কবি – ১১

কবি – ১১

জ্যোৎস্নার রহস্যময় শুভ্রতার মধ্যে দ্রুত চলন্ত কাশফুলটি যেন মিশিয়া মিলাইয়া গেল। নিতাই কিন্তু স্তব্ধ হইয়া জানালার ধারে দাঁড়াইয়াই রহিল। চোথে তাহার অর্থহীন দৃষ্টি, মনের চিন্তা অসম্বন্ধ অস্পষ্ট, বুকের মধ্যে শারীরিক অনুভূতিতে কেবল একটা গভীর উদ্বেগ! –সে যেন পাথর হইয়া গিয়াছে। এই বিপুল জ্যোৎস্নময়তার মধ্যে ঠাকুরঝি হারাইয়া যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে তাহার সবই যেন হারাইয়া গেল।
তাহার ভাব দেখিয়া মুখরা স্বৈরিণী অসুস্থ দেহেও উৎকণ্ঠিত হইয়া উঠিয়া বসিল।
জীবনের অভিজ্ঞতা তাহার যত জটিল, তত কুটিল। পথচারিণী নিম্নশ্রেণীর দেহব্যবসায়িনীর রাত্রির অভিজ্ঞতা! সে অভিজ্ঞতায় নিশাচর হিংস্ৰ জানোয়ারের মত মানুষই সংসারে ষোল আনার মধ্যে পনেরো আনা তিন পয়সা; সেই অভিজ্ঞতায় শঙ্কায় শঙ্কিত হইয়া বসন্ত উঠিয়া বসিল। সে ভাবিল, যে দলটি বাড়ীর দরজার গোড়ায় দাঁড়াইয়া জটলা করিতেছিল, তাহারাই বোধহয় দলপুষ্ট হইয়া নিঃশব্দ লোলুপতায় নখর দন্ত মেলিয়া বাড়ীর চারপাশ ঘেরিয়া ফেলিয়াছে। আক্রমণের চেষ্ট্র করিতেছে। উৎকণ্ঠিত হইয়া চাপ কণ্ঠে সে প্রশ্ন করিল—কি?
নিতাই, তবুও উত্তর দিল না। সে যেমন স্তব্ধ নিম্পদ হইয়া দাঁড়াইয়া ছিল, তেমনিই দাঁড়াইয়া রহিল। ঠাকুরঝির রাগ তো সে জানে! খানিকট গিয়াই সে দাঁড়ায়, পিছন ফিরিয়া তাকায়, ইঙ্গিতে বলে—আমায় ডাক, ডাকিলেই ফিরিব। আজ আর কিন্তু দাঁড়াইল না, চলিয়া গেল; এই রাত্রে একাই সে চলিয়া গেল। মধ্যরাত্রির নিস্তরঙ্গ স্তব্ধ জ্যোৎস্নার মধ্যেও একটা ভয় আছে। সে ভয় সে করিল না।
বসন্ত এবার উঠিয়া আসিয়া নিতাইয়ের পাশে দাঁড়াইল, জ্বরোত্তপ্ত হাতে নিতাইয়ের হাত ধরিয়া প্রশ্ন করিল–কই?
এতক্ষণে সচকিত হইয়া নিতাই ফিরিয়া চাহিল। রূপে গুণে ক্ষুরধার স্বৈরিণীর কৃশ মুখে, ডাগর দীপ্ত চোখে অপরিমেয় ক্লান্তি–গভীর উৎকণ্ঠা। নিতাই সে মুখের দিকে চাহিয়া স্নেহকোমল না হইয়া পারিল না। সস্নেহে হাসিয়া সে বসন্তর কপালে মাথায় হাত বুলাইয়া বলিল—এত জ্বর, তুমি উঠে এলে কেনে? চল শোবে চল। উঃ! ধান দিলে যেন খই হবে, এত তাপ!
–নচ্ছারগুলো ঘুরছে চারিদিকে? ছুরি ছোরা নিয়ে জুটেছে?
–নচ্ছারগুলো! নিতাই সবিস্ময়ে প্রশ্ন করিল। বসন্তর ভাবনার পথে যাহারা বিচরণ করিতেছিল, তাহদের সে কল্পনা করিতেই পারিল না।
এবার বসন্তর ভ্রু কুঞ্চিত হইয়া উঠিল—থাপ হইতে ক্ষুরের ধার উঁকি মারিল, সে প্রশ্ন করিল—তবে? কি? কে গেল? কি দেখছ তুমি?
চকিতেই নিতাই এবার বসন্তর কল্পনার কথা বুঝিল, হাসিয়া সে বলিল—না, তারা নয়। ভয় নাই তোমার। এস, শোবে এস। সে তাহাকে আকর্ষণ করিল।
—কে যে গেল! কাকে দেখছিলে? কে উঁকি মেরে গেল?
—কে চিনতে পারলাম না।
—চিনতে পারলে না?
–না।
—তবে এমন ক’রে দাঁড়িয়ে আছ যে? যেন কত সর্বনাশ হয়ে গিয়েছে তোমার?
বসন্তর শাণিত দৃষ্টি অন্ধকারের মধ্যেও যেন জ্বলিতেছিল।
নিতাই কোন উত্তর দিল না, শুষ্ক হাসিমুখে সে বসন্তর দিকে চাহিয়াই রহিল।
বসন্ত অকস্মাৎ খিলখিল করিয়া হাসিয়া উঠিল—তীক্ষ্ণ দ্রুত হাসি। হাসিয়া বলিল-আ মরণ আমার! চোখের মাথা খাই আমি! যে উঁকি মারলে তার মাথায় যে ঘোমটা ছিল! ও—! আমাকে দেখে—
আবার সেই খিলখিল হাসি।
নিতাইয়ের পা হইতে মাথা পর্যন্ত ঝিমঝিম করিয়া উঠিল। বসন্ত হাসিতে হাসিতে ঘরের খিল খুলিয়া বাহির হইয়া গেল।
নিতাই ডাকিল—বসন! ও ভাই! বসন!
দুয়ারের বাহির হইতে উত্তর আসিল—বসন নয় হে, কেয়াফুল, কেয়াফুল! টেনো না, করাত-কাঁটার ধারে সর্বাঙ্গে ছ’ড়ে-ছিঁড়ে যাবে!
নিতাই তবুও বাহিরে আসিল।
স্বৈরিণী তখন কাসেদ সেখের ছেলে নয়ানের সঙ্গে কথা বলিতেছে।
এ অবস্থায় নিতাই ডাকিতে গিয়াও পারিল না, লজ্জাবোধ হইল। আপনার দ্বারটিতেই সে স্তব্ধ হইয়া দাঁড়াইয়া রহিল। ওদিকে স্টেশনের ধারে ঝুমুরের আসরে গান হইতেছে।
আলোর ছটা গাছের ফাঁকে ফাঁকে আসিয়া এখানে ওখানে পড়িয়াছে। এদিকটা প্রায় জনহীন স্তব্ধ, পশ্চিম আকাশে চাঁদ অস্তে চলিয়াছে, পূর্বদিকের আকাশে অন্ধকার ঘন হইয়া উঠতেছে। স্বৈরিণী মেয়েটার কিন্তু কোন লজ্জা নাই; খিলখিল হাসির মধ্যে কথা শেষ করিয়া—ঘন অন্ধকারে কাসেদের ছেলে নয়ানের সঙ্গে ওই পূর্বদিকের গভীরতর অন্ধকারের মধ্যে অদৃশ্য হইয়া গেল। নিতাই আকাশের দিকে তাকাইয়া একা দাঁড়াইয়া রহিল। থাকিতে থাকিতে আবার তাহার মনে নূতন গান গুনগুন করিয়া উঠিল। ভগবান মানুষের মন লইয়া কি মজার খেলাই না খেলেন! এক ঘটে, মানুষ র্তাহার ছলনায় অন্য দেখে। ঠাকুরঝি বসন্তকে দেখিয়া চলিয়া গেল, বসন্ত ঠাকুরঝিকে দেখিয়া চলিয়া গেল। সে গুনগুন করিয়া তাই লইয়াহ গান বাঁধিতে বসিল –

“বঙ্কিমবিহারী হরি বাঁকা তোমার মন!”

ঘটনার মধ্যে সে যেন নিয়তির খেলা বা দৈবের অদ্ভুত পরিহাস দেখিতে পাইয়াছে আজ। ঠিক তাহার অচ্ছ্বৎ জন্মের মতই এ পরিহাস নিষ্ঠুর। সে তাই গানের মধ্যে হরিকে স্মরণ না করিয়া পারিল না।

ভোরবেলাতে রাজার হাক-ডাকে নিতাইয়ের ঘুম ভাঙিয়া গেল। সে ঘরে আসিয়া গান বাঁধিতে বাঁধিতে ঘুমাইয়া পড়িয়াছিল। চেতনা হইবামাত্র সেই অসমাপ্ত গানের কলিটাই প্রথমে গুঞ্জন করিয়া উঠিল তাহার মনে—

”বঙ্কিমবিহারী হরি বাঁকা তোমার মন,
কুটিল কৌতুকে তুমি হয়কে কর নয়—অঘটন কর সংঘটন।”

রাজা হাঁকডাক শুরু করিয়াছে। সে হাঁকডাকের উচ্ছ্বাসটা যেন অতিরিক্ত। নিতাইয়ের মনে হইল হয়তো নূতন কোন অভিনন্দন লইয়া রাজন তাহার দুয়ারে আসিয়াছে—ধৈর্য তাহার আর ধরিতেছে না। স্বভাবসিদ্ধ মৃদু হাসিমুখে সে আসিয়া দরজা খুলিয়া দিল। বাহিরে দাঁড়াইয়া রাজা—তাহার পিছনে ঝুমুরের দলের প্রৌঢ়া। রাজা সটান ঘরের ভিতরে আসিয়া চারিদিকে দৃষ্টি ফিরাইয়া সকৌতুকে কাহাকে যেন খুঁজিতে আরম্ভ করিল।
নিতাই সবিস্ময়ে প্রশ্ন করিল—কি?
—কাঁহা? কাঁহা হ্যায় ওস্তাদিন?
—ওস্তাদিন?
হা-হা করিয়া হাসিয়া রাজা বলিল—সব ফাঁস হো গয়া ওস্তাদ, সব ফাস হো গয়া। কাল রাতমে—সে হা-হা করিয়াই সারা হইল। কথা আর শেষ করিতে পারিল না।
নিতাই তবুও কথাটা বুঝিতে পারিল না। বুঝাইয়া দিল প্রৌঢ়া। সে এতক্ষণ দুয়ারের বাহিরে দাঁড়াইয়া ছিল, এবার ঘরের মধ্যে ঢুকিয়া হাসিয়া বলিল—আ মরণ! ও বসন্ত! বেরিয়ে আয় না লো, এই ট্রেনেই যাব যে আমরা!
নিতাই বলিয়—সে তো এখানে নাই!
–নাই! সে কি? সে আসর থেকে বেরিয়ে এল, তুমি এলে সঙ্গে সঙ্গে। আমি বলেও দিলাম তোমাকে। তারপর আমি খোঁজও করলাম; শুনলাম, তোমার ঘরেই—
নিতাই বলিল—হ্যাঁ, কজন লোক বিরক্ত করছিল ব’লে আমার ঘরেই এসেছিল। আমি এসে দেখলাম শুয়ে আছে, গায়ে অনেকটা জ্বর। কিন্তু খানিক পরেই বেরিয়ে সেই লোকের সঙ্গেই চলে গেল।
প্রৌঢ়া চিন্তিত হইয়া উঠিল; রাজার কৌতুক-হাস্য স্তব্ধ হইয়া গেল!
নিতাই বলিল—কাসেদ সেখের ছেলে নয়ানের সঙ্গে গিয়েছে। ওই বোঁপ মত বটগাছটার তলাতেই যেন কথা কইছিল। আসুন দেখি।
তাহারা আগাইয়া গেল।
সেখানেই তাহাকে পাওয়া গেল। সে হতচেতনের মত অসম্বৃত দেহে পড়িয়া ছিল।
বিপুলপরিধি ছায়ানিবিড় বটগাছটির তলদেশটা ছায়ান্ধকারের জন্য তৃণহীন পরিষ্কার; সেইখানেই মাটির উপর বসন্ত তখনও গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন হইয়া পড়িয়া আছে। কেশের রাশ বিস্রস্ত অসম্বৃত, সর্বাঙ্গ ধূলায় ধূসর, মুখের কাছে কতকগুলো মাছি ভন ভন করিয়া উড়িতেছে; পাশেই পড়িয়া আছে একটা খালি বোতল, একটা উচ্ছিষ্ট পাতা। কাছে যাইতেই দেশী মদের তীব্র গন্ধ সকলের নাকে আসিয়া ঢুকিল।
প্রৌঢ়া বলিল—মরণ! এই করেই মরবে হারামজাদী! বসনা, ও বসন! রাজা হাসিয়া বলিল—বহুত মাতোয়ারা হেগেয়া। নিতাই দ্রুত সেখান. হইতে চলিয়া গেল। কিছুক্ষণ পরেই ফিরিয়া আসিল এক কাপ ধূমায়মান চা হাতে লইয়া। দুধ না দিয়া কাঁচা চা, তাহাতে একটু লেবুর রস। কাঁচা চায়ে নাকি মদেয় নেশা ছাড়ে। মহাদেব কবিয়ালকে সে কাঁচা চা খাইতে দেখিয়াছে। বসন্ত তখন উঠিয়া বসিয়াও ঢুলিতেছে অথবা টলিতেছে। প্রৌঢ়া বলিতেছে—এ আমি কি করি বল দেখি?
—এই চা-টা খাইয়ে দিন, এখুনি ছেড়ে যাবে নেশা।

চা খাইয়া সত্যই বসন্ত খানিকট সুস্থ হইল। এতক্ষণে সে রাঙা ডাগর চোখ মেলিয়া চাহিল নিতাইয়ের দিকে।
প্রৌঢ়া তাড়া দিয়া বলিল—চল এইবার।
নিতাই বলিল—চান করিয়ে দিলে ভাল করতেন। সোরও হত, আর সর্বাঙ্গে ধুলো লেগেছে—
তাহার কথা ঢাকা পড়িয়া গেল বসন্তর মত্ত কণ্ঠের খিলখিল হাসিতে। সে টলিতে টলিতে উঠিয়া দাঁড়াইল, নিতাইয়ের সম্মুখে আসিয়া জড়িত-কণ্ঠে বলিল—মুছিয়ে দাও না নাগর, দেখি কেমন দরদ!
নিতাই তাহার মুখের দিকে চাহিয়া একটু হাসিল—হাসিয়া কাঁধের গামছাখানি লইয়া সযত্নে বসন্তর সর্বাঙ্গের ধূলা মুছাইয়া দিয়া বলিল—আচ্ছা, নমস্কার তা হ’লে।
প্রৌঢ়া তাহাকে ডাকিল—বাবা!
নিতাই ফিরিল।
—আমার কথাটার কি করলে বাবা? দলে আসবার কথা?
নিতাই কিছু বলিবার পূর্বেই নেশায় বিভোর মেয়েটা আবার আরম্ভ করিয়া দিল সেই হাসি। সে হাসি তাহার যেন আর থামিবে না।
বিরক্ত হইয় প্রৌঢ়া বলিল—মরণ! কালামুখে এমন সর্বনেশে হাসি কেনে? বুক ফেটে মরবি যে!
সেই হাসির মধ্যেই বসন্ত কোনরূপে বলিল—ওলো মাসী লো—কয়লা-মাণিকেরও মনের মানুষ আছে লো! কাল রাতে—হি-হি-হি—হি-হি-হি—হি-হি-হি— .
রাজা এবার অত্যন্ত বিরক্ত হইয়া মেয়েটাকে একটা ধমক দিয়া উঠিল—কেঁও এইসা ফ্যাক্‌ ফ্যাক্ করতা হ্যায়?
বসন্তর চোখ দুইটা জলিয়া উঠিল। কিন্তু পরক্ষণেই সে আবার হাসিতে আরম্ভ করিল— হি-হি-হি—হি-হি-হি—
ওদিকে স্টেশনে ট্রেনের ঘণ্টা পড়িল; স্টেশন-মাস্টার নিজে ঘণ্টা দিতে দিতে হাঁকিতেছিল—রাজা! এই রাজা!
রাজা ছুটিল, নতুবা একটা অঘটন ঘটা অসম্ভব ছিল না। নিতাই হাসিয়া বলিল—আচ্ছা, আসুন তা হ’লে। সঙ্গে সঙ্গে সেও আপনার বাসার দিকে ফিরিল।
প্রৌঢ়া এবার কঠিন-স্বরে বলিল—বসন! আসবি, না এইখানে মাতলামি করবি?
বসন্ত ক্লাস্তিতে শিথিল পদে চলিতে আরম্ভ করিল, কিন্তু হাসি তাহার তখনও থামে নাই। সহসা ফিরিয়া দাঁড়াইয়া হাত নাড়িয়া ইশারা করিয়া সে চীৎকার করিয়া বলিল— চললাম হে!

* * *

নিতাই আসিয়া বসিল কৃষ্ণচূড়া গাছটির তলায়। ওদিকে ট্রেনটা ছাড়িয়াছে। ট্রেনটা স্টেশন হইতে ছাড়িয়া সশব্দে সম্মুখ দিয়া পার হইয়া যাইতেছিল। কামরার পর কামরা। একটা কামরায় ঝুমুরের দলটাকে দেখা গেল। বসন্ত মেয়েটি একধারে দরজার পাশেই জানালায় মাথা রাখিয়া যেন একেবারে এলাইয়া পড়িয়ছে।
অদ্ভুত মেয়ে! নিতাই হাসিল। ঝুমুর সে অনেক দেখিয়াছে! কবিগান করিতে ইহাদের সঙ্গে মেলা-মেশাও অনেক করিয়াছে, কিন্তু এমন নিষ্ঠুর ব্যবসায়িনী ক্ষুরধার মেয়ে সে দেখে নাই। ক্ষুরধার নয়, জলন্ত। মেয়েটা যেন জ্বলিতেছে। তবে মেয়েটার গুণ আছে, রূপও আছে। আশ্চর্য মেয়ে! গত রাত্রের গানটা তাহার গানটা তাহার মনে পড়িয়া গেল—

“করিল কে ভুল—হায় রে!
মন-মাতানো বাসে ভরে দিয়ে বুক
করাত-কাঁটার ধারে ঘেরা কেয়াফুল।
করিল কে ভুল! হায়রে!”

ট্রেনট চলিয়া গেল। নিতাই বসিয়াই রহিল। চাহিয়া রহিল রেল-লাইনের বাঁকে যেখানে সমান্তরাল লাইন দুইটি এক বিন্দুতে মিশিয়া গিয়াছে বলিয়া মনে হয় সেইখানের দিকে। বসন্ত তো চলিয়া গেল, আর হয়তো কখনও দেখাই হইবে না। অদ্ভূত মেয়ে! ক্ষণে ক্ষণে মেয়েটার এক একটি রূপ, এক রাত্রে উহাকে লইয়াই তিন-তিনখান গান মনে আসিয়াছে। সে খানিকট উদাস হইয়া রহিল। অকস্মাৎ কোথা হইতে একটা সচেতনতা আসিয়া তাহাকে নাড়া দিল। ওইখানেই বাঁকের ওই বিন্দুটিতে এক সময় একটি স্বর্ণবিন্দু ঝকমক করিয়া উঠিবে, তাহার পর দেখা যাইবে—ও স্বর্ণবিন্দুটির নীচে চলন্ত একটি কাশফুল। স্বর্ণবিন্দু বিচ্ছুরিত জ্যোতিরেখাটির মধ্যে মধ্যে এক একটি চকিত চমকে চোখে লাগিয়া চোখ ধাধিয়া দিবে। অসমাপ্ত গানগুলি তাহার অসমাপ্তই রহিল, পথের উপর স্থিরদৃষ্টি পাতিয়া নিতাই যেন প্রত্যাশা-বিভোর হইয়া বসিয়া রহিল।
ঠাকুরঝি কখন আসিবে? কই, ঠাকুরঝি আসিতেছে কই?
ওই কি? না, ও তো নয়! নিতান্তই চোখের ভ্রম। মনের প্রত্যাশিত কল্পনা–এই দিকের আলোর মধ্যেও মরুভূমির মরীচিকার মত মধ্যে মধ্যে স্পষ্ট হইয়া ফুটিয়া উঠিতেছে। এমনি দেখা যায়, আবার মিলাইয়া যায়। নিতাই হাসিল। এই তো বেলা সবে দশটা। ঠাকুরঝি আসে ঘড়ির কাঁটাটির মত বারোটার ট্রেনটির ঠিক আগে।
তবু সে উঠিয়া গেল না। গাছের গুঁড়িতে ঠেস দিয়া ঘুমাইতে চেষ্টা করিল। ঘণ্টাগুলো আজ যেন যাইতেই চাহিতেছে না।
ওই! হ্যাঁ, ওই আসিতেছে। চলন্ত সাদা একটি রেখার মাথায় স্বর্ণাভ একটি বিন্দু। কিন্তু না, ও তো নয়, রেখাটির গতি-ভঙ্গি তো তেমন দ্রুত নয়, রেখাটিও তেমন সরল দীঘল নয়!
ওই আর একটি রেখা, এও নয়।
নিতাইয়ের ভুল হয় নাই। রেখাগুলি নিকটবর্তী হইলে সেগুলি নারীমূর্তি হইয়াই উঠিল, মাথায় তাহদের ঘটিও ছিল। তাহারাও এ গ্রামে দুধ লইয়া আসে। কিন্তু তাহদের মধ্যে কেহই ঠাকুরঝি নয়। একে একে তাহারা সকলেই গেল। কিন্তু ঠাকুরঝি কই? কই?
বেলা বারোটার ট্রেন চলিয়া গেল। রাজা আসিয়া ডাকিল—ওস্তাদ!
সচকিত হষ্টয়া নিতাই হাসিয়া বলিল—রাজন!
—কেয়া ধ্যান করত ভাই, হিঁয়া বইঠ্‌কে? নয়া কুছ গীত বানায়া—?
—না তো—। অপ্রস্তুতের মত নিতাই শুধু খানিকটা হাসিল।
—তুমার উপর হাম গোসা করেগা।
—কেন রাজন, কেন? কি অপরাধ করলাম ভাই?
—ওহি ঝুমুরওয়ালী বোলা তুমারা দিলকে আদমী, মনকে মানুষ—
নিতাই হা-হা করিয়া হাসিয়া উঠিল। তারপর রাজার হাত ধরিয়া টানিয়া বলিল—চল, চা খেয়ে আসি। চা খাওয়া হয় নাই, ঠাকুরঝি আজ আসে নাই দুধ নিয়ে। ঝুমুরওয়ালীর কথায় তুমি বিশ্বাস করেছ? হ্যাঁ রাজন—আছে আমার মনের মানুষ। আমার মনের মানুষ তুমি রাজন, তুমি।
—হাম? রাজা বিকট হাসিতে স্থানটি উচ্চকিত করিয়া দিল। সে তাহাকে জড়াইয়া ধরিয়া বলিল—চুমু খাগা ওস্তাদ? আবার সেই বিকট হাসি। সে হাসির প্রতিধ্বনিতে আকাশ হাসিতে লাগিল, বাতাস হাসিতে লাগিল।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *