোক বলা সত্ত্বেও আনোয়ার রাগ করে না। ২জনেই ভদরলোক বলে আনোয়ারের পক্ষে খয়বারের গতিবিধি অনুসরণ করা একটু সহজ। তার গতিবিধি সন্দেহজনক হলে আনোয়ার তাকে ফুসলে ফসলে, মিথ্যা কথা বলে, দরকার হলে নিজেদের বাড়িতে রেখে দেবে। খয়বার গাজীর বিচার করতে পারলে একটা কাজের মতো কাজ হয়। এর অনেকটা নির্ভর করছে আনোয়ারের ওপর।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *