1 of 2

চিলেকোঠার সেপাই – ০৭

চিলেকোঠার সেপাই – ০৭

খাওয়া শেষ করতে করতে ওসমান জিগ্যেস করে, খিজির তো এখানে অনেকদিন থেকে আছো, না?
সে তো বটেই। রহমতউল্লা মহাজনের বাড়ি, রিকশার গ্যারেজ, আলাউদিনের গ্যারেজ, এই বস্তি, কিছুদিন একনাগাড়ে রিকশা চালানো, আলাউদিনের গ্যারেজে ঢোকার পর রিকশার পর স্কুটার চালানো, রিকশা ও স্কুটারের যন্ত্রপাতি ঠিক করা, এই যে স্কু আর প্রায়ার আর নাট বন্টু, এই যে চেসিস আর ব্রেক আর টায়ার, এই যে এখানে স্কু বসানো, স্কুতে স্কু-ড্রাইভার ঘোরানো—এই তো চলছে কতোদিন থেকে। কতোদিন থেকে! কতোদিন থেকে কতোদিন থেকে!—খিজিরের মুণ্ডুটা তার গতরের ওপর একটা স্কুর মতো উল্টোদিকে খুলে যেতে থাকে।
খিজির সংক্ষেপে জবাব দেয়, বহুত দিন! আউজকার কেস?—ফালু মিস্ত্রীর সঙ্গে থাকতে থাকতেই খিজিরের মা মহাজনের ওখানে ঠিকা কাজের ব্যবস্থা করে নেয়। দুপুরবেলা এসে বাসন মেজে দিয়ে যেতো, ফালুমিস্ত্রির সায় ছিলো, তার মনিবের বৌ ব্যাপারটা ঠিক ধরতে পারেনি। খিজিরের মায়ের এই কাজ যোগাড় করে দেয় রহমতউল্লার বাড়ির বাধা মাতারি, এই মাতারির নিয়ে-আসা মৌলবির পানিপড়াতেই খিজিরের বিছানায়-পেচ্ছাব-করা বন্ধ হয়। বলতে গেলে রহমতউল্লার ভরসা পেয়েই খিজিরের মা ফালু মিস্ত্রীকে ছেড়ে চলে আসে। ফলে ঐ মাতারির চাকরিটা খোয়া গেলো। তখন থেকে তাদের খাওয়া-পরা, হাগা-মোতা সব এখানেই। মায়ে-পোয়ে সিঁড়ির নিচে গুটিমুটি হয়ে ঘুমাতো, তা হাত পা ছড়াবার অতো দরকারই বা কি? কিন্তু কোনো কোনো রাত্রে ঐটুকু জায়গা থেকে সে গড়িয়ে চলে আসতো বারান্দার দিকে। কখনো কখনো ঘুমের ভেতর কি নিমধুমে তার পায়ে কি হাতে খিজির অন্য কোনো শরীরের ছোঁয়া বুঝতে পেরেছে। ঘুমের ঘোরে একদিন সে মায়ের পিঠ ছুঁতে গিয়েছিলো। কিন্তু তার হাত ঠেকে মোটাসোটা ১টা পিঠে। আরেকদিন তার চিবুকে লেগে গিয়েছিলো শক্ত সমর্থ সেই হাত। ভয়ে সে ‘মা’ বলে ডেকে ওঠে। ঘুম ও জাগরণের মাঝামাঝি এই ডাক ঠিক স্পষ্ট হয়নি। বারান্দার দিকে সরে পাশ ফিরে জোড়াহাঁটুর মাঝখানে হাতজোড়া রেখে সে ঘুমিয়ে পড়েছিলো।
এর একদিন পর একবার আড়ালে ডেকে মা বলে, মাহাজনের রিকশার গ্রাজ আছে না? আছে না? আমি কতো গেছি! এই তো এই বাড়ির পাচিল পার হইলেই গ্রাজ! রহমতউল্লার রিকশার গ্যারেজের বর্ণনা দেওয়ার জন্য খিজিরের উৎসাহের আর শেষ নাই।
গ্রাজ বলে রাইতে খালি থাকে? নাঃ রাইতে তোতামিয়া থাকে। তোতায় কয় গ্রাজের মইদ্যে মাহাজনেরে কইয়া মিলাদ পড়াইতে হইবো। জিনে বহুত জ্বালায়!
ঐগুলি কোনো কথা না’, এবার খিজিরের মা আসল কথা পাড়ে, ‘তুই মাহাজনের গ্রাজের মইদ্যে থাকবি, রাইতে থাকবি। মাহাজনের অনেকগুলি গাড়ি, কেউরে বিশ্বাস করবার পারে না!’
এইবার খিজিরের একটু ভয় করে, একলা থাকুম? ‘একলা থাকবি ক্যালায়? তোতামিয়া আছে না? মায়ের এই কথাতেই খিজির চুপ করে যায়। পরপর কয়েকটা রাত্রি গ্যারেজে কাটলো, খিজির রান্নাঘরে এসে মায়ের সঙ্গে খেয়ে যায়, তেমন করে কথা বলে না। ছেলের সঙ্গে কথা বলতে খিজিরের মায়ের কেমন বাধো বাধো ঠেকে। একদিন বিবিসায়েবের চোখ এড়িয়ে সরিয়ে-রাখা মুরগির একটা রান ছেলের পাতে দিয়ে জিগ্যেস করে, রাইতে ডরাস?
‘না ডর কিয়ের? মুরগির রানে খিজিরের তখন অখণ্ড মনোযোগ। পারে তো হাড়ের গুড়ো সব গিলে ফেলে।
এসব কবেকার ঘটনা, কতোদিন আগে ঘটলো? দিন তারিখ খিজিরের মনে থাকে না, কিন্তু সেইসব ঘটনা দেখতে দেখতে তার লাল রেখা-উপরেখা কবলিত চোখজোড়া খচখচ করে। কিছুক্ষণের মধ্যেই মায়ের রক্তে-ভাসা শরীরের ছায়া পড়ায় চোখজোড়া লাল টকটকে হয়ে ওঠে। খিজিরের চোখেই যেন তার মায়ের সব রক্ত মোছা হয়ে যাচ্ছে।
মায়ের রক্তপাত ঘটেছিলো শেষরাত্রে। খুব ভোরবেলা, প্রায় রাত থাকতে থাকতেই বিবিসায়েবের তলব পেয়ে ঘুম-জড়ানো চোখে খিজির গ্যারেজ থেকে এসে দ্যাখে যে, তার মায়ের কাপড়চোপড় সব কালো রক্তে মাখা। সকাল ৮টার মধ্যেই মহাজন তার দাফনের সব ব্যবস্থা করে ফেলে। মহাজনের অনেক পয়সা বেরিয়ে গিয়েছিলো। মাকে ধোঁয়াবার জন্য নতুন একটা বাঙলা সাবান কেনা হয়। কতো কপূর, কতো আতর, গোলাপজল, আগরবাতি। তখন মহাজনের ঘরে বংশালের বিবি। মহাজনের প্রথম বৌ। দিনরাত নামাজ রোজা অজিফার মধ্যে থেকে বিবিসায়েবের বয়স বেড়ে গিয়েছিলো অনেক, এর ওপর ১৩/১৪ বছরের একমাত্র ছেলে আওলাদ হোসেন মারা যাওয়ার পর পরপর দুটো মরা বাচ্চা হলো, এরপর শুরু হয় তার ছোঁয়াছুয়ির বাতিক। দিনের মধ্যে ৩ বার ৪ বার গোসল করা, ২৫ বার অজু করা আর ৫০ বার হাতমুখ ধোঁয়া। ওদিকে মহাজনের দ্বিতীয় বিবি বেগমবাজারের খানদানি ঘরের আওরত,-সেও সতীনের ঘর করবে না। রহমতউল্লা তো বড়ো বৌয়ের কথা লুকিয়ে তাকে বিয়ে করেনি। তাহলে? অবশ্য এরকম একটা আভাস দিয়েছিলো যে, বড়ো বৌকে আলাদা বাড়িতে রাখবে। কিন্তু তাই কি হয়? ছেলেপুলে না-ই বা দিতে পারলো, সে হলো তার প্রথম স্ত্রী। তার বাপের পরামর্শ ও পয়সা দিয়েই রহমতউল্লা প্রথম রিকশা কেনে। এই বিয়ের পরই তার টাকা পয়সা আসতে শুরু করে, নামডাক হয়। বড়ো পয়মন্ত বিবি। তার ছোঁয়াছুয়ির বাতিক সহ্য না করে রহমতউল্লার উপায় কি? বড়ো বৌয়ের বাঁকা বাঁকা কথাতেও মহাজন কখনো রা করতো না। খিজিরের মাথাটা নিজের বুকে চেপে ধরে বড়ো বিবি বলে, ‘মায়ের লগে লগে থাকবার পারস নাই? তুই লগে থাকলে তর মায়ে এমুন কইরা তরে ছাইড়া যায় গিয়া? খিজিরের কিন্তু খুব অস্বস্তি ঠেকছিলো, বিবিসাবরে আউজকা না হউক ৫০ বার নাহাইতে হইবো! –কিন্তু ৫০ বার গোসল করুক আর ১০০ বার অজু করুক, সেদিন রাত্রে বিবিসায়েব নিজের ঘরের মেঝেতে শুতে দিয়েছিলো খিজিরকে। তার সামনেই বিবিসায়েব মহাজনকে বকে, হাবিয়া দোজখের মইদ্যেও তোমার জায়গা হইবো না আওলাদের বাপ! কি খাওইয়া দিছিলা, কও তো? তোমার আখেরাত নাই? গোর-আজাবের ডর নাই? মনে হয় পরকালে স্বামীর গতি নিয়ে বিবিসায়েব বড়ো উদ্বিগ্ন। বৌকে কাঁদতে দেখে রহমতউল্লা একটু বিব্রত হয়, ‘আরে আওলাদের মাও, তুমি এইগুলি কি কও? মইরা গেছে, কইতে নাই, আবার হাছা কথা না কইয়াও থাকতে পারি না, গলা নামিয়ে বলে, খারাপ মাইয়া মানুষ, কার লগে আকাম উকাম কইরা প্যাট বাধাইয়া বসছে, অহন প্যাট খসাইবার গেছিলো, গিয়া এই মুসিবত। খাড়াও না, চাকরবাকর, রিকশার ডেরাইভার উরাইভার ব্যাকটিরে আমি ধরুম!
থাউক। বিবিসায়েব চোখ মুছে বলে, পোলারে এইগুলি হুনাইয়া ফায়দা কি?
পোলায় কি ফেরেশতা? মায়ের কারবার পোলায় জানে না, না? এ্যাঁরে জিগাও তো, বাপের নাম কইবার পারবো? জিগাও না!
বিবিসায়েব জিগ্যেস করে না। মায়ের মৃত্যুর দোষে ও মায়ের মৃত্যুর শোকে খিজির এমনি নুয়ে পড়েছিলো, এর উপর বাপের নাম না জানার অপরাধ যোগ হওয়ায় সে একেবারে নেতিয়ে পড়ে। সে কি আজকের কথা? তবু দ্যাখো, জুরাইন গোরস্তানের কবরের ভেতর মাটিতে মাখামাখি কালো রক্তে ডুবসাঁতার দিতে দিতে ভুস করে ভেসে উঠে মা তার দিকে তাকায়। বেলাহাজ বেশরম মাগীটার শরম হায়া যুদিল এটু থাকো মওতের পরেও কি মানুষের খাসলত বদলায় না? —সেই কতোকাল আগে এসব কাণ্ড ঘটেছে, এর পর মহাজনের পয়লা বিবি এক শীতের রাতে আড়াই ঘণ্টা ধরে গোসল করে নিউমোনিয়ায় ভুগে মরে গেলো। এর মাস ছয়েক আগে থেকেই অবশ্য বেগমবাজারের খানদানি ঘরের আওরাত মেয়েকে নিয়ে মহাজনের ঘরে এসে জাকিয়ে বসেছে। তা পয়া এই বিবিরও কম নয় এর আমলে মহাজন নবদ্বীপ বসাক লেনে সরকারী পায়খানা ও পানির পাম্পের পেছনে মস্ত বড়ো বস্তির মালিক হলো। খিজিরের মা মাগী আজও সেই বস্তিতে খিজিরের ভাড়াটে ঘরে আসে ছিনালীপনা করতে। বললে লোকে বিশ্বাস করবে না, এখনো মাঝে মাঝে অনেক রাত্রে ঘুম ভেঙে গেলে নিমখুম নিমজাগরণে খিজির বুঝতে পারে যে, মোটাসোটা একটি হাত তাকে ঠেলে একপাশে সরিয়ে বুকে চাপ দিচ্ছে। মা—এই সম্বোধন করার জন্যে তার শ্লেষ্মা-জমা ও সিগ্রেটের ধোঁয়ায় কালি-মাখা গলায় ঝাপশা ধ্বনিপুঞ্জ জমা হয় এবং মাথার ওপরকার কেরোসিন টিনের ছাদকে তখন সে ধরে নেয় সিঁড়ির উল্টাপিঠ বলে। তবে এই হাল বেশিক্ষণ থাকে না। জুম্মনের মায়ের সশব্দে পাশ ফেরার আওয়াজে মা এবং অন্যজন হাওয়া হয়ে যায়। বাঁশের বেড়া ও ভাঙাচোরা টিনের ফাঁক দিয়ে রাস্তার ল্যাম্পোস্টের আলো এসে পড়ে জুম্মনের মায়ের মুখের বাদিকে। বৌয়ের গোলগাল কালো মুখে বসন্তের কয়েকটি দাগে লুকিয়ে থাকে ঘোলা আলো। খিজির তখন ঘর্ঘর-করা গলায় ‘মা’ বলে বৌকে জড়িয়ে ধরে।
আজ জুম্মনের মায়ের সঙ্গে থাকতে পারলে ছিনাল মায়ের দাপটটা সামলানো যায়। বেলা তিনটে সাড়ে তিনটের দিকে জুম্মনের মা রোজ একবার ঘরে আসে, প্রায় ঘণ্টাখানেক থাকে। আজ কি তার আসবার সময় হবে না? এখন মহাজনের বাড়ি গেলে হতো। তাহলে জুম্মনের মায়ের সঙ্গে কি একবার দ্যাখা হয়!
খিজির বোধহয় সিঁড়ির সবগুলো ধাপও নামে নি, এরই মধ্যে ওপর দিককার ধাপগুলোতে কোলাহল শোনা যায় এবং এক মিনিটের মধ্যে ওসমানের ঘরে ঢেকে রঞ্জু।
*আপনে না বাইরে গেলেন। কখন আসলেন? ‘যেতে পারলাম না। নিচে নামছি, খিজির এসে হাজির। এখন যাচ্ছি। রঞ্জুর পেছনে রানু ও ফরিদা। ওরাই কথা বলছিলো বেশি। ওসমানকে দেখে দুজনে হঠাৎ থামে। ওসমানকে একবার দেখেই রানু চোখ রাখে আরেকটা দরজা পেরিয়ে ছাদে, সেখানে ছাদভাসানো রোদ। ওসমান বলে, তোমরা ছবি তোলো। চমৎকার রোদ আছে।’
ফরিদার পেছনে কচি কচি মার্কা চেহারা লম্বা একটি তরুণ। তার খয়েরি রঙের চাপা প্যান্ট, চেন-খোলা জ্যাকেট, গলায় বেগুনী-হলুদ সিন্ধের স্পার্ক। তার ঘাড় থেকে ঝোলানো ক্যামেরা, সারা শরীর থেকে সেন্টে ঝাঁঝালো গন্ধ বেরুচ্ছে। ছোকরা ওসমানের দিকে হাত বাড়ায়, আশিকুর রহমান বাদল, পাকিস্তান টোবাকোতে সেলসে কাজ করি। করমর্দন করতে করতে ওসমান নিজের নাম বলে এবং শুধু রঞ্জুর কাছ থেকে বিদায় চায়, তাহলে চলি।
রঞ্জুর হঠাৎ কি মনে হয়, বলে, নানা যাবেন কেন। আপনেও থাকেন না! ওসমান ইতস্তত করে, সে থাকবে কেন? ইয়ং হাজব্যান্ডও আহবান জানায়, আপনি থাকেন না! মোস্ট ওয়েলকাম।
রঞ্জুর উৎসাহ এতে বাড়ে, আপনে থাকেন। দুলাভাই আমাদের ছবি তুলবে, কিন্তু দুলাভাইয়ের ছবি তুলবে কে?
কিন্তু ক্যামেরা জিনিসটা চালানো সম্বন্ধে ওসমানের কিছুমাত্র ধারণা নাই। সে তাড়াতাড়ি বলে, আমার একটু কাজ ছিলো।’
রঞ্জু বলে, ঈদের দিন আবার কাজ কিসের? ফরিদার দিকে তাকিয়ে রানু আস্তে করে বলে, তোরে দেইখা ভয় পাইছে। লালচে হয়ে যাওয়া মুখ সত্ত্বেও ফরিদা হাসে, ভয় টয় পাইলে তোরেই পাইতে পারে। আমরা উনার আর কি করতে পারি?
ফরিদার কথা সম্পূর্ণ করতে না দিয়ে রানু ওসমানকে অনুরোধ করে, আপনি থাকেন। এই দুইজনে একসঙ্গে ছবি তুলবে বইলাই তো আসছে। আসল তো এই দুইজন, আমরা ফাউ। আসল ছবি তুলবে কে? বলতে বলতে রানু হেসেই অস্থির।
ওসমান এবার কথায় বেশিরকম জোর দেয়, না, না। আমার একটা কাজ আছে।’ নিচে নামতে নামতে ওসমান ফের প্ররেমে পড়ে, এবার অন্যভাবে। এভাবে হুট করে চলে আসাটা ঠিক হলো না। রানুর শ্যামবর্ণ মুখের নীলচে ঠোঁটজোড়ার সব কৌতুক এতোক্ষণে নিশ্চয়ই নিভে গেছে। রঙুটাও মন খারাপ করবে। ক্যামেরা চালাতে না পারাটা কি অপমানজনক অযোগ্যতা? এ নিয়ে এতো জড়সড় হওয়ার কি আছে? শওকত সাইকেল চালাতে পারে না, কিন্তু তাই নিয়ে শওকত নিজেই কতো মজার মজার গল্প করে। অফিসের খলিলুর রহমান বেশ তোতলা, তা নিয়ে লোকটার সঙ্কোচ তো নাইই, বরং এই নিয়ে নিজেই কতো হাসিঠাট্টা করে! তো ওসমান এরকম পারে না কেন? —দাখো তো, রানুর এতো মিনতি ঠেলে সে চলে এলো। তালেব যেদিন মারা গেলো রঞ্জর ঠোঁট কি সেদিনকার মতো বেগুনি হয়ে গেছে? —আসলে এইসব ছবি তোলা, হৈ চৈ করা-কয়েক সপ্তাহ আগে নিহত ভাইয়ের শোক ভোলার জন্যেই তো এসবের আয়োজন। ঘরে তাদের মায়ের বিরতিহীন বিলাপ। বাপটা ঈদের নামাজ পড়ে এসে সেই যে বিছানায় শুয়েছে এখন পর্যন্ত করে সঙ্গে ভালো করে দুটো কথাও বলেনি। ফরিদা আজ স্বামীকে নিয়ে এসেছে কেন? বন্ধুর শোকটাকে কিছুক্ষণের জন্য হলেও একটু চাপা দিয়ে রাখার জন্যেই তো, তাই না? রানু তার সঙ্গ চেয়েছিলো, এখন সঙ্গ মানে বেদনার একটু ভাগ নেওয়া। তার ছোট্ট এই আবদারে ওসমান সাড়া দিতে পারলো না, ওসমানের এই প্রত্যাখ্যানে ভাইবোনের শোক ভুলে থাকার সমস্ত আয়োজনটাই পণ্ড হয়ে গেলো।—সিঁড়ির রেলিঙ ধরে ওসমান দাঁড়িয়ে থাকে। এখন যদি ও ছাদে যায় তো ওদের ছাইচাপা উৎসব আবার জ্বলে উঠতে পারে।
ঠাণ্ডা ও অন্ধকার সিঁড়িতে ওসমান বড়োজোর মিনিট তিনেক ছিলো। তিন মিনিট পরে রোদ-ভাসানো ছাদে উঠে ওর চোখে ধাঁধা লাগে, প্রথম কয়েক সেকেন্ড ভালো করে তাকাতেই পারে না। তারপর সব স্পষ্ট হলে দেখলে যে, এই কয়েক মিনিটে ওদের ছবি তোলার আয়োজন কী বিপুল পর্যায়ে উঠেছে ফরিদার বর ঐ ছোকরা এমন কায়দা করে ক্যামেরা ধরেছে যে, মনে হয়, ব্যাটা সত্যজিৎ রায় হবার জন্য স্টেজ রিহার্সেল দিচ্ছে। সত্যজিৎ রায়ের নাম জনিস নাকি ব্যাটা? দেখিস তো ওয়াহেদ মুরাদ-জেবা আর সুচন্দারাজ্জাকের ছবি ওসমানও অবশ্য এসবই দ্যাখে। তবে সত্যজিৎ রায়ের পথের পাঁচালি’ দেখেছে, টিকেট পায়নি বলে মহানগরী দ্যাখা হয়নি। ঐ ক্যামেরাম্যান শালা এসব ছবির নাম জানে? ওর পোজপাজে মেয়ে দুটো একেবারে মুগ্ধ। তারা একবার রেলিঙে হেলান দিয়ে দাঁড়ায়, একবার হাসতে হাসতে এ ওর গায়ে চলে পড়ে। এতো হাসির ছটা আর থামে না! ওসমানকে ফিরে আসতে দেখেও এদের হাসির কারণ কি থাকতে পারে? ওসমান এখন কি করবে? রঞ্জু বলে ডেকে ওদের দিকে এগিয়ে চলে। তার তো বলার কিছুই নাই। চুপচাপ আরেকটু এগুতেই রঞ্জু বলে, আরে দাঁড়ান দাঁড়ান, ক্যামেরার সামনে আইস পড়েন ক্যান? দ্যাখেন না বাদল ভাই ছবি তুলতাছে। ওসমানকে শেষ পর্যন্ত বলতে হয়, রঞ্জ, মনে করে দরজাটা বন্ধ করে দিও কিন্তু।
ক্যামেরার লেন্স বোধ হয় ফরিদা, রানু, রঞ্জ এমনকি ছাদের রেলিঙ পৰ্যন্ত শুষে নিচ্ছে। এখান থেকে রানুর প্রোফাইলটা দ্যাখা যায়। শ্যামবর্ণের গালে রোদের ঝাপটা লেগে চামড়ার ওপর পাথরের এফেক্ট দিচ্ছে। ওর ঠোঁটে রোদের চিকন একটি আভা। উত্তেজনা, লজ্জা ও খুশিতে রানুর ঠোঁটজোড়া কাপছে। কি রোদ! রোদ মনে হয় কাচের পার্টিশনের মতো ওদের সবাইকে ওসমানের স্পর্শের বাইরে রেখে দিয়েছে।
সিঁড়ি দিয়ে ওসমান এবার তাড়াতাড়ি নামে। সত্যজিৎ রায়ের ক্যারিকেচার এই ছোকরার ক্যামেরার কারদানিতে ওদের যে ভক্তি দ্যাখা যাচ্ছে তাতে ভয় হয় যে, যাবার সময় দরজা বন্ধ করার কথা খেয়াল থাকবে না। রঞ্জকে আরেকবার তালা লাগাবার কথা বলে গেলে ভালো হতো। এখন ওসমানের সাধ্য কি ঐ উৎসবে ঢোকে? তালা টালা না লাগিয়ে চলে গেলে ওসমানের ঘরে যদি চুরি হয় তো রঞ্জু ও রানু বেশ অপরাধী হয়ে থাকে। তখন তাদের ক্ষমা করার একটা সুযোগ হয় ওসমানের। কিন্তু ওসমানের ভাগ্যে কি সেই সুযোগ আসবে?

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *